#মরুর_বুকে_বৃষ্টি 💖
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৩৫
★ভার্সিটির মাঠের পাশে গাছের নিচে বসে আছে নূর। এমনি এমনি বসে নেই। কারও জন্য অপেক্ষা করছে ও। আসলে আজকে হিস্ট্রি প্রফেসর ওদের সবাইকে একটা প্রজেক্ট দিয়েছে। প্রজেক্ট টা দুজন মিলে করতে হবে। সবাইকে ফোর্থ ইয়ারের একজন সিনিয়রের সাথে এই প্রজেক্ট করতে হবে। কার সাথে কার পেয়ার হবে সেটাও প্রফেসর ডিসাইড করে দিয়েছে। নূরের কার সাথে পেয়ার হয়েছে তা সে জানেনা। তাই সে এখানেই বসে আছে। প্রফেসর বলেছে ওর যার সাথে পেয়ার হয়েছে সে নাকি এখানেই এসে দেখা করবে।
অনেকক্ষণ ধরে বসে থেকে নূর বিরক্ত হয়ে গেছে। নূর বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে নিল। হঠাৎ একটা ইটের টুকরার সাথে পা বেজে পরে যেতে নেয় নূর। তবে পরে যাওয়ার আগেই কেউ এসে ওকে ধরে ফেললো। নূর মাথা তুলে দেখলো একটা ছেলে ওকে ধরে আছে। নূরের ব্যাপার টা কেমন যেন ভালো লাগলো না। নূর দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ছেলেটা এখনো কেমন যেন হা করে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পলকই যেন পরছেনা।
লোকটাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নূরের খুব অস্বস্তি লাগছে। নূর একটু গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো।
ছেলেটার এতক্ষণে ঘোর কাটলো। ছেলেটা তার ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বললো।
–সরি সরি আপনাকে এতক্ষণ অপেক্ষা করানোর জন্যে। আসলে আমার ক্লাস চলছিল তাই আসতে দেরি হয়ে গেল।
নূর বুঝতে পারলো,তারমানে এই লোকটাই ওর প্রজেক্টের পার্টনার। নূর জোরপূর্বক মুচকি হেসে বললো।
–ইটস ওকে।
–প্রথমে পরিচয় পর্বটা জেনে নেয়া যাক? হাই অ্যাম শিশির।
কথাটা বলে শিশির ওর ডান হাতটা নূরের দিকে বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেক করার জন্য।
নূর অনিচ্ছা সত্ত্বেও সৌজন্যবোধ দেখানোর জন্য সে নিজের ডান হাতের আঙুল গুলো শিশির হাতে হালকা করে ছুঁইয়ে বললো।
–অ্যাম মেহরুমা নূর।
শিশির নূরের হাত ধরে থেকেই বললো।
–ওয়াও নূর। ইটস রিয়েলি নাইস নেম। একদম তোমার মতোই তোমার নামটাও সুন্দর।
নূর তাড়াতাড়ি ওর হাতটা সরিয়ে নিয়ে একটু সৌজন্যমূলক হাসলো। লোকটার কথাবার্তায় চরম অস্বস্তিবোধ করছে নূর। তাই টপিক চেঞ্জ করে বললো।
–আমরা কাজ শুরু করি প্লিজ? এমনিতেও দেরি হয়ে গেছে অনেক।
–ইয়া ইয়া শিওর। লেটস গো।
দুজন ওদের প্রজেক্টের কাজ শুরু করে দিলো। তবে শিশিরের চোখ যেন নূরের ওপর থেকে সরছেই না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শুধু নূরকেই দেখে যাচ্ছে। কিন্তু নূরের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। ও ওর মতো কাজ করে যাচ্ছে।
_____
বিহান আদিত্যের রুমে এসেছিল একটা জরুরি ফাইল নিতে। আদিত্যই ওকে বলেছিল। ফাইল টা নিয়ে বের হয়ে করিডর দিয়ে হেঁটে আসতে নিলে হঠাৎ কিছু কথা কানে আসতেই বিহান কদম আপনাআপনি থেমে গেল। পাশেই আয়াতের রুম। রুমের ভেতর আয়াত আর ওর বেস্ট ফ্রেন্ড কথা বলছে। সেসব কথাই বিহানের কানে এসেছে। আয়াতের বেস্ট ফ্রেন্ড সামিয়া আয়াত কে বলছে,
–তুই রাফিন সাহেবের প্রপোজাল মানা করে দিলি কেন? উনার মতো একজন ছেলে তোকে প্রপোজ করেছে সেটাতো তোর সৌভাগ্য।জানিস উনাকে বিয়ে করার জন্য কতো মেয়ে হাহাকার করছে? আর তুই কিনা সোজা মানা করে দিলি? আরে একবার ভেবেও তো দেখতে পারতিস?
আয়াত বলে উঠলো।
–ইয়ার তুইতো সব জানিসই তাও কেন এসব বলছিস?
–হ্যাঁ হ্যাঁ জানি জানি। তুই আর তোর পাগল ভালোবাসা। আরে সারাজীবন কি মানুষ একটার পেছনেই পরে থাকে নাকি? জীবনে মুভ অন করা শেখ। অন্য কাওকে ভালোবাসার চেষ্টা করে দেখ। দেখবি অনেক সুখী হবি।
আয়াত হতাশার সুরে বললো।
–এইটাই তো আমার দ্বারা সম্ভব নারে। তুই জানিস আমি চেষ্টা করলে হয়তো সবই পারবো। হয়তো একবারের জন্য চেষ্টা করে এভারেস্টও জয় করতে পারবো,হয়তো বা চেষ্টা করে সাতরে সমুদ্রও পার হতে পারবো। তবে অন্য কাওকে ভালোবাসার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা আমার নেই। আমার দ্বারা সেটা কখনোই হবে না। অন্তত এই জনমে তো আর সম্ভব না। মানুষ এক জীবনে যতটুকু ভালোবাসতে পারে আমি তার সবটুকু শুধু একজনকেই উজাড় করে দিয়েছি। এখন আর অন্য কাওকে দেওয়ার মতো কিছুই বাকি নেই আমার মাঝে। তুই জানিস? আমার সেই কিশোরী কাল থেকে। যখন আমি ভালোবাসা কি সেটা ভালোকরে জানতামও না। তখন থেকেই আমার এই ছোট্ট মনে শুধু একজনেরই বাস হয়েছে। শুধু একজনকেই আমার শয়নেস্বপনে মনের কোঠায় বসতবাড়ি করে দিয়েছি। ধীরে ধীরে যতো বড় হয়েছি সে আমার সবটা জুড়ে দখল করে নিয়েছে। এখন যে সে ছাড়া আমার মাঝে আমি বলতে আর কিছুই বাকি নেই। হ্যাঁ সে না হোক কোন বড়ো ব্যাক্তিত্য। তবুও আমার কাছে সে সবচেয়ে দামি। তার সবকিছুই আমার ভালো লাগে। তার কথা,তার চলাফেরা এমনকি তার বকাটাও আমার কাছে ভালো লাগে। জানি লোকে হয়তো আমাকে পাগল বলবে। তবে এটাই সত্যি। তাকে ভালোবাসা শুধু আমার ইচ্ছে না,আমার প্রয়োজন। তাকে ভালোবাসা বন্ধ করা মানে আমার নিঃশ্বাস ফুরিয়ে যাওয়া। এখন তুই বল আমি কিভাবে অন্য কাওকে ভালোবাসবো? শুধু শুধু কাওকে আমি মিথ্যে আশা দিতে চাইনা।
সামিয়া এবার একটু রাগী সুরে বললো।
–তা তুই যার জন্য এতো দিওয়ানি হয়ে আছিস, তার কি তোর কোন কিছুতে আসে যায়? সেতো তোকে পাত্তাই দেয়না। তোকে কুকুর বিড়ালের মতো তাড়িয়ে দেয়। তাহলে তুই কেন ওই নিষ্ঠুর জালিম লোকের জন্য নিজেকে জ্বলাচ্ছিস? ওই স্বার্থপর বদমাইশ লোকটা তোর এতো ভালোবাসার যোগ্য না।
আয়াত ধরা গলায় বললো।
–এভাবে বলিস না। উনিও উনার জায়গায় ঠিক আছেন। উনারাও নিজের বাধ্যবাধকতা আছে। তাই তার প্রতি এখন আর কোন অভিযোগ নেই আমার। হয়তো আমিও উনার জায়গায় থাকলে এটাই করতাম।
কথাগুলো বলতে বলতে আয়াতের চোখ ভরে উঠলো। আয়াত একটু থেমে আবার ব্যাথিত কন্ঠে বলে উঠলো।
–তবে একটা কথা কি জানিস? যতই উনার সামনে স্ট্রং আর স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করিনা কেন। ভেতরে ভেতরে আমি প্রচুর ভেঙে পড়ি। আমার এই অবুঝ মনটাকে কিছুতেই বুঝাতে পারিনা। এই পাগল মনটা যে এখনো তাকে পেতে চায়। তাকে অতি আপন করে কাছে পেতে চায়। তার বুকে মাথা রেখে একটু শান্তি পেতে চায়। তার হাতে হাত রেখে অনেক দূর চলতে চায়। জানিস, যখন আশেপাশে সবাইকে তার প্রিয়জনের সাথে হাসিখুশি দেখি। তখন আমার অনেক হিংসে হয়। মনে হয় আমার সাথেই কেন এমন হলো? কেন আমি আমার প্রিয়জনকে কাছে পাইনা? কেন তার সান্নিধ্যে পাইনা। আমাকে চাওটা কি খুব বেশি? বলনা সামিয়া আমি কি খুব বেশি লোভি হয়ে গিয়েছি?
