#ভালোবাসার_রঙ_কালো 🖤
#চাঁদনী_নূর_লামিয়া
পর্ব-৪
——————————————–
#ভালোবাসার_রঙ_কালো (পর্ব-৪)
#চাঁদনী_নূর_লামিয়া
.
শান্ত একটি বিকেল বেলা। একজোড়া কবুতর বাকবাকম করে ডেকে এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছে। একটি কবুতরের গায়ের রঙ সাদা; আর অন্যটির পাখায় সাদা কালো মিশেল এবং গলায় সবুজ রঙের ছোপ ছোপ। সাদা রঙের কবুতরটি ঠোঁটে করে গমের দানা কুড়িয়ে নিয়ে অপর কবুতরটির সামনে রেখে মুখ দিয়ে অদ্ভূত একটা শব্দ করছে। সম্ভবত প্রিয়ষীকে খুশি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু অন্য কবুতরটি না খেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গড়গড় শব্দ করছে। হয়তো ওটা রাগ করেছে আর সাদা কবুতরটি সেই রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে। অবুঝ প্রাণীদের মাঝেও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ শব্দকেও হার মানায়! একে অপরকে নিজেদের মনের ভাব বোঝাতে এদের কোনো ভাষা বা শব্দের প্রয়োজন হয় না। আমার রুমের জানালার সাথে পাশের বিল্ডিংয়ের চারতলা ফ্ল্যাটের বেলকনি অনেকটা লাগোয়া। সেই বেলকনিতে একজোড়া কবুতরের বসবাস। হয়তো সেই ফ্ল্যাটের কারোর কবুতর পোষার শখ আছে। আর সেই শখ থেকেই ওই কবুতর দুটি এতটা স্বাধীন ভাবে পুরো বেলকনি জুরে নিজেদের ভালোবাসার সংসার পেতে বসেছে! আমি প্রায় সময় আমার রুমের জানালায় দাঁড়িয়ে এদের খুনসুটি আর ভালোবাসার সংসার দেখি। যতক্ষণ কবুতর দুটিকে দেখি ততক্ষণই মনের ভেতর অদ্ভূত একটা শান্তি অনুভব করি আর ভাবি সংসার বুঝি এমনই হয়। একজন যদি রাগ কিংবা অভিমান করে তবে অন্যজন পরম মমতায় গভীর ভালোবাসা দিয়ে সেই রাগ ভাঙিয়ে অভিমান ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
” আরজু।
আম্মার ডাকে পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখি মিষ্টি রঙের একটি আটপৌরে শাড়ি পরে উদাসীন ভঙ্গিতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
” দরজায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে এসো।
আমি জানালার কাছ থেকে সরে গিয়ে খাটের একপাশে বসে পড়লাম।
আম্মা আমার পাশে বসে শুকনো গলায় বললেন,
” আরজু আমি চাই না তুই এই বিয়েটা কর।
আম্মার কথায় আমি অবাক হয়ে বললাম,
” কোন বিয়ে?
” তোর আব্বা যে বিয়ের কথা বলেছে, ঐ যে ছেলের মুদির দোকান আছে।
” ওহ।
” আমি চাই না তুই এই বিয়ে কর।
” বিয়েতে তো আর এখনি হয়ে যাচ্ছে না। আব্বা শুধুমাত্র বলেছে। দুই পক্ষের পছন্দ হলে তারপর বিয়ের কথা আসবে। অথচ তুমি এখনি অস্থির হয়ে পড়েছো।
আম্মা বিরক্তির সুরে বললেন,
” তোকে আমি এতকথা বলতে বলেছি?
আমি জানি আম্মা কি বলতে চাইছে। তাই আমি প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য বললাম,
” তোমার কাছে হাজার তিনেক টাকা আছে?
আম্মা চোখের ভ্রু সংকুচিত করে জিজ্ঞেস করলেন,
” তুই টাকা দিয়ে কি করবি?
” আমার জন্য না নোমানের জন্য। ওর ব্যাচের সবাই মিলে কক্সবাজার যাবে। সেইজন্য তিন হাজার টাকা লাগবে। অন্যদের ভাগে আরও বেশি করে টাকা পড়লেও নোমান ক্যাপ্টেন হওয়ায় ওর মাত্র তিন হাজার টাকা দিলেই চলবে।
এই কথা শুনেই রাগে আম্মার চেহেরাটা লাল হয়ে ওঠল। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
” তিন হাজার টাকা তোরা ভাইবোনের কাছে মাত্র লাগে? তোরা কি জমিদারের সন্তান যে চাইলেই এত টাকা পেয়ে যাবি?
