#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#পর্ব___২৯
#কায়ানাত_আফরিন
[রিচেক করা হয়নি। ভুলক্রুটিগুলো ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।]
বিকেলে কোচিং শেষ করে বাসায় ফেরার পথে রৌশিনের আরও একবার দেখা হলো ফাহিমের সাথে। এতে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো রৌশিন। কেননা রাস্তায় সাইকেল থামিয়ে মারুফ আর সে রীতিমতো মারামারি না করলেও হাতাহাতি করছিলো। মূল বিষয় ছিলো এটি যে আসলেই সাব্বির ভাই আর ইলার প্রেমের সম্পর্কের আদৌ কোনো পূর্ণতা পাবে কি-না। আর একজন কলেজে পড়ুয়া মেয়েকে যদি রাস্তাঘাটে সমানতালে নিজের সমবয়সী ছেলের সাথে মারামারি করতে দেখা যায় তাহলে সেটা কেউ তৃপ্তিকর নজরে দেখতে চাইবে না। অনেকে হয়তো ওদের পবিত্র বন্ধুত্বের সম্পর্কটিকে নোংরা বানিয়ে ছাড়বে।
অদ্ভুতভাবে এমন কিছুই করলো না ফাহিম।বরংচ ওদের দুজনকে এভাবে দখে হেসে দিলো। সে কি অমায়িক হাসি।খালের ওপর দিয়ে সুন্দর একটি সেতু। নিচ দিয়ে পাহাড়ি পানি বয়ে নদীর সাথে মিশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। গোধূলীর লালচে আকাশের প্রতিরশ্নিটা ফাহিমের ফর্সা মুখমন্ডলে পড়াতে রৌশিনের চোখ কেমন যেন ধাধিয়ে উঠলো। রৌশিন মিহি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘আপনি হঠাৎ এই রাস্তায়?’
-‘তোমার ভাইয়ের কাছেই যাচ্ছিলাম। কিন্ত সেতুর ওপরে পশ্চিমা আকাশের দৃশ্যটা এতটাই সুন্দর যে গাড়ি না থামিয়ে থাকতে পারলাম না। এইযে! এতক্ষণ এ দৃশ্যই উপভোগ করছিলাম।তবে ভাবছি যে আফরাও এখানে থাকলে খুব ভালো হতো। সেই বিদেশিনীও আবার প্রকৃতি প্রেমিকা। ইভেনচুয়ালি আমার থেকেও বেশি।’
‘আফরা’ নাম শুনতেই রৌশিনের আনন্দে ভরা মুখ থমথমে হয়ে এলো এবার । মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ওই মেয়েকে হিংসের বশে দু’চারটা কথা শুনিয়ে ফেলতে। কি এমন আছে আফরার মধ্যে যে ওর স্বপ্নের রাজকুমার ফাহিম শুধুই আফরা, আফরা করে?রৌশিন এবার তপ্তশ্বাস ছাড়লো। বৃদ্ধাআঙ্গুল দিয়ে কপালের প্রান্ত থেকে মুছে নিলো ঘাম। ফাহিম হঠাৎ মারুফকে প্রশ্ন করলো,
-‘তোমরা দু’জন হঠাৎ সাইকেল থামিয়ে রাস্তায় মারামার করছিলে কেনো?’
-‘আরে আর বইলেন না ভাই, ওইযে ইলা আর…………’
‘সাব্বির ভাই’ নামটা উচ্চারণ করার আগেই ওর মুখ সজোরে চেপে ধরলো রৌশিন। ফাহিম যেহেতু ইলার বড় ভাই সেই সুবাদে ওদের প্রেমের সম্পর্কের কথা ফাহিম কিছুই জানে না।রৌশিনের ইচ্ছে করছে মারুফকে আরও একদন্ড উড়াধুরা পিটিয়ে মারতে। ছেলে মানুষের মুখ যে এত পাতলা হয় মারুফকে না দেখলে রৌশিনের অজানা থাকতো। ভ্রু কুচকালো ফাহিম। নিজের বোনের প্রসঙ্গ উঠাতে সন্দেহবশতই জিজ্ঞেস করলো,
-‘ইলার সম্পর্কে কি বলতে চাইলো মারুফ যে তুমি ছেলেটার মুখ এভাবে চেপে ধরেছো?’
