তার শহরের মায়া ২ পর্ব ১+২

#তার_শহরের_মায়া 💜
#সিজন_২
#সূচনা_পর্ব
#writer_Liza_moni

আজ কত শত দিন চলে গেল,
হারিয়ে গেলো মুখের হাসি।
আমি আজও যে আমার না হওয়া
মানুষ টাকে ভালোবাসি।
আরো যাবে দিন,যাবে আরও সময়
আমি কাটাতে পারবোনা,,
তার শহরের মায়া।

গোধূলি লগ্ন। ছাদের রেলিং ধরে ক্লান্ত ভরা চোখে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অনু। হালকা বাতাসে চুল গুলো মুখের উপর এসে পড়ছে। চোখে মেয়েটার কাজল আঁকা।গাঢ় করে কাজল এঁকেছে আজ কত দিন হয়ে গেল। হালকা কাজল সব সময় থাকে তার চোখে। মানুষ যেনো বুঝতে না পারে মেয়েটা রাত জেগে চোখের নিচে কালি ফেলেছে। মানুষ যেনো বুঝতে পারে আসলে চোখের নিচে কাজলের কালির জন্যই কালো হয়েছে। অদ্ভুত এই মেয়েটা। চুপ চাপ থাকতেই যেন ভীষণ ভালো লাগে তার।

কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে পাশ ফিরে তাকায় অনু। বড় বোন তনু কে দেখে মুচকি হেসে বললো,,এই সময় তুই এখানে কেন?কখনো তো আসতে দেখিনি তোকে।

ছোট বোনের কথায় হাসলো তনু। দুই হাত দিয়ে অনু কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,, তোর সাথে আকাশ দেখতে চলে এলাম। সপ্তাহের এই একটা দিনই একটু ফ্রী থাকি। দুই বোন কত দিন ধরে গল্প করিনা বলতো?
শেষ কবে একটু মন খুলে কথা বলেছিস মনে আছে তোর?

অনু হাসলো। তনুর কথায় সায় দিয়ে বললো চল আজ তোকে অনেক কথা বলবো। কিছু অজানা কথা।

অনুর মা ছাদে এসে দুই মেয়ের উদ্দেশ্যে বললো,,
:- অনু,তনু কিছুক্ষণ পর মাগরিবের আজান দিবে।নিচে যা আর নামাজের প্রস্তুতি নে।

দুই বোনের মুখ মলিন হয়ে গেল।তারা সব সময় ভুল সময় ঠিক করে আড্ডা দেওয়ার।আজ ও আর দুই বোনের এক সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়ার সময় হবে না।

মা চলে গেলে অনু আর তনু দুই জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।তনু ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,,
সমস্যা না। সামনের শুক্রবার না হয় সারা বিকেল জুড়ে আড্ডা দিবো।

অনু কিছু বললো না।তারা এতই ব্যস্ত যে দুই বোন মন খুলে একটু কথা ও বলতে পারছে না।

তনু ছাদ থেকে নিচে চলে গেল।অনু বোনের চলে যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

“”তনিমা তনু আর অনুমেঘা রাজমিম দুই বোনের নামের সাথে তেমন মিল নেই।স্বভাবে ও আলাদা দুই বোন।তনু খাগড়াছড়ির একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করে। দিনের বেশিরভাগ সময় তার সেখানেই কাটে।আর অনু, অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্রী। পড়ালেখার খাতিরে ঢাকায় হোস্টেলে থাকে।ঢাকায় চার মাস এক নাগাড়ে থাকাতে অনুর দম বন্ধ হয়ে আসছিলো নিজের শহরের জন্য।তাই ছুটে আসলো নিজের জন্ম শহর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়। নিজের শহরের প্রতি এক অদ্ভুত মায়া কাজ করে তার।””
.
.
নামাজ পড়ে সোফায় পা তুলে গালে হাত দিয়ে বসে আছে অনু। সবাই ব্যস্ত।মা রান্না ঘরে নাস্তা বানাচ্ছে।বাবা মসজিদ থেকে এখনো ফিরে আসেনি।তনু বিছানায় আধশোয়া হয়ে পরীক্ষার খাতা কাটছে।

