#অনপেখিত
#পর্ব_২৬
লিখা: Sidratul Muntaz
চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে ঠোঁট পুঁড়ে গেল ফারদিনের। সেই ঠোঁটে আঙুল দিতে গিয়ে সিগারেটের খোঁচায় আঙুলটাও পুড়ে গেল! তার একহাতে চায়ের কাপ,অন্য হাতে সিগারেট ছিল। টেনশনে এই অবস্থা হচ্ছে। সে খুব অন্যমনস্ক হয়ে আছে। মনটা খারাপ। মেহেকের আনন্দিত কণ্ঠ শোনা গেল,
” আপনি কোথায়?”
বারান্দা থেকে জবাব দিল ফারদিন,” এইতো, বারান্দায় আছি।”
মেহেক বারান্দায় ছুটে এলো। ওর চেহারাটা কি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে! ফারদিনের ভেতরটা যেন একটু একটু করে অন্ধকারে ছেঁয়ে যাচ্ছিল। ওই মুখের উজ্জ্বল হাসিটুকু ধরে রাখার সামর্থ্য যে তার নেই! মেহেকের কণ্ঠে খুশির ফোয়ারা,
” উর্মিদের ঘরে গিয়েছিলাম। হোসনেয়ারা চাচী আম্মার জন্য আচার রেখেছেন। সেগুলোই নিয়ে এসেছি৷ এখন প্যাকেট করবো। জানেন, আম্মা কিন্তু এই আচার খুব পছন্দ করেন। আগে যতবার এখানে আসতেন, আলাদা ব্যাগ ভরে শুধু আচারই নিয়ে যেতেন। আম্মার সবচেয়ে পছন্দ তেতুলেরটা। আর আমি পছন্দ করি জলপাইয়ের মিষ্টি মোরব্বাটা। শাফায়েত আর শাফিনেরও খুব পছন্দ। ছোট চাচীর জন্যেও নিয়েছি। তিনি আবার আচার ততটা খান না। কিন্তু আমি নিয়ে এসেছি শুনলে নিশ্চয়ই খাবেন।”
মেহেক হাসল। চোখেমুখে তার আনন্দ ঝরে পড়ছে। কতদিন পর মেহেকের এই চাঞ্চল্যতা আবার খুঁজে পেয়েছে ফারদিন। মেয়েটা কষ্ট ভুলে আবার হাসতে শিখেছে। এই মুহুর্তে তার নিষ্পাপ মুখের ওই হাসিটুকু কেড়ে নেওয়ার মতো নিষ্ঠুর কাজ ফারদিন করতে পারবে তো? ফারদিন মলিন মুখে জিজ্ঞেস করল,” তুমি কি এখন থেকেই ব্যাগ গুছানো শুরু করেছো মেহেক?”
” হ্যাঁ! কাল সকালে উঠেই রওনা হবো না? এখন না গুছালে আর কখন গুছাবো? পরে তো সকালে তাড়াহুড়া হয়ে যাবে। আপনিও গুছিয়ে নিন সব। আচ্ছা, আমরা কি গাড়িতে করেই যাবো? নাকি বাসে? আমার না বাসে চড়ে লং জার্নি করতে খুব ভালো লাগে!”
মেহেক দুই হাত একত্র করে খুশি খুশি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওই তাকানো দেখে ফারদিন বুকে একটা সুক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করল। নাহ, সত্যি কথাটা বলার সাহস পাচ্ছে না সে। ইশশ, মেয়েটার মন একদম ভেঙে যাবে৷ কান্নাকাটিও শুরু করতে পারে। মেহেক যেই বাচ্চাসুলভ, নিশ্চয়ই কেঁদে ফেলবে। ফারদিন ওই কান্না কিভাবে দেখবে সেটাই ভাবছে। তার বুকের সুক্ষ্ম ব্যথাটা তীক্ষ্ণ হয়ে যাচ্ছে। ফারদিনকে নিশ্চুপ দেখে মেহেক ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,
” উত্তর দিচ্ছেন না কেন? প্লিজ চলেন না আমরা বাসে যাই? গাড়িতে আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া সারারাস্তা আপনি আমার পাশে বসে শুধু ড্রাইভ করবেন, আপনার হাত ব্যথা করবে এসব দেখতেও আমার ভালো লাগবে না। এর চেয়ে বাসে যাওয়া কত্ত মজা।”
” আমরা বাসে চলে গেলে গাড়ির কি হবে? গাড়ি কোথায় থাকবে?”
” গাড়ি গ্যারেজেই থাকবে! আমরা তো আবার এখানে ফিরবোই তাই না? নাকি আপনি গ্রাম থেকে সোজা ঢাকায় ফিরে যেতে চাইছেন?”
ফারদিন উশখুশ করে বলেই ফেলল,” আমরা ঢাকাতেই যাচ্ছি মেহেক। গ্রামে যাচ্ছি না। ”
মেহেকের চেহারার হাসি হাসি ভাবটা সত্যি মুছে গেল। বাড়ল ফারদিনের বক্ষচাপ। মেহেক জিজ্ঞেস করল,” কেন?”
ফারদিন অপরাধী কণ্ঠে বলল,
” আম্মু আমেরিকা থেকে চলে এসেছে। আজ সকালে বাড়িতে এসেছিল আমাদের সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমাদের তো পায়নি। তখন থেকেই ফোন করে যাচ্ছিল। আমি জরুরী নয় ভেবে কেটে দিচ্ছিলাম। তুমি উর্মিদের ঘরে যখন গেলে তখন আবার আম্মু ফোন করেছিল৷ বলেছে তোমাকে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ঢাকায় ফিরতে। তাই আজকে রাতে আমরা ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি। আই এম স্যরি মেহেক। তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে পারলাম না। প্লিজ মনখারাপ করো না পিচ্চি।”
মেহেক কোনো উত্তর না দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। ফারদিনের বুকের চাপটা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সে হাত থেকে সিগারেট ফেলে চায়ের কাপ রেখে মেহেকের সামনে এসে দাঁড়াল। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আকুল গলায় বলল,
” এই মেয়ে, শোনো আমি কি বলি, এখন যদি আমি তোমাকে নিয়ে তোমার গ্রামে চলে যাই তাহলে আম্মু মাইন্ড করতে পারে। আমি চাই না প্রথমেই তোমার প্রতি আম্মুর কোনো নেগেটিভ আইডিয়া তৈরী হোক। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো মেহেক? প্রমিস করছি, পরের সপ্তাহেই সবকিছু ম্যানেজ করে তোমাকে গ্রামে নিয়ে যাবো। কিন্তু কাল যাওয়া হচ্ছে না। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ। রাগ করেছো?”
মেহেক ফিক করে হেসে দিল। ফারদিন যেন কিঞ্চিৎ অবাক। মেহেক খুব মজা পেয়েছে এমনভাবেই হাসতে হাসতে বলল,
” আপনি আমাকে কি মনে করেন? আমি কি অবুঝ বাচ্চা যে এইটুকু বিষয় নিয়ে কেঁদে ভাসাবো? তাছাড়া এখানে মনখারাপের কি আছে? আমার তো আরও খুশি লাগছে এই ভেবে যে প্রথমবার মায়ের সাথে দেখা হবে! আমি খুব এক্সাইটেড! আচ্ছা, এই কথাটা আপনি আগে বলতে পারলেন না? আর মনখারাপ তো দূরের কথা, এখন আমাকে জোর করে কেউ গ্রামে উঠিয়ে নিয়ে গেলেও তো আমি যাবো না! আমার শাশুড়ী মা এতোদিন পর দেশে এসেছেন, তাঁর সাথে দেখা না করে আমি কি-না গ্রামে চলে যাবো? এটা কি হয় বলুন? আজকে আমরা ঢাকাতেই যাচ্ছি। আর আমার ভুলেও মনখারাপ হয়নি। বরং আমি দ্বিগুণ খুশি। আচ্ছা, মা কি আচার খেতে পছন্দ করেন? তাহলে মায়ের জন্যেও কয়েক বয়াম নিয়ে যাবো। কি বলেন?”
