অতঃপর প্রেমের গল্প পর্ব ৩৫+৩৬

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#পর্ব___৩৫
#কায়ানাত_আফরিন

রৌদ্দুরের কড়া উত্তাপে তপ্ত আশপাশ। কাঠফাটা রোদে চা বাগানটা দেখতেও কেমন যেন মলিন মনে হচ্ছে। আফরা দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে কিচেনে কথা বলতে ব্যস্ত মিসেস নাবিলার সাথে। উনি সবেমাত্রই টেবিল গুছিয়ে গাছিয়ে সব রান্নাঘরে রেখেছেন। বাসায় আর কেউ নেই। মিঃ ইফাজ গিয়েছেন দোকানে আর ফাহিম বরাবরের মতোই হসপিটালে। এসময় ওর ডিউটি না থাকলেও কিছু কাজের দেখভাল করার জন্য থাকতে হয়। ইলা তখনও মারুফের সাথে রৌশিনের বাসায়। ফাহিম আফরাকে নিয়ে এসেছিলো বাড়িতে। যদিও ওর অবচেতন মন বারবার বলছিলো যে ফারহান আসলে হয়তো ভালো হতো। ছেলেটা অনেক গম্ভীর, নিজ থেকে হয়তো একটিও কথা বলবে না। তবুও ওর সঙ্গই আফরার ভালোলাগে। ফাহিম যে ওর বিরক্তির কারন তা-না। ফাহিম নিঃসন্দেহে চমৎকার মানুষ। তবে মানুষের ক্ষেত্রে একটি চরম প্রবাদ আছে, মানুষ মাত্রই নিজের পছন্দের জিনিসটাতে আকর্ষিত হয়। ফাহিম চমৎকার, তবে সে আফরার হৃদয়ে ক্ষুদ্র আলোড়ন তৈরি করতে পারেনি যেটা ফারহান পেরেছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে হঠাৎ মিসেস নাবিলা বলে ওঠলো,

-আমার ছেলেটাকে কেমন লাগে তোমার আফরা?

আফরা হকচকিয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,

-আপনি কি ফাহিমের কথা বলছেন?

-হ্যাঁ।

আফরার মনে হঠাৎ খটকা লাগে। সেদিন রাতে আফরার বাবাও জিজ্ঞেস করেছিলো ফাহিমের কথা। তাছাড়া শুরু থেকেই মিসেস নািলার আচরণ কেমন জানি অদ্ভুত। বাঙালিদের ট্রেডিশন মতে এখানে কখনোই যুবকের সাথে এক যুবতীর অবাধে ঘোরাফেরা হয়না যেটা আফরা করতে পারছে। তাছাড়া মিসেস নাবিলার বারবার ফাহিমকে রিপ্রেজেন্ট করা, ওর সাথে একান্তে সময় কাটানোর ক্ষেত্রে খুব সচেতন। কিন্ত কেনো?

-এত কি ভাবছো আফরা?

মিসেস নাবিলার ডাকে ওর ধ্যান ফিরলো। অবাক প্রসন্ন হয়ে বললো,

-আপনি হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করছেন যে?

-একজন ছেলের মা কেন একটি মেয়েকে এ ধরনের কথা জিজ্ঞেস করে তা তোমার ধারনা আছে?

রহস্যের হাসির আদলে কথাটি বলেন মিসেস নাবিলা। আফরার মনের গভীর সন্দেহ এবার গভীর থেকেও আরও গভীরতর হলো। নিশ্চিত উনার কোনো একটা পরিকল্পনা আছে এসব নিয়ে। তই আফরা খুবই সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে গেলো মিসেস নাবিলাকে। বললো,

-আমি একটু বাইরে টি এস্টেটটা ঘুরে আসি। ঘরে ভালোলাগছে না।

টি এস্টেটের নাম করে গেলেও আফরার উদ্দেশ্য ছিলো একবার ফারহানের সাথে দেখা করার। তবে সে বাড়িতে নাই। ঘরে তালা ঝুলে আছে। আফরা এতে অবাক না হয়ে পারলো না। ছেলেটা সেই যে সকালে উত্তর গাঁও থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোলো , আর খবর নেই। অবশ্য ইলা বলেছিলো , যে ফারহান আগে নাকি ঘরেই থাকতো না। ফজরের আযানের পর বেরোতো আর ফিরতো রাত সাড়ে বারোটার পর।

