মাঝরাতে কারো গরম নিশ্বাস এসে আঁচড়ে পরছে নববিবাহিত মেয়েটির বুকে।ভয় পেয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করতেই ভালো করে তাকিয়ে দেখে,
তার বর কামাসক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে তার দিকে।মেয়েটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোকটি আলতো করে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় তার ঠোঁটে।মেয়েটি ভয় পেয়ে কোনো কথা না বলে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।তারপর মনেমনে ভাবে,”আজ তো এই লোকটির বাড়িতে থাকার কথা না? হঠাৎ করে সে চলে এলো কোথা থেকে?” ইমান খেয়াল করে দেখে মেয়েটি বেশ ভয় পেয়ে ওর শার্টের কলার খামচে ধরে আছে।লজ্জা পাচ্ছে বুঝতে পেরে নিজেই বেড সাইডের টেবিল ল্যাম্প টা বন্ধ করে আঁচল টা সরিয়ে দেয় মেয়েটির বুকের ওপর থেকে।রাত যত গভীর হচ্ছে,ততই যেন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে দু’জনের মাঝে।ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে দুটো’ মানুষ সুখ খোঁজার চেষ্টা করছে একে অপরের মাঝে।
সকালে,
মেয়েটি ঘুম থেকে উঠে দেখে তার বর মহাশয় নেই আশেপাশে বেচারি আর একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করতেই হঠাৎ কেউ ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে বলে ওঠে,
– উঠবে না? সকাল হয়ে গেছে? মিম মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে খেয়াল করে দেখে ওর পরনে জামাকাপড়ের কোনো ছিটেফোঁটা ও নেই গায়ে বিছানার চাদর জড়ানো আছে।ইমান ল্যাপটপ টা চার্জে রেখে এসে হঠাৎ করে কোলে তুলে নেয় মেয়েটাকে।তারপর বাথরুমে ঢুকে ঝর্না টা ছেড়ে দিতেই বুঝতে পারে।তার দু’দিনের পুরোনো বউ লজ্জা পাচ্ছে নিজেকে চাদরে মোড়ানো দেখে।ইমান নিজের মৌনতা ভঙ্গ করে বলে,
– দেখ মিম,হয়তো সময় লাগবে।তবুও আমি চাই আমাদের সম্পর্কের একটা নাম দিতে।মিম হঠাৎ ইমানকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– আপনি তো সবটাই জানেন কিছু লুকোনোর নেই আপনার কাছ থেকে।আপু কি করে এতো টা স্বার্থপর হতে পারলো? আজ ওর জন্যে বাবা-মায়ের বত্রিশ বছরের সংসার ভেঙে গেছে।ইমান কোনো কথা বলে মিমের মাথাটা জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে।তারপর ওর কপালে আলতো করে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
– একদিন সত্যতা সবার সামনে প্রকাশ পাবে।আফসোস তখন কারো কিছু করার থাকবে না।তবে মা এবং ভাইয়ারা সবসময় আছেন তোমার পাশে।তখন হঠাৎ ডাকাডাকির আওয়াজ শোনা যায় বাহির থেকে।ইমান কোনোমতে ফরজ গোসল করে দরজা খুলে দেখে,
ওর ভাবিরা মিটিমিটি হাসছে ওকে দেখে।অধরা জিজ্ঞেস করে,
– ছোটো কোথায় দেখতে পাচ্ছিনা তাকে? ইমান ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি রেখে বলে,
– ও বাথরুমে ফ্রেশ হচ্ছে।বের হলে আমি ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি নিচে।মিম তৈরি হয়ে রান্না ঘরে এসে দেখে,
মিহা আগে থেকেই কিচেন দখল করে আছে।কি আশ্চর্য? আজকে ওর বিয়ের রিচুয়াল।মিহা রান্নাঘরে আসার সাহস পায় কোথা থেকে? তবুও মিম নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে এসে মিহা কে বলে,
