অন্তরালে ভালবাসা পর্ব ২৮+২৯+৩০

#অন্তরালে_ভালবাসা
২৮
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা

চার মাস পর,,,,,,

নতুন বাসা ঠিক করলেও সাজেদা বেগম আরিশাকে সেটায় উঠতে দেয়নি।আরও দুমাস এ বাসায় রেখে দিয়েছেন। এর মাঝে অহিন আরিশার সম্পর্ক আরও সহজ হয়ে গিয়েছে। আগে সোফায় আলাদা ঘুমালেও এখন একসাথে এক বিছানায় ঘুমায়,তবে দুজনের মধ্যে ভারত পাকিস্তান দেয়াল। অহিনের বেশীর ভাগ রাত কাটতো আরিশাকে দেখে।দিন যত আগাতে থাকে অহিনের কষ্ট তত বাড়তে থাকে। দেখতে দেখতে দু মাস কেটে যায়।তাই আরিশার আলাদা বাসায় উঠার সময় চলে আসে।আরিশা সেদিন এ বাসা থেকে যেতে অনেক কেঁদেছিলো। সাথে সাজেদা বেগম ও।
অহিন আরিশাকে দিয়ে এসে সারাদিন রুমের দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে কেঁদেছে।নিজেকে খুব অসহায় লাগছিলো তার।তারপর ও যথারীতি নিজেকে মানিয়ে নেয় অহিন।

——————————————————————————-

আরিশা নতুন বাসায় উঠেছে দু’ মাস হয়ে গেছে চাকরি ও ভালোই চলছে।
অহিন তার বাসা আর বাসার জিনিস সব কাজে আরিশাকে সাহায্য করেছে। আরিশা আর রাফিনের সংসার সাজিয়ে দিতে অহিনের খুব কষ্ট হলেও, বুকের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে হাসি মুখে সব করে গেছে।আরিশা সে বাসা থেকে অফিস যায়।এ কদিনে আরিশা বুঝতে পারে তার অহিনদের বাড়ি ছেড়ে থাকতে ভালো লাগে না।সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকার পর যখন বাসায় আসে তখন বড্ড একা লাগে নিজেকে।আর আজকাল আরিশা রাফিনকে মিস না করলেও, অহিনকে মিস করে,খুব মিস করে।আলাদা থেকে আরিশা আস্তে আস্তে এখন বুঝতে পেরেছে সে আসলে অহিনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। অহিনের সাথে কাটানো খুনসুঁটি ভরা সময় গুলো খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে কুয়াকাটায় কাটানো দিনগুলো। কিন্তু মনের এসব ভাবনাকে আহ্লাদ দিতে চায় না আরিশা।

আর ১৫দিন পর বিয়ে তাই এখন অহিনকে নিয়ে ভাবা ঠিক হবে না।তারপরও আরিশার অবাধ্য মন আস্তে আস্তে অহিন নামক সাগরে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।আসলে একজন মানুষ তার জীবনের সব কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেও তার মনের উপর রাখতে পারে না।এটা হয়তো মানুষের আয়ত্তের বাইরে, তাই কখন আমরা অন্য কাউকে ভালবেসে ফেলি নিজেই বুঝতে পারি না।

কাল রাফিন দেশে ফিরবে। সব কেনাকাটা বাকি এখনো। তাই এসেই কেনাকাটা শুরু করবে।এর মাঝে সিহাব জানিয়েছে ১৫দিনপর অহিন আরিশার ডিভোর্স কার্যকর হয়ে যাবে।আজ অহিন এসেছে আরিশার বাসায়। প্রায় এসে আরিশার কি লাগবে এসব দেখে যায়।

—–কেমন আছিস আরু?

—–ভালো, তুই?
—–ভালো,কাল রাফিন আসছে তুই তো অনেক খুশী তাই না?
—আরিশা হাসার চেষ্টা করে বলে,হুম।খুশী হবো না।এতো বছরের প্রেম সার্থকতা পাবে।খুশী তো হতেই হবে।

—-এই কথাটা যেনো অহিনের বুকে গিয়ে লাগে।
–তুই কি তিন্নিকেই বিয়ে করবি?
—-জানিনা আরু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গভীর গলায় বলে অহিন।আরিশার কাছে কেমন যেনো লাগলো কথাটা।
অহিনের আর দাড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আজকাল হাঁপিয়ে উঠে অহিন।জীবনটা একটা অভিশাপের মত মনে হয়।ইচ্ছে করে সব ছেড়ে দূর দেশে পাড়ি জমাতে।সে ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। শুধু আরিশার সাথে ডিভোর্স হওয়া বাকি।

—আমি আসি আরু।
—এখনই তো এলি আবার চলে যাবি?
—-হুম যেতে হবে কাজ আছে আমার। বলেই সামনে এগিয়ে যায় অহিন।
আরিশা বলে পালাচ্ছিস অহিন?

অহিন অবাক হয়ে পেছনে ঘুরে দাড়িয়ে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে আরিশার দিকে।পালাবো কেনো আরু?

আমি জানি তুই পালাচ্ছিস।বসবি একটু অহিন?আমার কিছু কথা আছে তোর সাথে।কিছু জানতে চাই আর কিছু জানাতে চাই?সময় হবে তোর?শান্ত তবে গভীর গলায় বলে আরিশা।তখন অহিনের মনের মাঝে এক অজানা ভয় কাজ করে।মনে হয় ঝড়ের আগে যে শান্ত ভাব আসে পৃথিবীতে এখন সেরকম মুহুর্ত! কি জানতে চায় আরিশা!আর কি জানাতে চায়!

অহিন গিয়ে চুপচাপ বারান্দায় সোফায় বসে।চা খাবি অহিন?
অহিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।আরিশা চলে যায় চা বানাতে। আর অহিন বসে ভাবতে থাকে আরিশা তাকে কি বলবে! একটুপর আরিশা আসে চা নিয়ে। অহিনের মুখোমুখি বসে চা এগিয়ে দেয়।নিজের চা টায় চুমুক দিয়ে বলে,আজকের সন্ধ্যাটা কেমন যেনো বিষন্ন তাই না অহিন?

অহিন ভালোভাবে চারপাশ দেখে বলে কিছুটা। ধোঁয়া উঠা গরম চায়ে চুমুক দিতেই অহিনের জিহ্বা জ্বলে যায়,উঁহু বলে উঠে অস্ফুটে। আরিশা উঠে ব্যস্ত হয়ে দেখে অহিনের মুখ।অহিন আরিশাকে সরিয়ে দিয়ে বলে আমি ঠিক আছি।তুই বল কি বলতে চাস?

আরিশা কেমন রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসে।সে হাসিতে কিছু একটা আছে সেটা অহিন বুঝতে পারে।

—আরিশা কিছুক্ষন চুপ থাকে,হয়তো তার কথাগুলো সাজিয়ে নেয় সে।তারপর বলে,ধরে নেয় অহিন তোকে দুজন মেয়ে ভালবাসে। আর তুই এদের মধ্যে একজনকে ভালবাসিস,আর অন্যজন তোকে ভালবাসে। তাহলে তুই কাকে বিয়ে করবি এ দুজন থেকে?

অহিন অবাকের শেষ পর্যায়ে চলে যায়।তারসাথে তার মনে ভয় কাজ করে।আরিশা হঠাৎ এসব কথা কেনো বলছে?কি হয়েছে আরিশার!

