অতঃপর প্রেমের গল্প পর্ব ৩৭+৩৮

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤️
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব___৩৭
আজ ভোরে পাখির কলকাতানও সংকেত দিচ্ছে এইতো সময় ঘনিয়ে এসেছে ‘টাঙ্গুয়ার হাওর’ এ যাওয়ার। পিটপিট করে চোখ খুললো আফরা। মুখে ওপর পূব দিকের বারান্দা ভেদ করে আছড়ে পড়ছে রৌদ্দুর। সকাল বেলা সীমান্তবর্তী এই পূর্ব দিকটা অনন্য সুন্দর মনে হয় আফরার কাছে। রৌদ্দুরের আনাগোনা দেখলে মনে হয় যে সূর্য বুঝি বাংলাদেশে ওপারে থাকা ভারতের মেঘালয় এর পাহাড়গুলো সাথে রৌদ্রময়ী লুকোচুরি খেলছে। এসব কিছু দেখেই আফরার মন প্রসন্ন হয়ে গেলো।টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার ডেট পিছিয়ে গিয়েছে বিশেষ কারনে। আর এর মধ্যে হয়ে গিয়েছে অনেক কিছু । অনেকদিন পর ও একটা শান্তির ঘুম দিয়েিলো। । ফারহানের সাথে কাটানো সময়গুলো খুবই সাধারন প্রক্ষাপটের ভিত্তিতে মনে হলেও ওর কাছে এগুলো অনেক বিশেষ স্মৃতি। আফরা হতদন্ত ভাবে উঠে ফ্রেস হয়ে নিলো। ইলার রুমে গিয়ে দেখলো ইলাও ঝড়ের গতিতে রেডি হচ্ছে। মেয়েটা বরাবরই লেট লতিফ। কোনো কাজ সময়মতো করা একেবারে অসম্ভব ওর জন্য। ইতিমধ্যে ফাহিম আর মারুফ থেকে বেশ কয়েকটা ঝাড়িও খেয়ে ফেলেছে। আফরা তপ্তশ্বাস ফেলে ইলার উদ্দেশ্যে বললো,

-তুমি জানো যে লেট করলে ফাহিম তোমায় বকবে। তাহলে এত লেট করলে কেনো?

-আর আপু বলোনা। ঘুমটা কাটাতেই পাচ্ছিলাম না।

-আর কতক্ষণ লাগবে তোমার,, ফাহিম ডাকছে তো?

-এইতো হয়ে গিয়েছে। তুমি নিচে যাও ওদের কাছে। আমি আসছি।

আফরা তারপর নিচে ড্রইংরুমে পা বাড়ালো। আজ আফরা একটা বেগুনি রঙের সালোয়ার কামিজ পড়েছে। এই জামাটি আফরা নিয়েছে ইলার কাছ থেকে। আফরা সালোয়ার কমামিজে অভ্যস্ত না। ওর মনেও পড়েনা ও লাস্ট সালোয়ার কামিজ কবে পড়েছিল। তবে এই বেগুনি রঙটা ওর ফর্সা গায়ে মারাত্নকভাবে ফুটে ওঠেছে। সিড়ি বেয়ে আফরা নামার সময়ই ওর চোখাচোখি হলো ফাহিমের সাথে। ফাহিম কিছুক্ষণ আফরার এই রূপে বিমূঢ় হয়ে ছিলো। তবে আফরা চোখ সরিয়ে ফেললো ফাহিম থেকে। সেদিন রাতে মিসেস নাবিলা আর মিঃ ইফাজের কথার সাপেক্ষে ফাহিমকে এড়িয়ে যাওয়াটাই ওর জন্যে ভালো। আসলে সেদিন রাতে ফারহানের সাথে বাড়িতে ফেরার পর রাতে মিসেস নাবিলা আর মিঃ ইফাজ এসেছিলো আফরার কাছে। আফরা তখন খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুটিয়ে আনমনে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করছিলো। তখন উনাদের একসঙ্গে নিজের ঘরে দেখে খানিকটা বিস্মিত হয় আফরা। তবুও সেটা আফরা প্রকাশ করলো না। ভদ্রতার খাতিরে বললো,

-দাঁড়িয়ে আছেন কেনো আঙ্কেল আন্টি? বসুন।

মিঃ ইফাজ আর মিসেস নাবিলা বসে পড়লো খাটের একপ্রান্তে। মিঃ ইফাজের মধ্যে খানিকটা জড়তা কাজ করছে দেখে আফরা ভ্রু কুচকালো। বললো,

-এত অকওয়ার্ড ফিল করছেন কেনো আঙ্কেল? কিছু বলতে চান? বললে বলে ফেলুন। আমি শুনছি।

-আসলে,,,,,,,,,,

মিঃ ইফাজ এতটুকু বলে থেমে গেলেন। আফরা আবার বললো,

-আসলে কি আঙ্কেল?

চরম বিরক্ত হচ্ছেন মিসেস নাবিলা নিজের স্বামীর এমন গর্দেভ টাইপ ব্যবহারে। এমন জরুরি কথা যদি এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে বলতে থাকে তাহলে কে-ই বা গুরুত্ব দিবে উনার কথায়। মিসেস নাবিলা ভাবলেন , না! এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা স্বামীর আশায় রেখে দিলে চলবে না। উনাকে নিজেই কথাটি এগোনোর ব্যবস্থা করতে হবে। বলেই মিসেস নাবিলা এবার আফরাকে জিজ্ঞেস করলেন,

-তোমার বাবার সাথে কথা হয়েছে তোমার আফরা?

-কথাতো আমার ড্যাডের সাথে প্রতিদিনই হচ্ছে। কিন্ত কেনো আন্টি?

