শ্রাবণ_তোমার_আকাশে পর্ব ১৩

#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩

বেলা অনেক বোঝানোর পর শাইনি ওর কথায় বাড়ি ফিরতে রাজি হলো। তবে শর্ত একটাই, বেলা ওকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না।
সেদিন রাতটা পার করে কোনোমতে সকালে উঠে সবকিছু গোছগাছ করলো বেলা। প্রয়োজনীয় ব্যবহৃত জিনিসপত্র গুলো সেখানকার এক আদিবাসীকে দিয়ে দিলো। এতদিন এখানে থাকায় কেমন একটা মায়া বসে গেছে বেলার। অভাবনীয় সুন্দর মুহূর্তগুলোর কথা বারবার মনে পড়ছিল ওর। সারাজীবন এই পাহাড়ের ওপর কাটিয়ে দেওয়ার জন্য ইচ্ছে করছিল। সকালের নাস্তা তৈরি করে ওরা ব্রেকফাস্ট সেরে নিলো। চা আর বনরুটি। বেলা বনরুটি পছন্দ করে না তেমন। কিন্তু উপায় না পেয়ে খেতেই হলো। ওদিকে শাইনির ভীষণ পছন্দ বনরুটি। চায়ের ভেতর ডুবিয়ে নরম করে চা-সহ এক চুমুকে পুরোটা খেয়ে নিতে দেখে বেলা আঁতকে উঠে বলল, ‘এসব কী করছেন? ছিঃ!’
শাইনি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ছিঃ কেন? কী করলাম?’
-চায়ে ডুবিয়ে এভাবে খায় নাকি!
-হুম। তুমিও খাও।
-ছিঃ, বিদঘুটে খাদ্য।
-তোমার কাছে বিদঘুটে বলে আমার কাছেও বিদঘুটে লাগবে এটা কোনো কথা নয়।
-আমার সামনে বসে এভাবে খাবেন না।
-খাবো।
বেলা হেঁচকি উঠিয়ে বলল, ‘আমার কিন্তু বমি আসছে!’
-আমি কী করব তাহলে?
বেলা রেগে বলল, ‘আপনার জ্বর হওয়ার সময় সেবা করিনি? তাহলে আপনিও আমার সেবা করবেন। বমি পরিষ্কার করবেন।’
-আমি তো ঘরে বমি করিনি।
বেলা শক্ত কন্ঠে বলল, ‘আমি করবো।’
-তাহলে তুমিই তা পরিষ্কার করবে।
-আপনি করবেন।
-আমিতো অসুস্থ, তা-ও এত অত্যাচার করবে? কষ্ট হবেনা?
বেলা কিছু না বলে চুপচাপ উঠে যায়। আধখাওয়া খাদ্যগুলো ঘরের পেছনে এসে ফেলে দেয়। হাতমুখ ধুয়ে বাইরের মাচায় এসে বসে থাকে। একটু পরেই রওয়ানা দেবে বাড়ির উদ্দেশ্যে। সব গোছগাছ শেষ। যাবার আগে একটু রিলাক্স করার জন্যই সব আগেভাগে করে ফেলেছে বেলা। মাচায় বসে আরও একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। এখানে তাদের কত স্মৃতি জমে আছে! সেদিন হ্রদে গোসল করতে গিয়ে কী মজাটাই না করেছিল দুজন! শ্রাবণের বৃষ্টিতে পথঘাট কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল দেখে বেলার মনে শয়তানি বুদ্ধি উঁকি দেয়। আর সে জন্যই শাইনির অগোচরে হঠাৎ ওকে কাদা মাখিয়ে ভূত বানিয়ে দিয়েছিল। আর ও রেগে একাকার তখন! অবশ্য শাইনি বেলাকেও ছাড়েনি, প্রচন্ড জ্বালিয়েছিল সেদিন। ওর গায়ের চটচটে কাদা দিয়ে বেলার শখের ওড়নাটা নষ্ট করেছিল, আবার ওর কর্দমাক্ত মুখটা বেলার গালে ঘষে দিয়েছিল। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গালে লাগাতে বেলার গাল জ্বলছিল প্রচুর। মরিচ লাগলে যেমন হয় তেমনই লাল হয়ে গিয়েছিলো। ও ইচ্ছেমতো শাইনির বুকে কিল-ঘুষি মারতে মারতে হ্রদের পানিতেই ফেলে দিয়েছিল। গাল ফুলিয়ে কটমট করছিল। শাইনিকে একদম সহ্য হচ্ছিলো না ওর। অবশ্য পরে রাগ টাগ ভুলে হ্রদে গা ডুবিয়ে গোসল করেছিল দুজন। বেলা এটা মিস করতে চায়নি কোনোভাবেই৷ হাঁসদের সঙ্গে খেলা করে, দুষ্টু-মিষ্টি কিছু সময় কাটিয়ে এই ঘরটায় ফিরে এসেছিল তারা। যেন এটা ওদের নিজের সংসার, একান্তই নিজের। কারো আধিপত্য নেই, কিছু নেই।