তুই কি পাগল হয়ে গেছিস এসব কি বলছিস তুই আরু?আমি যা বলছি ঠিক বলছি।শুধু তুই উত্তর দিবি,কোন কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবি না তুই। আরিশা কাঠ কাঠ গলায় বলে।

অহিনের মনের সন্দেহ গুলো আরও বেশী গাঢ় হয়।অহিন বলে,’অবশ্যই আমি যাকে ভালবাসি তাকেই পেতে চাইবো।কারণ সবাই তার ভালবাসার মানুষকে কাছে পেতে চায়।আরিশা বলে গুড।এখন যদি তুই যাকে ভালবাসিস বলে মনে করিস,কিছুদিন পর তোর মনে হয় তুই আসলে যে তোকে ভালবাসে তুই তাকেই ভালবাসিস।আর আগের ভালবাসাটা হয়তো প্রেম ছিলো আর ভালোলাগা।কারণ প্রেম মানে ভালবাসা নয়।

—-দেখ আরিশা যদি আমি যাকে ভালবাসি বলে এতোদিন ভেবে এসেছি,কিন্তু কোন কারণে যদি মনে হয় আমি তাকে না,অন্য কাউকে ভালবাসি।তাহলে সেটাই হয়ত আমার সত্যি কারের ভালবাসা হবে।কিন্তু তাই বলে আমি আগের জনকে ছাড়তে পারি না।কারণ এতো গুলো দিন আমার তার সাথে সম্পর্ক ছিলো।তার মন ভাঙার অধিকার আমার নেই।

—-তুই খুব ভালো রে অহিন।আসলেই তুই আবরার শাহরিয়ার। তোর নামের অর্থই ন্যায়বান রাজা”তাই তুই ন্যায়বান মানুষ হয়েছিস।

তবে একটা কথা তুই কি কাউকে ভালবাসিস?

–না আমি কাউকে ভালবাসি না।অহিনের বুকের ভেতর তখন সমুদ্রের জোয়ার শুরু হয়ে গেছে।এখান থেকে উঠে যেতে পারলেই বাঁচে সে।তাই কাজ আছে বলে বেড়িয়ে যেতে নিলে।একটা কথায় থমকে যায় অহিন।

“তুই আমাকে ভালবাসিস অহিন?

“আমি তোর ডায়েরি দেখে ফেলেছি!”তুই আমায় মিথ্যে বলতে পারবি না অহিন।কাঁপা কাঁপা গলায় বলে আরিশা।

অহিনের তখন হাঁটু কাঁপছে। শিরদাঁড়া বেয়ে এক হীম শীতেল স্রোত নেমে গেলো! মনে হচ্ছে সে ভুল শুনেছে।আরিশা কি করে তার ডায়েরি পড়বে।এই ডায়েরি তো সে লুকিয়ে রেখেছে যত্নে।অহিনের মনে হচ্ছে সারা পৃথিবী বুঝি থমকে গেছে।

অহিন ধীর পায়ে এসে আরিশার সামনে বসে।তার দৃষ্টি নিচের দিকে।আরিশা অহিনের দিকে তাকিয়ে আছে কঠিন মুখে কিন্তু অহিন আরিশার মুখের দিকে তাকাতে পাচ্ছে না।কোন এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে ভরে যাচ্ছে অহিনের মন।আরিশাকে কি জবাব দিবে অহিন!

অহিনকে চুপ থাকতে দেখে আরিশা বলে, সেদিন আমি তোর লাইব্রেরি রুমটা পরিস্কার করতে গেলাম।তখন একটা নীল বাক্সে আমার চোখ আটকে যায়।এটা এতো সুন্দর ছিলো যে এটায় কি রাখা আছে আমার দেখতে ইচ্ছে হলো।যখন দেখলাম তোর ডায়েরি তখন বুঝলাম নিশ্চয়ই তোর বিষয়ে কোন গোপন কিছু পাবো যা নিয়ে তোকে ক্ষেপাতে পারবো।কিন্তু ডায়েরিটা খুলে আমি হতবাক এভাবে একটা মেয়েকে নিয়ে প্রতিটি লাইন লেখা।সবচেয়ে অবাক হলাম তুই আমাদের কোন ছোট ঘটনাও বাদ দিস নি।সব লিখে রেখেছিস।কেউ কাউকে কতটা ভালবাসলে এভাবে তার ভালোর জন্য নিখুঁত অভিনয় করে যেতে পারে আমি জানিনা।কারণ আমি আমার মনের কথা গোপন রাখতে পারিনা।তোর ভালবাসার গভীরতা মাপার যোগ্যতা আমার নেই অহিন,কিন্তু এর মর্যাদা তো আমি দিতেই পারি।সম্মান করি আমি তোর এই ভালবাসাকে।কিন্তু একই সাথে অসহ্য কষ্ট আর ঘৃনা হয় নিজের প্রতি।

তুই কিভাবে আমাকে প্রতিটি মুহুর্তে নিজের বউ হিসেবে কাছে পেয়েও নিজেকে সংযত রেখেছিস!বিশ্বাস কর আমি হলে হয়তো পারতামনা।

তোর আমার উপর সম্পুর্ণ অধিকার থাকার সত্ত্বেও, তুই আমার সাথে স্বামীর অধিকার ফলাতে চেষ্টা করিস নি। তুই কখনও বুঝতে দিস নি তুই আমাকে ভালবাসিস।তুই আমাকে ছাড়া কষ্টে আছিস।কিন্তু এতোটুকু আমি ঠিকই বুঝতে পারি যে ভালবাসার মানুষকে অন্যের সাথে দেখতে কেমন লাগে! কিন্তু তুই সব সহ্য করে গেছিস।কেনো অহিন?এতোটা ভালো হতে হবে কেনো? কেনো একটু নিজের কথা ভাবতে পারিস না তুই?কেনো এভাবে স্বার্থহীন ভালবাসতে হয় তোকে?

তুই চাইলে এই কয় মাসে আমাকে আপন করার চেষ্টা করতে পারতি।কিন্তু তুই করলি না।কেনো অহিন?এতোটা কষ্ট নিয়ে কিভাবে এতো সুখী সুখী মুখ করে থাকিস সবসময়? “শুনেছি বড়লোকের ছেলেরা আহ্লাদী হয়,”অধৈর্য হয়!”যা ভালো লাগে তা নিজের করেই ছাড়ে”!কিন্তু তুই কেনো এতোটা আলাদা হতে গেলি”!এতোটা ধৈর্যশীল কেনো হতে গেলি তুই!”

আরিশা কাঁদছে হেচকি তুলে তুলে কাঁদছে।একটু কথা বলে আবার লম্বা দম নিচ্ছে আবার কথা বলছে।দেখলি তো অহিন সত্যের আলো কতখানি? সত্যিটা ঠিক আমার সামনে চলে এলো।

তুই যে কথা গুলো তোর মনের বাক্সের গোপন ড্রয়ারে তালাবদ্ধ রেখেছিস, সেটা আমি পড়ে ফেলেছি অহিন।সত্য দিনের আলোর মত পরিস্কার হয়ে সামনে চলে এলো!

