তোর মায়ায় আবদ্ধ পর্ব ৯

#তোর_মায়ায়_আবদ্ধ
#পর্ব_৯(বোনাস পার্ট)
#আঁধারিনী(ছদ্মনাম)

পুরো ঘর কমপক্ষে বিশবার হলো পায়ে চারি করা শেষ কিন্তু এখনো ভেবেই পাচ্ছি না শুভ্রের বাবা হঠাৎ শুভ্রকে ঘরে ডেকে নিয়ে যাওয়ার কারণ কি!আগে যতোবারই দেখেছি শুভ্রকে কোনো কথা বলতে হলে ডাইনিং টেবিলেই বলতেন কারণ খাওয়ার সময় টা ছাড়া নাকি এই দুই বাপ ছেলে কোনোদিন এক হতে পারে না।শুভ্রকে এই খাওয়ার সময়ই শুধু বাসায় দেখা যায়।এছাড়া সারাদিন বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানো আড্ডা দেওয়া এসবেই ব্যস্ত থাকে মহাশয়।আগে নাকি এই খাওয়ার সময়ও পাও যেতো না মহাশয় কে।এই অবস্থা দেখে ফারহান আংকেল কড়াকড়ি ভাবে নির্দেশ দিয়েছেন যদি তিন বেলা খাবার টেবিলে যাকে পাওয়া যাবে না তার জন্য এবাড়ির দরজা জন্য চিরতরে বন্ধ করে দিবেন।আর এইদিকে বেচারা একটাই মাত্র বাপের বাড়ি নিজে তো বেকার বাপের টাকায়ই চলে এমন অবস্থায় যদি বাড়িতেই ঢোকা বন্ধ করে দেয় তাহলে থাকবে কই।তাই সারাদিন টোটো করে বন্ধুদের সাথে যতোই আড্ডা বা কোনো কাজই করুক না কেনো তিনবেলা খাবার টেবিলে ঠিকই স্ব শরীরে উপস্থিত থাকে।মিহি আর রোকেয়ার মুখে শুনেছিলাম কথাগুলো। শুনেই আমার পেট ফেটে হাসি পাচ্ছিলো।

একটু মিথিলা আপুর ব্যাপারটাও জানতে পারলাম রোকেয়ার কাছ থেকে।ওর ভার্ষ্যমতে মিথিলা আপু অসল একটু টাইপের মানুষ। বিয়ের আগে কোনোদিন রান্নাঘরের ধারে কাছেও কোনোদিন আসেনি।মিসেস আনিকা রহমান মানে আমার শাশুড়ী মার তিন ছেলেমেয়েই নয়নের মনি। বিশেষ করে মিথিলা আপুকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন সবসময়। তাই মেয়েকে কখনো জোর করেননি কোনো কাজে।এমনি বিয়ের পরও যাতে কোনোরকমে কষ্ট না করা লাগে তাই বিয়ের সময় মিথিলা আপুর সাথে একজন কাজের বুয়াও পাঠিয়েছিলেন।শশুর বাড়িতে গিয়েও তেমন কোনো কাজই কখনো করা লাগেনি।অর্নব ভাইয়ার সাথে আপুর পাঁচ বছরের প্রেমের বিয়ে ছিলো।তাই ভাইয়াও কখনো আপুর কোনো অযত্ন হতে দেয়নি।আপুকে কখনো এক গ্লাস পানি তুলেও খেতে হয়নি ওইরকম টাইপের অবস্থায় ছিলো আপু।তবে এখন অবশ্য তুরের জন্য মাঝে মাঝে এটা ওটা করা লাগে।কিন্তু আপু এখনোও কোনো রান্নাই ভালোমতো পারে না।তাই তখন খাবার টেবিলে আপুর রান্না করা নিয়ে এতো অবাক হচ্ছিলো।

