#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১
সকালবেলা বেলার ঘুম ভাঙলো বেশ দেরি করে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে আশেপাশে তাকালো পিট পিট করে। তারপর চৌকি থেকে নেমে পাশের ঘরে গিয়ে দেখলো শাইনি উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর চুল সব কপালের ওপর এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। ঘড়িতে বেলা বারোটা। এত বেলা হয়ে গিয়েছে আর শাইনি এখনো ওঠেনি? জ্বর কী বেশি নাকি? হ্যাঁ, অসুস্থই তো। ঘুমের কারণে হয়তো সকাল সকাল ওঠতে পারেনি, আর এজন্যই বেলাকে ডাকেনি। অন্যদিন ভোরে ওঠেই সূর্যোদয় উপভোগ করার জন্য বেলাকে ডেকে তুলতো। আর ও আরামের ঘুম ভেঙ্গে শাইনির সাথে ঢুলুঢুলু পায়ে হেঁটে বাঁশের মাচায় বসতো। ভোরের লালিমা মাখা আকাশ, আর মেঘ ভেদ করে কোমল সোনালী রোদ ধীরেধীরে মাথা তুলে জাগতো। সোনা রোদের কিরণ ছড়িতে দিতো সবুজ গাছগাছালির পাতায় পাতায়, দূর পাহাড়ে অবস্থিত বৌদ্ধ মন্দিরটায়। তারপর ছোট্ট পাহাড়ি ঝর্ণায় হাতমুখ ধুয়ে স্টোভে সকালের খাবার তৈরি করে নিতো। খাবার খেয়ে বেলা প্রতিদিন একবার করে পরিবারের লোকজনদের খোঁজখবর নিতো ওর কাছ থেকে। শাইনি অবশ্য বেলার এই কথাটা রেখেছে। তারপর বেলাকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ে, আদিবাসীদের গ্রামে ঘুরে বেড়াতো। সুন্দর সময় কাটতো ওদের। কিন্তু কাল রাতে হুট করে শাইনির অসুস্থতার খবরটা শুনে বেলা
নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। খুব খারাপ ব্যবহার করেছে ওর সাথে। আসলে ও ঠিক মানতে পারছেনা সবটা। রাতের ব্যাপারটা মনে পড়তেই বেলার মনটা হুট করেই খারাপ হয়ে গেলো। শাইনিকে এতো কথা শোনানোর মানেই নেই। লোকটা কোনোকিছুর ধার ধারে নাকি! নিজে নিজেই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। বেলা ওকে না মানলে কিছুতেই ও নিজের চিকিৎসা করবেনা, আর না পরিবারের কাছে ফিরে যাবে।
বেলা দরজা পেরিয়ে শাইনির বিছানার কাছে চলে এলো। ও মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এখন দেখা যাক, কতটা কী করতে পারে! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁপা কাঁপা হাতে শাইনির কপাল ছুঁলো। এখনও বেশ গরম আছে। জ্বরের তীব্রতা কমতেই চাইছেনা। এদিকে ঘামে ভিজে গেছে বলে রাতে ঘুমানোর সময় শাইনি ওর পোশাক খুলে ফেলেছিল। তাই বেলার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। লোকটাকে জলপট্টি দেওয়া দরকার। আস্তে করে ডাকলো সে,
‘শুনছেন আপনি? এই যে? দুপুর হয়ে গিয়েছে তো! এই সময় ঘুমাতে নেই।’
শাইনির কানে পৌঁছালো কথাটা। অদ্ভুত আওয়াজ করে চোখ খোলার বৃথা চেষ্টা করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো৷ অস্ফুটস্বরে বলল, ‘ত ত তুমিও ঘুঘুমাওওও!’
‘বেলা বারোটা বাজে, আপনি আমায় ঘুমাতে বলছেন। আশ্চর্য!’
‘না ঘুমালে আমায় ডিস্টার্ব করোনা।’
‘আপনার জ্বর তো একফোঁটাও কমেনি। মাথায় পানি দিবেন?’