সিলেটের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে রাত ১২ টায় বাহিরে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রায়শই সেনাবাহিনীর চার্জ পড়ে আশপাশে। তবুও ফারহানের হুঁশ হলো না। এই মিটিং-ওই মিটিং, এই নেতা-ওই নেতা’র সাথে সাক্ষাতের জন্য ছুটে যেতো যখন তখন। যদি হরতাল বা কারফিউ হয় তবে তো কথাই নেই। এ সময় হয়তো জেলে মামলা খাটা আসামি হয়েছে, নতুবা গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘরে বসে থেকেছে।

এমন একটা পাষাণ মানুষের তবুও মানুষের জন্য রয়েছে গভীর চিন্তা। এখনও তাই এখানকার মানুষদের প্রয়োজনে ছুটে যেতে দ্বিধা করেনা। কলেজ লাইফে ও শুধু ছাত্রদের অধিকারের জন্য রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেও পরে নিশে গেলো সাধারন মানুষদের অধিকারের লড়াইয়ে। ছেলেটা ছোট থেকে কষ্ট নিয়ে বড়ো হয়েছে, তাই একটু হলেও বুঝে মানুষের সান্নিধ্য লাভের ব্যাপারটি।

আফরার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। তারপর পুরো দুপুর নিজ মনেই সবুজে সমারোহ চা বাগানের মাঝে বিচরণ করতে লাগলো। অদূরেই দেখা যাচ্ছে ভারতের মেঘালয়ের উচুঁ উচুঁ পাহাড়। সেই সাথে মনে পড়ছে এখানে এতদিনের থাকা সমস্ত ঘটনাগুলো। শ্রীমঙ্গলের প্রতিটি কোণায় বিচরনের মধুর স্মৃতিগুলো। হঠাৎই ওর পেছন থেকে শোনা গেলো এক শক্ত পুরুষালি কন্ঠ,

-মেঘালয়ের মতো আপনারও কাউকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা আছে আফরা, আপনার এই ক্ষমতা মানুষকে এতটাই মুগ্ধ করবে যে আপনার কথাই নিউরনে আলোড়িত হতে বাধ্য।

আফরা মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। কথাটা বুঝতে ওর পাক্কা দুই মিনিট লেগেছে কেননা ফারহানের এই কথাগুলো ছিলো খুবই কঠিন। তবে যেই না কথাগুলো ও ধারন করতে পারলো সারা শরীরে এক অন্যরকম অনুভূতি ছেয়ে গেলো। চোখে মুখে উৎফুল্লতার রেশ। ফারহান দাঁড়িয়ে আছে গাছে হেলান দিয়ে, হাত জোড়া ভাঁজ থাকলেও ঠোঁটে রহস্যময়ী হাসি। শ্যামবর্ণের এই লোকটি মুহূর্তেই যে কাউকে পাগল করার মতো তীব্র ক্ষমতা নিয়ে এসেছে বোধহয়। আফরা এবার খানিকটা এগিয়ে এলো ফারহানের কাছে। ফিসফিসালো কন্ঠে বলে ওঠলো,

-কাউকে মুগ্ধ করতে পারবো কিনা জানিনা , তবে আপনাকে মুগ্ধ করলেই চলবে।

নিঃসংকোচ কথা ওর। ফারহান ভেবে পায়না এই মেয়ে এতটা খোলামেলা সহজসরল কেনো, বাঙালি মেয়ে মানেই তো লজ্জার আবরণ আর অস্বস্তি ঘিরে থাকবে। তবে এসব কিছুই ওর মধ্যে নেই। ফারহান ভ্রু উচিয়ে বললো,

-আমার সাথে ফ্লার্ট করার ট্রাই করছেন?