তখন যে বলেছিলো ওই রাত্রী না ফাত্রী ওই মেয়ে নাকি সব রান্নাই খুব ভালো মতো পারে।এটা কি আদোও সত্যি কথা?আমার তো এখন এই মিথিলা নামক মানুষ টার একটা কথাও বিশ্বাস হয় না।আমাদের বাড়ির পাশের এক কাকিমা ছিলেন পুরো গ্রামে উনার নাম গপ্পের বুড়ি নামে খ্যাত ছিলেন।যদিও পুরো গ্রাম উনার এই খ্যাতিমান নাম টা জানলেও উনি আজ অবধি বোধহয় নিজের এতো সুন্দর নাম টা জানতে পারলেন না।উনি হঠাৎ হঠাৎ নিজের আর নিজের পরিবার নিয়ে এমন এমন গল্প বানিয়ে ফেলতেন যে সবাই তাজ্জব বনে যেতো।মিথিলা আপুকে দেখে আমার সেই গপ্পের বুড়ির কথা মনে পরে গেলো।

খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি সিরিয়ালের কুচুটে ননদ গুলোর মতোই এই মিথিলা আপুও আমাকে নানাভাবে অপদস্ত করার জন্য উঠে পরে লেগেছে।আমি বাবার একমাত্র মেয়ে আর মা তো জন্মের পরই নিখোঁজ হয়ে গেলো।তাই ভেবেছিলো আমি বোধহয় তার মতোই কোনো রান্নাবান্না কিছুই পারবো না।তাই তো আজ এই চাল টা চাললো।আর কি বজ্জাত মহিলারে বাবা আমার রান্নাটা নিজের রান্না বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলো।ভাগ্যিস রোকেয়া চট করে গিয়ে হাঁটে হাড়ি ভেঙ্গেছিলো নাহলে না জানি আমিই আজ এর কি দশা করতাম।আমি ততোক্ষণই শান্তশিষ্ট নম্র ভদ্র থাকবো যতোক্ষণ আমার সাথে বাড়াবাড়ির সীমানাটা পার না করবে।কিন্তু তার বেশি হলে তো আমি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারবো না।নেহাৎই আসার সময় বাবা বলেছিলো আমার কোনো কাজে জেনো বাবার মুখ না কালো হয়।নাহলে এতোদিনে বুঝিয়ে দিতাম এই আলমুন কি জিনিস। তবে আমার কুচুটে ননদকে বেশিদিন এ বাড়িতে থাকতে দেওয়া যাবে না নাহলে আমাকেই কোনদিন বাড়ি থেকে আউট করে আমার জায়গায় রাত্রী নামক আমবস্যা কে বসিয়ে দেয় আল্লাহ মালুম।তবে তুরের জন্য খারাপ লাগছে ছেলেটা বড্ড ভালো। ছেলেটার জন্য মায়া লাগে এখন তো একদম আমার নেউটা হয়ে গেছে।সারাক্ষণ পুতুল মামী পুতুল মামী করতে থাকে।ছেলেটাকে আমার খুব ভালোই লাগে।

তুরের কথা ভাবতে ভাবতেই মুচকি হাসলাম।এরমধ্যেই দরজা খোলার শব্দে দরজার দিকে ঘুরতেই শুভ্রকে ঘরে ডুকতে দেখলাম।আমার বারবার এসে দাঁড়ালেন।

” এই মেয়….শুভ্র মুখ খুলে এইটুকু বলেই আবার মুখ বন্ধ করে নিলেন।কারণ জানেন এই শব্দ টা ব্যবহারের ফল কি হবে।আমি মুখে গম্ভীর্য ভাব বজায় রাখলেও মনে মনে হেঁসে কুটি কুটি হচ্ছি।

” তোমার স্টাডি কতো দূর পর্যন্ত এসেছে। দেখে তো মনে হয় না স্কুলের গন্ডিও এখনো পাড় হতে পেরেছো বলে।” আমার পা থেকে মাথা অবধি আপাদমস্তক একটা পরক করে বললেন।

আমি রাগে কটমট করতে করতেই বললাম ” আমি অনার্স থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট!আপনার কোন দিক দিয়ে মনে হলো আমি স্কুলে পড়ুয়া?”