শাইনি বলল, ‘না।’
বেলা বিরক্ত চোখে ওকে দেখলো। মানে কোন ধাতু দিয়ে এই লোক গঠিত? এরকম বেয়াদব লোকদের লাথি মেরে পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়া উচিৎ। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে অথচ সে মাথায় পানি দিবেনা। বেলাও কম যায় না। ও পাশের ঘর থেকে একটা বোলে করে পানি নিয়ে এলো। শাইনি নড়লো না ওর জায়গা থেকে। যেন দুনিয়া ভেসে গেলেও ওর কিছু যায় আসে না, কিন্তু ঘুমাতেই হবে। বেলা জোর করে ওকে বিছানায় এক কোণে আনলো। লজ্জায় ওর হাত কাঁপছিলো। কিন্তু মানবিকতা বলে তো একটা ব্যাপার আছে নাকি! তার ওপর ওর স্বামী হয়। ভালোবাসা না হলেও একটা টান তো আছেই! বালিশটা যাতে ভিজে না যায় তার জন্য ওপরে একটা প্লাস্টিক বিছিয়ে শাইনিকে শুইয়ে দিলো। একদম অচেতনের মতো হয়ে আছে শাইনি, তবে মাঝে মাঝে বিরক্ত গলায় কথাও বলছে। বোঝাই যাচ্ছে,বেলার কাজকর্ম ওর পছন্দ হচ্ছেনা। মেয়েটা যেন বেশিই খেয়াল রাখার চেষ্টা করছে ওর। কাল রাত থেকেই এরকম খবরদারি করছে ওর ওপর! শাইনি চোখ বন্ধ, চাইলেও খুলতে পারছেনা। যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি ওর চোখে সুপার গ্লু লাগিয়ে দিয়েছে। শুধু অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘এতো সেবা করো না, মায়ায় পড়ে যাবে৷ পরে নিজেকে সামলাতে পারবেনা আমার মতো।’
বেলা ওর কথা শুনেও না শোনার ভান করলো। পাত্তা দিলো না। এখন ওর প্রধান কাজ মাথায় জলপট্টি দেওয়া৷ একটা লাল রঙের কাপড়ের টুকরো পানিতে ভিজিয়ে, নিংড়ে শাইনির কপালে রাখলো। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ জলপট্টি দেওয়ার পরেও জ্বর নামার পায়তারা করলো না। বেলা হতাশ হয়ে কি করা যায় ভাবতে লাগলো। যেই ভাবা সে-ই কাজ৷ তারপর বালিশে হেলান দিয়ে শাইনিকে উঠিয়ে বসালো। তখন ও চোখ খুলে তাকালো। বেলা ভেজা গামছা দিয়ে শাইনির পুরো শরীর মুছে দিলো। লজ্জায় কাঠ হয়ে যাচ্ছিলো সে। আর শাইনি মিটমিট করে হাসছিলো। বেলা চোখ গরম করে তাকাতেই বলল, ‘জ্বর এমনিই সেরে যাবে, বউয়ের হাতের যত্ন পেয়েছে বলে কথা।’
বেলা লজ্জা গোপন করে বলল, ‘চুপ করুন বেহায়া লোক। রাতের থাপ্পড়টা ভুলে গেলে আরো কয়েকটা দিবো উলটাপালটা কথা বললে।’
শাইনি বলল, ‘মৃতপ্রায় স্বামীকে এভাবে নির্যাতন করা মোটেও ভালো কাজ নয়। আল্লাহ পাপ দিবে।’
বেলা ওর মুখে চেপে ধরে বলল, ‘মুখ সেলাই করে দিব বেশি পটরপটর করলে।’
‘আচ্ছা আচ্ছা। আমি আর কিছুই বলবো না।’
বেলা গটগটিয়ে হেঁটে পাশের রুমে এলো। স্টোভে আগুন দিয়ে গরম পানি ফুটালো, ডিম ভাজলো, আর নুডুলস রান্না করলো। শাইনির জন্য চাল ফুটিয়ে নরম ভাত করলো। খাবারগুলো দেখেই শাইনির বমি পেয়ে গেলো। খড়ের ঘরটার ছোট্ট জানালা দিয়ে হড়হড় করে বমি করে দিলো। বেলা ওকে ধরলো। পানির বোতল এগিয়ে দিলে শাইনি ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নেয়৷ নাকের ডগা রক্তিম হয়ে উঠেছে, কাহিল হয়ে গিয়েছে।
বেলা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘বমি করলেন যে? কী হয়েছে?’
