“তুমি কেন আগে আসোনি?”
৩.
ঘরভর্তি মেহমানের মাঝে সিনথিয়া একেবারেই হাপিয়ে উঠেছে। তারউপর ভারি শাড়ি, গয়না। এসবে আরো বিরক্ত লাগছে। তারপরেও কিছু বলতে পারছে না। মুরব্বিরা সবাই সরে যাওয়ার পর সায়ান এসে বসলো ওর পাশে। সিনথিয়া ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এটা দেখে সায়ান সবার অগোচরেই ওর কোমড় চেপে ধরে। সিনথিয়ার চোখে পানি চলে এসেছে। এরকম কেউ করে? কয়েকবার চেয়েও সায়ানের হাত সরাতে পারেনি। এরমধ্যেই সায়ানের ভাবি, কাজিনরা এসে জড়ো হয়েছে এখানে।
সিনথিয়া মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছে। সবাই সায়ানের সাথে ঠাট্টা মশকরা শুরু করেছে। একজন বললো,
— “তা ভাই কালকের রাত কেমন ইনজয় করলে?”
— “দারুণ। সিনথুর লেলিহান রুপের শিখায় যেমন ঝলসে গেছি। ঠিক সেভাবে পরাজিত করে দিয়েছি ওকে।”
— “বেশি রূপবতী নাকি?”
— “তোমাদের নজরে পরছে না আমার বউয়ের রুপ? সিনথিয়ার রুপ তো ঝলসে যাওয়ার মতো।”
সায়ান একটু অন্যরকম করে শেষ কথাটা বললো।
সবাই হু হা করে হেসে উঠলো। শুধু সিনথিয়া বাদে।
সায়ানের এক ভাবি সিনথিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
— “সিনথিয়া তোমার কেমন লেগেছে?”
সিনথিয়া কিছুই বললো না। ও কি বলবে ভেবে পেলো না। যেমনটা ও সবসময় আশা করে এসেছিলো সেরকম কিছুই হয়নি। বরং সায়ানের ক্ষোভ এবং হিংস্রতার যাতাকলে ওর সমস্ত স্বত্ত্বাই বিলীন হয়ে গেছে। সিনথিয়াকে চুপ দেখে সায়ান আবারও ওর কোমড় চেপে ধরে। পুরোটা শরীর কেঁপে উঠে ওর। কিন্তু এতোগুলো মানুষের সামনে কিছুই বলতে পারলো না৷ মুখে শুধু কোনোরকমে উচ্চারণ করলো,
— “ভা..ভালো।”
— “তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সায়ানের কিন্তু যথেষ্ট দম আছে।”
সিনথিয়া চোখ, মুখ কুচকে ফেলেছে। এদের কথা শুনতে একটুও ভালো লাগছে না। একটা চাপা যন্ত্রণা ওকে জর্জরিত করছে বারংবার। এই ঘরটায়, এই মানুষটার সংস্পর্শে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু ওর হাতে কিছুই নেই। ও সবার হাতের পুতুল মাত্র। যে যেভাবে পারে ওকে সেভাবেই নাচাচ্ছে।
সকালের নাস্তা খেয়ে সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। সিনথিয়া রুমে এসে একটা লম্বা শ্বাস নিলো। চোখ থেকে অনবরত পানি পরছে। চোখ মুছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কোমড়ের কাছ থেকে আঁচল সরিয়ে দেখলো সায়ান যেখানে চেপে ধরেছিলো সেখানে একদম লাল হয়ে আছে। জামদানি শাড়ির জরির খোচায় চামড়া উঠে জ্বলছে। আবার ঢেকে দিলো। এসব তো মাত্র শুরু। আরো কতকিছু সইতে হবে জানা নেই ওর।