-আগে প্রচুর ফ্লার্ট করতাম ছেলেদের সাথে। তবে আপনাকে দেখে ওসব ভুলে গিয়েছি। এমনকি ভবিষ্যতেও করবো না।

আরও একবার বিষয় খেলো ফারহান আফরার কথায়। এই মেয়ের রূপের তেমন তেজ কথাবার্তার তেজ যেন সীমা অতিক্রম করেছে। ভ্যাপসা দুপুর। তবুও বহমান ফুরফুরে হাওয়া। দুপুরের রোদ্দুর পশ্চিম দিকে খানিকটা হেলে যাওয়াতে জানান দিচ্ছে যে কিছুক্ষণ পরই বিকেল ঘনিয়ে আসবে। বর্ষাকালের বিকেলটা অনেক সুন্দর। অন্য এলাকাগুলোর কথা ফারহান তেমন জানে না তবে এই চায়ের রাজ্যের শেষ বিকেল ওর কাছে দুর্দান্ত লাগে। মাঝে মাঝে ক্লান্তি নিনির্মেষে এভাবেই সিক্ত পথের এক কোণে বসে নিবিড়ভাবে অনুভব করতো বিকেলটা। তবে ফারহানের সেই বিকেলগুলোতে কাজ করতো একধরনের শূণ্যতা। মনে হতো , কিছু একটা নেই ওর সাথে। ওর মধ্যে কিছু একটার কমতি আছে যার জন্য এই প্রকৃতি ওকে আপন করে নিচ্ছে না। ফারহান এসব ভাবনা বন্ধ করে গাছে হেলান দেওয়া অবস্থাতেই আফরাকে জিজ্ঞেস করলো,

-এই অসময়ে বাংলোর বাহিরে এখানে ঘুরছেন কেনো?

-এভাবেই ঘুরছিলাম। বাড়িতে মিসেস নাবিলা ছাড়া কেউই নেই তো। তাই ভালো লাগছিলো না।

ফারহান কিছু বললোনা। আফরা এবার চোখজোড়া ছোট ছোট করে বলে ওঠলো,

-আচ্ছা, আপনি তখন উত্তর গাঁও থেকে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলেন বলেন তো?

ফারহান এবার কি বলবে ভেবে পেলো না। কেননা সবার অগোচরে সে গিয়েছিলো নিজাম সাহেবের সাথে দেখা করতে। ইলেকশনের জন্য ওমর খুব ঝামেলা করছে। আর ফারহানের হুট করে উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কেউই ভালো চোখে দেখছে না। আবার তখন ফারহান এই চক্রান্তের মূল কালপ্রট এর বিপক্ষে থাকার কারনে উপর মহল থেকে আগোচরে নির্দেশ এসেছে ফারহানকে মেরে ফেলার জন্য। নিজাম সাহেব তাই ওকে সাবধান করে বলে দিয়েছেন কিছুদিনের জন্য এলাকিটি ত্যাগ করতে। ওমরের হাত অনেক দূর পর্যন্ত। তাই ওকে মেরে ফেলতেও দু’বার ভাববে না।
ফারহান সুক্ষ্ম চালে এড়িয়ে খানিকটা সন্দিহান হওয়ার ভান করলো আফরার মুখপানে চেয়ে। জিজ্ঞেস করলো,

-আপনাকে কেনো বলবো? আমার লাইফ,,আমি যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে লিড করতে পারি। এট এনি চান্স আপনি কি আড়ালে আবডালে আমার ওপর নজর রাখছেন? ইন্টেরেস্টিং,,,,,,,,,!

শেষ কথাটি ফারহান বললো রম্য কন্ঠে, চোখে মুখে চরম কৌতুহলতার ছাপ। আফরা আমতা আমতা করে বললো,

-আমি…….আমি কেনো আপনার ওপর নজর রাখবো?

-সেটা তো আপনিই জানেন। কেনো নজর রাখেন আমার ওপর?