আমি সব জেনে গেলাম অহিন!আমার দিকে তাকিয়ে দেখ অহিন?তাকা আমার দিকে?অহিনের চোখ দিয়ে অনবরত নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে।অহিন জানেনা কি হতে যাচ্ছে তার জীবনে।কিন্তু এই মুহুর্তে আরিশার কথা গুলো অহিনকে পুরো ভেঙে দিয়েছে।মুখের উপর কঠিন হওয়ার যে পর্দাটা সবসময় বয়ে বেড়াতো অহিন, আজ তা এক মুহুর্তে সরে গেলো। আজ আর এই কান্না লুকাতে পারছে না অহিন।এই কান্না লুকানোর কি আর কোন প্রয়োজন আছে!কিন্তু সত্যি আরিশার দিকে তাকানোর সাহস অহিন পাচ্ছে না।
আরিশা আবার কান্না জড়িত কন্ঠে বলে,আমার দিকে তাকিয়ে দেখ অহিন।আমার চোখের দিকে তাকা?অহিন তাকা আমার দিকে?অহিন নিচের দিক থেকে মুখ তুলছে না দেখে আরিশা ধমক দিয়ে বলে তাকা অহিন আমার দিকে।অহিন তার সুন্দর চোখ দুটো মেলে তাকায় আরিশার দিকে আরিশার চোখেও জল টপটপ করছে।আরিশা অহিনের এই তাকানোতে যেনো কিছু একটা পেলো।এমন কিছু যা আগে কখনও পায়নি।মনে হচ্ছে এই তাকানোতে আরিশা শেষ হয়ে যাবে।অহিনকে কখনও কাঁদতে দেখেনি বলে, এভাবে বাচ্চাদের মত কাঁদতে দেখে আরিশার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।

আরিশা হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে।আরিশা হঠাৎ করে গিয়ে অহিনকে নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আজ অহিন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না।সেও জড়িয়ে ধরে আরিশাকে। খুব খুব শক্ত করে।এতোটা শক্ত করে যে বুকের সাথে পিষে ফেলতে ইচ্ছে করছে তার।দুটো মানুষের চোখ জলে ভাসিয়ে যাচ্ছে একে অন্যের শরীর। ঠিক তখন অহিনকে পৃথিবীর সবচেয়ে অবাক আর আকাংখিত কথাটি আরিশা ফিসফিসিয়ে বলে,”আমি তোকে ভালবাসি অহিন”ভালবেসে ফেলেছি এই বৈধ সম্পর্কটাকে”

তখন অহিনের কান দিয়ে মনে হচ্ছে ধোঁয়া বের হচ্ছে।তার পৃথিবীটা যেনো পালটে গেছে।এক ভয়ংকর সুখ সে অনুভব করলো। যে সুখ সে কোনদিন পাবে না বলে মনে করেছে।সে অনাকাঙ্ক্ষিত সুখটা নিজ থেকে ধরা দিচ্ছে তার কাছে, এ যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না অহিন। মনে হচ্ছে এটা কোন ঘোর যা একটু পরেই কেটে যাবে!এটা কোন স্বপ্ন যা একটু পরেই ভেঙে যাবে!
#অন্তরালে_ভালবাসা
২৯
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা

আরিশার মুখ থেকে এই জাদুকরী কথা শুনে, অহিনের সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে আসে।শরীরের প্রতিটি রক্তকনিকায় এই জাদুকরী কথার সুখ পৌছে যায়। মনে হচ্ছে এ সুখের অসুখে সে এখনই মরে যাবে।মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে।এমন স্বপ্ন সে জীবনে যা কল্পনা পর্যন্ত করতে পারেনি।এটাও কি সম্ভব ছিলো! অহিনের হাত নিস্তেজ হয়ে আসে হঠাৎ আরিশাকে ছেড়ে দিতে চাইলে আরিশা আরও বেশী শক্ত করে ধরে অহিনকে।অহিন চাইলে ও আর আরিশাকে ছাড়তে পারে না।তার মনের সকল শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে আরিশাকে।কেমন এক অনুভূতি হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না।হয়তো এই অনুভূতিটা নতুন বলে!

আরিশাকে ছাড়িয়ে অহিন বলে,আজ আমি তোকে একটা গল্প শুনাবো আরু। একটা অসহায় ছেলের গল্প।শুনবি তো তুই?
আরিশা অহিনের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরে বলে শুনবো অহিন,আমি তো তোর সব গল্প শুনতে চাই,তোর জীবনের গল্প হতে চাই।

অহিন আর কথা না বাড়িয়ে বলা শুরু করে।লম্বা একটা দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করে।

জানিস আরু একটা ছেলে ছিলো যার বাবা মা সব থাকার পরও সে মানুষ হয় অন্য একটি পরিবারে।আবার অন্য একজন ছেলে ছিলো যার বাবা মা কিছু না থাকার সত্ত্বেও সে মানুষ হয় এমন এক পরিবারে যেখানে তার বড় হওয়ার কথাই না।কারণ বাবার পরিচয়হীন সন্তান এতো বড় পরিবারের সুখ পাওয়ার অধিকারই রাখে না।কিন্তু সে পেয়েছে।

প্রথম ছেলেটির মায়ের অল্প বয়সে করা ভুল ছিলো সে।বড় পরিবারের মেয়ে হওয়ায় ভদ্রমহিলার প্রসবের পরপরই তার সন্তানকে দিয়ে দেয়া হয় অন্য একটা সন্তানহীন পরিবার। সে পরিবারের দম্পতী সন্তানহীন ছিলেন বলে নিয়ে যান,সেই ছোট বাচ্চাটিকে।আর ভদ্রমহিলাকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় তার কিছুদিন পরে।খুব সুখে তিনি থাকলেও প্রতি রাতে তার ঘুম আসতো না।সে সন্তানের কথা ভেবে।সারাজীবন তিনি সন্তানের কাছে অপরাধী হয়ে থাকবেন।আর তার সন্তান জানতেও পারবে না তার আসল মায়ের না বুঝে করা এক পাপের ফসল সে।কিন্তু নিয়তির অদ্ভুত খেলায় ভদ্রমহিলা যে সন্তানকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন সমাজের খারাপ কথার জন্য। সে মানুষটি বিয়ের পর মা হতে পারলেন না।উনার স্বামী উনাকে পৃথিবীর এমন কোন বড় ডাক্তার বাদ রাখেননি যেখানে তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে যাননি।কিন্তু একসময় বাধ্য হয়ে তিনি তার স্বামীকে বিয়ে করতে বলেন আবার কারণ তিনি জানেন এটা তার করা পাপের শাস্তি। কারণ যে সন্তানকে তিনি সমাজের ভয়ে পরিবারের চাপে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন তার অভিশাপে বিধাতা হয়তো তার কাছ থেকে সন্তান সুখ কেড়ে নিয়েছেন।নয়তো কেনো তিনি মা হতে পারলেন না।ডাক্তাররা বলে তিনি কোনদিন মা হতে পারবেন না।
।তিনি এটাকে বিধির বিধান হিসেবে মেনে নেন।কারণ প্রকৃতি কারো পাপ -পুর্ন কিছুই ভুলে না।সবকিছুর হিসেব কড়ায়_ গন্ডায় বুঝিয়ে দেয়।তাই তিনি স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে বলেন।কিন্তু তার স্বামী স্ত্রীকে এতোটাই ভালবাসলেন যে বিয়ে করার কথা চিন্তাই করেননি। কিন্তু যখন তার স্ত্রী তাকে ডিভোর্স দিবে বলে ঠিক করে তখন তিনি বাধ্য হন,কিছু একটা উপায় বের করতে তখন বিভিন্ন হাসপাতালে তিনি যোগাযোগ শুরু করেন একটা বাচ্চার জন্য।আর সে বাচ্চাটা তিনি এমনভাবে কিনে নিতে চান যে বাচ্চার আসল বাবা মা যেনো কোনদিন জানতে না পারে সে বাচ্চাটা কার কাছে দিয়েছে তারা।টাকা আদান প্রদান করবেন ভদ্রলোকের এক বিশ্বস্ত ডাক্তার বন্ধু। বাচ্চাটাকে তিনি নিবেন ডাক্তারের কাছ থেকে।যাতে কোনদিন সে বাচ্চাটা জানতে না পারে সে এই পরিবারের সন্তান না।আর তার আসল বাবা মা ও যেনো কোনদিন অধিকার নিয়ে না দাড়ান তাদের সামনে। সবমিলিয়ে একটা বাচ্চা তিনি পেয়ে গেলেন কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সে বাচ্চাটা অবৈধ! অথাৎ অন্য কোন এক মহিলার পাপের ফসল সে।প্রকৃতির কি অদ্ভুত নিয়ম দেখলি আরু?যে নারী অবৈধ বলে নিজের সন্তানকে ত্যাগ করলেন,তার কপালে সেই অবৈধ সন্তানই জুটলো! “একেই হয়তো বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ!”