মিসেস নাবিলা এবার ভনিতা না করে বলে ফেললেন,

-আসলে আফরা , আমি তোমায় শুরু থেকেই অনেক পছন্দ করেছিলাম আমার ছেলে ফাহিমের জন্য। আর এখন আমরা আর তোমার ফ্যামিলি এ বিষয়ে এগিয়ে যেতে চাইছি আরকি। আমরা তোমার মতামত জানতে চাই। তুমি এর আগেও বলেছিলে যে ফাহিমকে তোমার পছন্দ। তো এখন এ ব্যাপারে তোমার কি মতামত আফরা?

আফরা স্তব্ধ হয়ে ছিলো কিছুক্ষণ। গলার স্বর ক্রমশ আটকে এসেছে। নিষ্পলক ভাবে সে তাকিয়ে রইলো মিসেস নাবিলার দিকে। আর যাই হোক বিয়ে নিয়ে ওর মস্তিষ্ক বরাবরই শূণ্যের কোঠায় চলে যায়। আর ও ভাবতেও পারেনি যে মিসেস নাবিলা এভাবে আফরাকে ফাহিমের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসবে। আফরার সন্দেহ হয়েছিলো, শুরুতেই কিছুটা সন্দেহ হয়েছিলো যখন ওর ড্যাড, এমনকি মিসেস নাবিলাও ফাহিম সম্পর্কে ওকে এমন ধরনের প্রশ্ন করেছিলো। তবে আফরা স্বভাবতই প্রতিউত্তর দিলো সবাইকে। এর মুখ্য কারন একজন ব্যাক্তিত্ববান মানুষ হিসেবে ফায়িমকে ওর ভালোলাগে, দ্যাটস ইট। এর বেশি ও ফাহিমকে একবিন্দুও কল্পনাও করতে পারেনি। আর কল্পনা করবেই বা কিভাবে যেখানে ওর মন মস্তিষ্ক জুড়ে ফাহিমেরই আপন চাচাতো ভাই ফারহান বাসা বেঁধে ছিলো? তবে ফারহানকে নিয়েও ও কখনও বিয়ের মতো সম্পর্ক করার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেনি। সেখানে মিসেস নাবিলার এতোটা এগিয়ে যাওয়া রীতিমতো চুপসে দিয়েছে ওকে।

আফরা জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ভিজালো। ওর স্নায়ু ক্রমশ উত্তল হয়ে পড়েছে। কথাটা জিভের আগায় এসে পড়লেও সাজিয়ে বলতে পারবে কি-না ঘোরতর সন্দেহ। আফরা তপ্তশ্বাস ছাড়লো। মিসেস নাবিলার উদ্দেশ্যে বলে ওঠলো,

-আমি……আমি এ ব্যাপারে ফাহিমের সাথে একান্তে কথা বলতে চাচ্ছি আন্টি।

মিসেস নাবিলা আর মিঃ ইফাজ আর কথা বাড়ালেন না। প্রস্থান করলেন আফরার পরিপাটি ঘরটি। আফরার শরীর উত্তেজনায় আর রাগে রীতিমতো রি রি করছে। এখানে আসার পর প্রথম,, এই প্রথম নিজ থেকে কল দিলো মাকে। আফরা কোনোমতে নিজের রাগ চেপে রেখেছে। ওর মম কল রিসিভ করা মাত্রই আফরা কাট কাট গলায় বলে ওঠলো,

-হোয়ার আর ইউ মম? আই ওয়ানা টক উইথ ইউ। ইটস আর্জেন্ট।

-বলতে পারো। আমি পুরো ফ্রি।

-মিসেস নাবিলার সাথে কি কথা হয়েছে তোমার আর ড্যাডের?

-ওহ্! উনি তবে তোমায় বলেছে সব কথা?

আফরার মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে ওঠলো। চিৎকার করে বলে উঠলো,

-হাউ ডেয়ার ইউ মম উইদআউট মাই পার্মিশন তুমি আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করছো? যেদিকে আমিই আমার বিয়ে নিয়ে ভাবিনি তুমি ভাবার কে হও আমার বিয়ে নিয়ে?

-মুখ সামলে কথা বলো আফরা। বেয়াদবির একটা সীমা আছে।

-বুলশিট স্টপ করো প্লিজ। আর তুমি ভাবলে কি করে তুমি বললেই আমি বিয়েতে রাজি হয়ে যাবো, আমার ফ্রীডম আমি নিজ হাতে কেড়ে নিবো? ফাহিম ছেলে হিসেবে অনেক ভালো। তাই বলে বিয়ে,,,,নেভার এভার। অ্যামেরিকায় থাকাকালিন কতগুলো রিলেশন করেছি আমি। তখনকার টাইমে যদি এরিকের মতো একজনকে রিজেক্ট করতে পারি তবে ফাহিম ক্ষতি কি?

-ফাহিম আর এরিক এক না অ্যাফি।

থমথমে গলায় বললেন মিসেস নীলু। আফরা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে ওঠলো,

-এক হবে কেনো,,,,এরিক ছেলে হলে ফাহিম কি মেয়ে যে এক হবে না?

