অতঃপর প্রেমের গল্প পর্ব ৪২+৪৩

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤️
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব__৪২
ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে দিনগুলো। সেই সাথে ঘনিয়ে আসছে আফরার ফিরে যাওয়ার সময়। হ্যাঁ, ফিরে যাচ্ছে আফরা একরাশ অভিমান আর জমকালো কিছু স্মৃতি নিয়ে। ফারহানের সাথে আফরার কথা হয়না প্রায় দু’তিনদিন হতে চললো আজ। সেরাতের কথাবার্তার পর সকালে ফজরের পূর্বেই সে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে। ফারহানের নিরুদ্দেশ হওয়াটা স্বাভাবিক ছিলো একসময়, কেননা তখন কোনো পিছুটান ছিলো না। তবে এখন একটা পিছুটান আছে। পিছুটান টির নাম ‘আফরা’, ফারহান ভালোমতোই এ ব্যাপারে অবগত। তবুও এখনও কেনো যে এমন খামখেয়ালিপনা করছে এটা ভাবতেই আফরার একই সাথে রাগ আর কান্না আসে প্রচন্ড।
তাই পরদিন সকালেই মিঃ আসিফকে ফোন দেয় আফরা৷ শীতল কন্ঠে বলে, দ্রুত টিকিটের ব্যবস্থা করতে। মিঃ আসিফ প্রথমে মেয়ের এমন ব্যবহারে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন কিছুটা। পরন্তু কিছু বললেন না। আফরা বাবার সাথে কথালাপ শেষ করেই মিসেস নাবিলা, মিঃ ইফাজ, ফাহিম ইলা সবাইকে বললো ওর ফিরে যাওয়ার কথা। ইলা রীতিমতো প্রচন্ড হতাশ হয়ে পড়েছিলো এতে। কেননা এই লম্বা সময়ে আফরার সাথে ওর খুব ভালো একটি সম্পর্ক হয়েছে৷ মিঃ ইফাজ প্রথমে নিজেকে দোষারোপ করছিলেন আফরার ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে। কেননা আফরার মাকে ভালোমতোই চিনেন উনি। যদি ফাহিম আর আফরার বিয়ে সঙ্গত কারনে আফরা ফিরে যায়, তবে নিজেকে কখনোই মাফ করতে পারবেন না উনি। তবে আফরা বুঝিয়ে বললেন ব্যাপারটা উনাকে। যে এমন কিছুই না। আফরার সত্যি সময়গুলো খুব ভালো কেটেছে। তবে যেই মোহ বা অনুভূতি ছিলো সেটা থেকে পালিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ হলো এই চায়ের রাজ্য কে ছাড়িয়ে বহুদূরে কোথাও চলে যাওয়া।

———

আচ্ছন্ন বিকেল। দূর দূর পাখির কলকালির আওয়াজে মুখরিত শ্রীমঙ্গল। আফরা আজ প্রথম এই বাংলোবাড়ির ছাদটিতে উঠলো। পুরোনো ব্রিটিশ ধাঁচের বাড়ি বিধায় ছাদে ওঠার ব্যাপারে সাবধান সংকেত দিয়েছিলেন মিঃ ইফাজ। তাই এই ছাদে তেমন আর ওঠা হয়নি। তবে আজ কেনো যেন সতর্ক সংকেত এড়িয়ে আফরার ছাদে ওঠার প্রচন্ড ইচ্ছে হলো। তাই ফাহিমকে নিয়েই সে এসে পড়লো ছাদে। সাথে আরও একজন আছে। রৌশিন৷ আফরার ফিরে যাওয়ার কথাটি শুনে অনেকটা হতদন্ত হয়েই ও চলে এসেছিলো এখানে৷ আফরার কেনো যেন প্রচন্ড ভালোলাগে রৌশিনকে। একেবারেই সাদামাটা, নিশ্চুপ ধরনের। কথার মধ্যেই একটা মায়াবী ভাব আছে। একজন আদর্শ বাঙালি মেয়ের যেমনটা হওয়া উচিত রৌশিন ঠিক তেমন৷

আফরা খানিকটা হাসলো। বলে ওঠলো,

‘ অ্যামেরিকায় হাজারো খুজেও রৌশিনের মতো মেয়ে খুঁজে পাওয়াটা দুর্লভ। তাই হয়তো কোনো এক মানব বলেছিলো, ‘A Bengali girl is a true owner of the hidden beauty!’