বলেই ফারহানের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ছড়িয়ে পড়লো। আফরাকে এভাবে উত্যক্ত করে ভালো লাগছে বেশ। ফারহান জানে আফরা ওর প্রতি দুর্বল, আর এর সুযোগটা নিতে ফারহান কখনোই বিলম্ব করে না। আফরা মুখ ফুলিয়ে বললো,

-এমন কিছুই না। আমি,,,,,আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করেছিলাম।

-আমায় নিয়ে আপনার একটু বেশিই চিন্তা আফরা। শুনুন, আপনি এখানে আমার জন্য চিন্তা করতে আসেননি , এসেছেন ঘুরাফিরা করতে। আর আপনি সেরকম কিছু না করে আমার পেছনে পড়ে আছেন । উফফফ! ইউ আর টু মাচ সিলি গার্ল আফরা।

আফরার রাগে অপমানে মুখ কালো হয়ে গেলো। একই সাথে নিজেকেও অবাধে গালি দিতে মন চাইছে। আগে তো ও এমন ছিলো না। তাহলে এখন এমন টিন এজারদের মতো আচরণ করছে কেনো ফারহানের সামনে। যতবারই ও চেষ্টা করে নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করতে অমনেই সব ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। মানুষের কাছে এতটা প্রশংসা পেয়ে কি লাভ যদি পছন্দের মানুষটার সামনেই হাসির পাত্র হতে হয়?

আফরা এবার রাগে দুঃখে বাংলোর দিতে ফিরে যেতেই ফারহান ওর হাতের কব্জি চেপে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। মিহি কন্ঠে বললো,

-এত রাগ কোথায় রাখেন আপনি? খালি কথায় কথায় ভুতের মতো এদিক ওদিক চলে যান?

আবারও। আফরার এবার ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে কাচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে। ফারহান ভ্রু উচিয়ে বললো,

-রাগ হচ্ছে আমার ওপর?

-অনেক।

-ইচ্ছে করছে আমায় একেবারের চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে?

-হুম।

-তাহলে তো আপনার রাগ ঠান্ডা করতে হয় দেখছি। তো! যাবেন আমার সাথে?

আফরা চুপসে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,

-কোথায় যাবো?

-গেলেই নাহয় দেখতে পারবেন…………ইটস সারপ্রাইস মিস উইয়ার্ড গার্ল!

শেষ কথাটি ফারহান বললো আফরার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে, একেবারে হৃদয় বিদীর্ন কন্ঠে। আফরার সারা শরীরে অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেলো এতে। আকাশ জানান দিয়েছে এখন বিকেলের প্রহর। রোদের হালকা মিষ্টি আলো ফারহানের মুখটা সোনালি রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। কি ঘোরতর সেই দৃষ্টি। আফরার মনে হলো , এই লোক নিজের চাহিনী দিয়ে একেবারেই মেরেই ফেলবে ওকে। মাথার ওপরের গাছ থেকে ঝরে পড়ছে ছোট ছোট শিউলি ফুল। আফরা মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ ফারহান ওকে যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে যেতেই ও রাজি। শ্রীমঙ্গলের প্রতিটি পথ-প্রান্তরে সে নাম লিখাবে ফারহানের সাথে।❤
.#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤️
#পর্ব___৩৬
#কায়ানাত_আফরিন
ফারহান গাড়ি থামালো কালিঘাট রোডে ১৪ রাইফেল এর ব্যাটালিয়নের ক্যান্টিনে। আশেপাশে অনেক মানুষের সমারোহ। বেশিরভাগই পর্যটক বললে চলে। এতে খানিকটা অবাক হলো আফরা। কেননা ফারহান সচরাচর পর্যটক স্থান যেখানে মানুষের আকর্ষণ বেশি সেখানে নিয়ে যায় না। ফারহান এমন জায়গাগুলোতেই নিয়ে যায় যেখানে মানুষের সমাগোম কিছুটা কম হলেও সুন্দর মোহনীয় পরিবেশে প্রকৃতিকে এক অন্যভাবেই উপভোগ করা যায়।

আফরা গাড়ি থেকে নেমে পরখ করে নিলো আশপাশ৷ সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে যাওয়ার পর নেমে গিয়েছে আঁধার। তবুও আলোর সমারোহে কালিঘাট রোডটি অনন্য লাগছে দেখতে। আফরা এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ফারহানের দিকে। বললো,

-এখানে আমায় কেনো নিয়ে এসেছেন ফারহান?

