শিশিরের বিন্দু
২০ তম পর্ব
আবির বাইসরার কথা বলে কিছুক্ষন দম নিয়ে বলল,
___ ” একটু পরে আমরা গাড়ি থেকে নেমে অন্যকিছুতে করে বাইসরা যাব।”
___ ” অন্য কিছু মানে? আমরা কি হেঁটে হেঁটে বাইসরা যাব?”
শিশির কথার মাঝেই কথা বলে উঠলো। আবির শিশিরের কথা পাত্তা না দিয়েই বলল,
___ ” একটু পরেই আমরা নামব গাড়ি থেকে “।
সত্যিই মিনিট দশেক পরে ঠিকই ওরা গাড়ি থেকে নামলো। বিশাল পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।নিনা এবার অবাক হয়ে আবিরকে বলল,
___ ” এখন কিসে করে যাব আমরা??”
___ ” এখান থেকে বাইসর পর্যন্ত ঘোড়ায় করে যাব আমরা “।
আবিরের কথা শুনে নিনা তো ভালই অন্যদের মুখও হাঁ হয়ে গেল। নিনা প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
___ ” ঘোড়া যদি কামড় দেয় তখন কি হবে? ”
___ ” ঘোড়ার এত তাড়াতাড়ি মরার শখ হয় নাই যে তোমারে কামড় দেবে “।
আবির বিরক্তির স্বরে বলল। বিন্দু শিশিরের হাত চেপে ধরে বলল,
___ ” ঘোড়ায় না চড়ে হেঁটে হেঁটে যাওয়া যায় না?”
শিশির হাসতে হাসতে বলল,
___ ” ভয় পাও নাকি ঘোড়ায় চড়তে।”
বিন্দু কোন উওরই দিল না। নিজের দূর্বলতা কে প্রকাশ করতে যায় সেধে সেধে। ঘোড়া ওয়ালাদের সাথে দাম দর করে প্রতি ঘোড়া সাড়ে সাতশ রুপি করে ঠিক করল ওরা। ছয়টা ঘোড়া সারি দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিনা বিন্দু আর তুলি যেন ভয়ে সেধিয়ে যাচ্ছে৷ ছেলেরাও বেশ কাঁপাকাঁপিতে আছে৷ এই ঘোড়ায় বাইসর যাওয়ার পথে বেশ কয়েকটা পাহাড় পাড়ি দিতে হবে। শিশিরের বিশ্বাসই হচ্ছে না যে এই ঘোড়া পাহাড় পাড়ি দিতে পারবে। সে যাই হোক বহুত চেষ্টা কসরত আর বোঝনোর পরে মেয়েরা কোন মতে ঘোড়ায় উঠে বসল। ঘোড়া ওয়ালারা বারেবার বলল, যেন শক্ত করে ধরে বসে ঘোড়াকে। শুরু হল ওদের বাইসরের পথে যাত্রা। বিন্দু যেন শক্ত পাথরের মূর্তির মত বসে আছে। শিশির এই ঝামেলার মধ্যেও বিন্দুর অবস্থা দেখে হেসে ফেলল। প্রায় ঘন্টা খানেকের বিশাল এডভেঞ্চারাস পথ পাড়ি দিয়ে ওরা শেষ মেষ পৌঁছালো বাইসরে। শিশির তখন সত্যিই তারিফ করল হর্সপাওয়ারের। এই শুকনো পটকা ঘোড়া গুলো এই পাহাড়ের পথ পাড়ি দিয়ে ওদের নিয়ে এসেছে এত দূরে এ সত্যিই অবিশ্বাস।
পরে সবাই মিলে ৩০ রুপি করে টিকিট কেটে ঢুকলো বাইসরের মিনি সুইজারল্যান্ড এ।
ভেতরে ঢুকেই বিন্দু শিশিরের হাত ধরে যেন দৌড়ে চলল সামনের দিকে। সামনে বিশাল পর্বতচূড়া যার মাথায় সাদা শুভ্র বরফের চাদরে ঘেরা। বিশাল সবুজ ঘাসের চাদরে মোড়া মাঠ আর সারি দেওয়া পাইন গাছ। সত্যিই ওরা যেন সুইজারল্যান্ড চলে এসেছে। বিন্দু শিশিরকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে বলল,