-‘কিছু না ভাইয়া এগুলো আমাদের ফ্রেন্ডসদের সিক্রেট। এসবে কান দিতে হয় না।’
-‘একা কই ,এই মারুফটায় আছে তো। এই মারুফ! (মাথায় বারি দিয়ে) বল, তুই আছিস না?’কফাটি অযৌক্তিক মনে হলেও বিশ্বাস না করেও পারলোনা। কারন রৌশিনকে চোখ বুজে বিশ্বাস করার ক্ষমতা দিয়েছে আল্লাহ তায়ালা ওকে। ফাহিম নিজের হাত ঘড়িতে চোখ বুলালো ।সূর্য প্রায় ডুবুডুবু অবস্থা। এর মধ্যে রৌশিন চোখ রাঙিয়ে তাকালো মারুফের দিকে। আর উনিশ থেকে বিশ হলেই ইলার গোপন প্রেমের বিষয়টা প্রকাশ পেয়ে যেতো। মারুফ কানে ধরে ইশারায় ওকে সরি বললো। রৌশিনও চোখ রাঙিয়ে ওয়ার্ন করে দিলো যে এমন ভুল যেন আর না হয়,। ফাহিম ব্যস্তসহিত বলে ওঠলো,
-সন্ধ্যে নেমে আসছে প্রায়। রৌশিন ! আমি যেহেতু তোমাদের বাড়িতেই যাচ্ছি তাহলে তুমিও আসো আমার সাথে। এভাবে সন্ধ্যায় একা ঘুরাফিরা করো না।’
-‘একা কই এই মারুফটায় আছে তো। এই মারুফ! (মাথায় বারি দিয়ে) বল, তুই আছিস না?’
-‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোর আর তোর জামাই বাচ্চার পাহারা দিবো।’
ফাহিম স্মিত হেসে বললো,
-‘ওর বিয়ে হয়ে গেলে ওর বরই ওকে পাহারা দেওয়ার মতো যথেষ্ট। আই অ্যাম ড্যাম সিউর ওর মতো মায়াবী একটা মেয়ে অবশ্যই ট্রু লাভড হাসবেন্ট পাবে।’
এই বিরাজমান থমথমে পরিবেশে রৌশিনের সারা দেহে ছড়িয়ে পড়লো আচমকা শীতলতা। ওর হৃদয়ের ধুকপুক বেড়ে ওঠেছে। শরীরে নেমে এসেছে অস্থিরতা। এই অস্থিরতা , তুমুল উত্তেজনা , সবকিছুই কি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির জন্য? হলে হতেও পারে। কেননা সচরাচর ফাহিমকে রৌশিন এ ধরনের কথা বলতে দেখেনি। ফাহিম এবার গাড়িতে বসে পড়লো। সে গাড়ি স্টার্ট করতে রৌশিনও সাইকেল চালিয়ে পেছন পেছন উদ্যত হলো নিজ বাড়ির দিকে।
______________________________________
নেলসন টি এস্টেটের সামনেই গাড়িটা থামিয়ে দিলো ফারহান। হু হু বাতাস বয়ে চলছে। সেই সাথে কেপে কেপে ওঠছে ওদের শরীর। তখন হঠাৎ পানিতে যেমন নেমেছিলো কোনোরূপ কোনো পরিকল্পনা ছাড়া , তেমনি পানি থেকে উঠে দেখলো ওরা কেউই কোনো জামাকাপড় নিয়ে আসেনি। অগত্যাই এভাবে ভেজা জামাকাপড় শুকানোর অপেক্ষায় দুজনে আরও কিছুক্ষণ বিলে সময় কাটালো। আফরা মানতে বাধ্য এই সময়গুলো ওর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কিছু সময়। ফারহানের সাথে একান্তে গড়ে তোলা একটি সুন্দর অতীত। যেটা স্মৃতিচারণ করলেই শুধু আনন্দ পাওয়া যাবে। ফারহান ভেবে নিলো আজ ফাহিম আসলে ওর সাথে একান্তে এই মাছ দিয়ে ইটালিয়ান ডিস রান্না করা যাবে।ছেলেটার সাথে অনেকদিন ধরে ভালোমতো কথাবার্তা হয়না। যা হয় সেটাও পরিমাণে বলতে গেলে খুব কম। ফারহান এবার বলে ওঠলো,
-‘জলদি রুমে গিয়ে একটা হট শাওয়ার নিন। এভাবে থাকলে আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে।’
-‘আপনার বুঝি ঠান্ডা লাগবে না?’