অনু সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তনুর রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই একনাগাড়ে চার বার কলিং বেল বেজে উঠলো।অনু থমকালো। বুকের মাঝে ধক করে উঠলো তার। এমন করে একজনই কলিং বেল বাজায়।

অনুর শাহসে কুলাচ্ছে না এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেওয়ার।সে নিশ্চিত তার সেই মানুষটি দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে।

রান্না ঘর থেকে মা চিল্লিয়ে বললো,,
অনু দরজা খুলে দে। দেখ তো কে এসেছে?তোর আব্বু আসছে মনে হয়।

অনু দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে দিয়ে সরে গেল সে। দৌড়ে রুমে গিয়ে রুমের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।প্রায় পাঁচ মাস পর আজ দেখলো সেই মুখখানি।
.
.
দরজার সামনে কাউকে না দেখতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকে গেলো মাহিরের।বুঝলো এটা কার কাজ হতে পারে। মাহির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

মুখে হাসি ফুটিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসতে বসতে বললো,,ফুফি এক গ্লাস পানি দিও তো। তোমাদের এই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আমার জান বের হয়ে যায়।ফুফা কে বলে একটা লিফটের ব্যবস্থা করতে হবে।

অনুর মা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর থেকে এক পানি নিয়ে মাহিরের হাতে দিলেন।

এই বাড়িতে লিফট? তুই মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছিস মাহির।
তুই আসলি।আর আমি ভাবলাম তোর ফুফা আসছে।এত দিন পর কেমনে মনে পড়লো আমাদের কথা?

মাহির পানি খেয়ে বললো,, তোমাদের কথা সব সময় মনে পড়ে কিন্তু ব্যস্ততার জন্য আসা হয় না।

বুজলাম।সবাই ব্যস্ত। আমার দুই মেয়ের মতো।

অনুমেঘা আসছে ঢাকা থেকে?

হ্যাঁ ওতো আজ তিন দিন হলো বাড়িতে এসেছে। সামনের সপ্তাহে চলে যাবে।

ওহ। অনেক দিন হলো পিচ্চি রে দেখি না।তাই জিজ্ঞেস করলাম।
.
.
অনুর মা রান্না ঘরে চলে গেলেন।নুডুলুস রান্না করেছেন তিনি। সাথে মালাই চা। এখন সবার জন্য সেগুলো বেড়ে নিয়ে আসবেন বলেই রান্না ঘরে চলে গেল।

মাহির পকেট থেকে মোবাইল বের করে গেমস খেলতে লাগলো।
.
দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে অনু। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো হাতের উপর।
মায়া খুব খারাপ একটা জিনিস। না দেয় ভালো থাকতে আর না দেয় ভুলে থাকতে।
.
.
এক বাটি নুডুলুস এনে মিহিরের হাতে দিলেন অনুর মা। এমন সময় তনু ড্রইং রুমে এসে সোফায় বসলো।মা তার হাতে ও এক বাটি নুডুলুস ধরিয়ে দিলেন।
কয়েক বার অনু কে ডাকলেন অনুর মা।অনু সাড়া দিলো না।

অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছেন মাহির ভাই।

তনুর কথায় মাহির তনুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,, আমার থেকে ও বেশী ব্যস্ত তুই বুঝলি তনু।নাম করা স্কুলের ম্যাম বলে কথা।

খোঁচা দিবেন না একদম। আপনি একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যদি আমাদের মতো সাধারণ জনগণকে এই ভাবে খোঁচা মেরে কথা বলেন তাহলে কী করে হবে বলুন তো?