___ ” ভালবাসি অনেক অনেক “।
___ ” ছেড়ে যাবে না তো কখনও? ”
শিশির গাঢ় স্বরে বলল বিন্দুর চোখে চোখ রেখে। বিন্দু শিশিরের বুকে মাথা রেখে বলল,
___ ” কখনও না।”
আবির তাড়াতাড়ি নিনাকে টানতে টানতে নিয়ে আসলো বিন্দু আর শিশিরের কাছে। ওদের দিকে আঙুল তুলে বলল,
___ ” বলিউড ফিল্মের শূটিং হচ্ছে তাড়াতাড়ি পিক তোলো।”
আবিরের বলার ধরন দেখে ওরা সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। পেহেলগামের সবচেয়ে আকর্ষনীয় টুরিস্ট স্পট হল এই বাইসর। বেশকিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করার পরে ওরা আবারও ঘোড়ায় চেপে ব্যাক করা শুরু করল। মোটামুটি আবারও পাহাড় পর্বত পাড়ি দিয়ে ওরা আবারও ফিরে আসলো পেহেলগামে। দুপুর দেড়টার দিকে ওরা পেহেলগামের বতুতা হোটেলে এসে উঠলো। প্রথম লিফটে আবির নিনা বিপ্লব আর তুলি চলে গেল। লিফট ফেরত আসলে শিশির আর বিন্দু উঠলো। লিফটের দরজা আটকালেই শিশির বিন্দুর কোমর চেপে ধরে টেনে কাছে নিয়ে আসলো। বিন্দুর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। বিন্দু আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল। লিফট খুলতেই ওরা চাবি নিয়ে চলে আসলো যার যার রুমে। শিশির রুমে ঢোকার আগেই আবির বলল,
___ ” ঠিক আড়াইটায় নিচে নামবি সবাই। লাঞ্চ করে বেতাব ভ্যালি আর চান্দনওয়ারী ঘুরতে যাব।”
শিশির কিছু না বলে মাথা ঝাকিয়ে রুমে ঢুকল। ঢুকে দেখে বিন্দু ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখছে। শিশির বারান্দার কাঁচে ঢাকা দরজার পর্দা সরাতেই সামনে আসলো বিশাল পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে সামনে। বিন্দু ধীর পায়ে এসে পিছন থেকে শিশিরকে জড়িয়ে ধরল। শিশির মুচকি হেসে বলল,
___ ” ফ্রেশ হয়ে নেও বের হতে হবে তাড়াতাড়ি। ”
___ ” হুম “।
আহ্লাদী স্বরে বলে উঠলো বিন্দু। শিশির হঠাৎ বিন্দুকে আড়কোলে তুলে নিল। সোজা হেঁটে চলল বিছানার দিকে। বিন্দুকে নরম বিছানার ছুড়ে ফেলে ও নিজেও বিন্দুর উপরে পড়ে গেল। দুজনে যেন হারিয়ে গেল এক অজানা পৃথিবীতে। এ যেন অন্য এক ভালবাসার পরশ।
আড়াইটার সময় সবাই নিচে নেমে আগে লাঞ্চ করল তারপর চলল পেহেলগামের আরেক টুরিস্ট স্পট বেতাব ভ্যালির উদ্দেশ্য করে। পথের সৌন্দর্যে যেন সবার মুখের কথাই বন্ধ হয়ে গেল। পাহাড়ের আকাবাকা পথ ধরে ওরা যখন বেতাব ভ্যালি পৌছালো তখন দূর থেকেই শুনতে পেল লিদার নদীর বয়ে চলার কুলকুল শব্দ। বেতাব ভ্যালির ঠিক মঝ থেকে বয়ে চলেছে এই লিদার নদী। পাহাড়ী নদীর সৌন্দর্য এর বর্ননা হয়ত ভাষায় দেওয়া সম্ভব নয়। নদী দেখা শেষ করে ওরা চলল ভ্যালির ভেতরে। জন প্রতি ১০০ রুপি করে টিকিট কেটে ওর ভ্যালির ভেতরে ঢুকল। প্রকৃতি যে এত এত সুন্দর হয় তা হয়ত ওরা কাশ্মীরে না আসলে জানতেও পারত না কখনও৷ বেতাব ভ্যালি ঘোরা শেষে ওরা