বলতে বলতে আয়াতের চোখের পানি অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে।
সামিয়া আয়াতকে জড়িয়ে ধরে ওকে শান্ত করতে লাগলো। আসলে আয়াতকে শান্তনা দেওয়ার কোন ভাষাই নেই ওর কাছে। মেয়েটার জন্য খুব খারাপ লাগে ওর।
এতক্ষণ ধরে এদের কথাবার্তা শুনে বিহান পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল। হাত পা অসাড় হয়ে এলো। আয়াতের ভালোবাসা যে এতো গভীর তা কখনো বুঝতেই পারেনি বিহান। ওর নিজেকে আজ সত্যি সত্যিই দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ মনে হচ্ছে। ও কিভাবে পারলো এই মেয়েকে এতো কষ্ট দিতে। কিভাবে পারলো ওকে কাঁদাতে। এসব ভেবে নিজের অজান্তেই বিহানের চোখে পানি এসে গেল। বিহান হাতের আঙুল দিয়ে নিজের চোখের পানি ধরে সামনে এনে অবাক চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো।
–তুই কি কাঁদছিস বিহান। হ্যাঁ তোর তো কাঁদারই দরকার। শুধু পানি না তোর চোখ দিয়ে তো রক্ত ঝড়া দরকার। এমন হিরাকে পায়ে ঠুকরানোর জন্য তোর ভয়ংকর শাস্তি হওয়ার দরকার। কতো কষ্ট দিয়েছিস তুই মেয়েটাকে।
বিহান নিজেকে একটু ঠিক করে নিয়ে মনে মনে বললো।
–তবে আর না। অনেক হয়েছে। এবার আমিও একটু স্বার্থপর হবো।এবার আর অন্য কিছুর কথা ভাববো না আমি। এই মেয়েটাকে দুনিয়ার সব খুশী দিয়ে ভরিয়ে দেব। এখন থেকে আমার জীবনের শুধু একটাই উদ্দেশ্য। আয়াতকে সর্বসুখ দেওয়া।
কথাটা ভেবে বিহান ওখান থেকে চলে গেল।
_____
ক্লাস শেষে নূর গেটের কাছে এসে দাড়িয়েছে। আদিত্য প্রায় সময়ই ওকে নিতে আসে। আর নূর না মানলেও মনে মনে ও নিজেও আদিত্যের অপেক্ষা করে। আদিত্যের সাথে সময় কাটাতে তার ভালো লাগে। যদিও নূর উপরে উপরে সেটা দেখায় না। তবে তার মনটা ঠিকই আদিত্যের মায়ায় আটকে পরেছে।
নূরের ভাবনার মাঝেই একটা গাড়ি এসে ওর সামনে থামলো। নূর তাকিয়ে দেখলো ওই শিশির ছেলেটা। শিশির গাড়ি থেকে নেমে নূরের সামনে এসে বললো।
–আরে নূর বাসায় যাচ্ছো বুঝি? চলো আমি তোমাকে ড্রপ করে দিবো।
নূর জোরপূর্বক মুচকি হেসে বললো।
–না না তার কোন দরকার নেই। আমি চলে যেতে পারবো। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
–এটা কেমন কথা নূর? আমরা তো এখন ফ্রেন্ডস তাইনা? তো আমাদের মাঝে এতো ফর্মালিটির কি আছে? আর তোমাকে ড্রপ করে দিলে আমার কষ্ট না বরং আরও ভালো লাগবে। প্লিজ আই ইনসিস্ট।
নূর পরে গেল এক মহা মুশকিলে।নূরের ইচ্ছে নেই শিশিরের সাথে যাওয়ার। তবে লোকটা এতো রিকুয়েষ্ট করছে না গেলেও কেমন অভদ্রতা দেখায়। তাছাড়া লোকটা নূরের প্রজেক্টে অনেক হেল্প করেছে। যার জন্য নূরের এসাইনমেন্ট ক্লাসে সবচেয়ে ভালো হয়েছে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও লোকটার কথা রাখত হবে। নূর একবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আদিত্যর গাড়ি এসেছে কিনা। নাহ কোথাও দেখতে পেল না। তাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অগত্যা শিশিরের সাথে যেতে রাজি হয়ে গেল। শিশিরের খুশি আর দেখে কে। শিশির হাসিমুখে গাড়ির দরজা খুলে নূরকে গাড়িতে উঠে বসতে বললো। নূর শেষমেশ এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।
আর ওই সময়ই আদিত্য ওর গাড়ী নিয়ে চলে এলো। রাস্তায় একটু জ্যাম থাকায় আদিত্যর পৌঁছাতে একটু দেরি হয়ে গেছে। আদিত্য গাড়ির ব্রেক কষতেই সামনে তাকিয়ে দেখলো নূর অন্য একটি ছেলের গাড়িতে উঠছে। আর ছেলেটি কেমন হাসিমুখে নূরের দিকে তাকিয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে আদিত্যের চোয়াল আর হাতের মুঠো শক্ত হাতে এলো। আর দেখতে দেখতেই ওদের গাড়ি স্টার্ট হয়ে চলতে শুরু করলো। আদিত্যও রাগী চোখে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ওদের পেছনে পেছনে ছুটলো। পুরো রাস্তা আদিত্য ওদের গাড়ির পেছনে পেছনেই এলো।
বাসার সামনে এসে নূরদের গাড়ি থামলো। আদিত্যও ওর গাড়িটা ওদের থেকে কিছুটা দূরে থামালো। গাড়ি থামিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো। নূর গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালে শিশিরও বেড়িয়ে এলো। হ্যান্ডশেক করার জন্য নূরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাসিমুখে বললো।
–ওকে দেন, বাই নূর। আজকের দিনটা অনেক স্পেশাল ছিল। থ্যাংক ইউ সো মাচ নূর। কাল আবার দেখা হচ্ছে তাহলে।
নূর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভদ্রতার খাতিরে শিশিরের হাতে হালকা হাত ছোয়ালো। তারপর শিশির চলে গেল। আর নূরও ভেতরে ঢুকে গেল।
আর আদিত্য শুধু রাগে ফেটে যাচ্ছে। আদিত্য ওর এক লোককে ফোন করে বললো।
–শোন আমি তোমাকে একটা গাড়ির নাম্বার বলছি। এই গাড়ির মালিকের সব ডিটেইলস চাই আমার। আজকের ভেতরেই।
কথাটা বলে আদিত্য ফোন কেটে দিয়ে একটু পরে সেও বাসার ভেতর ঢুকলো।
নিজের রুমে এসে আদিত্য যেন কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। কেমন অস্থির অস্থির লাগছে ওর। সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।আদিত্যের হঠাৎ বিহানের বলা কথাটা মনে পড়লো,”আদি নূরের জীবনে যদি অন্য কেও চলে আসে, আর নূরের যদি তাকে ভালো লেগে যায় তাহলে কি করবি তুই? “।
নাহ না না কখনোই না। নূর শুধু আমার, শুধুই আমার। ওর জীবনে আসা তো দূরে থাক। ওর দিকে চোখ তুলে তাকানোরও অধিকার কারোর নেই। কারোর না। আর যে চোখ ওর দিকে তাকাবে তাকে এই দুনিয়ার আলো থেকে বঞ্চিত করে দেব আমি।
নূর একটু ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে এসে আদিত্যের রুমের দিকে উঁকিঝুকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে আদিত্য এসেছে কিনা। তখনই ওর মা এসে যথারীতি নূরের হাতে কফির মগ ধরিয়ে দিয়ে বললো।
–যা আদিত্যকে কফি দিয়ে আয়।
আজ আর নূরের রাগ হলোনা। বরং মনে মনে খুশিই লাগলো। এই উছিলায় আদিত্যকে দেখা যাবে এটা ভেবে। নূর বিনাবাক্যে কফির মগ নিয়ে আদিত্যের রুমের দিকে এগুলো। রুমের দরজায় এসে কয়েকবার টোকা দিল।কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ এলো না। তাই নূর এবার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে এসে দেখলো আদিত্য বেডের ওপর দুই হাতে মাথার চুল চেপে ধরে মাথা নিচু করে বসে আছে। নূর আদিত্যের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো।
–আপনি ভেতরেই আছেন তাহলে কথা বললেন না কেন?