মিসেস নীলু কোনোমতে নিজের রাগ সংযত করে রেখেছে। মেয়েটার মধ্যে টু পরিমাণেও ভদ্রতার ছিটেফোটা নেই। অন্যের সাথে ভদ্রতার সহিত থাকলেও নিজের মমের সাথে আফরার আচরণ একেবারেই স্বাভাবিক না। তবে আফরার কাছে এবার স্পষ্ট হতে শুরু করলো সবকিছু। কেনো ওর মা ওকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে, কেন মিসেস নাবিলা এতদিন ওকে জোর করছে ফাহিমের সাথে একান্তে সময় কাটানোর জন্য। এর মানে এসব কি পূর্ব পরিকল্পিত ছিলো? আফরা কানে মোবাইল রেখেই ধপ করে খাটে বসে পড়লো। ওর কাছে স্পষ্ট হওয়া শুরু করেছে ফাহিমের প্রথম দিনের ব্যবহার, অগোচরে স্মিত হাসি। ওর এত যত্ন করা, ফারহানের কারনে আফরার মনক্ষুন্ন হলে হাসানোর চেষ্টা করা। তার মানে ফাহিম প্রথম থেকেই আফরাকে পছন্দ করতো যা বিন্দুমাত্রও টের পায়নি সে। আর পাবেই বা কিভাবে যেখানে ওর জীবন ফারহান নামক এক মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে ছিলো? ফারহানের সাথে ওর সূত্রপাত হয় তিক্ত ঘটনাসূহ নিয়ে। ওদের সূচনা হয়েছিলো খুবই অন্যরকম। ফারহানের ওভার এটিটিউট, দাম্ভিকতা এসব বিরক্তির চরম সীমান্তে নিয়ে যেতো আফরাকে। আর এই বিরক্তিটাই আস্তে আস্তে হৃদয়ে গভীরত্ব লাভ করে এতটাই ছড়িয়ে পড়ে এখন মন মস্তিষ্কে কেবল মাত্রই ফারহানের বসবাস। যার দরুন ফাহিমকে নিয়ে ভাবার চিন্তাও করেনি ও। তবে আফরা চুপ রইলো। বিন্দুমাত্র অপরপ্রান্তে থাকা মাকে বুঝতে দিলো না এ কথাগুলো। তারপর পট করে কল কেটেই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো।

ওর নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। বুক উঠানামা করছে বারবার। দৃষ্টি নিবদ্ধ ঘূর্ণায়মান সিলিংয়ের ফ্যানটির দিকে। এই বিয়ে থামানো ওর কাছে ব্যাপার না তবে বড় ব্যাপার হলো ফারহান। কেউ যদি জানতে পারে যে ও ফাহিমকে না ফারহানকে পছন্দ করে , এমন একজন মানুষ যার জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই, এসব কিছু কিভাবে সামলাবে আফরা?
.
.
ঘটনাটির পরের দিনই আফরা সরাসরি কথা বললো ফাহিমের সাথে। ফাহিম যেদিকে ছিলো ওর প্রতিউত্তরের অগাধ অপেক্ষায়, একজন পাষাণ শ্রেণির মানুষের মতো আফরা সরাসরি প্রতয়াখ্যান করলো ফাহিমকে,,যেমনটা এরিককে করেছিলো। পার্থক্য শুধু একটাই, এরিক যেখানে ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিল, ফাহিমের মুখে তখনও ছিলো প্রানবন্ত একটা হাসি৷ আফরা তবে ঠিকই ওর মনের চাপা কষ্টটা দেখতে পেলেও রইলো নির্বিকার। নিজের ওপর বড্ড রাগও হলো আফরার, যে এতদিন সে কেনো ফাহিমের এই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটি বুঝতে পারেনি ৷ সবচেয়ে অবাক করা আরও একটি বিষয় হলো যে এ ব্যাপারে ফারহানের একেবারেই ধারনা নেই। মিসেস নাবিলা চাননি যে ফারহান এ ব্যাপারে ওদের মধ্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়াক। চায়নি আফরাও। কেননা ফারহান যদি একবার জানতে পারে যে আফরা আর ফারহানেরই নিজের আপন চাচাতো ভাই ফাহিমের ব্যাপারটি বিয়ে পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিলো তবে ফারহান আর যাই হোক-আফরার কাছাকাছি কখনোই আসার চেষ্টা করবে না। পেরিয়ে গেলো ৪৮ ঘন্টা। কিন্ত আফরা আর ফাহিমের সাথে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেনি। তবে ফাহিমের মনে খচখচানি ছিলো যে ঠিক কোন কারনে আফরার অমত হয়েছিলো এই বিয়েতে? ও তো চাইলে সময় নিতে পারতো, কিন্ত সরাসরি নাকচ করাটাই বেশ ভাবিয়ে তুলেছে ফাহিমকে। তবে সে আফরাকে জিজ্ঞেস করলো না এ ব্যাপারে।

ফাহিম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মনে মনে আওড়িয়ে নিলো এমন জিনিসের প্রতি নজর দিতে নে যেটা কখনোই ওর হবে না। তারপর নিজেকে সহজ করে আফরার উদ্দেশ্যে বললো,

-আপনি রেডি আফরা?

-হুম।

-মারুফের সাথে বাহিরে চলুন তাহলে , ফারহান বাহিরেই আছে।

______________________

স্নিগ্ধ সকালের এই সময়ে বাতাসটা অত্যন্ত ফুরফুরে থাকে। ফারহান প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রগুলো এক এক করে গাড়িতে উঠিয়ে নিলো। টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়া হবে সকালেই উঠেছে ফারহান। সকালে উঠেছে বললে ভুল হবে, ফযরের মুহুর্তেই সাব্বির আর শামসু তাকে এসে ডেকে তুলেছে। সাব্বির আর শামসুও যাবে ওদের সাথে টাঙ্গুয়ার হাওরে। এর জন্য কেউ খুশি হোক না না হোক , বেজায় খুশি হয়েছে চঞ্চলা ইলা।ফারহান সবকিছু গাড়ির পেছনে রেখে এবার গাড়িতে একটু হেলে দাঁড়িয়ে রইলো। দৃষ্টি নিবদ্ধ অপেক্ষারত মানুষগুলোর আসার দিকে। অবশেষে সেই প্রহর কাটিয়ে সর্বপ্রথম এলো বেগুনি সালোয়ার কামিজ পরনে এক অপরূপা নারী, ফারহান একবার তাকিয়েই আর চোখ সরাতে পারলো না। ওর বোধ অনেক পরে আন্দাজ করতে পেরেছে যে মানবীটি কে। ঘাড়ের একটু নিচ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো খোলা চুল , কোণে সুন্দর করে সিথী করা , হাতে কহিনূরের মতো ঝকঝক করা ব্রেসলেট আর সেই লোভনীয় রূপ। ফারহানের হৃদয়ের কম্পন বন্ধ হয়ে গিয়েছে ক্রমশ। আফরাকে সালোয়ার কামিজে এতটা সুন্দর লাগতে পারে এ নিয়ে ওর ধারনা ছিলোনা বিন্দুমাত্র।