আবারও রওনা হল চন্দনওয়ারীর দিকে। দুটো স্পট বেশ কাছাকাছি থাকায় ওদের জন্য সুবিধাই হল। চন্দনওয়ারীতে যেয়ে ওরা দেখা পেল বরফের। সাদা শুভ্র বরফে ঢেকে আছে চারপাশে। এ যেন এক অন্যরকম সুন্দরতা। বরফের সিঁড়ি কেটে কেটে পাহাড়ের উপরে উঠের সিস্টেম করে দেওয়া আছে। ভিষন পিচ্ছল সে রাস্তা। ওরা ছয়জনই উঠা শুরু করল পাহাড়ের উপরে সেই বরফ ঢাকা রাস্তা দিয়ে। আবির আর নিনা তাড়াতাড়ি করে উপরে উঠতে যেয়েই বাধালো গোল। বেশ খানিকটা দূরে উঠার পরেই প্রথমে নিনার পা ফসকালো ও আবিরের হাত থাবা দিয়ে ধরতে গেল পতন ঠেকানোর জন্য। কিন্তু বিধির বাম আবির নিজেও পড়ে গেল পিছলিয়ে। দুজনে পিছলে গড়িয়ে নিচে পড়তে লাগল। পিছনে ছিল বিপ্লব আর তুলি ওরাও পড়ে গেল আবির আর নিনার ধাক্কায়। হঠাৎ শব্দে শিশির আর বিন্দু উপরে তাকিয়ে দেখল চারজনে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ওরা সরার আগেই উপরের চারজন ধরতে গেলে ওদের গায়ের উপরেই এসে পড়ল। ছয়জনকে পড়তে দেখে কেউ হাসলো ও না এগিয়েও এলো না। এটা এখানকার নিত্যদিনের কাহিনি। উঠে দাঁড়িয়েই সবাই বরফ ঝেড়ে ফেলল শরীর থেকে। মেজাজ এত খারাপ হল শিশিরের যে বলার মত না। ঝাড়ি দিয়ে আবিরকে বলল,
___ ” নিজে তো পড়েছেই সাথে আমাদের কে নিয়েই পড়েছে।”
___ ” আসলি মজা সব কা সাথ আতা হ্যায় দোস্ত “।
বরফ ঝাড়তে ঝাড়তে উওর দিল শিশির। ঘোরা শেষে হলে ওরা আবার ফিরে আসলো ওদের পেহেলগামের ওই হোটেলে। সারাদিনের ঘোরা ঘুরিতে সবাই ভীষন টায়ার্ড। খেয়ে তাই চলল রেষ্ট করতে। বিন্দু শিশিরের বুকে মাথা রেখে বলল,
___ ” আচ্ছা বাসায় যেয়ে কি বলব বলো তো৷? ”
___ ” আমার আম্মু কিন্তু রাজি আছে। আব্বুকে কোন মতে ম্যানেজ করে নেবো।”
শিশির বিন্দুর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল। বিন্দু উঠে শিশিরের বুকের উপরে শুয়ে শিশিরের চোখে চোখ রেখে বলল,
___ ” ডেনমার্ক যাবে না আর? ”
___ ” তোমাকে নিয়ে যাব এক সাথে। কাগজ জমা দিয়েছি তোমার ভিসা আসলে একসাথে যাব”।
___ ” আমার জবটা?”
___ ” এর চেয়ে ভাল জব পাবে তুমি।”
শিশির বিন্দু কপালে চুমু দিয়ে বলল। বিন্দু বিশাল এক নিঃশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল, বাসায় যেয়ে সবাইকে কি বলবে তাই তো খুঁজে পাচ্ছে না ও। শিশির ঘুরে বিন্দুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
___ ” যা হবে দেশে যেয়ে দেখা যাবে। তুমি চিন্তা করো না আমি আছি তো নাকি? সোজা নিয়ে চলে যাব।আমার বউ কাউকে দেব না “।
বিন্দু কিছু না বলে পরম নির্ভরতায় আঁকড়ে ধরল ওকে। এই লোকটাকে গত তিন বছরে এত এত চেষ্টা করেছে ভুলে যেতে কিন্তু ভুলতে পারে নি। একেই বুঝি বলে ভালবাসা।
চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর