অন্তরালে ভালোবাসা পর্ব ৩৬ ও শেষ পর্ব

#অন্তরালে_ভালবাসা

১০দিন পর,

অহিন আরিশার দুষ্টুমি আর খুনসুঁটি ভরা ভালবাসার সংসার ভালোই চলছে।দুজনকে দেখলে মনে হয় দুটি প্রাণ তবে এক আত্মা! দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়।ভালবাসার মানুষকে কাছে পেলে কতটা সুখী লাগে নিজেকে সে শুধু ভালবাসা প্রাপ্ত মানুষগুলোই জানে।

—–এই অহিন ছাড়তো আমায় তোর অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে।নাস্তা বানাতে হবে।মায়ের শরীর খারাপ।
—-উঁহু আমি আরও এক ঘন্টা ঘুমাবো এই এক ঘন্টা তুই আমার হাতে শুয়ে থাকবি,না হয় ঘুমাবি।কিন্তু আমি না উঠা পর্যন্ত তুই কোথাও যাবি না।

—–আরিশা অনেক জোর করেও অহিনকে বিন্ধুমাত্র তার জায়গা থেকে টলাতে পারে নি।বাধ্য হয়ে হার মানতে হলো।আর ভাবতে লাগলো ছেলেরা ও মানুষ মেয়েরা ও মানুষ কিন্তু ছেলেদের শরীরে এতো শক্তি থাকে কেনো?

——-অহিন চোখ বন্ধ রেখেই বলে, ‘ছেলেদের এতো শক্তি দিয়েছে, মেয়েদের এভাবে ধরে রাখার জন্য।মেয়েরা তো উড়াল পাখি তাই ধরে রাখতে হয় বুঝলি?

——-আরিশা বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে চলে যায়।এই ছেলে মনের কথাও বুঝে ফেলে, আজব!

——-অহিন আরিশার কাছে ঘেষে আরিশার ঘাড়ে মুখ গুজে শুয়ে আছে।অহিনের নিশ্বাস আরিশার ঘাড়ে পড়ছে।আরিশা খুব ভালো করে একটা বিষয় খেয়াল করলো, অহিনের শরীরে আলাদা একটা ঘ্রাণ আছে,যেটা কি না মনের ভেতর আলাদা একটা অনুভূতি দেয়।মনের কোঠরে শান্তি দেয়।শিহরণ দেয়!
আচ্ছা সব মানুষ কি তার ভালবাসার মানুষের শরীর থেকে এমন অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণ পায়!তাদের ও কি এরকমই অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি হয়!

অহিনের ঘুমন্ত মুখটা দেখলে আরিশার বরাবরই মায়া হয় খুব,আরিশার সবচেয়ে পছন্দ অহিনের চোখ, ছেলেদের চোখ যে এতো সুন্দর হয় সেটা বোধহয় অহিনকে না দেখলে সে বুঝতে পারতো না।ঘন পল্লব যুক্ত চোখ দুটোতে যেনো রাজ্যের মায়া ভর থাকে।দেখলেই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে।

আরিশা টুক করে কয়েকটা চুমু খেয়ে নেয় অহিনের পুরো মুখে।
অহিন চোখ খুলে আরিশার মুখের উপর নিজের মুখ উঁচু করে বলে,তুই শুধু সুযোগ খুজিস আমি কখন ঘুমাবো আর তুই আমাকে আদর করবি!

—-হু! আমার বয়ে গেছে।উঠে পড় এভাবে ঘুমের নাটক করতে হবে না আর।আমি ফ্রেশ হয়ে নিচে যাচ্ছি তুই ফ্রেশ হয়ে চলে আয়।

—-অহিন আরিশাকে ছাড়ে না। আবার ধরে পেলে। তোকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না আরু।মনে হচ্ছে ছাড়লেই বুঝি আর পাবো না!