একটু শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিলো এমন সময় একটা মেয়ে এসে জানালো ওর শ্বাশুড়ি মা যেতে বলেছে৷ উনার শ্বশুরবাড়ির দিক থেকে লোকেরা এসেছে নতুন বউ দেখতে। সিনথিয়া কোনোরকমে উঠে নিজেকে ঠিকঠাক করে বেরিয়ে গেলো। নিচে নেমেই ওর অন্তর আত্মা কেপে উঠে। এখানে সব পুরুষ। সিনথিয়া তাড়াতাড়ি উপরে চলে এসেছে। রুমে এসে শুধু পায়চারি করছে আর শুধু আল্লাহকে ডাকছে। এদের বদনজর থেকে যেনো ওকে বাচিয়ে দেয়।
একটু পর সায়ান, আরশি এবং আরো কয়েকজন এলো। সিনথিয়া ওদের দেখেই মিইয়ে গেলো। আরশি মুখে মধু ঢেলেই বললো ওকে নিচে এসে সবার সাথে দেখা করে যেতে। সিনথিয়া এদিক সেদিক তাকিয়ে মাথা নিচু করে বললো,
— “মা আমি কখনো পরপুরুষের সামনে যাইনি। তাই আপনি আমাকে ওদের সামনে যেতে বলবেন না প্লিজ।”
— “পর পুরুষ কই? এরা সবাই তোমার দেবর। যাও দেখা করে আসো।”
— “আম্মা রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেবরকে মৃত্যু সমতুল্য বলেছে। যেভাবে আগুন থেকে বেঁচে থাকা হয় নারীকে সেভাবেই দেবর থেকে বেঁচে থাকতে বলেছেন। তাই আমি যাবো না।”
আরশির সাথে যেই দুজন মুরব্বি ছিলো তাদের মধ্যে একজন তেঁতে বলে উঠলো,
— “শুনো মেয়ে তুমি এসেছো পর্যন্ত শুধু বাড়াবাড়ি করছো। ধর্ম শুধু তুমি জানো? আমরা জানি না? নাকি তুমি বুঝাইতে চাও আমরা ধর্মের বাইরে। শুনো দেবর হইলো গিয়া ভাইয়ের মতো। বড় ভাবি হইলো গিয়া মায়ের মতো। তুমি ওগোরে মায়ের মতো শাসন করবা। আসো আমগো লগে নিচে।”
সিনথিয়া শক্ত হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো। এটা দেখে একজন মুরব্বি সায়ানকে বললো,
— “কি মাইয়া বিয়া কইরা আনলি সায়ান? ওয় তো তোর মার সম্মানও দেখতাছে না। এমুন ঘাউরা মাইয়া আমি আগে কুনুসোম দেহি নাই।”
অপর মুরব্বি বললো,
— “আমাগো মিন্টুর বউ কত্ত ভালা। যা কই সব হুনে। দেবরগোরে নিজের হাতে খাওয়াইয়া দেয়, কাপড়-চোপড় দুইয়া দেয়, গোসুলের পানি আগাইয়া দেয়, মাথা টিপা দেয়। আর এই মাইয়া তো দেহি সামনে যাইতেই এতো তালবাহানা করতাছে। আরশি তোর পুতের বউ তো তোরেই দিয়াই সব কাম করাইবো লাগতাছে।”
সিনথিয়া খুব অসহায় বোধ করলো। আড়চোখে সায়ানের দিকে তাকালো। সায়ান মুচকি মুচকি হাসছে। সিনথিয়ার মনটা কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। এতোটা বিপন্নবোধ এর আগে কখনো হয়নি। সিনথিয়ার মনে হলো সায়ান শুধু ওকে ভোগ করতেই এনেছে। আর আরশি ওকে অপদস্থ করতে এনেছে। তবে যে যত যাই বলুক সিনথিয়া ওর কথায় অনড়। যাবেই না সে ওদের সামনে।
মুরব্বিরা বেরিয়ে গেলো। এখন আরশি আর সায়ান আছে। আরশি কিছু বলবে তার আগেই একটা মেয়ে এসে জানালো সিনথিয়ার বাবার বাড়ির মানুষজন এসেছে। আরশিও বেরিয়ে গেলো। সিনথিয়া বেডে গিয়ে বসলো। বউ দেখার চক্করে না জানি আরো কত অপদস্ত হতে হয় ওকে। সায়ান ওর পাশে বসতেই সিনথিয়া শক্ত হয়ে গেলো। সায়ান ধাক্কা দিয়ে বললো,
— “এমন শক্ত হয়ে গেলে কেনো?”