ভদ্রলোক ঠিক করলেন সে বাচ্চাটাকেই নিজের বাচ্চার মত করে নিবেন।তাই তিনি সব তার প্লান মত করে নিলেন।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এক জায়গায় অন্যরা যখন বলবে উনার স্ত্রী গর্ভবতী না হয়েও কিভাবে সন্তান আসলো। তাই তিনি তার স্ত্রীর জন্য ঢাকা থেকে দূরে সিলেটে একটা বাড়ি নিয়ে নিলেন।সেখানে তিনি দশ মাস থেকে বাচ্চা নিয়ে আসবেন।হলো ও তাই। বাচ্চা নিয়ে যখন তিনি ফিরলেন তখন তাদের সুখের সংসার। এই ছোট বাচ্চাটাকে তারা এতো বেশী ভালবাসা দিলেন যে, বাচ্চাটি কখনও বুঝতে পারলো না।এরা তার নিজের বাবা মা না।কিন্তু ওই যে সত্য তো দিনের আলোর মত পরিস্কার! তাই সত্যের আলো ঠিক সামনে চলে এলো।
ভদ্রমহিলাও তখন তার আসল সন্তানের খোঁজ পেয়ে গেলেন। আর অদ্ভুত ব্যাপার বা কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে এই যে,উনার দুই ছেলেই একই স্কুলে পড়ে তাও একই ক্লাসে। আর তারা দুজন খুব ভালো বন্ধু। এতে অবশ্যই ভদ্রমহিলার সুবিধাই হলো। তিনি ছেলের বন্ধুর অজুহাতে নিজের ছেলেকে কাছে পেয়ে গেলেন। দুজনকে সমান ভালবাসতেন তিনি।যাই কিনতেন সব দুটো করে।

ততদিনে তাদের দত্তক নেয়া ছেলেটা জানতে পেরে যায় উনারা ছেলেটার বাবা মা না।ছেলেটার তখন ১৪বছর বয়স। বুঝতে পারছিস কতটা কষ্ট হয়েছে তার এই সত্যিটা জেনে।আর তারচেয়ে বেশী কষ্ট হয়েছে এটা শুনে যে সে কোন এক নোংরা মহিলার পাপের ফসল। যে টাকার বিনিময়ে সন্তান বিক্রি করে।
তখন ছেলেটার মনে হলো, “পৃথিবীতে এমন মা ও হয়!
যে কি না সন্তান বিক্রির ব্যবসা করে।অথচ আমরা তো জানি মা শুধু মাই হয়।মা সন্তানের জন্য সবচেয়ে আলাদা হয়।মা তো এক মমতার নাম হয়!
কিন্তু সেই বয়সে এসে ছেলেটা বুঝতে পারে, হয়তো এমন হয় কারণ সবাইতো নারী হয়।সব নারী কি মা হতে পারে!হয়তো পারেনা।

অহিনের চোখের পানিতে তার শার্টের কলার বুকের দিকেটা ভিজে যাচ্ছে।একটু পর পর সামনে থাকা গ্লাসের পানি খেয়ে নিচ্ছে।তার কথা বলতে যে খুব কষ্ট হচ্ছে তা আরিশা খুব বুঝতে পারছে।আরিশা ও কাঁদছে কিন্তু কিছুই বলছে না।কারণ সে চায় অহিন সব বলে হালকা হোক।
অহিন বারবার শার্টের হাতায় চোখ মুছছে।একটু পর পর লম্বা দম নিয়ে আবার বলা শুরু করছে।

কিন্তু সে বয়সটায় এই ধাক্কাটা ছেলেটার সামলাতে কষ্ট হয়।খুব খুব কষ্ট হয়।দুরন্ত, চঞ্চল, অস্থির ছেলেটা তখন একেবারে ধীর, আর স্থির হয়ে যায়।জীবনের এই চরম, নির্মম সত্যিটা মেনে নিতে তার কষ্ট হয়।পাগলের মত মনে হয় তার।কিন্তু তারচেয়ে বেশী কষ্ট হয় এই জন্য যে,সে সময় সে কাউকে বলতে পারে না।এই নির্মম সত্যিটার কথা।কারণ যারা তাকে এতোটা ভালবাসা, আদর,স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছেন, তারা তো চান যাতে এই নির্মম সত্যিটা কোনমতেই যেনো তাদের আদরের সন্তানটি জানতে না পারেন।তাই সেই ছেলেটা তখনই সিদ্ধান্ত নিলো সেও কখনও বুঝতে দিবে না। সে আসল সত্যিটা জানে।যারা তাকে নিজের থেকে বেশী ভালবাসে তাকে কি করে কষ্ট দিবে সে।তাই নিজে নিজেই হজম করে এই কঠিন সত্যিটা।যখন কোন মানুষ জানতে পারে তার অস্তিত্বটাই মিথ্যে, তার জন্মটাই এক পাপ, তখন তার কাছে জীবনের সব রঙ হারিয়ে যায়,জীবনের রঙটা সেই মেঘলা আকাশে জমে থাকা ছাই রঙা আকাশের মত হয়ে যায়। অন্ধকার হয়ে যায়।তখন থেকে সে শুরু করে তার বাবা মাকে আরও বেশী করে ভালবাসার।যাতে কখনও তাদের এমন মনে না হয়,যে এক গাছের ছাল অন্য গাছে লাগে না।অন্যের সন্তান নিজের হয় না।তখন থেকে শুরু হয় ছেলেটার অন্য এক লড়াই।ছেলেটা অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে নেয় তখন।স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে।তারপর ও রাত হলে ছেলেটার মনে এক অসহ্য যন্ত্রনা নেমে আসতো। বৈধ কথাটায় যতটা শান্তি আছে ঠিক ততটা অশান্তি আছে অবৈধ কথাটায়।ছেলেটি রাতের পর রাত ঘুমাতে পারতো না।চোখ লেগে আসলেই মনে হতো কেউ তাকে বলছে,তুই অবৈধ পাপের ফসল।তোর বাবারই ঠিক নেই।সে নোংরা কথাগুলো যে কি এক অসহ্য যন্ত্রনা দিতো সে শুধু ছেলেটি জানে।

