অন্তরালে ভালবাসা পর্ব ১৪

#অন্তরালে_ভালবাসা
১৪

#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা_হঠাৎ_বৃষ্টি

অহিন,আরিশা সুর্যাস্ত দেখা শেষ করে রাখাইন পল্লী যায়।সেখানে অনেক রাখাইনদের সাথে দেখা হয়,এর পাশেই রাখাইন মার্কেটে নিয়ে যায় অহিন আরিশাকে,কুয়াকাটার সবচেয়ে বড় মার্কেট রাখাইন মার্কেট। আরিশা দোকানে ঢুকে অহিনের পেছন পেছন। অহিন বলে আরু যা ভালো লাগে নিয়ে নেয়।আরিশা হ্যাঙারে আটকানো কয়েকটি শাড়ি আর জামা হাতে ধরে দেখে,এগুলো দেখে বুঝা যাচ্ছে হাতে তৈরি। এখানকার আদিবাসিরা হয়তো এগুলো পরে।আরিশা বলে আমি এগুলো নিয়ে কি করবো। অহিনে জোর করে বলে আরিশা তিনটি শাড়ি নেয়,একটা নিজের জন্য,একটা শাশুড়ির জন্য,একটা তার মায়ের জন্য।
কয়েকটি মালায় হাত দিয়ে দেখে আরিশা,অহিনের চোখ যায় এক জোড়া রুপার নুপুরের দিকে,নিখুঁত কাজ করা এই নুপুর জোড়া দেখলে চোখ আটকে যাওয়ার মত।দোকানী দুজন তারা রাখাইন মনে হচ্ছে, স্বামী স্ত্রী দুজন দোকান চালায় মুখে হাসি লেগে আছে।অহিন নুপুর জোড়া হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে, দোকানীর স্ত্রী বলেন,বউকে সুন্দর মানাইবে এই নুপুর!
আরিশা অহিনের কানে যেতেই দুজন মহিলার দিকে তাকায়,আরিশা তাকায় অহিনের হাতের নুপুরের দিকে।বলে কিরে এগুলো কার জন্য?
অহিন অপ্রস্তুত হয়ে যায় আরিশার প্রশ্নে। অহিন কিছু বলার আগেই দোকানী মহিলাটি বলেন,আরে বুঝোনাই এটা তোমার জন্য নিছে তোমার বর।

আজ প্রথম তোমার বর কথাটা শুনে, আরিশার মনে রাগ, ক্ষোভ, কিংবা ভয়, সংকোচ সব কিছুকে ছাপিয়ে ক্রমে ক্রমে ভালোলাগায় রুপান্তর করছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আরিশা বুঝতে পারছে না, এটা কি কোন ভালো লাগা, নাকি ভালোবাসা!
আজ কেনো অন্যদিনের মত আরিশার কাছে অহিন তার বর কথাটা শুনে রাগ করতে পারছে না।কেনো চোখ গরম করে অহিনের দিকে তাকাচ্ছে না!কেনো জানি অহিনের দিকে তাকাতে হালকা হালকা ভালো লাগছে!কেমন একটা মায়া হচ্ছে, এটা কি শুধু মায়া,বন্ধুত্বের মায়া?নাকি অন্যকিছু? এই প্রশ্নের উত্তর আরিশার কাছে নেই।
আরিশার মুখে আজ প্রথম অহিন লজ্জা দেখলো, তাও অহিন তার বর এটা শুনে আরিশা লজ্জা পাচ্ছে এই বিষয়টা কেমন যেনো হজম হলো না অহিনের।কিন্তু অহিনের অবচেতন মন কেনো যেনো একটা সুক্ষ্ণ সুখ অনুভব করলো,সেই সুখ স্বামী হওয়ার কিংবা আরিশার লজ্জার কারণ হওয়ার!
পৃথিবীতে সব পুরুষ বিয়ে করে,সবাই স্বামী হয়,কিন্তু দিনশেষে কতজন পুরুষ আছে যারা স্ত্রীর মনের মনিকোঠায় এক সুখের নাম হয়!
নারীর জীবন কখনও অভ্যস্ততায়,কখনও প্রয়োজনে,আবার কখনও দ্বায়িত্বে আটকে থাকে।নারীর এই লজ্জার কারণ হতে পারে কয়জন পুরুষ! যে কি না এক স্বামী হওয়ার আগে এক বন্ধু হয়!
আছে কি এমন পুরুষ?
হয়তো আছে,হয়তো না,আর থাকলেও তা খুব নগন্য!