আফরা বুঝতে পারছে ফারহানের এই দৃষ্টি , তবুও ওর মধ্যে লাজুক ভাবটা টেনে আনতে পারলো না। ওর বেহায়া দৃষ্টি বারবার ফারহানের বিমুগ্ধ চোখগুলোতে ডুবে যেতে চাইছে। অজান্তেই ফারহান শীতল কন্ঠে বলে ওঠলো,

-সুন্দর!

এছাড়া আর কোনোরূপ কথা হলোনা ওদের মাঝে। আফরা একটা জিনিস ভালোমতই খেয়াল করেছে, ওদের মধ্যে কথাবার্তা খুব বেশি একটা হয়নি। তবুও মন দুজনকে খুব কাছাকাছি টেনে নিয়ে এসেছে , এই প্রণয়ের পরিণয় আদৌ হবে কিনা কে জানে? ফাহিম ইলা রৌশিন আসা সাপেক্ষেই শুরু হলো ওদের যাত্রা। প্রথম শাহ্জালাল মাজার পেরিয়ে সুনামগঞ্জ , তারপর সুনামগঞ্জের বড় ব্রিজের থেকে তাহিরপুর নৌকা ঘাটে। গাড়ির একেবারে পেছন সিটে আফরা আর রৌশিন বসে ছিলো। দুজনের মধ্যে অনেক আলাপ-চারিতা হয়েছে আবার মাঝেমাঝে ডুবেও গিয়েছে সকালের এই বর্ণীল সৌন্দর্যে। তারপর সাড়ে আটটা নাগাদ ওর পৌঁছুলো সুনামগঞ্জের তাহেরপুর নৌকা ঘাটে। নৌকা আগেই ভাড়া করে রেখেছিলো ফাহিম , তাই খুঁজে পাওয়া আর দরদাম নিয়ে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। একে একে নৌকায় উঠে পড়লো ফাহিম ,ফারহান রৌশিন , সাব্বির, শামসু, মারুফ আর ইলা। শুধু দাড়িয়ে রইলো আফরা। এত উচু আর ঢেউয়ের তালে নাচানো নৌকাতে উঠতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। ফাহিম খেয়াল করেছিলো বিষয়টা, অতঃপর আফরার উদ্দেশ্যে হাত বাড়ানোর আগেই ফাহিনকে চরম অবাক করে দিয়ে হাত এগিয়ে দিলো ফারহান। আফরা কিছুক্ষণ ওর হাত বাড়ানো দেখে প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে রইলো। যার দরুন নিচু হলো ফারহান৷ আড়ষ্ট ভঙ্গিমায় বলে ওঠলো,

-আমার হাত ধরুন আফরা। আমি আপনার সাথে আছি।
.
.
.#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤️
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব___৩৮ [প্রথম অংশ]
কখনো আকাশের মতো নীল, কখনো আয়নার মতো স্বচ্ছ—এমন স্নিগ্ধ রঙে রাঙা পানিতে টইটুম্বর এই টাঙ্গুয়ার হাওর। ইতিমধ্যে ট্রলারের ইন্জির স্টার্ট হওয়াতে সেটা তাহেরপুর ঘাট থেকে ছুটে অনেক দূরে চলে গিয়েছে হাওরের উদ্দেশ্যে। দূরে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, ঝরনা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি , চেনা অজানা অগণিত পাখির কলকাতান আর করচ-হিজল বনের আপরূপ সৌন্দর্য ও সমারোহে বিমূঢ় হয়ে রইলো আফরা। সময়টা এখন বর্ষাকাল। আষাঢ়ের শেষ সময় পাড়ি দিয়ে যেকোনো সময় রূপ নিবে শ্রাবণ হাওয়ায়। চারিদিকে তাই থই থই করছে জলাধার। আকাশ পরিষ্কার, সেই নীল আকাশের সাথে হাওড়ের পানিকে লাগছে আয়নার মতো স্বচ্ছ। ইলা-রৌশিন-মারুফ তিনজন ট্রলারের ছাদে চড়ে জমপেশ আড্ডা দিচ্ছে। সাথেই বসে রয়েছে আফরা। তবে ওদের আড্ডায় মেয়েটার কোনো হুঁশ জ্ঞান নেই। ইলা জিজ্ঞেস করলো,

-আপু এত চুপ হয়ে আছো কেনো তুমি?