—–আরিশা অহিনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,কি হয়েছে অহিন পাগলামি করছিস কেনো? আমি তো ২৪ঘন্টা তোর সাথে থাকবো।মাকে নাস্তা দিয়ে একটু পর আবার আসতেছি।

—অহিন আরিশার কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলে,তুই মাকে খুব ভালবেসে ফেলেছিস আরু।আমার খুব ভালো লাগে তুই মাকে অনেক যত্ন করিস,খেয়াল রাখিস।আমি না থাকলেও তুই যে মাকে দেখবি তা আমি জানি।

—-তুই না থাকলে মানে, আজব!এসব কি কথা।তুই এসব বাজে কথা কেনো বলছিস?আরিশা ভেজা গলায় বলে।
—আরে পাগলি তুই এতো সিরিয়াস কেনো হচ্ছিস?আমি তো শুধু কথার কথা বলছি।ধর! আমি যদি অফিসের কাজে কয়েকটা দিনের জন্য বাইরে যাই তাহলে আমাকে আর চিন্তা করতে হবে না মায়ের জন্য।আগে অনেক চিন্তা করতাম তাই এটা বলা।এতে এতো সিরিয়াস হতে হবে না বউ।আরিশার মুখটা নিজের দুহাতে আজলা করে ধরে বলে অহিন।আরিশা বলে,এসব মজা করে ও বলবি না।আমার শুনতে ভালো লাগে না।তুই আমাকে রেখে দেশের বাইরেও যাবি না।কথা দে আমাকে?অহিনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় আরিশা তার চোখ চলচল করছে।
অহিন আরিশার চোখের দিকে তাকিয়ে তার ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে বলে আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যাবো মা পাগলি বউ আমার। অহিন আরিশার কপালে গভীর চুমু খায়।
অহিন আরিশাকে ছাড়তে চায় না দেখে আরিশা বলে, আরে মা তুমি এখানে?অহিন যেই সেদিকে তাকাতেই আরিশা দেয় দৌড়।অহিনকে ভেংচি কেটে চলে যায় গোসল খানায়। অহিন হাত দিয়ে চুল আঁচড়ানোর ভাব করে বলে,ইশ!তুই এতো অস্থির ক্যান!

———————————————————————————-
সাজেদা বেগম অসুস্থ বলে ঘরে গিয়ে আরিশা নাস্তা দিয়ে এলো। নিজে আর অহিন একসাথে খেতে বসলো অহিন আরিশাকে হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে,আরিশাও তাই করছে।দুজনের মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগেই আছে।সুখের হাসি!অহিন আরিশাকে বলে, আমি একটু অফিসে যাবো।তোর কি লাগবে বল?
—–আরিশা বলে,তুই তাড়াতাড়ি চলে আসলেই হবে।তবে চাইলে আমার জন্য তিনটি ফুল নিয়ে আসবি।

—অহিন ভ্রু কুচকে বলে,’তিনটি কেনো?
—–তুই বাসায় ফিরলেই বলবো।
—অহিন আরিশার কপালে চুমু খেয়ে বলে আসছি তাহলে?
—আরিশা হাত ধরে পেলে মন খারাপের সুরে বলে,যাস না আজকে আমার ভালো লাগছে না।
—অহিন আরিশাকে দুহাতে ধরে বলে আমি শুধু তিন ঘন্টা থাকবো এর বেশী না।চলে আসবো। দেখিবি তোর রান্না শেষ হওয়ার আগেই আমি হাজির। এসে তোকে এতো এতো ভালবাসবো।

—–আরিশা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলে,চুপ সবসময় দুষ্টুমি।আরিশা অহিনের ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে তাড়াতাড়ি আসবি কিন্তু।
—অহিন তার সেই সুন্দর হাসি দিয়ে চলে যায়।আরিশা দৌড়ে তার রুমের বারান্দায় চলে যায়, কারণ সেখান থেকে অহিনকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।অহিন যতক্ষণ না চোখের আড়াল হয় আরিশা দাড়িয়ে থাকে সেখানে।অহিন চোখের আড়াল হতেই আরিশার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আরিশা মুখে হাত দিয়ে সে জল স্পর্শ করে বলে আমার চোখে জল কেনো?আমি তো সবচেয়ে সুখী। তারপর ও এই জল কিসের।আরিশা নিজেই বুঝতে পারে না।এই জলের কারণ।

কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকে,তারপর উঠে রান্না করতে চলে যায়।এদিকে রান্না শেষ হয়ে যায় কিন্তু অহিন আসে না।বিকেল ৫টা বেজে যায় অহিন আসার নাম নেই।অহিনের ফোনে কল যাচ্ছে না।অফিসে কল দিয়েছে সেখান থেকে বলেছে অহিন অফিসে আসার ঘন্টা দুয়েক পরে বেরিয়ে গেছে।আরিশার এবার চিন্তা হচ্ছে খুব। কোথায় অহিন?আর ফোন অফ কেনো? চিন্তায় আরিশার প্রান বের হয়ে যাওয়ার অবস্থা। মা অসুস্থ তাই মাকে কিছু বলতে পারছে না।তাই অনেক ভেবে রাফিনকে কল দেয়।রাফিন বলে তার কাছেও যায় নি অহিন।এবার আরিশা কান্না করে দেয়।রাফিন শান্তনা দিয়ে বলে, আমি খুজে দেখছি তুই কান্না করিস না।অহিন চলে আসবে।আমি সব বন্ধুদের জিজ্ঞেস করে দেখি।কল।কেটে আরিশা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু না তার চোখের পানি বাধা মানছে না।খুব কষ্ট হচ্ছে মনে হচ্ছে তার খুব মুল্যবান কিছু হারিয়ে গেছে তার জীবন থেকে।

রাত নয়টা অহিন এসেছে,রাফিনের সাথে।আশেপাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে অহিনদের বাসার সামনে।আরিশা খুশী হয়ে দৌড়ে যায়।অহিন এসে গেছে এতো অপেক্ষা করানোর জন্য আজ অহিনকে শাস্তি দিবে বলে ভেবে রেখেছে আরিশা।কিন্তু ড্রয়িং রুমে এতো মানুষ কেনো?
সাজেদা বেগম মেঝেতে বসে আছেন। রাফিন তার পাশে বসে আছে।এদিকটায় সিহাব বসে আছে।আরিশা বুঝতেছে না সবাই এখন এখানে কেনো? আর পাশের বাসার সবাই এখানে রাতের বেলা কি করছে?অহিন কোথায়?অহিনকে দেখা যাচ্ছে না কেনো?
আরিশার পা কেনো যেনো চলছে না।থমকে আছে।
ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে আরিশা ভেতরে যায়।সাদা কাপড়ে জড়ানো একটা কেউ শুয়ে আছে মেঝেতে,সাদা কাপড়টায় রক্তে ভেসে গেছে।কেমন ভয়ংকর দেখতে লাগছে কাপড়টা।আরিশা সাজেদা বেগমকে বলে,’কি হয়েছে মা?এখানে কে শুয়ে আছে?আর এতো রক্ত কেনো? সাজেদা বেগম কিছুই বলছে না।শুধু কেঁদে চলেছে।
আরিশা রাফিনকে বলে,এই রাফিন অহিন কই?তুই না অহিনকে খুজতে গিয়েছিলি?কিরে বল?এই রাফিন বল না?
রাফিন নিচের দিকে তাকিয়ে অনবরত কেঁদে চলেছে। সে ও কিছুই বলছে না।এবার সিহাবের কাছে যায়,সিহাব অহিন কই?তাকে দেখছি না কেনো? এই সিহাব বল?
সিহাব কিছু না বলে, সাদা কাপড়টা শুয়ে থাকা মানুষটার উপর থেলে সরিয়ে নেয়।

আরিশা ভয়ে ভয়ে সেদিকে তাকায়।অহিন শুয়ে আছে।হাসি হাসি মুখ করে।মাথায় ব্যান্ডেজ।আরিশা অহিনের পাশে বসে পড়ে,অহিনের মাথা নিজের কোলে নিয়ে অহিনকে জাগানোর চেষ্টা করে।
এই অহিন উঠ কিরে কি হয়েছে তোর?কিরে উঠে পড় তাড়াতাড়ি। আমি তোর জন্য রান্না করেছি। তোর সাথে খাবো বলে আমি এখনো না খেয়ে বসে আছি।সারাদিন খাইনি।সেই সকালে তুই একটা পরোটা খাইয়ে দিয়েছিস।আর কিছু খাওয়া হয়নি।চল চল ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিবি।আরিশা অনবরত পাগলামি করছে অহিনকে নিয়ে টানাটানি করছে।রাফিন এসে আরিশাকে থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।হঠাৎ রাফিনের কথায় হুস আসে আরিশার।রাফিন চিৎকার করে বলে,অহিন আর উঠবে না আরিশা।অহিন আর কোন দিন তোর সাথে খাবে না।
অহিন আর নেই আমাদের মাঝে আরিশা, নেই আর।রাফিন অঝোরে কাঁদছে।খুব কাঁদছে।আরিশা যেনো পাথর হয়ে গেছে।রাফিনের উপর রেগে গেছে অনেক।

