অনপেখিত পর্ব ২৫

#অনপেখিত
পর্ব_২৫
লিখা: Sidratul Muntaz

মেহেক কান্না-টান্না মুছে অনেকক্ষণ পর বাথরুম থেকে বের হলো। এখন আর আগের মতো খারাপ লাগছে না তার। কি দরকার পুরনো স্মৃতিগুলো মনে করে কষ্ট পাওয়ার? খারাপ স্মৃতি মনে রাখতে নেই৷ তাই মেহেক ঠিক করেছে এখন থেকে আর ওইসব মনে রাখবে না। বর্তমান নিয়েই সে এখন অনেক সুখী, বিজয়ী। তাহলে খারাপ অতীতের কাছে কেন নিজেকে পরাজিত করবে সে? কখনও করবে না। মেহেক বেরিয়েই দেখলো ফারদিন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পকেটে একহাত রেখে দেয়ালের সাথে এক হাত ঠেকিয়ে আনমনে কিছু একটা ভাবছে। মেহেক মনে মনে বলল,” আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সুদর্শন মানুষ! ”
সে গিয়ে বিছানায় বসলো। খাবারটা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে! আর মেহেক খেয়ালও করেনি,ফারদিন চা-ও বানিয়ে এনেছে। এইটা নিশ্চিত এতোক্ষণে সরবত হয়ে গেছে। মেহেক আগে ডিম থেকে টুকরো মুখে দিল। আর দারুণ একটা চমক পেল। খাবারটা এতো মজা হয়েছে!যে জীবনে কখনও রান্না করেনি তার পক্ষে এতো ভালো খাবার বানিয়ে ফেলা কিভাবে সম্ভব? তাহলে কি ফারদিনের কথাটাই সত্যি? ‘ Nothing is impossible in love!’
মেহেক নিজের মনেই হাসল। ফারদিনের দিকে চেয়ে বলল,” বাহ, ভালোই রান্না করেন আপনি। দারুণ হয়েছে এটা।”
ফারদিন মনখারাপের চোখে তাকাল একবার। এরপর পুনরায় জানালার দিকে চেয়ে বলল,” তুমি তখন কাঁদছিলে কেন?”
মেহেকের হাস্যজ্বল চেহারাটা মুহুর্তেই নিভে গেল। নিচু গলায় বলল,” এমনি।”
” এমনি না। তুমি কেন কেঁদেছো আমাকে জানতে হবে। বলো!”
মেহেকের আবার ওই বিষয়ে কথা বলতে অস্বস্তি লাগছে। সে বার-বার ফারদিনকে মনে করাতে চায় না যে সে একজন ধর্ষিতা! এতে যেমন ফারদিনের কষ্ট, তার নিজের আরও বেশি কষ্ট। মেহেক বলল,
” আম্মা-আব্বার কথা মনে পড়েছিল।”
” আমি তোমাকে চুমু দিলাম আর তোমার আম্মা-আব্বার কথা মনে পড়ে গেল? আশ্চর্য! ”
মেহেক এই কথার উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারল না। অপ্রতিভ স্বরে বলল,” কি জানি? হঠাৎ মনে পড়লে আমি কি করবো?”
মেহেকের কণ্ঠটা ভীষণ অসহায় শোনাল। ফারদিন স্বাভাবিক হয়ে বলল,
” আচ্ছা এদিকে এসো?”
মেহেক এগিয়ে গেল জানালার কাছে। ফারদিন মেহেকের বাহু স্পর্শ করে তাকে নিজের সামনে দাঁড় করালো। তারপর পেছন থেকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে মেহেকের মাথায় চিবুক ঠেঁকিয়ে বলল,
” চলো কালকে যাবো তোমাদের গ্রামে।”
মেহেক সাথে সাথে ফারদিকের দিকে ঘুরে তাকাল। চাপা উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,” সত্যি বলছেন?”
” হুম।”
” কালকে?”
