আসক্তি ২ পর্ব ৩+৪+৫

#আসক্তি২ (আ জার্নি অব্ এডিকশান)
পর্বঃ০৩
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

পাখি ইনায়াহ্’র ঘরে গিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পরে।পরমূহূর্তে কি হবে বা কি করবে সে নিজেও জানে না।দূঃচিন্তায় মাথা যেন ফেটে যাবার উপক্রম।অন্যদিকে শানের বাজে ব্যবহার তাকে আরো দ্বিগুন ভাবাচ্ছে।
“এই নতুন বউ, তুমি ফ্রেশ হও।চলো নাস্তা করবে।আমার সান সাইন আমার জন্যে অনেক অনেক রান্না করে। জানো?….. ”
“ইনায়াহ্”
“হুমম”,গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জবাব দেয় ইনায়াহ্।পাখির হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলছে সে।
“তোমার মা কোথায়?”
“জানি নাহ।সান সাইন বলেছে মা নাকি আমাদেরকে রেখে কোথাও বেড়াতে গেছে।আর যারা নাকি সেখানে যায় তারা আর কখনো ফেরে না।”,মুখটা গম্ভীর করে জবাব দেয় ইনায়াহ্।

পাখির বড্ডো মায়া হয় ইনায়াহ্’র কথা শুনে।হাত টেনে নিজের একদম কাছে টেনে নেয়।
“মন খারাপ করে না বাবু”,বলেই ইনায়াহ্’র কপালে চুমু এঁকে দেয়।
“মে আই কল ইউ মুন সাইন!”
ভ্রুকুচকে পাখি হেসে ফেলে।
“মুন সাইন!”
“হুমমম”
“আচ্ছা বলিও”
“এবারে তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও”
পাখি ভাবনায় পরে যায়।
“ফ্রেশ তো হওয়া দরকার কিন্তু গায়ে দিবো কি?কোন ড্রেসই তো নাই আমার?”
“এই মুন সাইন, কি ভাবছো তুমি?”,পাখির গা ঝাকিয়ে বলে ইনায়াহ্
ইনায়াহ্’র ডাকে চমকে ফিরে পাখি বলে,”কি পরব?”
মুখে আঙ্গুল ঠেকিয়ে ইনায়াহ্ ভাবনার ভঙ্গিতে বলে,”তাই তো!”
কিছু একটা ভেবে ইনায়াহ্ বলে,”ওয়েট হেয়ার।আমি আসছি”
মুচকি হাসি দিয়ে পাখি ঠাঁয় বসে থাকে।ইনায়াহ্ দ্রুত সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে।
“আস্তে মাম”,বলতে বলতে শান টেবিলে নাস্তা রেডি করতে থাকে।
“সান সাইন, মুন সাইনের ড্রেস লাগবে”
শান ভ্রুকুচকে বলে,”মুন সাইন!”
“হুমম ঐ নতুন বউ।ওর ড্রেস লাগবে।আমার গুলো তো ওর গায়ে হবে না।তাই না?”
শানের কুচকানো ভ্রু জোড়া সোজা হয়ে যায় মূহূর্তেই।
চাপা রাগ ভেসে ওঠে চোখে মুখে।

🌸🌸
“তোমার মুন সাইনকে দিয়ে দাও মাম “,দরজার আড়াল থেকে ডেকে ইনায়াহ্’র দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দেয়।ততোক্ষনে পাখি চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে পূনারায় বিছানায় এসে বসে।ইনায়াহ্ দ্রুত সেটা এনে পাখির হাতে ধরিয়ে দেয়।হাত বাড়িয়ে পাখি সেটা নিয়ে খুলে বুঝতে পারে ভিতরে একটা শাড়ি।উল্টেপাল্টে বুঝতে পারে এটা কারো ব্যবহৃত ;যা এখন অব্যবহৃত অবস্থায় হয়ত কাবার্ডের এককোণে পরে ছিলো।উপয়ান্তর না পেয়ে পাখি ইনায়াহ্’র থেকে টাওয়াল নিয়ে গোসলের উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমে চলে যায়।

🌸
শান ইনায়াহ্ সহ ডায়নিং এ নাস্তা করছে। আপনমনে রুটির টুকরো মুখে পুরছে শান। আর টেবিলের উপর রাখা ফোনটা স্ক্রল করছে।
“সান সাইন,আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।তুমি খাইয়ে দাও”,টেনে টেনে বলে ইনায়াহ্।
“আমি একটু কাজ করছি মা। কষ্ট করে খেয়ে নাও”,ফোনের দিকে চেয়ে অনুনয়ের স্বরে বলে শান।
“আসো আমি খাইয়ে দিই”,গলা নামিয়ে বলতে বলতে পাখি সিঁড়ি দিয়ে নেমে টেবিলের কাছে চলে আসে।
পাখির কথায় শান মাথা তুলে তাকায়।

সদ্য গোসল নেয়া চুল গুলো টাওয়ালে প্যাঁচানো। সামনে ঝুঁকে পরেছে কয়েকটা অবাধ্য চুল।যার আগায় পানির ফোটা আটকে আছে নির্দ্বিধায়।হালকা পাতলা গড়নে চাপা গায়ের রংটা যেন বেশ মানিয়েছে। পরিচিত শাড়ি পরিহিত অপরিচিত স্নিগ্ধ রমনি।শানের চোখ আটকে যায়। অপলক চেয়ে থাকে সেদিকে।শাড়ির দিকে ভালো করে নজর পরতেই চোখ দুটো মূহুর্তেই বন্ধ করে নেয় শান।রাগে চোয়াল শক্ত করে পূনরায় তাকায় পাখির দিকে।

শানের দিকে একবার চেয়ে পাখি অপ্রস্তুত হয়ে যায়।এদিক সেদিক নজর বুলিয়ে আঁচল টা ঠিক করে নিয়ে ইনায়াহ্’র দিকে হাত বাড়ায়।ইনায়াহ্’র চোখে মুখে ফুটে ওঠে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি।প্লেট টা বাড়িয়ে দেয় পাখির দিকে।পাখি হাস্যোজ্বল মুখে প্লেটটা নিয়ে খাওয়াতে শুরু করে।ইনায়াহ্ দৌড়ে ছুটে যায় বাহিরে।
“ইনায়াহ্”,বলেই পাখি পিছনে যেতে শানের ডাকে থমকে যায়।
“দাঁড়াও ”
“না জানি আবার কি অপমান করে বসিয়ে রাখে”,বিড়িবিড় করে বলে পাখি।
শান চেয়ার ছেড়ে পাখির পিছনে এসে দাঁড়ায়।
“টার্ণ ব্যাক”
শানের কথায় এবার পিছনে ফিরে পাখি।চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে হাতে রাখা প্লেটের দিকে তাকায়।
“কারো ব্যাকসাইড দেখে কথা বলার কোন ইন্টারেস্ট আমার নাই।বাই দ্য ওয়ে,যা করছি আমার সব ইনায়াহ্’র জন্যে করছি।একটু পরে ড্রেস আসবে। শাড়িটা রিটার্ণ চাই এন্ড ফাস্ট।আর নিজের থাকার ব্যবস্থা করো”,বলেই শান পাখির উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে থাকে।
“আমি ককোথায় যযাবো?”,আমতা আমতা করে বলে পাখি।
শান রেগে গিয়ে বলে, “হোয়াট??তুমি কি এখানে পার্মানেন্টলি থাকতে চাইছো?”
মাথা তুলে অসহায় হয়ে তাকায় পাখি।শান আবার বলে,”নো ওয়ে।তোমাকে এখানে কখনো এলাও করব না আমি।”
“আমায় কয়টা দিন একটু হেল্প করুন।আমি রানি মাসির থেকে যোগাযোগ করে ঠিকানাটা যোগার করে চলে যাবো”,বেশ অসহায় ভঙ্গিতে শানের দিকে চেয়ে বলে পাখি।
টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে পাখির দিকে এগিয়ে বলে,”কল হার”
“এই মূহূর্তে তাকে কল করাও সম্ভব না।আমি জানি ঐ বাড়ির সবার ফোন এখন আয়ানের হাতে”
মুখে জগৎের বিরক্তি এনে শান বলে,”হে লিসেন, আই ডোন্ট ওয়ান্না হেয়ার ওব ইওর কক এন্ড বুল স্টোরি। ওকে?তাড়াতাড়ি দূর হবে বাড়ির থেকে”
বলেই শান টেবিল থেকে খাবার গুলো উঠিয়ে কিচেনে রেখে আসে।পাখি অবাক হয়ে যায়, তাকে সৌজন্যতার খাতিরেও একবার খেতে বললো না।

