অতঃপর প্রেমের গল্প পর্ব ৩৯+৪০+৪১

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤️
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব___৩৯
একনাগাড়ে টানা দুইদিন ধরে বৃষ্টি পড়ছে শ্রীমঙ্গলে। দূর দূর যেখানেই তাকানো যায় শুধু সবুজের সমারোহ। বৃষ্টি পানিকণার আবেদনময়ী স্পর্শে সেই রঙগুলো যেনো আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। আফরা তাই টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ফেরার পর দু’দিন নেলসন টি এস্টেট থেকে বের হতে পারছে না। সেই সাথে ফারহানও লাপাত্তা দু’দিন ধরে। আফরা বারকয়েক ফারহানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো ইলাকে যে ফারহান কোথায়। তবে ইলা বিস্তারিত কিছুই বলতে পারলো না এ ব্যাপারে।

কেননা ফারহান প্রায়শই এভাবে বৃষ্টির মৌসুমে উধাও হয়ে যেতো হুট করে। ফারহান আসলে একটু ভবঘুরে ধরনের ছেলে। অবসর সময়ে সে প্রায়ই দেশ বিচরণের জন্য বেরিয়ে যেতো। এতে খানিক অভিমান জমলো আফরার মনে। কেননা ফারহান কথা দিয়েছিলো যে এবারের ট্যুরে সে প্রতিটা পথ প্রান্তরে আফরাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু কথা রাখলোনা ফারহান। এমনকি সে যে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছে এর আগে বলেও গেলোনা আফরাকে। এদিকে সে কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করলো যে কিছু একটা হয়েছে ফাহিমের। সে রাতে রৌশিনকে বাড়িতে দিয়ে আসার পর থেকে ফাহিম একেবারেই চুপচাপ হয়ে গিয়েছে।

আফরা তাই বেশ সকাল করে উঠলো আজ। বৃষ্টির গতি কমে শুরু হয়েছে হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। জানালা দিয়ে সমগ্র চা বাগানের একটা সুন্দর দৃশ্য চোখ ধাধিয়ে দিয়েছে আফরার। অদূরো বড় বড় দেবদারু গাছগুলো কেমন যেন নুয়ে পড়েছে বাতাসের ধাক্কায়। আফরা তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। একটা পাতলা ফিনফিনে চাদর গায়ে জরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সরু করিডোরটা পার হলেই কাঠের সিড়ি। সেটা বেয়ে নিচে নেমে গেলো ডানপাশেই কিচেন রুমটি দেখা যায়। আজ বেশ সকালে উঠেছে বলে মিসেস নাবিলার দেখা পায়নি আফরা। তাই অগ্যাই নিজের আর ফাহিমের জন্য দু’কাপ কফি বানিয়ে রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো।

ফাহিম বরাবরই সকাল উঠে। আর যাই হোক এই এক মাসে ফাহিমকে দেরিতে উঠতে দেখেনি আফরা। আফরা দরজায় শব্দ করতেই ফাহিম ভেতরে আসতে বললো তাকে৷ আফরার হাতে দু’কাপ কফির মগ। মগে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ‘Starbucks’ এর লোগো, আফরা এরকম এক সেট মগ অ্যামেরিকা থেকে নিয়ে এসেছিলো উপহার স্বরূপ। ঠোঁটকোলে রয়েছে মুচকি হাসি। আফরা বিনয়ী সুরে বলে ওঠলো,

-গুড মর্নিং ফাহিম!

-মর্নিং।

ফাহিম বললো মিনমনিয়ে, মুখে বিষ্ময়ের রেশ। আফরা কফির মগ এগিয়ে দিলো। বললো,

-মেড বাই মি। ওয়ানা ট্রাই ইট?

ফাহিম আফরার হাত থেকে মগটি নিয়ে নিলো। মুখের অবাকতার ছাপটি এখনও যায়নি। মুখে দেওয়া মাত্রই নাকে সুন্দর একটা কফির স্মেল ভেসে আসলো৷ জিভে তা লাগতেই টের পেলো এটার টেস্ট আসলেই অন্যরকম। এই বৃষ্টির মৌসুমে কফির মন্দ নয়। আফরা জিজ্ঞেস করলো,

‘ কফিটা কেমন লাগলো আপনার?’

‘ উমমমম, রিফ্রেশমেন্ট এনে দিয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে পারছি না। কারন আমি রিভিউতে বড্ড বেশি কাচা।’

আফরার ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুটে ওঠে। বললো,

‘ যেই ওয়ার্ড টা শুনতে চেয়েছিলাম সেটাই বলেছেন। সো আই লাইক ইট।’

ফাহিম কোনো কথা বললো না। আজকাল রৌশিন নামের মেয়েটি ওর অন্তরকে কেমন যেন নাড়িয়ে দিয়েছে। ফাহিম আজকাল যেদিকে যায় সেদিকেই কল্পনা করে রৌশিনকে। সর্বত্রই টের পায় রৌশিনের উপস্থিতি। বসতে গেলেও রৌশিন, উঠতে গেলেও রৌশিন। সেদিন চেম্বারে এক রোগীকে রৌশিন ভেবে তো হ্যালুসিনেটও হয়ে গিয়েছিলো। আফরার ডাকে ওর ধ্যান ফিরলো এবার। আফরা প্রশ্নবোধক চাহিনী দিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। জিজ্ঞেস করলো,

‘ ইদানীং আপনি এত মনমরা হয়ে আছেন কেন ফাহিম? সেদিন ট্যুরের পর থেকেই দেখতে পারছি আপনার বিহেভের চেন্জ হয়েছে কিছুটা। কি হয়েছে আপনার?’