—-এই রাফিন তুই মিথ্যে বলিস কেনো? আমার অহিন আমার কাছেই আছে।আমার অহিন আমাকে কথা দিয়েছে কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাবে না।তুই বললেই হলো নাকি?হুম!আমার অহিন আমার কাছে আছে থাকবে সারাজীবন। তুই আর একবার এসব বাজে কথা বলবি আমি তোকে মেরে দিবো।

আরিশা অহিনের কাছে এসে বসে, এই অহিন উঠে আয় তাড়াতাড়ি কিরে তোকে বলেছি না।আমি তোকে একটা সারপ্রাইজ দিবো। কিরে শুনবি না আমার কথা?এই অহিন করে শুনবি তো। এই অহিন আমি মা হতে চলেছি।তোর সন্তানের মা।তুই শুনবি না এই কথা।কিরে শুনছিস তো অহিন?
এরা এসব কি বলে, আমরা কত স্বপ্ন দেখেছি একসাথে সেসব পূরন হওয়ার আগে তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি!এটা হতে পারে না!আমি মানি না এমনটা।
আমরা আমাদের বাবু নিয়ে কত মজা করবো,খেলবো একসাথে। তুই কি শুনতে পাচ্ছিস অহিন।

সিহাব এসে আরিশাকে ধরে বলে,অফিস থেকে বের হয়ে নাকি ফুলের দোকানে গিয়েছিলো, ১টা বেজে যাওয়ায় এদিকের দোকান গুলো বন্ধ হয়ে গেছে।তখন দেখে একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে ফুল নিয়ে দাড়িয়ে আছে রাস্তার অপরপাশে।মেয়েটার কাছে গিয়ে ফুল নেয়।ফুল নিয়ে ফিরে আসার সময় একটা বাস এসে মেরে দেয় অহিনকে।সেখান থেকে লোকজন হাসপাতালে নিয়ে যায়।আর ডাক্তার বলে অহিন আর আমাদের মাঝে নেই।উপস্থিত সবাই বলছিলো ছটফট করার সময় মুখের উপর এই ফুল তিনটি ধরে ছিলো।উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে যায় এটা দেখে যে একটা মৃত্যু পথ যাত্রী কিভাবে ফুল তিনটির দিকে তাকিয়ে হাসছে।

সিহাব ফুল তিনটি আরিশার হাতে দেয়,রক্তে মাখানো তিনটি গোলাপ।লালা গোলাপে রক্ত মিশে আরও লাল হয়ে গেলো।আরিশা গোলাপ তিনটিতে অজস্র চুমু খায়। বুকের মাঝে চেপে ধরে। পাগলের মত কান্না করে।অহিনের মাথা নিজের বুকের সাথে ধরে চিৎকার করে কাঁদে তার কান্নার সাথে উপস্থিত সবাই কাঁদছে।এই কেমন নিয়ম অহিন!আমাদের জীবনে এতো পূর্নতা দিয়ে সব কেনো কেড়ে নিলো আল্লাহ?
যদি নিয়েই নিবে তাহলে কেনো এই কয়টা দিন এতো সুখ দিলো?আমি তোর মাঝেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি অহিন।এবার আমি কি করে থাকবো তোকে ছেড়ে?তুই তো বলেছিলি আমাকে ঘুম থেক্ব উঠে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে সবসময় দেখবি!তাহলে এখন কিভাবে দেখবি রে অহিন?
আমার পেটে হাত দিয়ে দেখ তোর অস্তিত্ব খুজে পাবি।তুই বাবা হতে চলেছিস অহিন।বিধাতা ওই খবরটা পর্যন্ত তোকে দিতে দিলো না। আমি কত আয়োজন করে রেখেছি আজ তোকে অবাক করে দিবো বলে!কত কল্পনা করেছি তুই এ কথা শুনে কতটা খুশী হবি এটা ভেবে।
এখন আমি কাকে বলবো বল?
এই যে,যে আসছে তাকে কি জবাব দিবো অহিন?আমি একা কি করে তাকে পৃথিবীতে আনবো?কি করেই বা বড় করবো?
ও যদি আমাকে বলে তার বাবা কই?আমি কি উত্তর দিবো বল অহিন?তুই এভাবে আমাকে কিছু না বলে যেতে পারিস না!তুই আমাকে ঠকাতে পারিস না।আমি তোকে যেতে দিবো না।
এই যে দেখ মা কাঁদছে অহিন,মাকে কাঁদতে বারন কর অহিন।মাকে কে দেখবে অহিন?চলে যাবি বলেই কি সকালে আমাকে এভাবে মায়ায় জড়িয়ে মাকে দেখে রাখতে বলেছিলি?