‘নরমাল। জ্বরের বন্ধু বমি। একজন আসলে আরেকজনকে সাথে করে নিয়েই আসবে।’
বেলা রেগে বলল, ‘আপনার রসিকতা আমার মোটেও পছন্দ নয়।’
শাইনির খাবার খাওয়া শেষে বেলাও খেয়ে সবকিছু ধুয়েমুছে রেখে দিলো। তখন দুপুর দুইটা। শাইনি ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাইরে বেরুলো। জ্বরের প্রকোপ কমেছে। এখন কিছুটা ভালো লাগছে। বেলা ঘরে বসে রাগে ফুঁসছে। অসুস্থতা নিয়ে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনটা কী? একসময় ও বেরুলো ঘর থেকে। শাইনি মাচায় বসে উদাস চোখে চারপাশ দেখছে। বেলা সামনে বসেই বলল, ‘ড্যাবড্যাব করে কী দেখছেন?’
‘বউকে। আজ এত যত্ন নিলো তাই ভীষণ অবাক হয়েছি৷ ভালোবেসে ফেললে নাকি আমাকে?’
‘জি না। মানবতার খাতিরে যত্ন করেছি। শুরুতেই আপনার মেয়েবাজ ক্যারেক্টর দেখে রুচি বদলে গেছে। এখন সবটাই মানবিকতা।’
শাইনি মুচকি হেসে বলল, ‘শিওর?’
‘অফকোর্স।’
‘আমি যদি বলি তুমি আমাকে ভুল জানো, ভুল ভাবো, হোটেলঘরের সবটাই তোমার ছোট মস্তিষ্কের ভুল, তাহলে কী মেনে নিবে?’
বেলা দৃঢ় চিত্তে বলল, ‘না।’
শাইনিও কাঠ কাঠ গলায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘কিন্তু মানতে তোমার হবেই৷ কারণ ভুলটা তোমার। আবার আমারও।’
বেলার এসব কথা নিয়ে আলোচনা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। কিন্তু শাইনির কথায় রহস্যের আভাস পেয়ে কৌতূহল জাগছে ধীরে ধীরে। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঠিক কী বলতে চাইছেন ওই হোটেলঘরের ব্যাপারটা নিয়ে?’
‘তোমার ভুলটা ভাঙাতে চাইছি।’
‘যেমন?’
শাইনি বেলার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ও উঠে যেতে চাইলে বলল, ‘প্লিজ। বাইরে শুতে ইচ্ছা করছে।’
‘বলুন কাহিনী কী?’
‘কলেজ লাইফ থেকে নিশা ছিলো আমার বন্ধু। আস্তেধীরে আমরা বেস্টফ্রেন্ড হয়ে যাই, তারপর একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। দুজনেরই টাকাপয়সা আছে। সেই সুবাদে দুজনেই টাকা উড়াতে থাকি। বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে চলে যাই, ফাইভ স্টারে খাওয়াদাওয়া করি, লং ড্রাইভে যাই এসব করেই চলছিলো আমাদের। পড়াশোনার প্রতি মনোযোগটা ধীরে ধীরে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। একসময় সবকিছু বিষন্ন লাগতে শুরু করলো। বাসায় আম্মু থেকেও যেন নেই, আমাকে অদ্ভুত কারণে পছন্দ করে না আমি বুঝতে পারি। ছোট বোনটার প্রতিই আম্মুর সব খেয়াল, ভাবনা। আর আব্বু ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু কোনোদিনই আমার চাওয়া অপূর্ণ রাখেনি তিনি। জন্মদিনে আম্মু পায়েস রেঁধে না খাওয়ালেও আব্বু ঠিকই আমার জন্য গিফটটা নিয়ে আসতো। পারিবারিক অবহেলা আর বেপরোয়া জীবনের প্রতি একসময় বিতৃষ্ণা এসে যোগ হলো। মাঝে কিছুদিন অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। সব ঝাপসা দেখতাম, মাথা ঝিমঝিম করতো, আরো নানান প্রবলেম। আব্বুকে জানালাম না। কিছুদিন নিজেকে একা রাখতে ঢাকার বাইরে চলে যাই৷ তারপর এদিক-সেদিক কিছুদিন কাটিয়ে আবার ঢাকা ফিরে যাই