-এখানকার রূপের কারনে চুপ হয়ে আছি।

মিনমিনিয়ে বলে ওঠলো আফরা। ওর ঘোর এখনও কাটেনী। অপার নয়নে তাকিয়ে রইলো সে প্রশস্ত হাওড়ের দিকে। অগোচরে মুচকি হাসলো রৌশিন। আফরা মেয়েটার এই বিমূঢ় রূপে মারাত্নক লাগে। তাই তো ফাহিম বোধহয় পছন্দ করেছালো আফরাকে , ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রৌশিন। মাঝে মাঝে আফরাকে দেখলে ওর হিংসে হয়, এককথায় প্রচন্ড রকমের হিংসে হয় এমন সুন্দর রূপ দেখে। আচ্ছা আফরার এক শতাংশ রূপ যদি আজ রৌশিনের কাছে থাকতো তবে কি ফাহিমও পছন্দ করতো রৌশিনকে? পরক্ষণেই এসব উদ্ভট চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো রৌশিন। বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠলো,

-দুনিয়াটাই এমন। যে যাকে চায় তাকে সে পায় না, তার গুরুত্বটাও বুঝে না।

আফরা যেহেতু ক্যামেরা নিয়ে এসেছিলো তাই অনেকগুলো ছবি তুলে নিলো হাওরের। ইতিমধ্যে নিচ থেকে ট্রলারের ছাদে উঠে এলো ফারহান। কপালে ফারহানের বিন্যস্ত অল্পবিস্তর ঘাম, পুরু ঠোঁটগুলো কাঠফাটা রোদে শুকিয়ে গেলেও লালাভ ভাবটা যায়নি। চুলগুলো সুন্দরভাবে একপাশে আছড়ে রাখা। আফরার হার্টবিট মিস হয়ে গেলো ফারহানকে দেখে। এই মানুষটার প্রতিটি মুভমেন্টই ওকে বড়সড়ভাবে আকর্ষিত করে ফেলে। ফারহান এতক্ষণ নিচে ফাহিমের সাথে একান্তেই কথা বলছিলো , অনেক সময় নিয়ে। এই দুই ভাইয়ের পেটে এত কি কথা কে জানে?

আফরার হঠাৎ মনে হলো এসময়ে যদি অগোচরে ফারহানের একটা ছবি না তোলা হয় তবে ঘোরতর পাপ হবে, ঘোরতর পাপা। এমন মুখ্যম সুযোগ আর কখনও নাও পেতে পারে।তাই সময় বিলম্ব না করেই অগোচরে ফারহানের কয়েকটা ছবি তুলে নিলো আফরা। কিন্ত ওর ভাগ্য সহায় ছিলো না আজ।শেষ ছবিটা তোলার সময়ই ক্যামেরার সাথে চোখাচোখি হলো ফারহানের। ধরতে পারলো যে কি করছে আফরা। তাই তৎক্ষণাৎ সে বাধাঁ দিলো আফরাকে। শীতল গলায় বলে ওঠলো,

-পার্মিশন ছাড়া কারও ছবি তোলা বাড ম্যানার্স জানেন না আপনি? যেখানে আমি ছবি তোলার ঘোর বিরোধী সেখানে আপনি নির্ভয়ে আমার ছবি তুলেছেন, আপনি কি ভাবছেন আপনাকে ছেড়ে দেবো?

আফরা ঠোঁটে সুচালো হাসি ফুটিয়ে এগোলো ফারহানের কাছে। মিনমিনিয়ে বললো,

-ছেড়ে না দিলে আমায় ধরে রাখবেন বুঝি? রাখতে পারেন। আই ডোন্ট মাইন্ড।

ফারহান অবাক প্রসন্ন হয়ে আফরার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মনে মনে ভাবতে লাগলো, এমন এক্স্ট্রা এক্সট্রোভার্ট টাইপ মেয়ে এই প্রথম দেখলো ফারহান। আফরা এমন একজন মেয়ে যার মুখে কোনো বাঁধ নেই। অনায়াসেই যেকোনো কথা বলে দিতে পারে। ফারহান এবার সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে গেলো আফরাকে। আর যাই হোক, এতগুলো মানুষের সামনে কিছুতেই অস্বস্তির শিকার হবে না এই আফরার কাছে।

____________

ট্রলার এবার টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ারের সামনে থেমেছে। রৌদ্দুরের উত্তাপে ঝিকমিক করছে চারিদিক। টলটলে পানির দৃশ্যটা ওয়াচটাওয়ারের কাছাকাছি আসার পর খানিকটা ঘোলাটে দেখা দিলো। আফরা অদূরেই খেয়াল করলো ইট পাথরের তৈরি একটা সুন্দর ওয়াচ টাওয়ার। মাঝখানে সুন্দর গোলাকৃতি করে সিড়ি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আফরা রৌশিনেক জিজ্ঞেস করলো,

-এখানে ট্রলার থামিয়েছে কেনো রৌশিন?

-ওয়াচটাওয়ারের সামনে মূলত সুইমিং করার জন্যই ট্রলার থামায়। সবাই তো অলরেডি প্রস্তুত। তুমিও করতে চাও সুইমিং আপু?

