নিষিদ্ধ বরণ পর্ব ৮

#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৮)

” নায়রার রুমটাও এভাবে গুছিয়ে দিতেন। তাই না, বাবা? ”

মাহদীর কণ্ঠ স্বরে এরশাদ রহমান পেছনে তাকালেন। তার হাতে বিছানার চাদর। মন একটু দূরে কাঠের চেয়ারে বসে নানার কার্যকলাপ দেখছিল। বাবাকে দেখেই ছুটে এলো। তার চোখে-মুখে দারুন উচ্ছ্বাস!

এরশাদ রহমান চোখ ফিরিয়ে বিছানায় চাদর পাতায় ব্যস্ত হলেন। বালিশে নতুন কভার লাগিয়ে বললেন,
” ঘরটা অনেক দিন বন্ধ ছিল। তাই পরিষ্কার করে দিলাম। ”

মাহদী ছেলেকে কোলে তুলে নিল। ভেতরে ঢুকে বলল,
” নায়রার প্রশংসার সবটা জুড়েই আপনি থাকতেন। মাঝে মাঝে কিন্তু আমার খুব হিংসে হতো, রাগ হতো। আপনি সাজার চেষ্টা করতাম। এক দিন নায়রার খুব জ্বর হলো। ডাক্তার দেখালাম। ওষুধ খাওয়ালাম। লাভ হলো না। শরীরের তাপমাত্রা কমার বদলে বেড়ে গেল। বিছানা ছেড়ে দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই। সেই অবস্থায় সে ঘর ঝাড়ু দেওয়ার জন্য ঝাড়ু খুঁজছে। আমার তো খুব রাগ হলো। খানিকটা বকাঝকা করে নিজেই ঝাড়ু হাতে নিলাম। তাকে দেখিয়ে ঘর ঝাড় দিলাম, বাসন ধুলাম, ভাত করলাম, ডিম ভাজলাম। সব শেষে যখন তার সামনে গিয়ে বসলাম। সে হেসে ফেলল। যে মেয়ে জ্বরে ভুগে চোখের পাতা ফেলতেও কষ্ট পাচ্ছে সে মেয়ে আমাকে দেখে হাসছে আর বলছে, ‘ তুমি চাইলেই কি আমার বাবার মতো হতে পারবে? তাহলে তো আমি বিছানায় পড়ে থাকতাম না। তিনি আমার কপাল ছুঁয়ে দিলেই জ্বর হারিয়ে যেত! ‘ বাবা, আপনি কি বুঝতে পারছেন সে সময়টা আমি কত দুঃখ পেয়েছিলাম? ”

এরশাদ রহমান কিছু বললেন না। নীঃশব্দে দরজার দিকে এগুলেন। হঠাৎ কী হলো মাহদীর কাছে এসে দাঁড়ালেন। তার মুখে নরম চাহনি ফেলে কাঁধে হাত রাখলেন। বিগলিত কণ্ঠে বললেন,
” আমার কাছে প্রথম বারের মতো কিছু চেয়েছিল নায়রা। সেটা তুমি। দিয়েছিলামও। কিন্তু কেন জানি মন থেকে মেনে নিতে পারলাম না। খুশি হতে পারলাম না। অথচ প্রার্থনায় সারাক্ষণ চাইতাম মেয়েটা ভালো থাকুক, সুখে থাকুক। ”
” তাহলে কেন এক বারের জন্য কথা বলেননি আমার সাথে? কেন এক বারের জন্য দেখতে যাননি তাকে? নায়রা যে খুব করে চাইত তার নিজের হাতে সাজানো সংসারে আপনি এক বার আসুন। তার হাতে বানানো চা খেতে খেতে ভুল সংশোধন করে দিন অথবা প্রশংসায় ভরিয়ে দিন। ”

এরশাদ রহমান সাথে সাথে কিছু বলতে পারলেন না। তার কণ্ঠ স্বর ভার হয়ে আসছে। চোখের চাহনি ঝাপসা হচ্ছে। মুহূর্তকাল শেষে কিছু একটা বলতে চাইলেন তখনই অন্য কারও কণ্ঠ স্বর,

” তুমিও তো কথা বলতে আসোনি। নায়রা নিশ্চয় এটাও চাইত তুমি এ বাড়ি আসো। তার বাবার সাথে মনোমালিন্য ভেঙে পাশাপাশি বসে চা খাও? ”

মাহদীর চকিত দৃষ্টি পড়ল দরজার দিকে। নায়রার মা আসমা রহমান দাঁড়িয়ে আছেন৷ হাতে ট্রে। তাতে চা ও বিস্কুট সাজানো।

স্বামীর জরুরি কল পেয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন আসমা বেগম। এসেই সাংসারিক কাজ শেষে সন্ধ্যার নাস্তা সাজিয়ে আনলেন। স্বামী ও মেয়ের জামাইয়ের সামনে নাস্তা রেখে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,

” আপনারা দুজনেই আমার নায়রাকে সর্বোচ্চ ভালোবেসেছেন। কিন্তু তাকে সুখী করতে পারেননি। তার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারেননি। শেষ হাসিটা উপহার দিতে পারেননি। ”