সিনথিয়া ঢুকরে কেঁদে উঠে। সায়ান ওকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
— “কাঁদছো কেনো?”
— “আপনি তো এখন আমার স্বামী। আমাকে একটু সাপোর্ট কেনো করেন না? কেনো তখন কিছু বললেন না?”
— “ওহহো সিনথু কেঁদো না প্লিজ। আমি কিভাবে বড়দের উপর কথা বলি বলো তো?”
— “তাই বলে চুপ করে থাকবেন? আপনার সামনে আপনার স্ত্রীকে অপদস্ত করছিলো আর আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা দেখবেন? ওহ আমি তো ভুলে গেছিলাম, আপনি তো মেইড এনেছেন আপনার মায়ের জন্য। আর নিজের জন্য বিছানার সঙ্গী।”
— “সিনথু তুমি অযথাই রাগ করছো।”
সিনথিয়া সায়ানকে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো। সায়ান নেশাময় কণ্ঠে বললো,
— “সরিয়ে দিলে কেনো?”
— “ভালো লাগছে না এখন।”
দরজায় টোকা পরতেই সায়ান উঠে গেলো দরজা খুলতে। সিনথিয়া ভয় পাচ্ছে। যদি কোনো পুরুষ মানুষ হয় তাহলে এখন কোথায় পালাবে ও? দরজা খুলে নিজের মাকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলো। সায়ান সিনথিয়ার মাকে সালাম দিয়ে কেমন আছে না আছে জিজ্ঞেস করতে লাগলো। এতো হেসে হেসে কথা বলছে মনে হচ্ছে সিনথিয়ার কত কেয়ার করে। সায়ান বাইরে গেলো। সিনথিয়া ওর মাকে সালাম দিলো কিন্তু আসমা সালাম না নিয়ে মুখ শক্ত করে রাখলো। সিনথিয়া মায়ের দিকে এগিয়ে আসতেই আসমা ওর বাহু চেপে ধরে রুঢ় কণ্ঠে বললো,
— “মাত্রই কাল বিয়ে হয়েছে আর আজকেই অভিযোগ আসতে শুরু করে তোর শ্বশুড়বাড়ি থেকে। কোথাও গিয়ে কি একটুও শান্তি মতো থাকতে পারিস না? সব জায়গায় তোর এসব গোড়ামি আচরণ কেন করিস বল তো?”
— “মা কিসব বলছো? কিসের গোড়ামি করছি?”
— “গোড়ামি করিস নি? আরশি তোকে ওর ননদ-ননাসের ছেলেদের সাথে দেখা করতে বলেছিলো তুই করিস নি কেনো? উলটো মুখের উপর কথা বলিস। তর্ক করিস।”
— “মা আমার কথাট….”
