একমুঠো সুপ্ত বাসনা পর্ব শেষ

#একমুঠো_সুপ্ত_বাসনা
#সুপ্তি_আনাম
{ পর্বঃ ৪৪ (অন্তিম) }

সময়ের উর্মিমালায় বয়ে যায় কত শত স্মৃতির মালা। কোনো এক সময়ের ঘটনাই রূপান্তরিত হয়ে যায় স্মৃতি নামক ডায়েরিতে। শত শত ভালোবাসার স্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায় মানুষকে। হৃদয়ের মণিকোঠায় ভেসে বেড়ায় ভালোবাসার নিষ্পাপ মুখসমূহ। কারো মনে প্রষ্ফুটিত হয় ভালোবাসার রক্তগোলাপ। কারো মনে দুলিত হয় ব্যর্থতার আকাশচুম্বী বিষাদ। আর কেউ বা সূচনা করে তার নবজীবনের। এভাবেই স্মৃতির ডায়েরিতে রচিত হয়েছে কয়েকটি বছর…

তিন বছর পরে,,,,,,,,,,,

আনাজের বাসার সবাই আজকে ব্যাতিব্যস্ত। বাসার যেদিকে চক্ষুস্থির হচ্ছে সেখানেই মানুষের ঢল। এহমাদ বাড়ির সর্বাংশে আজ মরিচবাতি শোভা পাচ্ছে। জোড়ে জোড়ে গান বাজনা করছে উঠতি ছেলেপিলেরা। সবাই আজ মহাখুশি। সবাই রেডি হচ্ছে ফাইভ স্টার হোটেল এন্ড রিসোর্টে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। মেয়েরা একটা রুমে পরস্পরকে তৈরী করতে ব্যস্ত। অপরদিকে ছেলেদের দখলে আরেকটি রুম। সবাই সেখান হৈ-হুল্লোড় করছে। কাতান ল্যাহেঙ্গাটা পড়ে খানিকটা অস্বস্তি লাগছে ইয়ানার। আজকে ভারী রকমের লুকে মেকওভার করেছে সে। হাতে থাকা রক্তিম লাল লিপস্টিকটা ভালো মতো ঠোঁটে পাউট করে নেয়। শেষ লুকটা দেখতে আয়নার দিকে তাকায় সে। হ্যা, সব ঠিকঠাক। এবার সুবিধামতো ওড়নাটা পেচিয়ে পড়ে নেয়। খানিক বাদেই রুমে প্রবেশ করে আনাজ। ইয়ানাকে দেখে চশমাটা ঠিকভাবে চোখের উপর চালান করে। বুকের উপর হাত গুঁজে দিয়ে দেওয়ালে ঠেস মেরে দেখতে থাকে ইয়ানা। আনাজের উপস্থিতি টের পেয়ে অপ্রতিভভাবে তার কাছে যায় ইয়ানা। লাজুক কন্ঠে বলে,

–‘আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?’ ইয়ানার চিবুক বুকের সাথে ঠেকে যায়। দু’হাতে লজ্জায় মোচড়াতে থাকে। আনাজ তার থুতনি তুলে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

–‘ তোমাকে কোনদিন দেখতে খারাপ লেগেছিলো হুম? তোমার চোখ ঝলসানো সৌন্দর্যে বারংবার আমার চোখের জ্যতি কমে যায়। সর্বদাই কাবু হয়ে যাই এই সৌন্দর্যের বাহারে। নতুন করে নিমজ্জিত হই আমার প্রণয়িনীর প্রেমে!’

আনাজের কথায় মুচকি হাসে ইয়ানা। আনাজের জেল দিয়ে সেট করা চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে বলে,

–‘আজকেও আপনাকে হ্যান্ডসাম হাঙ্ক লাগছে সুইটহার্ট! ‘

ইয়ানার দিকে বিষ্ময়ের নজরে তাকায় আনাজ। বিয়ের এতো বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও ইয়ানা তাকে কখনো ভালোবেসে অন্য নামে কল করেনি। তবে আজকে….
হুট করে ইয়ানা কোথায় গিয়ে হাতে করে একটা গলার সেট নিয়ে আসে। আনাজকে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

