শিশিরের বিন্দু পর্ব ১৩

শিশিরের বিন্দু
১৩ তম পর্ব

বিন্দুর রাগে শরীর ফেটে যাচ্ছিল সারা রাত এই লোকের সাথে থাকবে কি করে! কিন্তু উপায় ও তো নেই নিজেদের জন্য অন্য কাপলদের কেন কষ্ট দেবে৷ বিন্দু বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুল মুছতে লাগল। শিশির ওর ব্যাগপত্র নিয়ে সোজা চলে এলো বিন্দুর রুমে। বিন্দু চোখ কুঁচকে শিশিরের দিকে তাকাতেই শিশির ঢোক গিলে বলল,
___ “কি ব্যাপার এমন করে চেয়ে আছো যেন আমি একটা তেলাপোকা “।
___ ” আপনি এখনও গোসল করেন নাই?”
বিন্দু চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করল। শিশির ব্যাগ থেকে কাপড় বের করতে করতে বলল,
___ ” সালার সবাই মিলে গোসল টা করতে দিল কই আমারে? এই রুম ওই রুম করতে করতে তো সুযোগই পেলাম না গোসলের! ”
___ ” যান যান গোসল করে আমারে উদ্ধার করেন “।
বিন্দু ড্রেসিং টেবিলের দিকে ফিরে বলল। শিশির একদম বিন্দুর পিছনে যেয়ে টাওয়াল হাত থেকে নিয়ে নিল বিন্দুর। বিন্দু টাওয়ালের এককোনা ধরে বলল,
___ ” আপনি এই টাওয়াল নিচ্ছেন কেন?”
___ ” এতে যে তোমার চুলের মাতাল করা ঘ্রান আছে সেই ঘ্রানটা খুব দরকার আমার।”
শিশির ফিসফিসিয়ে বলল। বিন্দু গতি ভাল না দেখে টাওয়াল ছেড়ে দিল৷ শিশির মুচকি হেসে বলল,
___ ” আমি কিন্তু সিরিয়াসই বলেছিলাম “।
___ ” যতসব “।
বিন্দু নাকমুখ কুঁচকে বলল। শিশির হাসতে হাসতে শাওয়ার নিতে গেল। শিশির যখন শাওয়ার নিয়ে বের হল তখন বিন্দু খাটের পাশের ফ্লোরে বসে ওর কাপড় গুছিয়ে ব্যাগে রাখছিল। টাওয়াল পরা শিশিরকে দেখে ওর বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। ভেজা শরীরে মুক্তর দানার মত পানির ফোঁটা লেগে আছে। মাথার চুল গুলো এলোমেলো। বুকের পশমগুলো লেপ্টে আছে বুকের সাথে। হাতে পায়ের পশমগুলোও সেই মাপের লাগছে। আসলে আগে কখনও শিশিরকে এভাবে ও দেখে নি। বিন্দু যেন চোখই ফেরাতে পারছে না। হঠাৎ শিশিরের চোখে চোখ পড়লো ওর শিশির হেসে বলল,
___ ” অমন করে চেয়ে থেকো না সুন্দরী প্রেমে পড়ে যাবা।”
___ ” লাজ শরম কিছুই নেই খালি গায়ে ঘুরতেছে এভাবে “।
বিন্দু মুখ বাঁকিয়ে বলল।শিশির একদম বিন্দুর সামনে এসে দাঁড়ালো বিন্দু তাড়াতাড়ি উঠতেই শিশির দেওয়ালের সাথে দুই হাত দিয়ে বিন্দুকে মাঝে রেখে আটকালো। বিন্দুর চোখে চোখ রেখে বলল,
___ ” বউয়ের সামনে লজ্জা কিসের।”
বিন্দুর গাল লাল হওয়া শুরু করল লজ্জায়। শিশির বিন্দুর একদম কাছে মুখ নিয়ে এলো। বিন্দু ভয়ে দেয়ালের সাথে সেধিয়ে যেতে লাগল। শিশির হেসে বলল,
___ ” জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার মধ্যে মজা নেই যদি সেচ্ছায় কেউ দেয় তা নেওয়ার মাঝে যে সুখ জোরে সেটা নেই। বিন্দু সত্যিই ভালবাসি তোমাকে কখনও আর ছাড়তে পারব না তোমাকে “।
___ ” আমি মেনে নিলেও ফ্যামিলির কেউ মানবে না।”
___ ” আমি মানিয়ে নেবো। না হয় তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব। যেখানে শুধু তুমি আর আমি “।
___ ” এসব তিনবছর আগে ভাবলে হয়ত আর আজকের এই দিন দেখা লাগত না “।
___ ” ভুল মানুষই করে আবার সেই ভুল মানুষই শুধরায়। দেও না প্লীজ আর একটি বার সুযোগ। প্লীজ বিন্দু”।
শিশির বিন্দুর কোমরে হাত দিয়ে ওকে আরো নিজের কাছে টেনে নিয়ে এলো। বিন্দুর চোখ ছলছল করতে লাগল। ওযেন দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে তবে কি ভালবাসার কাছে নিজের বিবেক হেরে যাবে। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়লো যেন কেন। শিশির তাড়াতাড়ি বিন্দুকে ছেড়ে দিল। বিন্দু চোখ মুছে দরজা খুলতেই দেখলো তুলি দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো শিশির টাওয়াল পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। তুলি হেসে বলল,