— “এই তোর কি কথা শুনবো…হুম? তুই নিজেকে কি মনে করিস? অনেক রূপবতী কেউ? শুন তোর কোনো যোগ্যতাই ছিলো না সায়ানের বউ হওয়ার। ওরা দয়া না করলে কোনো ভিখারির ঘাটে গিয়ে পরতি।”
— “আমি যেহেতু এতোই অযোগ্য ছিলাম তাহলে তারা যোগ্য কাউকে ছেলের বউ কেন করলো না? কেনো পিছনে পরে ছিলো আমার? আমিতো বলিনি আমাকে বউ করতে। নিজেরাই যেচে পরে এসেছে।”
আসমা সিনথিয়াকে থাপ্পড় মারার জন্য হাত উঠাতেই ওর বড় ভাবি এবং ছোট ভাবি এসে ধরে ফেললো। রিহা বললো,
— “মা শান্ত হোন। এখানে এখন এসব ড্রামা না করলেই ভালো হয়।”
— “আমি ড্রামা করছি? নাকি এই মেয়ে ড্রামা করছে। ইচ্ছে তো করছে থাপড়ে সব দাঁত ফেলে দেই। ইতরের বাচ্চাকে এখানেই পুতে ফেলতে মন চাচ্ছে।”
সিনথিয়া নিরবে চোখের পানি ফেলছে। রিহা এগিয়ে এসে বললো,
— “তুমিও পারো বটে সিনথিয়া। এসব কেনো করছো বলো তো? কি সুখ পাচ্ছো? আরে এখন এসব চলে না তুমি বুঝতে পারছো না। যুগ পরিবর্তন হয়েছে। এখনো সেই আগের যুগের লেবাস ধরে রাখলে চলে নাকি? একটু তো পরিবর্তন হও।”
মিম বললো,
— “উফ! আমিতো বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছি। এই সিনথিয়া তুমি কোনো অপ্সরী নও যে ছেলেরা তোমাকে দেখলেই ফিট খাবে। হয়েছো তো ময়লা রঙের তাতেই এতো দেমাগ। একটু যদি সাদা চামড়া পেতে তাহলে না জানি কি করতে। নিজেকে তো হুরপরি মনে করতে।”
— “ভাবি এটা আল্লাহর ফরয বিধান। এটাকে অমান্য করার দুঃসাহস আমার নেই। আল্লাহর আইন মানতে গিয়ে যদি আমি ব্যকডেটেড হই তাহলে আমি তাই। আমি কারো জন্য নিজেকে পরিবর্তন করতে পারবো না।”
আসমা রেগে গেলো ভিষণ। রেগে তেড়ে এসে সিনথিয়ার চুল মুঠ করে ধরে বললো,
— “ম*** তোরে আজকে আমি মেরেই ফেলবো। আমাকে আইন শিখাস তুই? খা** তোর মা*******। আজকে তোকে আমি আইন শিখাবো নতুন করে। পর্দা মারাস তুই আমার লগে..মা**।”
মিম এবং রিহা দুইজনেই টেনে আসমা সরিয়ে আনলো সিনথিয়ার কাছ থেকে। সিনথিয়া অসাড় হয়ে পরে রইলো বিছানার এক কোণে। আসমা হাপাতে লাগলো। রিহা, মিম দুজনেই নানান কথা শুনাতে লাগলো ওকে। সিনথিয়া বুঝতে পারছে না আসতে না আসতেই ওর শ্বাশুড়ি কি এমন বললো যার কারণে ওর মা রেগে বোম হয়ে গেছে। আসমা আবার এগিয়ে এলো সিনথিয়ার দিকে। ওর আঁচল ধরে জোরে টান দিয়ে সরিয়ে ফেললো। সিনথিয়া আঁচল চেপে ধরে বললো,
— “মা কি করছো? শাড়ি খুলছো কেনো?”