-ওইযে তখন বললাম না আপনার মুড ভালো করার জন্য নিয়ে এসেছি।

ফারহানের নিষ্প্রভ কন্ঠ। মনে মনে চরম বিরক্ত হলো আফরা। একে তো ফারহান পুরোটা পথে কোনো কথা বলেনি আর আফরা এই প্রশ্নটা করার পর বারবার একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছে । আফরা এবার কৌতুহল নিয়ে অন্যত্র তাকালো। এই লোকের সাথে কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। নাহলে ত্যাড়া ত্যাড়া উত্তর দিয়ে মাথা বিগড়িয়ে ফেলবে।
ফারহানের পিছু পিছু আফরা একটি চায়ের দোকানের সামনে এলো।নাম ‘নীলকন্ঠ টি কেবিন’। শ্রীমঙ্গলের অন্য চার পাঁচটা চায়ের দোকানের মতো এটি না। বেশ সুন্দর আর পরিপাটি করে সাজানো এই দোকানটি৷ ফারহান এককোণে বসে পড়লো এবার, সেই সাথে আফরাও। আফরা এবার জিজ্ঞেস করলো,

-আমরা কি এখানে চা খেতে এসেছি?

-হ্যাঁ।

-আপনার তো জানার কথা যে আমি চা তেমন একটা খাইনা।

ফারহান মিহি হেসে হাতের মোবাইলটা আর হাত ঘড়িটা খুলে সামনের টেবিলে রেখে দিলো। আজ আবহাওয়াটা ঠান্ডা, তাই ফারহানের শীতল রূপে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে। ঠোঁটে একধরনের চাপা হাসি৷ ফারহান একটু টেবিলে ঝুকে আফরার চোখে মনোনিবেশ করলো। বলে উঠলো,

-চায়ের দেশে এসেছেন আর চা খাবেন না তা কি সম্ভব? আর আপনার মুড ভালো করার জন্য এই খ্যাতনামা ‘নীলকন্ঠ টি কেবিন ‘ এর সাত রঙের চা হলো বেস্ট। আপনার তো এমনিতেও আকাশের মতো মুড। এই ভালো থাকেন তো এই জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো পারলে আমায় ঝলসে ফেলেন। এখন চা কি খাবেন নাকি ওই ব্রয়লার অ্যামেরিকানদের মতো ‘কফি’ ‘কফি’ করে বেড়াবেন?

আফরার মুখে কিঞ্চিত রাগের আভাস। অপমানে থমথম করছে ওর মুখশ্রী। ফারহান কি সিরিয়াসলি ওর রাগ ভাঙানোর উদ্দেশ্য এখানে এসেছে নাকি রাগের মাত্রা আরও দ্বিগুন বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এখানে এসেছে? আফরা এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠলো,

-ফাইন, তো ভালো করুন আমার মুড এখন৷ ফটাফট চা আনতে বলুন।

ফারহান মিহি কন্ঠে ‘গ্যুড গার্ল’ সম্বোধন করলো আফরাকে। তারপর একজনকে নিয়ে আসতে বললো দু কাপ সেই বিখ্যাত “সাত রঙের চা”। আফরা এবার কটাক্ষ গলায় বললো,

-যদি চা খেয়ে আমার মাথা ঠান্ডা না হয়, আপনার মাথা আমি খেয়ে ফেলবো কিন্ত৷ রিমেম্বার দ্যাট!

-দেখা যাবে।

অল্প সময়ের ব্যাবধারেই হাফ প্যান্ট আর টিশার্ট পড়া এক কিশোর ট্রে তে করে নিয়ে এলো চা। আফরা সেদিকে ধ্যান না দিয়ে মোবাইল স্ক্রল করছিলো কিন্ত যেই না চায়ের গ্লাসটির দিকে তাকালো অমনি স্তব্ধ হলো সে। চা বলতে আফরা যেমনটা ধারনা করেছিলো এর রূপ আর রঙ একেবারেই ভিন্ন। অবাক প্রসন্ন গলায় সে ফারহান এর উদ্দেশ্যে বললো,

-এটা কি?

