#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব
পর্ব-২৪
পেপারটা হাতে নিয়ে বিছানায় চুপচাপ বসে আছি। ফর্মে সুন্দর করে গোটাগোটা অক্ষরে সাব্বির নিজের নাম ঠিকানা লিখে রেখেছে। শুধু আমার ঘর গুলো বাকি।
বাংলাদেশের ইসলামি নিয়ম অনুযায়ী এই প্যাপারটা উকিল নোটিশ সহ ইস্যু করার তারিখ থেকে তিন মাসের মধ্যে যদি আমি কোনো রেসপন্স না করি তাহলে ডিভোর্স হয়ে যাবে। আর তার পরে একটা পারমানেন্ট সার্টিফিকেট ধরিয়ে দেবে।
অনেকটা তালাকের মতো। তালাকে যেমন তিন মাসের মধ্যে ঠিক না হলে আর সুযোগ থাকে না, তেমন।
রেসপন্স করে যদি সলভ হয় তাহলে আলাদা কথা।
চোখের পানিতে কাগজটা অলরেডি অনেক খানি ভিজে গিয়েছে।
কি করবো বুঝতে পারছি না।
একটা পেন নিয়ে আমার ডিটেইলসর ফাঁকা ঘরগুলো ফিলাপ করতে শুরু করলাম। হাত দিয়ে ধরে লিখতে অনেক সময় লাগছে। কাপুনির জন্য ঠিকঠাক মতো লিখতেও পারছি না!!!
সাব্বিরের জন্মদিনে আমার তরফ থেকে গিফট!!!,
এটা দেখলেই আশা করি উকিল নোটিশ সহ কোন কিছু আমাদের বাসায় পাঠাতে হবে না!!
কেউ জানাজানির আগেই পালাতে হবে।
একটা ছবি তুললাম ফর্মটার।
যত্ন করে প্যাপারটাকে ওর ড্রয়ারে রেখে দিলাম। আমি দেশে থাকতে এতোগুলো মানুষের কস্ট দেখতে পারবো না। আমি যাওয়ার পর যা হবার হোক। তবে একজন আছে যাকে আমি এতোদিন যা যা হয়েছে সব কিছু আমি বলতে পারি। আমার অবর্তমানে অন্তত মিথ্যা কোনো কিছু যেনো বলতে না পারে।
সময় নষ্ট করা যাবে না। সাব্বির আসার আগেই বাসা থেকে চলে যাবো। ওর সামনে যাওয়ার আগে ছাড়া আর পরতে চাই না। কস্টের দিনগুলো ফাল্গুনের ঝরা পাতার দিনগুলোর মতোই ঝরে যাক। যা আর কখনোই ফিরে আসবে না।
আমাদের বাসায় যেতে হবে একটু। উফ্, কখন করবো এইগুলো!! কস্ট নিয়ে পরে থাকলে কি হবে।
ফুপিকে তার রুমে পেলাম।
-এই তোমাদের কিছু জিনিস লাগবে আমার, দাওতো একটু তারাতাড়ি।
-কি জিনিস লাগবে?
ডকুমেন্টস গুলো সব নিয়ে ফুপিকে বললাম
-তোমার ছেলে কই?
-রুমে নাই?
-না, নাইতো।
-জানি না তো তাহলে!! ওর তো বাসায় থাকার কথা এখন। ও তো এখন প্রায় সময় বাসায়ই থাকে।
হুম সেটা তো থাকবেই। আমি তো বাসায় নেই এখন। বাসায় থাকলেই তো উনি সারাদিন বাইরে বাইরে থাকবেন। মনে মনে কথা গুলো একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলাম।
– কি রান্না করছো আম্মু? ক্ষুধা লাগছে আমার।
ফুপির পাশে জড়িয়ে ধরে বললাম।
-ক্ষুধা লাগছে বলে এমন জড়িয়ে ধরে বসে থাকলে খাবি কিভাবে শুনি? চল, খাবি চল ।
-আচ্ছা একটু পরে যাই। আর একটু এভাবে থাকি।
আদুরে গলায় বললাম।
জানো ,তোমার কাছে আসলে কেমন আম্মু আম্মু একটা স্মেল পাই । এর জন্যে তোমার কাছে কাছে থাকতাম সারাদিন।
ফুপি আঁচলে চোখ মুছলেন।
বাবা মায়ের আদর বোধহয় আমার কপালে নেই। তাইতো বাবা মায়ের মতো এই মানুষগুলোকেও ছেড়ে চলে যেতে হবে!!!!
মাথা তুলে বিরক্ত স্বরে বললাম কথায় কথায় এমন ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না শুরু করো দেখেই না কিছু বলতে ইচ্ছে করে না তোমাকে।
আসো দেখি কি রান্না করছো তুমি, সব খেয়ে শেষ করে ফেলবো। তারপর বিশ্বমুটকি হবো।
কথা গুলো বলে হাত ধরে টানতে টানতে রান্নাঘরে নিয়ে গেলাম।
-আম্মু একটু খাওয়াই দাওতো। আমি হাতের কাজ গুলো শেষ করি। একটু পরেই আমি চলে যাবো।
ফুপি মুখ টা হা হয়ে গেলো আমার কথা শুনে।
আরে আস্তে হা করো, মশা ঢুকবে।
-তুই আসছিস কেনো তাহলে? কি এমন ইমারজেন্সি কাজ ছিলো শুনি?