___ ” বিন্দু তোমাদের একদম মিয়া বিবির মত লাগছে। কাজী ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দেই? ”
___ ” ভাবি তুমিও না খালি মশকরা করো। যে যার বরের সাথে যেয়ে আমারে এই নন্দকিশোরের কাছে রেখে গেছ আর এখন মশকরা করতেছ।”
বিন্দু বিরক্ত হয়ে বলল। তখন তুলি তাড়াতাড়ি বলল,
___” রাতে বাইরে যাব না খেতে রুমেই খাব। আর কালকে ট্রেন দিল্লীর তাই তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে।”
___ ” আচ্ছা ভাবী সমস্যা নেই। ”
তুলি চলে যেতেই বিন্দু ঘুরে দেখলো শিশির একটা শর্টস আর টিশার্ট পরে টিভি ছেড়ে দিয়ে বসেছে। বিন্দু সোজা বাংলায় বলল,
___ ” আমি এখন ঘুমাবো টিভি বন্ধ।”
___” বাজে মাত্র ৬ টা এখনই ঘুমাবে, তুমি ডিনার করবে না “।
তখন বিন্দু শিশিরকে বলল, তুলি কি কি বলে গেছে। শিশির ফোনে ওর আর বিন্দুর জন্য বিরিয়ানীর অর্ডার করল আরসালান থেকে। শিশির টিভি দেখতে দেখতে বলল,
___ ” নেটে অনেকবার দেখেছি আরসালানের মাটন বিরিয়ানী নাকি হেব্বি টেষ্ট।”
___ ” আমার এত সময় নাই যে কোথার কি টেষ্ট তা খুঁজে বেড়াবো। ”
বিন্দু কাটা কাটা উওর দিল। শিশির হেসে মনে মনে বলল, আসলেই এই মেয়েকে বুঝানো মিশন ইমপসিবল এর মতই। বিরিয়ানি আসতেই ওরা খেয়ে নিল। এমনকি বিন্দু পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হল যে বিরিয়ানী সত্যিই টেষ্ট ছিল অনেক। পরের দিন চারটা পঞ্চাশে ওদের ট্রেন আবার ট্রেন ধরার আগে কলকাতায় বেশ কিছু কাজও আছে ওদের তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো সবাই। রুমে খাট একটাই কিন্তু খাট বিশাল বড়। বিন্দু খাটের এক কোনায় শুয়ে পড়লো। শিশির সিগারেট ধরাতেই বিন্দু কোন কথা না বলে সোজা শিশিরের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে ছিঁড়ে ওয়েষ্ট বাস্কেটে ফেলে দিয়ে শুয়ে পড়ল। শিশিরও কথা না বাড়িয়ে চুপ চাপ খাটের আরেক কোনায় শুয়ে পড়ল। গতকালের সারারাত থেকে আজ পর্যন্ত জার্নির কারনে এমনিতেই শরীর খুব ক্লান্ত। তাই শোয়ার সাথে সাথেই শিশির ঘুমিয়ে পড়লো। বিন্দু শুয়ে শুয়ে ফেসবুক স্ক্রল করতে লাগল। পাশে ভারি নিঃশ্বাসের শব্দে বুঝতে পারল যে শিশির ঘুমিয়েছে। ওর কম্বল শিশিরের গায়ের উপরে ভাল করে টেনে দিল। কিছুক্ষন পরে বিন্দুও শুয়ে পড়ল।

পরের দিন বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙল শিশিরের। কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভাঙার পরে ওর কেমন জানি লাগতে লাগল। হঠাৎ টের পেল বুকের কাছে এক কোমল উষ্ণতার। তাকিয়ে দেখে বিন্দু ওর বুকের সাথে একদম লেগে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে৷ কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন ওর হৃদপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে দিল। বিন্দু শিশিরের বুকের সাথে লেগে বেঘোরে ঘুমিয়ে আছে। এক মূহুর্তের জন্য মনে হল শিশিরের ও যেন স্বর্গের বাগানে আছে। আস্তে করে বিন্দুর পাশ থেকে সরে ঘড়ি দেখলো প্রায় বারোটার কাছাকাছি বাজে। শিশির অবাক হয়ে ভাবল এতো দুপুর হয়ে গেছে আবির বা বিপ্লব কেউ ডাকলো না কেন ওদের। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে শিশির বিন্দুকে ডাকতে লাগলো,
___ ” এই শুনছো ওঠো তাড়াতাড়ি অনেক বেলা হয়ে গেছে! ”
___ ” উউউউউহু আমি আরো ঘুমাব”।
বিন্দু ঘুমু ঘুমু স্বরে বলে উঠল। বিন্দুর ওই ভয়েস শুনে শিশিরের কেমন জানি পাগল পাগল লাগতে লাগল। এখনই এখান থেকে চলে যেতে হবে ওর না হলে ঝামেলা। ও বের হয়ে আবিরদের রুমে নক করল। বেশ কিছুক্ষন পরে আবির চোখ ডলতে ডলতে বের হল। শিশির অবাক হয়ে বলল,