ফাহিম মিহি হাসলো। জড়ানো গলায় বললো,

‘ যেমনটা আপনি আমার প্রতি বিহেভিয়ার চেন্জ করেছেন তেমনটাই।’

হঠাৎ অস্বস্তির বেড়াজাল ছড়িয়ে পড়লো সারা ঘরে। আফরা আনমনে নিজের হাত কচলাতে লাগলো। কথাটি সত্যি। ওদের বিয়ের নামক ঘটনাটির উত্থানের পর দু’জনের মধ্যেই কথাবার্তার পরিববর্তন এসেছে। নষ্ট হয়ে গিয়েছে একটি সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আফরার মাঝে মাঝে প্রচন্ড রাগ হয় নিজের মম আর মিসেস নাবিলার প্রতি। কি প্রয়োজন ছিলো এভাবে বিয়ে নামক চিন্তা মাথায় টেনে আনার? আবার মাঝে মধ্যে নিজের প্রতিও রাগ হয় যে ফারহানের পেছনে আফরা ইমম্যাচিওরের মতো এতটাই বিমূঢ় হয়ে ছিলো যে ফাহিমের মনে যে ইমোশনস কাজ করছিলো তা টেরই পায়নি। ফাহিম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বলে উঠলো,

‘ বাসায় ভালোলাগছে না আফরা?’

‘ বৃষ্টির জন্য টানা কিছুদিন বাসায়। একটু বোরিং তো লাগবেই। ‘

‘ আপনি এসেছেনই এমন এক মৌসুমে। বাংলাদেশে গড়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় সিলেট বিভাগের ভেতর এই শ্রীমঙ্গলে। আর এটা তো এমনিতেও বৃষ্টির মৌসুম। আপনি তো আবার আষাঢ়-শ্রাবণ মাস থাকবেন বলে পরিকল্পনা করে এসেছিলেন। তাই বৃষ্টির মুখোমুখি কমবেশি হতে হবেই।’

‘ বুঝলাম ব্যাপারটা। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে আমার এখানে দু’মাস থাকা হবেনা। ১ মাস অলরেডি হয়ে গিয়েছে। আর সর্বোচ্চ দশ পনের দিন? তারপর আমি ফিরে যাবো আমার গন্তব্যে।’

ফাহিম একরাশ হীনমন্যতা নিয়ে আফরার কথার পরিপ্রেক্ষিতে দৃষ্টিপাত করলো ওর দিকে। কফিতে আরও এক চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আপনার গন্তব্যে মানে?’

‘ আমার গন্তব্য বুঝতে পারছেন না ফাহিম? যেখানে আমি বড় হয়েছি। যেটা আমার জন্মস্থান। যেখানে আমার লাইফ-ক্যারিয়ার সব। অ্যামেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি।’

ফাহিম মৌনতা কাটালো। কেননা ও অবগত ছিলো ফারহান আর আফরার মধ্যকার সূক্ষ্ণ সম্পর্কের ব্যাপারে। তাই এসব এড়িয়ে ওর হঠাৎ ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুললেও ফাহিম কিছু বললো না। আফরা এবার বললো,

‘ অবাক হচ্ছেন তাইনা? যে আমি দুই মাস থাকার পরিকল্পনা নিয়ে বিডিতে আসলেও কেন এত দ্রুত ডিসিতে ফিরে যাচ্ছি? প্রথমত বিডিতে আমার অনিচ্ছাপূর্বক পাঠানো হয়েছিলো। পরবর্তীতে এখানে একটা সুন্দর সময় স্পেন্ড করেছি আপনাদের সাথে। এখানকার প্রতিটা জায়গা, এখানকার লাইফস্টাইল, কালচার, আপনাদের অতিথিয়তা সব আমার মন ভালো করে দিয়েছিলো। এককথায় আমার লাইফের বেস্ট একটা মোমেন্ট স্পেন্ড করেছি আপনাদের সবার সাথে। তবে তিক্ত কথা কি জানেন? এখানে সবার নজর কাড়তে পারলেও যার দৃষ্টি আমি চেয়েছি সেটা পায়নি। রেইনট্রি পাতার মতো একজনের পিছে ছুটেছি। তবে আমার বুঝতে দিরি হয়েছে যেই কানট্রি আমার না , সেখানকার কোনো কিছুই আমার হতে পারবে না।

তাছাড়া আমার মম-ড্যাড এখানে মেইনলি পাঠিয়েছিলো আপনার সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য। যা আমি জানতাম না। তবে পরবর্তীতে জেনেছি। উনারা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যে আফরা নিজের মনের বিরুদ্ধে কোনো ডিসিশন নেয়না। তবুও আমি একটা ডিসিশন নিয়েছিলাম উনাদের কথা ভেবে। অ্যামেরিকায় একটা ছেলে আমার ভালোবাসতো। এককথায় প্রচন্ড রকমের ভালোবাসতো। ওর নাম ছিলো এরিক। স্বভাবতত অ্যামেরিকানরা সহজে বিয়েই করেনা। দরকার পড়লে আজীবন লিভ টুগেদারে থাকবে, বেবি কনসিভ করবে তবুও বিয়ে করবে না। ‘কজ ওদের কাছে বিয়ে হলো একটা বেঁধে দেওয়া সম্পর্ক। তবুও এরিক আমায় প্রস্তাব দিয়েছিলো বিয়ের। কেনো না করেছিলাম জানেন? আমার মম-ড্যাডের জন্য। উনারা আমার সবকিছু মেনে নিয়েছিলেন, আমার হ্যাং আউট-নাইট পার্টি-ডেটিং-বয়ফ্রেন্ডস সব। কিন্ত একজন খ্রিস্টান ছেলেকে আমার লাইফ পার্টনার কখনোই মেনে নিতে পারবেন না। আমিও মেনেনিলাম উনাদের কথা। কাট কাট গলায় এরিককে বললাম, আমার ফিলিংস নেই তোমার প্রতি। আমি বিয়ে করে আমার ধর্ম পরিবর্তন করতে পারবো না। তো বলুন তো? আমি যদি উনাদের জন্য সেক্রিফাইজ করতে পারি উনারা কেন পারবেন না? আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে না দেখে কালই ডেড কল দিয়েছে। বলেছে শীঘ্রই উনি টিকেট পাঠিয়ে দেবে এয়ারলাইন্স এর। যাতে আমি দ্রুত ব্যাক করতে পারি।’

একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলো দম নিলো আফরা। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে ও। ফাহিম এতক্ষণ প্রতিটা কথা মনোযোগ দিয়েশুনলো আফরার।ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে পারলো আফরার লাইফস্টাইল, ওর পার্সোনাল লাইফ আর ওর ফিলিংসের ব্যাপারে। নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে আন্দাজ করে নিলো কোনো না কোনো ভাবে ফারহানের দ্বারা আফরা চরমভাবে হার্ট হয়েছে। যেটার মীমাংসা করা দরকার। কেননা ফাহিম কোনো জঘণ্য ধরনের মানুষ না যে যাকে সে পছন্দ করতো তার খারাপ সে চাইবে। ফাহিম কফির মগে চুমুক দিলো পুনরায়। বলে ওঠলো,

‘ কষ্ট নিয়ে চলে যাবেন না আফরা। আপনার মনে যেই অস্থিরতাগুলো হচ্ছে সেগুলো কমিয়ে তারপর ফিরবেন।’

ফাহিমের এই কথাটি হৃদয়ে গেঁথে গেলো ক্রমশ। আসলেই তো! ফারহানের ব্যবহারে ও কেনো মন খারাপ করছে? আফরা মনে মনে ভেবে নিলো, ফারহানের সাথে কথা বলবে ও। ওর মনের অস্থিরতার বিহিত যদি কেউ করতে পারে সেটা ফারহান। ফাহিম বলে ওঠলো,

‘ তবে ফিরে যাওয়ার আগে আপনাকে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে হবে।’

‘ কোন প্রশ্নের?’

‘ সেটা নাহয় সময় হলেই দেখে নিয়েন।’

ফাহিমের চোখেমুখে রহস্যের ছাপ। আফরা সেই রহস্যময়তা ধরতে পারলো না। যদি ধরতে পারতো তবে বুঝতে পারতো যে আফরা আর ফারহান দু’জন কিভাবে ওর অনুভূতিগুলোকে ধুলিস্যাৎ করেছে।

_______________

বৃষ্টির তেজ কমার দরুন আফরা পা বাড়ালো বাংলোর বাহিরে। আশপাশে স্যাঁতস্যাতে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দুপুর এখন আড়াইটা কি তিনটা বাজে। ফাহিম বাসায় নেই। ইলা গিয়েছে প্রাইভেট পড়তে। মিসেস নাবিলা এতক্ষণ আফরার সাথে গল্প করছিলো কিন্তু কিছুণ আগে মিঃ ইফাজ বাড়িতে আসাতে তাকে ভাত বেড়ে দিতে মগ্ন হয়ে পড়লেন। আফরা তাই বাংলোর বাহিরে পা বাড়ালো।
দূর আকাশে ফুটে ওঠেছে মিষ্টি রোদ্দুরের আভা। সেই আলো সমগ্র চা বাগানকে দিন দুপুরেই মায়ার রাজ্য বানিয়ে দিয়েছে৷ আফরা পা বাড়িয়ে ফারহানের ছোট কুটিরটিতে গেলো। উঠোনের এক সাইডে জংলা হয়ে আছে। সামনের কাঠের বারান্দার কাঠের একটি রকিং চেয়ার রাখা। দরজায় তালা ঝুলছে দেখে আফরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জড়ানো কন্ঠে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,

‘ কোথায় আপনি কমরেড সাহেব? আপনার চিন্তায় এদিকে যে কেউ অপেক্ষায় আছে সেটার ধারনা আছে আপনার?’

—————-

আজ রৌশিন খুব ভয়ঙ্কর একটি স্বপ্ন দেখেছিলো দিন দুপুরে। সেদিন রাতে ফাহিম আর ওর অপ্রত্যাশিত চুমুর পর স্বপ্নে দেখেছিলো যে ফাহিম কানে হাত দিয়ে উঠবস করছে আর সরি বলছে রৌশিনকে। যদিকে দোষ ফাহিমের ছিলো না, এমনকি রৌশিনেরও। তবুও এই অস্বস্তির মাত্রা কাটিয়ে তোলার জনয় রৌশিন স্বপ্নে ফাহিমকে না বলে দেয়। ফাহিম খুশিতে আরও এক দফা ওর গালে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করতেই হড়বড়িয়ে উঠে পড়ে রৌশিন। কপাল দিয়ে টপটপ ঘাম পড়ছিলো। রৌশিনের বড় ভাই সাব্বির তা দেখে অবাক হয়ে যায়। একে তো ঠান্ডার দিন তার ওপর ওকে এত ঘামতে দেখে অনবরত প্রশ্ন করতে থাকে শারীরিক অবস্থা নিয়ে। তবে রৌশিন তা সূক্ষভাবে এড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। পড়ায় মন দেওয়ার চেষ্টা করলেও যেন পারলোনা।

সেরাতের পর ফাহিমের সাথে একেবারেই দেখা হয়নি রৌশিনের। দেখা হবেই বা কিভাবে, রৌশিন তো সেরাতের পর মুখোমুখিই হয়নি ফাহিমের। কলেজেও যায়নি এমনকি যোগাযোগ করেনি ইলার সাথেও।