-তুমিই না বললে সাব্বির কে সারপ্রাইজ দিতে আসছি। প্রেম দেখানো কতো ইম্পরটেনট একটা জিনিস!! সেটাকে তুমি ছোট করে দেখছো কেনো!!!
দেখো না রিতু আপু আর ভাইয়া কি সুন্দর প্রেমের ঠেলায় প্রতি বছর বাহিরে কয়বার হানিমুনে যায়!!
প্রেম না থাকলে কি আর সম্ভব এগুলা???
-হুম, বাইরের দেশ তো অনেক সুন্দর!!!! সৌদি আরব যে কি সুন্দর!!!! হজ্জের উছিলায় বাইরে ঘুরার ইচ্ছে তো পুরন হলো!!!
ফুপির চেহারাটা মলিন হয়ে গেলো। ফুপির খুব ইচ্ছে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার। টাকা পয়সার অভাব নেই কিন্তু নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ নেই!!!
রিতু আপু এতো দেশে যায়, কিন্তু ফুপিকে নিয়ে যাওয়ার সময় নেই!! রিশাদ ভাইয়ার কথা তো বাদই, সাব্বির ফুপির সাথে কথাই বলে না ফ্রিলি!!
ইনশাআল্লাহ, এইবার একটু হলেও পুরন করতে পারবো।
-আম্মু রিশাদ ভাইয়া কই? দেখলাম না যে?
রিশাদ ভাইয়ার কথা জিগ্যেস করতেই ফুপির হাসি এক কান থেকে অপর কান পর্যন্ত ছড়ালো!!!
কমাস আগেও কেউ জিগ্যেস করলে মলিন মুখে এড়িয়ে যেতো।
-আর বলিস না, জার্মান এ নাকি ওর কোন ফ্রেন্ড থাকে, সেখানের এক ইউনিভার্সিটিতে নাকি এডমিশন নিবে। কয়েকদিন ধরে ভিসা টিসা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতেছে। আহারে, ছেলেটাও আমার থেকে দূরে চলে যাবে। কি খাবে দাবে ওখানে কে জানে!!
শেষ কথা গুলো দুঃখের হলেও ফুপির মুখ আত্নতৃপ্তির হাসি।
-ও, তাহলে ভাইয়ার সাথে আর দেখা হলো না।
-রিতু আসছে তো বাসায়
-আমি চিটাগং যেয়ে পৌছানোর পরে বলতা।
-তোর আব্বু একটু অফিসে গিয়েছে। কি কাজ জানি এসেছে আবার, তোর আব্বুকে নাকি লাগবে আবার।
সাব্বিরের সাথে দেখা করবি না? ও তো বাসায় নেই।
-ওর সাথে তো বাসায় দেখা করবো না, স্পেশাল জায়গায় করবো, একটা চোখ মেরে বললাম আমি।
-তুই……
হাসতে হাসতে উঠে হাত ধুয়ে আপুর রুমে গেলাম।
রিতু আপু মলিন চেহারায় জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে।
আপু সুখে নেই। একজন দুঃখী মানুষই আরেকজন দুঃখী মানুষের কস্ট বোঝে।
-ভাইয়ার সাথে কি হয়েছে আপু?
চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে একটা মলিন হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো
-কখন আসছিস? কেমন আছিস তুই?
-সকালে আসছি। যেমন দেখছো ঠিক তেমনই আছি।
-মানুষের বাইরেরটা দেখে ভিতরটা কখনোই বোঝা যায় ন।
– কে বললো? সব মানুষের যায় না। কিছু কিছু মানুষের যায়। যেমন হলো তুমি। যাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে,
সে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে হুমকির সম্মুখীন। ভরসার জায়গাটা হয়তো আগের মতো নেই!!
রিতু আপু আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো!!
-আমি ভালো নেইরে মেহের, ভালো নেই!!!
ও অনেক চ্যাঞ্জ হয়ে গিয়েছে!!! নতুন কারো সাথে সম্পর্কে জরিয়েছে। ডিভোর্স দিয়ে দিবো!!
চারদিকে এমন ডিভোর্সের ছড়াছড়ি কেনো!!!
একদিক গড়ে তো আরেকদিক ভাঙে।
আপুকে সামনা সামনি বসিয়ে বললাম,
-তোমার রান্না করা ভাত কি প্রতিদিন একরকম সিদ্ধ হয়?
কপাল কুচকে মাথা ঝাকিয়ে আপু বললো, ” এখানে ভাত আসলো কোথা থেকে ? তুই ফাজলামো করতেছিস কেন? আমার সংসার ভেঙে যাচ্ছে আর তুই ভাত রান্না করতেছিস????”