___ ” কি রে তুই এখনও ঘুমাচ্ছিস?”
___ ” এত সকাল সকাল উঠে করবটা কি? ”
অবাক হয়ে আবির শিশিরকে প্রশ্ন করল৷ শিশির আবিরের মাথায় গাট্টা দিয়ে বলল,
___ ” সালা ১২ঃ১০ বাজে “।
আবির তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ভাল করে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই এত বেলা হয়ে গেছে। আবির চলল নিনাকে ডাকতে আর শিশির গেল বিপ্লবদের রুমে। গত কালের জার্নির ধকলে সবাই এত মরার মত পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। শিশির বিপ্লবকে উঠিয়ে এসে রুমে ফিরে দেখে বিন্দু তখনও ঘুমাচ্ছে। এবার শিশির বিন্দুর ঘাড়ে ধরে জোরে ধাক্কা দিয়ে বলল,
___ ” ঠিক আছে তুমি ঘুমাও আমরা যাচ্ছি দিল্লী।”
একথা শুনে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো বিন্দু। সবাই ফ্রেশ হয়ে পাশেই মোঘল রেস্টুরেন্ট এ চলল ব্রেকফাস্ট + লাঞ্চ করতে। মেনু দেখে সবাই কনফিউজড খাবেটা কি। পরে বিপ্লব বলল,
___ ” শোন এক কাজ করি সবাই থালি সিস্টেমে খাবার নেই। এতে অনেক ভ্যারাইটি টেষ্ট করতে পারব “।
প্লান মন্দ না তাই সবাই থালি অর্ডার করল। কিন্তু অবস্থা বেগতিক কালকের মতই সব মিষ্টি মিষ্টি। নিনা মেজাজ খারাপ করে বলল,
___ ” এটা মিষ্টি কুমড়ার ছক্কা না বলে মিষ্টি কুমড়ার পায়েশ বললে ভাল হত “।
___ ” কিন্তু আলুর ঝুরি ভাজিটা হেব্বি মজা হয়েছে “।
তুলি আবার প্রশংসা করে বলল। বিপ্লব তখন ওদের থামিয়ে দিয়ে বলল,
___ ” তাড়াতাড়ি খাও ৪ঃ৫০ এ ট্রেন সে খেয়াল আছে তো “।
খাওয়া শেষে ওরা হোটেলে ফিরেই গোছ গাছ শুরু করল। হোটেল থেকে বের হতে কমলা কালারের এম্বাসেডর যেটা কি না কলকাতার ঐতিহ্য ওরা সেই ট্যাক্সি ভাড়া করল দুইটা শিয়ালদহ রেলস্টেশন পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। রেল স্টেশনে আসতে আসতে প্রায় সাড়ে চারটার কাছাকাছি বেজে যায় অদের। কমলা আর ক্রিম কালারের বিশাল বিল্ডিং টাই হল শিয়ালদহ স্টেশন। ট্যাক্সি থেকে নেমেই ওরা চলল ট্রেনের ইনফরমেশন নিতে। দেশে থাকতেই কলকাতার পরিচিত একজন দিয়ে ট্রেনের টিকিট বুকিং দিয়েছিল আবির। বাংলাদেশের যেমন নিচতালায় টিকেট কাউন্টার কিন্তু শিয়ালদহতে তিনতালা টিকেট বুকিং কনফার্মেশন আর ইনফরমেশন কাউন্টার। তাই শিশির আর আবির গেল তিনতালায় খোঁজ নিতে আর বাকিরা নিচে দাঁড়ালো। ওদের ট্রেনের নাম রাজধানী এক্সপ্রেস।যেটা ডাইরেক্ট দিল্লি টু কলকাতা চলাচল করে। আর ট্রেন এক্কদম টাইমে ছিল ওদের। আবির আর শিশির ফিরতেই ওরা চলল ওদের নিদিষ্ট প্লাটফর্ম এ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ওদের ট্রেন………….

চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here