ঘোরাফিরা আর সুইমিং, এই দুটোর প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আফরার। পানি দেখলেই ওর ঝাপিয়ে পড়তে মন চায়। আর ফারহানের সাথে সাতগাঁওয়ের বিলের সেই শেষ অভিজ্ঞতাটা মনে পড়তেই ওর মধ্যে ‘ওয়েদার ডিমান্ডস’ মনোভাবটা চাড়া দিয়ে ওঠলো স্নায়ুতে। ফারহান ইতিমধ্যে লাইফ জ্যাকেট পড়ে ফেলছে। সেই সাথে ফাহিম, সাব্বির আর শামসুও। আফরাও এবার পানিতে নামবে বলে পণ করলো। যেই ভাবা সেই কাজ, আচমকা সবাইকে অবাক করেদিয়ে সে লাইফ জ্যাকেট না পড়েই ঝাঁপ দিলো হাওরের টুইটুম্বুর পানিতে। প্রথমে সবাই বিস্মিত হয়ে গেলেও ক্রমেই বোধ ফিরে পেলো সবাই।মনে বাসা বাধলো উদ্রেক। এই ভরা বর্ষায় কিভাবে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া পানিতে ঝাঁপ দিলো আফরা? কিছু হয়ে গেলে………..ফারহান পুরো ব্যাপারটা ভাবার আগেই হঠাৎ পানিতে ঝাঁপ দিলো। পানিতে ঝাপ দেওয়ার দরুন টুইটুম্বুর শব্দটা কানে বাজছে সবার। এই মাত্র কি করলো এটা ফারহান? ফারহানের এই নতুন গুণের সাথে একেবারেই অপরিচিত সবাই৷ ফারহান এবার সাঁতরেই চলে গেলো আফরার কাছে। আফরা ততক্ষণ শীতল পানির সংস্পর্শে এক অন্য আনন্দে ছিলো। তবে ওর আনন্দ নিমিষেই থমকে গেলো গালে ঠাসঠাস করে কিছু একটা পড়াতে। ফারহান থাপ্পড় মেরেছে ওকে। আফরা পানিতে ভাসতে ভাসতেই গালে হাত দিয়ে তাখকালো ফারহানের মুখে। রাগে রি রি করছে ফারহানের শরীর। ঠোঁটজোড়া অল্পবিস্তর কেপে রক্তিম রং ধারন করেছে।

ফাহিম, সাব্বির, ইলা, মারুফ সহ সবাই অবাক ফারহানের এমন কান্ডে। এই প্রথম ফারহান কোনো মেয়েকে কষে চড় মারলো তাও কিনা এমন একজন যে ওদের অতিথি। ছলছল করে ওঠলো আফরার চোখ। শিথিল হয়ে গেলো ওর পুরো শরীর। পানিতে গভীরে তলিয়ে যাওয়ার পূর্বেই ফারহান শক্ত করে ওর কোমড় চেপে টেনে নিয়ে এলো নিজের কাছে। নিজের বুকের সাথে মিহিয়ে ধরলো আফরার সিক্ত শরীর। ফারহান এমনভাবে ওকে চেপে ধরেছে যেন ছেড়ে দিলেই হয়তো চলে যাবে পানির গভীর অতলে। যা মোটেও নিতে পারবে না ফারহান। থমথমে গলায় সে বলে ওঠলো,

-আপনি কি পাগল আফরা? এভাবে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া কি হিসেবে ঝাঁপ দিলেন? এখানকার গভীরত্বের কথা আন্দাজ আছে আপনার? তলিয়ে যেতেন পানিতে। নিজে তোমরতেনই , সাথে আমার নিঃশ্বাসও কেড়ে নিতেন।

আফরার মস্তিষ্কের নিউরন অচল হয়ে গিয়েছে ছেলেটার কথায়। ফারহানের চোখে মুখে রাগের সাথে ভয় আর উদ্রেকের চরম রেশ। আফরা প্রথমে ফারহানের এমন ব্যবহার নিতে পারছিলো না কোনোভাবেি৷ এতদিন ইগ্নোর করাও ঠিক ছিলো তবে ফারহান যে কখনও ওকে চড় বসিয়ে দিবে এটা ও ভাবতেই পারিনি৷ হু হু করে বইছে হাওরের বাতাস। পানিতে ভেসে থাকা দুজন মানব মানবীর চোখের ভাষা ভিন্ন। যা এই প্রথম ফাহিম দেখলো অন্য নজরে৷ কিছু একটা আছে আফরা আর ফারহানের মধ্যে যা অজান্তেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে আরও।
.
.#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#কায়ানাত_আফরিন
#পর্ব__৩৮ (দ্বিতীয় অংশ)
নিজের পছন্দের মানুষের কাছ থেকে থাপ্পড় খাওয়ার পর স্বভাবতই একজন মানুষ সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ে, আফরার ক্ষেত্রে সেই ব্যাপারটি চলে গিয়েছে অতিরিক্ত পর্যায়ে। পুরোটা জার্নিতে আফরা ছিলো মুখ গুমড়া করে। ফারহান প্রথম প্রথম অনেক রেগে থাকলেও পরন্তু নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়েছে বেশ। এই একটা দোষ ফারহানের, রেগে গেলে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। কখন ঠিক কিরূপ প্রতিক্রিয়া করা উচিত তা যেনো ভুলেই যায় সে। ফারহান তাই পরবর্তীতে আমতা আমতা করে সরি বললো আফরাকে। বললো, যে এভাবে সবার সামনে চড় মারাটা উচিত হয়নি ওর। মারুফ, ইলা, সাব্বির , শামসু রৌশিন সাবই ফারহানের সাথে তাল মিলিয়ে আফরাকেবঅনুনয় বিনিময় করে চললো ফারহান ভাইকে মাফ করার জন্য। যতই হোক, ওদের সবার চোখের মধ্যমণি ফারহান ভাই।