রৌশিন হাসলো খানিকটা। তবে আফরার নিষ্প্রভ চাউনি দেখে জিজ্ঞেস করলো,

‘ তুমি ফিরে যাচ্ছো যে হঠাৎ? ‘

‘ একদিন তো যেতেই হতো তাইনা? ‘

‘ তবুও, তোমার ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা আমার কেনো যেনো তাৎক্ষণিক মনে হচ্ছে। তোমার মন মেজাজও তেমন একটা ভালো না৷ আপু! সত্যি করে বলো তো! শ্রীমঙ্গল তোমার ভালো লাগে নি?’

‘ ভালো লেগেছে তো। সবথেকে বেশি ভালো লেগেছে এখানকার মানুষদের। এখানকার লাভ বার্ডসগুলো খুব কিউট হয়। যেমন তোমরা!’

হকচকিয়ে গেলো রৌশিন। সেই সাথে ফাহিমও। কেননা ওরা দুজন ধারনা করতে পারেনি যে আফরা ওদের ব্যাপারে কিছু জানে।

‘ অবাক হচ্ছেন ফাহিম যে আমি জানলাম কি করে?’

ফাহিম কথা বললো না।

‘ লাভ এন্ড ইমোশোনস, এই দুটো কখনোই হাইড করা যায় না ডক্টর ফাহিম। সেটা তো আপনার ভালোমতোই জানার কথা। আমিই এক গর্দেভ যে ইমোশনসগুলো বুঝতে অনেক লেট করে ফলি।’

পরিবেশটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে ক্রমান্বয়ে। পরন্ত আফরা হয়তো বিব্রতকর করছে। আফরা বরাবরই স্পষ্টভাষী মানুষ। তাই কোনো কথা বলতে তেমন একটা ভাবে না৷ ফাহিম শুকনো কাশি দিলো৷ বলে উঠলো,

‘ ফারহানকে বিদায় জানিয়ে ফিরবেন না?’

আফরা ঠোঁট কোলে ফুটে উঠলো তাচ্ছিল্যের হাসি৷ বললো,

‘ উনি কি আমায় সেই সুযোগটা দিয়েছেন ফাহিম?’

‘ সুযোগ করে নিতে হয় আপু, ফারহান ভাই প্রচন্ড ইন্ট্রোভার্ট টাইপ মানুষ, তাই হয়তো এরকম করছে তোমার সাথে৷ তুমি একবার,,,,,,,’

‘ উনাকে সময় দিয়েছি অনেক। উনি ইন্ট্রোভার্ট হলে আমি প্রচন্ড ইগোস্টিক। আর ফারহান চাননা যে আমি উনার জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়াই। তাই তো চলে যাচ্ছি এখান থেকে চলে যাচ্ছি দূরে। আমার কাছে লাভ ছিলো টাইম পাসের মতো। অ্যামেরিকায় থাকাকালেই ক’জনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ছি মনে নেই৷ সবই ছিলো ‘কিছু না’ টাইপ। আর সেই আফরা অ্যামেরিকার ঠিক উল্টো পথে সাউথ এশিয়ান এক বাঙালী ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, ভাবা যায়? তবে এখানে কখনও ফিরে আসবো কিনা জানিনা, তবে হি ইজ মাই ফার্স্ট ইমোশন রৌশিন। আমি উনাকে কখনোই ভুলতে পারবো না!’

আফরার চোখমুখ সিক্ত হয়ে আছে অশ্রুতে। আজ হয়তো এটা শেষ বিকেল এখানে আফরার৷ আগামীকাল বিকেলের প্রথম প্রহরেই আফরা বেরিয়ে যাবে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।

——————

আকাশে নেমেছে কিছুটা জমকালো আধার। দূর দূর তারার সমারোহে অপূর্ব লাগছে সবকিছু। ফারহান রাইফেল রোড ধরে নিজের গাড়ি ড্রাইভ করতে মগ্ন। রাত হওয়ার দরুন গাড়ির জানালা নামিয়ে দিয়েছে। এতে হু হু করে ভেতরে প্রবেশ করছে উন্মুক্ত শীতল বাতাস। রাস্তার বাঁ পাশেই শালবন। সেখান থেকে অদ্ভুত কিছু শব্দ ভেসে আসলেও ফারহান কর্নপাত করলো না।