আফরা চোখজোড়া ছোট ছোট করে স্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো ফারহানকে। ফারহান ঠোঁটজোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলো।কৌতুকস্বরে বললো,
-‘আমি আপনার মতো এত সেনসিটিভ না আফরা যে অল্পতেই ঠান্ডা বাধিয়ে ফেলবো।অ্যামেরিকান মানুষেরা তো অল্পতেই শরীরে অসুখ বাধিয়ে ফেলে। বাধাবে না? জীবনটাইতো পার করে ইন্জয় করতে করতে আরাম আয়েশের মধ্য দিয়ে। আমি জানি আপনিও তেমনি । ফার্মের মুরগির মতো।’
অপমানে আফরার দাঁত রীতিমতো কিড়মিড় করে ওঠলো। ফারহান ইনডাইরেক্টলি ওকে ফার্মের সাথে তুলনা করছে যেটা ওর দুদন্ডও সহ্য হচ্ছেনা। আফরা ঠোঁট কামড়ে বললো,
-‘ফাইন। আমি আজ জামাকাপড় পাল্টে চুপচাপ খাটে শুয়ে থাকবো তবুও হট শাওয়ার নিবো না। দেখি , আমার ঠান্ডা লাগে নি !’
-‘আমার সাথে ইগোতে জেতার জন্য শুধু শুধুই নিজের শরীরের ক্ষতি করেন না ।’
-‘করলে করবো , আপনার কি? ‘
বলেই আফরা হতদন্ত হয়ে বাংলোর দিকে পা বাড়ালো। বরাবরের মতোই ফারহানের ঠোঁটে রম্যাত্নক হাসি। শুরুতে এই মেয়ের অস্বাভাবিক কাজগুলো ওর কাছে চরম বিরক্তিকর লাগলেও এখন সেগুলো ওর ভালোলাগে। জানেনা কেন?
আফরাকে এভাবে দ্রুতপায়ে ঘরে যেতে দেখে বারকয়েকবার ওকে থামানোর চেষ্টা করলেন মিসেস নাবিলা। কিন্ত আফরা ছোট খরে বললো, ‘আমার ভালো লাগছে না। আমি রুমে রেস্ট নিবো।’
এই বলে সেই যে আফরা রুমে গেলো আর বেরিয়ে এলো না। তারপর ডিনারের জন্য মিঃ ইফাজ , মিসেস নাবিলা এমনকি ইলাও ডাকতে গেলো বরাবরের মতই আফরা নিরুত্তর। মিহি কন্ঠে বললো,
-আজ খেতে ইচ্ছে করছেনা।
বিষয়টা ভাবুক করে তুলল সবাইকে। আফরা ওদের অতিথি আর আতিথিকে কখনোই এভাবে অ্যাপায়ন সম্ভব না একজন বাঙালি পরিবারের সাপেক্ষে। ফাহিম রৌশিনদের বাড়ি থেকে নিজেদের বাংলোতে এসেই শুনতে পারলো আফরার ঘটনা। মিসেস ধাবিলা চিন্তিত স্বরে কথাগুলো ওকে বলছে। মিসেস নাবিলা এবার বললো,
-‘এই ফাহিম , তুই একটু দেখে আয়না যে আফরার কি হয়েছে। আমি নিশ্চিত , ও তোকে সব বলবে।’
ফাহিম গলার টাইয়ে ঢিল দিয়ে বলতে থাকলো,
-‘তুমি উনার খাবারটা রেডি করো।আমি খাবারটা নিয়েই যাচ্ছি।’
মিসেস নাবিলার চোখমুখে পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠলো।তারপর খাবারের ট্রে টা ফাহিমের হাতে দিতেই ফাহিম সেটা নিয়ে উদ্যত হলো আফরার ঘরের উদ্দেশ্যে।
.