বিরক্ত হয়ে বললাম
-আরে মুর্খ মেয়েমানুষ, সামান্য একটা ভাত প্রতিদিন একরকম করে রান্না করতে পারো না, আর তুমি কি করে আশা করো যে একটা জলজ্যান্ত মানুষ বছরের পর বছর একরকম থাকবে?
কম বেশি সবাই বদলে যায়, বদলে যায় তার ভালোবাসার ধরন, শুধু ভালোবাসার মানুষটা বদলায় না।
কি বুজলা?
-বুঝছি, কিন্তু এখন তাহলে কি করবো?
বুজবো কিভাবে যে এখনো আমিই তার ভালোবাসার মানুষ আছি ?
-তোমার ফোনটা দাও তো একটু।
ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো, “কি করবি?”
-যাই করি না কেনো তুমি দয়া করে কিছু বইলো না।
এটা ভাইয়ার নাম্বার?
-হুম।
-ওওওওরে প্রেম, জান লিখে সেইভ করা!!!!
-যাহ্, ফাজিল মেয়ে একটা!!!
ভাইয়ার নাম্বারে কল দিয়ে কান্না কান্না গলায় বললাম
-ভাইয়া, আমি মেহের। রিতু আপু মনে হয় বাঁচবে না আর!!!
আপনি কই ভাইয়া? একটু তারাতাড়ি আমাদের বাসায় আসেন প্লিজ!!!!
-কি হয়েছে ওওর। হ্যালো…!! হ্যালো…!!
আমি সুন্দর করে ফোনটা কেটে দিয়ে সিমটা অফ করে দিলাম।
আপু চোক বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে!!
-তোমার রসগোল্লার মতো চোখ দেখে তো আমার মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে!! আচ্ছা তুমি আর একটা বেবি নিচ্ছো না কেন। তাহলে তো এই উছিলায় মিষ্টি খেতে পারতাম। কোনো উপলক্ষ ছাড়া মিষ্টির আসল টেস্ট আসে না।
“মেহের আমি প্রেগন্যান্ট!!!! আর তুই প্রথম জানলি কথাটা!!! ” প্রায় ফিসফিস করে অবাক হয়ে কথাটা বললো আপু!!!
আজকে মিষ্টি না খেলেও কোনো আফসোস নেই আমার!!
আপুকে একটা হাগ দিয়ে বের হয়ে এলাম। অনেকদিন পর খুশিতে চোখে পানি এসে গেছে!!
রান্নাঘরে গিয়ে ফুপিকে বললাম,
-আম্মু মিষ্টি আছে বাসায়?
-না রে, আমার ডায়াবেটিস, তোর বাবারও।
রিশাদ আর সাব্বিরও তেমন একটা মিষ্টি খায় না।
তাই বাসায় আনাও হয়না তেমন।
এজন্যেই তো মুখে ভালো কোনো কথা নাই, বিরবির করে বললাম আমি।
মিষ্টি দিয়ে কি হবে? খাবি তুই?
-খালি আমি না, আজকে সবাই খাবে। আর শোনো ভাইয়া আসতেসে দুপুরে, রিতু আপুকে মনে হয় নিয়ে যাবে। ভালো কিছু রান্না করো।
বলেই আব্বুকে ফোন করলাম। পাশ থেকে ফুপি এক গাদা প্রশ্ন করছে।
-হ্যালো, আব্বু…. সব থেকে ভালো দেখে মিষ্টি নিয়ে আসো তো।
-কেনো কি হয়েছে? তুই কখন এলি?
-রিতু আপুর অানডা বাচ্চা হবে। তারাতাড়ি নিয়ে এসো কিন্তু!!!
ফোন কেটে দিতেই দেখি ফুপি বাচ্চাদের মতো চেয়ারে বসে হাউ মাউ করে কান্না শুরু করে দিয়েছেন!!!
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে কান্না করতে করতে রিতু আপুর হাসবেন্ড ঢুকলো বাসায়!!!
তার পিছন পিছন সাব্বির!!!
বুলেটের গতিতে কিভাবে আসলো এরা!!!!!!
বাসার আসেপাশেই ছিলো মনে হয়।
“রিতু….রিতু….?????” হেচকির জন্যে বেচারা কথাও বলতে পারছে না ঠিকমতো!!
ইশারায় আপুর রুমটা দেখিয়ে দিলাম।
দিগুণ শব্দে কাদতে কাদতে সাব্বিরসহ আপুর রুমের দিকে দৌড়ে গেলেন!!!!
ভাইয়ার বুকে রিতু আপুর আছড়ে পরার শব্দটা বোধহয় আমি এখান থেকেই তৃষ্ণার্ত মন নিয়ে শুনতে পেলাম।
কিংবা হয়তো মনের ভুল।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। এখন না বের হলে ট্রেন মিস করতে হবে। আরও কিছু কাজ করাও বাকি আছে।
কাউকে কিছু না বলে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে এলাম। আসল কথা হলো, সাব্বিরকে জড়িয়ে ধরতে মনে চাইছে খুব।
আমারওতো ইচ্ছে করে সমুদ্র সৈকতে ঢেউ ভাঙার মতো করে কারো বুকে আছড়ে পরতে!!!!!