🌸🌸
ইনায়াহ্কে খাইয়ে পাখি বেসিনে প্লেটটা রাখতে যায়।কলিং বেলের শব্দে দরজার দিকে তাকায়।
“দরজা তো খোলাই!”,ভাবতে দ্বিধায় পরে যায়।
“এগিয়ে দেখব নাকি না?আমি তো কেউ না, দেখা টা উচিত হবে?”
চট করে শান কোথাও থেকে এসে পার্সেল নিয়ে আবার ঘরে ঢোকে।
সোফায় বসে ডোরিমন দেখতে থাকা ইনায়াহ্কে উদ্দেশ্য করে শান বলে,”মাম এগুলো ধরো”
“কি এগুলো?”
“ওকে দাও”,গম্ভীর মুখভঙ্গিতে থমথমে স্বরে পাখিকে দেখিয়ে বলে শান।
ইনায়াহ্ পার্সলটা পাখিকে দিয়ে দৌড়ে ছুটে আসে আবার সোফার দিকে।

পাখি পার্সেল খুলে বুঝতে পারে কয়েকটা সালওয়ার কামিজের সেট।ঘরে গিয়ে সংকোচে সেগুলো বের করে শাড়িটা পাল্টিয়ে নেয়।এরপর শাড়িটা ভাঁজ করে নিচে নেমে এগিয়ে দেয় শানের দিকে।
“মিনিমাম সেন্সটুকুও কি নেই?”
পাখি চমকে যায়।বুঝতে পারে না কি করলো সে!
শান আবার বলে,”পরনের জিনিস ওয়াশ করে দিতে হয়।”
ভীষণ অপমানিত বোধ করে পাখি।লজ্জায় চোখের কোণে জল জমে যায়।চিকচিকে জলের কণা গুলো গাল বেয়ে নিচে পরতেই চট করে মুছে নেয় পাখি।
“একটা মানুষ এতো বাজে কিভাবে আচরন করতে পারে!”
শান কটাক্ষের চোখে চেয়ে পাখির পা থেকে মাথা অবধি দেখে শাড়িটা নিয়ে চলে যায়।

🌸🌸
বিকেল হয়ে যায়।শান ল্যাপটপে কাজ করছে বাহিরে বাগানে বসে।ইনায়াহ্ এগিয়ে গিয়ে বলে,”তুমি না আজ অনেক এনজয় করতে চাইলা আর এখন কাজ নিয়ে বসে পরলা?”
শান ইনায়াহ্’র পেটে মাথাটা ঠেকিয়ে বলে, “একটা কাজ পরে গেছে গো মা।তুমি কোথায় ছিলা এতোসময়?”
“মুন সাইনের কাছে”
শান মাথা তুলে আবার কাজে মন দেয়।
“মুন সাইন খায় না কেন? ওর কি ক্ষিদে লাগে না?”
ইনায়াহ্’র কথায় টাইপিং স্টপ রেখে শান চমকে যায়।
“খায় নি?”
“নাহহহ”
পাখির জন্যে সামান্য মানবতাবোধ জাগ্রত হয় শানের। ইনায়াহকে বলে,”তুমি খাইয়ে দিলে খাবে”

ক্ষিদের চোটে চোখ মুখ চুপসে গেছে পাখির।ইনায়াহ্’র ঘরে চুপটি মেরে বসে নিচে শান আর ইনায়াহ্কে দেখছে জানালা দিয়ে।খানিক পরে দৌড়ে এসে ইনায়াহ্ এক প্রকার জোড় করে পাখিকে নিচে নামিয়ে আনে।ছোট ছোট হাতে খাবার বেড়ে প্লেটে সাজিয়ে দেয়।এরপর নিজ হাতে মেখে খাবারের লোকমা পাখির মুখের সামনে ধরে। এতোক্ষন ইনায়াহ্’র কাজ অবাক বিষ্ময়ে দেখে চলছে পাখি।এবার জোড়ে হেসে দিয়ে জড়িয়ে নেয় ওকে।
“হা করো মুন সাইন”
“হাআআ”

🌸🌸
রাত্রেবেলা ইনায়াহ্ শানের কাছে ঘুমাতে চলে যায়।খানিক পর ফিরে এসে পাখির হাত টানতে টানতে তাকেও নিয়ে দাঁড় করায় শানের ঘরের মেঝেতে।
“আজ আমরা একসাথে ঘুমাব”,খুশির রেখা মুখে রেখে বলে ইনায়াহ্
ইনায়াহ্’র কথায় চোখ কপালে উঠে যায় পাখির।শান ওয়াশরুম থেকে বেরোতে বেরোতে ওদের দেখে ভ্রুকুচকে ফেলে।রাগে উঠে যায় চরমে।
“তুমি আমার বেডরুমে….”,চাপাস্বরে পাখিকে ধমক দিতেই ইনায়াহ্ শানের দিকে এগিয়ে হাত টেনে বলে “আজ আমরা একসাথে থাকব সান সাইন”

শান কিছু বলতে পারে না। মুচকি হাসি উপহার দিয়ে ইনায়াহ্কে বলে,”হুমম।তো এবার যাও তো মাম তোমার টেডি টা নিয়ে আসো”
“ওকে”,বলেই ইনায়াহ্ ঘর ছেড়ে চলে আসে।

“দেখলে তো নিজেদের ফর্মে চলে আসতেছো মূহূর্তে মূহূর্তে!”,শানের তেড়ছা কথায় পাখি চমকে তাকায়।
শান পূনারায় বলে,”তোমাদের মতো মেয়েরা বেডরুমেই আসতে চায় ;কারণে -অকারণে।তাই বলে প্রথম দিনেই!হাউ লেইম!”
চোখ মুখ কুচকে দুই পা পিছিয়ে যায় পাখি।ডিকিতে ওঠার মতো ভুলটার জন্যে বার বার নিজেকে দোষারোপ করে চলে।

শান একটু এগিয়ে পাখির ঠোঁটের নিচের তিলটার দিকে আঙ্গুল তাক করে বলে,”প্রমান? এই তিল।সাথে তোমার আচরন।আই হেইট দিজ টাইপ অব পার্সন।ক্যারেক্টারলেস!”,বলেই শান পিছু ফিরে চলে আসতেই পাখি বলে ওঠে,”আমি এখানে আসতে চাই নি।ইনায়াহ্…..”
“হুসসস!একদম ইনায়াহ্’র অজুহাত দেবে না”
“আপনি ওকে তো জিজ্ঞেসা করতে পারেন আমার কথা বিশ্বাস না করতে চাইলে!”
“ও ছোট্ট একটা বাচ্চা।বললো আর চলে এলে?শিখাও আমাকে?লিসেন এই ব্যপারে ইনায়াহ্কে কিচ্ছু বলবে না তুমি।গট ইট!”
পাখি চোখ নামিয়ে নেয় শানের থেকে।
“ও ঘুমানোর সাথে সাথে ঘর থেকে বের হয়ে যাবে।মাথায় রেখো”,বলেই শান ফোন হাতে বিছানার একপ্রান্তে আধশোয়া হয়ে বসে থাকে।

একটু পর ইনায়াহ্ টেডি সমেত ঘরে ঢুকে পাখির কোমড় জড়িয়ে ধরে।শান সেদিকে একবার চেয়ে আবার ফোনের দিকে দৃষ্টি রাখে।
পাখি ইনায়াহকে কোলে নিয়ে শুইয়ে দেয়।
“মুন সাইন,তুমি গল্প পারো?প্লিজ গল্প শুনাও।সান সাইন তো প্রতিদিন শুনায়”
ইনায়াহ্’র কথায় কটাক্ষের চোখে শানের দিকে চেয়ে পাখি ভাবে,”যা বদরাগী লোক সে আবার শুনায় গল্প। হুহহ”

শানের সাথে চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে পাখি গল্প বলতে শুরু করে।

“তোমাদের নারীরা এতোটাই নোংড়া যে পুরো জাতটাকেই ঘৃনা লাগে।সবাই এক তোমরা।নিজের শরীর বিলাতে দ্বিতীয়বার ভাবো না তোমরা।টাকার লোভে সব করতে পারো,সব। ইভেন ঘর-সংসার, সন্তান-সন্তোতি, ভালোবাসার মানুষ সবকিছুকে পিছনে ফেলতে পারো”,দাঁতে দাঁত চিপে শান আপনমনে বলে কথা গুলো।