.#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#পর্ব____৩০
#কায়ানাত_আফরিন
আফরার রুমটি খানিকটা অগোছালো। খাটের এদিকে ওদিকে জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এর মাঝেই উদ্ভ্রান্ত হয়ে শুয়ে রইলো আফরা। ঘনঘন নিঃশ্বাসের দরুন ওর বুক ওঠানামা করছে। আফরা নিজেও বুঝতে পারছে না এত রাগ কেন হচ্ছে ওর ফারহানের প্রতি? ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিলেই তো আর এত একটা সমস্যা হয়না। কিন্ত সেটাই আফরার কাছে কেমন যেন দুঃসাধ্যের একটি ব্যাপার। নিজের মধ্যে বিরাট এ পরিবর্তন দেখে ও অবাক না হয়ে পারলো না। পূর্বে আফরা মেয়েটি ছিলো নির্বিকার , ওর চলাফেরা ছিলো উড়ন্ত চাতক পাখির মতো। কে কি বললো না বললো এগুলো নিয়ে কিছুই ওর যায়-আসত না। তাই ওর বাবা-মা’র বড্ড নিষেধের পরেও নাইট ক্লাব , বার ,হুইস্কি , অ্যালকোহল , ডেটিং , বয়ফ্রেন্ড এগুলো থেকে ও সরে আসতে পারেনি। একজন খাটি অ্যামেরিকান নাগরিক যেমন করে আফরাও দিনকে দিন হয়ে গিয়েছিলো এমন।এসব কিছুই ও করতো ক্ষণিকের আনন্দের জন্য। ভালোবাসা নামক সূক্ষ্ণ অনুভূতিকে ভাবত টাইম পাস। তাই ওর জীবনে এরিকের মতো অনেক ভালোবাসাময় মানুষ আসলেও সে হাওয়াই মিঠাইয়ের ন্যায় উড়িয়ে দিয়েছে তা। আর আজ সেই মেয়েটাই অ্যামেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের এক ছোট্ট পাহাড়ি অঞ্চলের ছেলের কথায় মনে দাগ কাটিয়ে দিলো? আফরার মনে হলো সে হৃদয়ভ্রমে আছে। ফারহান নামক অস্তিত্বটা ওকে রীতিমতো পাগল করে দিচ্ছে।
তখনই দরজায় নক পড়াতে আফরার ধ্যান ভাঙলো। খাটের থেকে উঠে বসে মিহি কন্ঠে বললো,
-‘ভেতরে আসুন।’
ফাহিম এসেছে। হাতে খাবারের ট্রে। ওর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে ছেলেটা মাত্র বাহির থেকে এলো। পরনে শার্ট প্যান্টও পাল্টায়নি। টাই ঢিলে করে নিচে নামিয়ে রেখেছে। ফাহিম বরাবরের মতোই মুখে প্রসন্ন হাসি টেনে বললো,
-‘আপনার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। খেয়ে নিন প্লিজ।’
-‘আমি তো আন্টিকে বলেছিলাম আমি খাবোনা।’
ফাহিম অগোচরে গহীন নিঃশ্বাস ফেলে আফরার বরাবর খাটে বসে পড়লো। বলে ওঠলো,
-‘আমিও কিন্ত খাইনি ম্যাডাম। ভেবেছিলাম এই বিদেশীনী অতিথির সাথে খাবো। এখন অতিথি যদি না খায় তাহলে আমার খাওয়াটা কি কোনো কায়দার মধ্যে পড়ে?’