-আপনার বিক্ষিপ্ত মন ভালো করার ঔষধ।

ফারহানের টনক নাড়ানো কন্ঠে আর চায়ের দিকে তাকিয়ে আফরা যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। একটা নরমাল গ্লাসে চায়ের পরপর সাতটা লেয়ার আছে,, যেটার কালার আর টেস্ট দুটোই ভিন্ন। আফরা সেটা গুণেও দেখলো ভালো করে। ফারহান আফরার এক্সপ্রেশন দেখে যা বোঝার বুঝে নিয়েছে৷ তাই বসার চেয়ারে আর একটু আরাম করে নিজের শরীর এলিয়ে দিলো। বললো,

-ফার্স্ট ইমপ্রেশন ইজ দ্য লাস্ট ইমপ্রেশন! আপনার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনার ভালো লেগেছে। তাই এভাবে চোখ দিয়ে না খেয়ে টেস্ট করে দেখুন কেমন লাগে এটা৷

আফরা কথা অনুযায়ী করলোও তাই। সাতটা লেয়ারের একটার টেস্টও অন্যটার সাথে মিল নেই। শুরুতে একটু তেঁতো লাগলেও পরে জিনিসটা ভালো লাগলো আফরার। প্রসন্ন হয়ে বলে ওঠলো,

-ইমপ্রেসিভ!

বাহিরের পথ ধরে আনাগোনা চলছে হাজারো যান বাহনের। অদূরেই একটা ছোট মার্কেট আছে যেখানে বার্মিজ আর ইন্ডিয়ান নানা ধরনের তৈজসপত্র পাওয়া যায়। ফলে মানুষের শোরগলো কম নয়। আফরার কেন যেন ভালো লাগলো এসব। শ্রীমঙ্গলে এসেছে আজ অনেকদিন তো হলো কিন্ত এখানে মানুষ একেবারেই কম। আর আফরা এতো জনমানবহীন জায়গায় বসবাস করে অভ্যস্ত না কখনোই৷

আফরার হঠাৎ মনে পড়তে লাগলো অ্যামেরিকাতে থাকাকালীন দিনগুলোর কথা৷ রাতে এসময় প্রায়ই সে পার্ট টাইম জব শেষ করে বেরিয়ে পড়তো ওয়াশিংটন ডিসির ব্যাস্ততম সড়কগুলো বিচরণ করতে৷ আফরা ছিলো বাউণ্ডুলে ধরনের মেয়ে। ঘরে থাকাটা বরারই ওর কাছে অপ্রিয় ছিলো। তাই সুযোগ পেলেই হাইওয়ে ধরে লংড্রাইভ, ক্যাম্পিং, বনফায়ার, নাইট আউট এগুলোতে এতটাই বুদ হয়ে গিয়েছিলো যে মনে হতো এটাই ওর প্রকৃত আনন্দ। এতেই বুঝি মানুষের সুখ নিহিত থাকে৷ এই ভালোবাসা, কেয়ার, অনুভূতি এগুলো মোহ ছাড়া আর কিছুই না। আর আজ এই আফরা নিজেকে কল্পনা করলেই অবাকের ওপর অবাক হয়। এই বাংলাদেশ,, বাংলাদেশের মানুষ,, এই শ্রাবণ মাস, এই চা বাগান, এই সবুজ গালিচার মনোরোম দৃশ্য ওর চিন্তা ধারাই পরিবর্তন করে দিয়েছে। আর মনের এক বিশাল অংশ দখল করে রেখেছে সামনে বসা এই মোহনীয় মানুষটি।