আজকাল পড়াশোনাতেও কেমন যেন অন্যমনষ্ক হয়ে গিয়েছে। চোখে বন্ধ করেই ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওর আর ফাহিমের সেই কাছাকাছি আসার অপ্রত্যাশিত দৃশ্যটা। রৌশিন তাই বই বন্ধ করে চেয়ারে শরীরের ভর ছেড়ে দিলো। এই ব্যাপারটা ভুলানোর জন্য মুখ্যম উপায় হলো ঘুম। এমনিতেও রাত হয়েছে অনেক। তার ওপর বৃষ্টি একেবারই নেই। আকাশ পরিষ্কার একেবারে। দূরে তারাদের আনাগোনা দেখা গেলো অনেকদিন পর। কামিনী ফুলের কড়া ঘ্রানে ঘুম ভর করেছে রৌশিনের চোখে। তাই দ্রুত সে বিছানায় কাথা মুড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
.
.
.
নিরবিচ্ছিন্ন রাত। ঘুমে অর্ধনিমজ্জিত রৌশিন। জানালা দিয়ে সা সা করে হাওয়া ওর ঘরে প্রবেশ করাতে ঘর শীতল করে দিচ্ছে। রৌশিন ঘুমের ঘোরেই চোখ কুচকালো। ওর জানামতে জানালা তো লাগিয়ে দিয়েছিলো, যদিও লক করা হয়নি, কিন্ত সেটা খুলে গেলো কি করে? আচমকাই নিজের শরীর গরম অনুভূত করছে রৌশিন। এই গরম স্বাভাবিক উষ্ণতা নয়, কোনো মানবের স্পর্শে যেমন অনুভূত হয় ঠিক তেমনই। রৌশিনের মনে ভয় ঢুকে গেলো। চোখ খুলতেই আলো আধারের খেলায় দেখতে পেলো একটি অবয়বকে। তার অবস্থান ঠিক রৌশিনের ওপর, একেবারে ঝুঁকে আছে সে ওর দিকে। একটা দেখে রৌশিন চিৎকার দিতে যাবে তার পূর্বেই মানুষটা নিজের বলিষ্ঠ হাত দ্বারা চেপে ধরলো রৌশিনের মুখে। রৌশিন এতে আরও ভয় পেয়ে গেলো। উম্মম উমম্ম গোঙানি করতেই মানুষটা শীতল কন্ঠে বলে ওঠলো,

‘ রৌশিন! ইটস মি। ফাহিম। চিৎকার করো না। আজ তোমার জন্যই চোরের মতো এভাবে তোমার বাড়িতে বেসামাল হয়ে এসেছি!!”‘
.
.#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤️
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৪০+৪১
‘ রৌশিন! ইটস মি। ফাহিম। চিৎকার করো না। আজ তোমার জন্যই চোরের মতো এভাবে তোমার বাড়িতে বেসামাল হয়ে এসেছি!!”‘

রৌশিন পলকহীন চোখে নিজের ওপর অবস্থানরত ফাহিমের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। চোখপর বিস্ময়কর ভাবটা এখনও কাটেনি। ওর স্নায়ু রীতিমতো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মানতে কষ্ট হচ্ছে যে এখানে ফাহিম আছে। রৌশিন নড়াচড়া বন্ধ করলো না। অস্বস্তি হচ্ছে প্রচন্ড এভাবে একই বিছানায় ফাহিমের সাথে ঘেঁষে থাকাতে। ফাহিম আবার বলে ওঠলো,

‘ এত নড়াচড়া করতে হবে না। আমি এখনই তোমার মুখ ছাড়তে পারি যদি তুমি চিৎকার না করো। চিৎকার করবে নাকি?’

রৌশিন মাথা নাড়িয়ে না-বোধক উত্তর দিলো। তারপর ওর মুখ থেকে নিজের হাত সরালো ফাহিম। রৌশিন উঠে বসলো। দূরে চলে গেলো ফাহিমও। রৌশিনের শরীর কাঁপছে ভয়ে। ঘড়ির কাটায় তিনটা বেজে পাঁচ মিনিট দেখে আটকে ওঠে৷ জানালা খোলা থাকাতে বুঝতে বাকি রইলো না যে ফাহিন কিভাবে এত রাতে এ ঘরে এসেছে। রৌশিনের রীতিমতো শরীর রি রি করছে রাগবশত। দাঁতে দাঁত চেপে সে ফাহিমকে প্রশ্ন করলো,

‘ এত রাতে একটা মেয়ের ঘরে এভাবে আসতে আপনার লজ্জা করেনা? জলদি বাড়ি ফিরে যান। আব্বা যদি জানে যে এত রাতে আমার ঘরে ছেলে আছে জানে মেরে ফেলবে আমায়। যতই মানুষটা আমাট বড় ভাইয়ের বন্ধু হোক না কেনো?’

‘ তোমার সাথে কথা না বলে আমি যাচ্ছিনা।’

কাট কাট গলায় বললো ফাহিম। ওর চোখে কঠোরতার ভাব। চোখ মুখ অস্থির দেখাচ্ছে। আজ সারাদিনই রৌশিনের সাথে একদন্ড কথা বলার জন্য নিষপিষ করছিলো ওর মন। রৌশিন কাতর চোখে তাকালো ফাহিমের দিকে। বলে ওঠলো,

‘ আপনি আস্তে কথা বলুন ফাহিম, আব্বা শুনতে পারলে……’

‘ ওকে ফাইন, তো তুমি আমার সাথে চলো।’

রৌশিনের চোখ বড় হয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,

‘ কোথায় যাবো? কিভাবে যাবো? আমি কোথাও যাচ্ছিনা বুঝছেন? আপনি ভালোয় ভালোয় এখান থেকে কেটে পড়ুন নয়তো আমি ভাইজানকে’

কথাটির ইতি টানতে পারলো না রৌশিন। ফাহিম খাটের একপ্রান্ত থেকে ওর ওড়না টেনে নিয়ে মুখ কড়াকড়িভাবে বেঁধে দিলো। রৌশিন হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। মোচড়া মুচড়ি করতেই ফাহিম কোলে তুলে নিলো রৌশিনকে। জানালা দিয়ে যেভাবে এসেছিলো তেমনভাবেই বাহিরে বেরিয়ে রাস্তার সাইডে রাখা গাড়িতে চলে গেলো রৌশিনকে নিয়ে। একে তো গহীন রাত, তারওপর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মাঝরাতে ভাগ্যবশত মিলিটারি লোকদের ছাড়া দেখা যায়না তেমন কাউকেই৷ তাই ফাহিমের এই ছোটখাটো কিডন্যাপিং করতে তেমন দুঃসাধ্যের মতো কিছু হলো না।