আদিত্য কিছুই বলছে না। এখনো আগের মতোই আছে। নূর একটু ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি হয়েছে চুপ করে আছেন কেন?
আদিত্য তাও চুপ।
নূর এবার একটু চিন্তিত সুরে বললো।
–আপনার কি মাথা ব্যাথা করছে? এইযে গরম গরম কফি খেয়ে নিন।মাথা ব্যাথা সেরে যাবে।
আদিত্য তবুও আগের মতোই আছে। নূরের এবার বিরক্ত লাগছে। ও কখন ধরে কথা বলে যাচ্ছে আর লোকটা কোন জবাবই দিচ্ছে না। নূর তাই কফির মগটা বেডের পাশে ছোট টেবিলের ওপর রেখে বললো।
–আপনার কফি রাখলাম খেয়ে নিয়েন।
কথাটা বলেই নূর চলে যেতে নিলে আদিত্য আগের মতোই মাথা নিচু অবস্থায়ই গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো।
–ছেলেটা কে ছিল?
আদিত্যের কথায় নূর থেমে গেল। আদিত্যের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো।
–ছেলে? কোন ছেলে?
–যার সাথে গাড়িতে আসলে সেই ছেলেটা কে ছিল?
নূর কিছুক্ষণ ভাবার পর বুঝতে পারলো আদিত্য শিশিরের কথা বলছে। নূর ব্যাপার টা একটু আচ করতে পারলো। তাহলে কি উনি শিশিরের সাথে আমাকে দেখে এমন মুখ ফুলিয়ে আছেন। কথাটা ভাবতেই নূর একটা বাঁকা হাসি দিল। আব আয়েগা মাজা। কাল আমাকে জ্বালিয়ে ছিল না, আজ আমার পালা। আজকে আমিও ওনাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একদম কয়লা করে দেব। মাথার ভিতরে এসব সয়তানি বুদ্ধি পাকিয়ে নূর একটু আহ্লাদী কন্ঠে উঠলো।
–ওওও উনার কথা বলছেন? উনি আমার ফ্রেন্ড। বলতে গেলে একদম স্পেশাল ফ্রেন্ড। অনেক ভালো লোক উনি। দেখতেও মাশাল্লাহ একদম হি,,,,
নূরের কথা পুরো হওয়ার আগেই আদিত্য এক ঝটকায় মাথা তুলে অগ্নিলাল চোখে নূরের দিকে তাকালো। আদিত্যর এমন ভয়ংকর চাহনি দেখে নূরের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। ভয়ে ওর কন্ঠনালী বন্ধ হয়ে গেল। আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে নূরের হাত চেপে ধরে দেয়ালের সাথে আটকে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে রাগী কন্ঠে বললো।
–ডোন্ট ইউ ডেয়ার নূর। অন্য কাওকে হিরো বলার চেষ্টাও করবে না তুুমি। তোমার হিরো শুধু আমি বুঝতে পেরেছ তুমি। আর কিসের ফ্রেন্ড হ্যাঁ? একটা কথা মনে রাখবে নূর, আমি সবকিছু সহ্য করতে রাজি আছি। তবে এমন কিছু করোনা যা আমি কখনো মাফ করতে পারবো না।
আদিত্যের কথা নূর পুরোটা বুঝতে না পারলেও, আদিত্য যে ভয়ংকর রেগে আছে সেটা ঠিকই বুঝতে পারছে ও। তাই ভয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো।
–আ আমার ভার্সিটির সিনিয়র ভাইয়া উনি। আজকে উনার সাথে একটা প্রজেক্টে কাজ করতে হয়েছে। ত তাই একটু পরিচিত হয়েছি। আর কিছু না।
নূরের কথায় আদিত্যর রাগ একটু কমে এলো। আদিত্য চোখ বন্ধ করে নিজেকে একটু সামলে নিল। তারপর নূরকে ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলো।
–ঠিক আছে এখন যাও।
নূর যেন এটারই অপেক্ষায় ছিল। আদিত্য বলতেই এক দৌড়ে ছুটে পালালো রুম থেকে।
_____
নীলা বারবার আবিরকে ফোন করে যাচ্ছে তবে আবির ফোন ধরছে না। আসলে আবির নীলাকে কাল দেখা করতে বলেছিল কিন্তু নীলা বাসা থেকে বেরো বার সুযোগ পায়নি। আর সেই জন্যই আবির রেগে বম হয়ে আছে। নীলা কাল থেকে ফোন দিচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছেই না। এভাবে আরও একবার ফোন দিল নীলা। এবার ফোনটা রিসিভ হলো। নীলা একটু খুশী হয়ে যেই কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবির কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠলো।
–বারবার ফোন দিয়ে বিরক্ত করছ কেন? তুমি থাকো তোমার কাজ নিয়ে। আমার মতো নগগ্ন ব্যাক্তিকে আবার তোমার মনে পরছে কেন?
–আরে আমার কথাটা তো শুনবেন,,
–কোন কথা নেই আর। আজ থেকে তোমার আমার ব্রেকআপ। আমার বাবা সুন্দর একটা মেয়ে দেখেছেন আমার জন্য। সে আমাকে সময় আর চুমু দুটোই দেওয়ার জন্য এভার রেডি হয়ে বসে আছে। তাই আমি তাকেই বিয়ে করবো। তোমাকে সময়মত বিয়ার কার্ড পৌঁছে দেব। এসে আমার সুন্দর বউটা দেখে যেও।
কথাটা বলেই আবির খট করে ফোনটা কেটে দিল। তারপর বাঁকা হেসে মনে মনে বললো, এখন দেখ কেমন লাগে। আমাকে ইগনোর করা তাইনা?
এদিকে ফোন কাটতেই নীলা রাগে কটমট করে উঠলো। আবিরের কথা শুনে ওর রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। এতো বড়ো সাহস, আমার সাথে ব্রেকআপ? আবার আমাকে রেখে বিয়ে করার ধান্দা হচ্ছে? করাচ্ছি বিয়ে। এমন মজা দেখাবো বাপের জন্মে বিয়ের নাম ভুলে যাবে।ঘুঘু দেখেছ ঘুঘুর ফাঁদ দেখোনি। আজতো তোমাকে দিনের বেলায় যদি আকাশের তারা না দেখিয়ে দিয়েছও তো আমার নামও নিলা না। মনে মনে একটা প্ল্যান ভেবে সয়তানি হাসি দিল নীলা। #মরুর_বুকে_বৃষ্টি 💖
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৩৬
★নূর মাত্রই ভার্সিটিতে এসেছে। হেঁটে ক্লাসের দিকে যাচ্ছিল ওমনই কোথাথেকে শিশির এসে হাজির হলো। নূরের সামনে এসে হাসি মুখে বললো।
–হায় নূর। কেমন আছ তুমি?