______________________

কাল সকালেই টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে রৌশিন, ইলা আর মারুফ। উদ্দেশ্য মারুফের বার্থডে সেখানে সেলিব্রেট করা৷ প্রথমে ইলা আর মারুফ নাখোশ ছিলো ওখানে যাওয়ার ব্যাপারে যেহেতু রৌশিন সবেমাত্রই জ্বর সারিয়ে উঠেছে৷ কিন্ত রৌশিন কিছুতেই চাচ্ছে না যে ওর জন্য কেউ কোনো সিদ্ধান্ত বদলে ফেলুক। অগত্যাই রাজি হলো মারুফ আর ইলা। তাছাড়া টাঙ্গুয়ার হাওড়ে যেহেতু ওদের সাথে আফরা ফারহান আর ফাহিমও যাচ্ছে তাই আনন্দটা নেহাত কম নয়। ওদের পরিকল্পনা প্রথমে ছিলো সকালে ঘাটে গিয়ে একটা ট্রলার সারাদিনের জন্য ভাড়া করবে। কিন্ত ফাহিমের পরামর্শ সাপেক্ষে ওরা সবাই এক রাত সেখানে আড্ডা দিবে বললে ধাতস্থ করলো।

ইলা আর মারুফের মনে এতে তুমুল আনন্দ, সেই সাথে খুশির জোয়ার। তবে রৌশিন ওপর দিয়ে হাসির আবরণ দিয়ে রেখেছে শুধু। ওর ভেতরটা একটু উঁকি মারলেই দেখা যাবে ভেতরে ভেতরে দুঃখে কষ্টে ছারখার হয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। ফাহিমের সেই কথাগুলো ভেঙে দিয়েছিলো ওকে। ফাহিমেরই বা কি দোষ? সে কি কখনও বলপছে যে সে রৌশিনকে ভালোবাসে? ওর মনে আফরার জন্য অনুভূতি আছে সেটাই অনেক। এটলিস্ট রৌশিন নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে না পেলেও সে কাম্য করে ফাহিমের খুশিটা।

______________________

নিবিড় রাতের আকাশে দৃশ্যমান লক্ষ লক্ষ তারা। এক ফালি চাঁদের আলোখেলার আবরণে এখানকার প্রতিটি রাস্তা মায়াবী মনে হচ্ছে আফরার কাছে। গাড়ি ড্রাইভ করছে ফারহান। ওর সুগভীর নয়নের দৃষ্টি সামনের পিচঢালাই পথের দিকে। হেডলাইটের আলোতে সামনের আঁধার আংশিক কেটে গেলেও পুরোপুরি ভাবে কেটে যায়নি৷ কিছুক্ষণ আগেই রামনগরে পেপারের দোকানটার সামনে ফাহিমের সাথে দেখা হলো ওদের৷ অবশ্য ফাহিমই কল দিয়ে ওদের আসতে বলেছে। ফাহিমের হাতে ছিলো বিশাল দুটি ব্যাগ। ঘামে ভিজে ছিলো ওর প্রশস্ত কপাল। ঠোঁটদুটো ক্লান্তির দরুন কাপছে তিরতির করে। ফারহান জিজ্ঞেস করলো,

-হাতে এসব কি ফাহিম?

-কালকে হাওর যাচ্ছি না, ওসবের জন্যই কিছু জিনিস কিনলাম। খালি হাতে গেলে ইলা গলা টিপে মেরে ফেলতো আমায়।

আফরাকে দেখা মাত্রই অবাক হলো ফাহিম৷ জিজ্ঞেস করলো,

-আফরা আপনি এখানে যে?

আফরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফারহান বলে ওঠলো,

-আমি নিয়ে এসেছি ওকে৷ কেনো, কোনো সমস্যা ফাহিম?