ফারদিন মেহেকের কথাগুলো হেসে দিল। মনে হলো যেন বুক থেকে পাথর সরে গেল তার। অদ্ভুত এই স্বস্তিটুকু উপহার দেওয়ার আনন্দে সে মেহেকের চিকন কোমড় দুই হাতে জাপটে ধরে তাকে উপরে তুলে ফেলল। মেহেক হালকা আতঙ্কিত হয়ে বলল,” ওমা, এটা কি করছেন?”
ফারদিন তাকে দেয়ালের কাছে নিয়ে ঠেস দিয়ে তারপর মুখের উপর ঝুঁকে কপালে কপাল ঠেঁকাল। মেহেক ফারদিনের কান্ডে জোরে হেসে ফেলল। দু’জনেরই নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছিল। ফারদিন কোমল গলায় বলল,” এই পিচ্চিটা, আই লভ ইউ।”
মেহেক ছলছল দৃষ্টিতে বলল,” আই লভ ইউ টু!”
তারপর ফারদিনের গলার পেছনে হাত রেখে গালে খুব আদর নিয়ে একটা চুমু দিল। ফারদিন বেসামাল হয়ে পড়ল। মেহেকের ঠোঁট দু’টো দীর্ঘসময়ের জন্য নিজের দখলে নিয়ে গেল। মেহেক মোহাচ্ছন্নের মতো চোখ বন্ধ করে দুইহাতের মুঠোয় ফারদিনের টি-শার্ট খামচে ধরল। সিগারেটের উৎকট গন্ধেও যে এতো ভালো লাগার অনুভূতি থাকতে পারে সেটা তো মেহেক আগে জানতো না! এখন তার সত্যিই অপরিসীম শান্তি লাগছে। একটু আগে ফারদিনকে বলা তার প্রতিটি কথাই ছিল মিথ্যে। সেটা ফারদিন হয়তো কখনও জানবে না। গ্রামের বাড়ি যাওয়া হলো না বলে মেহেকের আসলেই খুব মনখারাপ হয়েছে। সে একটু আগে উর্মিদের ঘরে গিয়ে আম্মাকে ফোন করেছিল। আম্মা যখন শুনলেন মেহেক কাল সকালে আসছে তখন খুশিতে কেঁদেই ফেলেছিলেন। মেহেকও মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে অনেক বার চোখ মুছেছে। এই কয়েকদিন ধরে সে তার মাকে অনেক বেশি মিস করছিল। মেহেকের আব্বা নাকি মাঝে মাঝেই ভুল করে মেহেকের ঘরে চলে যান। মেহেকের জন্য নাকি কাল সন্ধ্যায়ও জিলাপি নিয়ে এসেছিলেন। বৈঠকঘরে বসে যখন তিনি মেহেকের নাম ধরে ডাকছিলেন তখন দাদী মনে করিয়ে দিলেন,” মেহেক তো শ্বশুরবাড়ি।” সাথে সাথেই মোজাম্মেল শাহের চোখ ভিজে গেল। এসব কথা শুনে মেহেকের এতো মন পুড়ছে সবার জন্য! সবকিছু ছেড়ে ছুটে চলে যেতে মন চাইছে গ্রামে। কিন্তু ফারদিনকে কষ্ট দিতে পারবে না সে। জীবন চলে গেলেও না। নিজের যত কষ্টই হোক, সে ফারদিনকে সবসময় খুশি রাখবে। তাই মেহেক আম্মাকে ফোন করে জানিয়ে দিল, আগামীকাল সকালে তারা গ্রামে আসছে না। আম্মা যাতে কষ্ট না পান।
উর্মি-উজানের থেকে বিদায় নিতে যাওয়ার সময় উর্মি মেহেককে ধরে কেঁদেই ফেলল। মেহেক উর্মির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” এই পাগলী, আমি কি একেবারের জন্য চলে যাচ্ছি? আরও কতবার আসবো। এই বাড়িটা তো আমারই৷ আমার বাড়িতে আমি আসবো না?”
