ভোরের শিশির পর্ব ১২

#ভোরের_শিশির
#সাহিরাহ_আনজুম_ইউশা
পার্ট:১২

রাধিকা কোনোদিন নলিনার কোনো ভর্ৎসনায় তার সম্মুখে অশ্রুবর্ষণ করেনি।আজও সে কঠোর মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।নলিনার বাক্যবর্ষণ একটু ক্ষান্ত হলে রাধিকা বললো আমার কাজে আপনি অসন্তুষ্ট হলে,আমাকে বিদায় করে দিন।

নলিনা ঝংকার দিয়ে বললো বটেই তো!আমার স্বামী আশ্রয় না দিলে তো কুকুরে তকে ছিড়ে খেত।

আমি আর পারছি না,আমার কোনো কাজে মন টিকছে না।তাই বলছি আমাকে বিদায় দিন।

নলিনা কোমরে হস্ত স্হাপন করে বললো বিদায় তো করবো।তোমাকে আজীবন পুষতে আমার ইচ্ছা নেই।
কিন্তু এই কয়দিনে তকে জ্বালিয়ে ছাড়বো।

কথাটা বলে নলিনা গম্ভির হয়ে চলে যান।রাধিকা আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো আল্লাহ কখন আমাকে তাদের থেকে মুক্তি দিবেন?রাধিকার হস্তদ্বয় যেনো বাঁধা।এই নিষ্ঠুর মহিলা রাধিকাকে সবদিক থেকে অত্যাচার করছে।এই প্রচন্ড শীতে তাকে একখানা কম্বলও দেয়নি।রাধিকা তার মাকে এক নজর দেখার জন্য বেকুল হয়ে গেলো।কত মাস অতিবাহিত হয়েছে সে তার মাকে দেখেনি।
রাধিকা অশ্রুচুক্ষে তার রুমে চলে আসে।তার ডায়েরিটা তন্ন-তন্ন করে খুঁজতে থাকে।অনেক দিন কিছু সে লেখেনি।আজ সে অনেক কিছু লিখতে চাই।

মাহিন শীতেররৌদ্রালোকিত বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইল।সে রাধিকাকে যেনো অন্তঃকরণের গভীরতম অভ্যন্তরদেশে আকর্ষণ করিয়ে রয়েছে।রাধিকার মুখটা যখনিই তার অন্তরের মধ্যে মুদ্রিত ও পরিস্ফুট হয়ে উঠে ততই তার সমস্ত শরীর ক্রমে ক্রমে অবশ হয়ে যায়।সে আর পারছে না রাধিকাকে ছাড়া।রাধিকা কি সত্যিই শিশির বিন্দুর ন্যায় হারিয়ে গেলো?না তার সাথে লুকোচুরি খেলছে?

মাহিনকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্নেহা বলে উঠলো এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?শরীর কি অসুস্হ?

মাহিন ঘুরে তাকায়।স্নেহার প্রতি স্হিরদৃষ্টি দিয়ে বললো আপনি কে?চিনতে পারছি না!

স্নেহা খানিকটা অবাক হয়ে অবিচলিতকন্ঠে বললো আমি স্নেহা।আমাকে চিনতে পারনি!আমরা দুজন তো ছোট বেলায় এক সাথে পড়াশুনা করেছি।

মাহিন পুনরায় দৃষ্টি দিয়ে বলে তুমি স্নেহা!আগে বলবে তো।কত বড় হয়ে গেছো,চিনার উপায় তো নেই।

স্নেহা মৃদু হেসে বললো কেমন আছো?

মাহিন নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে মনের দিকে একদম ভালো নেই,আর শরীরের দিক দিয়ে ভালো আছি।

মনের দিক দিয়ে ভালো হওয়ার জন্য একটা বিয়ে করো।
কথাটা স্নেহার মুখ দিয়ে বের হতেই তার মনে পড়ে মাহিনের সাথেই তো তার বিয়ের আলাপ হচ্ছে।মুহূর্তে তাকে লজ্জা আক্রমণ করে।তার মুখশ্রী রক্তিম হয়ে উঠল।অকস্মাৎ স্নেহার এই লজ্জার আবির্ভাব দেখে মাহিন কিছুই বুজতে পারেনি।সে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মাহিন রুদ্ধনিশ্বাসে একাগ্র আগ্রহের সহিত বললো কোথায় হারিয়ে গেলে?