” তুমি এখনো স্টুডেন্ট! স্টাডি কমপ্লিট না করতেই বিয়ের পিরিতে বসে পরলে?অবশ্য তোমার কি দোষ গ্রামের মানুষের মেন্টালিটিই তো এমন।”প্রথম কথা গুলো অবাক হয়ে বললো আর শেষের টা তাচ্ছিল্যের সুরে।

শুভ্রের এমন রিয়াকশন দেখে আমি বেকুব বনে গেলাম।এখানে এতোটা অবাক হওয়র কি আছে?যেমন রিয়াকশন দিলো জেনো আমি বাল্যবিবাহ করলাম।শেষের কথাটা খুব গায়ে লাগলো।হ্যা মানলাম গ্রামের দিকে সত্যি সত্যি অনেক মেয়েকে আঠেরো পেরোনোর বহু আহেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।তাই বলে একটা বাইশ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে দেওয়া নিয়ে গ্রামকে এভাবে কথা শুনাবে।তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম।

” একটা বাইশ বছরের মেয়ের বিয়ে নিয়ে আপনি কি করে গ্রাম নিয়ে বাজে মন্তব্য করলেন।গ্রামে থাকি বলে এটা ভাববেন না কিছুই জানি না এই আপনাদের শহরে ভার্সিটির কয়টা মেয়ে অবিবাহিত বলেন তো?ভার্সিটি বাদ ইন্টারমিডিয়েটেই তো অবিবাহিত মেয়ে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর শুধু গ্রামে না আপনাদের এই শহরেই অনেক বাল্যবিবাহ দেখা যায়।”এক টানা বলে অবশেষে একটা নিশ্বাস নিলাম।

শুভ্র আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার নিশ্বাস নেওয়া শেষ হলেই বলে উঠলেন,

” ভাষাণ শেষ? নাকি আরো আছে?”ভাব শীল ভাবে বললেন কথাটা।ইচ্ছে তো করছিলো আরো দু’চারটে কটু কথা শুনিয়ে দেই কিন্তু এখন আর সম্ভব না একটানা বলার ফলে হাঁপিয়ে গেছি।তাই শুধু ভ্রু কুঁচকেই তাকিয়ে রইলাম মুখ খুললাম না।আমাকে চুপ থাকতে দেখে নিজে মুখ খুললো,

” কোন জায়গায় ভর্তি আছো এখন?”

” আমাদের ওখানকার একটা কলেজ।” সোজাসাপ্টা উত্তর দিলাম।

” ওকে কাল তোমার কলেজ থেকে ট্রান্সফার করিয়ে এখানকার একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেবো।”

” লাগবে না ”

” তোমরা মেয়েরা এতো কম কমনসেন্সেন নিয়ে ঘোরো কেনো বলো তো?বিয়ে মানেই আর নিজেদের ক্যাড়িয়ার লাগে না তোমাদের…”

” ও হ্যালো আমি আপনাকে কখন বললাম যে আমার পড়াশোনা এখানেই সমাপ্তি ঘটালাম।আমি বলছি ট্রান্সফার করে এখানে আনার প্রয়োজন নেই আমি আমার আগের কলেজ থেকেই পড়তে পারবো।আমার জন্য আপনার এতো কিছু করা লাগবে না।”দাঁতে দাঁত চেপে কোনোরকমে বললাম।

” আমিও না নিজ ইচ্ছায় তোমার জন্য কিছু করছি না।বাবার কথায় বাধ্য হয়ে তোমার মতো বাচালের সঙ্গে কথা বলতে আসলাম।”এইটুকু বলেই বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

আর এইদিকে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।লোকটা আমায় বাঁচাল বলে চলে গেলো!এই প্রথমবার আমাকে কেউ এই উপাধি দিলো।স্কুল জীবন থেকে শুরু করে কলেজ জীবন অবধি যেই আমি কথা কম বলার জন্য সবার থেকে সুনাম পেতাম সেই আমিকেই বাঁচাল বলে গেলো।নিজেই তো একটা বাঁচাল আবার আমাকে বলতে আসছে।এতোদিন জানতাম শুধু ঘাড়ত্যাড়া এখন বুঝতেছি ঘাড়ত্যাড়ামি ঝগড়ুটে আর বাঁচাল তিনটে জিনিসই ভরপুর।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here