অগত্যাই আফরাকে পালন করতে হলো মৌনতা। কেননা এখন ওর কাছে আর কোনো পথ নেই না খাওয়া ছাড়া। তাছাড়া ছেলেটা এত কষ্ট করে খাবার নিয়ে এসেছে এখন যদি ওকে ফিরিয়ে দেয় তাহলে সেটা কখনোই ভদ্রতার মধ্যে পড়বে না। ফারহানের কথাগুলো মনে করে মনক্ষুন্ন হওয়ার চেয়ে এই মানুষটার সাথে হাসিমুখে কথা বললেও সময়টা একটু ভালো কাটবে। তাই আফরা প্লেট নিয়ে নিলো ট্রে থেকে। সেই সাথে ফাহিমও। খাওয়ার মাঝে সে বলে ওঠলো,
-‘তো আজ কেমন দিন কাটলো আপনার?এমনিতেও ফারহান গিয়েছে। ও আবার মানুষদের ভালো ট্রিট করতে পারেনা। মেয়েদের তো একেবারেই না। তাই জিজ্ঞেস করলাম সব ঠিক গিয়েছে তো?’
-‘অন্য মেয়েদের মতো আমি নই ফাহিম যে আমায় উনি ট্রিট করতে পারবেন না। বরংচ আজ আমি অনেক ইন্জয় করেছি। অনেক !!’
তখনকার বিলের পানিতে ডুবন্ত দৃশ্যসমূহ ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠতেই মনে ভালোলাগা ছেয়ে গেলো। কি এক নিদারুন অনুভূতি। আফরা খাওয়ায় মনোনিবেশ করে বললো,
-‘তবে ওই বদ লোকটার তো কথাবার্তায় ঠিক নাই। আমায় ফার্মের মুরগি বলেছে।’
হো হো করে হেসে উঠলো ফাহিম। আফরা চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই সে নীরব হয়ে গেলো। বললো,
-‘রাগ করেছেন ওর ওপর?’
-‘প্রচন্ড রাগ। ইচ্ছে করতে মাথাটা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে।’
-‘তাহলে ওর সাথে আর আউটিংয়ে যাবেন নাকি?’
বিস্মিত হলো আফরা। জোর গলায় বললো,
-‘অবশ্যই যাবো। রাগ রাগের জায়গায় আর উনি উনার জায়গায়। এই রাগের জন্য উনার সাথে ঘুরাঘুরির মতো সুবর্ণ সুযোগ মিস করবো নাকি?’