🌸🌸
ইনায়াহ্ ঘুমিয়েছে কিনা শিওর হতে শান এগিয়ে এসে দেখে।এএরপর ইনায়াহ্কে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিতে নিতে বলে,”আউট”
পাখি লজ্জায়, অপমানে দৌড়ে ঘর ছেড়ে বাহিরে চলে আসে।

চলবে….#আসক্তি২ (আ জার্নি অব্ এডিকশান)
পর্বঃ০৪
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

খুব ভোর বেলা শান উঠে যায়।নিত্যদিনের অভ্যেস যাকে বলে।বাড়ির চারিদিকে তিন রাউন্ড ঘুরে পূনরায় আঙ্গিনার মাঝে দাঁড়ায়।হাফিয়ে উঠে হাটুঁতে দুই হাত ঠেকিয়ে ঝুকে যায় সামান্য।
পাখি আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানায় বসে বসে ভাবে
কতো রাত থেকে এতো শান্তির ঘুম ঘুমায় না সে!
বিছানা থেকে নেমে জানলা খুলতেই শানকে চোখে পড়ে ।গৌড়বর্ণ দেহে সাদা স্যান্ডো গ্যাঞ্জি ঘামে ভিজে একাকার।পরনে কালো ট্রাউজার।
আপন মনে পাখি ভাবতে থাকে,”একটা এতো সুন্দর মানুষের মন কি করে এতো অসুন্দর হতে পারে?কিভাবে বলতে পারলেন আমি ক্যারেক্টারলেস? ”
না জানি আর কতো কিছু সইতে হবে এ জীবনে”

ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ খেয়াল হয় শান উপরে সরুচোখে তাকিয়ে আছে।
“ছিহ, কি ভাবলেন উনি?এমনিই তো কতো কিছু শুনতে হয়েছে একদিনেই।”,ভাবতে ভাবতে পাখি দ্রুত জানলার পর্দাটা সরিয়ে দেয়।
এলোমেলো চুল গুলো বেঁধে হাতে ঢিলে খোপা করে ঘর গুছানো শুরু করে।হঠাৎই পিছনে ছোট্ট দুটি হাতের স্পর্শে থেমে যায় পাখি।
“ইনায়াহ্”
“গুড মর্নিং মুন সাইন।তুমি আমায় রেখে এসেছো কেন?”
পাখি চায় না ছোট্ট বাচ্চাদের সাথে মিছে আচরন করতে। কিন্তু কি করে বোঝাবে ইনায়াহ্কে তারা একঘরে থাকতে পারে না!
“বলো ”
“বেবি,তোমার সান সাইনের ঘরে সারারাত লাইট জ্বালানো থাকে।আর আমি লাইটের আলোয় ঘুমাতে পারি না।তাই… ”
“ওকে ডোন্ট ওরি,তুমি আর আমি এখন থেকে এ ঘরে থাকব”,বলেই ইনায়াহ্ জড়িয়ে ধরে পাখিকে।
পাখিও আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ভাবে,”একদিনে কতো মায়া পরে গেছে মেয়েটার উপর।এমন একটা বাচ্চাকে রেখে কোথায় গেছে ওর মা?মা বাবা ছাড়া জীবন যে কতো কষ্টের তা তো আমি জানি”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পাখি

🌸🌸
পাখি ইনায়াহ্কে সাথে করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে।ড্রয়িং রুম পুরো ফাঁকা।কারণ বাড়িতে বাড়তি মানুষ একদমই নেই।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কোথাও শানকে না পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে পাখি।

আব্দুল্লাহ্ ড্রয়িং রুমে ঢুকে পাখিকে দেখে অবাক হয়ে যায়।ইনায়াহ্ দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,”দাদু, এতোক্ষনে সময় হলো তোমার?”
আব্দুল্লাহ্ ইনায়াহ্কে আদোর করে বলে,”আজ একটু দেরি হলো দাদু ভাই।”
পাখিকে ইশারা করে বলে, “কে ও?”
“ও?ও হচ্ছে মুন সাইন।মানে আমার নতুন গভারনেস”
আব্দুল্লাহ্ এক গাল হেসে পাখির সামনে এসে দাঁড়ায়।
“আমার দাদুভাইকে দেখে রাখবে মা”
ঠোঁট এলিয়ে সৌজন্যের হাসি রেখে পাখি সম্মতি জানায়।
“ও আমায় খুব ভালোবাসে দাদু”

রান্নাঘর থেকে একজন মহিলা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বাহিরে চলে আসে।আব্দুল্লাহ্ তাকে চাবি ধরিয়ে দিয়ে বলে,”চাবিডা তোমার ধারে রাইখো।আর তাড়াতাড়ি কাম শ্যাষ কইরা বাড়িত যাইও রানুর মা।আমার আইতে দেরি অইব”

রাহেলা বেগম আব্দুল্লাহর স্ত্রী।প্রতিদিন সকালে আর সন্ধ্যার দিকে এসে শানের বাড়ির মোটামুটি কাজ সেরে দিয়ে যায়।

ওদের কথাবার্তায় পাখির বুঝতে অসুবিধা হয় না এনারা স্বামী-স্ত্রী।

“দাদিমা কাল আসো নি কেন?”,ইনায়াহ্’র কথায় পাখি ওর দিকে ফেরে।
“কাজ ছিলো রে একটু “,রাহেলা বেগম বলতে বলতে পাখির দিকে আগা-গোড়া দেখে আবার রান্নাঘরে চলে যায়।পাখি সবটাই দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে।নিজেকে কেমন যেন অযাচিত মনে হচ্ছে তার।

সিঁড়ি বেয়ে ফোনে কারোর সাথে কথা বলতে বলতে নামে শান।
“ওহহ, ইট’স ওকে।কিন্তু একজন বিশ্বস্ত গভারনেসের জরুরী দরকার ছিলো”,বিরসবদনে ফোনে কথা চালিয়ে যায় শান।মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে শান নিরাশ।
“কোথায় পাবো বিশ্বস্ত একজন মানুষ।ইনায়াহকে যে আগলিয়ে রাখবে!”,ভাবতেই ইনায়াহ্’র মায়াবি মুখটা দেখে মনটা বিষিয়ে ওঠে শানের।পাখি শানকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায়।কেমন যেন সংকোচ লাগে শানের সামনে থাকতে।তাই আগ পিছ না ভেবে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।

“কি নাম তোমার মা?”,রাহেলা বেগম মুচকি হেসে প্রশ্ন করেন।
পাখি কিচেন ডেস্কের পাশে হেলান দিয়ে বলে, “জ্বি আমার নাম পাখি।পুরো নাম তাসনুভা তানহা পাখি”
“বাহ,বেশ মিষ্টি নাম তো”
পাখি ঠোঁট এলিয়ে নিশব্দ হাসে।
“তুমি ইনায়াহ্’র নতুন গভারনেস?”
রাহেলা বেগমের প্রশ্নের জবাবে পাখি কি বলবে বুঝতে পারে না আবার নিজের করা ভুল, ডিকিতে চলে আসার কথাও বলতে পারে না।এদিক সেদিক নজর ফেলিয়ে ছোট্ট করে বলে,”হু”
“আচ্ছা আচ্ছা, বেশ ভালো”,জবাব দেন রাহেলা।
“আপনাকে একটা প্রশ্ন করব?”
পাখির কথায় রাহেলা কাজ থামিয়ে বলে, “হ্যা করো”
বলে আবারও কাজে মন দেন।
“ইনায়াহ্’র মা কোথায়?উনি কি এখানে স্যারের সাথে থাকেন না? ”
পাখির কথায় রাহেলার কাজ থেমে যায়।মাথা তুলে কেমন যেন শুকনো মুখে পাখির দিকে তাকান।কিন্তু কিছু বলেন না।কিছুক্ষন তাকিয়ে আবারও নিজের কাজে মন দেন।

এদিকে পাখি ভাবে থাকতে,”ভুল কিছু জানতে চাইলাম নাকি?ভদ্র মহিলা চুপসে গেলেন কেন?আমি তো জাস্ট….”
ভাবতেই চোখ পড়ে রাহেলার দিকে।রাহেলা সরুচোখে তাকিয়ে আছে পাখির দিকে।পাখি অপ্রস্তুত হয়ে এক গাল হেসে বলে,”আচ্ছা থাক, বলতে হবে না।হেহেহে”
মেকি হেসে পাখি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।তবুও রাহেলার কোন হেলদোল নেই।সন্দিহান চোখে তিনি পাখিকে দেখেই চলেছেন।কিছুক্ষন পর চোখ নামিয়ে পূনরায় নিজের কাজে মন দেয়।পাখি বুকে হাত দিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ে।যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল।