ফারহানের নিদারুণ কন্ঠ। সচরাচর ও এমনভাবে কখনোই ফাহিমের সাথে কথা বলে না। মিসেস নাবিলা বা মিঃ ইফাজের সাথে ফারহানের যেমনই সম্পর্ক হোক না কেনো, ফাহিমের সাথে ওর বন্ডিং প্রচন্ড ভালো। তবে এই প্রথম একটি বিশেষ কারনে ও এড়িয়ে যাচ্ছে ফাহিমকে। কারনটির নাম ‘আফরা’। ফারহান জানে না ফাহিমের সাথে আফরাকে দেখলে ওর মনে এতো অস্থিরতা বিরাজ করে কেনো, তবে যেইদিন থেকে ফারহান জানতে পেরেছে যে ফাহিম পছন্দ করে আফরাকে তখন থেকেই ও যেন প্রচন্ড বিচলিত মনে করে নিজেকে। মনে কাজ করে তুমুল উত্তেজনা। এ উত্তেজানা যে আফরাকে নিয়েই এ নিয়ে ওর মনে কোনো সন্দেহ নেই৷

ফারহানের এমন কথায় ফাহিম তেমন কোনো প্রতিউত্তর দিলো না৷ মনে মনে তবে এমন কাজে অবাক হলো বেশ। ফাহিমের কাজ আছে। মিঃ ইফাজ বলেছেন হসপিটালের ডিউটি সম্পন্ন করে একটু বাজারের দোকান থেকে ভাড়া তুলে আনতে। তাই ব্যাগগুলো ফারহানের গাড়ির ডিকিতে তুলেই সে অন্যরাস্তায় পা বাড়ালো। তারপর আফরা আর ফারহান উদ্যত হলো নেলসন টি এস্টেটের উদ্দেশ্যে।

কালিঘাট রোড থেকে নেলসন টি এস্টেট যাওয়ার পথে আরেকটা টি এস্টেট পড়ে, নাম ‘নূরজাহান টি এস্টেটে’। সিলেট বিভাগের অন্তর্গত এই নূরজাহান টি এস্টেট এখানকার সবচেয়ে বড় টি এস্টেট গুলোর মধ্যে একটি। আসলেই এটার পরিধি বিশাল , যা রাতের আঁধারে বাহির থেকে দেখলেই ভালোমতো বোঝা যাচ্ছে। আফরা এবার ঘাড় বাকিয়ে ফারহানের দিকে তাকালো৷ ফারহান বললো,

-কিছু বলবেন?

আফরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ মনে মনে আওড়িয়ে নেয় একটু শান্তিমতো এই ছেলেটার রূপও উপভোগ করতে পারবে না৷ কথাটি অন্যদিকে ঘুরানোর জন্য সে বললো,

-আপনি কি কাল সত্যিই যাচ্ছেন আমাদের সাথে হাওরে ?

-যাওয়ার তো ইচ্ছে ছিলো না।

-তাহলে এখন যাওয়ার ইচ্ছে হলো কেনো?

ফারহান ড্রাইভ করতে করতেই একবার মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিলো আফরাকে। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

-আপনার জন্য।

ফারহান হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না যে ওর এই কথাটি কত গভীর প্রভাব ফেলেছে আফরার মনে। আফরা হতভম্ব, নিষ্প্রভ। কেননা ও কল্পনাও করতে পারেনি এমন উত্তর ফারহান দিবে। আফরার চোখের পলক ফেলা যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে এমন হৃদয়ঘাতি কথায়। নিশিরাতে বহমান ফুরফুরে বাতাস। অদূরে লম্বা ডানা মেলা গাছগুলো ঝাপটিয়ে চলছে নিজের ডালপালা। ফারহান নামক এই পুরুষটি আফারার কাছে ওই ডানা ঝাপটানো গাছগুলোর মতোই মনে হচ্ছে এখন৷ আফরা বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠলো,

-আপনার পাগলামিগুলো এখন দৃশ্যমান আমার কাছে ফারহান, খুব শীঘ্রই আমার জন্য আপনার এই পাগলামি আপনার নিজের কাছেও প্রকাশ পাবে। আমি জানিনা কেনো আপনি আমায় নিজে থেকে দূরে সরিয়ে রাখছেন তবুও আমি জানি, এটা আপনি বেশিদিন পারবেন না। কারন প্রেম কখনোই লুকিয়ে রাখা যায় না। আর আমি তো আপনার দুর্বলতা। সেটা তো লুকিয়ে রাখা অসম্ভব!!

#চলবে

কায়ানাত আফরিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here