মাহির হাসলো।
তনু এবার অনু কে ডাকলো। অনু সাড়া দিলো এবার।চিল্লিয়ে বললো,,
আপু আমি একটা কাজ করতেছি পরে আসছি।

মাহির ভাইয়া এসেছেন দেখা করবি না?

একটু পর আসছি।
তনু আর কিছু বললো না। মায়ের হাতের মালাই চা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
.
.
অনু বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সে। ধবধবে ফর্সা না। হলদেটে ফর্সা যাকে বলে। তবে অনেক ছেলের ভালবাসা পাওয়ার যোগ্যতা আছে। কিন্তু তার যে অনেক ছেলে না। একজন ছেলের ভালবাসা দরকার।

অনু ওয়াস রুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে নিলো। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়ে এসে আবারও ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো।কাজল নিয়ে চোখে দিলো।গাঢ় করেই দিল আজ। হালকা না হয় আবার আগামী কাল থেকে দিবে।
.
.
রুম থেকে বের হয়ে এসে সোফায় বসা মাহির আর তনুর দিকে এক নজর তাকিয়ে মুচকি হেসে মাহিরের উদ্দেশ্যে বললো,,

আসসালামুয়ালাইকুম মাহির ভাইয়া। কেমন আছেন?

মাহির চোখ তুলে অনুর দিকে তাকালো। তার মুচকি হেসে বললো,,
ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুই?

আমি তো বিন্দাস আছি।
তনুর পাশে গিয়ে বসলো অনু। মায়ের উদ্দেশ্যে বললো, আম্মু আমাকে শুধু মালাই চা দিও।আর কিছু না।
.
.
রাত আটটা অব্দি মাহির অনুদের বাড়িতে থাকে। বাড়িতে কল আসায় সে চলে যায়। রাতের খাবার খেয়ে যায়নি সে।কারন সে জানে তার মায়ের সাথে এক সাথে বসে খাবার না খেলে তার মা খাবার ছুঁয়ে ও দেখবে না।তাই এত জোর করার পর ও ডিনার করার জন্য রাজি হয়নি সে।
.
.
মধ্যে রাত।সবাই ঘুমে মগ্ন। কোলাহোল পূর্ণ শহর এখন প্রায় শান্ত।অনুর চোখে ঘুম নেই।বেলকনির গ্রিলে হাত রেখে আলোকিত চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবনায় মগ্ন সে।

,,অতীত,,
কিশোরি অনু সেদিন হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পড়া এক যুবকের প্রেমে পড়েছিল। তখন সবে মাত্র সে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের গন্ডি পেরিয়ে সেকেন্ড ইয়ারে পা রেখেছে।কিশোরি মন।বয়সটা তখন ১৭‌ হবে,,যাকে দেখছে তাকেই ভালো লাগছিল তার।এই বয়সটাই এমন। আবেগে ভরা একটা সময়।অনুর ক্ষেত্রে ও একই। কিন্তু এমন ভালো লাগার মধ্যে যে ভালোবাসা হয়ে যাবে তা কখনো ভাবেনি সে।যে মানুষটাকে সে ভালোবেসে ফেলেছিলো সে হলো মাহির।তার মামাতো ভাই।
অনুর মামাতো বোন মাহিমার বিয়েতে হলুদ হিমু কে দেখে কিশোরী মনে প্রেমের ছোঁয়া লাগে।
মাহিরের সাথে কথা বলতে ও তখন তার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছিলো। ঠিক মত তার সামনে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছিলো না অনু।মনে হচ্ছিলো যদি মাহির বুঝে যায় অনুর মনে তার জন্য প্রেম জমেছে। তখন কী হবে?
.
.
মাহিমার বিয়ের মাস খানেক পর কাজিন দের সাথে ট্রুথ অর ডেয়ার খেলায় মত্ত হয় মাহির। অনেক কনফিডেন্স নিয়ে সে ডেয়ার নিলো।

এক কাজিন তাকে ডেয়ার দেয় অনুমেঘাকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে। এবং ২ মাস তার সাথে রিলেশন চালিয়ে যেতে।