🌸
সোফায় বসে শান ফোনে কিছু একটা করছে।ইনায়াহ্ একহাত সরিয়ে শানের কোলে গিয়ে বসে গলা জড়িয়ে বলে, “ও সান সাইন, মুন সাইন অনেক ভালো।ও আমাদের সাথে থাকুক না প্লিজ;আমার নতুন গভারনেস হয়ে।”
ইনায়াহ্’র কথাকে বেশ গভীরভাবে মগজে গেঁথে নেয় শান।বলে,”ঠিকাছে মাম।তুমি যা বলবে তাই।”
ইনায়াহ্ খুশি হয়ে শানের গালে একটা চুমু দেয়।শান এবার সুযোগ বুঝে বলে,”তোমার কথা তো রাখলাম।এবার তাহলে সান সাইনের কথাও তো রাখতে হবে তাই না?”
“বলো, কি কথা?”
“মুন সাইনকে নতুন গভারনেস হিসেবে রাখব।তবে,তবে ও অন্য বাড়িতে থাকবে।ঠিক যেমন নাভানা আন্টি এসেছিলো, রাত হলে চলে যেত; তেমন।”
“কিন্তু আমি যে মুন সাইনকে কথা দিলাম আমরা একসাথে থাকব!”
“কোন কিন্তু না মাম।আমি কথা রেখেছি, তুমিও রাখবে।”

ইনায়াহ্’র চোখে মুখে দূঃচিন্তার ছাপ দেখা যায়।বেশ দোটানা বুঝা যাচ্ছে মুখের উপর।মুখটা কেমন অন্ধকারে ঢেকে যায় মূহূর্তেই।
শান শুকনো ঢোক গিলে বলে,”ওকে ওকে মাম, কোন কথা দিতে হবে না।রিল্যাক্স, তুমি কোন টেনশন করবা না।”

ততোক্ষনে ইনায়াহ্ স্থীর হয়ে যায়।এক ধ্যানে পলকহীন চেয়ে থাকে ঝাড়বাতিটার দিকে।শান অবস্থা বুঝতে পেরে দূঃচিন্তায় কয়েকবার ইনায়াহ্’কে ডাকে;কিন্তু কোন সাড়া পায় না। সে নির্বিকার চেয়ে আছে উপরের দিকে।কয়েক সেকেন্ড পর ইনায়াহ্’র চোখ মুখে উল্টে আসে।চোখের পাতা অস্বাভাবিক কাপতে থাকে।চোখ মুখের রং পাল্টে যায়।

শান শুকনো ঢোক গিলে জোড়ে আব্দুল্লাহ্’কে ডেকে বলে,”চাচা ঘড়ি ধরো,সময় দেখো”
শানের চিৎকারে রান্নাঘর থেকে পাখি দৌড়ে ছুটে আসে। সাথে পিছন পিছন ছুটে আসে রাহেলা বেগম।
ইনায়াহ্’র অবস্থা দেখে পাখি ওকে ধরতে গেলে শান হাত উচিয়ে ওকে থামিয়ে দেয়।

একটু পর ইনায়াহ্’র বাম হাত অস্বাভাবিক কাপা শুরু করে। এবার পুরো শরীরে খিঁচুনি উঠে যায়।ইনায়াহ্’র পুরো শরীর থেকে থেকে খিঁচুনি দিচ্ছে।
শান মনে প্রানে আল্লাহ্কে ডেকে চলছে।আর বার বার অসহায়ের মতো আব্দুল্লাহর দিকে তাকাচ্ছে।

“চাচা কতোক্ষন হলো”
“১ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড”,হন্তদন্ত হয়ে জবাব দিয়ে আবার বলে, “শান বাবা ২ মিনিট তো পেরিয়ে যাচ্ছে!”

শানের সাড়া শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে।পাল্সের গতি অস্বাভাবিক চলছে।শান আর সময় নষ্ট করতে চায় না।ইনায়াহ্কে বুকে জড়িয়ে হাঁটা ধরে সদর দরজার দিকে।দরজার চৌকাঠে পা রাখতে শান্ত হয় ইনায়াহ্।শানের পা থেমে যায়।শান দ্রুত এনে সোফার উপর শুইয়ে দেয়।
“চাচি পানি আনো ফাস্ট”,বলে শান ইনায়াহ্’র ঘর্মাক্ত শরীর মুছে দেয়।পাখি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে। কিছু বুঝে উঠতে পারছে না, আর না পারছে ইনায়াহ্কে ধরতে।

রাহেলা পানি এনে এগিয়ে দেয় শানের দিকে।শান ফট করে গ্লাস টা এনে ইনায়াহ্’র মুখের কাছে ধরে।খুব দ্রুত পানিটা শেষ করে ইনায়াহ্ শানের দিকে ঘুম জড়ানো দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।গলা জড়িয়ে বলে,”সান সাইন”
“হ্যা মাম্মাম,এইত আমি বলো না মা!”,কাতর কন্ঠের জবাব শানের।
“মুন শাইন এখানেই থাকুক না সান সাইন”
“ঠিকাছে মাম।ও এখানেই থাকবে। তোমার সাথে।তুমি যা চাইবে তাই হবে।”,বলতে বলতে পাখির দিকে তাকায় শান।

পাখির এবার বুঝতে অসুবিধা হয় না ইনায়াহ্ ওকে নিয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে।শানের চোখে চোখ পড়তেই পাখি চোখ নামিয়ে নেয়।কিন্তু ও চোখে এই প্রথম তার প্রতি কোন রাগ দেখতে পায় নি পাখি।আবার নজর তুলে তাকাতে বুঝতে পারে চোখে কতোটা অসহায়ত্ব আজ।

“মা!”,বলেই শান ইনায়াহ্’র গালে দেয়।আর বুঝতে পারে ঘুমিয়ে গেছে সে।এবার যেন ভিতর থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস আসে শানের।পাখির দিকে তাকায়। পাখি সংকোচে এগিয়ে এসে শানের থেকে ইনায়াহ্কে কোলে নেয়। শানের হাতের উপর হাত পরতেই চমকে যায় পাখি।দ্রুত সরিয়ে নেয় হাতটা।পাখির ওমন আচরনে বেশ অবাক হয় শান।
“ওকে ওর ঘরে শুইয়ে দাও”,পাখির তাকিয়ে বলে শান।
মাথা এলিয়ে সম্মতি জানায়।
“আর কোন সমস্যা হলে আমায় কল করবে”,অন্যদিকে তাকিয়ে বলে শান।এবার অবাক বিষ্ময়ে শানকে দেখে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।

“চাচি আমি গেলাম”,বলেই শান হসপিটালের উদ্দেশে বের হয়।গলা উচিয়ে রাহেলা বলে, “শান বাবা তোমার নাস্তা?”
“ক্ষিদে নেই। “,বলে শান উপরের দিকে একবার তাকায়।
এরপর দ্রুত পদে এগিয়ে যায় দরজার দিকে

🌸🌸

দুপুর বেলা পাখি ইনায়াহ্’র পাশে শুয়ে শুয়ে ভাবছে সকালের কথা।
“কি এমন কারণ থাকতে পারে যার জন্যে ইনায়াহ্ এতো হাইপার হলো।তারপর নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পরল!এতোটা হাইপার তো এর আগে কোন বাচ্চাকেই দেখিনি আমি”
“মুন সাইন”,ইনায়াহ্’র কথায় পাখির ভাবনায় বিরতি ঘটে।পাশ ফিরে মুচকি হেসে পাখি জবাব দেয়,”এই যে বেবি,এই তো আমি! কিছু লাগবে তোমার?”
ইনায়াহ্ পাখিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমার তোমাকে লাগবে”
পাখি একগাল হেসে বলে, “আছি তো”

এরপর ইনায়াহ্’কে গোসল করিয়ে দেয় পাখি।নিজে গোসল সেড়ে নিচে নেমে আসে।ইনায়াহ্কে দুপুরে খাওয়াতে হবে।সকাল থেকে কিচ্ছু খায় নি এখনো।
শানের কড়া নির্দেশ ছিলো ইনায়াহ্কে ডাকা যাবে না।যতোক্ষন ও নিজে থেকে না উঠে।তাই পাখিও ডাকে নি আর।