এই পুরোটা সময় শুধু নির্বিকারে রইলো ফাহিম। গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। তখনকার ফারহানের বিরূপ ব্যবহার ভাবিয়ে তুলছে ওকে। ফারহান তখনই ভয়ংকরভাবে রাগে যখন ওর নিকটবর্তী কোনো বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হয়। আপাতদৃষ্টিতে হিসেব করলে আফরা একেবারেই দূরের কেউ ফারহানের। আসলেই কি তাই? আর যাই হোক, আজ ফারহান আর আফরা দুজনের মুখের যেই ভাবভঙ্গি দেখেছে ফাহিম নিশ্চিত ওদের মধ্যে কিছু একটা আছে। যেটা হয়তো গভীরতায় ছুঁই ছুঁই। কিন্ত ফাহিম কোনোক্রমেই মানতে চাইছে না বিষয়টা। ফারহান ওর কাছে আপন ভাইয়ের থেকেও বেশি কিছু। ফারহান আহত অবস্থায় থাকলে নিজের সকল কাজকর্ম ফেলে সে ছুটে যায় ফারহানের কাছে ওকে রিকভার করার জন্য। একজন রাজনৈতিক নেতা হওয়ার দরুন কম গুলিবিদ্ধের শিকার হতে হয়নি ফারহানকে। এসময় ফাহিম ছিলো ওর পাশে। ফাহিম ফারহানকে এতটাই বিশ্বাস করতো যে আফরার সম্পর্কে প্রথম অনুভূতিটা সে জানিয়েছিলো ফারহানকে। আর সেই ভাই ওর কাছ থেকে এত বড় সত্য লুকালো? যদি ফারহান আগেই বলতো যে দুজন দুজনকে পছন্দ করে ফাহিম কল্পনাও করতো না আফরার ধারপাশে ঘেষার । সেখানে দুটো মানুষই ওর ইমোশানস নিয়ে খেলেছে। ফাহিমের মুখ দিয়ে এই প্রথম, এই প্রথম একটি অশ্রাব্য ভাষা বেরিয়ে এলো ফারহানের জন্য। সুযোগ হোক, ফারহানকে এর জবাবদিহিতা করতেই হবে যে কেনো এত বড় সত্যটা সে লুকোলো।

_________________

বিকেলে যখন সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ে তখন অপরূপ লাগে দেখতে এই টাঙ্গুয়ার হাওর। নীলাদ্রী লেকের পাহাড়ি সৌন্দর্য হাওরের ট্রলারে বসা প্রতিটি মানুষকে বিমোহিত করে তুলেছে। অদূরের এক প্রান্তে বসে আছে সাব্বির আর ইলা। আপাতদৃষ্টিতে ওদের আচার আচরণ সবার কাছে সাধারণ মনে হলেও কেবল মারুফ আর রৌশিন জানে পুরো ঘটনাটি। মারুফ এবার রৌশিনের কাধে বারি মেরে বললো,

-ওই চড়ুই দুইটা দেখলে মোর হিংসে হরে রৌশিন। চল তুই আর আমি মিলে আর এক জোড়া চড়ুই হয়ে যাই।

রৌশিন এবার মারুফের কান টান মারতেই মারুফ আত সুরে বললো,

-ছাইড়া দে বইন। আমি তো মজা করসিলাম।

-তোর বিতড়ামি আমি হাওরে ফেলমু শালা। সাহস কতো, আমার লগে ফ্লার্টিং করস?

ওদের কাজকর্ম দেখে আফরার যেন হাসি থামছে না কোনো ক্রমেই। হাওরের এক পাশের উত্তরে হাওয়া সারা গায়ে হিম জরিয়ে দিচ্ছে। ফারহান আড়চোখে লক্ষ করলো আফরার প্রানবন্ত হাসিকে। সে এতক্ষণ মোবাইলে আলাপচারিতায় মশগুল ছিলো। আজ বহুদিন বাদে কল দিয়েছে নিজাম সাহেব। পুনরায় সতর্ক করে দিয়েছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ফারহানের প্রানাশঙ্কা আছে। যা ফারহান ভালোমতই জানে। তবুও মনে ওর কোনো ভয়নেই। সকল দুশ্চিন্তা, ক্লান্তি সবকিছু নিমিষেই যেন আফরাকে দেখলে উধাও হয়ে যায়। ফারহান এবার ফাহিমের কাছে বসে পড়লো। কথা বলতে যাবে তবে ফাহিম খুব কড়াকড়ি ভাবে এড়িয়ে গেলো ফারহানকে। ফারহান হঠাৎ হকচকিয়ে গেলো নিজেরই ভাইয়ের এমন কান্ডে। হলো টা কি ফাহিমের?

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ট্রলার এবার ছুটে চললো তাহেরপুর ঘাটের দিকে। আফরা ট্রলারের একদম প্রান্তে বসে রইলো। পাশে বসলো ফারহান। জিজ্ঞেস করলো,

-কেমন লাগলো আজকের ট্রিপ?

-আপনার স্ল্যাপ খাওয়া ছাড়া সবটুকু ভালো ছিলো।

আফরা বললো মিনমিনিয়ে। ফারহান হেসে ফেললো হঠাৎ। বলে ওঠলো,

-তো কি করতাম বলেন। আপনি যে ফার্মের মুরগি জানতাম, সেই সাথে ব্রেইনলেস ফার্মের মুরগি জানলে আপনার হাতই ছাড়তাম না।এখন বর্ষাকাল আফরা! হাওরের পানি এসময় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। যেখানে ভালো সাতাঁরুরাও লাইফ জ্যাকেট ছাড়া থাকতে পারবে না সেখানে আপনি কিভাবে বেইনলেস ফার্মের মুরগির মতো ঝাঁপ দিলেন পানিতে?

মুখ ক্রমশ সাল হয়ে গেলো আফরার লজ্জায়। অপমানের মাত্রাটাও রি রি করে বাড়ছে। তবে ফারহানকে অবাক করে দিয়ে আফরা কিছুই বললোনা আজ। ফারহান ঠোঁটে দাম্ভিক হাসি ফুটিয়ে বললো,

-উমমম! ব্যাপার কি আফরা। আপনি তো এখন আগের মতো আমার ওপর ক্ষেপে যান না। এট এনি চান্স আমার ওপর আসক্ত হয়ে পড়েছেন নাকি?

শেষ কথাটা ফারহান বললো খানিকটা ঝুঁকে, ফিসফিসিয়ে। আফরা চাপা কন্ঠে বললো,

-আসক্ত হলেই কি, না হলেই বা-কি?