হঠাৎ শিশিরকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ছেলেটা কেমন যেন গায়ে পড়া টাইপের। নূরের আবার কালকের আদিত্যের কথা মনে পরতেই ভীষণ ভয়ও করছে। আবার যদি উনি এই লোকটার সাথে আমাকে দেখেন তাহলে আর রক্ষা নেই। নিশ্চয় আমাকে লবন দিয়ে গিলে খেয়ে ফেলবেন। নূরের ভাবনার মাঝেই শিশির বলে উঠলো।
–হেই নূর কি ভাবছ? চলো একটু ক্যাফেতে যাই। ক্লাসের তো এখনো সময় আছে।
নূর জোরপূর্বক হেসে বললো।
–আসলে আমার একটু নোট লিখার দরকার ছিল। আপনি যান না।
–আরে এটা কোন ব্যাপার হলো।তোমর নোট আমি লিখতে হেল্প করবো। এখন চলো। নাকি আমার সাথে যেতে চাচ্ছ না? আমার সাথে কি এককাপ কফি খাওয়া যায় না?
নূর চরম বিরক্ত হচ্ছে মনে মনে । কেনরে ভাই? তোর কি খেয়ে দেয়ে আর কোন কাজ নেই? ক্যাফেতে গিয়ে মরতে হবে কেন? আমি আছি আমার জ্বালায়। আর এই মহাশয় আছেন উনার কফি নিয়ে। সিনিয়র ভাই হয়। মানাও করতে পারছি না। নাহলে আবার নাজানি কি ভেজাল করে বসে। তাই অগত্যা নূর আর উপায় না পেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিশিরের সাথে কফি খেতে রাজি হয়ে গেল।
আর শিশির তো সেই খুশী। নূরকে পটানোর কোন রকম সুযোগ সে হাত ছাড়া করবে না। মেয়েটাকে তার মনে ধরে গেছে। আর যে একবার শিশিরের মনে ধরে যায় তাকে সে যেভাবেই হোক হাসিল করেই ছাড়ে। আর এই মেয়েটাকে একটু বেশিই মনে ধরেছে। তাই একেতো কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। কথাটা ভেবে শিশির বাঁকা হাসি দিল।
আদিত্য ওর অফিসের কেবিনে বসে আছে। তখনই ওর এক লোক কেবিনের দরজায় নক করলো। আদিত্য আসতে বললে লোকটা ভেতরে ঢুকলো। আদিত্যের সামনে একটা ফাইল রেখে বললো।
–স্যার আপনার দেওয়া গাড়ির নাম্বার অনুযায়ী গাড়ির মালিকের সব ডিটেইলস বের করেছি।
আদিত্য গম্ভীর কন্ঠে বললো।
–বলতে শুরু করো।
–স্যার গাড়ির মালিকের নাম শিশির আহমেদ। শামসুল আহমেদ এর একমাত্র ছেলে। এমনিতে সবদিক দিয়ে ঠিক ঠাকই আছে। পড়ালেখায়ও ব্রিলিয়ান্ট। শুধু একটা দিক প্রবলেম আছে।
আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি?
–স্যার ছেলেটা সেই লেভেলের মেয়েবাজ। মানে ক্যারেক্টার লেস আরকি। যাকে একবার ভালো লেগে যায় তাকে যেভাবেই হোক তার নিজের করেই ছাড়ে। আর তারপর, বাকিটা তো বুঝতেই পারছেন।
–হুম বুঝতে পেরেছি। তুমি এখন যেতে পারো।
লোকটা মাথা ঝাকিয়ে চলে গেল।
আদিত্য ফাইলে থাকা শিশিরের একটা ছবি হাতে নিয়ে সামনে ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তড়ে।
কথাটা বলে আদিত্য একটা বাকা হাসি দিয়ে, শিশিরের ছবিটা দুমড়েমুচড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল।
_____
আয়াত ওর রুমে বসে এনজিওর কিছু পেপারস দেখছিল, তখনই ওর দরজায় কেউ নক করলো। আয়াত পেপারের দিকে তাকিয়ে থেকেই আসতে বললো। একটু পরে বিহান দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। আয়াত এখনো পেপারস চেক করছে। বিহান চুপচাপ কিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে আয়াতের দিকে তাকিয়ে রইলো। আয়াত মাথাটা হালকা নিচু করে পেপার দেখছে। চুলগুলো উপরে চায়না কাটা দিয়ে আটকে রেখেছে। তবুও কিছু অবাধ্য চুল বাতাসে মুখের ওপর দিয়ে বাড়ি খাচ্ছে। পেপার চেক করতে করতে হাতের কলম টা কখনো দাঁতের মাঝে আটকে রাখছে। এই অতি সামান্য রুপেও যেন তাকে অপরুপ লাগছে। মেয়েটা যে এতো অপরুপ বিহান আগে খেয়ালই করেনি। আয়াতের ঠোঁটে চেপে রাখা কলমটার ওপর বিহানের অনেক হিংসে হচ্ছে। বিহানের আগেই বিহানের জিনিসে কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক মিনিট, বিহানের জিনিস? তুই তো দেখছি অনেক দূর চলে গেছিস বিহান। নিজের মন্তব্যে নিজের মনেই হাসলো বিহান।
আয়াত এতক্ষণ ধরে কে আসলো তার সাড়াশব্দ না পেয়ে মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো বিহান। তবে আজকের বিহানকে দেখে আয়াত বড়সড় একটা ঝটকা খেল। আয়াত হা হয়ে বিহানের দিকে তাকিয়ে রইলো।হা হওয়ায় ওর মুখের কলমটা ঠাস করে পরে গেল।
বিহান আজ একটা ব্লু জিন্সের ওপর হোয়াইট টিশার্ট পরেছে। মুখের জঙ্গল হয়ে থাকা দারি গোঁফ ট্রিম করে শেভ করেছে। চুলগুলোও সুন্দর করে জেল দিয়ে স্টাইল করে রেখেছে। হাতে রিচ ঘড়ি। সবমিলিয়ে বিহানকে আজ কিলার দেখাচ্ছে। বিহান সবসময় কেমন এলোমেলো অগোছালো হয়েই থাকে। নিজেকে আজকালকার ছেলেমেয়েদের মতো পরিপাটি রাখে না। তবে আজকে বিহানকে অন্যরকম লাগছে। আয়াত যেন ওর চোখই ফেরাতে পারছে না।
আয়াতকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিহান মুচকি হেসে গলা খাঁকারি দিয়ে আয়াতের সম্ভূতি ফেরানোর চেষ্টা করলো। আয়াতের ঘোর কাটলো। ও এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। তারপর বিহানের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো।
–আ আপনি হঠাৎ এখানে? কোন দরকার ছিল?
বিহান বলে উঠলো।
–হ্যাঁ দরকার তো একটু ছিল। আসলে,,,
বিহানের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই আয়াত কৌতুহলী কন্ঠে বললো।
–আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন? না মানে হঠাৎ এতো পরিপাটি হয়ে আছেন। তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি।
–হ্যাঁ যাচ্ছি।
–কোথায়?
–বলবো। তার আগে বলো তুমি কি বেশি ব্যাস্ত আছ?
বিহানের মুখে আবারও তুমি সম্বোধন শুনে, আয়াতের বুকটা আবারও কেঁপে উঠল। আয়াত বলে উঠলো।
–না না তেমন ব্যস্ত নেই। বলুন না কি বলবেন?
–তুমি কি আমার সাথে এক জায়গায় যেতে পারবে?
আয়াত অবাক চোখে তাকিয়ে বললো।
–আমি? কো কোথায় যাবো?
–চলনা? গেলেই দেখতে পাবে। আমার ওপর এটুকু বিশ্বাস তো আছে তোমার তাইনা?