নিচে নেমে দেখে রাহেলা বেগম টেবিলে খাবার সার্ভ করছে। একটা চেয়ার টেনে পাখি ইনায়াহকে বসিয়ে রাহেলা বেগমকে বলেন,”আপনি সারাদিন এখানে থাকেন?”
রাহেলা শুকনো জবাব দেন, “না”
পাখি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।রাহেলা বুঝতে পেরে বলে,”শান বাবা ফোন করেছিলো। বার বার ইনায়াহ্’র খবর নিচ্ছিলো।আর আমায় বললো এখানে থেকে যেতে।তাই আছি এখনো”
“ওহহহ আচ্ছা,”সৌজন্যমূলক হাসি এলিয়ে জবাব দেয় পাখি।

ইনায়াহ্কে নিজের হাতে খাইয়ে দেয় পাখি।রাহেলা বলে ওঠে,”তুমিও খেয়ে নাও।তারপর এঁটো বাসনগুলো ধুয়ে দেব আমি”
পাখি তার দিকে বলে,”আমি ধুয়ে নেব সমস্যা নেই”
“তুমি এ বাড়ির গভারনেস, কাজের লোক নও মা”,নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দেন রাহেলা।
পাখি চুপসানো মুখে বলে,”এসব কাজ করতে আমি অভ্যস্থ ”
ইনায়াহ্’র খাওয়া দেখে রাহেলা অবাক না হয়ে পারে না।কারন ইতোপূর্বে কোন গভারনেসের কাছেই সে এতো তৃপ্তি করে খায় নি আর এতোটা খায় নি।রাহেলা ইনায়াহ্কে বলে,”দাদুভাই একটু ভাত দিই!”
“দাও দিদা”
রাহেলা খুশি মনে কিছু ভাত তুলে দিয়ে পাখির দিকে তাকিয়ে ভাবে,”এই মেয়ের মাঝে কিছু তো একটা আছে, যার জন্যে দাদুভাই ওকে এতো ভালোবাসছে”

পাখি আপনমনে মাছের কাঁটা বেছে বেছে ইনায়াহ্কে খাওয়াচ্ছে।
খাওয়া শেষে ইনায়াহ্ দৌড়ে ছুটে যায় বাহিরে।পাখি বেসিনে প্লেটটা রাখতে যায়।রাহেলাও কিচেনে গিয়ে ঘরটা গুছিয়ে নেয়।
“আচ্ছা আপনাকে একটা প্রশ্ন করব?”,বলেই রাহেলার দিকে তাকায় পাখি।
রাহেলা সহাস্যমুখে বলে,”বলো”
“ইনায়াহ্’ সকালে ওমন করল কেন?ওর কি কোন রো…”
“এতো কৌতূহল ভালো না মা।ক’দিনের জন্যে এসেছো নিজের চাকরিতে মন দাও।এখনি এতোকিছু জানতে হবে না।ধীরেধীরে সব বুঝতে পারবে”,রাহেলা জবাব দেন।

পাখি এবারও অপমানিত বোধ করে কিন্তু বাহিরে মিথ্যে হাসি ঠোঁটে রেখে বলে,”জ্বি”

রাহেলা আরেকটু কাছে এসে পাখির মুখটা ভালো করে দেখে।বেশ মায়াবি একটা মুখ।চুপসানো মুখটা দেখে বড্ডো মায়া হয় তার। পাখির মাথায় হাত রেখে বলে,”আমায় চাচি বলে ডাকিও”
পাখি ছলছলে চোখে তাকিয়ে মাথার উপর রাহেলার হাতটা দেখে।
“এভাবে শেষ বার রানি মাসি আদোর করেছিলো”,ভাবতেই চোখের কোণ ভরাট হয় পাখির।

রাহেলা একটু দূরে এসে বলে,”যদিও বলা ঠিক না তবুও তোমায় দেখে আগের গগভারনেসদের থেকে অন্যরকম লাগছে।আমার চোখ মানুষ চিনতে ভুল করে না।মনে হচ্ছে তুমি খুবই ভালো একটা মেয়ে।”
পাখি প্রশ্নাতুর চোখে রাহেলার দিকে তাকায়।
বলছি শোন,”ইনায়াহ্ হলো শান বাবার….”
“চাচি “,শানের ডাকে রাহেলা চুপ হয়ে যায়।এদিক ওদিক নজর ঘুরিয়ে শানের দিকে তাকায়।শান অনুভুতি হীন চোখে চেয়ে বলে,”চাচি আমায় এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও ”
বলেই সোফায় গিয়ে বসে।

রাহেলা ফ্রিজ থেকে একগ্লাস পানি নিয়ে শানকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে,”শান বাবা এই মেয়েটা খুব ভালো মনে হচ্ছে অন্যান্যদের থেকে।জানো আজ ইনায়াহ্ কতোটা মাছ ভাত খেয়েছে!আমি অবাক হয়ে গেছি।আর সারাক্ষন শুধু মেয়েটার সাথে থাকে।মাত্রই খেলতে গেলো”
শান পানিটা খেয়ে ফাঁকা গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে বলে,”চাচি ওর মতো মেয়েরা ভালো হয় না।তুমি খেয়াল করেছো ওর তিলটা?”
রাহেলা নিঃশব্দ হেসে বলে,”দেখেছি। দু একজনের জন্যে বাকিরা যে খারাপ তা তো নয় শান বাবা।আর তোমারও কিছু বোঝার ভুল আছে।যেগুলো তুমি গত ১৬ বছর ধরে মানতে নারাজ।আল্লাহ্’র কাছে চাই তোমার জীবনে এমন কেউ আসুক যে তোমার……”
“তৃতীয় কোন নারীর স্থান আমার জীবনে নেই চাচি।ছোটবেলা থেকে ইনায়াহ্’কে নিয়ে আছি আর ওকে নিয়ে সারাজীবন থাকব”,রাহেলার কথাকে থামিয়ে দারাজ কন্ঠে বলে শান।

এরপর প্যান্টের দুই পকেটে হাত গুঁজে বলে,”ও অপরিচিত কোন মেয়ে।যতোদূর বলেছে নিজের ব্যপারে, তাতে বুঝেছি সে মিথ্যে বলে নি।তাই যতোদিন না ইনায়াহ্’র নতুন গভারনেস পাচ্ছি ও ততোদিন থাকুক।ইনায়াহ্’র ট্রিটমেন্টও চলুক।এর বাহিরে নতুন করে কোন আত্মীয়তা করো না ওর সাথে।”
বলে শান হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।
রাহেলা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারও নিজেকে ব্যর্থ মনে করে গ্লাসটা হাতে নিয়ে কিচেনের দিকে চলে যান।

কিচেনে থেকে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনে ফেলে পাখি।বুঝতে অসুবিধা হয় না শানের জীবনে ভীষণ কালো অতীত রয়েছে।যার জন্যে তিনি কোন নারীকে সহ্য করতে পারে না।পাখি চিন্তায় পরে গিয়ে ভাবে,”কিন্তু তৃতীয় বার কেন বললেন?আর ইনায়াহ্’র কি অসুখ রয়েছে?যতোদূর মনে হলো ইনায়াহ্ ওনার মেয়ে না তাহলে, কার মেয়ে?কি সম্পর্কই বা শান স্যারের সাথে?”

চলবে…..

( শানের সাথে ইনায়াহ্’র সম্পর্ক কি?আর ইনায়াহ্’র রোগের লক্ষন দেখে কী বুঝা যায়?)#আসক্তি২ (আ জার্নি অব্ এডিকশান)
পর্বঃ০৫
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

দিন যতো পার হয় পাখির সাথে ইনায়াহ্’র সম্পর্কটা দিন দিন আরো বেশি গাঢ় হতে থাকে।একজন আরেকজনকে ছাড়া যেন অচল প্রায়।রক্তের কোন সম্পর্ক নেই অথচ কতো আপন করে নিয়েছে দুজন দুজনকে।
ইনায়াহ্’র ঘুম এখন আর শানের চুমুতে ভাঙ্গে না ;পাখির চুমুতে ভাঙ্গে।সারাদিন খেলাধুলা, সময় মতো খাওয়াদাওয়া সাথে পড়তেও বসা সব যেন নিয়মমাফিক চলছে।শান দিনকে দিন অবাক হয় কিন্তু মুখে কিছু বলে না। ইনায়াহ্’র চেহারা আগের থেকে আরো বেশি সুন্দর হচ্ছে যেটা কারোরই নজর এড়াচ্ছে না।শানও এখন হসপিটালে এসে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে।

গত কয়েকদিনে আব্দুল্লাহ্ আর রাহেলার সাথেও বেশ জমে উঠেছে পাখির। উঠবে না’ই বা কেন স্বাভাবে মিশুকে সে!তাঁদের দুজনেরই পাখিকে বেশ মনে ধরেছে।