– আপু কি চাই তোমার? জেনে-বুঝে কেন ঝামেলা করতে চাইছ আমার সাথে? মিহা এগিয়ে এসে বলে,
– দেখ তুই তো রান্না করতে পারিস না।তাই আমি করে দিচ্ছি ঠিক আছে? মিম রেগে গিয়ে বলে,
– এটা তোর একার শশুর বাড়ি না।আমারো ঠিক আছে? রিচুয়াল যখন আমার তখন আমি রান্না করবো কথা কানে গেছে? এখন এখান থেকে দূর হও নয়তো বাবাকে ডেকে তোমার এসব বেহায়াপনা বন্ধ করতে হবে।মিহা যেতে যেতে বলে কাজ টা তুই ঠিক করলি না ছোটো আমার সাথে।আমি জানি,বাবা-মায়ের আজ ছাড়াছাড়ি হতে যাচ্ছে।তবে আমি কিন্তু বাবাকে বলিনি মা কে ডিভোর্স দিয়ে দিতে।
– তুই কি করেছিস? সেটা তুই ও জানিস আর আমি ও জানি ঠিক আছে? সুখ বা শান্তি কোনো টাই তুমি পাবেনা মিহা ওপরে আল্লাহ তাআ’লা আছে।তাই আমি ও দেখতে চাই তোমার এই তাসের সংসার ক’দিন টেকে? যে দিন সত্যতা প্রকাশ পাবে ইশান নিজেই লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে তোকে।তখন আমি দেখবো তোমার এউ দম্ভ এবং অহংকার কোথায় থাকে? আমি আমার মায়ের মেয়ে মিহা তোমার মতো জারজ সন্তান নই কারো ঠিক আছে? আমি ওপর ওয়ালার বিচার দেখবো।তুমি তোমার নোংরা খেলা চালিয়ে যেতে পারো বোঝা গেছে? কোর্ট থেকে বের হয়ে মাহি আলম চৌধুরী আদিব চৌধুরী কে উদ্দেশ্য করে বলেন,
– সুখ শান্তি কোনো টাই আপনি এবং আপনার মেয়ে দেখতে পারবেননা ওই চোখে।এত বছর আমি আপনার জারজ সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো লালন-পালন করেছি সেটাই আমার ভুল।সৎ মায়ের মতো আমার আচরণ করা উচিত ছিল তার সাথে।তাহলে ও আর অন্তত এই নোংরা খেলা টা খেলতে পারতো না আমার মেয়ের সুখের সাথে।আদিব চৌধুরী চেঁচিয়ে বলে ওঠেন,
– তুমি ভুল করছ মাহি এর জন্যে একদিন ঠিক পস্তাতে হবে তোমাকে।
– হাসালেন আপনি? আমি পস্তাবো? এতো টা শিওরিটি কে দিয়েছে আপনাকে? আপনি আমাকে ঠকিয়ে বিয়ে করেছিলেন।কিছুই ভুলিনি আমি।সবটাই মনে আছে।আমারি ভুল আমি মাথায় তুলতে গিয়ে ছিলাম ওই ছা-পোষা মেয়ে টাকে।আর আপনি যে কত চরিএবান? সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে আরো ছয় মাস আগে।এতোই যখন মরহুম বড় ভাইয়ের বউয়ের সাথে প্রেম? তখন তাকে কেন বিয়ে করেননি আগে? কি করে ভাবলেন? এতোকিছু হয়ে যাওয়ার পর আমি সংসার করবো আপনার মতো একটা নোংরা লোকের সাথে? সায়ান এসে মাহি আলম চৌধুরী কে উদ্দেশ্য করে বলে,
– মা তুমি কেন বাজে বকছ? এই দুশ্চরিত্র লোকটার সাথে? উনি কি বুঝতে পারছেনা? আমার বোন যেমন ওনাকে চায় না,আমরা ও চাই না ওনাকে।বেশ কয়েকবার তোমাকে এই লোকটার ব্যাপারে সাবধান করেছিলাম।তুমি তো গায়ে মাখোনি মা আমাদের সে ভাবে? মাহি আলম চৌধুরী হাসতে হাসতে বলেন,
– চোরের মেয়ে তো বাটপার হবে বাবা।এর থেকে ভালো কিছু আশাকরা যায় কি এদের কাছ থেকে? বসায় চল এতো কথা খরচ করতে আমার ভালো লাগছেনা এই লোকটার সাথে।আদিব সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন মাহি আলম চৌধুরীর দিকে।মানুষ টা কি করে পারলো? এতো সহজে বত্রিশ বছরের সংসার জীবনের ইতি টেনে দিতে? তার একবার ও কি মনে হয়নি? সামনা-সামনি বসে দু’জনের কথা বলা উচিত ছিল একসাথে? না কি নিজের মায়ের কথায় রাগ সামলাতে না পেরে তার দ্বিতীয় বিয়ে টাই তাঁর কাল হয়ে দাঁড়ালো এভাবে?
দুপুরে, রায়হান সাহেব খাবারের গন্ধ পেয়ে গলা উঁচিয়ে বলেন,
– বাহ!