অহিন বরাবর বন্ধু হতে চেয়েছে,কিন্তু আজ প্রথম তার মনে হলো আরিশার তার প্রতি কিছু মায়া হয়তো তৈরি হচ্ছে, হয়তো না।তবুও এই মুহুর্তে তার মন কেনো যেনো খুব ভালো হয়ে গেলো। কিছু একটা অনুভব করলো, এটাকে কি বলে মন কেমনের অনুভুতি!

আরিশা বলে,নুপুর জোড়া তো খুব সুন্দর অহিন।অহিন উত্তরে শুধু হাসলো, দোকানীকে দাম বুঝিয়ে দিয়ে দুজন বেরিয়ে পড়লো রিসোর্টের উদ্দেশ্যে। অহিন নুপুর জোড়া পকেটে নিয়ে নিলো। আরিশাকে দিলো না।এতে কেনো যেনো আরিশার মন একটু খারাপ হলো।
কিন্তু কেনো সেটা আরিশা জানেনা, অহিন কার জন্য নুপুর নিলো, কেনাই বা নিলো এসবে তো আরিশার মাথা ঘামানোর কথা না,তবে আজ কি হলো আরিশার,কেনোই বা আরিশা তার মনে সুক্ষ্ণ একটা ব্যাথা অনুভব করলো?এর উত্তর আরিশার জানা নেই।
সন্ধ্যার আকাশটা খুব সুন্দর দেখাচ্ছে,আকাশে হালকা মেঘ আছে,কিন্তু চাঁদ স্পষ্ট! তবে আজকের চাঁদ সম্পুর্ণ নয় অর্ধ।তারপর ও আলো যেনো কম পড়ছে না।সুন্দর এই সর্নালী সন্ধ্যায় দুটো মন কি এক অজানা সুখে ভরে ওঠে। দুজনের কেউ জানেনা তাদের মনে কি চলছে?অহিনের কাছে তার অনুভূতি বরাবরই খুব স্পষ্ট, কিন্তু আরিশার কিছু নতুন অনুভূতির উপস্থিতি অনুভব করলো যা তার আগে কখনও মনে হয়নি!

রিসোর্টে এসে আরিশা বেডের উপর চিত হয়ে শুয়ে পড়লো, অহিন বলে কিরে ফ্রেশ না হয়ে শুয়ে পড়ছিস যে?

আরিশা বলে, আগে তুই যা আমি পরে ফ্রেশ হবো।অহিন বলে,বুঝলি আরু, এতো সুন্দর রিসোর্ট, এতো সুন্দর পরিবেশ, ওয়াশরুমে বাথটাবে একা একা গোসল করতে কি মন চায় বল?আসলে আমার বিয়ে করে বউ নিয়ে আসা উচিত ছিলো বুঝলি?তাহলে এই কষ্টটা হতো না।বন্ধুদের সাথে পিকনিকের চেয়ে বউ নিয়ে হানিমুনে আসা বেশী রোমাঞ্চকর বুঝলি দোস্ত! এই কথাগুলো বলেই অহিন চওড়া হাসি দেয়।সেই হাসিতে দুষ্টুমি ছিলো তা স্পষ্ট!
আরিশার মুহুর্তে মনে হলো বলবে তুই তো বিয়ে করেই এসেছিস।কিন্তু কোন এক বাধা সেটা বলতে দিলো না আরিশাকে।আর এটা বলা ও যায় না।
তাছাড়া তারা শুধুই বন্ধু এটা তো তাদের কাছে স্পষ্ট।
কিন্তু কেনো জানিনা আরিশার মুখ কোন এক অজানা ক্ষোভে লাল হয়ে উঠলো।মনের আনন্দটা কিছুটা নিভলো!