কেবল ভাব জমে নি শান নামক মানুষটার সাথে।শান যতোক্ষন বাড়িতে থাকে এর মাঝে একটি বারও পাখি তার সামনে আসে না।কারো বাড়িতে অযাচিত হয়ে থাকা হয়ত পৃথিবীর সবথেকে নির্লজ্জ কাজগুলোর মাঝে একটি।তাই সবটা সময় শানের থেকে আড়ালে থাকে পাখি।
শান এতে অবাক হয় বেশ কিন্তু কিছু বলে না।কারন সে নিজেও চায় না কোন মেয়ে তার সামনে থাকুক।

🌸
সকাল বেলা শান নাস্তা করে চলে যায় হসপিটালে।আজ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বসার দিন। তাই আগেভাগেই চলে যায় সে।তার চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পর পাখি ইনায়াহ্’র হাত ধরে নিচে নেমে আসে।রাহেলা বেগমের সাথে চোখাচোখি হতে দুজনে সহাস্যমুখে অভিবাদন জানায়।
রাহেলা হেসে ইনায়াহ্’কে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোমার মুন শাইনের ঘুম ভাঙ্গলো বুঝি দাদুভাই?”
ইনায়াহ্ পাখির হাত ধরে ছোট ছোট পায়ে একসাথে দুই সিঁড়ি লাফিয়ে নামতে নামতে বলে,”উফফ দিদা, আর বলো না!মুন সাইন কিছুতেই নিচে আসতে চাইলো না।জানো তো!শুধু বলে সান সাইন আর মুন সাইন নাকি একসাথে কোনদিনও উঠে না।একজন গেলে আরেকজনের আসার সময় হয়”

ইনায়াহ্’র কথায় পাখি অস্বস্তিতে পরে যায়।চোখ এদিক সেদিক ফিরিয়ে পরিস্থিতি থেকে পাশ কাটাবার চেষ্টা করে।রাহেলার দিকে তাকিয়ে দেখে সে পাখির দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে।পাখি প্রশ্ন করে,”কি দেখছো”
মাথা নাড়িয়ে হালকা শব্দে রাহেলা বলে, “কিছু না”
আব্দুল্লাহ্ তখনি বাহিরের কাজ সেড়ে বাড়িতে ঢোকে নাস্তার উদ্দেশ্যে।ওদের কথার মাঝে চেয়ার টেনে বসে পরে ডায়নিং এ।রাহেলা বাঁকা চোখে তাকিয়ে পাখিকে ইশারা করে।আব্দুল্লাহ্ কিছুই বুঝতে পারে না রাহেলার ইশারার মানে।আপন মনে নাস্তা শুরু করে।পাখি আর ইনায়াহ্ও বসে পরে নাস্তার জন্যে।

🌸
“তোমারে একখান কতা কই রানুর বাপ?”
“কও”,আব্দুল্লাহ্ পিছনে দুইহাত দিয়ে বাগানের মাঝখানে হাঁটছে আর জবাব দিচ্ছে।রাহেলাও তার সাথে সাথে হাঁটার চেষ্টা করে বলতে থাকে,”পাখি মাইয়াডা ক্যামুন লাগে তোমার কাছে?”
আব্দুল্লাহ্ আগের ভঙ্গিমায় জবাব দেয়,”ক্যান বালাই তো”
“হ, আমারও বালাই লাগে।মায়া মুখের মিষ্টি একখান মাইয়া।তয় আমি কি ভাবতাছি জানো?”,হেসে হেসে বলে রাহেলা।
“না কইলে জানুম ক্যামনে?কইয়া ফালাও তো।”
“আমাগের শান বাবার সাথে যদি মাইয়াডার….”
“তোমার মাতা খারাপ অইছে রানুর মা।হেইডা কি কও তুমি।শান বাবা শুনলে আমাগেরও এই বাড়িত থাইক্কা বাইর কইরা দিবে।”,চাপা চাপা স্বরে বলে আব্দুল্লাহ্ এদিক সেদিক তাকায়।
কাপড়ের আঁচল টা আঙ্গুলে মুচড়িয়ে বলে রাহেলা ,”তোমার কি মনে অয়, আমি পাগলি?আরে বুইড়া ভাবো, যদি তাগোর মাঝে পেরেম অয়। তহন?”

আব্দুল্লাহ্ এবার হা হয়ে যায়।কারণ সে জানে এই কাজ কোনদিনও সম্ভব না।শানের মনে মেয়েদের ব্যপারে যে বিরূপ মনোভাব তা একদিনে তৈরী হয় নি ধীরেধীরে হয়েছে।যা একবারে কোনদিনও দূর হবে না।
“তুমি গেছো রাহেলা। সাতে আমারেও নেওয়ার পায়তারা করতাছো।মনে নাই ম্যাডাম কি কইছে?”,দাঁতে দাঁত চেপে বলে আব্দুল্লাহ্।

রাহেলা মুচকি হেসে বলে,”তোমারে কিছুই করতে হইবে না।আমি যা যা করব একটু সাতে থাইক্কো তাইলেই অইছে”
“আমি তোর আগেও নাই তোর সাথেও নাই।যা করার কর।আমি যে কামের লাইগ্গা এইহানে পইরা আছি তা আমারে করবার দে”,বলেই আব্দুল্লাহ্ সামনে হাঁটা ধরে।

🌸
দুপুরের খাবারের পর পাখি ইনায়াহ্’কে নিয়ে ঘুমিয়েছিলো।ঘুম ভেঙ্গে বুঝতে পারে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
“এতো সময় ধরে ঘুমাইলাম “,ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হয় পাখি।দড়বড় করে উঠে ফ্রেশ হতে চলে যায় ওয়াশরমের দিকে।ইনায়াহ্ তখনো শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে।

পাখি ফ্রেশ হয়ে ইনায়াহ্কে ডাক দেয়।এরপর দুজন নিচে নেমে আসে।রান্নাঘরে খুঁটখাট আওয়াজে পাখির পা থেমে যায়।
“কি হলো মুন সাইন, যাবা না?”
“উনি এতো তাড়াতাড়ি এসে গেছেন!”,ভাবতেই সংকোচে আড়ষ্ট হয়ে যায় পাখি।
“চলো নাআআ”,পাখির হাত টেনে নিয়ে যায় ইনায়াহ্।
গিয়ে বুঝতে পারে রাহেলা রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছে।পাখি হাফ ছেড়ে বাঁচে

“উঠলে তবে।চা খাবে মা?”,পাখিকে উদ্দেশ্য করে বলে রাহেলা।পাখি মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।
“দাদু ভাই তুমি তোমার দাদুর কাছে যাও তো,”আব্দুল্লাহ্কে দেখিয়ে দিয়ে বলে রাহেলা।ইনায়াহ্ পাখির দিকে চেয়ে থাকে।পাখি মুচকি হেসে বলে,”যাও”
ইনায়াহ্ চলে যায় সেদিকে।

“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে মা”,চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে রাহেলা
পাখি সবেমাত্র চা এ চুমুক দেবে তার আগে রাহেলার কথায় থেমে গিয়ে বলে,”বলো না চাচি কি কথা?”
রাহেলা আমতা আমতা করে বলে,”তোমার বাড়ি কোথায় মা?”
পাখি বুঝতে পারে রাহেলা কি কি জানতে চাইবেন এখন।তাই নিজেকে প্রস্তুত করে রাহেলাকে সবটা বলার জন্যে।
রাহেলা চায়ের কাপ টা দেখিয়ে বলে,”খাও মা ঠান্ডা হয়ে যাবে নয়ত”

পাখি কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলে,”আমার বাড়ি সিলেটের মৌলভীবাজারে চাচি”
“ওহহহ আচ্ছা আচ্ছা। তা তুমি সিলেট থেকে ঢাকা এতোদূরে কেমনে আসলা মা?পত্রিকায় গভারনেসের নিয়োগ দেখে?”
রাহেলার প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে যায়।কাপটা টেবিলের উপর রেখে হাত মুচড়াতে মুচড়াতে বলে, “আসলে চাচি…”
বাকিটা শেষ না করেই দুটো শুকনো ঢোক গিলে চেয়ে থাকে রাহেলার দিকে।রাহেলা কাপে চুমু দিতে দিতে সরুচোখে তাকিয়ে ভ্রু উচিয়ে ইশারা করে বলে,”বলো তারপর।কোন সমস্যা নেই। আমি তোমার মায়ের মতো কারণ তোমার বয়সি আমার একটা মেয়ে আছে।”