উর্মি দুঃখ ভরা গলায় বলল,” আপনার কথা খুব মনে পড়বো আপা।”
” আমারও। খুব মনে পড়বে তোদের কথা। ভালো থাকিস।”
এরপর জামাল চাচা আর হোসনেয়ারা চাচীর দোয়া নিতে মেহেক আর ফারদিন এগিয়ে গেল। হোসনেয়ারা চাচী মেহেকের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” সাবধানে যাইয়ো৷ সব গুছায় নিসো তো ঠিকমতো? ”
” জ্বী চাচী। সব ঠিকাছে।”
ফারদিন বলল,” দোয়া রাখবেন চাচী। চাচা, যাই।”
চাচা বললেন,” আচ্ছা, আচ্ছা, তোমরা কি বাসেই যাইবা?”
” জ্বী।”
” তাহলে গাড়ি?”
” গাড়ি আপাতত গ্যারেজেই থাকুক। পরে কাউকে পাঠিয়ে নিয়ে যাবো।”
” ঠিকাছে।”
ওরা যখন সিএনজি’তে উঠলো তখন রাত সাড়ে নয়টা বাজে। মেহেকের আবদার রাখতেই বাস জার্নি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফারদিন। সে নিজেও অনেকবছর ধরে বাসে চড়ে না। বাস জার্ণির স্বাদ তো ভুলতেই বসেছিল। মেহেকের গাঁয়ে একটা সবুজ রঙের সুতির লেহেঙ্গা। লেহেঙ্গার ওরনাটা বেশ বড় হওয়ায় সে হিজাবের মতো মাথায় বেঁধে পুরো শরীরে জড়িয়ে রেখেছে। একদম কোমড় পর্যন্ত। ফারদিন এই অবস্থা দেখে হেসে জিজ্ঞেস করল,” তোমার গরম লাগে না?”
মেহেক ভ্রু কুচকে বলল,” গরম লাগবে কেন?”
ফারদিন একহাতে মেহেকের বাহু ধরে কাছে এনে বলল,” এমনি বললাম। সুন্দর লাগছে।”
” থ্যাঙ্কিউ। ”
মেহেককে কাউন্টারে বসিয়ে টিকিট কেটে আনল ফারদিন। সেগুলো মেহেকের হাতে দিয়ে বলল,” নাও ব্যাগে রাখো। বাস আসবে এগারোটায়। আর তুমি কি কিছু খাবে?”