অহিন ফ্রেশ হতে চলে যায়,আরিশা রাফিনের কথা ভাবে,হয়তো রাফিন থাকলে আজ সেও রাফিনের সাথে সুর্যদয় থেকে সুর্যাস্ত সব দেখতো।রাতের সমুদ্রের পাড়ে হাত ধরে হাটতো।আর বাথটাবে দুজনে ভিজতো।
মুহুর্তে আরিশার মনে গোপন ব্যাথা গুলো যেনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
অহিন গোসল সেরে টাওয়াল পরে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো, অহিন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে আচড়াবার ভান করলো।

আরিশা আজ প্রথম খেয়াল করলো মন দিয়ে,অহিনের ধবধবে সাদা বুকে পশমের ছড়াছড়ি, আর সেই রোমশ বুকটা দেখতে এতো সুন্দর লাগছে যে কোন মেয়ের মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার মত। মুখে খোচা খোচা দাড়িগুলো ফর্সা গালটাকে মোহনীয় করে তুলেছে।বডি স্ট্রাকচার একদম পারফেক্ট। সেটা হয়তো নিয়মিত ব্যায়াম করার জন্য এতোটা সুন্দর!
অহিন আয়নায় দেখছিলো আরিশা তার দিকে তাকিয়ে আছে,অহিনের মাথায় একটা দুষ্টুমি চেপে বসলো।
অহিন আরিশার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে, কি মামা তুমি কি আমার প্রেমে পড়ে যাচ্ছো?
যেভাবে তাকিয়ে আছো মনে হচ্ছে আমাকে গিলে নিচ্ছো?

আরিশা আধশোয়া থেকে উঠে বসে কাঠ কাঠ গলায় বলে,ছিঃ অনিন্না তুই এটা কইতে পারলি?তোর কি এমন চেহারা যে তোর প্রেমে পড়ে যাবো আমি?শালা খাটাস একটা।

অহিন মুখে হাসি রেখেই বলে,তাহলে এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে গিলছিস ক্যান?
আরিশা বলে,আমি মোটেও তোর দিকে তাকাচ্ছিলাম না।আমিতো দেখছিলাম ড্রেসিং টেবিলটা কি সুন্দর! কত নিখুঁত কাজ করা।
অহিন বলে হুম ঠিক, কি সুন্দর ভায়োলেট কালার ড্রেসিং টেবিল তাই না আরু?
আরিশা বলে একদম, এটা বলেই আরিশা ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো এটা ভায়োলেটা কালার না,হোয়াইট কালার।আরিশা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
অহিন সামনের সোফায় বসে হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাচ্ছে, হাত নেড়ে হাসছে অহিন,ভুবন ভোলানো হাসি!সেই হাসি যে হাসিতে আকাশ হাসে!যে হাসিতে চোখ হাসে,যে হাসিতে ঠোঁট হাসে, স্নিগ্ধ সেই হাসি,মাতাল করা সেই হাসি!

আরিশার এই মুহূর্তে মনে হলো তার এতো বছরের বন্ধুটা এতো সুন্দর করে হাসে কোনদিন খেয়াল করেনি তো। আজ অহিনের মাঝে যত কিছু চোখে পড়লো আরিশার কই কোনদিন তো এসব চোখে পড়েনি।হঠাৎ আজ কেনো পড়লো!

অহিন আরিশাকে ফ্রেশ হতে বলে, নিচে গেলো সিহাব কল দিয়েছে এখানে আরিশার সামনে কথা বলা যাবে না।

এদিকে আরিশা গোসল করে এসে দেখলো তার রুমে কেউ উঁকি দিচ্ছে।আরিশা কে কে বলাতেই লোকটি চলে গেলো।
আরিশার ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো, আরিশা এমনিতেই একা থাকতে ভয় পায়, তার উপর অজানা অচেনা জায়গায় তো আরও বেশি।আরিশা অহিনকে কল দেয় কল শেষ হওয়ার আগেই অহিন রুমে ঢুকে, আরিশার চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট, অহিন ঘাবড়ে যায় আরিশার অবস্থা দেখে।আরিশার মুখ অহিন তার দুহাতে আজলা করে ধরে বলে আরু এই আরু কি হয়েছে, বল কি হয়েছে,এই এরু?