শাইনির সাথে স্বাভাবিক একটা জীবন পেলে এই মুহূর্তগুলোই তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হতো। এটা হতো তাদের মধুচন্দ্রিমা! কিন্তু ওর জীবনের সবকিছুই যেন উলটো করে ঘটলো। লোকটা যে ভয়ংকর এক অসুখে আক্রান্ত! কীভাবে ঠিক হবে সবকিছু? ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে বাবা-মা কী ফিরিয়ে দেবে শাইনির কাছে? নাকি বিয়েটা ভাঙার সিদ্ধান্তেই তারা অটল থাকবে? তার ওপর বেলাকে কিডন্যাপ করে মস্ত বড় ভুল করেছে শাইনি। এত সহজে সবকিছু ঠিক হবেনা। তার বাবা কঠিন লোক। এখান থেকে ফিরে গেলে বিশাল বড় ঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে শাইনিকে। লোকটার শরীরের যা কন্ডিশন তাতে কি এসবের মুখোমুখি হওয়া ঠিক হবে? তার ওপর জ্বরটা থেমে থেমেই উঠছে। কে জানে কী অপেক্ষা করছে ওদের জন্য! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো বেলা।

পাহাড়ের পাদদেশে গঠিত বৌদ্ধ মন্দির হতে ঢং ঢং শব্দ আসছে। শব্দটা কেটে কেটে আসছে। কী এক মোহনীয় বার্তা নিয়ে যেন ছুটে সেই শব্দ! অসাধারণ লাগলো মুহূর্তটা বেলার কাছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখলো কেমন কুয়াশা যেন জমে আছে সবখানে। তবে বেলা জানে ওগুলো আসলে মেঘ! একটু কিনারে গিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়াতেই কিছু মেঘ বেলার গাল ছুঁয়ে যায়। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। ও চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে শাইনিকে দেখতে পায়৷ শাইনির বুকের সঙ্গে ওর পিঠ লেপ্টে আছে। ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বেলা অস্বস্তিতে পড়ে গেলো৷ শাইনি ওর হাতদুটো নিজের মুঠোয় নিতে নিতে বলল, ‘পাখি হতে ইচ্ছে করে না?’
-হুম।
-তাহলে হাত দুটো এভাবে ছড়িয়ে দাও। পাখির ডানার মতো। মেঘেরা যখন ছুঁবে তখন নিজেকে ঠিক পাখি ই মনে হবে। স্বাধীন, মুক্ত মনে হবে।
বেলা ওর কথামতো দাঁড়াতেই পেছন থেকে শাইনিও ওর হাতের ওপর হাত রাখলো। দুজনকেই পাখি মনে হচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে পৃথিবীর সবচেয়ে সবচেয়ে সুখী মনে হচ্ছিলো দুজনকে।