তুই তো আমার কথা রাখিস নি।আমিও তোর কথা রাখবো না।কাউকে দেখে রাখবো না আমি।অহিন, অহিন, অহিন বলে জোরে চিৎকার করে কাঁদছে আরিশা।

এই অহিন তোকে এই তিনটি গোলাপ কেনো আনতে বলেছি তুই শুনবি না অহিন?এই তিনটি গোলাপে তুই আমি আর আমাদের ভালবাসার চিহ্ন থাকবে বলে।তুই আমার জন্য গোলাপ আনতে গিয়ে, আমাকে সারাজীবনের জন্য ছেড়ে চলে গেলি?

ইয়া আল্লাহ! এটা কেমন বিচার আপনার! আমাদের জীবনে এতো সুখ দিয়ে সব কেনো কেড়ে নিলেন!আমি যে অহিনকে ছাড়া নিশ্বাস পর্যন্ত ফেলতে পারি না।আপনি কি তার প্রতিশোধ নিলেন?যদি তাই হয় কেনো আমাদের জীবনে ভালবাসা দিলেন?এই প্রকৃতি এমন কেনো? কেনো এতো হিংসে আমাদের ভালবাসার উপর? কেনো? আমার সাজানো সংসারটাকে এভাবে কেনো শেষ করে দিলো? এমন অহিনের সাথে এই কয়েকটা দিন থেকে যে তৃষ্ণা মেটে না। হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে এমন অহিনের সাথে।সারা দুনিয়া খুজলে এমন হাতে গোনা কয়েকটা অহিন পাওয়া যাবে,যে প্রতিটি সম্পর্ককে সমান ভাবে ভালবাসে, সম্মান করে।এমন অহিনকে আমি কিভাবে ভুলে থাকবো?এই অহিন ছাড়া আমি যে একা বড় একা!
আমার অহিনকে আমি চাই আল্লাহ, ফিরিয়ে দিন আমার অহিনকে।

আরিশার পাগলের মত কান্না দেখে সবাই সামলানোর চেষ্টা করে,এতোক্ষনে আরিশার বাবা চলে এসেছে।মেয়ের এই অবস্থা দেখে তারা ও সহ্য করতে পারছে না।

অনেক জোর করে সবাই আরিশাকে অহিনের মাথার কাছ থেকে নিতে পারে না।অহিনকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছে সে।হাসি মুখ তার।দেখে কেউই বলবে না এই ছেলেটা আর এই পৃথিবীতে নেই।

আরিশা কিছুক্ষণ পর অজ্ঞান হয়ে যায়।তাকে রাফিন কোলে করে আরিশার ঘরে দিয়ে আসে।অহিনকে গোসল করাতে নিয়ে যায়,শেষ গোসল। তারপর সাজায় আতর,গোলাপ জল দিয়ে,কর্পুর দিয়ে।সারা বাড়িময় আগরবাতির ঘ্রাণ।

অহিনকে সাজানো শেষ হয় আরিশার জ্ঞান ফিরেছে,তাকে নিয়ে আসা হয় শেষবার দেখানোর জন্য।আরিশা আসে ধীর পায়ে অহিনের কাছে।এক স্ত্রীর কাছে হয়তো এই সময়টা পৃথিবীর সবচেয়ে যন্ত্রনার সময়।যখন তার রঙিন শাড়ি পালটে যায় সাদা শাড়িতে।যখন তার জীবনের সব রঙ পাল্টে যায় ছাই রঙা ধুসর রঙে! যখন তার জীবনের সুখ দুঃখের অংশীদার চলে যায় তাকে একা পেলে!
আর সেই স্বামী যদি হয় অহিনের মত কোন মানুষ তাহলে তো কথাই নেই।
আরিশা অহিনকে দেখছে কেমন নিরব চোখে।দুহাতে মুখটা ছুঁয়ে দিয়ে দেখছে।মনে হচ্ছে অহিন ঘুমাচ্ছে।আরিশার ইচ্ছে করছে বুকের ভেতর একটা ঘর বানিয়ে তাকে রেখে দিতে যাতে এরা কেউ অহিনকে আরিশা থেলে আলাদা করতে না পারে।