বিহানের কথা কাজ সবকিছু কেমন যেন অন্য রকম লাগছে আজ। আয়াত ঠিক বুঝতে পারছে না। তবুও কোনরকমে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। আপনি বাইরে গিয়ে বসুন।আমি এখুনি রেডি হয়ে আসছি।
কথাটা বলে আয়াত কাবার্ডের দিকে যেতে নিলে বিহান আবার ডাক দিল।
–আয়াত,
–আয়াতের হৃৎপিণ্ড যেন থমকে গেল। আজ এই প্রথম বিহান এতো সুন্দর করে আয়াতের নাম ধরে ডাকলো। আয়াতের হাত পা কেমন কাঁপতে শুরু করলো। গলার ভেতর দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। আয়াত কোনরকমে ঢোক গিলে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–জ্বি বলুন?
বিহান ওর হাতে থাকা একটা প্যাকেট আয়াতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।
–এটা তোমার জন্য এনেছি আমি। জানিনা তোমার পছন্দ হবে কিনা। আসলে তোমাকে সেদিন শাড়ীতে অনেক সুন্দর লাগছিল। তাই আবারও তোমাকে শাড়ীতে দেখার লোভে এটা নিয়ে এসেছি। তুমি যদি কিছু মনে না করো তাহলে আজকে এই শাড়ীটা পরে আসবে প্লিজ?
আয়াত বিস্ময় ভরা চোখে বিহানের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিজের কানকে ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। কেমন যেন সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে। বিহান কি সত্যি আমাকে এসব বলছে? আয়াতের গলা ধরে আসছে। অনেক কষ্টে নিজের কান্না আটকে মাথা ঝাকালো। মানে সে পরবে।
বিহান একটা স্বস্তির হাসি দিয়ে বললো।
–ঠিক আছে। আমি নিচে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
তারপর বিহান বেরিয়ে গেল।
বিহান চলে যাওয়ার পর আয়াত কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেট টা খুললো। প্যাকেটের ভেতর একটা হালকা গোলাপি ইন্ডিয়ান সিল্কের শাড়ী। আয়াতের চোখের পানি এবার বাধ ভেঙে গড়িয়ে পড়লো। আয়াত শাড়ীটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর শাড়ীটা বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে খুশীর অশ্রু ঝড়ালো। এটা ওর বিহানের দেওয়া প্রথম উপহার। আয়াতের যেন খুশিতে পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
কিছুক্ষণ পর আয়াত নিজেকে সামলে নিয়ে, চোখের পানি মুছে শাড়ীটা নিয়ে রেডি হতে চলে গেল।
বিহান ড্রয়িং রুমে বসে আছে। একটু পরে আয়াত সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। বিহান আনমনে পাশে তাকাতেই ওর চোখ আর হৃৎপিণ্ড দুটোই আটকে গেল আয়াতে। ওর কল্পনার চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে আয়াতকে।মেয়েটাকে যত দেখছে ততই যেন তার নতুন নতুন রুপের আবিষ্কার করছে। এই অপরুপ কন্যাটা ওকে এতোটা ভালোবাসে, ভাবতেই একরাশ ভালো লাগা এসে ঘিরে ধরলো বিহানের হৃদয় জুড়ে।
আয়াত বিহানের সামনে এসে দাঁড়াল। বিহানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আয়াতের কেমন লজ্জা লাগছে। আয়াত একটু গলা ঝেড়ে উঠলো। বিহনের এবার ঘোর কাটলো। বিহান একটু নড়েচড়ে উঠে বললো।
–তাহলে যাওয়া যাক?
আয়াত মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। তারপর ওরা দুজন বাইরে এসে গাড়িতে চড়ে রওয়ানা হলো। গাড়ীতে দুজনের ভেতর তেমন কোন কথা হলোনা। তবে বিহান বারবার আরচোখে আয়াতকেই দেখছিল। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর ওরা বনানী এলাকায় একটা এপার্টমেন্ট সামনে এসে থামলো। বিহান গাড়ি থেকে নেমে আয়াতের পাশে এসে দরজা খুলে ওর দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিল। আয়াত শুধু বিস্ময়ের ওপর বিস্ময় হচ্ছে।আয়াতের মনে পড়লো একদিন এই হাত ধরে নামার জন্য কতো জেদ ধরে বসেছিল আয়াত। আর আজ বিহান নিজে থেকেই ওর হাত ধরে নামাবে। সবকিছুই যেন স্বপ্নের মতো লাগছে আজ। যেন চোখ খুলে তাকালেই স্বপ্নটা ভেঙে যাবে।
আয়াত ওর কম্পনরত হাতটা বিহানের হাতে রাখলো। বিহান পরম যত্নে আয়াতের হাত ধরে ওকে নিচে নামিয়ে দাঁড় করালো। আয়াত সামনের এপার্টমেন্ট টা দেখে বললো।
–আমরা কি কারোর বাসায় এসেছি?
বিহান বলে উঠলো।
–হ্যাঁ তেমনই কিছু। চল গেলেই দেখতে পাবে।
কথাটা বলে বিহান আয়াতের হাত ধরে থেকেই ভেতরের দিকে পা বাড়ালো।
আয়াত শুধু বিহানের ধরে থাকা হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিহানের সাথে সাথে চললো।
এপার্টমেন্ট টা চৌদ্দ তলা বিশিষ্ট। বিহান আয়াতের সাথে লিফটে এসে টুয়েলভ বাটনে চাপ দিল। মানে ওরা তেরো তলায় যাবে। কিছুক্ষণ পরেই তেরো তলায় পৌঁছে লিফট থেকে নেমে এসে একটা ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়াল। ফ্ল্যাটের দরজায় এসে বিহান ওর পকেট থেকে একটা চাবি বের করে দরজা খুলছে। আয়াত শুধু বিহানের কার্যক্রম দেখে যাচ্ছে। ওর মাথায় আপাতত কিছুই ঢুকছে না। বিহান দরজা খুলে আয়াতকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।
ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে আয়াত অনেক টা অবাক হলো। কারণ ফ্ল্যাট টা একদম নতুন। দেয়াল থেকে এখনো রঙের ঘ্রাণ আসছে। তেমন কোন আসবাবপত্রও দেখা যাচ্ছে না। শুধু হালকা পাতলা কিছু জিনিস আছে। তবে ফ্ল্যাট টা অনেক সুন্দর। আয়াতের কাছে ভালোই লাগলো ফ্ল্যাট টা। ফ্ল্যাট টা উঁচুতে হওয়ায় জানালা দিয়ে ঠান্ডা শীতল বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে। আর এই জিনিসটাই আয়াতের সবচেয়ে ভালো লাগছে। আয়াত আর কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–এটা কার ফ্ল্যাট? এখানে তো কাওকে দেখতেও পাচ্ছি না।
বিহান মুচকি হেসে বললো।
–কেন, আমাকে বুঝি চোখে পরছে না? নাকি আমাকে মানুষের তালিকা থেকে বাতিল করে দিলে?
আয়াত এবারে অত্যন্ত অবাক হয়ে বললো।
–এই ফ্ল্যাট আপনার?
–হ্যাঁ, বলতে পারো। তা কেমন লাগলো ফ্ল্যাট টা?
–অনেক সুন্দর। সত্যিই ভীষণ সুন্দর। মেনি মেনি কংগ্রাচুলেশনস।
–ধন্যবাদ। আসলে ভাবছিলাম কতকাল আর এভাবে ভবঘুরে হয়ে থাকবো। বিয়ে শাদি করে একটু সেটেল্ড হই। আর বিয়ে করতে গেলে আগে একটা ভালো ঘরের দরকার। তানা হলে আবার কোন মেয়ে বিয়েই করতে চাইবে না। তাই নিজের জীবনের কিছু জমাপুঞ্জি দিয়ে এই ফ্ল্যাট টা কিনলাম।
বিহানের কথায় আয়াত থমকে গেল। বুকটা ধড়ফড় করলে উঠলো ওর। কি বলছেন উনি? তাহলে কি উনি বিয়ে করছেন? আয়াতের এতক্ষণের সব খুশী যেন নিমিষেই মাটিতে মিশে আছে। আয়াত একটা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
–আ আপনি ব বিয়ে করছেন?