” সামান্য কয়টা টাকার জন্য এত রেগে যাচ্ছো কেন? নোমান তোমাদের একমাত্র ছেলে হয়েও নিজের কোনো শখ আহ্লাদ পূরণ করতে পারে না। কই তুমি নিজ থেকে খুশিমনে ওকে কিছু টাকা দিবে, তা না উলটো রাগ দেখাচ্ছো। তোমার কাছে টাকা থাকলে দিবে নাহলে না করে দিবে। আমি তো তোমাকে জোর করছি না।
আম্মা দাঁত কটমট করে কিছু বলতে গিয়েও আব্বার ডাক শুনে চলে গেল। যাওয়ার আগে আমার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যেতে ভুলল না। আম্মা চলে যেতেই আমি আনমনে হেসে ওঠলাম! আমি জানি আম্মা কেন এসেছিল। আমি যেন আব্বাকে এই বিয়ের জন্য না করে দেই সেটা বলতে এসেছিল। কিন্তু আমি কিছুতেই এই বিয়ের জন্য না করবো না। নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে খুব ভালো অবিজ্ঞতা হয়েছে আমার। তাই ভাগ্যে যা থাকে হাসিমুখে সেটাই মেনে নেবো।
.
নিধির রুমের দরজায় আস্তে করে টোকা দিতেই ভেতর থেকে বলল,
” দরজা খোলাই আছে ভেতরে এসো।
দরজা সামান্য ফাঁক করে আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম। নিধি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। লম্বা ছিপছিপে গড়নের মেয়েটা দেখতে অনেকটা পুতুলের মতো। ওর বড়বোন রিধিও দেখতে ওর চেয়ে বেশি সুন্দরী। মিহির ভাই ছাড়া ওরা বাকি তিন ভাইবোনই সুন্দর। কয়েকমাস আগে মিহির ভাইয়ের বন্ধুর সাথে রিধির বিয়ে হয়ে গেছে। এখন নিধির বিয়ের কথা চলছে। ওদের তো টাকা পয়সার অভাব নেই। তারপর নিধি দেখতে সুন্দরী হওয়ায় ওর জন্য যোগ্যতা সম্পন্ন পাত্রের অভাব নেই। মিহির ভাই আর আংকেল সবদিক ভেবে চিন্তে সুপাত্রের কাছেই ওকে বিয়ে দিতে চান। তাই সবদিক দিয়ে যোগ্যতা সম্পন্ন পাত্র খুঁজছেন।
” উপুড় হয়ে শোয়া নিষেধ কারণ এইভাবে শয়তান শোয়।
নিধি আমার কথায় চমকে পিছনে তাকায়। কয়েক সেকেন্ড বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মিষ্টি করে হেসে বলল,
” আরে আরজুপু তুমি। দাঁড়িয়ে আছো কেন বসো।
ও বিছানার একপাশে সরে গিয়ে আমার বসার জন্য জায়গা করে দিল। আমি চুপ করে ওর পাশে বসে পড়তেই নিধি বলল,
” এইবার বোলো আমাকে হঠাৎ মনে পড়লো কেন তোমার?
” কোনো কারণ ছাড়া কি আমি তোমার কাছে আসতে পারি না?
” অবশ্যই আসতে পারো। কিন্তু তোমাকে তো কখনো জোর করেও আমার রুমে আনতে পারিনি। অথচ আজ তুমি নিজ থেকে আমার রুমে এসে হাজির। তাই জিজ্ঞেস করছি।
মেয়েটা সুন্দরী হওয়ার পাশাপাশি বুদ্ধিমতীও বটে। আমার বলার আগেই বুঝে ফেলেছে আমি ওর কাছে কোনো প্রয়োজনেই এসেছি। আমি মুচকি হেসে বললাম,
” তোমার কাছে কিছু টাকা হবে?