সবাই তাড়া দিচ্ছে খুব তাই আরিশার মা আরিশাকে ধরে নিয়ে আসে,অহিনের লাশের খাটিয়া আরিশা ছাড়ে না।আরিশার মাঝে কোন এক অদ্ভুত শক্তি এসে ভর করে দুও তিনজন মহিলা এসেও তাকে সরাতে পারে না।পরে আরিশার বাবা এসে সরিয়ে আনে।সাজেদা বেগম রাফিন অহিনকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
সাজেদা বেগমের কষ্ট ও যে কম না।মানুষ বলে,পালা পাখির জ্বালা বেশি ‘সাজেদা বেগমের সেই দশা।এতো গুলো বছর ধরে লালন পালন করেছেন। যে সন্তানের কাছ থেকে প্রথম মা ডাক শুনেছেন।সেই সন্তান চলে গেলে এতো দূরে।এটা যে তার কাছে মরনের চেয়েও যন্ত্রনার। আর রাফিন যে বন্ধুর জন্য ভালবাসা বিসর্জন দিতে পারে সে কিভাবে এই চলে যাওয়া মেনে নিবে।

সবাই অহিনকে নিয়ে যাবে এমন সময় একটা মহিলা আসে,সাজেদা বেগমের কাছে তার সন্তানের খোজে।সাজেদা বেগম তখন কি বলবেন এই মহিলাকে,এই যে তার সন্তানকে সাজিয়ে কবরে রাখার প্রস্তুত করা হয়েছে।সাজেদা বেগম হাতের ইশারায় দেখান সেই মহিলাকে।মহিলাটি সেখানে ধপাস করব বসে যান,ছেলের মুখ দেখেন শেষ বারের মত।এতো গুলো বছর উনি অনেক খুজেছেন সাজেদা বেগমের ঠিকানা অবশেষে আজ সেই ডাক্তার তাকে ঠিকানা দিলো। ভেবেছে সন্তানের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবে।কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ঠিকানা না পেলেই ভালো হতো।তাহলে অন্তত এই দৃশ্যটা দেখতে হতো না।আচ্ছা এটা তার পাপের ফল নয়তো! তার করা সারাজীবনের পাপের জন্য তার সন্তানকে হারালো। এটাই কি তবে প্রকৃতি!যখন নিজের ভুল বুঝতে পারলো তখন জীবন থেকে সব সুযোগ চলে গেলো। এটাই হয়তো প্রকৃতির মার।সব শোধ করে দেয়।

আজ এই বাড়িটি কবরের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠেছে।রাফিন খাটিয়া ধরেছে,সিহাব ধরেছে আরও কয়েকজন এসেছে।আরিশা ছুটে যেতে লাগলে সবাই তাকে ধরে পেলে। আরিশার আহাজারিতে প্রকৃতি থমকে গেছে, সময় দাড়িয়ে গেছে।

আরিশা রুমে এসে সেই ডায়েরিটা খুজে বের করে,পাতা উল্টাতে শুরু করে,

‘প্রথম দেখা,প্রথম ভালবাসা আরিশা’

এরপরের,

‘মেয়েটা একটু অন্যরকম সবার থেকে আলাদা, এই যে আমার শরীরে দাগ করে দিয়েছে।এমন দাগ যা আমায় ঘুমাতে দেয় না’

এরপর,

‘আরু দেখলে এমন অস্থির লাগে কেনো!
বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে’

‘আরু তুই এমন পাগলামি কেনো করিস,তুই কি জানিস আমার তোকে বুকের সাথে পিষে ফেলতে ইচ্ছে করে’

‘অবশেষ পেলাম,তাহাকে পেলাম

রিমি এসে ডায়েরিটা নিয়ে নেয়,কারণ এই ডায়েরি পড়ে অহিনের আরু যে আরও ভেঙে পড়বে।
রিমিকে ধরে পাগলের মত কাঁদে আরিশা।

রিমি আমার অহিনকে ফিরিয়ে এনে দেয় রিমি।তুই তো বলেছিলি বৈধ সম্পর্কের অনেক জোর তাহলে কেনো অহিন আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। আমি কখনও একা কোথাও যাইনি রিমি।এই গোটা একটা অহিনবিহীন জীবন কি করে কাটাবো রিমি।অহিনবিহীন জীবন কি ভিষণ যন্ত্রনার সে শুধু আমি জানি রিমি।আমার মনে হচ্ছে কেউ আমার কলিজাটা কেটে কুচিকুচি করে দিয়েছে রিমি।ও রিমি আমি বাঁচবো কি করে রিমি!