কিছুক্ষণ আগেই নিয়াজি সাহেবের সাথে আর কিছু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে বোর্ড মিটিং সম্পন্ন করে এলো ফারহান। কেন্দ্রীয় বিষয় হলো আগামীতে এখানকার স্টুডেন্ট লিডার হিসেবে কে নিয়োজিত হবে সে ব্যাপার নিয়ে। এক পক্ষ ফারহানকেই বরাবরের মতো লিডার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলো। তবে বাঁধ সাজলো এখানকার নতুন চেয়ারম্যানের লোকদল। তারা ফারহানকে ক্ষমতায় আনতে চাননা। কারন যতদিন ফারহান স্টুডেন্টদের লিডার হয়ে থাকবে ততদিন সরকারের স্টুডেন্ট ফান্ডিং থেকে টাকা আত্মসাৎ করা অসম্ভব উনাদের কাছে। তবে ফারহান এবার এ ব্যাপারে কোনোরূপ কোনো হৈ-হুল্লোড় করলো। মোটামুটি অবাক হয়ে গিয়েছিল এতে পার্টির লোকজন। কেননা ফারহান কখনও এসব বিষয় নিয়ে কাউকে ছাড় দেয়নি। আর আজ এত বড় পদ থেকে ওকে নিজেই সরে আসতে দেখে নিয়াজি সাহেবের সাথে কম কথা কাটাকাটি হয়নি ফারহানের।
এখন এসব কোনোমতে সামলিয়ে ফারহান নূরজাহান এস্টেটের ওদিকটাতে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি নিয়ে। ওর মন বিষন্ন। আফরার সেরাতের অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া বারবার ভাবিয়ে তুলছে ওকে। আজকাল পার্টি অফিসেও তেমন একটা মন বসে না। কোনো বিচার সালিশেও তেমন একটা উপস্থিত থাকে না। এককথায় রাজনৈতিক বেড়াজাল থেকে দিনকে দিন সরে আসছে ফারহান। নিজের মধ্যকার এমন বিরাট পরিবর্তন দেখে নিজেই অবাক সে। তাইতো বাড়িতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করেনা ওর।

ফারহান গাড়িটা উঁচু এক ভ্যালীর সামনে থামালো। এটা সেই জায়গাটি যেখানে আফরার সাথে প্রথম জগিং করতে এসেছিলো ফারহান৷ আকাশে লক্ষ তারার সমাগমে নিশিরাতটিতে দেখলে মনে হবে যেন খালি চোখেই ছায়াপথ দেখতে পারছি৷ একপাশে সুগভীর খাদ ডুবে আছে গহীন অন্ধকারে। ফারহান গাড়ির ডিকির ওপর শুয়ে পড়লো। দেখতে লাগলো সুবিশাল আকাশ। আফরার প্রতিটা দৃশ্য না চাইতেও চোখের সামনে ভেসে ওঠছে। ফারহান নিজেকে ধাতস্থ করে অন্যত্র মন দেওয়ার চেষ্টা করেও পারলো না। বারবার মনে হচ্ছে বিশাল কোনো ভুল হতে চলেছে।

কিন্ত কি করতো সে? এইযে কিছুক্ষণ আগেই মৃত্যুর ধমকি খেয়ে আসলো৷ এখন এসব বেড়াজালে যদি আফরা পড়ে। এমনিতেও ওর জন্য আফরাকে কম খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হয়নি। সেবার কলেজে আক্রমণ, তারপর পুলিশ স্টেশন আবার নিজেও আহত হওয়া এসব ক্রমান্বয়ে ফারহানকে আরও ভাবিয়ে তুলছে আফরার জন্য। তাছাড়া ফারহান বড় হয়েছে নিঃস্বভাবে। ছোটবেলাতেই মা বা হারিয়ে ফেলেছে। ফাহিমের মাও ওকে অপছন্দ করে সম্পত্তিগত ব্যাপারের জন্য। তাইতো ভালোবাসা নামক বিষয়টার প্রতি ঘোরতর অনীহা ওর। আফরাকে যদি ও নিজের সর্বস্ব দিয়ে কাছে নিয়ে আসতে না পারে? তবে কি হবে ওর? আর আফরা বলছে সব হলো আবেগ। LS