রোশিন অনবরত নড়াচড়া করছিলো, ফাহিম গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিতেই ওর মনে ভয় ঢুকে যায়। চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে টপটপ করে। ফাহিম আজ অনড়, রৌশিনের সাথে কথা না বলে কিছুতেই শান্তি পাবে না ও। গাড়ির ইন্জিন ফটাফট স্টার্ট করে রৌশিনদের বাসা থেকে অনেক দূরে চলে গেলো দুজনে। রৌশিনের মুখ এখনও বাঁধা, জামাকাপড় ওলটপালট হয়ে আছে। ও কখনো ভাবতেই পারেনি যে ফাহিম এমনভাবে কিডন্যাপ করতে পারবে ওকে। আর যাই হোক এমন একটা জঘণ্য কাজের জন্য ও ফাহিমকে ক্ষমা করবে না, কিছুতেই ক্ষমা করবে না।

ফাহিম এবার রোশিনদের বাসার থেকে নিরাপদ দুরত্বে এসে গাড়ি থামিয়ে দিলো হঠাৎ। তারপর স্টেয়ারিংয়ে মাথা এলিয়ে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। উন্মাদ লাগছে ফাহিমকে। আজ ওর কীর্তিকলাপ জানান দিচ্ছে অন্য কিছুরই। রৌশিন তখনও প্রাণপণে ছটফট করে চলছে ফাহিমের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য। চোখ নাক সব লাল হয়ে গিয়েছে কান্নায়। তবে মুখ দিয়ে একটি আওয়াজও বের করতে পারলোনা। ফাহিম দুর্বল চোখে তাকালো রৌশিনের দিকে। শীতল কন্ঠে বলে ওঠলো,

‘ তুমি আমার জন্য আর কোনো চয়েজ রাখো নি রৌশিন। দ্যাট হোয়াই আই হ্যাভ টু ডু ইট।’

রৌশিনের রাগ হচ্ছে ফাহিমের প্রতি প্রচন্ড। এই লোক তো আগে এমন ছিলো না? এখন হুট করে পাগলে ধরেছে নাকি? ফাহিম আচমকা স্টেয়ারিং ছেড়ে এগিয়ে এলো রৌশিনের দিকে। ভড়কে গেলো রৌশিন, দু’কদম পিছিয়ে যাওয়ার পর থেমে গেলো। কেননা , ও একেবারেই জানালার সাথে ঘেষে গিয়েছে। আসলে কি করতে চাচ্ছে ফাহিম? ওর মনে আচমকা ভয় হানা দিলো । তা দেখে ফাহিম দুর্বল হাসলো। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

‘ রিলেক্স ! আগের মতো কিস করবো না। যদিও তা হয়েছিলো এক্সিডেন্টলিই। আর হ্যাঁ, জামা ঠিক করো, হাতখুলে দিচ্ছি , তোমার গোপন জিনিসগুলো আমার সামনে দৃশ্যমান হয়ে আছে।’

রৌশিনের কান একেবারেই গরম হয়ে গেলো লজ্জায় আর অস্বস্তিতে। চোখ নিচে নামাতেই চক্ষু চড়কগাছ। এতক্ষণ মোচড়ামোচড়ি করার কারনে পরনে জামার নাজেহাল অবস্থা। গলায় একসাইডে জন্মদাগটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাত ছাড়া পাওয়া মাত্রই রৌশিন তা ঠিক করে নিলো। মুখে বাধাঁ ওড়না খুলে জড়িয়ে নিলো গায়ে।

রৌশিনের বুক এবার ঢিপঢিপ করছে। কাঁপা কাপাঁ গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘ আমায় কেনো নিয়ে এসেছেন ফাহিম ভাইয়া?’

‘ বললাম তো। জরুরি কথা আছে তোমার সাথে।’

‘সেটা তো কখন থেকেই বলছেন। আসল কথা বলছেন না কেনো?’

চিৎকার দিয়ে বললো রৌশিন। বাইরে বহমান জোরালো বাতাস। বিদ্যুত চমকানোর আওয়াজ জানান দিচ্ছে ঝুমঝুমিয়ে পড়ার বৃষ্টির ছন্দের। ফাহিম এবার গহীন দৃষ্টিতে তাকালো রৌশিনের দিকে। কাট কাট গলায় জিঙ্গেস করলো,

‘ আমায় ইগ্নোর করছিলে কেনো এতদিন? তুমি কি মনে করো, তোমার কলেজে না যওয়ার কারন আমি ধরতে পারিনা?’

রৌশিন এবার কি বলবে ভেবে পেলো না। ফাহিম আবার বললো,

‘ আমাদের মধ্যে সেই ঘটনাটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। তবুও এরকম বিহেভিয়ার কেন রৌশিন? তোমার ইগ্নোরেন্স পাগল করে দিচ্ছিলো আমায়?’

‘ আপনি যদি বুঝতেন তবে কথাটি কখনোই জিজ্ঞেস করতেন না আমায়। আরে ভালোবাসি আমি আপনাকে। পাগলের মতো, উন্মাদের মতো ভালোবাসি এটা জেনেও যে আপনি আমার না , আফরার। তাইতো সেদিনের আপনার স্পর্শ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো আমার। আমি চাইনি আপনাকে দেখে উপলদ্ধি করতে যে আপনি আমার না।’

কথাগুলো রৌশিন আর মুখের আগায় আনতে পারলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুদৃঢ় গলায় বলে উঠলো,

‘ আমার ইগ্নোরেন্স কেনো পাগল করবে আপনায়? আমি আপনার কি হই? বোন? কাজিন? নাকি অন্যকিছু। ভালোবাসা তো একেবারেই না, কারন আপনি আফরাকে…….’

‘আমি যদি বলি আফরার জায়গায় এখন তুমি আছো? আমি শুধু ধরতে সময় নিয়েছি?’