-নাহলে কিছু না। তবে আমার প্রতি যদি আসক্ত হন, সেটা আমার কাছে অনেককিছু।

আফরা খপ করে তাকালো ফারহানের চোখে। ফারহানের চোখ অন্যকিছুই বলছে আজ। যা নিমিষেই আফরার হৃদয় কাপিয়ে তুলতে পারবে। হাওড়ের বাতাসের দরুন সমানতালে উড়ে চলছে আফরার অবাধ্য চুল। বেগুনি সালোয়ার কামিজের ওড়নাও সেই সাথে উড়ছে। ফারহান কিছুক্ষণ মোহাচ্ছন্ন ভাবে আকৃষ্ট হয়ে রইলো এই রূপে। মনে নিষিক্ত কিছু উন্মাদনা কাজ করছে। পরক্ষণের নিজের কান্ড ভেবে নিজেরই সে অবাক হয়। ‘আফরা’, ‘আফরা’ নামেই এই ভীনদেশি মেয়েটি ওর হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।ফারহান ঘোর বশতই আফরার চুলগুলো গুঁজে দিলো কানের পিঠে। বরাবরের মতো মিহি স্বরে বলে ওঠলো,

-সুন্দর।

_____________

সন্ধ্যার সময়ে সবাই ঘাটে এসে পৌঁছুল। দিকবিদিক ছাড়িয়ে গিয়েছে আঁধারে। পশ্চিমাকাশের লালাভ আভা এখনও দৃশ্যমান। সবাই নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ঘাট থেকে নামলো, একে একে সবগুলো রেখে দিলো গাড়িতে। তবে বিপত্তি বাঁধলো রৌশনিকে নিয়ে। বিকেল ঢলে পড়ার পরই রৌশিন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। সকালে বেশ সকালে ওঠার কারনেই ওর এ দশা। মারুফ গালে হালকা বারি দিয়ে ঢাকলো রৌশিনকে। যতটুকু চোখ রৌশনি খুলেছে, বেশ কষ্ট করেই খুলেছে সে৷ রোশিনের বাসার রাস্তা যেহেতু ওদের বাসা থেকে একেবারেই উল্টো পথে, তাই এ অবস্থায় কাউকে বাসায় দিয়ে আসতে হবে ঘুমন্ত রৌশিনকে। ফাহিম যাবে বলে মনস্থির করলো৷ ফারহানের গাড়িতে যখন ইলা আর আফরা ঢুকছিলো ফাহিম একপলক আহত চোখে তাকিয়ে নিলো রৌশিনের দিকে। তারপর গাড়ির ইন্জিন স্টার্ট করে রওনা দিলো রৌশিনের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

_________

ছিমছাম অন্ধকার। দুধারের উঁচু উঁচু গাছের পাতা গুলো হাওয়ার ন্যায় দুলছে আনমনে। চা পাতার এক কড়া ঘ্রাণ ভেসে এলো ফাহিমের নাক বরাবর। পাশেই ঘুমন্ত রৌশিন৷ মাথাটা জানালার ধারে বেঁকে বসেছে। ঠোঁটটা সামানো উল্টানোর কারনে কিউট লাগছে দেখতে।

তবে মনে উথাল পাতাল ঝড় ফাহিমের। ফারহানের সেই বলা কথাগুলো, আফরার প্রতি ওর দৃষ্টিগুলো ক্রমেই ভাবিয়ে তুলছে ওকে। মন না চাইতেও সায় দিচ্ছে ওদের অন্তরের কোনো সম্পর্রকের ব্যাপারে। এসব ভাবতে ভাবতেই গাড়ি এসে থামলো রৌশিনদের বাসার সামনে। ফাহিম তারপর সিটবেল্ট খুলে দিলো রৌশিনের। একপলক দেখে নিলো ওর ঘুমন্ত মুখশ্রী। তারপর কোমল কন্ঠে ডাক দিলো,

-রৌশিন, এসে পড়েছি আমরা। ঘুম থেকে উঠো।

প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে। ফাহিম ছোট করে শ্বাস ছাড়লো। আবার হালকা করে ডাক দিলো রৌশিনকে। বললো,

-রৌশিন? আর কত ঘুমাবে তুমি?

তখন এক অবাক কান্ড করে বসলো রৌশিন। ঘুমের ঘোরে ফাহিমের গলা জড়িয়ে ধরতেই ফাহিম ভারসাম্যহীন ভাবে পড়ে গেলো ওর ওপর। নিজের ঠোঁটজোড়া অস্বাভাবিক ভাবেই মিশে গেলো রৌশিনের গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁটে। ফাহিম হতভম্ব। ওর স্নায়ু কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নিজের ওপর প্রচুর ভার অনুভব করতেই রৌশিন যখন পিটপিট করে চোখ খুললো, নিজেদের এমন অবস্থা টের পেতেই হুড়মুড়িয়ে ধাক্কা দিলো ফাহিমকে। উত্তেজনায় অস্থির হয়ে গিয়েছে দুইজন৷ পুরো গাড়িতেই ভ্যাপসা আভাস। রৌশিন অস্বস্তির দরুন ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে৷ ও ভাবতেও পারেনি যে ঘুমের ঘোরে এমন কিছু করে বসবে।
রৌশিন একদন্ড গাড়িতে থাকলো না৷ গাড়ির দরজা খুলে দ্রুত বাড়িতে ঢুকে গেলো। একপলক ও তাকালো না সে ফাহিমের দিকে। এদিকে ফাহিম এখনও বাকরুদ্ধ। বেসামালভাবে সে হাত দিলো নিজের ঠোঁটজোড়ায়। সেই সাথে চোখের পলক পড়াও যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here