খুব সুন্দর কষা মাংসের গন্ধ আসছে রান্নাঘর থেকে।মিহা মৃদু হেসে বলে,
– বাবা আপনি খেতে বসুন আমি এখনি খাবার বেড়ে দিচ্ছি আপনাকে? মিম সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ময়না কে ডেকে বলে,
– টেবিলের ওপরের খাবার গুলো কুকুর কে খেতে দিয়ে দাও।আজকে বাড়িতে সবাই আমার রান্না করা খাবার খাবে? ইশান টেবিলের ওপরে সজোরে একটা ঘুষি মেরে এগিয়ে এসে মিমকে বলে,
– কি সমস্যা কি তোমার? বেয়াদবি করছ কেন? আমার স্ত্রীর সাথে।মিম ইশানকে চমকে দিয়ে বলে,
– আপনার বউয়ের সমস্যা কি ভাইয়া? সে কেন আজকে আমার হয়ে রান্না ঘরে রান্না করতে যাবে? আমি কি তাকে কিছু বলেছি? সে কেন শুধুশুধু আদর্শ বউ হওয়ার নাটক করতে যাবে? না মানে যেটা সে নয়,সেটা কেন মাইক বাজিয়ে প্রচার করতে যাবে? নাটক করতে ওর কষ্ট হয় না? আমি ও এ বাড়ির বউ আর সে ও এ বাড়ির বউ তাহলে সে কেন আমার ওপরে তার হুকুম খাটাতে যাবে? বাবা প্লিজ আমাকে ক্ষমা করবেন।অনেক কিছু সহ্য করেছি সকাল থেকে।আমার দুপুরে রান্না করতে দেরি হওয়ার কথা না।তবে মেঝো ভাবির জন্যে দেরি হয়ে গেছে।রায়হান সাহেব মিমের কথা শুনে মৃদু হেসে বলেন,
– আজ কেউ বাড়িতে মেঝো বউমায়ের হাতের রান্না খাবে না।ফেলে দেওয়া হোক খাবার গুলো কে।মিহা ছলছলে নয়নে তাকিয়ে আছে ইশানের দিকে।ইশান কিছু বলেনি কারণ বাবার কথাই শেষ কথা তার কাছে।রায়হান সাহেব কষা মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে খেতে মিমের মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করেন,
– মা তোর হাতের রান্নায় অসম্ভব স্বাদ।তবে তুই রান্না শিখেছিস কবে? মিম একবার ইশানের দিকে তাকিয়ে ইমানের বা হাত টা শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
– ছ’মাস আগে শিখে ছিলাম বাবা।তোমার ছোটো ছেলে কে চমকে দিতে।ইমান ওর কথা শুনে মৃদু হেসে ওর মুখের কাছে এক পিস মাংস তুলে ধরে বলে,
– সকালে তোমার খাওয়া হয়নি।আমি সব শুনেছি বড় ভাবির কাছ থেকে।মিম মৃদু হেসে বলে,
– আমি না হয় পরে খেয়ে নেবো? এখনো আমার শাশুড়ি মায়ের খাওয়া বাকি আছে।তাকে ছেড়ে আমি আগে কি করে খাই কর্নেল সাহেব? বলুন আমাকে? হৃদিকা এহসান হাসতে হাসতে বলেন,
– আমি তো খাচ্ছি মা? আর কার খাওয়া বাকি আছে? মিম খাবার সাজানো থালা টা হাতে নিয়ে বলে,
– কেন আমার নিজের শাশুড়ি মা? অর্থাৎ আমার স্বামীর মায়ের খাওয়া বাকি আছে।মিমের কথা শুনে হৃদিকা এহসান টেবিল থেকে উঠে বলে,
– ছোটো (এনা) তো মানুষিক ভাবে অসুস্থ মা? ও তোমাকে জখম করে দেবে।
– তবুও আমি যেতে চাই।কারণ আমার কখনো পাগল বা মানুষিক রুগী বলে মনে হয়নি তাকে।রায়হান সাহেব ছলছলে চোখে তাকিয়ে আছেন মিমের মুখের দিকে।তার বারবার মনে হচ্ছে।মিমকে ছোটো ছেলের বউ করে একদমই ভুল করেনি সে।ইমান ওর খাওয়া শেষ করে মিমের হাত ধরে বলে,
– চলো আমি ও যাচ্ছি।নাহলে তোমার কষ্ট হবে একা একা বাগান বাড়ি যেতে।মিম মন খারাপ করে বলে,
– আপনি খাওয়া ছেড়ে উঠে এলেন যে? এটা কিন্তু ভালো লাগছে না আমার কাছে।ইমান ওর কপালে চুমু খেয়ে বলে,
– তাতে কি? পরে না হয় দু’জনে খেয়ে নিলাম একসাথে? ইশান দু’জনের ঘনিষ্ঠতা দেখে রেগে গিয়ে উঠে যায় খাবার টেবিল থেকে।ও হয়তো বুঝতে পারেনি,ওদের বিয়ে টা শুধু লোক দেখানো নয়।ইমান ওর কথায় বিয়ে করেনি ওকে।মিম ইমানকে অনুরোধ করে বলে,
– আপনি খেয়েনিন।আমি কিন্তু সত্যি একা একা ভয় পাচ্ছি না মায়ের কাছে যেতে।রায়হান সাহেব ছেলের হাত ধরে বলে,
– তুই খেয়ে নে বাবা।আমার তো শেষ আমি যাচ্ছি ওর সাথে? ইমানের তবু্ও মন মানলো না,ও মিমকে পৌঁছে দিয়ে আসলো বাগান বাড়ির গেটে।
#কর্নেল_সাহেব
লেখিকা সুরিয়া মিম
পর্ব- ১