— “তোরে আজকে আমি দেখে নেবো। কি এমন রুপের বাহার হয়েছে তোর যার কারণে নিজেকে হুরপরি ভাবিস।”
— “মা প্লিজ ছাড়ো আমার কাপড়। প্লিজ এমন করো না। তুমি বসো এখানে। মাথা ঠান্ডা করো।”
আসমা শুনলো না। টেনে হিচড়ে শাড়ি খুলে ফেললো। সিনথিয়া দুইহাতে আড়াআড়ি ভাবে নিজের উপর দিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। আসমা দুই ছেলের বউকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— “ওর আলমারি থেকে স্লিভলেস গাউনটা নাও। আর এটা ওকে পরিয়ে সাজিয়ে দাও।”
— “মা!!!!! প্লিজ এভাবে আমাকে অপদস্ত করো না সবার সামনে। নিচে অনেক পুরুষ আছে।”
আসমা এবার ঠাটিয়ে চড় দিলো সিনথিয়ার গালে। ধপ করেই বিছানার কোণ থেকে মেঝেতে পরে গেছে। মিম এবং রিহা মুচকি হেসে গাউন বের করলো। সিনথিয়ার সাথে এটা প্রথম নয়। এর আগেও আসমা এমন করেছে। আর এই সুযোগে দুই জা মজা নিয়েছে।
সিনথিয়াকে গাউনটা জোর করে পরিয়ে দিলো ওর মা। হালকা সাজগোছ করিয়ে নিচে নিয়ে গেলো। সিনথিয়ার পা দুটো চলছিলো না। একেবারেই গুড়িয়ে গেছে। এদের জোরের সাথে একেবারেই পেরে উঠছে না। সিনথিয়া চোখ বন্ধ করে বারবার শুধু আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। নিচে এসে দাড়াতেই অবাক হলো আসমা। বাসা খালি। মানুষজন তেমন নেই। শুধু ওরা দুই ফ্যামিলির মানুষ আর সায়ানের দুই একজন কাজিন আর ভাবি। সিনথিয়া বড়সড় একটা নিঃশ্বাস নিলো। মনে মনে শুকরিয়া জানালো রবের দরবারে ওকে আজ অপদস্ত হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয়ার জন্য। অপদস্ত হওয়া থেকে তো বেঁচে গেছে কিন্তু সবার এক একটা খোচাপূর্ণ কথার আঘাত থেকে বাঁচতে পারলো না। আরশি কেঁদে কেঁদে ভাইকে বলছে,
— “ভাই আমি আমার শ্বশুড়বাড়িতে কিভাবে মুখ দেখাবো বলো? ওরা সবাই আমার একমাত্র ছেলের বউকে দেখতে এসেছে আর ছেলের বউ কিনা দেমাগের কারণে কারো সামনেই আসলো না। ওরা আমার সম্পর্কে কি ভাববে বলো? ওখানে গিয়ে যদি বলে আমার ছেলেরবউ আমার কথা শুনে না তখন তো সবাই আমাকে নিয়ে টিটকারি করবে।”
— “তুই চিন্তা করিস না আমি সিনথুকে বুঝাবো।”
— “বুঝিয়ে আর কি লাভ বলো৷ যা সম্মান যাওয়ার তা তো চলেই গেছে। ওকে এখন বুঝালে কি আমার হারানো সম্মান ফিরে পাবো?”
সিনথিয়া এসব শুনে যেনো আকাশ থেকে পরলো। মানে বুঝতে পারছে না আসলে এদের মেন্টালিটি এতোটা ডাউন কেনো। পর পুরুষদের সামনে সেজেগুজে নিজেকে প্রদর্শন করা সম্মানীয় আর নিজেকে পর্দার আড়ালে রাখলে অসম্মানীয় কাজ? এমন উল্টোনীতি কেনো এখানে সিনথিয়া বুঝতে পারলো না। ওর বাবার কথা শুনে মনে হলো হৃদপিন্ডটা যেনো কেউ কামড়ে ধরেছে। সিনথিয়ার বাবা বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
— “আচ্ছা আমার বনু আর কাদিস না। তুই এক কাজ কর ওদের সবাইকে আবার ডেকে নিয়ে আয়। আর দেখ ওইদিকে, সিনথিয়া একেবারে প্রিপেয়ার্ড হয়ে এসেছে।”
আরশি একবার সিনথিয়ার দিকে তাকালো। ওর মলিন মুখটা দেখে ওর ভেতরে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেলো। তবুও রেগে বললো,
— “এখন এসে কি হবে? এখন আবার ওদের আসতে বললে তোমার গুণধর মেয়ে না জানি আরো কত কান্ড রটিয়ে বসে। কোনো দরকার নেই ওদের আসার। তখন আমি এতো অনুরোধ করে ডাকার পরেও এলো না। এখন সেজেগুজে ঢং করতে এসেছে এখানে। ওকে বলো আবার গিয়ে ওই গর্তে ঢুকতে।”