” না। ডিনার তো করেই এসেছি। ক্ষিদে পায়নি।”
” বাসে উঠলে যদি পায়? আগে থেকেই কিনে রাখি।”
” উমম, তাহলে চিপস, চকলেট অথবা আইসক্রিম। এই তিনটার মধ্যে কিছু একটা।”
ফারদিন হেসে বলল,” আচ্ছা, তিনটাই আনবো। বসে থাকো।”
ফারদিন চলে যাওয়ার পর মেহেক একা বসে আশেপাশের পরিবেশ দেখতে লাগল। একটা এলইডি টিভি চালিয়ে রাখা হয়েছে। এ ধরণের টিভি যেগুলো কোলাহলপূর্ণ জায়গা থাকে সেগুলোতে সচরাচর সাউন্ড শোনা যায় না। কিন্তু এই টিভিতে যাচ্ছে। কারণ এখানে কোলাহল তেমন নেই। এয়ারকন্ডিশন যুক্ত কাউন্টার হওয়ায় সবকিছু অনেকটাই শান্ত। মেহেকের থেকে দুই চেয়ার দূরে একজন বৃদ্ধ বসে ম্যাগাজিন পড়ছেন। সামনে একজন ভূড়িওয়ালা বসে তখন থেকে খেয়ে যাচ্ছে। কাউন্টারে যেন সে খেতেই এসেছে। বেশিরভাগ মানুষের হাতে ফোন। মেহেকেরও খুব শখ, তার একটা নিজের মোবাইল থাকবে। কিন্তু সে সারাক্ষণ টিপবে না। মাঝে মাঝে শখের মোবাইলটা বের করে দেখবে তারপর আবার রেখে দিবে৷ মেহেক হঠাৎ খেয়াল করল, এক জোড়া চোখ তাকে অনেকক্ষণ ধরে পরোখ করছে। অর্থাৎ চোখজোড়া এক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। মুখ ছাড়া মেহেকের দেহের অন্য কোনো অংশ দৃষ্টিগোচর না। মেহেকের মনে হয়, এখন থেকে মুখটাও ঢেকে রাখা উচিৎ। সে ব্যাগ থেকে ফেস মাস্ক বের করে পড়ে নিল। এবার সে দেখবে, খবিশটা কোথায় তাকিয়ে থাকে। ওই লোকের পাশে আরও দুইজন বসে আছে। একজন বোরখা পরিহিত মহিলা ও তার সাথে নয়-দশ বছরের একটা পিচ্চি মেয়ে। মেয়েটা খুব মিষ্টি দেখতে। তখন থেকে হাত-পা নেড়ে কথা বলছে। ওর হাতে একটা স্যামসাং এর ট্যাব। ট্যাবে গেইম খেলতে খেলতেই সে মায়ের সাথে নানান বিষয়ে কথা বলছে। মেহেকের ওর কথাগুলো শুনতে ভালোই লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ মা তার মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন,
” এই ফাইজা, চুপ করে বসো। এতো কথা কিসের? আর তোমার ওরনা কোথায়? নাও ওরনা পড়ো৷ ”
ওরনা পড়ার কথাটা ফাইজার বোধহয় খুব পছন্দ হলো না। সে মুখ গোঁজ করে ফেলল। মা যখন ওর গাঁয়ে ওরনা জড়িয়ে দিলেন ও তখন গাঁ ঝাঁড়া দিয়ে ওরনাটা ফেলে দিল। ভদ্রমহিলা চোখ বড় করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেহেক মনে মনে হাসছিল। আহারে, ছোটবেলায় তারও এমন রোগ ছিল। ওরনা পড়তে চাইতো না৷ এজন্য মায়ের কাছে কত বকা খেত! মেহেক হাতের ইশারায় ফাইজাকে নিজের কাছে ডাকল। ফাইজা উৎসাহী দৃষ্টিতে মেহেকের দিকে তাকালো। মেহেক বলল,” এদিকে এসো।”
ফাইজা ওর মায়ের দিকে একবার তাকাল। ভদ্রমহিলা অনুমতি দিলেন। তারপর ফাইজা ধীরপায়ে হেঁটে এসে বসলো মেহেকের পাশে। সে ক্রমাগত জিহ্বা দিয়ে তার সামনের ঠোঁট ঠেলছে। মেহেক আদুরে গলায় বলল,” নাম কি তোমার?”
” ফাইজা সুলতানা তাম্মি।”
” খুব সুন্দর নাম। আমাকে চেনো?”
ফাইজা দুইপাশে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ চেনে না। মেহেক হেসে বলল,” মনে করো আমি তোমার একটা আপু। মেহেক আপু।”
” আচ্ছা, আসসালামু আলাইকুম আপু।”
” ওয়া আলাইকুম আসসালাম। কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?”
” ক্লাস থ্রি।”
” মাশাল্লাহ। তাহলে তো অনেক বড় হয়ে গেছো। মা যে তোমাকে ওরনা পড়তে বলে, তুমি পড়ো না কেন? ওরনা পড়লে তো তোমাকে অনেক সুন্দর লাগে।”
ফাইজা নাক ছিটকে বলল,” ছি!”
