#একমুঠো_সুপ্ত_বাসনা
#সুপ্তি_আনাম
|| পর্ব: ০৪ ||
💠💠💠
দীর্ঘক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছে নিলয়। ইয়ানার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণেই চলছে সে। সে ইয়ানা কে কল করেছে তার সাথে দেখা করবে বলে। এই নিয়ে এক ঘন্টা হলো বলে তাও মেয়েটার খোঁজ নেই। নিলয় ফোন ট্রাই ও করেনি কারণ সে জানতো মেয়েটা ফোন ধরবে না!
অবশেষে তার কাঙ্ক্ষিত সময় এসে গেলো ইয়ানা আসছে। পরণে তার হালকা নিল শাড়ি তার আঁচলের দিকে শুভ্র রঙের কাজ করা। ঠোটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক, কানে ঝুমকো আর হাতভর্তি চুড়ি। কপালের টিপটা যেনো মুখে সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে। চুলগুলো স্বাধীনভাবে বাতাসে উড়েই চলছে। কি অমায়িক সুন্দর লাগছে তাকে। এতে আরেক দফা ক্রাশ খায় নিলয়।
ইতস্তত বোধ করে নিলয়ের সামনে আসছে ইয়ানা। এতো সেজেগুজে কখনোই নিলয়ের সামনে আসেনি সে। তবে আজকে এসেছে নিলয়ের কথায়। বিকেলের দিকে নিলয় উত্তেজিত কন্ঠে তাকে বলে শাড়ি পরে আসতে, কেনো? তা অজানা।
কিন্তু ইয়ানার সৌন্দর্য ভরপুর মুখশ্রীতেও রাগ স্পষ্টরূপে বিদ্যমান। সে গটগট করে নিলয়ের সামনে যেয়েই ঠাটিয়ে চড় লাগায় নিলয় কে। নিলয়ের দৃষ্টি স্বাভাবিক। কারণ সে জানে অপপাত মেয়েটার মধ্য দিয়ে কেমন ঝড় বয়ে চলছে। সে বাকরুদ্ধভাবে ইয়ানার রাগি মুখশ্রীর দিকে চেয়ে। কে জানি বলেছিল, ‘মেয়েদের রাগান্বিত চেহারার সৌন্দর্যই আলাদা’ আজ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে!
চড় মেরেই রেগে নিলয়ের শার্টের কলার চেপে ধরে ইয়ানা। গজগজ করতে করতে বলে,
—‘কেন এতো কষ্ট দিস আমাকে? তোর কি অসহ্য লাগে না আমাকে কষ্ট দেওয়া? সেদিন কেনো আমাকে সেই ধান্দাবাজ ডাক্তারটার কাছে নিয়ে গিলি? তুই কিস্ করলেই কিন্তু হেড ডেকটা সেরে যেতো!’
নিলয় নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে। চোখে পানি চলে আসে তার। এটাই হয়তো মধ্যবিত্ত! ইয়ানাকে চোখের পানি দেখতে না দিয়ে, অন্যদিকে তাকিয়ে নরম সুরে বলে,
—‘আমার উদ্দেশ্য সেটা ছিলো না ইয়ানা। আমি জানতাম না এরকম কিছু হবে।’
নিলয়ের কথায় রাগটা কর্পূরের ন্যায় উড়ে যায় ইয়ানার। ফট করে নিলয়কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে সে।
—‘তুমি ডা.আনাজকে বিয়ে করে নাও ইয়ানা। এটাই বেস্ট হবে। আমার সাথে পালাতে চেওনা। আমি তোমাকে পালিয়ে নিয়ে কই তুলবো বলো? আমার বাবা নেই। শুধু মা আর একটা ছোট বোন আছে। ছোট বোনটা পড়ালেখা করে ওর বেতন দিতে হয়। মা হর্টের পেশেন্ট রোজ ওষুধ লাগে। আমরা একটা রুমে কোনো রকম থাকি। তোমাকে বিয়ে করে তুলবো কই? কি খাওয়াবো? আমাদের প্রাইভেসি দেওয়াও আদৌ সম্ভব নয়। তুৃমি বরং আনাজ কে বিয়ে করো? তার মাঝেই আমাকে খুঁজে নাও? দেখো আনাজ কিন্তু খুব ভালো ডাক্তার হি ইজ অ্যা বিগ উইগ অব ঢাকা। আর আমি?