স্তব্ধ হয়ে গেলো রৌশিন। ওর চোখের পলক পড়া যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এই মাত্র কি বললো ফাহিম? ফাহিম এবার রৌশিনের পিঠে হাত দিয়ে কাছে টেনে আনলো ওকে। রৌশিনের হাত পা তখন জমে হয়ে গিয়েছে পাথর। চোখের থৃষ্টি নিষ্প‍্রভ। ফাহিম তখন বলে ওঠলো,

‘ আফরা পছন্দ ছিলো আমার। ক্রমেই আমি বুঝতে পেরেছি আফরা আর আমি এক হতে পারবো না। আর আমি এতদিন নির্বোধ ছিলাম যে তোমার চোখের ভাষাগুলো, আমার নিজের মনের কথাগুলোই বুঝতে পারিনি। তোমার চোখ এখনও স্পষ্ট বলছে যে ইউ আর ইন লাভ উইথ মি রৌশিন। আমি এমন কাউকেই চাই যে ভালোবাসতে পারবে আমায়। আমায় সব দিক দিয়ে আগলে রাখবে। আমার ছোট ছোট বিষয়গুলো খেয়াল রাখবে। রৌশিন? তুমি হবে আমার চলার পথের সঙ্গী?’

রৌশিনের কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। কিন্ত না, ফাহিমের বেসামাল চোখ, প্রখর অনুভূতির চাহিনী জানাল দিচ্ছে যেএটা স্বপ্ননা। রৌশিন মাথা নাড়ালো। বলে ওঠলো,

‘ অপ্রত্যাশিত জিনিসটা খুবই আজব ফাহিম ভাইয়া। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই আপনাকে আমি নিজের করে পেয়েছি।’

_______

আফরার ঘুম বড্ড বেশি পাতলা, তাই এই রাতে হঠাৎ সরু শব্দ কানে আসাতে চোখে খুলতে সময় নিলো না। বাইরের থেকে ঠান্ডা বাতাস হুড়হুড় করে গা ছানি দিয়ে পালিয়ে যায় বলে আজ আফরা লাগিয়ে দিয়েছিলো বারান্দার দরজা৷ পর্দা খোলা থাকলেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সামনে বরাবরে থাকা নাম না জানা গাছের ডালপালা নড়ছে বিরতীহীন ভাবে।

আফরা বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে গেলো। জানালাটা খুলতেই ওর গায়ে ছমছম করা হাওয়া স্পর্শ করে নাড়িয়ে দিলো কর উষ্ণ শরীর। রাত অনেক হলেও বাহিরে অন্ধকার তেমন একটি নেই। এর মধ্যে যে চা বাগানের সরু পথ দিয়ে কেউ হেঁটে আসছে এটা বুুঝতে ওর অসুবিধা হলো না। ক্রমেই সেই ঘোলাটি অবয়বটি আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠলো ধীরে ধীরে সামনে আসার পর। সাথে সাথে উত্তেজনায় আফরার চোখজোড়া চকমক করে ওঠলো।
আফরার শরীর কাঁপছে বিরতিহীন ভাবে, পা জোড়া ক্রমশ হয়ে এসেছে অসাড়। ফারহানকে আজ এতদিন পর এখানে উপস্থিত দেখার পর অভিমানও আক্রোশ করেছে মনে। আফরা আর ভাবলো না, নমনীয় ভাবে পা ফেলে ও নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এত রাতে ওই মানুষটার কাছে যাওয়াটা আপাতদৃষ্টিতে ভালো না দেখালেও ওর মন বলছে অন্য কথা। তাই এমনভাবে পা টিপে টিপে সে বাইরে বেরুলো যাতে ঘরে অবস্থানরত মিসেস নাবিলা বা মিঃ ইফাজ বিন্দুমাত্র টের না পায়। বাইরে বেরোতেই পুনরায় জমকালো হাওয়ার আদলে কেঁপে উঠল ওর শরীর। তবে আফরা তাতে ভ্রুক্ষেপ করলো না৷ বরং ধীরপায়ে সে ফারহানের ঘরের কাছে গেলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ডাক দিলো,

‘ ফা ফারহান!’

ফারহান তখন ঘরের তালা খুলছিলো। হঠাৎ পেছন থেকে একটি মিষ্টি কন্ঠ কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হওয়াতে পিছে ফিরলো। এত রাতে আফরাকে চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না, ফারহানের মুখভঙ্গি শান্ত, যেনো আফরার এত রাতে এখানে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবুও ভদ্রতার খাতিরে সে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আপনি এত রাতে এখানে কেনো এসেছেন আফরা?’

আফরা কথা বলতে পারলো না। এতদিন মনে হাজারো কথা জমে থাকলেও এখন ওর সর্বাঙ্গে সংকোচ ভর করেছে৷ ফারহানকে আজকেও লাগছে মারাত্মক। গায়ে সাদা টিশার্ট, নীল জিন্স, তার ওপর সাপের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য পরেছে কালো রঙের বুট জুতো৷ এত রাতেও মুখে মাস্ক পড়া। যেন নিজের বাড়িতে ছদ্মবেশী রূপ ধারন করে এসেছে। আফরাকে চুপ থাকতে দেখে দৃষ্টি আরও গম্ভীর হলো ফারহানের। বলে ওঠলো,

‘ এত রাতে এখানে আসাটা আপনার উচিত হয়নি আফরা। আপনি ফিরে যান।’

‘ যাবো না৷ কারন আপনি কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না যে আপনার সাথে আমার পরবর্তীতে কথা হবে কিনা!’

আকাশে আচমকাই হাতছানি ছিলো কালো মেঘগুলো৷ গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ বৃষ্টির আগাম বার্তার সংকেত দিচ্ছে। অপ্রতিভ হলো ফারহান। এতদিনে এতটুকু বুঝতে পেরেছে যে আফরা কথা থেকে একটুও নড়বড়ে নয়। তাই ফারহান দরজা খুলে ইশারায় প্রবেশ করতে বললো আফরাকে। আফরা তাই নীরবে প্রবেশ করলো ভেতরে।

ফারহান বারান্দার একপাশের দরজা খুলে দিলো। যার দরুন সাঁ সাঁ করে হাওয়ার দল ছুটে এলো ঘরে। ঘরের পর্দাগুলো ফিনফিনে মেঘের ন্যায় উড়ে চলছে। আফরা বারন্দার একপাশে রাখা কাউচে বসে পড়লো৷ অপ্রতিভ চোখে দেখলো ফারহানকে। ফারহান তখন পায়ের বুট জুতো খুলতে মগ্ন। সেখানে আংশিক কাদা দেখা যাচ্ছে। প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ, মোবাইল আর মাক্স রাখলো ছোট টেবিলের ওপর। রুমের এককোনায় অবস্থানরত ছোট কিচেন রুমটির দিকে এগোতে এগোতে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি খাবেন আফরা? চা না কফি!’