” ছি এর কি আছে? ওরনা জিনিসটা কি খারাপ?”
” আমার এতোবড় ওরনা পড়তে ভালো লাগে না। আমি সামলাতেও পারি না।”
” সামলানো তো শিখতে হবে। এটাই তো মেয়েদের প্রধান কাজ।”
” কিন্তু ওরনা পড়লে তো আমাকে একটুও সুন্দর লাগে না। কেমন জানি বুড়ি বুড়ি লাগে।”
” শোনো আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলি, এইযে তোমার ট্যাবের ডিসপ্লে। এটার উপর পাতলা জিনিসটা কি?”
” এটা হলো গ্লাস প্রটেক্টর।”
” আমি যদি বলি জিনিসটা ভালো লাগছে না। খুলে ফেলে দাও৷ তাহলে কি তুমি খুলে ফেলবে?”
” না।”
ফাইজা এই কথা বলেই তার স্বভাবসুলভ কাজটা করল। অর্থাৎ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ঠেলল। মেহেক বলল,” কেন খুলবে না?”
” এটা খুলে ফেললে ডিসপ্লেতে অনেক প্রবলেম হবে। হাত থেকে পড়লেই ফেটে যাবে। তাড়াতাড়ি নোংরা হয়ে যাবে।”
” একজাক্টলি। কারণ ট্যাবের মধ্যে এই ডিসপ্লে জিনিসটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্যই এটা সবসময় প্রটেক্ট করে রাখতে হয়। মেয়েদের জন্য ওরনাটাও ঠিক তেমনি গ্লাস প্রটেক্টর। ”
” কেন? মেয়েরা কি ট্যাবের ডিসপ্লে?”
” না। তবে ডিসপ্লের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ”
” তাহলে ছেলেরা কি গুরুত্বপূর্ণ না?”
” ছেলেরা হলো তোমার ট্যাবের ব্যাকসাইডের মতো। এর কাজও তোমার ডিসপ্লেটাকেই প্রটেক্ট করা। ব্যাকসাইডের গাঁয়ে নোংরা লাগলেও সেটা মুছে ফেলা যায়। কিন্তু একবার যদি ডিসপ্লেতে নোংরা লাগে সেটা আর মোছা যায় না। আশা করি তুমি আমার কথা বুঝতে পেরেছো।”
ফাইজা কতক্ষণ তার ট্যাবের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,” মানে ছেলেদের কাজ মেয়েদের প্রটেক্ট করা? আর মেয়েরা নিজেদের প্রটেক্ট করতে পারে না?”
” অবশ্যই পারে। কিন্তু নিজেদের প্রটেক্ট করাই মেয়েদের প্রধান কাজ না। যেমন ডিসপ্লে’র কাজ শুধু নিজেকে প্রটেক্ট করা না। তার এছাড়াও অনেক গুরুদায়িত্ব আছে। এই ডিসপ্লে না থাকলে তো তোমার ট্যাবটাই অকেজো হয়ে যেতো। এই ডিসপ্লেকে সারাদিন কত কাজ করতে হয় বলোতো? সব মিলিয়ে নিজের প্রটেকশন করা কি ডিসপ্লে’র একার পক্ষে সম্ভব? এজন্যই আমরা গ্লাস প্রটেক্টর লাগিয়ে ডিসপ্লেটা প্রটেক্ট করে রাখি৷ এটা তো আমাদের দায়িত্ব। তেমনি ছেলেদেরও দায়িত্ব, মেয়েদের সম্মান করা, প্রটেক্ট করা৷ তার মানে কিন্তু এই না, যে মেয়েরা দূর্বল। তারা কিছু পারে না। তারা আসলে অনেক দামী। আর দামী জিনিসেরই প্রটেকশন লাগে। যেমন একজন মন্ত্রীর পিছে হাজারটা কর্মচারী থাকে তাকে রক্ষা করার জন্য। তার মানে কি মন্ত্রীসাহেব দূর্বল? একদমই না।”