ডেয়ার পূরণ করার জন্য মাহির অনু কে একদিন প্রেমের প্রস্তাব দিয়েই বসে।এটা যে ডেয়ার তা জানে না অনু।মাহিরের প্রপোজাল পেয়ে অনু যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিল।
নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারিনি সে।


অনু শুন,,
সেই ছোট বেলা থেকেই আমি তোকে পছন্দ করি। ভালোবাসি বলতে পারিস। কোনো দিন তোকে বুঝতে দিইনি। তুই আমার সারা জীবনের সঙ্গী হবি?”

সেই সময় এই সাজানো মিথ্যা কথা গুলোই অনুর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর ভালোলাগার কথা মনে হয়েছিল।সে ও যে মনে মনে এই মানুষটার শহরের মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে।

সেদিন মাহিরের মিথ্যে প্রেমের জালে আটকা পড়ে অনু। খুব নিখুঁত ভাবে অভিনয় করে দুই টা মাস মাহির তার সাথে। এতটাই নিখুঁত অভিনয় যে অনুর কখনোই ভুলেও মনে হয়নি মাহির হঠাৎ করেই কেন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিবে?
কিশোরী অনুর মন তখন পড়ে ছিলো মাহিরের কাছে।মাহিরের রাগি কন্ঠে বলা কথা গুলো মুচকি হেসে হজম করতো অনু।অনু মেয়েটা ছোট থেকেই চুপচাপ ধরনের।

শুনেছি বাড়ির ছোট মেয়েরা বড্ড চঞ্চল হয়।রাগী হয়। কিন্তু অনু সে রকম নয়।অনু অভিমানী ভীষণ। অল্পতেই অভিমান করে বসে।

মায়ের মোবাইল দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হতো মাহিরের সাথে।কলেজে যাবার সময় মাঝে মধ্যে মাহির এসে নিয়ে যেতো।

সেদিন ছিল ২মাস শেষ হবার শেষ দিন।
কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরছিল অনু। মাহির বাইক নিয়ে এসে পথ আটকায় অনুর। মাহির কে দেখে অনুর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।
মাহির অনু কে বাইকের পিছনে উঠে বসার জন্য চোখ দিয়ে ইশারা করলো।অনু মুচকি হেসে উঠে বসে বাইকে।

বাড়ির রাস্তা পেরিয়ে অন্য এক রাস্তায় নিয়ে যায় মাহির। বিশাল বড় একটা মাঠের পাশে বাইক থামিয়ে অনুর হাত ধরে হাঁটতে থাকে মাঠে।শরতের নীল আকাশ।তার মাঝে তুলোর মত সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে।অনুর চোখে মুখে খুশি উপচে পড়ছে।কাশ ফুল দেখে সেদিকে দৌড়ে গেল অনু।
মাহির পকেটে হাত ঢুকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে অনুর কান্ড দেখছে।

অনেক লাফালাফি করে সুন্দর একটা কাশফুল নিয়ে আবারো মাহিরের কাছে দৌড়ে এসে হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাতে থাকে অনু।

মাহিরের দিকে ফুলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,
ফুলটা সুন্দর না?কী নরম তুলতুলে,,

অনুর হাত থেকে ফুল টা নিয়ে মাহির ভালো করে দেখে মাটিতে ফেলে দিলো।

মাহিরের কাজে অবাক হলো অনু।
ফুলটা ফেলে দিলেন যে?

তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে অনু।

কী কথা বলুন?