‘ আপনার হাতের যেকোনো একটা হলেই চলবে।’

আফরা অন্যসময় হলে কফি চাইতো, কেননা আফরা চায়ের টেস্ট খুব বেশি একটা পছন্দ করে না। তাই ফারহান তেমন একটা কফি না খেলেও কফি এনে রেখেছিলো শুধুমাত্র আফরার জন্য। এখন ওর এমন প্রতিউত্তরে অবাক হলো ফারহান৷ তবুও কিছু বললো না। ইনস্ট্যান্ট কফি মেক করে কফির কাপ এগিয়ে দিলো আফরার দিকে। আফরা তা হাতে নিয়ে নিলো।

বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে গভীর রাতের। তবে আফরার মনে কোনো সংকোচ নেই। নীরবতা কাটানোর জন্য সরাসরি ফরহানকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি?’

‘ আমায় সচরাচর এ ধরনের প্রশ্ন করার কেউ সাহস পায় না আর আমিও কাউকে এ ধরনের উত্তর দিতে অভ্যস্ত নই আফরা।’

শীতল গলায় বলে উঠলো ফারহান। চেহারায় নির্বিকারত্বের ছাপ। আফরার চেহারায় অভিমান আরও স্পষ্ট হলো এতে। বলে ওঠলো,

‘ আর কেউ সাহস না পেলেও সে সাহস আমার আছে৷ সেটা আপনি ভালোমতোই জানেন। আর অন্য কারও সাথে ভুলেও আমার তুলনা করার চেষ্টা করবেনা না প্লিজ। আপনি জানেন আপনার কোনো খোঁজ খবর না পাওয়াতে কি অবস্থা হয়েছিলো আমার?’

ফারহান ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বললো,

‘ আমি কিভাবে জানবো? তাছাড়া আমি আগেও বলেছি যে পৃথিবীতে এখন এমন কেউই নেই যারা আমার জন্য চিন্তা করবে৷ কারন সেই মানুষগুলো অনেক আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছে। তাহলে আপনার আমার জন্য এত চিন্তা কেনো?’

আফরার গলা আটকে আসছে ক্রমশ। চোখ টুইটুম্বুর করছে জলে। তবুও অনেক কষ্টে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আপনি কি এখনও বুঝতে পারেন না এই চিন্তার কারন?’

ফারহান দমে গেলো এ কথা শুনে। কেননা ও এতটাও অবুঝ না যে এতদিনে আফরার চোখের ভাষা, ওর ব্যাবহার বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেনি। ফারহান হাসলো। বলে ওঠলো,

‘ আপনার চোখের ভাষা, কথার ধরন দেখে শুধু আমি না, মোটামুটি সবাই বুঝতে পারে যে আপনি দুর্বল আমার প্রতি। তাইতো আমি দূরে সরে যাচ্ছি আপনার কাছে থেকে। আপানর লাইফস্টাইল সম্পর্কে ধারনা আছে আমার আফরা। কেননা আপনি আমায় সবটাই বলেছিলেন যে ঠিক কি কারনে আপনার বাবা-মা আপনাকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। তারপরও একই ভুল করতে যাচ্ছেন কেন আফরা? তাই আমি স্পষ্টভাবেই বলছি, আমার থেকে দূরে থাকলেই সুখী থাকবেন আপনি। কারন আপনার জীবন আর আমার জীবনের গতিতে আকাশ জমিনের ব্যবধান!’

ফারহান থামলো। আফরার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য তাকালো ওর দিকে। তবে দেখে মনে হলো না যে আফরার মধ্যে ওর কথার বিন্দুমাত্র কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটেছে।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি এবার রূপ নিয়েছে তুমুল বৃষ্টিতে। আকাশে শব্দ হচ্ছে মেঘের গর্জনের৷ আফরার হাতে ধূমায়িত কফির কাপ। শ্রীমঙ্গলের এ সময়ে চা’ই হয়তে মুখ্যম ছিলো। কফিটা কেমন যেনো বেমানান লাগছে এখানে। আফরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলে উঠলো,

‘ আমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবেন ফারহান? শেষবারের মতো?’

আফরার এই কথাতে ছিলো অগাধ মায়া। ফারহান কেনো যেন না করতে পারলো না৷ মাথা নাড়িয়ে তাই আফরার হাত ধরে সে বাড়ির বাহিরে পা বাড়ালো। বৃষ্টির দরুন সিক্ত হয়ে উঠেছে সারা চা বাগান। অদূরে অবস্থানরত বাংলো টা ভুতুড়ে বাড়ি থেকে কম কিছু মনে হচ্ছে না। আফরা সেদিকে মন দিলো না৷ চোখ বন্ধ করে উপভোগ করতে লাগলো বৃষ্টির প্রতিটি বিন্দু। ফারহান একপলক ওর দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো।

‘ কমরেড সাহেব!আমার চোখের দিকে তাকানোর মতো ক্ষমতা আছে আপনার? ‘

আফরার নিদারুন কন্ঠ। ফারহান তাকালো ওর দিকে। আফরা আবার বললো,

‘ এই মেয়েটাকে দেখে আপনার একটুও মায়া হয়না? এইযে সারাদিন রাত আপনার চিন্তায় বিভোর থাকে। কি হয় তাকে একটু আগলে নিলে?’