এবার একটু থামলো অহিন,গ্লাসে থাকা শেষ পানিটুকু পান করলো সে।মনে হচ্ছে কথা গুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে গলায় আটকে যাচ্ছে।আরিশার কান্না গতি বাড়ছে।অহিনের হাতদুটো আরও শক্ত করে ধরে সে।
কিছুটা সময় নিয়ে অহিন আবার বলা শুরু করে।জানিস আরু এই এক নির্মম সত্যিটার ফাঁকে ছেলেটার জীবনে আলোর দূত্যি নিয়ে আসে একটি মেয়ে।সে মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলে ছেলেটি। নিজের মনের বাক্সে গোপনে লুকিয়ে রাখা কষ্টগুলো মেয়েটার আগমনে কমতে থাকে ছেলেটার জীবনে। আবার সে ভাঙা মন নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।জীবনে ভালবাসার মানে খুজে পায় সে।বেঁচে থাকার অর্থ খুজে পায়।মেয়েটা তার মেঘলা আকাশে এক ফালি রোদের ঝিলিক নিয়ে আসে।এক তপ্ত ক্ষরা মরুভূমিতে এক ফোঁটা অনাকাঙ্ক্ষিত শিশিরের ছোঁয়া নিয়ে আসে।
তার স্বপ্নগুলো যখন রসে টইটুম্বুর তখন প্রকৃতি তাকে নিয়ে খেললো আরেক নতুন খেলা!সে খেলাটায় এবার ছেলেটা একেবারে ভেঙে না গিয়ে বরং পাথর হয়ে গেলো। কারণ যে মেয়েটিকে সে ভালবাসে, সে জানতে পারে, তার খুব কাছের বন্ধু আর তার পালিত মায়ের নিজের গর্ভের সেই সন্তানটি মেয়েটিকে ভালবেসে ফেলেছে। এখানে এসে ও ছেলেটি পিছিয়ে গেলো। কারণ যে মা তাকে সন্তানের মত ভালবেসেছে সে মায়ের ভালবাসায় একমাত্র অধিকার ছিলো তার নিজের ছেলেটির। নিজের গর্ভের সন্তানকে তিনি অন্যেকে দিয়ে তাকে ভালবাসেছে এই তো অনেক।ঠিক এই মুহুর্তে এসে ছেলেটি ঠিক করে নিলো তার মায়ের ভালবাসার কিছুটা ঋণ হলেও শোধ করবে।আর করলো ঠিক তাই।এক নিখুঁত অভিনেতার মত করে এবার নিজের মনের গোপন ভালবাসাটাকে আরও গোপন করে তাতে সিলমোহর লাগিয়ে দিলো। যাতে কেউ তার হদিস না পায়।সবকিছুই তার চাওয়া মত হচ্ছিলো। সে মেয়েটি তার ভাই আবার বন্ধুকে ভালবাসলো।তাদের সুখী দেখতে ছেলেটি নিজের ভালবাসা ভুলে গেলো। মনে কোন হিংসা সে কখনও আনে নি। বরং এটাই মনে করেছে তার বন্ধু তথা ভাইটির সব ভালবাসায় সে ভাগ বসিয়েছে।যা তার বন্ধুর প্রাপ্য ছিলো তা সে নিজে পেয়েছে। তাই সে সময় থেকে তার সবকিছু সে নিজে দুটো করে নিতো একটা তার হলে অন্যটা বন্ধু তথা ভাইয়ের। তার মা ও বেশ খুশী হতেন।কারণ তিনি তার দুটো সন্তানকে কাছে পাচ্ছেন।আর সবচেয়ে বড় কথা দুটো সন্তানের মাঝে খুব ভাব।তিনি শান্তি পেতেন।তার করা পাপের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতেন।আর এটাই ছিলো ছেলেটির পাওয়া। মা খুশী তো সে খুশী। তাই যখন ছেলেটার সামনে এমন একটা সুযোগ এলো, সে তার ভালবাসাকে বিসর্জন দিয়ে তার বন্ধুর ভালবাসাকে প্রাধান্য দিলো। কারণ তার বন্ধুটির জীবন ও তো কোন এক জায়গায় এসে তার মতই। সে হয়তো জানে না।সে ও কোন এক নারীর গর্ভের অবৈধ সন্তান। আর এটা জানলে সেও এই একই কষ্ট বয়ে বেড়াতো। তাই ছেলেটা চেষ্টা করলো তার বন্ধুটি যাতে কখনও কোনদিন জীবনের এই নোংরা সত্যিটা জানতে না পারে। কারণ সে এই ছেলেটার মত এতো শক্ত মনের না,সে অল্পতেই ভেঙে যেতো। আর এই সত্যটা জানার পর তো সে হয়তো মরেই যেতো। একবার চিন্তা করে দেখ আরু যে ভালবাসায়
স্নেহ মমতায়, টাকা পয়সায় শুধু তার অধিকার ছিলো সে ভালবাসায় অন্যকেউ ভোগ করছে তাহলে সেটা কতটা যন্ত্রনার হতো। আর সবচেয়ে বড় কথা সেতো হয়তো এই সত্যিটা জানলে তার গর্ভধারিণী মাকে ঘৃনা করতো যেমনটা এই ছেলেটা তার ব্যাবসায়ী মাকে করে।কোন এক জায়গায় এসে দুটো মায়ের অবস্থান সে একই হয়ে যায়।কিন্তু সে ছেলেটি চায়নি যে মা তাকে নিজের সন্তানের মত ভালবেসেছে সে মাকে তার নিজের সন্তানের কাছে ছোট হতে দিতে।কোন কষ্ট পেতে দিতে।
এবার অহিন জোরে কান্না করে, হেচকি তুলে তুলে কাঁদে।

এতো গুলো বছর পর মনের বাক্সের গোপন তাকে লুকিয়ে রাখা সত্যি গুলো যখন বেরিয়ে আসছে,তখন অহিনের মনের কষ্ট গুলো তাজা হয়ে ওঠেছে।যে যন্ত্রনা গুলো মনের গভীরে এতো দিন চাপা ছিলো, আজ তা একে একে বের হয়ে আসছে।তাই আজ অহিন আর অভিনয় করতে পারছে না।মনের ভেতর গুমোট হয়ে থাকা মেঘ আজ বৃষ্টি হয়ে ঝরছে।অঝোরে ঝরছে!

মানুষের জীবন নাটকের চেয়ে ও নাটকীয়!বাস্তব জীবন এতো বেশী কষ্টের হয় যে মানুষ চাইলে ও তা অস্বীকার করতে পারে না।প্রতিটি মানুষের জীবনে এমন কঠিন কিছু সত্যি থাকে,যা সে প্রকাশ করতে চায় না।যা থাকে একান্ত তার নিজের একার।নয়তো অহিন রাফিনের মত এমন দুজন উজ্জ্বল ছেলের জীবনে এমন নির্মম সত্যি থাকতে পারে তা তো আরিশা ভাবতেই পারে না।মানুষকে কখনও জন্ম দিয়ে বিচার করা যায় না।প্রতিটি মানুষ সঠিক আদর, যত্ন আর ভালবাসা পেলে জন্ম যাই হোক তারা হয়ে ওঠে সোনার সন্তান।তাই বলা হয়,জন্ম হোক তথা”কর্ম হোক ভালো ”
আজ এই সত্যিগুলো জানার পর এই দুটো ছেলের উপর আরিশার সম্মান আরও বেড়ে গেলো।বরং তাদের জীবনের গোপন কষ্ট গুলো আরিশাকে আহত করলো খুব খুব খারাপ ভাবে।এতো কষ্ট পেয়েও এই ছেলেটা কত সহজ, স্বাভাবিক! এমন ছেলেকে ভাল না বেসে কোন মেয়েই থাকতে পারে না।যার সমস্ত জীবন ত্যাগে আর ধৈর্যে পরিপূর্ণ।

