#নয়নতারা_১৯
#জেরিন_আক্তার_নিপা
এদিকে নয়নকে ছাড়া নক্ষত্রর দিনও যে ভালো কাটছিল তা না। সে-ও নয়নতারাকে প্রতিটা মুহূর্তে মিস করে যাচ্ছে। বাড়িতে এক সেকেন্ড তার মন টিকছে না। ঘরে এলেই মনে হয় এই ঘরে তারা না থাকলে সে নিজেও থাকতে পারবে না। ঘরের প্রতিটা জিনিস জুড়ে তারার অগণিত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পরীক্ষার জন্য তারাকে গিয়ে নিয়ে আসতে পারছে না। বিয়ে, বেড়ানো, প্রতিশোধ নানান চিন্তায় পড়াশোনা লাটে উঠেছে। সে যে এবছর ডাক্তারি পরীক্ষায় বসবে তা ভুলেই বসেছিল। নক্ষত্র নিজেকে বুঝায়।
—-কয়টা দিন নাহয় কষ্ট কর। মন দিয়ে পরীক্ষা গুলো দে। তারপর তারাকে গিয়ে নিয়ে আসিস। ও মেয়ে বাড়িতে থাকতে তোর পড়া হবে না বাপ। ওকে সামলিয়েই দিন কাটবে। তখন আবার ফেল মারলে কপালে দুর্গতি আছে। বউকে সারাজীবন খাওয়াবি কী? নিজেই বা কী খাবি? ভালো রেজাল্ট করে পায়ের তলার মাটি মজবুত কর। তারপর যা ইচ্ছা তা কর।’
নক্ষত্র নিজের সাথে কথা বলতে বলতেই ফোন বেজে উঠে। ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকায়। ওর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। মেয়েটা বেঁচে থাকবে অনেকদিন। ওর কথা বলতে বলতেই কল এলো। দীর্ঘজীবী হও বালিকা। কল কেটে যাবার আগে তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করে।
—-কী ব্যাপার তারা, কেমন আছো?’
নয়নতারা ওসব কথার ধারের কাছেও গেল না। কাঠকাঠ গলায় বলল,
—-ঝিনুক আপু আপনাকে আসতে বলছে। আজ কি আসবেন আপনি?’
—-আজ! না। আজ, কাল, পরশু, তরশু। আরও চার পাঁচটা দিন সময় পাব না বুঝলে। ঝিনুককে বলে দিও আজ আসতে পারব না আমি।’
নক্ষত্র বলতে যাচ্ছিল কেন সে সময় পাবে না। তার পরীক্ষা চলছে। নয়নতারা আর কিছুই শোনার প্রয়োজন মনে করল না।
—-আচ্ছা রাখছি তাহলে। আমি আপুকে বলে দেব।’
কট করে কল কেটে গেল। নক্ষত্র ফোনের দিকে অসহায় মুখে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়ে এমন কেন? বিয়ের তো অনেক দিনই হলো, এখনো রাগ কমে না? এখনো নক্ষত্রকে দেখতে পারে না।
—-এত রাগ, এত অভিমান নিয়ে বেঁচে আছে কীভাবে এই মেয়ে? এতদিনেও আমাকে ক্ষমা করতে পারল না। ওর বোনটা তো এমন ছিল না।”
ইলার কথা মনে হতেই নক্ষত্রর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। ইলাকে ভালোবেসেছিল সে। যতই মুখে বলুক ইলাকে এখন ভালোবাসে নক্ষত্র। ঘৃণা করে। প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু মনের মধ্যে যে অনুভূতি ছিল তা কি এত সহজে মুছে ফেলা যায়? ইলা তো তার প্রথম ভালোবাসা ছিল। প্রথম ভালোবাসা কি এত সহজে ভুলা যায়।
—-স্বার্থপর বেইমান, যেখানেই থাকিস তুই, মরার একদিন আগে হলেও তোর থেকে প্রতিশোধ নিবই আমি। তোর উপর প্রতিশোধ না নিয়ে আমার মৃত্যু নেই। জীবনের শেষ দিনেও তোকে ক্ষমা করব না আমি। তোর জন্য আমি যতটা কষ্ট পেয়েছি, ঠিক ততটা কষ্টই তোকে ফেরত দেব। তোর কারণে তারাও কম কষ্ট ভুগেনি। সুদে আসলে বদলা নেব। যেই গর্তেই লুকিয়ে আছিস খুব শীঘ্রই তোকে গর্ত থেকে টেনে বের করব।”