আফরা কাট কাট গলায় কথাটি বলে ফেললেও পরে থতমত খেয়ে গেলো। ভীত হয়ে তাকালো ফাহিমের দিকে। ফাহিম এমন কথা শুনে ভ্র কুচকে তাকিয়ে আছে। তবে সৌভাগ্যবশত ফাহিম আফরার কথার অন্যকিছু ভাবলো না। স্বাভাবিকভাবেই নিয়ে নিলো ব্যাপারটা। এ নিয়ে আফরা মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। ফাহিমের সাথে সময়টা বেশ ভালোই কেটেছে। ফাহিম বরাবরই একজন বন্ধুসুলভ মানুষ তাই কথা বলাতে অন্যরকম এক আনন্দ পাওয়া যায়। ফাহিম যাওয়ার পর আফরা অগোছালো রুমটি গুছিয়ে নিলো। জানালা দিয়ে পরখ করে নিলো ‘ফারহানের’ ছোট্ট কুটিরটা। কে জানে মানুষটি কি করছে? তবে সেই মানুষটার ওপর ওর প্রবল অভিমান জমেছে। প্রিয়মানুষের থেকে এমন মন্তব্য পেলে একজন বাচ্চাসুলভ কিশোরীর যেমন অবস্থা হয় আফরার ঠিক তেমনই অবস্থা। আর কিছু ভাবলো না আফরা। সকালে দ্রুত ওঠার উদ্দেশ্যে ঘুমানোর জন্য বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো।
_____________________________
ইলার সকালটা শুরু হলো একটা মিষ্টি কন্ঠ দিয়ে। সাব্বির কল দিয়েছে এই সাতসকালে। ইলার চোখে মুখের ঘুমুঘুমু ভাবটা নিমিষেই তুলোর ন্যায় উবে গেলো। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো মেয়েটা। ওপরপাশে সাব্বির মিটমিটিয়ে হাসছে। জড়ানো কন্ঠে জিঙ্গেস করলো,
-‘ইলারাণীর ঘুম ভাঙেনি এখনও? এই সুন্দর সকালটা উপভোগ না করে ঘুমাও কিভাবে তুমি?’
-‘যেভাবে তোমায় কল্পনা করে করে দিন পার করি সেভাবেই।’
ইলার ঘুমন্ত মুখশ্রীতে একধরনের চাপা হাসি। সাব্বিরের সাথে সচরাচর ভোরে কমই কথা হয় ইলার। কেননা এ সময় সাব্বির আর শামসু ফারহান ভাইয়ের সাথে কাজে মশগুল থাকে। আর ফারহান যেহেতু ধীরে ধীরে রাজনীতির কোন্দল থেকে বেরিয়ে আসছে তাই সাব্বিরের কাছেও রয়েছে অবসর যাবনের একটা চমৎকার সুযোগ। ওদের প্রেমের সম্পর্কটি খুবই অদ্ভুত। শুরুটা হয়েছিলো চোখে চোখে ইশারার মাধ্যমে। ফারহানের সাথে দেখা করার জন্য প্রায়ই সাব্বিরকে আসতে হতো ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে তৈরি এই টি এস্টেটে। তখনই ইলার সাথে ওর সাক্ষাত। বলা বাহুল্য দুজনের মধ্যেই একটা সুক্ষ্ণ অনুভূতি কাজ করতো। সাব্বিরকে একপলক দেখার জন্য পুরোটা বিকাল ইলা ফারহানের ছোট বাড়িটির মুখোমুখি বারান্দায় বসে থাকতো। সাব্বিরও শামসুকে নিয়ে মাঝে মাঝে অনুসরণ করতো ইলাকে। ইলা তা বুঝতো কিন্ত ঠোঁট চাপা হাসির বিনিময়ে তা প্রকাশ করতো। এভাবেই ইশারার সূচনাটা বর্তমানের প্রেমের টোনা-টুনি নামেই ইলার বন্ধুমহলের কাছে পরিচিত।তবে সাব্বির তা সর্বদা লুকোনোর চেষ্টায় থাকে। কেননা ও জানে এখন ওদের প্রকাশ্য হওয়ার উপযুক্ত সময় না।