আরিশা অহিনের পাশে গিয়ে বসে,অহিনের কাঁধে মাথা রেখে বলে,এতো কষ্ট লুকিয়ে তুই কিভাবে আছিস অহিন?এতো কষ্ট নিয়ে এতো স্বাভাবিক হয়েই বা কি করে থাকতি তুই?তোকে দেখে কেউ বুঝতে পারবেনা তোর ভেতরে ঠিক কতটা যন্ত্রনা লুকিয়ে তুই এক নিখুঁত অভিনেতা হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিস।

রাফিন কি এই সত্যিটা জানে অহিন?
এতোক্ষনে আরিশা বুঝে গেছে প্রথম ছেলেটি অহিন,আর বন্ধু তথা ভাইটি রাফিন।আর রাফিনের গর্ভধারিণী মা,আর অহিনের পালিত মা সাজেদা বেগম।

অহিন হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে বলে,না জানে না।আমি চাই ও না রাফিন কোনদিন কিছু জানুক।তুই চিন্তা করে দেখেছিস আরু রাফিনের কষ্টটা তো আমার চেয়ে বেশী হবে।আমিতো মায়ের কাছে থেকেছি সব পেয়েছি।কিন্তু রাফিন তো মায়ের কাছে থাকতে পারেনি।তার জীবনটা তো আমার চেয়েও বেশী কষ্টের।তাই আমি কোনদিন চাইনা রাফিন এই বাজে সত্যিটা জানুক।আর এটাও চাইনা রাফিন কোনদিন কোন কষ্ট পায়। আমি চাই রাফিন সবসময় ভালো থাকুক আরু।রাফিনকে অবহেলা করেছে বলে আমার মায়ের ভালবাসা পেয়েছি।তাই আমার জন্য রাফিন যাতে কোনদিন কারো ভালবাসা থেকে বঞ্চিত না হয়। রাফিন খুব ভালো রে তাকে কষ্ট কি করর দেই!

আরিশা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,তুইও খুব ভালো রে অহিন।খুব খুব ভালো। এতো ভালো কেনো হতে গেলি?একটু খারাপ হলে কি হয় অহিন?তোর কষ্টটা কেনো সবসময় তোর কাছে এতোটা ছোট? এতো মহান কেনো হতে হয় তোকে?করুণা হয় সে মায়ের জন্য যে তোকে গর্ভধারণ করেছে কিন্তু ধরে রাখতে পারেনি।এই ছোটবেলা থেকে তুই যে ভয়ংকর এমন সত্যি বুকে নিয়ে সুখী মানুষের মত জীবন কাটিয়েছিস।তা অন্য কেউ হলে পারতো না অহিন।তুই আলাদা! তুই অনন্য!

আমি তোর কাছে কিছু চাইলে দিবি আরু?

আরিশা অদ্ভুতভাবে চেয়ে থাকে অহিনের দিকে।এই সুন্দর গভীর চোখ দুটোর গভীরতা মাপার চেষ্টা করে সে।তার চাহনিতে মাদকতা মেশানো ছিলো। যা অহিনের কাছে স্পষ্ট।
অহিন তখন গেয়ে ওঠে,,,

“এছে না মুঝে তুম দেখো চিনেসে লাগাউঙা”
তুমকো মে চুরালুনগা, তুমসে দিল মে চুপা লুনগা”

আরিশা অবাক হয়ে যায়, এই কষ্টেও ছেলেটা গান গাইছে। উফস এতো অস্থির কেনো এই ছেলে! কান্নায় হাসে,আবার হাসিতে কাঁদে”অহিনের কান্নামাখা হাসিটা তো আরও অস্থির! এতো সুন্দর হওয়ার কি দরকার ছিলো তোর অহিন!কান্নায় লাল হওয়া গালটা টেনে দেয় আরিশা।অহিন অশ্রু চোখে হাসে,সুন্দর সেই হাসি যে হাসিতে অশ্রু ঝরে, যে হাসিতে ঠোঁট হাসে”ভুবন ভোলানো সেই হাসি”স্নিগ্ধ সেই হাসি!”আরিশা দুম করে জড়িয়ে ধরে অহিনকে।অহিন আবার হাসে।আরিশাকে বুকে নিয়ে ভাবে তার তপ্ত মরুভূমিতে আজ শিশিরকণার স্পর্শ পেলো।আরিশার মনে হলো, এক অদ্ভুত সুখে চেয়ে গেছে চারপাশ।অদ্ভুত নেশায় মত্ত হয়ে আছে চারপাশে!
#অন্তরালে_ভালবাসা
৩০
#প্রজ্ঞা_জামান_দৃঢ়তা

অহিন আরিশাকে জড়িয়ে আছে, আরিশা অহিনকে।অহিন বলে আরও কিছু কথা আছে এই গল্পে শুনবি না আরু?

আরিশা অহিনের বুক থেকে মুখ তুলে তাকে জড়িয়ে থেকেই বলে, ‘হুম শুনবো সব শুনবো অহিন।আবার দুজন বসে আগের জায়গায় গিয়ে।অহিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,’ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস দেখেছিস আরু!যখন আমাকে মা দত্তক নিলেন তার ৮বছর পর রাত্রি মায়ের গর্ভে আসে।অথচ ডাক্তার বলেছিলো মা কখনও সন্তান ধারণ করতে পারবেন না।সব ওই উপরওয়ালারা খেলা বুঝলি!তারপর আবার রাফিনের দত্তক নেয়া বাবা মায়ের ঘরে ও রাফিনের ৯বছর বয়সের সময় এক সন্তান আসে সেও মেয়ে তার নাম রামিসা।অদ্ভুতভাবে যে পরিবার কখনও সন্তানের আশা করেনি সন্তান হবে না বলে নিজেদের বুঝিয়ে নিয়েছে, সে পরিবার তাদের সন্তান ফেলো।প্রায় সময় অনেকের বাচ্চা না হলে দত্তক বাচ্চা নেয়ার পর দেখা যায় তাদের বাচ্চা হয়।এই ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে।হয়তো এই অনাথ দুই ছেলেকে এতোটা ভালবাসা দেয়ার জন্য আল্লাহ তাদের নিজের সন্তান সুখের অধিকারী করেছেন।বিধাতার খেলা বোঝা বড় দায়!কে জানে উনার খেলায় কে কোথায় যায়!
এই দুই পরিবার এক মেয়ে এক ছেলে পেয়ে একদম সুখে শান্তিতে থাকতে লাগলো। তাদের কারোই ছেলে বা মেয়ের কোন শখই অপূর্ন থাকলো না।
কিন্তু তাই বলে নিজের সন্তান আসার পর দত্তক নেয়া সন্তানকে তারা কোনদিন অবহেলা করেনি।সবসময় আগের মতই গভীর ভালবাসা দিয়েছেন। তারা ভাবতেন এদের জন্যই আল্লাহ তাদের সন্তান সুখ দিয়েছে। এরা হচ্ছে আল্লাহর নেয়ামত।