মাহির হাঁটতে থাকে।আর মাহিরের পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকে অনু।
#তার_শহরের_মায়া ২ 💜
#পার্ট_২
#Writer_Liza_moni

বিকেল গড়িয়ে আসছে।অনুর এখনো বাড়িতে আসার নাম নেই। বাড়ির সদর দরজার সামনে বসে অপেক্ষা করছেন অনুর মা।কলেজ ছুটি হয় বেলা ২ টায়।আর এখন প্রায় ৩:৫৬ বাজে।এত সময় কখনও লাগে না অনুর।২০ মিনিটেই বাড়ি এসে পৌঁছায় মেয়েটা। কিন্তু আজ এত দেরী হচ্ছে কেন তা বুঝতে পারছেন না অনুর মা।
.
.
মাহিরের সাথে হাঁটছে তো হাঁটছেই। দুই জনই চুপ করে আছে।
নিরবতা ভেঙ্গে অনু বললো,,
অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।মা চিন্তা করছেন হয়তো। আপনি যা বলবেন তা না হয় রাতে কলে বইলেন।

মাহির পাশ ফিরে অনুর দিকে তাকালো। হাঁটা থামিয়ে বললো,,,

“অনু আমি তোকে ভালবাসি না।এটা একটা ডেয়ার ছিল।যা পূরন করার জন্য তোর সাথে এমনটা করতে হলো।”

মাহিরের কথায় অনুর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। কেমন যেন লাগছে তার। অসহ্য মনে হচ্ছে সব কিছু।
চোখে মুখে অন্ধকারের আভা।

আপনি মজা করছেন তাই না?

না আমি মজা করছি না। আমি সিরিয়াস।

অনু কী বলবে আর? তার মুখের কথা হারিয়ে গেছে। অদ্ভুত তো।

আমি বাড়িতে যাবো।

তুই কি সিরিয়াস ছিলি এই সম্পর্কে?

আমার ভালো লাগছে না। আমি বাড়ি যাবো।

মাহির আর কিছু বললো না। বাইকের দিকে হাঁটতে লাগলো।

অনুর পা চলছে না। প্রথম প্রেম তাকে এই ভাবে ধোঁকা দিলো? তার অনুভূতি এত ঠুনকো?
.
.
অনুর বাড়ির গেটের সামনে এসে বাইক থামায় মাহির।অনু একটা ঘোরের মাঝে আছে।
বাইক থেকে নেমে গেটের ভেতরে ঢুকার সময় পেছন ফিরে মাহিরের দিকে তাকিয়ে অনু বললো,,

দিত্বীয় বার ডেয়ার খেলবেন না।

মাহির মাথা নিচু করে বাইক স্টার্ট দিল।

অনু কাতর কন্ঠে মাহিরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,,
থেকে যান না আমার হয়ে। আমি যে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে।
অনুর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। অদ্ভুত এই পৃথিবীর অদ্ভুত সব মানুষ।

সেদিনের পর থেকে মাহিরের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল অনু।কার্টেসি রক্ষা করার জন্য আজ আবার কথা বললো।

,,,বর্তমান,,,
অতীতের ভাবনা থেকে বের হয়ে বেলকনি থেকে রুমে আসলো অনু।রাত এখন প্রায় ২টা বাজে। চোখ জুড়ে ঘুমেদের ভীড়। একটু ঘুমানো উচিত এখন।

বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। বেশি সময় লাগলো না ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতে।
.
.
অনু,এই অনু দিনের কয়টা বাজে দেখেছিস?

ঘুমন্ত অনু নড়ে চড়ে উঠলো। ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,,
কয়টা বাজে?

তনু জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই রোদ এসে অনুর মুখের উপর পড়ে।অনু বিরক্তিকর শব্দ করে চোখের উপর হাত রাখলো।

উঠে পর।১০ টা বাজে।

অনু শোয়া থেকে উঠে চোখ ডলে তনুর দিকে তাকালো।হাই তুলে বললো তুই আজ স্কুলে যাস নাই?