” তুমি কি আজকে যেতে চাও? তাহলে আজকেই চলো।”
” না, না, কালকেই। সকাল সকাল রওনা হবো।”
ফারদিন মিষ্টি করে হেসে বলল,
” ঠিকাছে।”
মেহেকের এতো আনন্দ লাগছিল! কতদিন পর সবার সাথে দেখা হবে। ছোট খালামণিকেও ফোন করে তাদের বাড়ি আসতে বললে কেমন হয়? ছোট খালামণি আবার ফারদিনকে দেখার জন্য মুখিয়ে আছেন। বিয়েটা তো খুব তাড়াহুড়ায় হয়েছিল৷ তাও মেহেকের গ্রামে হয়নি। ফারদিনদের বাড়িতে ছোট্ট করে বিয়ের আয়োজন হয়েছিল। আব্বা খুব গোপনে এই বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। যাতে মেহেকের শ্বশুরবাড়ির কেউ তার অতীত সম্পর্কে জানতে না পারে। আর এখন তো ফারদিন সব জানে৷ তাই তাকে গ্রামে নিয়ে যেতেও কোনো অসুবিধা নেই। মেহেকের ভাবতেই ভালো লাগছে। এখন থেকে আর কোনো লুকোচুরি নেই। ফারদিন বলল,” বৃষ্টিটা তোমার মতো।”
” মানে? বৃষ্টি কে?”
মেহেক অবাক হয়ে জানতে চাইল। ফারদিন হেসে তাকাল। ওইসময় তাকে এতো সুন্দর দেখাল! ফারদিন হাসলে তার চোখ দুটি ছোট হয়ে আসে। অসম্ভব সুন্দর লাগে! তাছাড়া যারা খুব কম হাসে তাদের হাসিতে এমনিতেও একটা আলাদা অসাধারণত্ব থাকে। ফারদিনের হাসিতেও আছে। ফারদিন বলল,” বৃষ্টি কেউ না। আমি বাহিরে যে বৃষ্টি হচ্ছে সেই বৃষ্টির কথা বলছি। দেখো, কি এলোমেলো আর চঞ্চল! মনে হচ্ছে যেন কোনো চঞ্চলা কিশোরী নুপুর পায়ে দিয়ে মেঠোপথে নেচে বেড়াচ্ছে। কি যেন গানটা? আঁকাবাঁকা মেঠোপথে কোন রূপসী হেঁটে যায়। আমি এখানে মেহেক রূপসীকে দেখছি।”
মেহেকের ঠোঁটে আহ্লাদী হাসি ফুটে উঠলো। জানালায় তাকিয়ে দু’জনই বৃষ্টি দেখছিল। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যের মাঝে বৃষ্টির এই ছন্দময় নৃত্য কি চমৎকার লাগে। মেহেক হঠাৎ ফারদিনের গলা জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু দিল। তারপর আর দাঁড়ালো না। দৌড়ে বিছানায় গিয়ে গাঁয়ে কাঁথা নিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল। ফারদিন কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে রইল। তার বুকের হার্টবিট বেড়ে গেছে। খুব ঝকঝকে একটা অনুভূতি হচ্ছে। কি আশ্চর্য! কিছুদিন আগেও যে মেয়েটির বাচ্চামি দেখে বিরক্তিতে দীর্ঘশ্বাস আসতো এখন সেই মেয়েটির হালকা একটু চঞ্চলতাই ফারদিনকে এলোমেলো করার জন্য যথেষ্ট! ভাবতেই অবাক লাগে, এই মেয়েটিকে সে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস সেই ভুলটা করেনি। নয়তো সারাজীবন আক্ষেপ করতে হতো। সে কোথায় পেতো এই ভালোবাসা? এই মায়াবী,আহ্লাদী,চঞ্চলা মেয়েটিকে কোথায় পেতো? ফারদিন বিছানায় গিয়ে মেহেকের পাশে শুয়ে তাকে পেছন থেকে নরম করে জড়িয়ে ধরল। মেহেক চোখ বন্ধ করে ফেলল। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল। ফারদিন মেহেকের চুলে নাক ঘষছিল। কি মিষ্টি একটা সুভাষ! এই সুভাষ আগেও পেয়েছে সে। কিন্তু তখন এতো ভালো লাগেনি তো! ফারদিন মেহেকের কানের কাছে ঠোঁট রেখে আবিষ্ট কণ্ঠে বলল,” মেহেক, আই লভ ইউ।”
মেহেক বিছানার চাদর খামচে ধরল। চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। পরিতুষ্ট কণ্ঠে সে বলল,” আমার একটা কথা রাখবেন?”