নক্ষত্র আর বইয়ে মন দিতে পারল না। ইলার কথা মনে হয়ে মনটা বিষিয়ে উঠেছে।
এদিকে নয়নতারা ফোন বিছানায় ছুড়ে ফেলে ফোপাঁতে লাগল। রাগে নাকি কষ্টে বুঝতে পারছে না সে। এতদিন সে বাবার বাড়ি চলে আসতে চাইলে লোকটা আসতে দিত না। ভয় দেখিয়ে আটকে রাখত। এখন সে এসে পড়ায় যেন লোকটা বেঁচে গেছে। দিয়ে গিয়ে এখন আর এসে নেওয়ার নাম নিচ্ছে না।
—-যাব না আমি। আর কখনও ওই বাড়িতে ফিরব না।”
এতদিন হয়ে গেল জামাই মেয়েকে রেখে গিয়ে আর আসছে না। এই ব্যাপারটা বাড়ির সবাইকে ভাবাচ্ছে। নয়ন কি রাগটাগ করে একেবারের জন্য চলে এসেছে? নইলে নক্ষত্র নিজেও কয়দিন থাকতে আসত। বা না থাকলেও নয়নকে এসে নিয়ে যেত।
নয়নতারা এমনিতেই বিরক্ত। তার উপর সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আরও বিরক্ত হয়ে উঠেছে। চাচীর কথায় সে ফোঁসে উঠেই বলল,
—-তোমাদের বাড়িতে এসেছি। দয়া করে থাকতে দিচ্ছ। এখন যদি মনে করো আমি তোমাদের উপর বোঝা হয়ে বসে আছি তাহলে বলে দাও। আমি চলে যাব।”
—-তুই অত রেগে যাচ্ছিস কেন রে নয়ন? আমি কি খারাপ কিছু বলেছি?”
—-ভালোও তো বলছো না। এটা আমার বাড়ি না? এই বাড়িতে আমি দুই তিন সপ্তাহ এসে থাকতে পারব না! তারজন্য তোমাদের সবার কাছে জবাবদিহি করতে হবে কেন আমাকে? তোমাদের সবার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি তোমাদের উপর কত বড় বোঝা। আমাকে বিদায় করতে পারলেই শান্তি তোমাদের। বারবার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এক কথা জিজ্ঞেস করছ, জামাই কেন আসছে না। যেন এই বাড়িটা ওই লোকের। আর আমি ভেসে এসেছি। তোমরা চাও তো ওই লোক এসে আমাকে নিয়ে যাক? এটাই চাও তো? আচ্ছা চলে যাব আমি। সারাজীবন পড়ে থাকব না তোমাদের বাড়িতে। এবার খুশি?’
এটুকু বলেই নয়নের গলা ধরে এলো। বড় অভিমান হচ্ছে তার। বিয়ের পর স্বামী ছাড়া বাবার বাড়ি এসেও মেয়েরা শান্তিতে থাকতে পারে না। সবাই ভেবে নেয় মেয়ে জামাইয়ের মধ্যে গণ্ডগোল হয়েছে। নয়নের চোখ ভিজে আসছে। তার দুঃখ কেউ বুঝে না। তার মনে কী চলছে এটা কেউ জানে না। এমনিতেই কি কম কষ্ট পাচ্ছে সে? বাড়ির লোকেরা নক্ষত্রর কথা তুলে কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। নয়ন সব সময়ই অবুঝ ছিল। ওর কথায় চাচী রাগ করেন না। বরং ওকে কাঁদতে দেখে স্নেহভরে হেসে ওর মাথায় হাত রেখে বলেন,
—-পাগল মেয়ে! কাঁদছিস কেন? এটা তো তোরই বাড়ি। এই সারাজীবন এখানে থাকলেও কারো আপত্তি হবে না। বরং নিজের মেয়েকে কাছে পেয়ে আমরা আরও খুশিই হবো। কিন্তু মা রে, জামাইকে ছাড়া একা আছিস তো, ও বেচারা তোর উপর রাগ করলেও হয়তো বলতে পারছে না। তোর চাচা, বাবাদের দেখিস না। বউদের একটা দিনের বেশি বাবার বাড়িতে থাকতে দেয়? আমাদের দেখেছিস কখনও তোর চাচাকে রেখে কোথাও গিয়ে কয়টা দিন থেকেছি?”