–হ্যাঁ করতে চাচ্ছি। একটা মেয়েও পছন্দ করেছি। এখন সে শুধু রাজি হয়ে গেলেই হয়।
আয়াতের পায়ের নিচ থেকে যেখানে মাটি সরে গেল। নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হতে লাগলো। তারমানে উনি মেয়েও পছন্দ করে ফেলেছেন? আমার শেষ আশাটাও কি তাহলে এভাবে নিশ্বেষ হয়ে যাবে। তাহলে আমি বেঁচে থাকবো কি করে? আয়াতের ভাবনার মাঝেই বিহান আবার বলে উঠলো।
–মেয়েটা ভেতরেই আছে। তুমি একটু ওকে বুঝাও না আমাকে বিয়ে করতে যেন রাজি হয়ে যায়।
আয়াত এবার আরও বড়ো একটা ধাক্কা খেল। শেষমেশ কিনা এই দিনটাও ওকে দেখতে হলো? এখন কি আমার ওই মেয়েকে রাজি করাতে হবে বিহানকে বিয়ে করার জন্য? তাহলে এতক্ষণ ধরে এতো ভালো ব্যবহার বুঝি এইজন্য করছিলেন উনি? উনি এতটা নির্দয় কিভাবে হতে পারলেন? সবকিছু জেনেও আমাকে এই সিচুয়েশনে কিভাবে ফেলতে পারলেন উনি? এভাবে অপমান না করলেই কি হতোনা? ঠিক আছে। উনি আমাকে জ্বালিয়েই যদি শান্তি পায় তাহলে তাই হোক। আমিও আজ ধৈর্যের পরিক্ষা দেব। দেখি এর শেষ কোথায়?
আয়াতকে চুপ থাকতে দেখে বিহান আবার বললো।
–প্লিজ আয়াত? আমার জন্য একটু এই কাজটা করে দাও? প্লিজ প্লিজ প্লিজ,,,
আয়াত ঢোক গিলে কোনরকমে নিজের কান্না আটকে নিয়ে বললো।
–ঠি ঠিক আছে।
বিহান হাসি মুখে বললো।
–থ্যাংক ইউ আয়াত। থ্যাংক ইউ সো মাচ। তুমি পাশের এই রুমটাতে যাও। দেখবে রুমেই আছে ও।
আয়াত কোনরকমে মাথা ঝাকিয়ে কাঁপা কাঁপা পা জোড়া সামনে বাড়ালো। পা কেমন যেন চলতে চাইছে না ওর। হঠাৎ করেই প্রচুর ভারি হয়ে গেছে পা জোড়া। তবুও অনেক কষ্টে আয়াত রুমের দিকে এগুলো। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো ও। ভেতরে ঢুকে আশেপাশে তাকিয়ে কাওকে দেখতে পেল না আয়াত। আয়াত এবার ভ্রু কুঁচকে একটু উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–এখানে তো কেউ নেই।
এবার বিহান ভেতরে ঢুকলো। আয়াতের কাছে এসে বললো।
–কে বলেছে কেউ নেই? আরে এখানেই তো আছে তুমিই দেখতে পাচ্ছ না।
–আরে আজব। কোথায় আছে? কাওকেই তো দেখতে পাচ্ছি না।
বিহান এবার আয়াতের হাত ধরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিয়ে এসে বললো।
–এইযে ভালো করে দেখো এখানেই আছে।
আয়াত আশেপাশে তাকিয়ে বললো।
–কই আছে আমিতো দেখতে পাচ্ছি না। আপনার হবু বউ কি ইনভিসিবল নাকি? নাকি মানুষ বাদ দিয়ে জ্বীন-ভূতকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন?
বিহান হালকা হাসলো। তারপর আয়াতের পেছনে এসে ওর পিঠ ঘেঁষে দাঁড়াল। এক হাতে আয়াতের থুতনি ধরে আয়নার দিকে তাক করলো। এরপর আয়নার দিকে আঙুল তুলে ইশারা করে বললো।
–এইযে, এতো সুন্দর একটা জলজ্যান্ত মেয়ে তোমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তোমার চোখে পরছে না? এটাই তো আমার হবু বউ। ওর জন্যই তো আমি কাল এই ফ্ল্যাট কিনেছি। ওকে একটু বলনা, ও যেন আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়।
আয়াত কিছু সময়ের জন্য ব্ল্যাংক হয়ে গেল। পুরো ব্যাপার টা বুঝতে ওর কিছুটা সময় লাগলো। আর যখনই বুঝতে পারলো তখনই ওর সারা শরীর যেন অবস হয়ে আসলো। হৃৎপিণ্ডও যেন কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করা গেল।
আয়াতকে চুপ থাকতে দেখে বিহান আবার বলে উঠলো।
–কি হলো বলনা,সে করবে তো আমাকে বিয়ে?
আয়াত হঠাৎ এক ঝটকায় বিহানের কাছ থেকে এক কদমে পিছিয়ে গেল। তারপর দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিল। দরজা আটকে নিচে বসে পরে মুছে হাত চেপে কাঁদতে লাগলো। এটা ওর সুখের কান্না না দুঃখের তা জানেনা ও। শুধু জানে এখন কাঁদতে না পারলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে ও।
বিহানও আয়াতের পিছে পিছে দৌড়ে এলো। আয়াতের বন্ধ দরজার সামনে সে নিজেও বসে পড়লো। তবে আয়াতকে ডাকলো না। মেয়েটা হঠাৎ এতবড় শক নিতে পারেনি। তাই মেয়েটাকে একটু কাঁদতে দেওয়া দরকার। তাহলে মন হালকা হবে।
প্রায় দশমিনিট পর আয়াত নিজেকে একটু সামলে নিয়ে দরজা খুলে বের হলো। দরজা খুলতে দেখে বিহানও উঠে দাঁড়াল। আয়াত দরজা খুলে বিহানের দিকে না তাকিয়ে সোজা বাইরে চলে যেতে লাগলো। বিহান এবার আর চুপ করে না থেকে দ্রুত গিয়ে আয়াতের হাত টেনে ধরলো। আয়াত পেছনে না ঘুরেই হাত মোচড়ামুচড়ি করতে করতে বললো।
–ছাড়ুন আমাকে। বাসায় যাবো আমি?
–তো এটা কি জঙ্গল মনে হচ্ছে তোমার? আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম তখন। সেটার উত্তর না জানা পর্যন্ত তুমি কোথাও যেতে পারবেনা।
আয়াত আর সহ্য করতে পারলোনা। এতদিনের দুঃখ কষ্ট, মান অভিমান সব মিলিয়ে এক বিস্ফোরক তৈরী হলো। আয়াত এক ঝটকায় বিহানের দিকে ঘুরে নিজের হাত ছাড়িয়ে, বিহানের বুকে দুহাত দিয়ে ধাক্কা দিল। ধাক্কা দিতে দিতে কান্না জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলো।
–কি পেয়েছেন কি আপনি হ্যাঁ? সবকিছু আপনার মর্জি মোতাবেক হবে? যখন ইচ্ছে দূরে ছুরে দিবেন।আবার মন চাইলে কাছে টেনে নিবেন? আজ বলছেন বিয়ের কথা, আবার মন ঘুরে গেলে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিবেন। আমাকে কি আপনার খেলনা মনে হয়? আমি কি মানুষ না? আমার কি কোন অনুভূতি নেই? আর কতো খেলবেন আমাকে নিয়ে হ্যাঁ? আপনার কথা মেনে আপনার জীবন থেকে সরে গেছি। তাহলে আবার কেন আমাকে নিয়ে এমন খেলা খেলছেন? আমার কথা আপনি কখনো ভাবেন না। এখন কি আমাকে মেরে আপনি শান্তি পাবে,,,,
আর বলতে পারলোনা আয়াত। বিহান দুই হাতে আয়াতের মুখটা ধরে ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো। এই মুহূর্তে আয়াতকে শান্ত করার জন্য এই উপায়টাই পেল বিহান। আর আয়াত,সেতো পুরো ফ্রিজ হয়ে গেল। হাত পায়ের শক্তি লোভ পেল। পুরো শরীর অসার হয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর আয়াত একটু শান্ত হয়ে এলে বিহান আস্তে করে আয়াতের ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বলে উঠলো।
–আমি ভালোবাসার ক্যাচাল বুঝিনা। ক্যামতে করে তাও জানিনা। তয় একটা কথা আমি বুইঝ্যা গেছি। তোমাকে আমার প্রয়োজন। আমি আমার অন্ধকার অতীত ভুলে, তোমার সাথে নতুন করে জীবন শুরু করতে চাই। এখন তুমি বলো বিয়ে করবে আমায়? দেখ বিয়ের কথা যখন একবার মাথায় এনেছি তখন বিয়েতো করেই ছাড়বো। শারীরিক কিছু দরকারও তো আছে তাইনা? তাই তুমি বলো কি করবে? তুমি রাজি না হলে আমি অন্য কাওকে বি,,,,
এবার আয়াতও একই ভাবে বিহানের মুখ বন্ধ করে দিল। বিহান তার জবাব পেয়ে গেল। তাই খুশী মনে সে এবার আয়াতের অধরে ডুব দিল।
কিছু সময় পর আয়াত বিহানের ঠোঁট ছেড়ে বলে উঠলো।
–খবরদার আর কখনো যদি অন্য কারোর কথা মুখে এনেছেন, তাহলে আমি খুন করে ফেলবো আপনাকে। জানেন তখন কিছু সময়ের জন্য আমার ওপর কি ঝড় বয়ে যাচ্ছিল? এভাবে কেউ ভয় দেখায়?