ঢাকায় এসে বাস থামলো যখন, তখন রাত সাড়ে বারোটা। ওরা রওয়ানা দিয়েছিল দুপুরের দিকে।লম্বা সময় ধরে বাসে বসে থাকার দরুণ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল বেলা, শাইনির কাঁধে মাথা রেখে। বাস থামার পর শাইনি বেলাকে ডেকে তুললো।
-পৌঁছে গিয়েছি?
-হুম, নামতে হবে।
-আচ্ছা।
দুজনেই নামলো। শাইনিদের ড্রাইভার অপেক্ষা করছিল বাসস্ট্যান্ডে। শাইনি বেলাকে নিয়ে সেখানে উঠে পড়ে৷ ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। বেলার খুব অস্বস্তি হতে থাকে। এই প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে তাও এত রাতে। অথচ ওদের বিয়ে হয়েছে সাড়ে চারমাস আগে। বাবা-মা জানতে পারলে না জানি কী করবে আল্লাহ জানে। ওর খুব চিন্তা হলো। শাইনি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, ’ঘুম পেয়েছে?’
-নাহ।
-ঘুমাতে পারো।
-দরকার নেই৷ আপনি ঠিক আছেন?
-হুম।
-দেখি তো জ্বর আছে কি-না!
বেলা ওর ডান হাতটা শাইনির কপালে ঠেকিয়ে চেক করে জ্বর আছে কি-না। গা গরম সামান্য। মানে রাতে উঠার পায়তারা করছে। বেলা হাত নামিয়ে বলে, ’ঔষধ নেননি? গা গরম তো!’
-ঔষধ ফেলে এসেছি।
বেলা অবাক হয়ে বলল, ’এত কেয়ারলেস আপনি? ওহ গড!’
-উতলা হওয়ার কিছু নেই।
বেলা ধমকে বলল, ’এক্ষুনি ঔষধ নিয়ে আসুন।’
-এত রাতে সব দোকানপাট বন্ধ।
-না। হাসপাতালের সামনের ডিসপেনসারি গুলো এখনো মনে হয় না বন্ধ করেছে।

বেলার জোরাজুরিতে গাড়ি থামিয়ে ডিসপেনসারি থেকে প্রয়োজনীয় ঔষধ নিয়ে আসে শাইনি। গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। পানি দিয়ে জ্বর নামার ট্যাবলেটটা ওকে খাইয়ে দিলো বেলা। শাইনি এবার হাসতে হাসতে বলল, ’খুব চিন্তা হয় আমার জন্য তাই-না?’
বেলা অস্বীকার করে বলল, ’একদমই না।’
-বউ আমার বেশি মিথ্যা শিখেছে। আমি জানি তোমারও চিন্তা হয় আমার জন্য। আমি বুঝতে পারি গো বউ!
-হুহ!

একটা দোতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামে। বেলা ভয়ে ভয়ে গাড়ি থেকে নামে। শাইনি ওকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। গিয়ে দেখে দরজা খোলা। এত রাতে দরজা খোলা দেখে অবাক হয় বেলা। হঠাৎই দরজার সামনে একটা মহিলাকে দেখতে পায়। পরক্ষণেই চিনতে পারে। এটা শাইনির মা অর্থাৎ বেলার শ্বাশুড়ি। তার পাশে দাঁড়িয়ে আলম সাহেব অর্থাৎ বেলার শ্বশুর। তাদের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। নাজনীন বেগম ওদেরকে বরণ করে ভেতরে ঢোকায়। বেলা কুশল বিনিময় করে। হাতমুখ ধুয়ে আসে। ডাইনিংয়ে হরেক রকম খাবার সাজানো হয় নতুন বউয়ের উদ্দেশ্যে। সবকিছুই যেন পূর্বপরিকল্পিত। প্রচন্ড ক্ষিধে থাকায় শাইনি-বেলা দুজনেই খেতে রাজি হয়ে যায়। রাত তখন দেড়টা। ওরা ক্লান্ত থাকায় আলম সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। নাজনীন বেগম ওদেরকে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। শাইনির ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো-গোছানো। বেলা নিজের কাপড় পালটে ব্যাগ থেকে একটা কামিজ বের করে পরে নেয়। শাইনিও কাপড় পালটে বিছানায় এসে বসে। বেলা জিজ্ঞেস করে, ’ওনারা কী জানতেন আমরা আসবো?’
শাইনি বলল, ’হুম৷ আমি আসার সময় জানিয়ে দিয়েছিলাম আব্বুকে। তাইতো বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি পাঠিয়ে দিলো।’
-ওহ। আপনার আম্মুকে কিন্তু ভালোই লাগলো। সব স্বাভাবিকই আছে৷ আপনার সাথে কথাও বলেছে সুন্দর করে।

শাইনি বলল, ’আমার মা সবসময়ই এমন। সে ভালো খুব। সবার সাথেই মিষ্টি হেসে কথা বলে। কিন্তু আমি মা মা ব্যবহারটা পাই না কেন জানি!’

-আপনার ব্যবহারগুলোর জন্যই হয়তো তিনি আপনার সাথে সহজ নন। তাই মায়ের ভালোবাসাটা বুঝতে পারেন না।

চলবে..ইনশাআল্লাহ! গল্পে মন্তব্য কমে গেছে, বোরিং লাগছে গল্পটা?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here