আরশ সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে রাগি স্বরে বললো,
— “তোকে এখনো আমি থাপ্পড় মারিনি যে এই অনেক। জলদি আরশির কাছে ক্ষমা চা। অনেক প্রশংসনীয় কাজ করেছিস আজকে। মান-সম্মান একেবারে ডুবিয়ে দিয়েছিস। অলক্ষুণে কোথাকার। আমার পরিবারে কিভাবে যে তোর মতো একটা গোয়ার জন্ম নিলো ভাবতেই পারছি না। জন্মের পর যদি জানতাম তোর জন্য আমার বোনের অসম্মান হবে তাহলে তখনই গলা টিপে মেরে ফেলতাম।”
সিনথিয়া কিছুটা অভিমান নিয়েই বললো,
— “তাহলে এখনই মেরে ফেলো। বেঁচে যাই তোমাদের জ্বালা থেকে।”
তারপরই গালটা জ্বলে উঠলো ওর। মাথাটা ভো ভো করে উঠেছে। ঢলে পরতেই ওর পাশে সায়ানের যেই ভাবি ছিলো সে ধরে ফেললো। সিনথিয়া ঠোঁট কামড়ে কান্নার শব্দ আটকে ফেলে। সিনথিয়াকে সোজা করে দাড় করিয়ে অতশি বললো,
— “চাচিমনি থাক না এখন এসব। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। তাছাড়া ওরা সবাই ব্যাপারটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো। তাইতো তাড়াতাড়ি চলে গেছে। আজকে সিনথিয়ার এই বাড়িতে প্রথম দিন। কোথায় একটু আনন্দ করবে তা না এখন মার খাচ্ছে।”
সিনথিয়া অবাক হয়ে তাকালো অতশির দিকে। অতশি ওকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ওখানে উপস্থিত একজন মুরব্বি বললো,
— “হয় তুমি জানো তো ওরা বুইঝা চইলা গেছে। আরে মাইয়ার এমন দেমাগ দেইখা চইলা গেছে। আরো হাসাহাসি কইরা গেছে আরশির উপরে।”
— “না দাদি আপনি ভুল বলছেন। ওরা হাসাহাসি করেছে কারণ আমার দেবর আকাশ যখন শুনলো সায়ানের বউ পর্দা করে কারো সামনে আসে না তখন ও বললো ও বিয়ে করলে সিনথিয়ার মতো কাউকে বিয়ে করবে৷ তাই সবাই হাসছিলো। ওরা সবাই যথেষ্ট সম্মানের নজরে দেখেছে ব্যাপারটা।”
— “মিথ্যা কইয়া লাভ নাই কুনু।”
— “আপনি বিশ্বাস না করলে আমি আকাশকে এখনই ফোন দিতে পারি। ওর মুখ থেকে শুনে নিন।”
কথাটা বলেই অতশি মোবাইল বের করলো তার দেবরকে ফোন করার জন্য। আরশি আড়চোখে ওর ফুফু শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো। সে অতশিকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— “হইছে থামো। এহন এসব প্রমাণ করতে হইবো না। যাও ছেমরিরে ঘরে নিয়া যাও।”
— “হ্যাঁ নিয়ে যাচ্ছি। তবে আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না আপনারা সবাই সামান্য একটা ব্যাপার এতো ঘোলাটে কেন করলেন। সিনথিয়া আসতে চাইছে না সেটা সম্পূর্ণই ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনারা কেউ ওর ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যেবোধে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। ও এখন এই বাড়ির বউ হয়েছে। সেখানে এসেও ওর ফ্যামিলি মেম্বার ওকে মারধর করছে আর সায়ান কিছুই বললো না। ব্যাপারটা সত্যিই স্ট্রেঞ্জ। আমার কিন্তু এটা ব্যক্তিগত আক্রমণ মনে হচ্ছে। যাইহোক আপনাদের ব্যাপার।”
অতশি সিনথিয়াকে রুমে নিয়ে এলো। সিনথিয়া বিছানায় বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। অতশি ওকে বললো,
— “এতো অবাক হয়েছো কেনো?”