এবং সেদিনই তোমার কলেজের সামনে তোমাকে প্রথম দেখি। হয়তো কোনো ছেলে তোমাকে ডিস্টার্ব করছিল, তাই তোমার আব্বু ছেলেটাকে শাসাচ্ছিলো। তুমি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলে কলেজ ড্রেসে। দেখতে খুব স্নিগ্ধ, মায়াবতী আর বাচ্চাদের মতো লাগছিল। আমার চোখ তোমাতেই আটকে গেলো। মনে হলো তোমার মতো একটা স্নিগ্ধ মেয়ে আমার প্রয়োজন। তারপর খোঁজখবর নিয়ে আব্বুকে জানাই এবং যেভাবেই হোক তিন মাসের মধ্যে আমাদের বিয়েটাও সেরে ফেলি। নিশাকে বিয়ের কথা জানালেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, শুভেচ্ছা জানিয়েছে।’
লম্বা সময় নিয়ে কথাগুলো বলার পরে শাইনি থামলো। পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলো। বেলা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তারপর কী?’
‘তারপর! আরো জানতে চাও দেখছি?’
#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২
-হুম। বাকিটা বলুন। পুরো ঘটনা না জানলে তো আর কিছু বুঝতে পারবো না।
-বলছি।
-জি।
শাইনি চোখ বুজলো। গলা খাকারি দিয়ে আবার তাকালো। বলল, ‘আমি যে অসুস্থ ছিলাম তখন বাসার কাউকে না জানিয়েই হসপিটালে যাই এবং ডাক্তার দেখাই। তিনি আমাকে বিশেষ কিছু পরীক্ষা দিলেন। তারপর প্রয়োজনীয় কিছু ঔষধ দিয়ে দিলেন। রিপোর্ট আসতে সময় লাগবে তাই সেদিন আর নিয়ে আসিনি। কাকতালীয় ভাবে এই রিপোর্ট আসে আমাদের বিয়ের দিন রাতে, তোমাদের বাসা থেকে ফেরার পর পর-ই। আমি তেমন কিছুই বুঝিনি, তাই আমার ডাক্তার ফ্রেন্ড নাজিমকে ফোন দেই এবং রিপোর্টগুলো পাঠাই। সে দেখে আমাকে কিছু না জানিয়ে রাতেই আমাদের বাসায় চলে আসে। আব্বুর সঙ্গে বিশেষ কারণে কথা বলতে চায়। আমার খটকা লাগে এবং ওকে চেপে ধরি। তখন ও মুখ গম্ভীর করে আমাকে জানায় আমি রক্তের ক্যান্সারে আক্রান্ত।’
বেলা চুপ করে রইলো। তাদের বিয়ের দিন রাতেই জেনেছিল বিষয়টা? কী নিষ্ঠুর নিয়তি তাদের। কাকতালীয় ঘটনা কতকিছুই তো ঘটে পৃথিবীতে! আর এমন আনন্দপূর্ণ একটা দিনে এই ভয়াবহ খবরটা শুনে শাইনির না জানি কী অবস্থা হয়েছিল!
শাইনি ঘাড় বাঁকা করে ডানপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে বেলার কোমড় জড়িয়ে। বেলার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়৷ ঠান্ডা বাতাসেও কেমন কুলকুল করে ঘামতে থাকে। রোদ পড়ে গেছে। বিকেল নামার পায়তারা করছে। আকাশে অনেক রঙের মেলা বসেছে যেন। কোথা থেকে আসছে বুনোফুলের সুগন্ধ! ক্লান্ত-শ্রান্ত পাখিরা ডানা মেলে উড়ছে চলছে দূরে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ওর। এমন সময় একটা গানেই কথাই মাথায় আসলো বেলার।
‘আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
তুমি চোখ মেললেই ফুল ফুটেছে আমার ছাদে এসে
ভোরের শিশির ঠোঁট ছুঁয়ে যায় তোমায় ভালোবেসে,
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।’
‘আমার ক্লান্ত মন, ঘর খুঁজেছে যখন
আমি চাইতাম, পেতে চাইতাম,
শুধু তোমার টেলিফোন।
ঘর ভরা দুপুর
আমার একলা থাকার সুর,
রোদ গাইতো, আমি ভাবতাম
তুমি কোথায়, কতদূর!’