চাচীর কথা শুনে নয়নের কান্না আরো বাড়ে। চাচা থাকতে দেয়না বলে চাচী থাকতে পারে না। কিন্তু নক্ষত্রই তো তাকে এসে দিয়ে গেছে। এখন আর নিতে আসছে না। তাদের বিয়ে স্বাভাবিক ভাবে হয়নি তাই নক্ষত্র তার প্রতি এরকম উদাসীন। আপুর সাথে বিয়ে হলে এরকম হতো না। উনি আপুকে ভালো রাখতেন। আপুকেই তো পছন্দ হয়েছিল উনার। নয়নের কান্নায় হেঁচকি উঠে যায়।
ঘরে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে বালিশে মুখ চেপে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে বুল ভাসিয়ে দেয়। চোখ মুখ লাল করে ফুলিয়ে ফেলে।
—-ওরকম একটা মানুষের জন্য আমি কেন কষ্ট পাই? কেন এত কষ্ট হয় আমার? এরকম কেন হয়? আমি তো সব সময় এটাই চেয়েছিলাম। চলে আসতেই চাইতাম। এখন যখন এসে পড়েছি তাহলে কেন ওবাড়ির জন্য মন খারাপ হয়? কেন লোকটার কথা এতো মনে পড়ে?”
চাচী হয়তো বাড়ির সবাইকে বলেছে। তারপর দিন থেকে নয়নকে আর কেউ কিছু বলেনি। ভুলেও একটিবার নক্ষত্রর কথা কেউ জিজ্ঞেস করেনি। নয়ন নিজের মতো থাকছে খাচ্ছে।
সেদিন সন্ধ্যায় নক্ষত্র এসে হাজির। লোকটার উপর নয়নের এত রাগ জমেছে যে, ও নক্ষত্রর সামনেই গেল না। ঝিনুক কত ডাকল। হাত ধরে আড়ালে টেনে নিয়ে কত ধমকাল। চোখ পাকিয়ে নক্ষত্রর কাছে যেতে বলল। নয়ন যায়নি। ঝিনুকর আপুর রাগের পরোয়াই করল না। যে লোক তাকে কষ্ট দিতে পারে সে-ও সেই লোককে এড়িয়ে চলতে পারে। তার অত কিসের ঠেকা?
—-নয়ন চড় খাবি তুই আমার হাতে। নক্ষত্র বেচারা কতক্ষণ ধরে একা বসে আছে। মুখে না বললেও চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে শুধু তোকেই খুঁজছে। যা না একবার ওর কাছে। না বসলি, দেখা করে তো আয়।’
—-তুমি গল্প করছো তো আপু। আমি গিয়ে কী করব? তার থেকে ভালো তুমিই খাইয়ে দাইয়ে উনাকে বিদায় করো।’
—-থাপ্পড় কিনে কালা বানিয়ে ফেলব নয়ন। আমি ওর বউ? আমার অত দায় কিসের? যদি মন চায় তুই নিজে যা। নইলে নাই। বাদ দে বাবা। আমিও পারব না।’
নয়নের রাগ হলো।
—-আপু! উনি না তোমার ভাই! তুমি না ভাই বানিয়েছ।’
ঝিনুক যেন নয়নের সাথে রসিকতা করছে।
—-আপু উনি না তোমার স্বামী। তোমার না উনার সাথে বিয়ে হয়েছে। তুই যদি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে থেইথেই করে ঘুরে বেড়াতে পারিস তাহলে আমার অত ঠেকা কেন? আমি আমার চাকর না। ফাজিল মেয়ে বলে কিনা খাইয়ে দাইয়ে বিদায় করে দাও। ওই ও কি বাড়িতে খেতে পায় না? না খেয়ে আছে অতদিন ধরে? তাই তোদের বাড়িতে আজ খেতে এসেছে?”