আরিশা কাঁপা গলায় বলে,অহিন কেউ আমাকে দেখছিলো দরজার ফাঁকে। কেনো যেনো মনে হচ্ছে হয়তো আমাদের দিকে নজর রাখছে সেই লোকটি।
অহিন ভরসা দেয়ার গলায় বলে,আরে কিছু হবে না।আমি আছি না, তুই সবসময় ভয় পাচ্ছিস, এমন কিছু হবে না।
আরিশা অহিনের বুকের কাছে এতোটা কাছে যে দুজনের গরম নিঃশ্বাস দুজনের গায়ে পড়ছে,আরিশার গায়ের একটা আলাদা গন্ধ আছে,যা অহিনের ভেতর ঝড় বইয়ে দেয়।এতোটা কাছাকাছি থাকায় সেই গন্ধ খুব বেশী পাচ্ছে অহিন।
অহিন আরিশার মাথাটা আলতো করে নিজের বুকের সাথে লেপ্টে ধরে বলে, আরু তুই ভয় পাবি না একদম।তোর সব কষ্ট শেষ হবে এবার,রাফিনকে আমরা খুজে পেতে চলেছি।সিহাব কল দিয়েছে।রাফিনের বাবা আর বোনের সাথে রাফিনের যোগাযোগ আছে।আর আমার সন্দেহ যদি ভুল না হয় রাফিন আমাদের আশেপাশেই কোথাও আছে।রাফিনের কাছে আমাদের প্রতিটি আপডেট যাচ্ছে এখন আমাদের খুজে বের করতে হবে কে সে খবর প্রদানকারী ব্যাক্তি!আর রাফিনই বা কেনো এতো লুকো খেলছে আমাদের সাথে।আর রাফিনের পরিবার জেনেও কেনো আমাদের কিছু জানাচ্ছে না।
আমরা কাল বাড়ি ফিরে যাবো সব প্রশ্নের উত্তর এক এক করে বের করবো। রাফিনের কোন অধিকার নেই তোকে আমাকে এতো কষ্ট দেয়ার।
এভাবে আমাদের নিয়ে খেলার এবার আমি রাফিনকে সেই কঠোরতা দেখাবো যা কোনদিন রাফিন দেখেনি।

তুই খুব শীঘ্রই রাফিনকে ফিরে পাবি।আর আমি নিজে তোদের বিয়ে দেবো।দেখবি তোর কোন কষ্ট থাকবে না।তুই খুব খুব ভালো থাকবি।

অহিনের কথাগুলো শুনে আরিশার আলগা হয়ে থাকা হাত দুটো যেনো অহিনকে অবচেতন মনে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো।কেনো যেনো আরিশার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, সেই জল অহিনের বুকের সাথে মিশে যাচ্ছে।সব ফিরে পাবে জেনেও কেনো আরিশা আজ খুশী হতে পারছে না।কেনো তার চোখ অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে!এমনটা তো হওয়ার কথা না!কি হচ্ছে এসব আরিশা যেনো নিজেকে চিনতে পারছে না।নিজের এহেন অনুভূতির সাথে কোনকালেই সে পরিচিত নয়!

অহিন কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে বললো, অহিনের খুব কষ্ট হচ্ছে, সে নিশ্চিত আরিশাকে সে হারাব,অবশ্যই পেয়েছেই বা কবে যে নতুন করে হারাবে,তবুও এতোদিন কাছে তো ছিলো এবার সেটাও শেষ হয়ে যাবে।অহিনের আরু অন্য কারো বুকে ঘুমাবে এটা ভাবতেই যেনো অহিনের বুকের এক একটা হাড় ভেঙে চূর্নবিচুর্ন হয়ে যাচ্ছে।এ যন্ত্রনা কিভাবে সহ্য করবে অহিন!
এতো কষ্ট কেনো ভালবাসায়!
যদি ভালবাসার নামই কষ্ট হয়,তবে পৃথিবীর কোন শালা যেনো তার ভালবাসা না পায়,এভাবেই কষ্ট পেয়ে যেনো ধুকেধুকে মরে।সব ভালবাসা গুলো অপুর্ন রয়ে যাক।

চলবে,,,

কালকে ধামাকা পর্ব পাবেন ইনশাআল্লাহ। 😊

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here