–তাহলে বলো বিয়ে করবে?
–এখনো আপনাকে বলতে হবে? এই দিনটার জন্য আমি কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি জানেন আপনি? শুধু একবার না হাজার বার রাজি আমি।
বিহান তৃপ্তির হাসি দিয়ে আয়াতের কপালে একটা চুমু খেয়ে আয়াতকে জড়িয়ে ধরলো। এক হাতে আয়াতকে জড়িয়ে নিয়ে, আরেক হাত দিয়ে ফোনটা বের করে আদিত্যের নাম্বারে ফোন দিল। আদিত্য ফোন রিসিভ করতেই বিহান বলে উঠলো।
–আদি আমিও স্বার্থপর হতে চাই। হেল্প করবি আমার।
আদিত্য বুঝে গেল বিহান কি বলতে চাইছে। তাই আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
–অফকোর্স ইয়ার। তোর জন্য তো জান হাজির। তুই চিন্তা করিস না আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলবো।
বিহান খুশিমনে ফোন রেখে দিল। ও জানে আদিত্য থাকলে আর কোন চিন্তা নেই।।
_____
আবির ওর অফিসের কেবিনে বসে কাজ করছিল। হঠাৎ বাইরে কিছু হইচই এর শব্দ পেল আবির। আবির ব্যাপার টা দেখার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে কেবিনের দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো। বাইরে এসে আবিরের কপাল কুঁচকে এলো। বাইরে সব স্টাফ রা একজায়গায় গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ভিরের ভেতর থেকে কোন মহিলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এসব দেখে আবির একটু উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–কি চলছে এখানে?
আবিরের কথায় সব স্টাফ রা দুই দিকে লাইন হয়ে সরে গেল। তখনই মাঝখানে থাকা একজন লম্বা ঘোমটা দেওয়া মহিলাকে বসে থাকতে দেখতে পেল আবির। মহিলাটা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আবিরের দিকে দৌড়ে এসে আবিরের পায়ের কাছে পড়ে বলে উঠলো।
–প্রাণনাদ(প্রাননাথ) প্রাণনাদ। আন্নে এইহানে প্রাণনাদ।
আবির যেন তব্দা খেয়ে গেল। ছিটকে সরে গিয়ে বললো।
–এই এই, কে আপনি? কি করছেন এসব?
মহিলাটি এবার দুই হাতে বুক চাপড়ে আহাজারি করে বললো।
–হায়, হায় এইয়া কিতা কয় আঁর প্রাণনাদ? আঁর প্রাণনাদ আঁরে কয় আঁই কেডা। আঁই এহন কিতা করিয়াম? এই অভাগীর কিতা হইবো অহন?
মহিলার এমন মরাকান্না দেখে আবির বেচারা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কে এই মহিলা? আর এখানে কি করছে তাই বুঝতে পারছে না ও। চেহারাটাও দেখা যাচ্ছে না। তবে মহিলার আওয়াজ কেমন যেন পরিচিত পরিচিত লাগছে ওর কাছে। অফিসের স্টাফরাও সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একজন স্টাফ আরেকজনকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো।
–এই প্রাণনাদ কি জিনিস রে? না মানে গরুর নাদ শুনেছি। তবে প্রাণনাদ কি?
আরেকজন বলে উঠলো।
–আরে হবে হয়তো কোন কিছুর নাদ।
আবির ওর স্টাফদের দিকে তাকিয়ে বললো।
–কি হচ্ছে এসব? এই মহিলা কে? আর উনাকে ভেতরে ঢুকতে দিয়েছেন কেন?
একজন স্টাফ বলে উঠলো।
–স্যার উনি বলছেন এখানে নাকি উনার হাসব্যান্ড আছেন। তাকেই খুঁজতে এসেছেন উনি।
–হোয়াট? কে উনার হাসব্যান্ড?
মহিলাটি ঘোমটার ভেতর থেকে বলে উঠলো।
–আরে আন্নেই তো আঁর হাফপ্যান্ট (হাসব্যান্ড)। আঁর প্রাণনাদ।
আবির মহিলার কথা কিছুই বুঝতে পারলো না। একজন স্টাফ বলে উঠলো।
–স্যার উনি বলতে চাচ্ছেন আপনিই উনার হাসব্যান্ড।
আবির যেন আকাশ থেকে পড়লো। অবাক হয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো।
–হোয়াট ননসেন্স? কি বলছেন আপনি এসব? আমি তো আপনাকে চিনিই না।
আবিরের কথা শুনে মহিলাটি আরও জোরে জোরে আহাজারি করে বললো।
–হায়য় হায়য় কিতা কয় আঁর প্রাণনাদ? হ্যায় বলে আঁরে চিনেনা। হ্যায় কেমনে আরে ভুইল্যা গেলগা।
মহিলাটি এবার অফিসের স্টাফদের কাছে এগিয়ে এসে বললো।
–ও সাপ(সাব) সাপ। আন্নেরা এতোগুলান সাপেরা আছেন। কেউ আঁর এই অন্যায়ের বিচার হরেন। আঁরে ইনসাফ দেন।
মহিলাটি আবিরের দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো।
–এইযে এই মরদ হান। এই আমার মরদ,আমার প্রাণনাদ আজ থাইক্কা পাঁচ বচ্ছর আগে আঁর গ্রামে আইছিল। আর গ্রামে আইসা আমার লগে ইটিস পিটিস করছিল। রাতের বেলায় চুপ কইরা আমার কাছে আইসা কয়, আই লাভলী গু (আই লাভ ইউ)। আঁইও হ্যাঁরে কইলাম, আইও তোমারে লাভলী গু করি। তারপর কি কয় জানেন সাপ?
স্টাফ রা অতি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
–কি বললো?
—আঁরে কয়, আমি হাগু(হাগ) করবার চাই। আইও হ্যাঁরে হাগু করোনের লাইগা পাট খতে
লইয়া গেলাম। তয় হ্যায় হাগু করলো না। হ্যাঁয় আঁরে পাটখেতের ভিতরে চাইপ্পা ধরলো। আই শরম পাইয়া কইলাম, কি করতাছেন আমগো অহনো বিয়া হয়নাই। হ্যায় তহন কইলো, আমি তোমারে এই রাতের তাঁরা, আর এই পাট খেত রে সাক্ষী রাইখা বউ হিসেবে কবুল বললাম। আঁইও হ্যাঁরে কবুল কইলাম। ব্যাস হইয়া গেল আমগো বিয়া। আর অহন কিনা কয় হ্যাঁয় আঁরে চেনে না। হায়য় আল্লাহ আঁই অহন কিতা করিয়াম? আঁর কি হইবে?