আচ্ছা অহিন আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে তুই কিভাবে জানলি তুই আন্টিদের নিজের সন্তান না?
অহিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,’সে বার মা অসুস্থ হয়েছিলো, বাবা দেশে ছিলো না।আমাদের ফ্যামিলি ডাক্তার ছিলেন আব্বুর সবচেয়ে কাছে বন্ধু। তাই আমি মাকে উনার কাছে নিয়ে যাই।মাকে হাসপাতালে কেবিনে দেয়ার পর মায়ের শরীর খারাপ হয়,আমি দৌড়ে ডাক্তার আঙ্কেলের চেম্বারে আসি,নিয়তি সেখানে ও খেলে আরেক খেলা।আমি যখন উনার চেম্বারে ঢুকবো তখন আমি ডাক্তারের সাথে কারো তর্ক করা শুনতে পাই।অদ্ভুতভাবে সে কথাগুলো বলছিলো সাজেদা বেগমের দত্তক নেয়া সন্তান অহিনকে নিয়ে।আর সেখানে যে মহিলা এসেছেন তিনি হচ্ছে সেই সন্তান বিক্রেতা নারী, তার আরও টাকা চাই,,তাই তিনি সাজেদা বেগমের খোঁজ করতে এসেছেন।কিন্তু ডাক্তার আঙ্কেল তা হতে দেননি।আর সেদিন আমি সেই নারীকে দেখতে পেলাম। যার গর্ভে আমি ছিলাম।এভাবেই জানা আমার সবকিছু।

তাহলে রাফিনের বিষয়টা কিভাবে জানলি?

—সে বার আমি মা,আর রাফিন প্রথম নানু বাড়িতে যাই।আমি যখন মাকে এসে একবার বললাম মা আমার এক বন্ধুকে আমি নানু বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই।তখন মা একবার ও কিছু না ভেবেই হ্যাঁ বলে দিলেন।যদিও এই বিষয় গুলো তখন আমি খুব একটা বুঝতামনা। তারপর ও আমি চেষ্টা করতাম। এরপর নানু বাড়িতে যাওয়ার পর সবাই রাফিনকে কত স্বাভাবিকভাবে নিলো মনে হলো এর আগে খুব ভালোভাবে চিনে তারা রাফিনকে।তারপর ঢাকা ফেরার দুদিন আগে আমি মা আর নানু মনির কথোপকথন শুনে ফেলি।তখন রাফিনের বিষয় পুরোটা জানতে পারি।

আরিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।বলে,তুই কিভাবে নিজেকে সামলে নিয়েছিস এসব শুনে আমি ভাবতেই পারছি না। কারণ এমন বয়সে এতো বুদ্ধি আর বিশ্লেষণ কেউ করতে পারে!আর এতো ধৈর্য কেউ ধরতে পারে!বলতেই হয় তোর ভেতর ইশ্বর প্রদত্ত কিছু আছে যার জন্য তুই সবচেয়ে আলাদা। অহিন নরম স্বরে বলে,হুম আমাদের সবার মাঝে সবকিছুই তো আল্লাহ প্রদত্ত কোনটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না।

তবে অহিন, আমি হলে হয়তো তখন আমার মাকে জিজ্ঞেস করতাম।রাফিনকে হিংসা করতাম।আমার মায়ের পাশে ঘেষতে দিতাম না।কিন্তু তুই নিজেকে এতোটা শক্তিশালি কিভাবে বানালি?আর তোর বুদ্ধির ধার অনেক!

অহিন নরম স্বরে হাসার চেষ্টা করে বলে,এই বুদ্ধিটাই আর শক্তিশালী হওয়াটাই তো আমার কাল হলো।নয়তো আমার এতো কষ্ট হতো না। সব বলে হালকা হয়ে যেতাম। তবে যেমন আছি তেমনই ভালো। কাউকে অন্তত কষ্ট দিতে হয় না।সবাইকে ভালবেসে যেতে চাই।

তুই সবচেয়ে আলাদা অহিন।তোর কষ্টের ভার হয়তো কমাতে পারবো না।কিন্তু আমি চাই তোর কষ্ট গুলো যাতে আমি আমার মাঝে ধারণ করতে পারি।তোর কষ্টের ভাগিদার হতে পারি। তোর গল্পের একটা চরিত্র হতে পারি।
অহিন বলে,তুই তো আমার গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন চরিত্র গুলোর মাঝে একটি।তোকে ছাড়া তো আমার গল্পটাই মিথ্যে হয়ে যাবে আরু।

রাফিন যদি জেনে যায় এই সত্যের কথা?
জানবে না,আমি চাইও না জানুক।আমি চাই না আরু রাফিনের আমার মত কষ্ট হোক।গভীর রাতে এক তীব্র আর্তনাদে ঘুম ভেঙে যাক,আর সেই ভয়ংকর রাত সে একা একা কাউকে কিছু বলতে না পেরে যন্ত্রণায় কাটাক।জীবনের এই বিষন্নতা না বা দেখলো রাফিন।রাফিন এখন এই আঘাত নিতে পারবে না আরু।আর আমি চাই ও না রাফিন কষ্ট পাক।আমাদের জীবনের এতো গুলো সময় তো ঠিক চলে গেলো এসব না জেনে রাফিনের।তাহলে এখন শুধু শুধু যন্ত্রণা বাড়িয়ে কি লাভ!রাফিন যদি জানত্র পারে সে একেবারে ভেঙে পড়বে আরু।যখন কেউ তার জন্মের ২৭বছর পর এসে জানতে পারবে তার জন্মটাই অস্বাভাবিক, তার পরিচয়টা অস্তিত্বহীন, তখন তার জীবনের প্রতি ঘৃনা চলে আসবে।আর এই ঘৃনা আর হতাশা থেকে ডিপ্রেশন চলে আসবে।এতে করে দিনদিন এক ভয়ংকর জীবনে দিকে চলে যাবে সে।আর আমি তা কখনও চাই না।সবাই মানুষ তাই যখন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে কথা উঠে যায় তখন মানুষ সত্যি অসহায় হয়ে যায়।

অহিনের কথাগুলো শুনে আরিশা এটা বুঝতে পারছে অহিনের জীবনটা কতটা দুর্বিষহ হয়ে কেটেছে।কতটা যন্ত্রনা আর দগ্ধ হয়েছে সে।আর এটাও বুঝতে পারছে অহিন ছেলেটি তার ভাই _বন্ধু রাফিনকে কতটা ভালবাসে!কতটা গুরুত্বপুর্ন রাফিন অহিনের জীবনে। আরিশার মনে হচ্ছে সে অহিনের প্রেমে পড়ে গেছে আবার নতুনভাবে। এমন মানুষকে আসলেই ভাল না বেসে থাকা যায় না।

রাত্রি বা রামিসা তারা কি জানে এই সত্যিটার কথা?
নারে আরু ওরা কিভাবে জানবে।ওরা জানে না।

অহিন তাড়া দেখিয়ে বলে আমি অনেক রাত হয়ে গেছে আমি আসি আরু আজকে।কাল আবার আসবো। বলেই ব্যস্ত ভঙিতে চলে যেতে নিলে আরিশা পেছনে থেকে অহিনের হাত ধরে ফেলে।

যাস না অহিন,আজকে থেকে যা এখানে প্লিজ।অনুরোধের সুরে বলে আরিশা।অহিন পেছনে না তাকিয়েই বলে এভাবে বলিস না আরু আমি সইতে পারি না।আমার কিছুটা সময় একা কাটাতে হবে।”আই নিড এ ব্রেক আরু।রিয়েলি নিড”!
এবার আরিশা পেছনে থেকে অহিনের দুহাতের ফাঁকে নিজের দু’হাত ঢুকিয়ে জড়িয়ে ধরে অহিনকে।
এই এতো গুলো বছর তো এই কষ্টটা নিনে নিজেই সামলে নিয়েছিস।আজকে আমাকে একটু সুযোগ দিবি অহিন?