–‘হুহ নিন। সারাজিবন তো ডাক্তারি গিরি করে আসলেন। এবার একটু বরগিরি দেখান। চটপট এটা পড়িয়ে দিন।’
আনাজ বাঁকা হাসি দিয়ে ইয়ানার এক হাত টেনে তার বুকে ফেলে দেয়।ইয়ানা আনাজের বুকে এসে পড়তেই হকচকিয়ে যায়। আনাজ ধীরে ধীরে তাকে আয়নার দিকে মুখ করিয়ে গলায় গহনাটা পড়িয়ে দিতে থাকে। পড়ানো হয়ে গেলে আয়নায় তার ইয়ানার প্রতিবিম্বের দিকে দৃষ্টিপাত করে আনাজ। ইয়ানা ঠোঁট কামড়ে মিটমিটিয়ে হাসছে। আনাজ দৃষ্টি দেয় ইয়ানার লেহেঙ্গায়। ইয়ানার উপরের ফতুয়ার পরে পেটের নিচের অংশটা উন্মুক্ত। ইয়ানাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে তার কাঁধের উপর মাথা রাখে আনাজ। মুহূর্তেই ঠান্ডা শিহরণ বয়ে যায় ইয়ানার শরীরে। মাথার নিউরনগুলোর চলাচল রীতিমতো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ইয়ানার গলায় নিজের ঠোঁট বুলাতে থাকে আনাজ। তার হাতদুটো দিয়ে ইয়ানার পেট ধরে রয়েছে। জোরে জোরে দম ছাড়ে আনাজ। ইয়ানার গলায় তার তপ্তশ্বাসগুলো আছড়ে পরতেই শিউরে উঠছে সে। আনাজ চোখ বন্ধ করে রয়েছে। খানিকবাদেই আনাজকে এক ঝটকায় সাইডে সরিয়ে দেয় ইয়ানা। আনাজ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইয়ানা বলে,

–‘কি করছেন কি?! আপনার ছেলে দেখে ফেলবে তো!’

–‘সে জন্য এভাবে ধাক্কা দিতে হবে? ‘ ইয়ানার উপর অভিমান করে বলে আনাজ। ইয়ানা আনাজের দিকে ফিক করে হেসে দিয়েই রুম থেকে প্রস্থান করে।
আনাজ নিজের চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে ঠিক করে নিয়ে বাহিরে রুমে যায়। মুহূর্তেই চোখে পড়ে তার ছোট্ট সোনটা এক’পা দু’পা করে এগোনোর চেষ্টা করছে। মনটা ভরে উঠে তার। বাচ্চাটা তাকে দেখা মাত্রই ‘ড্যাডি ড্যাডি’ করে আনাজের কাছে চলে আসে। আনাজ সস্নেহে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়। সারা মুখে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে,

–‘আপনি কি করছিলেন এখানে ড্যাডি? মাম্মা পাপার দুষ্টুমি দেখতে এসেছিলেন? ‘
আনাজের কথায় খিলখিলিয়ে দুষ্টু হাসি হেসে ওঠে বাচ্চাটা। যেনো ওইটুকুন পুঁচকেটা সব বুঝে ফেলেছে! খানিকটা আলিঙ্গন করে আনাজ আওয়ানকে নিয়ে যায় সবাইকে দেখতে।