‘আমার বেসুর গিটার সুর বেঁধেছে, তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
আমার একলা আকাশ চাঁদ চিনেছে তোমার হাসি হেসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে।’
‘অলস মেঘলা মন, আমার আবছা ঘরের কোণ
চেয়ে রইতো, ছুঁতে চাইতো,
তুমি আসবে আর কখন।
শ্রান্ত ঘুঘুর ডাক, ধুলো মাখা বইয়ের তাক
যেন বলছে, বলে চলেছে
থাক, অপেক্ষাতেই থাক।
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।’
শাইনির ডাকে ওর ধ্যান ভাঙলো। চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে?’
-কোথায় হারিয়ে গেলে? কখন থেকে ডাকছি!
-বলুন কী বলবেন।
-তোমার নখ এত বড় কেন? আমাকে খোঁচা দিচ্ছো বারবার!
বেলা চোখ বড় বড় করে তাকালো। বলল, ‘মিথ্যা বলা বাদ দিন।’
-বড্ড ঝগড়ুটে তুমি।
-তারপর কী হলো?
-কখন?
বেলা বিরক্তিসূচক একটা শব্দ করে কটমট করে বলল, ‘আমাদের বিয়ের রাতে যখন আপনি যখন জানতে পারলেন যে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত তখন কী করলেন? কথাটা কী আপনার ফ্যামিলির লোকজন জানতো না? আমাদের জানানোর উচিৎ ছিল না?’
-না। আমি মানা করেছিলাম। ওনারা ওভার রিয়্যাক্ট করতো।
-কেন?
-বোকা নাকি তুমি? সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়ের জামাই দুদিন পর মরে যাবে, কথাটা শুনলে ওনারা কী ঠিক থাকবে নাকি? আজব!
বেলা মাথা নাড়ালো। আসলেই ওর মাথা গেছে। কী যে হচ্ছে খুব নার্ভাস লাগছে। এরকম কথা জানলে ওর আব্বু নিশ্চয়ই ওভার রিয়্যাক্ট করতো আর মা কষ্ট পেতো।
তারপর বলল, ‘ঠিকই বলেছেন।’
-হুম।
-আমাকে জানালেও পারতেন। যাইহোক, নিশা আপুর ব্যাপারে কিছু বলুন।
শাইনি চোখ কুঁচকালো। উঠে বসে বলল, ‘সেদিন রাতে আমাদের বাসার সবার ওপর দিয়ে কী যে গেছে তা বলা বাহুল্য। আব্বু তো হাই প্রেশারের পেশেন্ট, মুহূর্তেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আর আমার পায়ের নিচ থেকে মাটিগুলো যেন আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে। দিশেহারা হয়ে পড়ি, খুব অসহায় মনে হয় নিজেকে। আব্বু আর তোমার মুখটা মনে পড়ছিল। এই পৃথিবীতে তোমাদের দুজনের মুখের দিকে তাকালেই বুঝে যেতাম তোমরা আমার একান্ত নিজের কেউ, খুব আপন। সেই রাতে নাজিম আর আম্মু সেদিন সবটা সামলায়। আমি ঠিক করি তোমাকে সবটা জানাবো, তাই মাঝরাতে ফোন দিই তোমাকে। মনে আছে?’
বেলা মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ ওর মনে আছে। শাইনি ফোন করে বলেছিল, ‘কাল একবার আমার সাথে দেখা করতে পারবে?’
বেলা লজ্জা পাচ্ছিলো। সদ্য বিবাহিত স্বামীটির সঙ্গে ফোনে ওর প্রথম কথা বলা সেদিন। ও নত গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় দেখা করবো?’
শাইনি বলেছিল, ‘সানফ্লাওয়ার হোটেলে।’
-হোটেলে?
-হুম। কিছু প্রাইভেট কথা আছে। তাই।
-ওহ আচ্ছা।
-এসো কিন্তু!