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে নিলয়। আবারো মুখে মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে রেখে নরম কন্ঠে বলে,
—‘আমি একটা গ্রাজুয়েটেড বেকার!’
তার কথায় চাপা কষ্টগুলো উপচে পড়ছে। ইয়ানা আবেগে কেঁদে দেয়। সে এখনো নিলয়কে জড়িয়ে ধরা। নিলয় তিলে তিলে কষ্ট পাচ্ছে।
—‘তুমি তো গ্রাজুয়েটেড তাই না? তাও তোমার চাকরি হচ্ছে না? ‘
—‘সব কিছু বললেই হয় না ইয়ানা। দুনিয়াটা বড্ড স্বার্থপর! এখানে ঘুষ নামক একটা ব্যাপার আছে। যার জন্য আমি আজ জবলেস। আর টিউশানি? এটা করিয়ে কি একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের সব চাওয়া পাওয়া পূরণ হয়? ‘ (নিলয়)
—‘আমি শিওর, তুমি একটা খুব ভালো চাকরি পাবে দেখোও।
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে নিলয়।
—‘ইফ গড ওয়ান্টস’ (নিলয়)
আবার রাগটা ফুসে উঠে ইয়ানার।
— ‘তুমি তো অনেক কিছুই বুঝো কিন্তু এটা কেনো বুঝনা যে বাই এনি মিনস্ আমি তোমাকে চাই, আমার নাছোড়বান্দা মনটা যে তোমাতেই আবদ্ধ⁉’
—‘তুমি আমাকে খুশি রাখতে চাও? ওকে দ্যান। আমার খুশি কিসে জানো? তোমার সুখে এন্ড দেখো ডা.আনাজের সাথে বিয়ে হলে তুমি খুব সুখে থাকবে, পারবে না আমার খুশির জন্য এটা করতে?’
শব্দ করে কেঁদে দিলো ইয়ানা। বুকের গহীনে অজস্র কষ্ট জমে আছে তার, প্রিয় মানুষকে হারাতে দেওয়ার কষ্ট। নিলয়ও তাকে খুব শক্ত করে চেপে ধরে আছে। এটাই হয়তো তার শেষ জড়িয়ে ধরা!
নিজের ভালোবাসাকে অন্যের সাথে শেয়ার করতে পারবে না সে। এটা যে অগ্নি জ্বলা! কিন্তু তাও নিয়তিকে তো আর সে বদলাতে পারবে না। তাই অগত্যাই তা হাসিমুখে বরণ করে নিতে হচ্ছে তাকে!
খানিক বাদেই সময় নিয়ে ফ্রি হয় দুজনে। তারা একে অপরকে প্রতিজ্ঞা করেছে একে অপরের জন্য কষ্ট পাবে না কিছুতেই। ইয়ানা নিজেকে ফ্রি করতে লম্বা শ্বাস নেয়। তারপর নিলয় এর কাছে যায়। নিলয়ের পানে চাইতেই দেখে নিলয় মুখ মলিন করে বসে আছে। নিজেকে সংযত রাখতে ব্যস্ত। ইয়ানা তার কাছে হাসিমুখে যেয়ে বসে। আবদারের সুর করে বলে,
—‘আচ্ছা আমার বিয়েতে কি দিবে?’