ফাইজা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে। মেহেক বলল,” শোনো আপু, ওরনা পড়া কোনো লজ্জার কাজ না। এটা গর্বের কাজ৷ এটার মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় তুমি নিজেকে কতটা দামী মনে করো৷ তুমি যতটা দামী তোমার নিরাপত্তাও ততটা বেশি।”
ফাইজা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” আগে আম্মুর থেকে ওরনাটা নিয়ে আসি। তারপর তোমার কথা শুনবো।”
মেহেক হেসে ফেলল। ফাইজাকে বুঝাতে পেরে তার খুব ভালো লাগছে। কিন্তু জীবনে প্রথম ধর্ষিত হওয়ার স্মৃতি মনে করে তার ততটাই খারাপ লাগছে। ইশশ, যদি ফাইজার মতো করে তাকেও কেউ বোঝাতো৷ মেহেক কিন্তু রাজ আহমেদের কাছে একবার ধর্ষিত হয়নি। হয়েছিল বার-বার। ওই নরপশু প্রত্যেকবার চোখ দিয়েই ধর্ষণ করেছে মেহেককে। একদম প্রথম যেদিন সে মেহেককে দেখল সেদিনই চোখ দিয়ে বার-বার নিগড়ে নিয়েছিল। ধর্ষণ করেছিল। শুধু শারীরিকভাবে স্পর্শ করলেই কি ধর্ষণ হয়? চোখ দিয়ে যে কুনজর, মনের মধ্যে তার শরীরটা নিয়ে খারাপ চিন্তা পোষণ সেটাই বা ধর্ষণের থেকে কম কি? আমরা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই তখন কত শত মানুষরূপী জন্তু জানোয়ার আমাদের কল্পনায় ধর্ষণ করে৷ আমরা কি তা আদৌ জানতে পারি? এজন্য সবসময় উচিৎ শালীন পোশাকে রাস্তায় চলা-ফেরা করা। তাহলে অন্তত চোখের সেই ধর্ষণ থেকে বেঁচে থাকা যাবে। বোকা মেয়েরা এইসব বোঝে না। তারা পোশাক পরিচ্ছদেও নিজেদের স্বাধীনতা খুঁজে বেড়ায়। খোলা-মেলা পোশাক পড়ে নরপশুদের মনোরঞ্জনের কারণ হয়। মেহেকের বড্ড আফসোস। কবে মেয়েরা বুঝবে? কবে সুদিন আসবে? তার যে আর কিছুই ভালো লাগে না!
চলবে
( ছোটবেলায় কিছুটা গুলুমুলু ছিলাম। মানুষ খুব খারাপ দৃষ্টিতে তাকাতো। বয়স তখন নয় কি দশ। আমি মানুষের তাকানোর ভয়ে তটস্থ থাকতাম। সবচেয়ে বেশি অবাক লাগতো, যখন পরিচিত মানুষগুলোই নিকৃষ্ট নজরে তাকাতো। আমি ভয়ে তাদের সামনে যেতাম না। নিজে থেকেই ওরনা পড়া শুরু করলাম। ওরনা মাথায় দিয়ে শরীর ঢেকে রাখতাম। ওরনা পড়া মানেই পরাজয় না। এটা ছিল কুনজরকারীদের প্রতি উচিৎ জবাব। আম্মু হেসে বলতো, তুই এভাবে ওরনা পড়ে হুজুর সেজেছিস কেন? গরম লাগে না? আমি উত্তর দিতাম না। তবে সবসময় বড় বড় ওরনা পড়তাম। সমবয়সীরা খালাম্মা বলেও পঁচাতো। আমি পাত্তা দিতাম না৷ আমার সম্মান আমার কাছে অনেক বড় ছিল। হিজাব পড়ার অভ্যাসটাও এভাবেই তৈরী হয়।)