তনু বিছানায় বসে বললো না।আজ ছুটি নিয়েছি। ঘুরতে যাবো।

ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে অনুর চোখে মুখে খুশির ঝিলিক দিয়ে উঠলো। সত্যি? অনেক দিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না।

যা ফ্রেশ হয়ে আয়। নাস্তা করে নে। একটু পরেই বের হয়ে যাবো।
.
.
অনু ওয়াস রুমে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য।রাত জেগে থাকাটা যেনো তার বাজে অভ্যাস হয়ে গেছে। গভীর রাতকে ও তার সন্ধ্যা মনে হয়। অদ্ভুত মেয়ে।

অনু ওয়াস রুম থেকে বের হয়ে এসে মুখ মুছে মায়ের কাছে রান্না ঘরে চলে গেল।

অনু কে দেখে অনুর মা বলে উঠলো,,
তুই এত দেরী করে ঘুম থেকে উঠিস কেন? রাতে নিশ্চয় দেরি করে ঘুমাস?

অনু মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,, ঘুম আসতে দেরি হয় এই জন্যই।

নিজের শরীরের দিকে দেখেছিস?দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে না। ঠিক মতো ঘুমায় না। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে না। নামাজ কালাম তো মনে হয় বাদ পড়েছে। এমন হলে কে বিয়ে করবে তোকে?এত শুকিয়ে গেছিস যে ফুঁ দিলে উড়ে যাবি।

মায়ের কথা শুনে অনু হাসলো।
মা অনুর হাত ধরে বললো,,
আমাকে একটা কথা বলতো সোনা।

কী কথা আম্মু?

তুই কি কাউকে পছন্দ করিস?ভালোবাসিস কাউকে?

অনুর মুখটা মলিন হয়ে গেল।
হুম বাসি তো মা। অনেক ভালোবাসি। সেই অনেক দিন আগে থেকেই ভালোবাসি। বছর তিন পেরিয়ে চারে পড়বে। খুব ভালোবাসি তারে। কিন্তু সে আমার অনূভুতির মূল্য দেয়নি মা। আমার অনূভুতি নিয়ে খেলেছে।
মনে মনে কথা গুলো বললেও মুখে কিছু বললো না অনু।

ঠোঁটের কোণে মেকি হাসি ফুটিয়ে বললো,,
আরে আম্মু কী যে বলো না। আমি আবার কাউকে ভালোবাসবো।এটা বিশ্বাস যোগ্য মনে হয় তোমার?এই সব প্রেমে আমার এলার্জি আছে।

অনুর মা সন্দিহান দৃষ্টিতে অনুর মুখের দিকে তাকালো।
শুন,,
প্রেম করিস আর যাই করিস,, ভেবে চিনতে করবি।একটি প্রবাদ আছে জানিস তো?
ভাবিয়া করিও কাজ,,,করিয়া ভাবি ও না।
আর এই যুগের ছেলে মেয়েদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে আমি কম দেখেছি।চার দিকে শুধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বিচ্ছেদ,বিরহ, বেদনা,যন্ত্রনা, আর ও কত কি। আমি তোর মা হয়ে না, তোর বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে বলছি,জিদ করে ঢাকায় গিয়ে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছিস। ভুল কিছুতে জড়িয়ে যাইস না। তাহলে সারা জীবন আফসোস করে মরবি।
আমার মতো।

বলেই অনুর মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

মায়ের কথা শুনে অনুর ভ্রু কুঁচকে গেলো।
তুমি কি কাউকে ভালোবাসতে আম্মু?

অনুর মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,,অন্য দিন বলবো। এখন কাজ করছি।যা এখান থেকে।
.
.
অনু আর কিছু বললো না।চলে আসলো সেখান থেকে। রুমে আসার সময় অনুর চোখ পড়ে তনুর রুমের দিকে।তনু ফোনে কারো সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।অন্যরকম কথা।যাকে বলে প্রেমকথন।অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।প্রেম প্রেম খেলায় মত্ত সবাই।না জানি এর শেষ পরিণতি কী হয়?
অনু গিয়ে তনুর রুমে ঢুকলো।

তনুকে কিছু বলতে দেওয়ার আগেই অনু বলে উঠলো,, আমার ঘুরতে যেতে মন চাইছে না। তোর ইচ্ছে হলে যা। আমি যাবো না।