কথাটা বলেই শাড়ির আঁচল চেপে ধরলেন মুখে। চোখের পানি গালে গড়িয়ে পড়ার পূর্বেই সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।

________________

বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে না ভেবেও পরের দিন ঠিক হাজির হলো নিহিতা। গেইট ছেড়ে মাঠ পার হতে পারল না। তার আগেই সুমি সামনে এসে দাঁড়াল। তার পিছু পিছু এসে দাঁড়াল সানোয়ার আর সেতু। নিহিতা সকলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে নাদিম বলল,
” আজ ক্লাস করতে হবে না। ”
” কেন? ”
” সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজন করা হবে তাই। অনেক কিছু প্ল্যান করার কাছে। ”
” সারপ্রাইজ পার্টি? কিসের? ”

এবার কথা বলল সুমি,
” কাল সানোয়ারের জন্ম দিন। নিহিতা, আমার জন্ম দিনে তোকে পাইনি। এবার কিন্তু থাকতেই হবে। তোর কোনো কথা শুনব না। ”

নিহিতা কিছু একটা বলতে চাইল তার আগেই সেতু বলল,
” মুখ বন্ধ। চুপচাপ আমাদের সাথে চল। ”

নিহিতার ক্লাস করা হলো না। সুমি, সেতু জোর করে তাকে নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেল। প্রায় ঘন্টাখানেক পর মার্কেট থেকে বের হয়ে নিহিতা মুখ খুলল,
” তোরা কিন্তু অযথায় জোর করছিস। আমি এসবে থাকতে পারব না। আমার বাবা এগুলো পছন্দ করেন না। আমিও না। ”
” আংকেলকে বলতে যাচ্ছে কে? ”

নিহিতা কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
” বাবাকে বলব না? ”
” জন্মদিনের কথা বলবি না। অন্য কিছু বলিস। ”

সুমি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
” ঊর্মির মতো তুইও বলবি আমার বাসায় আসবি। রাতে থাকবি। ”

ঊর্মির কথা শুনে নিহিতার চোখ-মুখে লাবণ্য ছড়াল। দুই দিন ধরে মেয়েটার সাথে যোগাযোগ নেই। এই সুযোগে দেখা তো হবে! নিহিতা খানিকটা উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” ঊর্মি? ও আসবে? ”
” তো আসবে না? ও কি তোর মতো? ”

নিহিতা সুমির প্রশ্ন এড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
” এখন কোথায় আছে? দেখতে পাচ্ছি না যে? ”
” সানোয়ারকে নিয়ে কোথাও একটা গেছে। ও আমাদের সাথে থাকলে তো সারপ্রাইজ মাটি হয়ে যাবে। ”

নিহিতা চুপ হয়ে গেল। ঊর্মির সাথে দেখা করার জন্য মন যেমন ছটফট করছে তেমন ধর্মীয় শিক্ষা বোধও জেগে উঠছে।

” তুই কি এখনই নাদিমের সাথে যাবি নাকি সন্ধ্যার দিকে আসবি? ”

সুমির প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করল নিহিতা,
” নাদিমের সাথে যাব কেন? ”
” ওর বাসা চিনতে। তুই তো নাদিমের বাসা চিনিস না। ”
” ওর বাসা চিনে কী হবে? ”

সুমি বিরক্ত হয়ে বলল,
” বার্থ ডে পার্টি ওদের বাসায় হবে তাই। ”

মুহূর্তে নিহিতার দুর্বল মন সবল হয়ে উঠল। সব কিছু ভুলে শক্ত স্বরে বলল,
” অসম্ভব! তোর বাসায় হলে একটা কথা ছিল। নাদিমের বাসায় হলে কিভাবে যাব? শুনেছি ও এখানে চাচার সাথে থাকে। তার মধ্যে চাচি জীবিত নেই। ”
” তোর চাচিকে দিয়ে কী কাজ? ”
” আমার কোনো কাজ নেই। যে বাসায় মহিলা মানুষ নেই। সে বাসায় যাওয়াই উচিত না। আর তুই বলছিস রাতে ওখানে থাকতে। তোদের কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? ”

পাশ থেকে সেতু বলল,
” মহিলা নেই দেখেই নাদিমের বাসা ঠিক করা হয়েছে। মহিলারা থাকলে অনেক ঝামেলা। কোনো কিছু ঠিক মতো করা যায় না। সারাক্ষণ নজরে রাখে আর শাসায়! ”
” আমাদের ভালোর জন্যই করেন। একজন মেয়েই জানেন অন্য মেয়ের বিপদ সীমা সম্পর্কে। ”

সেতু মুখ বাঁকাল। নাদিম বিরক্তে অন্য দিকে চলে গেল। সুমি ধৈর্য্য ধরে কঠিন সুরে বলল,
” আর একটা কথাও না। তুই এখনই আংকেলকে কল দিয়ে বল আজ বাড়ি ফিরছিস না। আমার সাথে থাকবি। ”

নিহিতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সুমি নিজেই কল ঢুকিয়ে বলল,
” তোর বলতে হবে না। আমি-ই বলছি। ”

নিহিতা দ্রুত ফোন কেড়ে নিল। বেশ কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটির পর নিহিতা বলল,
” আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি বাবাকে বলব তিনি যদি অনুমতি দেন আসব। কিন্তু হ্যাঁ, মিথ্যে নয় সত্য বলে। আমি চাই তোদেরকে খুশি করতে কিন্তু আল্লাহকে অখুশি করে নয়। পাপ করে নয়। ”

_________________

মাহদীর কথামতো পরের দিনই শিহাব মনের সাথে দেখা করতে এলো। অনেক কথাবার্তা শেষে বলল,

” সবই বললি কিন্তু নায়রা ভাবি কেন বাবার নাম্বার দিয়েছিল সেটা বললি না। ”

কথাটা সহজ মনে বলে ভয় পেয়ে গেল শিহাব। বন্ধুর চোখ-মুখের ভাব পালটে গেছে। কাঠিন্য চেহেরার দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল। একটু দূরে সরে বলল,
” বলতে হবে না। কিছু বলতে হবে না। আমি আজ উঠি। ”

মাহদী শিহাবের শার্ট টেনে ধরল। জোর করে বিছানায় বসিয়ে বলল,
” আমার বউ তোর ভাবি। ভাবি মানে ভাবি। শুধু ভাবি বলবি। ফের যেন নাম ধরে বলতে শুনি না। ”

শিহাব আড়ষ্টভঙ্গিতে মাথা এক পাশে কাত করল। সে ভেবেছিল অন্য কিছু। এখন বুঝল ভাবির আগে নাম উচ্চারণ করার জন্য রেগে গেছে।

এবার শিহাবের প্রশ্নের উত্তর দিল মাহদী,
” সে দিন তাড়াহুড়োয় টিকেট ছাড়াই ট্রেনে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম টিটিকে টাকা দিয়ে সামলে নিব। তার আর প্রয়োজন হলো না। টিটি টিকেট চাইতেই নায়রার বাবা আমারটা সহ তার টিকেট দেখাল। ”
” নায়রার বাবার কাছে তোর টিকেট গেল কী করে? ”
” আমার টিকেট না। ঐ সিটের টিকেট। যদিও তখন অনেক অবাক হয়েছিলাম। পরে নায়রার কাছ থেকে শুনেছি ওর বাবা নাকি সব সময় দুই সিটের টিকেট কাটে। ”
” কেন?”
” নিজের সুবিধার জন্য। উনি কখনও নামাজ কাযা করেন না। গাড়িতে থাকা অবস্থায়ও পড়েন। নামাজ পড়ার সময় যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য। এ ছাড়া আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। সে দিন নায়রার বাবাও ঢাকার দিকে যাচ্ছিলেন। আর নায়রা জানত তার বাবার কাছে দুটো টিকেট আছে। সেজন্যই হয়তো সাহায্য করতে চেয়েছিল। ”

শিহাব প্রথমে ভালো মতো বুঝতে পারল না। পরক্ষণে সব কিছু নিজের মতো গুছিয়ে নিল।

____________

ঘরের আলো নিভে যাওয়ার পরও বার বার মোবাইলে আলো জ্বেলে সময় দেখছেন এরশাদ রহমান। বারোটা পার হতে নিহিতার নাম্বারে কল দিলেন।

দুপুরে খাওয়ার সময় নিহিতা জন্ম দিনে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিল। তিনি যাওয়ার অনুমতি দিলেও থাকার অনুমতি দেননি। বলেছিলেন তাদের আনন্দ-উল্লাস কমে আসলে যেন বাবাকে কল দেয়। যত রাতই হোক তিনি গিয়ে নিয়ে আসবেন।

প্রথম বার কল হয়ে কেটে গেলে আবার কল দিলেন এরশাদ রহমান। দ্বিতীয় বারে ফোন বন্ধ আসতে তার ভেতরটা কেমন করে উঠল! যেন কোনো মাংসাশী প্রাণী তার কলিজাটা কামড়ে ধরে আছে। তিনি তাৎক্ষণিক পাঞ্জাবি পরে বাইরে বের হলেন। স্ত্রীর পিছু ডাকের তোয়াক্কা করলেন না। বারান্দা পার হয়ে উঠোনে পা পড়তে মাহদী ডেকে উঠল,
” বাবা? ”

এরশাদ রহমান চমকে উঠলেন। কিছুটা ভয়ও পেলেন বোধ হয়। উত্তর দেওয়ার পূর্বে মাহদী নিকটে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
” এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন? ”

এরশাদ রহমান তখনও নিজেকে ধাতস্থ করতে পারেননি। আরও কিছুক্ষণ সময় পর দুর্বল স্বরে বললেন,
” নিহিতাকে আনতে। ”

চলবে

[রোমান্টি আপুরা ধৈর্য্য ধরো।😒]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here