—‘তুমি যা চাইবে, শুধু মন বাদে’
নিলয়ের কথা শুনে মুখটা ভার হতে নিলেই তা সামলে নেয় সে। সে চায় না তার তৈরি হওয়া স্মৃতিগুলো নষ্ট করতে, আবার মলিন হেসে বলে,
—‘আমি যদি তোমার মনই নেই, তাহলে ধান্দাবাজটার মন আছে কি করতে? তার চেয়ে বরং বিয়েতে তোমার উপস্থিতি উপহারস্বরূপ চাচ্ছি। দিতে পারবে না এই দামি গিফ্টটা বলো? ‘
বলতে বলতে চোখের কোনে অশ্রুবিন্দু জমা হয় তার। তা অন্যদিকে তাকিয়ে মুছে নেয় সে।
—‘অবশ্যই’
বলে হেসে দেয় নিলয়। ইয়ান খুব ভালো করেই বুঝতে পারে তা মিথ্যে হাসি ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু তাকেও অগত্যা নিলয়ের সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে হলো।
—‘তখন তো খুব হিরোর মতো আদেশ করলা শাড়ি পড়ে এসো, এখন আমি আদেশ করছি তুৃমি বিয়েতে সাদা পাঞ্জাবি পড়ে এসো, আর চুল গুলোও যেন স্পাইক করা হয়। নাহলে আমি নিজে বউয়ের আসন থেকে উঠে গিয়ে বিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিব। হুহ।’
বলে কিঞ্চিৎ রাগ করে সে।
—‘আচ্ছা মিস. ঘ্যাড়তাড়া, যথা আজ্ঞা। নাহলে আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে অপমান্স করিয়েন কেমন? ‘
—‘এক্স কিউজ মি, আমি কোনো ঘ্যাড়তাড়া না। কথা হচ্ছে তুই একটা বদের হাড্ডি। হে হে হে’
বলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে ইয়ানা।আজ সে নিলয়ের সাথে শেষবারের মতো মজা করে নিচ্ছে।
এক পর্যায়ে নিলয়কে পুনরায় জড়িয়ে ধরে সে। নিলয়কে জড়িয়ে ধরে তার সুশীতল পরশ গুলোর স্মৃতি রচনা করছে।
#একমুঠো_সুপ্ত_বাসনা
#সুপ্তি_আনাম
|| পর্বঃ ০৫ ||
এক উজ্জ্বলময় সন্ধ্যেতে সোহান ম্যানশন উৎসবমুখর। ইয়ানার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান কিছুক্ষণের মাঝেই শুরু হয়ে যাবে। তাদের বড়িটি অতিথি মুখর। সারাবাড়িতে লাল-নীল-কমলা রঙের মরিচবাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলেই চলছে। হলুদ লাগানোর মঞ্চটা খুব সুন্দর করে ফুলেল সৌন্দর্যে ভরপুর। উপরে বড় করে লেখা “ইয়ানার হলুদ সন্ধ্যা”। অতিথি সমাগমে শব্দমুখর চারিপাশ।
ড্রেসিং টেবলের সামনে ম্লান মুখে চেয়ে আছে ইয়ানা। তার দুপাশে থাকা দু’জন হায়ার করা মেয়ে তাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে ব্যস্ত। একজন চুলের ডিজাইনিং করছেন অপরজন মুখের সাজ।
তার পাশেই নেচে বেড়াচ্ছে তার ভাইবোন সুহানা-সেহওয়ার সহ আরো অনেকে।
ইয়ানার বিরক্ত পাচ্ছে, কান্না পাচ্ছে না মোটেও। হাকাউ কান্না করে ভাসানোর কোনো মানে হয় না, সে মনে করে।
দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে ইয়ানার মা।
মেয়েকে দেখে মুখে হাসির রেশ ফুটে উঠে তার। মুখে হাত দিয়ে বলেন,
—‘মাশাল্লাহ মা, একদম হলদে পরি লাগছে তোকে। কিছুক্ষণ পরে হলুদের ছোঁয়ায় আরো রঙিন হয়ে যাবি’
তার কথায় মলিন হাসি দেয় ইয়ানা।
—‘আচ্ছা মা, জলদি রেডি হয়ে নিচে আয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই হলুদের অনুষ্ঠান শুরু করে দিবো। আমরা ওয়েট করছি।’
চলে যান ইয়ানার মা মিসেস. শাহিনা চৌধুরী। ওমনি ইয়ানার কাছে যেয়ে তার ছোট বোন বলে,
–‘শুন আপু তোকে কিছু টিপস্ দেই। সবাই যখন হলুদ মাখিয়ে তারপর খাবার খাইয়ে দিবে তখন আবার ভুলে যাইস না, এটা তোর গায়ে হলুদ। তাই রাক্ষসীর মতো না খেয়ে একটু রয়েসয়ে খাবি কেমন?’