———————————————————————————-

ছয় বছর পর,,,,

এই অহিন তাড়াতাড়ি আয় দেরি হয়ে যাচ্ছে,কখন যাবো আমরা?

—আসছি হয়ে গেছে।

—-দুজন ছেলে মেয়ে বের হয়ে আসলো, তাদের বয়স পাঁচ অহিন আরিশার ছেলে মেয়ে।ছেলের নাম অহিন,মেয়ের নাম অরিন।

—–আরিশার টুইন ছেলে মেয়ে হয়েছে।একজন ছেলে একজন মেয়ে।
আজ অহিনের পঞ্চম মৃত্যু বার্ষিকী তাই সবাই মিলে অহিনের কবর জিয়ারত করতে যাচ্ছে।
—–আরিশা বলে,মা তোমরা থাকো আমরা তাড়াতাড়ি চলে আসবো।আরিশা অহিনের বাড়িতেই আছে।সাজেদা বেগম আর অহিনের গর্ভধারিণী মাকে আরিশাই দেখে।অহিন বলেছিলো সে নিশ্চিন্তে থাকবে কোথাও গিয়ে কারণ তার মাকে আরিশা দেখবে।আরিশা করছে ও তাই।আরিশা যা করছে মায়ের জন্য।অন্যকেউ করবে না।আরিশার বাবা মা অনেক চেষ্টা করেছে আরিশাকে নিয়ে যেতে আরিশা যায় নি।তার এক কথা এখানে অহিন আছে।সে অহিনকে এখনো প্রথম দিনের মতই অনুভব করে।
তার স্বামীর বাড়িতেই সে মরতে চায়।তাই উনারা আর জোর করেননি।কারণ জোর করে লাভ হবে না। আরিশার জেদের কাছে সবাই হার মানে।

রাফিনের বিয়ে ঠিক হয়েছে,মেয়ে সাজেদা বেগমের দেখা।এই ছয় বছর ছায়ার মত পাশে ছিলো আরিশার।ভেবেছিলো আরিশা যদি তাকে একটু ভালবাসতে পারে।কিন্তু না তা হলো না।সত্যিকারের ভালো কাউকে বাসলে অন্য কাউকে ভালবাসার ইচ্ছেটাই মরে যায়।রাফিন কোনদিন আরিশাকে মুখ ফুটে বলেনি সে আরিশাকে বিয়ে করতে চায়।কারণ সে জানে বললে আরিশার বন্ধুত্বো হারাতে হবে।এর চেয়ে বন্ধু হয়ে থাকা ঢের ভালো।
আরিশা অহিনকে এতোটা ভালবাসে যে পৃথিবীর সবকিছু তার কাছে আজ তুচ্ছ! নয়তো এই বয়সের একটা মেয়ে জীবনের সাচ্ছন্দ্যের উপর লোভ না করে অনায়াসে একটা জীবন পার করার সিদ্ধান্ত কিভাবে নিতে পারে!এর জন্য প্রয়োজন গভীর ভালবাসা!রাফিন ভাবে অহিন সত্যি ভাগ্যবান নয়তো এমন ভালবাসা পায়!
আরিশার জীবনে এখন একটাই লক্ষ্য মায়েদের দেখা আর অহিনের শেষ চিহ্নদের মানুষ করা।এর বাইরে তার কোন জগৎ নেই।অহিনের ব্যবসা সে দেখে।অহিন তার মৃত্যুর আগে সব সম্পত্তি দুই ভাগ করে গেছে।এক ভাগ তার, অন্য ভাগ রাফিনের।আরিশা সেটা পরে জানতে পারে।অহিনের সবকিছু এখন আরিশা দেখে।আজও অহিনের চেম্বারের কিছুই পাল্টায়নি।ঘরের কিছুই পাল্টায়নি।এসব কিছুতে সে অহিনকে খুজে পায়।

আরিশা, অরিন,অহিন,দাড়িয়ে আছে অহিনের কবরের পাশে।এখানে আরিশা ছয় বছর আগে একটা বেলী ফুল গাছ লাগিয়ে দিয়েছে।গাছটায় ফুল ধরেছে।গন্ধে চারপাশ ম ম করছে।অরিন বলে,বাবা তুমি কেমন আছো?
আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে তোমায়, কিন্তু মা বলেছে, চোখ বন্ধ করলেই তোমাকে পাবো।আমি তোমাকে পাই বাবা।চোখ বন্ধ করে দেখি তুমি আমায় কোলে নিছো,আদর করছো।