যা আমার তা শুধু আমার আরু,আমি আমার সুখের শতভাগ তোকে দিতে পারি।কিন্তু আমার কষ্টের এক কনা ও তোকে দিবো না।এ আমার ধাতে নেই আরু।আরিশা অহিনেত কথায় অবাক হয় না,কারণ এই ছেলেটা তো এমনই অসম্ভব একটা ছেলে!

আমি একা থাকতে পারি না অহিন।আমার ভয় করে।প্লিজ আমার জন্য থেকে যা।

এ কি করে হয় আরু,রাফিন শুনলে কষ্ট পাবে।
না পাবে না।কারণ আমি এতোদিন তোর সাথে একই ঘরে একই বিছানায় ছিলাম বলে যেহেতু রাফিনের কষ্ট হয়নি আজও হবে না।
আজকের রাতটা আলাদা আরু,আজ তোর আর আমার মাঝে কোন দেয়াল নেই।তাই ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

ভুল হলেই বা,আমি তোর বিয়ে করা বউ।একটু ভুল তো করতেই পারিস।আমি চাইছি তুও ভুল কর।
উহু আমি চাই না।

ঠিক আছে ভুল করতে হবে না,তারপর ও থেকে যা অহিন।
আচ্ছা থাকবো। আরিশা খুশীতে অহিনের পিঠের সাথে আরও লেপ্টে যায়।

আরিশা খাবার বেড়ে আনে।তবে একটা প্লেটে।অহিন বলে কিরে তুই খাবি না?

খাবো তো। এই এক থালায় দুজনে খাবো।
অহিন আরিশার দিকে কিছুক্ষণ পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকে।আরিশা সেই তাকানোতে কিছু একটা পায়।
অহিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,এমন পাগলামো করিস না আরু।আমি যে সইতে পারি না।

আরিশা মিষ্টি করে হেসে বলে,সইতে বলছে কে!কিছু বলবি না তুই।আমরা একসাথে খাবো।আরিশা অহিনের মুখে পরম যত্নে খাবার তুলে দেয়।অহিনের চোখে অশ্রু! তবে সেটা কি সুখের না দুঃখের বোঝা গেলো না।আমাদের জীবনে কিছু সুখ ঠিকই আসে তবে তা অসময়ে আসে,বড্ড দেরি করে ফেলে সে সুখ।অবেলায় এসে কি লাভ!অহিনের জীবন হয়তো তেমনই অবেলায় এসে ধরা দিলো তার জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত সে সুখ!কিন্তু এই সুখ কি সইবে তার মত অভাগার কপালে!

আরিশা বলে,বা রে তুই একা একা খাচ্ছিস আমার বুঝি ক্ষিধে পায় না?আমাকে খাইয়ে দিচ্ছিস না কেনো?
অহিন চুপচাপ আরিশার মুখে খাবার তুলে দেয়।দুজনের মুখে কোন কথা নেই তারপর ও মনে হচ্ছে কত শত কথা যেনো তারা বলে ফেলছে। সব যেনো দুজনে বুঝে যাচ্ছে।এতোটা গভীর তাদের চোখের ভাষা!

অহিন এবার তুই আমাদের বিষয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয়। সিহাবকে কল দিয়ে বল, যাতে ডিভোর্সটা বাদ দিয়ে দেয়।অহিন আরিশাকে বলে,না এটা সম্ভব নয় আরু।তুই এটা করতে পারিস না।রাফিনকে আমরা কষ্ট দিতে পারি না।রাফিন আমাদের এতো ভালো বন্ধু তাই তাকে আমরা ঠকাতে পারি না।রাফিন যদি জানে তুই আমাকে ভালবেসে ফেলেছিস কতটা কষ্ট পাবে ভেবে দেখেছিস।আমি কোনদিন আমার বন্ধুকে কষ্ট দিতে পারি না।

আরু আমি তোর কাছে একটা জিনিস চাই দিবি তুই আমায়?
——না অহিন, আমি জানি তুও কি চাস।তাই আমি তোকে তা দিতে পারবো না অহিন।আমি তোর মত মহান বই অহিন।তুই আমাকে কোন পরীক্ষায় ফেলিস না অহিন, দোহাই তোর।আমি এতোদিনে নিজের মনের কথা বুঝতে পেরেছি,তাই তুই আমাকে দূরে ঠেলে দিছ না।আমি পারবোনা তা দিতে তোকে।আরিশা অনুনয়ের সাথে বলে।আমি তোকে ছাড়তে পারবো না অহিন।তুই এতো বড় পরিক্ষার মাঝে আমাকে ফেলিস না।আর তুই চাইলেও আমি তোকে ছাড়বো না।আমি পারবো না অহিন,পারবো না!আরিশার গলার স্বর ভেজা।চোখে পানি টলমল হয়ে আছে,ঝিলিক দিচ্ছে সে মুক্তার মত অশ্রুদানা গুলো!

—–তুই তো না চাইতেও এর মাঝে ঢুকে গেছিস আরু।তাই তুই না চাইলেও তোকেও এই কথাটা শুনতেই হবে রে আরু।আরু তোকে রাফিনকেই বিয়ে করতে হবে।আমি পারবো না আরু রাফিনকে কষ্ট দিতে।আর তুইও কখনও রাফিনকে এই কঠিন সত্যি গুলো জানতে দিবি না। তোকে আমি দ্বায়িত্ব দিলাম রাফিনকে ভালো রাখার। রাফিনের জীবনের এই সত্যিটা এতোদিন আমি লুকিয়ে রেখেছি।এবার এই দ্বায়িত্ব তোকে দিলাম আরু।তুই প্লিজ আমার কথা রাখ!আমার জীবনে আমি অনেক পেয়েছি আর কিছু চাই না আমি।তুই রাফিনকেই বিয়ে করবি।এটা আমার অনুরোধ।

আরিশা বলে সে পরে দেখে নিবো তুই এদিকে আয়।আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবি আজ তুই।অহিন বলে, না আমরা আগের মতই ঘুমাবো। আরিশা দুষ্টুমির সুরে বলে,আমি তোকে তেমন কিছুই বলছি না।শুধু আমার কোলে ঘুমাতে বলছি।আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিবো।
আরিশা জোর করে অহিনের মাথা নিজের কোলে নিয়ে আসে।খাটের সাথে নিজে হেলান দিয়ে বসে,অহিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।আজ প্রথম অহিনের তার মায়ের কোল ছাড়া অন্যকারো কোলে কয়েক মিনিটের মাঝেই ঘুম নেমে আসে তার চোখে।এ এক অদ্ভুত ঘটনা।
আরিশা সারারাত অহিনকে দেখে কাটায়।তার কষ্ট গুলোর গভীরতা কতটা তা খুজে বেড়ায়।খুব খুব কষ্ট হয় আরিশার এই ছেলেটার জন্য।তার সাথে এটাও মনে আশংকা আনে রাফিন সত্যিটা জানলে কি করবে!সে কি মেনে নিবে অহিন,আরিশার ভালবাসা!সেও তো কষ্ট পাবে!
তবে কোনদিকে যেতে চলেছে এই ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ক?

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here