ইলা আর সাব্বির অন্তর্নিহিত সম্পর্কটা অন্যান্য চার পাঁচটি সম্পর্ক থেকে ভিন্ন। ওরা কখনোই কলেজ ফাকি দিয়ে হাতে হাত ধরে সৌন্দর্য উপভোগ করেনি। অনুভব করেনি হুডতোলা রিক্সার অগোচরে প্রথম ঠোঁটজোড়ার স্পর্শটুকু। প্রেমপত্রের আদান-প্রদানতো কস্মিককালেও ছিলো না , যা ছিলো সেটা হলো বইয়ের আদান-প্রদান। ইলা প্রতিসপ্তাহে একটা করে বইয়ের ভেতর ছোট্ট খামে ওর চিরকুটে রংতুলি আকাঁ ছবি দিতো সাব্বিরকে। এর তাৎপর্য কি সেটা ওদের দুজনেরই অজানা। তবুও এধরনের কাজে এক অন্যরকম ভালোলাগা আছে। হয়তো সেটা অপ্রকাশ্যিত , অথবা লুকিয়ে থাকে রংতুলির ভেতরে।
______________________
রৌশিন আজ সকাল সকালই ইলার কাছে এসেছে। উদ্দশ্য দুজনে আজ মারুফের জন্মদিন উপলক্ষে বাজারে যাবে সারপ্রাইজের জন্য গিফ্ট রেডি করতে। আজ কলেজ বন্ধ। তাই এটাই যাওয়ার জন্য উপযুক্ত সময়।কিন্ত বরাবরের মতোই ইলা লেটলতিফ। রৌশিনকে সোফায় বসিয়ে হুড়মুড়িয়ে রেডি হচ্ছে নিজের রুমে। রৌশিন হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিচলিত হলেও কিছু বললো না। তখনই সিড়ি বেয়ে নেমে এলো আফরা। আফরার পরনে স্লিভলেস সাদা টপস , তার ওপর হালকা বাদামী রঙের লেডিস শার্ট পড়েছে। কালো প্যান্ট সাথে ঘাড় পর্যন্ত লালচে খোলা চুলগুলো অপূর্ব করে দিয়েছে মেয়েটাকে। রৌশিন হা করে তাকিয়ে রইলো আফরার দিকে। কেননা এ ধরনের মেয়ে ও সাধারনত টিভি সিরিয়ালেই বেশি দেখো যায়।কি অপূর্বই না দেখতে মেয়েটা। আফরা হঠাৎ সকাল বসার ঘরে পরিচিত একখানা মুখ পেয়ে অবাক গলায় বললো,
-‘রৌশিন , রাইট?’
-‘হ্যাঁ।’
মিনমিনিয়ে প্রতিউত্তর দিলো রৌশিন। আফরা ঠোঁটে হাস ফুটিয়ে বললো,
-‘হোয়াট অ্যা প্রেজেন্ট গার্ল ! তুমি হঠাৎ সকাল সকাল এখানে?’
-‘ইলার জন্য ওয়েট করছি।ওর সাথে বাইরে যাবো একটু,,,,,তাই আরকি।’
আফরা এবার সোফায় বসে পায়ে সাদা কেডস পরে নিলো। রৌশিন অপ্রস্তুত হয়ে জিঙ্গেস করলো,
-‘আপনি,,,,কোথাও যাচ্ছেন আপু?’
-‘ওহ্ হ্যাঁ , এখানে ‘লাউয়াছড়া’ নামের একটা স্পট আছে মেইবি। ফারহান ওখানে নিয়ে যাচ্ছে আমায়।’
-‘লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান?’