তনু কে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই অনু রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
.
.
তনু মোবাইলে কথা শেষ করে অনুর রুমে গেল। অনুর সামনে যেয়ে বলল সমস্যা নেই বনু,আমিও যাচ্ছি না। আজকে আমাকে স্কুলে যাইতে হবে। একটা মিটিং বসবে বলল টিচার্স মিটিং।

অনু মৃদু হাসল। তনুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
চল আমিও তোর সাথে স্কুলে যাই।ছোট ছোট বাচ্চাদের কে দেখতে খুব ভাল্লাগে।

তনু বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,,

ঠিক আছে।তুই তৈরি হয়েনে।
.
.
তনু,আর অনু স্কুলে যেতে যেতে প্রায় অনেক দেরি হয়ে যায়। মিটিং রুমে সবাই তনুর জন্য অপেক্ষা করছিলো।তনু যেতেই মিটিং শুরু হয়।

অনু স্কুলের বারান্দায় বসে বসে বোর হচ্ছে। কোথায় ভাবলো এখানে এসে ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে মজা করবে।
কিন্তু সব শিক্ষকদের নিয়ে মিটিং বসায় তাদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।অনু একা একা হাঁটতে লাগলো।

স্কুলের মাঠের বা দিকে একটা কাঠ বাদাম গাছ আছে। নিরিবিলি জায়গাটা দেখে অনু সেই দিকে এগিয়ে গেল।এই স্কুলটা তার নিজের ও।তার শিক্ষাজীবনের শুরু হয় এই স্কুল থেকে।

প্রায় আধঘন্টা পর তনু অনু কে কল
করে জানায় স্কুলের দিকে আসতে। টিচার্স রুমে। প্রিন্সিপাল স্যার তার সাথে দেখা করতে চেয়েছে।অনু সে দিকে চললো।

পরিচিত অনেক টিচার আছেন এখনো স্কুলে।যদি ও এখনকার প্রিন্সিপাল স্যার তার শিক্ষক না। কয়েকজন সহকারি শিক্ষকই আছেন।যারা অনু কে ছোট থেকে চিনেন।

টিচার্স রুমে গিয়ে সবার সাথে দেখা করল অনু।
.
.
স্কুল থেকে ফিরে তনু দুপুরের খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্লান্ত ছিল সে।

বিকেল চারটা।সূর্যের তাপ নেই এখন তেমন একটা।
অনু ছাদের দোলনায় বসে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে সাতকাহন পড়ছে। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। হালকা বাঁকানো চুল গুলো মৃদু বাতাসে উড়ছে। গোসলের পর চুল ছেড়ে দিয়েছে শুকানোর জন্য।আর বাঁধে নি। সাতকাহন পড়ায় মগ্ন সে।

হঠাৎ কেউ তার হাত থেকে বইটা ছো মেরে নিয়ে নিলো।অনু বেশ রেগে গেলো এই কাজে।তনু অনুর সামনে দাঁড়িয়ে বইটা উল্টে পাল্টে দেখছে।

সব সময় মজা একদম ভালো লাগে না আপু।বইটা দে। তুই না ঘুমাচ্ছিলি?এখানে আসলি কেন?

তনু অনুর পাশে গিয়ে দোলনায় বসে বললো,,
তোকে একটা সিক্রেট কথা বলি শোন,,

আমি এখন কিচ্ছু শুনবো না। তুই বইটা দে।

আরে দিচ্ছি তো।আগে আমার কথা শোন।

বিরক্ত হয়ে গেলো অনু। বিরক্ত মাখা কন্ঠে বললো,,
তাড়াতাড়ি বলে বইটা দিয়ে এখান থেকে যা।

তনু উঠে দাঁড়ালো। রেলিং এর কাছে যেতে যেতে বললো,,

আমার আর মাহিরের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

চলবে,,,, 🍁

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here