-জি।
কথাগুলো মনে পড়ে বেলার। শাইনি বলে, ‘সারারাত না ঘুমিয়ে ভাবতে থাকি কীভাবে তোমাকে সবটা জানবো, তুমি কীভাবে মেনে নেবে এসব কিছু। খুব কষ্ট হচ্ছিলো। শেয়ার করার মতো কাউকে পাচ্ছিলাম না তাই নিশাকে হোয়াটস অ্যাপ করি। ওর সাথে স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা হয়। আমার অসুস্থতার কথাটা খুলে বলি। ও অবাক হয়ে সেদিন কেঁদে দিয়েছিল। অনেকদিনের বন্ধুত্ব ছিল প্লাস একটা রিলেশনশিপ ছিল তাই। পরদিন ও দেখা করতে চায়। আমিও সাতপাঁচ না ভেবে ওকে ওই হোটেলে আসতে বলি যেখানে তোমাকে যেতে বলেছিলাম। ভেবেছিলাম নিশাও তোমাকে কিছু বুঝাতে পারবে!’
তারপর?
-পরদিন আমি আগে আগেই চলে যাই হোটেলে। একটা রুম বুক করি। তোমাকে আর নিশাকেও আসতে বলি। ও তোমার আগেই পৌঁছে যায়। দেখা হওয়ার পর ও সবকিছু শুনে ইমোশনাল হয়ে পড়ে। তারপর কেঁদে ফেলে। আমি ওকে সামলানোর চেষ্টা করছিলাম। সে সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় আর তখনই তুমি এসে পড়ো। আর ওখানেই একটা সিনক্রিয়েট হয়ে যায়। আসলে এরকমটা হওয়ারই কথা। কোনো মেয়ে তার স্বামীকে এরকম অবস্থায় দেখলে মানতে পারবেই না। কেউ কি নিজের স্বামীর ভাগ দিতে চায় নাকি! যেমন আমি তোমাকে অন্য কারোর সাথে দেখতে পারবো না, মেনেও নিবো না।’
বেলা আহত চোখে তাকায়৷ বলে, ‘তার মানে সেদিন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল?’
-হুঁ। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি বুক করা রুমের দরজা খোলা ছিল?
-আসলেই না।
-ভাবো, আমরা যদি তেমনই ইন্টিমেন্ট হতাম তাহলে ঘরের দরজা কেন বন্ধ করলাম না!
বেলা মাথা চেপে ধরে বলল, ‘ওহ মাই গড!’
-সেখানে নিশার সাথে তোমার কথা কাটাকাটি দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম, ঝগড়া থামাতে নিশাকে চলে যেতে বলি। ও বিনাবাক্য ব্যয়েই চলে যায় তোমার ওপর রেগে। তারপর আমি ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম এখন বলা ঠিক হবেনা কারণ তোমার মন ভালো নেই। আর তখন আমি যদি এসব কথা বলতাম তাহলে তুমি ভাবতে আমি নিশার ঘটনা ধামাচাপা দিতে অসুস্থতার নাটক করছি। তাই সেদিন কিছু বলিনি। তোমাকে হুমকি ধমকি দিই যাতে এই ঘটনা বাসার কাউকে না জানাও। কিন্তু সেদিন না জানালেও পরবর্তীতে তুমি সবটা তোমার বাবা-মাকে জানিয়ে দাও। আর তারা আমাদের সেপারেশনের ডিসিশন নেয়। আমি তো কয়মাস দেশের বাইরেই ট্রিটমেন্ট নিচ্ছিলাম। সেপারেশনের কথা শুনে আমার তখন খুব রাগ হয়েছিল। তাই ট্রিটমেন্ট ফেলেই সেখান থেকে চলে আসি আব্বুকে না জানিয়ে।’
-এরকম করা আপনার মোটেও উচিৎ হয়নি।
শাইনি করুণভাবে তাকিয়ে বলল, ‘কি করতাম বলো? মরে গেলেও আমি তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা চিন্তাতেও আনতে পারবো না। অন্য কারো সাথে তোমার নামটা জুড়ে থাকুক আমি চাই না কখনোই। আর তোমার কর্মকান্ডে আমার প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো। সামনে থাকলে মেরেই ফেলতাম তোমায়। তুমি শুধু আমার। আকাশে যেমন মেঘেদের মানায়, তেমনি তোমার নামটাও আমার পাশেই মানায়। অথচ তোমার ফ্যামিলি আর তুমি নিয়মের বিপরীতে উল্টোটা ঘটাতে চেয়েছিলে। তাই আমি ঠিক করি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাব। তাই কিছুদিন নজর রাখি তোমার ওপর এবং সুযোগ বুঝে এখানে নিয়ে আসি!’