আড়চোখে তাকিয়ে আবার বলে, “কেন জানি না তোমার ব্যপারে জানতে খুব ইচ্ছে করছে”
পাখি পর পর দুটো ঢোক গিলে বলে,”আমার বাবারা দুই ভাই ছিলেন।সিলেট মৌলভীবাজারে শান্তিনগর গ্রামে(ছদ্ম নাম) আমাদের বাড়ি।আমার দাদু ভাই মারা যাওয়ার আগে দুই ভাইকে সম্পত্তি সমান অংশে ভাগ করে দেন।আমার বাবার আমি একমাত্র মেয়ে ছিলাম।আর আমার বড় বাবার দুইজন ছেলে আরেক জন মেয়ে ছিলো ইরা।বড় ছেলে বিদেশে পড়াশুনা করত।ছোটজন বাড়িতেই থাকত। আর ইরা আমার এক বছরের ছোট ছিলো।

দাদু মারা যাবার পর বড় বাবা আর তার ছেলে আমাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায় আমরা যেন ঐ সম্পত্তি ওদের নামে লিখে দেই।দাদিমা বেঁচে ছিলেন বলে ওরা তেমন মাথাচাড়া দিতে পারত না।আমার বাবা সেটা কিছুতেই করতে নারাজ।বাবা একদিন স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি আমার নামে লিখে দেয়।তখন আমি অনেক ছোট।

একদিন বাবা মা সহ আমি ঘুরতে গেছিলাম।আমাদের গাড়িটা এক্সিডেন্ট করে ঘটনাস্থলেই বাবা মা আমায় একা রেখে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায়। আমি হয়ে গেলাম একা”,এটুকু বলতেই পাখির চোখের কোণ ভরে আসে।
আবারও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”এরপর এসে জুটলাম বড়মা’র সংসারে।বড় মা কাজের দুটো মেয়েকে ভাগিয়ে আমায় বানালেন বাড়ির কাজের লোক।সকালকার এঁটো বাসন থেকে শুরু করে রাত্রে বেলা বড় মার পা টিপে দেয়া পর্যন্ত সংসারের খুঁটিনাটি আমাকে দিয়েই করাতেন।অথচ আমি কিছুদিন আগেও বাবার রাজকন্যা ছিলাম।কখনো রান্নাঘরের ধারে কাছেও যেতে দিতো না বাবা।মা বললে বলত’বিয়ের সময় আমার মেয়ের সাথে দরকার পরলে কাজের লোক পাঠাব। তবুও মেয়েকে কাজে দিবো না’
এমন ছিলো আমার বাবা”

রাহেলা অবাক চোখে চেয়ে থাকে পাখির দিকে।কিছু একটা পোড়ার গন্ধ পেতেই বলে,”একটু থামো মা,আমি তরকারিটা নামিয়ে রেখে আসি”

রাহেলা যাওয়ার পর পাখি হাতের কাপটা রেখে ওড়নার আঁচলে চোখের কোণা দুটো মুছে নেয়।ইতোমধ্যে আবার রাহেলা এসে এবার পাখির পাশে বসে বলে, “তারপর?”
“জানো চাচি আমাকে একটু আদোর করবার মতো কেউ ছিলো না।ধীরেধীরে বড় হচ্ছিলাম আর বড় মা”র নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলছিলো।ইরা একটু ভালোবাসত তবে ওর মাকে ও প্রচন্ড ভয় পেত।বড় মা সবটা সময় তার ছেলে মেয়েদের ভালো ভালো খাওয়াতো।আর আমার জন্যে বরাদ্দ ছিলো সবজি।খুব কষ্ট করে বড় মা’র সংসারে সবজি খাওয়া শিখেছিলাম।
বড় মা খোঁটা দিয়ে দিয়ে বলত আমি নাকি তার অন্ন ধ্বংস করছি।তার স্বামীর পয়সায় চলছি।অথচ বাবা মা মারা যাবার পর সমস্ত সম্পত্তির ভোগ তারা করত।এভাবে সারাটাদিন খেটে রাত্রে একটু সময় পেতাম বইটা ধরার।সেই চেষ্টায় মাধ্যমিকটা দিলাম।রেজাল্ট এসেছিলো এ+

কিন্তু আমায় মিষ্টি খাওয়ানোর মতো কেউ ছিলো না।বড় মা মুখ ভেঙ্গিয়ে বলত ‘ওতো পড়ে কি করবি?হবি তো আমার রায়ানেরই বউ’
রায়ান ছিলো আমার বড় বাবার ছোট ছেলে।পৃথিবীর এমন কোন খারাপ কাজ নেই যেটা সে করত না।নেশা করা মেয়ে নিয়ে ফুর্তি। সব করত সে।বড় মা, বড় বাবা বলতো’ছেলেরা এমন একটু আকটু করে’

ততোদিনে দাদিমাও আমায় ছেড়ে চলে গেলেন।একদিন আমি রান্নাঘরে ঘুমিয়ে আছি। রাতের বেলা হঠাৎ মনে হলো কেউ আমার পায়জামায় হাত দিয়েছে।ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে বুঝতে পারি সেটা রায়ান ভাই ছিলো।ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসছিলো।কারণ ভাই তখন নেশা অবস্থায় ছিলো।আমি না পারছিলাম চিৎকার করতে, না পারছিলাম চুপ থাকতে।হঠাৎ ইরা পানি নেয়ার জন্যে নিচে নেমে এসে রায়ান ভাইকে আর আমায় দেখে। আমি দৌড়ে ইরার কাছে চলে যাই।
পরদিন ইরা বাড়িতে সবটা বলে সবাইকে।কিন্তু কেউ কোন প্রতিবাদ করে না।সবার মাঝখান থেকে বড় বাবা বলেছিলো’এরকমই যদি হয় তবে বিয়ে দিয়ে দিই ওদের দুজনের’
কারণ আমার বড় মা, বড় বাবার আসল উদ্দেশ্যই ছিলো আমার নামে দেয়া সম্পত্তি গুলো।রায়ানের সাথে বিয়ে হলে তখন যেভাবেই হোক সম্পত্তি গুলো তারা পেয়ে যেত।আমি আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে বিয়েটা সে বার আটকে দেই।অনেক বার অনেক টর্চার করে আমার উপর আমি আইনের ভয় দেখিয়ে তাদেরকে কিছুদিন দমিয়ে রাখতে পারতাম।

সেদিনের পর থেকে আমি ইরার সাথে ঘুমাতাম।দেখতে দেখতে কেটে যায় আরো দুইটা বছর।তখন আমি উচ্চ মাধ্যমিকের পরিক্ষা দিই।তখন আয়ান ভাইয়া বিদেশ থেকে চলে আসে।দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি তার যোগ্যতা।যেকোন মেয়েই ওর জন্যে পাগল ছিলো।
আমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলো সেদিন আমি পরিক্ষা দিয়ে বাড়ি আসি।আমায় দেখে ভাইয়া সেদিন মুগ্ধ হয়ে চেয়েছিলো।কিছুদিন যেতে না যেতে আমার প্রতি ভাইয়ার অন্যরকম যত্ন বুঝতে পারলাম।মনে মনে খুব শান্তি পেতাম এই বুঝি একটু সুখের সন্ধান পেলাম।

একদিন ভাই আমাকে অবাক করে দিয়ে ইরাকে দিয়ে প্রেম পত্র দিলো।আমি কিছুতেই রাজি ছিলাম না। কারণ ভাইকে কোনদিন অন্য নজরে দেখিই নি আমি।ভাইয়ার আসার পর রায়ান আমায় দেখলে মাথা নিচু করে হাঁটত।আয়ান ভাই সবসময় সব বিপদ থেকে আমায় বাঁচাত।এমনকি বড় মাও ভাইয়ার ভয়ে আমায় কোন কাজ করতে দিতো না।আমার জীবনে সবটাই যেন আগের মতো হতে থাকলো।”

পাখি থেমে গিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে, “জানো চাচি ঘুটঘুটে আঁধারে সামান্য একটু আলো দেখলেই সেটা ধরে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে করে!”
“তুমি জীবনে এতো কষ্ট সহ্য করেছো মা?”,বলতে বলতে রাহেলা হাত বুলিয়ে দেয় পাখির মাথায়।আবার প্রশ্ন করে, “তারপর কি হলো?”