— “আসলে আপনি আমাকে সাপোর্ট করেছেন কেনো?”
— “করবো নাই বা কেনো? ওরা তোমার উপর অযথাই জুলুম করছিলো। আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি সায়ানের সাইলেন্ট বিহেভিয়ার দেখে। এতগুলো মানুষের সামনে সবাই মিলে তার স্ত্রীকে অপমান করছে আর সে চুপচাপ মজা নিচ্ছে। অদ্ভুত!”
সিনথিয়া মলিন হাসলো। কিন্তু কিছুই বললো না। অতশির বেশ খারাপ লাগলো বিষয়টা। কিন্তু ওই-ই বা কি করতে পারবে। অন্যের সংসারে কথা বলার অধিকার তো ওর নেই। সিনথিয়া অতশির হাত চেপে ধরে বললো,
— “জাযাকাল্লাহ খাইরুম আপু।”
অতশি হাসলো। সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
— “তখন এতো অবাক হয়েছিলে কেনো?”
— “কারণ এই প্রথম কেউ আমাকে সাপোর্ট করেছিলো। আমার পক্ষে কথা বলেছিলো। আমাকে নির্দোষ প্রমাণিত করতে সবার সামনে প্রমাণ উপস্থাপন করতে চেয়েছিলো তাই। এটা আমার জন্য সত্যিই খুব আনন্দের ছিলো এবং বিষ্ময়ের। মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির মতো।”
অতশি কিছু বললো না। একটু হাসলো। সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা শ্যামলা হলেও চেহারায় অদ্ভুত মায়া আছে। কতটা ইনোসেন্ট লাগে। এমন মেয়েকে তো এমনিতেই আগলে রাখতে ইচ্ছে করে। সায়ান একটা খাটি হিরা পেয়েছে। কিন্তু আগলে রাখতে পারবে কিনা আল্লাহ মালুম। অতশি বেরিয়ে আসতে গিয়ে আবার দাড়ালো। পেছনে ফিরে আবার সিনথিয়ার দিকে তাকালো। বামগালে এখনো আঙুলের দাগ বসে গেছে। ওকে যতই দেখছে ততই যেনো অনুপ্রেরণা কাজ করছে মনে। দ্বীনের পথে থাকার জন্য কতই না যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ অতশি! ওর সব সুযোগ থাকা স্বত্তেও গাফেল। অতশি কিছু ভেবে মুচকি হাসলো। তারপর আবার হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো। ইশ! যদি সায়ানের আগে অতশির সিনথিয়ার সাথে দেখা হতো তাহলে কতই না ভালো হতো। সিনথিয়াকে এখানে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হতে হতো না। আর ওর ভাইটাও….। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।
.
সিনথিয়া শুয়ে আছে। গায়ে এখনো গাউনিটা আছে। এতোকিছুর পর আর শক্তি পেলো না কাপড় বদলানোর। তাই ওভাবেই শুয়ে পরেছে। সায়ান রুমে ঢুকে আস্তে করে দরজা আটকে দিলো। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিনথিয়াকে দেখলো। এই গাউনটা পরে যখন নিচে গেছিলো তখন থেকেই নেশাময় চোখে শুধু সিনথিয়াকে দেখেছে। সায়ান ঠোঁট কামড়ে হাসে। এগিয়ে আসে সিনথিয়ার দিকে।
সিনথিয়াকে ওভাবেই বিছানার সাথে দুইবাহু চেপে ধরে। আচমকা এমন হওয়ায় সিনথিয়া খুব ভয় পেলো। সায়ানকে দেখে আরো ভয় পায়। ওর চাহনি স্বাভাবিক লাগছে না। নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে থেমে যায়। সায়ান ওর দিকে তাকিয়ে আবার হাসে। আর এই হাসিই ওর কাল হয়ে দাঁড়ায়।
চলবে,,,
® ‘নুরুন নাহার’