টাকার কথা শুনতেই ওর মুখটা কালো হয়ে গেল। গম্ভীর সুরে জিজ্ঞেস করলো,
” কত টাকা।
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
” তিন হাজার টাকা।
নিধি ফট করে হেসে বলল,
” মাত্র তিন হাজার টাকার কথা বলতে তোমার এত সংকোচ হচ্ছিলো? শোনো, আমি কিন্তু বয়সে তোমার চেয়ে মাত্র কয়েক মাসের ছোট। তার চেয়েও বড় কথা আমি তোমার বান্ধবীর মতো। তাই আমার কাছে তোমার সংকোচ করা মোটেও উচিত না।
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। নিধি বিছানা থেকে নেমে গিয়ে ওর মিনি পার্স থেকে টাকা বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিতেই হঠাৎ করে মিহির ভাই এসে সেখানে হাজির হলেন। আমি তাকে দেখে নিধির হাত থেকে টাকাগুলো না নিয়েই দাঁড়িয়ে গেলাম। মিহির ভাই একবার আমার দিকে আরেকবার নিধির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে বললেন,
” নিধি বাবা তোকে ডাকছে তুই এক্ষুনি যা।
” ঠিক আছে আমি যাচ্ছি।
নিধি আমার হাতে টাকাগুলো গুজে দিতে গেলে মিহির ভাই আবার বলেন,
” এইসব এসে করিস। আগে যা বাবা কেন ডেকেছে সেটা শুনে আয়।
তার কণ্ঠস্বর কেমন যেন রুক্ষ শোনাচ্ছে।
নিধি আমার দিকে তাকালে আমি ইশারায় ওকে যেতে বললে ও রুম থেকে চলে গেল। ওর যাওয়ার পরে আমিও সেখান থেকে চলে আসতে চাইলেই মিহির ভাই খপ করে আমার হাত ধরে ফেলেন। আমি অবাক চোখে তার পানে তাকাতেই প্যান্টের পকেট থেকে তার ওয়ালেট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলেন,
” নিধির কাছ থেকে টাকা নিতে লজ্জা না করলে আমার কাছ থেকে নিতেও লজ্জা লাগবে না তোমার।
এই বলে তিনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন। রাগে আর অপমানে আমার সারা শরীর কাঁপছে। সেখান থেকে কোনো রকমে আমার রুমে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। তার ওয়ালেটটাকে আমার দুইহাতের মাঝে পিষে ফেলতে লাগলাম। আমাকে একটু ধাতস্থ হওয়ার সুযোগ না দিয়েই মিহির ভাই হুড়মুড় করে আমার রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন। তাকে দেখামাত্র আমি চেঁচিয়ে ওঠলাম,
” একি আপনি আমার রুমে কেন এসেছেন? আর দরজাই বা লাগাচ্ছেন কেন?
আমার কথা যেন তার কানেই যায়নি এমন ভান করে ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার আর মাঝে এখন খুব অল্প পরিমাণে ফাঁক রয়েছে। মিহির ভাই আমার চেয়ে কয়েক ইচ্ছি লম্বা হওয়ায় তার প্রসস্থ বুক আমার নাক বরাবর এসে ঠেকেছে। আজও শার্টের বুকের উপরের তিনটি বোতাম খোলা রেখে দিয়েছেন। যার দরুন তার চওড়া বুকের অনেকটাই দৃশ্যমান। লোকটার কি আক্কেল বলতে কিছু নেই নাকি। এমন ভাবে শার্টের বোতাম খুলা রেখে কোনো মেয়ের সামনে আসে কেউ? কিন্ত তার হাবভাবে সে রকম কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না। বরং তিনি বুক ফুলিয়ে স্বগৌরবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার বুকের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলি। তিনি চিবিয়ে বলার মতো করে বলেন,
” মুদি দোকানদারকে বিয়ে করার খুব শখ হয়েছে তোমার তাই না?
আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম,
” আপনাকে এই কথা কে বলেছে?
” যেই বলুক। তুমি এই বিয়ের জন্য না করে দিবে ব্যস।
” ওহ বুঝেছি। আমাকে এই কথা বলতে আম্মা আপনাকে ভাড়া করেছে বুঝি।
” মিহির আহমেদকে ভাড়া করার মত সাহস আর যোগ্যতা এখনো কারোর হয়নি। আর রইলো চাচির কথা। চাচির সাথে এই ব্যাপারে কোনো কথা হয়নি আমার।
” তাহলে আপনি কেন আমার বিয়ের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন? আমি কাকে বিয়ে করবো সেটা আমার ব্যাপার। আপনি…..
আমার কথার মাঝখানেই তিনি আমার ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে সামান্য ঝুকে এসে আমার চোখে চোখ রেখে নরম সুরে বলেন,
” হুস! তোমার সব ব্যাপারে আমার নাক অবশ্যই গলাবো। মুদি দোকানদারকে বিয়ে করবে তো তুমি? ঠিক আছে আমি সব ব্যবস্থা করছি।
এই বলে তিনি হেঁটে দরজা পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেলেন। তারপর পিছনে ফিরে বললেন,
” আমার ওয়ালেটটা তোমার দুইহাতের মাঝে পিষে ফেলতে দেইনি। নোমানের যত টাকা লাগে দিয়ে দিও। আর হ্যাঁ, এরপর তোমার কোনোকিছুর দরকার হলে অন্য কাউকে না বলে সোজা আমার রুমে গিয়ে আমার ওয়ালেট নিয়ে আসবে। কথাটা যেন মনে থাকে।
এই পর্যন্ত বলেই তিনি দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। একবারও পিছনে ফিরে তাকালেন না।
আর আমি রুমে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে হতভম্ব হয়ে তার যাওয়ার পানে চেয়ে রইলাম!
.