স্নেহা মাহির কথা কর্ণঘোচর হলে সে মাথা নেড়ে বললো হারায় নি বাস্তবেই আছি।

মাহিন হঠাৎ স্নেহার আগমণ কিছু বুজতে না পারায় সে তার মার কাছে যেতে থাকে।মাহিনকে চলে যেতে দেখে স্নেহা বলে উঠে কোথায় যাচ্ছো? আমার সাথে কি কথা বলতে ভালো লাগছে না?

ভালো লাগবে না কেনো?এতদিন পরে তোমাকে দেখে খুব খুশি হয়েছি।

স্নেহা মাহিনের কথা শুনে ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি নিয়ে বললো চল আমরা দুজন কোথাও ঘুরতে যাই।

মাহিন ভদ্রতার রক্ষার্থে বললো আজ আমি খুব ব্যস্ত,তাই কাল গেলে কেমন হয়।

খুব ভালো হবে।

মাহিন উৎক্ষিপ্ত হয়ে তার মাকে বললো হঠাৎ স্নেহা আসলো কেনো?

মাহিনের মা শান্তকন্ঠে বলে উঠেন তর সাথে মেয়েটির বিয়ে ঠিক করবো,তাই এখানে এনেছি।

মাহিন মায়ের কর্মে বিরক্ত হয়।তাকে না বলে মেয়েটিকে কেনো এনেছে।একবারও তাকে বলার প্রয়োজন মনে করলো না।মাহিন রাগান্বিত হয়ে বলে উঠে আমি আগেই বলেছি আমি বিয়ে করব না।শুধু শুধু কেনো আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন করছো?আমি রাধিকার স্হানে আর কাউকে বসাতে পারবো না।যদিও স্নেহাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাও তবুও আমি বিয়ে করবো না।

বিয়ে না করলে কখনো আমার সামনে আসবি না।তর মতো ছেলে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো।এত বড় হয়েও আমাদের কথা শুনিস না।সর্বদায় নিজের মতকে প্রাধান্য দিস।

মাহিন তার মায়ের কথায় চুপসে যায়।সে কখনো তার মাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।মায়ের খুশির জন্য তার বিয়েতে রাজি হওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই।মায়ের রাগ দেখে নিজেকে শান্ত করে বলে তোমার যা ইচ্ছা তা করো।আমার মনে হই না আমি স্নেহাকে স্ত্রীর অধিকার দিতে পারবো।

তিনি মাহিনের এমন কথায় কিছু বলার আগেই মাহিন স্ব স্হান ত্যাগ করে।সে এখন পরিবারের কাছে হেরে যাচ্ছে।মায়ের জিদের কাছে তার জিদ অতি সামান্য।

শীতের চাঁদ যখন রশ্মিচ্ছটাহীন ম্লান পশ্চিমাকাশের প্রান্তে নেমেছে।তখন রাধিকার নিদ্রা ভেঙ্গে যাওয়াই সে ছাদে আসে।চাঁদের আলো কম হওয়াই রাত্রিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার লাগছে।রাধিকা বহুদূরে তারার প্রতি তাকিয়ে রইল।সে ক্লান্তিকর দুঃখ-বেদনার জন্য মুক্তি চায়।সে আর পারছে না,এই বিরতিহীন দুঃখে।মনে সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতেই সে চলে যাবে।যেই ভাবা সেই কাজ।মাহিনের দেওয়া ডায়েরিটা নিয়ে চুপিশারে বেরিয়ে পড়ে।রাস্তাঘাটে নিরবতা বিরাজ করছে।রাস্তার কুকুরগুলো খুদার জ্বালায় ঘেউ ঘেউ করছে।মাঝে মাঝে সদর রাস্তা কাঁপিয়ে ছুটে যাচ্ছে দানব আকৃতি ট্রাক ও ভ্রমণ বিলাস নাইট কোচ।দূরের রাস্তার মিটমিট করে জ্বলছে ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো।এই আলোতে রাধিকা চলতে লাগলো।শীতে প্রচন্ডতায় ক্ষণে ক্ষণে সে কেঁপে উঠছে।কিশোরী হয়েও তার আজ ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে।জিবনটা বড় অদ্ভুত।কিন্তু এটা সত্য আল্লাহ দুটি সুখের মাঝে একটি কষ্ট দিয়েছেন।