অহিন বলে,বাবা তোমার হিংসা হচ্ছে আমাকে দেখে,মা বলে আমি নাকি একদম তোমার মত দেখতে,তাই আমার নাম ও তোমার নামে রেখেছে।বাবা মিস ইউ!আমরা তোমার জন্য কাঁদি না বাবা।মা বলে, কাঁদলে নাকি তুমি রাগ করবে।কিন্তু বাবা মা নিজেই কাঁদে।তোমাকে চুপিচুপি বলছি, মা প্রতিদিন রাতে আমাদের ঘিম পাড়িয়ে তোমার ছবি বুকে নিয়ে কাঁদে।আমি দেখি বাবা।বাবা ও বাবা মা, আমি, অরিন দাদুমনিরা সবাই তোমাকে খুব ভালবাসে বাবা!খুব!মা হয়তো একটু বেশী ভালবাসে বাবা!

আরিশা পাশে দাড়িয়ে কাঁদছে,এই একটা দিন বাবাকে ছেলে মেয়েরা সব বলে আরিশা বাধা দেয় না।অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তার বাচ্চারা কাঁদে না।প্রথম থেকেই আরিশা তাদের শক্ত করে গড়ে তুলেছে।কারণ সে জানে বাবাহিন সন্তানদের জীবন কতটা কঠিন।তাই প্রথম থেকেই শক্ত করে বানাচ্ছে।

এই অহিন ভালো লাগছে আমাকে এভাবে দেখে!খুশী হয়েছো?আমি কেনো তোর অন্তরালের ভালবাসা বুঝিনি তোকে কষ্ট দিয়েছি তার প্রতিশোধ নিলি তুই? তাই তো আমার মনের অন্তরালে তোর জন্য ভালবাসা বরাদ্দ করে দিলি।যে ভালবাসা লুকিয়ে থাকবে সারাজীবন অন্তরালে। যার হদিস কেউ পাবে না।আমি সারাজীবন মনের অন্তরালে এই ভালবাসা লালন করবো অহিন।অহিন সারাজীবন থেকে যাবে আরিশার বুকে গভীরে অন্তরালে!
আরিশা চীখ বন্ধ করে আছে,বাতাস বইছে চারপাশে বেলী ফুল ঝরে পড়ছে অহিনের কবরে আর আরিশার গায়ে।আরিশা অনুভব করছে অহিন এসে তার পাশে বসেছে বলছে,আমি সবসময় তোর সাথে আছি আমার পাগলি বউ!সেটা হোক বাস্তবে, কিংবা কল্পনায়! যেখান আরু সেখাই অহিন!এই ভালবাসা যে অনন্ত, এই অন্তরালের ভালবাসা কি কেউ আলাদা করতে পারবে আরু সে হোক না মৃত্যু!অহিন সারাজীবন রয়ে যাবে আরুর মনের অন্তরালে। আরুর শরীরের অন্তরালে। আরুর আত্নার সাথে মিশে।

আরিশা চোখ বন্ধ করে অহিনের ছুঁয়ে দেয়া অনুভব করছে।আরিশার মুখে হাসি।
অহিন,অরিন হাত তালি দিয়ে বলে,ইয়ে মাকে বাবা ছুঁয়ে দিয়েছে।

এখন আরিশার একটা গানের লাইন মনে পড়ছে,
যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে, কেটেছিলো নৌকার পালের মত!আমার চোখে, ঠোঁটে, গালে তুমি লেগে আছো”
আরিশা আজও অনুভব করে অহিনের প্রতিটি স্পর্শ!আজও সব তার কাছে জীবন্ত!সজীব!
এই ভালবাসা নিয়ে আরিশা আরও একশোটা জীবন পার করে দিতে পারে।

‘কিছু সুতা বাধতে বাধতে ছিড়েঁ যায়’,
কিছু লেখা লিখার সাথেই সাথেই বৃষ্টির জলে মুছে যায়,
কিছু সম্পর্ক গড়ার আগেই ভেঙে যায়।
তাই বলে কি অন্তরালের ভালবাসা শেষ হয়ে যায়!
নাতো!অন্তরালের ভালবাসা অন্তরালেই থেকে যায়!

সমাপ্ত
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here