ফারহান এবার কি বলবে ভেবে পেলো না। এসব অভিজ্ঞতা তার নেই বললেই চলে। আফরা এবার কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠলো,

‘ আমি…….আমি যে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি ফারহান! এখন কি করবো আমি? ভুল তো আগেও করেছিলাম বহুবার। কিন্ত এই ভুলটা থেকে কোনোক্রমেই ছাড় পাচ্ছি না আমি ফারহান। আমায় এই ভুলটা সহ একবার কি আগলে নেয়া যায় না?’

আফরার এবার চরম একটা কাজ করে বসলো, এক সেকেন্ড সময় ব্যয় না করে টুপ করে ফারহানের থুতনিতে ঠোঁট স্পর্শ করে দিলো। ফারহানের তখন কি হয়েছিল ওর ধ্যান ছিলো না। আচমকা ফারহান নিজের বলিষ্ঠ হাত দ্বারা আগলে নিয়েছিলো আফরাকে। দুজনের সময়ই যেনো থেমে গিয়েছে৷ শুধু অনুভব করতে পারছে একে অপরের উষ্ণ নিঃশ্বাস আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আওয়াজ।

বেশ কিছুক্ষণ পর ধ্যান ফিরলো ফারহানের। তাই আফরাকে ঝট করে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিলো। আফরা অবাক। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে ফারহানের দিকে। ফারহান মৃদু কন্ঠে বলে ওঠলো,

‘ আই…..আই এম সরি আফরা। ইটস ইম্পসিবল!’

আফরা নিশ্চুপ।

‘ এটাকে ভুলে যান আফরা। আমি, আমি কখনোই আপনাকে আমার দুর্বলতা বানাতে পারবো না। যেখানে আমার নিজের জীবনেরই ঠিকঠিকানা নেই। আপনার জীবনের কি নিশ্চয়তা দেবো আমি?’

‘ ম মানে?’

ফারহান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো৷ বলে উঠলো,

‘ আমি এতদিন নিখোঁজ ছিলাম কেনো জানেন? কারন আমায় কেউ মারার চেষ্টা করছিলো। আপনার হয়তো মনে আছে যে ইলেকশন জনিত কারনে বেশ কয়েকদিন আগে পুলিশ এরেস্ট করেছিলো আমায়। এগুলোর সব করা হচ্ছে একজনের কথামতো, যে চাচ্ছে না যে আমি বেঁচে থাকি। কারন মানুষটা ব্ল্যাক মানির সাথে ইনভল্ভড ছিলো। যার প্রমাণ আমার হাতে আসাতে দু’তিনদিন আগে রাতে রাস্তায় শ্যুট করা হয় আমায়।’

আফরা আতঁকে উঠে। ফারহান নিজের পরেনে শার্টের বোতাম খুলে একপাশের ক্ষতটা দেখিয়ে দিলো ওকে৷ ক্ষতটা বেশি পুরোনো নয়। দাগটাও স্পষ্ট দৃশ্যমান। আফরা দুর্বল কন্ঠে বলে উঠলো,

‘ আপনি এসব ছেড়ে দেননা কেনো? জানেন আপনার জীবনের ঝুঁকি আছে, তবুও……..’

‘ এটাই তো আপনার আর আমার মধ্যে পার্থক্য আফরা৷ আমি মানুষের জন্য কাজ করতে ভালোআাসি আর আপনি ভালোবাসেন নিজের লাইফ নিয়ে ইন্জয় করতে। আপনার টা আমি খারাপ বলছি না, তবে আমি চাইলেও এখন এখান থেকে সরে আসতে পারবো না।
রাজনীতি একটা মায়াজালের মতো আফরা৷ একবার এই গন্ডিতে ঢুকে গেলে সেখানে থেকে ছাড় পাওয়া দুষ্কর। আর আমি এজন্যই চাইনা আপনার সাথে নিজেকে জড়াতে। কথাটা তিক্ত শোনালেও আপনাকে শুনতে হবে আফরা, আমার থেকে দূরে থাকাটাই আপনার জন্য মঙ্গল। আমার সাথে আপনি না ভালো থাকতে পারবেন, না আমি আপনার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবো। আমি একা থাকাতে অভ্যস্ত আছি আফরা৷ আপনিও আমাকে ভুলে যান৷ ভুলে যান আজকের রাতের এই স্মৃতিগুলোও। ‘

আফরার চোখ দিয়ে টুপ করে জল গড়িয়ে পড়লো। ও কখনোও ভাবতেও পারেনি ভালোবাসার জন্য এভাবে কাঁদতে হবে ওকে। আফরা বিদ্রুপ হাসি হেসে বলে উঠলো,

‘ ফাইন, আপনার জন্য একটা গুড নিউজ আছে৷ শুনবেন? আমার ড্যাড আমায় বিগত কয়েকদিন ধরেই জোর করছিলো ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি আপনার সাথে আমার ফিলিংস শেয়ার করতে চেয়েছিলাম বলে কথা আগাইনি। ‘

‘ এটা তো আসলেই একটা গুড নিউজ আপনার জন্য হিসেব করলে৷ কেননা আপনাকে তো বাংলাদেশে জোরপূর্বক পাঠানো হয়ছিলো৷ তাহলে ফিরে যান আপনার দেশে। খুশিমনে যান, আপানর জবও হবে, ইন্জয়মেন্টও হবে। আবার আগের মতো লাইফও হবে৷’

আফরার এবার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে৷ ইচ্ছে করছে ফারহানকে ইচ্ছেমতো মারতে৷ এই লোকটা কেনো এতো পাষাণ? কি এমন ক্ষতি হতো ওর অনুভূতি টা বুঝতে পারলে। হয়তো ফারহান নিজের জায়গাতে ঠিকই ছিলো যা বুঝতে পারনি আফরা৷ আফরা এবার কথা বাড়ালোনা৷ চুপচাপ ফারহানকে ছেড়ে চলে গেলো বাংলোর দিকে। থাকবে না ও আর বাংলাদেশে৷ ভুলে যাবে এই ফারহান নামক মানুষটিকে।
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here