” বলো।”
ফারদিনের কণ্ঠে ঘোর। মেহেক বলল,” প্রতিদিন ঘুমানোর আগে ঠিক এভাবেই আমাকে আই লভ ইউ বলতে হবে। নাহলে আমি ঘুমাবো না।”
ফারদিন হেসে ফেলল। মুখ তুলে মেহেকের দিকে তাকিয়ে তার কপালের চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিতে দিতে আদুরে গলায় বলল,” একদম পিচ্চি একটা! ঠিকাছে পিচ্চি, বলবো।”
মেহেক লজ্জা পেয়ে গেল। ধূর, এইটা কেমন আবদার করেছে সে? আবেগে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যা মনে এসেছিল তাই বলে ফেলেছিল। এখন খুব লজ্জা লাগছে। মেহেক অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,” সারারাত ঘুমাইনি। এখন আমার ঘুম আসছে।”
” ঠিকাছে ঘুমাও। আমি কি কপালে একটা চুমু দিবো?”
” যদি নিষেধ করি তাহলে কি দিবেন না?”
” নিষেধ করলেও দিবো।”
” তাহলে নিষেধ করলাম।”
ফারদিন হেসে মেহেকের কপালে চুমু দিল ছোট্ট করে। মেহেক ফারদিনকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ রেখে বলল,” আমি এভাবেই ঘুমাবো। একদম নড়বেন না কিন্তু।”
ফারদিন মেহেকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” ঠিকাছে প্রমিস করলাম। একটুও নড়বো না।”
পিচ্চি মেয়েটা কয়েক মুহুর্তেই ঘুমিয়ে গেল। আর ফারদিন চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছিল তাদের বিবাহিত জীবনের সূচনার কথা। একদম প্রথম যখন মেহেককে দেখেছিল সে। কত ছোট্ট একটা মেয়ে মনে হয়েছিল। বাসররাতে যখন জানতে পারল মেহেকের বয়স ষোল, তখন কি রাগটাই না উঠেছিল দাদুর উপর। দাদু কি ঠিক করে খোঁজটাও নিতে পারেনি? মেয়ের আসল বয়সটাও জানতে পারেনি? নাকি ইচ্ছে করে মিথ্যে বলেছিল? অপরিণত বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করার জন্য নিজেকে ভয়ংকর অপরাধী মনে হতো ফারদিনের। তারপর যখন সুজি এলো, শুরু হলো তার অভিমান, কান্নাকাটি, পাগলামী! বন্ধুরা পর্যন্ত ফারদিনকে দোষারোপ করছিল। তখন ফারদিনের মনে হচ্ছিল, সে দু’টো জীবন একসাথে নষ্ট করছে। সুজির জীবনটা যেমন তার জন্য নষ্ট হলো তেমনি মেহেকের জীবনটাও নষ্ট হচ্ছিল। না চাইতেও মেহেককে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছিল সে। এসব ভাবলেও এখন নিজের প্রতি বিরক্ত হয় ফারদিন। আচ্ছা, মেহেকের তো ক্লাস এইটের পর আর পড়ালেখা হয়নি। ফারদিনের উচিৎ তাকে আবারও লেখা-পড়ার প্রতি উৎসাহিত করা। নাহলে ভবিষ্যতে এটা নিয়ে মেহেকের খুব আফসোস হবে। ফারদিন মেহেককে সেই আফসোসটা করতে দিবে না। মোবাইল বেজে উঠলো। ফারদিনের মা আমেরিকা থেকে ফোন করেছেন। এখন কথা বলতে গেলে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় যেতে হবে। নাহলে নেটওয়ার্কের ঝামেলার কারণে কথা বলা যাবে না। কিন্তু মেহেক তো তার বুকের উপর ঘুমাচ্ছে। এমনভাবে ঘুমাচ্ছে যে তাকে ডাকতেও ইচ্ছে করছে না। ফারদিন একবার ভাবল মেহেকের মাথাটা আস্তে করে তুলে বালিশে রেখে সে উঠে যাবে। কিন্তু ফারদিন তো প্রমিস করেছিল, সে নড়বে না।পরে যদি মেহেক জেগে দেখে ফারদিন পাশে নেই তখন কি কষ্ট পাবে? আসলে এই ছোট্ট মেয়েটা তার অল্প পরিসরের জীবনে এতো বেশি কষ্ট পেয়েছে যে তাকে আর একফোঁটাও কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না। ফারদিন তার মায়ের ফোন কেটে দিল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here