“ভাইয়ার ব্যবহার আচার আচরনে দিনদিন আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম।বলতে গেলে একটু একটু দূর্বল হয়ে পরেছিলাম।আমার অবস্থা বুঝতে পেরে ভাইয়া আবারও তখন ইরাকে দিয়ে প্রেম পত্র দেয়।আমি আর না করি নি।শর্ত দিয়েছিলাম আমার অনার্স কমপ্লিট হবে তারপর বিয়ে।ভাইয়া আমার শর্তে রাজি হয়েছিলো।কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলো।বই কিনে দিলো।আমার সারাদিনের এ টু জেড সবটাই আয়ান ভাইয়া খেয়াল রাখত।একই বাড়িতে থাকতাম অথচ এর মাঝে একদিনও ভাইয়ার কোন অশোভন আচরন আমি পাই নি।এইটা আমায় তার প্রতি বেশি দূর্বল করে তুলত।

তিনটা বছরে আমি ভাইয়ার প্রতি এতো বেশি দূর্বল হয়ে পরেছিলাম কি বলব তোমায়!
আমার নিঃশ্বাস নেয়াও যেন আয়ান ভাইয়ের অনুমতিতে চলত।এতো ভালোবেসে ফেললাম।বড় মা দুটো মেয়েকে আবার কাজে দিলো।কারণ আয়ান ভাই আমায় কোন কাজে হাত দিতে দিতোই না।আয়ান ভাইয়ের মতো একজনকে জীবনে পাবো ভাবিও নি কখনো।এমনি এক সন্ধ্যেবেলা আমি নিজেই আয়ান ভাইকে বলি ‘বিয়েটা যেন তাড়াতাড়ি হয়’
ভাই সেদিন বলেছিলো ‘মাস্টার্স পড়বি না?’
আমি হেসে বলেছিলাম’তোমার মতো কেউ জীবনে থাকলে কোন মেয়েরই চাকরির দরকার পরবে না’
কি জানো তো চাচি, বড্ডো বোকা ছিলাম আমি

তার তিনদিন পরই খুব ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করে আয়ান।আমায় পার্লারের মেয়েরা সাজিয়ে দিয়ে গেছে।বাহিরে আয়োজন চলছে।এরমাঝে আমার রানি মাসি।ওহহ রানি মাসির কথা তো বলাই হলো না তোমায়।
আমার বাড়িতে কাজ করত সনাতনধর্মের একজন মহিলা।নাম রানি। আমি ছোটবেলা থেকে রানি মাসি বলে ডাকি।বলতে গেলে তিনিই আমায় ছোটবেলা থেকে বড় করেছেন।মাকে কোন কাজ করতে দিতো না।আমাদের বাড়ির সব কাজ তিনি করতেন।

তো রানি মাসি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে ঘরের ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন।আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে সরে এসে বললাম, “মাসি তুমি! এই সময়!কি হয়েছে?”
তারপর রানি মাসি যা বলল তা আমি জীবনে কোনদিনই ভাবতে পারি নি চাচি।
আয়ান নাকি সবটাই করেছে শুধুমাত্র আমার সম্পত্তির লোভে।সে বিদেশে বিয়ে করেছে ওর একটা বাচ্চাও আছে।বড় বাবা, বড় মা ওকে যখন সব কথা বলে তখন সে কৌশলে দেশে চলে আসে আমার সাথে ভালোমানুষির নাটক করে আমায় প্রেমের ফাঁদে ফেলে। তারপর বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে সাইনের বদলে জমির দলিলে সাইন করিয়ে নিতো।তাদের প্ল্যান ছিলো কৌশলে জমি হাতিয়ে নিয়ে রায়ানের সাথে বিয়ে দেয়া আর তারপর আয়ান পূনারায় বিদেশ চলে যেত।

আমি রানি মাসির কোন কথা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আবার রানি মাসি এমন একজন মানুষ যাকে অবিশ্বাসও করতে পারছিলাম না।রানি মাসি বুঝতে পেরে আমার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দেয় যেখানে স্পষ্ট লেখা ‘আমি আমার স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি আমার স্বামী রায়ানের নামে লিখে দিলাম’
আমার গা হাত পা কাপা শুরু করেছে ভীষণভাবে।আমি ভাবতেও পারি নি এরা আমায় এভাবে ধোকা দেবে!

রানি মাসি সেদিন আমায় বলেছিলো আমি যদি কোনভাবে সবটা জেনে যাই, বিয়েতে মত না দিই তাহলে নাকি আয়ান নিজে হাতে আমায় খুন করত।সেটাও বিশ্বাস করি নি আমি।তখন রানি মাসি একটা ভিডিও আমার সামনে এগিয়ে দেয়।সত্যিই সেখানে বড় বাবাদের পরিবারের সবাই আমায় মারার প্লানটাই করছিলো।

আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করব।এদিকে আমাকে বিয়ের আসরে নেয়ার জন্যে মেয়েরা দরজা ধাক্কাচ্ছিলো।রানি মাসি আমায় তখন হাতে একটা ফোন আর একটা ছোট্ট কাগজ হাতে দিয়ে বলেছিলো,”এটা আমার বোনের ঠিকানা।আর এই ফোনটা সাথে রাখবি ”
বলেই পিছন দরজা দিয়ে আমায় বের করে দিয়ে নিজেও ঐ দরজা দিয়ে বের হয়ে আসে।বুঝতেছিলাম না আমি কি করব!দিগ্বিদিক না ভেবে শুধু সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।আমাদের এলাকা থেকে মেইন সরক বেশটা দূরে।দৌড়াতে দৌড়াতে কখন যে মেইন সরকে এসেছি বুঝতে পারি না।ইতোমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।রাস্তায় কোথাও কোন গাড়ি নেই।অনেকটা দূরে দুইটা আলো দেখা যাচ্ছে।ভয় ভীতি একপাশ করে দৌড়ে ছুটে এসে দেখি একটা কার।আর একটা ছেলে গাড়ির বনেট তুলে ইঞ্জিন দেখছে।আমি অনেক অনুরোধ করি আমায় সাহায্য করার কিন্তু করে নি।”

বলতে বলতে থেমে যায় পাখি।শানের সেদিনের ব্যবহারের কথা মনে উঠতেই খুব রাগ হয় সাথে কষ্টও হয়।রাহেলা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না মানুষ সম্পদের লোভে কতোটা জঘন্য হতে পারে!

“তারপর কিভাবে এলে? ”
পাখি রাহেলার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে,”যাকে অনুরোধ করি তিনি ছিলেন গাড়ির ড্রাইভার।উনার হয়ত একটু মায়া হয়েছিলো পরে আমাকে গাড়িতে বসা তার মালিকের কাছে পাঠায়।আমি এগিয়ে এসে তাকেও অনুরোধ করি কিন্তু তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই জবাব দেয় ‘নো’।মানে তিনি সাহায্য করতে পারবেন না।পরে উপায়ান্তর না পেয়ে আমি তার গাড়ির ডিকিতে উঠে পরি।আর তারপর তো এখানে….”
বলতে বলতে গলার স্বর নিচু হয়ে আসে পাখির।
রাহেলা অবাক হয়ে বলে, “তারমানে সেদিনের ঐ লোক শান বাবা তাই না?”
ক্ষীণস্বরে পাখি জবাব দেয়,”হু”
“তারমানে ড্রাইভার ছিলো রাফি”,আনমনে ভাবে রাহেলা।

রাহেলা বুঝতে পারে না এই মূহূর্তে কি বলা উচিত তার।পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”একটা কথা বলি আজ।শান বাবা খুবই ভালো মানুষ।তবে মেয়েদেরকে তিনি দুই চোক্ষে দেখতে পারে না।ওটা ব্যপার না।দেখবে ও তোমার অবস্থাটা একদিন ঠিক বুঝতে পারবে”
পাখি ছলছলে তাকিয়ে বলে,”উনার জীবনে কি আছে আমি জানি না চাচি। জানতে চাইও না।আমার জীবনেও তো এতোবড় একটা ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি তাই বলি আমি কি দুনিয়ার সব ছেলেকে এক মনে করব?সবাই তো আর খারাপ হয় না।”

রাহেলা পাখির তিলটা দেখে মনে মনে ভাবে,”কেমনে কই তোমারে গো মা। এমনিই মেয়েদের পছন্দ করে না।তারউপর তোমারও ঐ একই জায়গায় তিল এটা যে ওর জন্যে কতোটা কষ্টদায়ক সেটা আমি জানি”

ওদের কথার মাঝখানে শান দুইবার গলা ঝেড়ে কাশি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়।পাখি সেদিকে না তাকিয়েই সোজা উপরে ইনায়াহ্’র ঘরে চলে যায়।শান হতভম্বের মতো পাখির যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে।রাহেলা শানের দিকে চেয়ে ভাবে,”জীবনে যা কিছু হয় সবটার পিছনে কিছু না কিছু ভালো কারণ থাকে”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here