—————————–✨

গাড়ি নিয়ে সবাই বিয়ের সেন্টারে আসতে শুরু করেছে। অনুষ্ঠান শুরু হতে আর দেরী নেই। ইতোমধ্যে পুরো সেন্টার মানুষে ভরে গেছে। কয়েকটা মেয়ে অবলীলায় নেচে মানুষদের পারফোরমেন্স দেখাতে ব্যস্ত। আরো কয়েকজন তরুণসহ সবাই মিলে সেন্টারের গেটের কাছে সুবিন্যস্তভাবে দাড়িয়ে আছে। কারো হাতে গোলাপ-গাঁদার পাপড়ি, কারো হাতে মিষ্টি আবার কেউ হাতে ট্রে তে করে শরবতের কয়কটা গ্লাস নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সবার সামনে দু’জন লাল রঙের ফিতা ধরে দাড়িয়ে আছেন। সবার সাথে একযোগে গেট ধরেছে আনজানাও। যদিও সে ব্রাইড। তাতে কিছু যায় আসে না! অনেক আগে থেকেই সে বলতো, তার যখন বিয়ে হবে তখব সবার সাথে সেও নিজের জামাইয়ের গেট ধরবে। একজন লোক রয়েছেন সামনে তিনি জোড়ে জোড়ে চিল্লাচ্ছেন বরযাত্রী এসে গেছে। সবাই রেডি থাকো। সবাই একসাথে দাড়িয়ে যায়। কাছে এসে থামে গাড়িটা। গাড়িটা অপূর্ব রকমের সাজানো। গোলাপ-রজনীগন্ধা ফুলের সৌন্দর্য গাড়িটাতে এক অন্যরকম রূপ দিয়েছে। গেটটা খুলে যায়। সবাই সাগ্রহে তাকিয়ে আছে সেদিকে। বেড়িয়ে আসে সাদা-সোনালি শেরওয়ানী পড়া অদ্ভুত সুন্দর মানুষটা। সবার চোখ আটকে যায় আদ্রর দিকে। মেয়েগুলোও কেমন চোখে চোখে গিলে খাচ্ছে আদ্রকে। আদ্রর পিছে পিছে এগিয়ে আসে তার বন্ধুরা। সবাই ধ্যান হাটিয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়। সবাই একযোগে বলতে থাকে, ‘নো মানি, নো হানি! ‘ সেই সাথে আনজানাও জোড়ে জোড়ে চিল্লাতে থাকে। আদ্র আনজানার দিকে লক্ষ্য করতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। আনজানা চোখ টিপে হাসতে শুরু করে। সেই সাথে আদ্রও হাসতে শুরু করে দেয়। সবাই চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলে,

–‘দেখা দেখি পড়েও করা যাবে এখন টাকা ফেলাও!’
আদ্র ধরা পড়ে যাওয়া কিছুটা লজ্জা পায়, একই সাথে আনজানাও। তারপর আবার আনজানাও চিল্লাতে শুরু করে,’নো মানি, নো হানি’
সবার দাবি পয়ত্রিশ হাজার টাকা দিতে হবে। আদ্র একজনকে ইশারা করতেই সে যেয়ে সাথে সাথে একটা ব্যাগ নিয়ে আসে। যেখান থেকে নগদ পয়ত্রিশ হাজার টাকা বের করে দেয়। আদ্র আনজানার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দেয়। আনজানা একটু অবাক হয়ে যায়। সবাই সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে ওঠে। আদ্রর হাতে কেঁচিটা ধরিয়ে দিলে আদ্র ফিতাকে কেটে ভেতরে ঢোকে। সবার মাঝে এক অন্যরকম উত্তেজনার মাদল বাজছে। মুহূর্তেই আদ্র আর আনজানাকে শরবত খাওয়িয়ে গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয় ফুলের পাপড়িগুলো।
.
.
.

সকল ধরনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বিয়ে হয় আদ্র-আনজানার। আবারও এক নবজীবনের সূচনা করলো তারা। মানুষ ও সম্পর্ক দুটি আগের মতোই আছে। ভালোবাসাটা শুরু হলো নতুনভাবে। মিসেস আয়না আর আনুজ তার ছেলে মেয়ে, জামাই বউকে স্টেজে আনেন। সবার সামনে অবলীলায় ছেলে-মেয়েদের জড়িয়ে ধরে বলেন,

–‘এখন থেকে তোমরা আমার চার ছেলে মেয়ে। আমার কাছে রক্তের সম্পর্কটা বড় নয়, তোমাদের পবিত্র সম্পর্কটাই বড়ো। আমার একমুঠো সুপ্ত বাসনা তোমরা সর্বদা এভাবেই হাসিখুশি থেকো প্রিয়মানুষকে নিয়ে। তোমরা যেনো অতীতের সকল দুঃখই কাটিয়ে উঠতে পারো, ব্যাস এর বেশি কিছু চাই না সৃষ্টিকর্তার কাছে। এখন তোমরা চারজন আমাকে কথা দাও যতোই তোমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক, যতোই বাধাবিপত্তি আসুক কেউ কাউকে রিক্ত করে যাবে না। ‘

সবাই আয়নার হাতের উপর একে একে হাত রাখলো। আয়না ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে সবাইকে জড়িয়ে ধরলেন। উপস্থিত সবাই আবেগে আপ্লূত হয়ে পড়ে। বিয়ের সেন্টার সশব্দে ধ্বনিত হলো জোড়া জোড়া হাতের করতালিতে…

———–সমাপ্ত ❀

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here