বাধ্য হয়ে নয়নকে নক্ষত্রর সাথে যেতে হলো। নক্ষত্রর চোখ নয়নকেই খুঁজছিল। থমথমে মুখে নয়ন ঘরে এলে নক্ষত্র স্বস্তির শ্বাস নিল।
—-কেমন আছো তারা?”
—-ভালো। আমার খারাপ থাকার তো কোন কারণ নেই।”
—-হ্যাঁ। বাবার বাড়িতে আছো এখন একটু বেশিই ভালো থাকার কথা।”
নয়ন এই কথার মানে বুঝল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। নক্ষত্র ওকেই দেখে যাচ্ছে। লুকিয়ে চুকিয়ে না। সরাসরি দেখছে সে নয়নকে। এই মুখটাকে সে এতটা মিস করেছে! ভাবা যায়? এই মুখ দেখার জন্য চোখ ব্যাকুল হয়ে ছিল। অমন বোকা বোকা কথা, অকারণ রাগ, ঘাড় ত্যাড়ামি জেদ এসবের জন্য মন অস্থির হয়ে উঠেছিল। এই মুহূর্তে সে নিজেকে সুস্থ মনে করছে। এতদিন যেন তার ভীষণ বাজে একটা রোগ হয়েছিল। কোন ঔষধেই সারছিল না। এখন এই মুখটা দেখে ওই রোগ পুরোপুরি সেরে গেছে।
নক্ষত্র নিজেকে শাসায়।
—-পাগল হয়ে গেছিস তুই নক্ষত্র! কাকে নিয়ে ভাবছিস তুই? কার জন্য এসব ফিল করছিস! এই মেয়ে তোর অস্থিরতা বুঝবে? তোর অনুভূতির মূল্য দেবে? সবথেকে বড় কথা, তুই নয়নের জন্য এরকম ভাবনা মনে আনতে পারিস না। ওকে তুই মুক্ত করে দিবি। নিজের সাথে বেঁধে রেখে ওকে কষ্ট দেওয়ার কোন অধিকার তোর নেই। সময় থাকতে মনকে বোঝা। সর্বনাশ হয়ে যাবার আগে সামলা নিজেকে। তোর বোনের থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ওকে বিয়ে করেছিস তুই। ভালোবাসার জন্য বা সংসার করার জন্য না।’
নক্ষত্র আজ নয়নকে নিতেই এসেছিল। কিন্তু সাহস করে এই কথাটা নয়নকে বলতে পারল না। নয়ন যদি মুখের উপর না করে দেয়। বলে আমি যাব না। আপনি চলে যান। তাই নক্ষত্র ঠিক করল আজ এখানেই থেকে যাবে সে। বাড়ির সবাইও অনেক সাধাসাধি করছে। ওদের এতো করে বলার পরও নক্ষত্রর যাওয়ার ইচ্ছে হলো না।
—-আপনি আজ থাকবেন?”
—-হ্যাঁ। কেন তুমি চাও না আমি এখানে থাকি?”
—-আমার না চাওয়ার কী আছে? এটা আপনার শ্বশুরবাড়ি। আপনি এখানে থাকতেই পারেন।”
নক্ষত্র আর কিছু বলল না। নয়ন যা সাঙ্ঘাতিক মেয়ে। বলে বসতে পারে, আমাদের বাড়িতে আপনি থাকবেন কেন? চলে যান এক্ষুনি। নয়নতারা মনে মনে বলল,
—-সবার সামনে কত ভালো সাজছে। সবার মন রাখার জন্য থেকেও যাচ্ছে। সব ভালো অন্যের সামনে। নাটক তো ভালোই পারেন।”
নক্ষত্র আকিবের সামনে তেমন একটা পড়তে চায় না। আকিব বেচারার অপরাধী সে। আকিব নয়নকে পছন্দ করত। এই কথা নক্ষত্রও জানত। তারপরও সে নয়নকে বিয়ে করে আকিবের স্বপ্ন, ভালোবাসা, মন, আশা, ভরসা সব ভেঙে দিয়েছে।
চলবে___