বেলা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নির্লিপ্ত চোখে রোদের লুকোচুরি খেলা দেখতে লাগলো। এই লোকটা এতটা পাগল? এত বড় রোগ হওয়ার পরেও সে নিশ্চিন্তে বনে-বাদাড়ে, পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! শুধুমাত্র বেলাকে ছাড়তে পারবে না বলে? মানে মৃত্যুর ভয় কি একটুও নেই তার? সে প্রশ্ন করে,
-যাইহোক, ট্রিটমেন্ট না করাটা বা ওখান থেকে চলে আসা আপনার ঠিক হয়নি। আগে নিজের সুস্থতা তারপর বাকি সবকিছু ভাবার দরকার ছিল! কেন এরকম করলেন? আমি হয়তো থাকতাম না আপনার জীবনে, কিন্তু জীবনসঙ্গীর অভাব হতো না আপনার জীবনে! এই পাগলের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আপনার ফ্যামিলির লোকদের কথা মাথায় আসেনি একবারও?
-এসেছে। তোমার আর আব্বুর! আর কারোর না।
-মাথা খারাপ হয়েছে আপনার! কে হই আমি আপনার?
-বউ।
-মা-বোনের কথা একবারও মনে পড়েনি, যিনি আপনাকে জন্ম দিয়েছেন! নিষ্ঠুর আপনি, ছেলে হওয়ার কোনো যোগ্যতাই নেই আপনার।
-যা ভাবতে পারো তাই।
বেলা ঘাড়ত্যাড়া লোকটার কথা শুনে মনে মনে চটে গেলেও ভাষায় প্রকাশ করলো না। মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি! ওর কোলে থাকা শাইনির মাথার চুলগুলোতে আঙুল চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাকে ভালোবাসেন তাইনা?’
-হুম, তোমাকে ভালোবাসি।
-আমি যা বলবো, তা শুনবেন?
শাইনি অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘বলেই দেখো না। তবে একটা কথা মাথায় রাখবে, তোমার থেকে দূরে যেতে বলবে না। আমি কীসের কথা বলছি বুঝতে পারছো তুমি?’
-হুম।
-বলো, কী বলতে চাও?
বেলা কাঁপানো গলায় বলল, ‘বাসায় ফিরে চলুন আর ট্রিটমেন্ট শুরু করুন।’
শাইনি ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। রাগী স্বরে বলল, ‘কখনোই না। ওখানে গেলে সবাই তোমাকে আমার থেকে দূরে করে দেবে। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, তখন আমি এমনিই মরে যাবো। কখনোই যাবো না।’
বেলাও উঠে দাঁড়ালো। আলতো হাতে শাইনির গাল ছুঁয়ে বলল, ‘যাবো না আপনাকে ছেড়ে। কিন্তু ট্রিটমেন্ট না করালে তো আপনার অসুখ ভালো হবে না। আমি তো ভালোবাসেন আমাকে, আমার এই রিকুয়েষ্টটা শুধু রাখুন। প্লিজ! কখনোই কিছু চাইবো না আপনার থেকে। আপনার আব্বুর কথাটা ভাবুন, ওনার মনের অবস্থাটা চিন্তা করুন! আপনার জন্য নিশ্চয়ই চিন্তা করছে তাইনা?’
শাইনি জ্বরে ক্ষয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘সত্যি তো? ছেড়ে যাবেনা তো?’
বেলা চোরা গলায় বলে, ‘সত্যি।’
কথাটি বলার সময় ওর কন্ঠ কেঁপে ওঠে। জীবনের প্রথম কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে গিয়ে ওর চোখে জল চলে এসেছে!
চলবে…