রাধিকার আর হাঁটার শক্তি নেই।তার খুব ক্লান্ত লাগছে।আশপাশে তাকিয়ে দেখে কয়ের কদম দূরে একটা বাড়ি।বিলম্ব না করে সেখানে চলে যায়।কাঁপা কাঁপা কন্ঠ নিয়ে কয়েকবার ঘরের মালিকদের ডাকে।তার আওয়াজ পেয়ে বৃদ্ধ এক লোক দরজা খোলে।অন্ধকার রজঁনীতে এক বিক্ষিপ্তকেশী ধূলি-মলিন কিশোরী মেয়েকে তাদের আঙ্গিনায় দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে কে তুমি মা?

রাধিকা শাড়ির আচঁলটা টেনে গায়ে ভালো ভাবে জরিয়ে বলে আমি রাধিকা।বিপদে পড়ে এসেছি ।আজকের রাতটি থাকতে দিবেন।

বৃদ্ধলোকটির দয়া হয়।কারণ তারও যৌবতী মেয়ে আছে।আর এত রাতে কোনো মেয়ে বাহিরে থাকা তার জন্য বিপদজনক।বৃদ্ধলোকটি হেসে বলেন আসো ভিতরে আসো।

রাধিকা বিলম্ব না করে ঘরে প্রবেশ করে।
বৃদ্ধলোক ডেকে তার স্ত্রী ও মেয়েকে জাগ্রত করে।বৃদ্ধলোকের স্ত্রী প্লেটে কিছু খাবার এনে রাধিকার সামনে রেখে বলে খেয়ে নাও এগুলো।তোমাকে দেখে ক্লান্ত লাগছে।

রাধিকা প্লেট তার কাছ থেকে সরিয়ে বললো আমার খিদে নেই।আপনারা আমাকে থাকতে দিয়েছেন তার ঋণেই আমি দিতে পারবো না।

যৌবতী মেয়েটি বলে উঠে তুমি আজ রাতের জন্য আমাদের অতিথি।তোমার খেদমত করা আমাদের কর্তব্য।তাই না করে খেয়ে নাও।

বৃদ্ধলোকটি তখন বললো হে মা খেয়ে নাও।তোমার খেদমত করে আমরা সওয়াব পেতে চাই।এই সুযোগ আমাদের কখন আসে তা আল্লাহ জানে।

তাদের কথাবার্তায় রাধিকা বুজতে পারে পরিবারটা হয়তো ধার্মিক।তা না হলে এতে রাতে কেউ খেতে দিতো না।রাধিকা তাদের কথা রক্ষার্থে খাবারগুলো খেয়ে নেয়।তার সত্যিই অনেক খিদা লেগেছিলো।

নলিনা মাঝরাতে রাধিকা না দেখতে পেয়ে ভয় পান।এত রাতে মেয়েটি গেলো কোথায়।চুরি করে সব নিয়ে পালিয়ে যায়নি তো?নলিনা ভয়ে তার স্বামীকে জাগ্রত করে।
তার স্বামী তন্দ্রার ভাব নিয়ে বলেন কি হয়েছে এত রাতে ডাকলে কেনো?

নলিনা বিছানা থেকে উঠে বলে তাড়াতাড়ি ওঠো।রাধিকা মেয়েটি চুরি করে পালিয়েছে।

স্ত্রীর মুখে এমন কথা শুনে তিনি ওঠে বলেন বলো কি চুরি করে পালিয়েছে?

হুম পালিয়েছে।এই জন্য বলি অপরিচিত কাউকে বাসায় নিয়ে এসো না।এবার বুজো মজা।

বেশি কথা না বলে,চল দেখি কি চুরি করেছে।

নলিনা তার স্বামীকে নিয়ে তন্ন তন্ন করে সব খুঁজতে লাগলো।নিজের গহনা , টাকা সব দেখলো।কিন্তু সব ঠিকঠাক জায়গায় দেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

চলবে,,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here