-‘হ্যাঁ , অনেকটা অমন কিছুই তো ফাহিম বললো।’
-‘ঘুরে আসতে পারেন। কেননা জায়গাটি অত্যন্ত সুন্দর। গেলেই একরাশ ভালোলাগা কাজ করবে। আমিও আমার বড় ভাইয়ের সাথে ওখানে গিয়েছিলাম।’
আফরা প্রতিউত্তরে মুচকি হাসলো। রৌশিন মেয়েটাকে ওর ভালোলেগেছে। বয়স উনিশের কোঠায় গেলেও মুখে একপ্রকার বাচ্চাসুলভ ভাব। দেখতে আহামরি সুন্দর না , তবে মায়াবী। অনেক মায়াবী। আফরা এবার মিঃ ইফাজ আর মিসেস নাবিলা থেকেও বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। রৌশিন আবার ধ্যানমগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ইলার। একপলক ফাহিমের কথা মনে হয়েছিলো। কিন্ত পরক্ষণেই ভাবনাটা ঝেড়ে ফেললো মাথা থেকে।
___________________
ফারহান আজ সচরাচর দিনের তুলনায় দেখতে কিছুটা অন্যরকম। নেভি ব্লু রঙের শার্ট এই প্রথম ওকে পড়তে দেখলো আফরা। কালচে মসৃন চুলগুলো পেছনে ঠেলে দেওয়াতে শ্যামবর্ণের ছেলেটির সৌন্দর্য আরও নিঁখুত দেখাচ্ছে। কিন্ত আফরা নিজের মুগ্ধতা প্রকাশ করতে দিলো না। বরংচ পুরোটা পথেই থম মেরে বসে ছিলো। গতকালের কথাটা এখনও ভুলেনি ও। তাই ফারহান আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বললেই আফরা থমথমে গলায় উল্টাপাল্টা উত্তর দিয়ে দিলো। কিন্ত ফারহানকে ওর ব্যবহার নিয়ে বিচলিত হতে দেখা গেলো না। ওর ভাবভঙ্গি এমন যে , ‘দ্য ম্যান হু কেয়ারস অ্যাবাউট নাথিং ইজ এ পারসন হু ইজ সামওয়ানন্স সামথিং’ । আফরা তাই গাড়ির জানালা থেকে মুখ বাহিরে নিয়ে ছোট ছোট টিলা পথের দৃশ্য অপার পানে দেখতে লাগলো। নেলসন টি এস্টেট থেকে লাউয়াছড়া উদ্যানের দুরুত্ব খুব একটা বেশি না।
তাই দ্রুতই এখানে এসে পড়লো। তবে এসে দেখলো যে বাংলাদেশি নাগরিকদের তুলনায় ফরেইনাদের টিকেটের মূল্য খানিকটা বেশি। আফরা যেহেতু বাংলাদেশি নাগরিক নয় তাই অগত্যাই ওর সঙ্গে ফারহানকেও দ্বিগুন দিতে হলো। ভেতরটা এককথায় অসাধারন। দুধারে উচু উচু গাছ মাঝখান দিয়ে সরু একটি পথ। লাউয়াছড়া উদ্যানটি মূলত একপ্রকার অভয়ারণ্য। একজন প্রকৃতিপ্রেমিকের কাছে নিঃসন্দেহে একটি পছন্দের জায়গা হবে এটি। আফরা আর ফারহানের কাছে জায়গাটি এখন এমনই লাগছে। যদিও ফারহানের এখানে বহুবার আসা তবুও আফরার মুখে নতুনত্ব ভাবটা ওর মনেও ভালোলাগা ছাড়িয়ে দিলো।
এই জায়গাটি একেবারেই নেটওয়ার্কের বাহিরে থাকায় যদি কেউ চরম ডিপ্রেশন নিয়ে এখানে আসে , তাহলে সকল হতাশা ঝঞ্ঝাট ভুলে এখানকার নিস্তব্ধতায় গুম হয়ে যাবে। আফরা একটা নরম ঘাসের প্রান্তে থম মেরে বসে পড়লো। সাথে বসলো ফারহানও। আাফরার ভালোলাগছে। অ্যামেরিকার সেই উপভোগ্য জীবন আর মম ড্যাডের সাথে ঝামেলাগুলোর কথা ভুলে ফারয়ানের সাথে সময়টা উপভোগ করছে। আকাশ খানিকটা মেঘলা। হয়তো আল্লাহ চাইলে অল্প সময় পরেই ঝুমময় বৃষ্টির দরুন প্রকৃতি সিক্ত করে দেবে। ফারহান আলতো হেসে বললো,
-‘এখনই গুম হলে চলবে প্রকৃতিপ্রেমিকা? সামনে যে আমার সাথ আরও পথচলা বাকি আছে?❤
.
.
.
.
~চলবে…….ইনশাআল্লাহ