বলে হে হে করে হেসে দেয় সুহানা। ইয়ানার মন এখন সেখানে নেই অন্য পানে তাকিয়ে সে। তার মাথায় কেবল নিলয়ের জন্য রাজ্যের চিন্তা ঘুরপাক করছে। আবার সুহানা বলে,
—‘আর হ্যা, তারপর যখন সবাই টাকা দিবে তখন আবার কাঙালিনীর মতো ছিনিয়ে নিস না, কেমন? কিরে আপু শুনতে পাচ্ছিস না? বাসর রাতে কিভাবে শুরু করবি সেটার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে? তাহলে শুনে রাখ তোর বাসর রাত আজকে নয় হে হে হে ‘
আবারও দাঁত কেলিয়ে হাসতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সুহানা। তবে একটা কথাও কানে নেয়নি ইয়ানা।
—‘তোর কথা গায়ে মাখিনা যা ভাগ, নাহলে মাকে ডেকে তোর সর্বনাশ বয়ে আনব’
ইয়ানার ধমকানিতে নিচে চলে যায় সুহানা। তার আগে ইয়ানাকে বলে,
—‘মা নিচে ডাকছে’
খানিকবাদেই নিচে চলে যায় ইয়ানা। নিচে ঢ়েয়েই তার চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম। লাইক সিরিয়াসলি ? সামান্য গায়ে হলুদেই এতো অতিথি-আয়োজন? যেন কেউই বাদ পড়েনি। ইয়ানার নিচে যাওয়া মাত্রই সবার দৃষ্টি আটকে যায় ইয়ানার দিকে। সবাই অপপাত তার সুসজ্জিত রূপে চোখ বুলাতে ব্যস্ত। তন্মধ্যেই আবার ইয়ানার কাজিন বোন দুটো তাকে দেখে আনুষ্ঠানিক মঞ্চে নিয়ে যায়। সেখানে বসানো হয় ইয়ানাকে। সবাই তার হলদেটে মাখনরঙার ছবি তুলতে ব্যস্ত।
সবার ছবি তোলা দেখে নিজের উপর সেলিব্রিটি ফিল আসে ইয়ানার। সে নির্লজ্জের মতো সব ভুলে যেয়ে বিভিন্ন স্টাইলে পোজ দিতে শুরু করে।
সবাই চরম বিস্ময়ের সাথে ইয়ানাকে দেখতে শুরু করে। যেনো তারা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখছে।
ছবি তোলার সময় ইয়ানার মনে হলো কেউ যেনো তাকে বলছে,
-‘হেই ম্যানারলেস ষ্টুপিড গার্ল, হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? ‘
এটা তো মনে হয় ডা.আনাজের আওয়াজ। চারপাশে ফটাফট চোখ বুলিয়ে নেয় ইয়ানা। ‘নাহ, ধান্দবাজটা কোথাও নেই’ বলেই শান্তির নিঃশ্বাস নেয় ইয়ানা। আরেকবার চারিদিকে পরখ করে নিতেই দেখে, কারো বিষ্ময় এখনো কাটেনি বরং তারা বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে।
তাদের সকলের অবাক চাহনি দেখে একদফা শক্ খায় ইয়ানা। সে কিছু বোঝার চেষ্টা করলেই তার হাত টেনে তাকে নিচে বসিয়ে দেয় সুহানা। সে রাগে গজগজ করতে করতে ফিসফিসিয়ে বলে,
—‘আপু তুই কি পাগল – টাগল হয়ে গেলি নাকি আবার? এভাবে দাড়িয়ে কাকে পাগলের মতো খুঁজছিলি? ‘
সুহানার কথা সাথে সাথে বুঝতে পারে ইয়ানা। তারমানে সে এতোক্ষণ ধান্দাবাজটাকে খুঁজতে বসা থেকে উঠে পড়েছিলো!
.
.
হলুদ শাড়িতে মঞ্চে মসে আছে ইয়ানা। সবাই এসে এসে তাকে হলুদ মাখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সাথে একরাশ দোআও। বাহিরে মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে রাখলেও ভেতরে ভেতরে পাথর হয়ে যাচ্ছে সে। বারবার মনে একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘সত্যিই কি তার ধান্দাবাজটার সাথে বিশে হচ্ছে? নাকি সে স্বপ্ন দেখছে? ‘
পরক্ষণেই তার বড় মার হলুদের ছোঁয়ানিতে বুঝতে পারে এটা বাস্তব ছাড়া কিছুই নয়।
চলবে,
[