আবির বেচারা হতভম্ব হয়ে গেল। কোথাকার কোন মহিলা কি সব হাবিজাবি বলে যাচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না ওর। মহিলাটা নির্ঘাত পাগলা গারদ থেকে ছুটে এসেছে।
মহিলাটি এবার বলে উঠলো।
–আঁর চুন্নু মুন্নু টুন্নুর কি হইবে?
একজন স্টাফ ভ্রু কুঁচকে বললো।
–চুন্নু মুন্নু টুন্নু? এরা কারা?
মহিলাটি বলে উঠলো
–কারা আবার, আঁর প্রাণনাদের ভালোবাসার ফসল। আঁর বাইচ্চারা। আঁর বাইচ্চারা কবে থাইকা তাগো বাপেরে দেখবার চায়। আইজকা ওগো আশা পূরণ হইবো।
মহিলাটি একটু উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো।
–চুন্নু মুন্নু টুন্নু,,
একটু পরে তিনটা বাচ্চা দৌড়ে এলো। মহিলাটি তাদের কে আবিরের দিকে দেখিয়ে বললো।
–বাইচ্চারা ওই দেহ তুমগো আব্বা।
বাচ্চাগুলো আবিরের দিকে ছুটে আসতে আসতে বললো।
–আব্বাজান,,,,
আবির বেচারা এবার অজ্ঞান খাওয়ার উপক্রম। পুরো হাক্কাবাক্কা হয়ে গেছে ও। বাচ্চাগুলো কাছে আসতেই আবির হকচকিয়ে উঠে বললো।
–আরে আরে কি করছ তোমারা? আমি তোমাদের বাবা হতে যাবো কেন? আরে আমার তো এখন বিয়েই হয়নি।
মহিলাটি আবারও আহাজারি করে বললো।
–হায় হায় কত্তোবড় নির্দয় রে। নিজের বাইচ্চা গুলান রেও চেনে না। আই অহন কিতা করিয়াম?
মহিলাটি আবারও স্টাফ দের দিকে তাকিয়ে বললো।
–জানেন সাপ, আমি কত্তো কষ্ট কইরা এই বাইচ্চা গুলান রে পালছি। সবসময় কইছি তগো বাপের মতো বড়ো মানুষ হইবি। জানেন সাপ, আঁর প্রাণনাদ এতো পড়ালেহা জানে দেইখা আঁইও আঁর বাইচ্চা গুলান রে পড়ালেহা শিখাইছি। হ্যাঁগো আঁই আঙ্গার কেজি(ইংরেজি) শেখাই ছি। আঁর বাইচ্চারা অহন পটপট কইরা আঙ্গার কেজি কয়। দেহেন এহোনি কি সুন্দর আঙ্গার কেজি কইবো।বাবা চুন্নু সাপেগো তোমার আঙ্গার কেজি হুনাও তো।
মহিলাটির কথামতো ছেলেটা সবার সামনে এসে বলতে লাগলো।
–আই নেম চুন্নু। আই উঠিং সকালবেলা। আই মুখ ধুয়িং, দেন আই হাগিং। তারপর আই খাইং ভাত। আফটার ভাত খাইং আই গোয়িং ইশকুল। ইন দা ইশকুল আই করিং লেখাপড়া। দেন আই ফিরিং বাড়ি। ওয়ান ডে হোয়েন আই ফিরিং বাড়ি, আই দেখিং হোয়াট?
সব স্টাফ রা আগ্রহ নিয়ে বললো।
–হোয়াট?
–আই দেখিং মুন্নু এন্ড টুন্নু করিং মারামারি। আন্ডার দ্য গাছতলা, বিহাইন্ড দ্যা ঝোপের বেড়া।
একজন স্টাফ ভ্রু কুঁচকে বললো।
–হোয়াট ইজ ঝোপের বেড়া?
–ওয়ান বাম্বু খাঁড়া খাঁড়া, আদার বাম্বু পাতালি করা। তাহার মাঝে প্যারাগ মারা। হেইয়ারে কয় ঝোপের বেড়া।
সব স্টাফ গুলো হাসতে শুরু করে দিল। আবির পরে গেছে এক মহা মুশকিলে। কি এক আপদ এসে জুটলো কে জানে।
হঠাৎ হৈচৈ এর শব্দে আবিরের বাবা বাইরে এলো। আশরাফ রহমান কে দেখে সবাই চুপচাপ হয়ে গেল। আবিরও ঘাবড়ে গেল ওর বাবাকে দেখে। নাজানি বাবা কি মনে করে কে জানে?
আশরাফ রহমান বলে উঠলেন।
–কি হচ্ছে এখানে? এতো হইচই কেন? আর এরা কারা?
একজন স্টাফ ফট করে বলে উঠলো।
–স্যার এই মহিলার কথা অনুযায়ী ইনি আপনার পুত্রবধূ আর এই বাচ্চাগুলো আপনার নাতী।
আশরাফ রহমান আশ্চর্য হয়ে বললেন।
–হোয়াট? কি বলছ এসব? আবির এসব কি সত্যি?
আবির ভীতু স্বরে বললো।
–না না বাবা একদম না। আমিতো উনাকে চিনিই না। জানিনা কোথাথেকে এসেছেন? আর কিসব আবোল তাবোল বলে যাচ্ছেন।
আশরাফ রহমান এবার মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বললেন।
–এই মেয়ে কে তুমি? আর কি বলছ এসব? তোমার কথার কোন প্রমান আছে?
মহিলাটিও হঠাৎ করে কেমন চুপ হয়ে গেল। আশরাফ রহমান আবার বলে উঠলেন।
–কি হলো কথা বলো? আর তোমার মুখ দেখাও। দেখি তুমি কে?
মহিলাটি তাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আশরাফ রহমান এবার একটা ফিমেল স্টাফ কে ইশারা করলো মহিলার ঘোমটা সরাতে। স্টাফ টি এসে মহিলাটির ঘোমটা সরিয়ে দিলেন। ঘোমটা সরাতেই আবির ৮৮০ ভোল্টের একটা ঝটকা খেল। কারণ যেমনটা আমরা সবাই জানি, মহিলাটি আর কেওনা বরং নীলা। আবির বেচারা পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল। নীলা যে এসব করবে সেটা ওর ধারনাই ছিলনা।
আশরাফ রহমানও নীলাকে দেখে অবাক হলেন। নীলা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে ও জানতোই না যে এখানে আবিরের বাবাও আছেন। জানলে কখনোই আসতো না। এখন কি করবে ও। ভয়ে গলা শুঁকিয়ে দিলেই ওর।
আশরাফ রহমান অবাক সুরে বললেন।
–নীলা? তুমি এখানে? আর এসব কি?
নীলা বেচারি কি বলবে? আবির কে মজা দেখাতে এসে নিজেই ফেঁসে গেল। এখন কি বলবে ও? আবিরও প্রচুর ভয় পেয়ে গেল। নাজানি ওর বাবা ব্যাপারটা টা কিভাবে দেখেন।
হঠাৎ আশরাফ রহমান হো হো করে হেঁসে উঠলেন। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। আশরাফ রহমান হাসি থামিয়ে বললেন।
–আমার কবিনে এসো কথা আছে তোমাদের সাথে।
একটু পরে আবির আর নীলা মাথা নিচু করে ভীতু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আশরাফ রহমানের সামনে। আশরাফ রহমান একটু গম্ভীর কন্ঠে বললেন।
–কবে থেকে চলছে এসব?
আবির ভীতু স্বরে বললো।
–আ আসলে বাবা হয়েছে কি,,,
আশরাফ রহমান এবার হাসিমুখে বললেন।
–থাক আর বলতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি। আমি খুব শীঘ্রই নীলার বাবা মার সাথে কথা বলবো।
আবির প্রচুর খুশী হয়ে গেল। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। বাবা যে এতো সহজে রাজি হয়ে যাবেন তা ভাবতেই পারেনি ও। যাক নীলার এখানে আসায় আমারি ভালো হলো। কথাটা ভেবে আবির নীলার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে চোখ টিপ মারলো। আর নীলাতো এমনিতেই লজ্জায় শেষ।
চলবে…..
(