-দেখ অভিক বিরক্ত করিস না হাত ছাড় আমার। দেশে আসতে না আসতেই কি শুরু করলি বল তো?
-তোমার হাত ছেড়ে দেই আর তুমি অমনি আমাকে রেখে রওনা হও তাই না। তুমি আমার সাথে যাবে এবং আমার গাড়িতে চড়ে। আর কোনো কথা বলবে না চুপচাপ উঠে বসো।
এই অভিক না বড্ড একরোখা স্বভাবের। বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে আজ দীর্ঘ দু’বছর পর দেশে ফিরে এলাম। বাবা হসপিটালে ভর্তি ; আমি এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হসপিটালে যেতে চাচ্ছিলাম কিন্তু এই অভিক এসে শুরু করে দিলো ওর পাগলামো।
-ফুল, তুমি কেমন আছো?
অভিকের মুখে ফুল ডাকটি শুনে ওর দিকে তাকালাম। দেখি ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ি ড্রাইভ করছে রহিম চাচা।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
-দেখ অভিক আমি তোর থেকে আমি তিন বছরের বড় আর তুই কি না আমায় নাম ধরে ডাকিস?
-তোমার আসল নাম নিশ্চয়ই ফুল নয়! কিন্তু, আমার কেন জানি তোমায় ফুল বলে সম্বোধন করতে বেশ আনন্দ অনুভব হয়।
– হ্যা ঠিক তো আমার নাম তো হিয়া জামান। দেখ তোর কোনো কথাই আমার এই ছোট মাথায় ঢুকে না। তাই তোর বকবকানি আপাতত একপাশে রেখে চুপ থাক। টেনশনে আমার মাথা ব্যাথা করছে না জানি আব্বুর কি অবস্থা?
-চাচ্চু পরশু দিন হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পরে। পরে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর কিছু টেষ্ট করার পর ডক্টর জানায় চাচ্চুর হার্ট ব্লক হয়েছে।
-তোরা তো আমাকে কিছু বলিস না ভাগ্যিস নোভা আমাকে বলেছে।
গাড়ি থেমে গেছে বাইরে তাকাতেই দেখতে পেলাম আমরা হসপিটালের গেটের কাছে চলে এসেছি।আমি জলদি নেমে হসপিটালের ভেতর যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কে যেন আমার হাত ধরে টেনে ধরলো। পিছু তাকাতেই দেখতে পেলাম অভিক আমার হাত ধরে আছে।
এবার অভিক আমার হাত ওর হাতের মুঠোয় নিয়ে চলতে শুরু করলো।
রিসিপশনের মেয়েটিকে কেবিন নাম্বার জিজ্ঞেস করে আমাকে নিয়ে গেলো আব্বুকে যেই কেবিনে রাখা হয়েছে সেখানে।
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম মা বসে আব্বুর পায়ের কাছে। চাচ্চু বসে আছে সোফায় আমার ছোট ভাইটিকে কোলে নিয়ে। আমাকে দেখে তারা অনেক খুশি হয়েছে। কিন্তু আব্বু কেমন করে শুয়ে আছে?আব্বুর কাছে এগিয়ে গিয়ে বসলাম। আব্বুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই চোখ খুলে তাকালো। আমাকে দেখে আব্বু যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলো না যে আমি এসেছি। আম্মু যখন বললো তখন আব্বু বিশ্বাস করেছে।
আব্বুর সাথে শুধু একজন থাকতে পারবে তাই আমি চেয়েছিলাম থাকতে কিন্তু আম্মু আমাকে থাকতে দিতে চাইছে না বলছে আমি এতদূর থেকে প্লেন জার্নি করে এসেছি আজ যেন বাড়িতে চলে যাই। আগামীকাল না হয় থাকব আব্বুর পাশে।
আমি ভেবে দেখলাম আম্মুর কথাই ঠিক। পরে অভিককে সাথে নিয়ে আমি, আমার ছোট ভাই সাদাফ এবং চাচ্চু বাড়ির পথে রওনা হলাম।
বাড়িতে পৌঁছাতে সবাই যেন এক অন্যরকম ভাবে ওয়েলকাম জানালো। রাতের খাবার কোনোভাবে শেষ করে চলে এলাম আমার রুমে। আজ দীর্ঘ দু’বছর পর আমার বাড়িতে আমার এই রুমে এলাম। সবকিছু যেন আমার মনমতো করে গোছানো।হয়তো মা সব পরিষ্কার করে রাখতো।
দরজায় কে যেন নক করছে আমি বললাম ভিতরে আসতে দরজা খুলে রাখা আছে।
অভিক এসেছে দুহাতে কফির মগ।পাগলটা মনে রেখেছে যে আমার রাতের খাবারের পর কফি খাওয়ার অভ্যেস আছে।আমার দিকে কপির মগ বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
– এখনো এই সাদা শাড়ি থেকে মুক্তি নাও নি তুমি?
-রঙিন সব কিছু যখন ফিকে হয়ে আছে আমার জীবনে তাহলে এই সাদা শাড়ি থেকে মুক্তি নেই কি করে।
-যেই লোকটির সঙ্গে তোমার বিয়ে হয় নি তারই নামে সাদা শাড়ি পরে স্বামীব্রত পালন করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।
-তাকে আমি এখনো প্রচুর পরিমানে ভালোবাসি রে। সে তো আমাকে ধোকা দেয় নি। তুই তখন নোভাদের কাছে আমেরিকায়। বরযাত্রী রওনা হয়েছিলো কিন্তু আমাকে আর বৌ বানিয়ে নিয়ে যেতে পারে নি। পথিমধ্যে গাড়ি এক্সিডেন্টে আহান ও তার বাবা মারা যায়। আর বাকি যারা ছিলো তারা হসপিটালে ভর্তি হয়।
আবারও পুরনো স্মৃতি মনের দৃশ্যপটে ভেসে উঠেছে হিয়ার চোখে। চোখের নোনাজলে ওর গালদুটো ভিজে যায়।
-আহান আমাকে ধোকা দেয় নি সে মারা গেছে। আর আহানের বিধবা সেজে থাকাটাও আমার অনেক ভাগ্যের
বুঝেছিস অভিক।
এখন তুই যা আমি এখন অনেক ক্লান্ত ঘুমাবো। সকালে আবার হসপিটালে যেতে হবে।
অভিক কফির মগ দুটো হাতে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
অভিকের যাওয়ার পর হিয়া উঠে দরজা লক করে চলে আসে বারান্দায়। এই বারান্দায় বসে কতশত রাত আহানের সাথে মোবাইলে কথা বলে কাটিয়েছে। সেই সব দিন গুলো যেন আজ স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছে।
-আহান, তোমাকে ছাড়া আমি এই পৃথিবীতে হাঁপিয়ে উঠেছি। সবাই বলে কেন আমি এই সাদা শাড়ি থেকে মুক্তি নেই না। তাদেরকে কি ভাবে বুঝাবো এই সাদা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে রেখেছি মানেই আমার আহানকে আমার জীবনের সাথে জরিয়ে রেখেছি। যেখানে আর অন্যকেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
বারান্দায় কিছু সময় কাটিয়ে রুমে এসে ঘুমের ঔষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো হিয়া;অপেক্ষা দুচোখে ঘুম নামার।
————
অন্যদিকে,
হিয়া তোমার অপেক্ষা করছি আজ বহুদিন ধরে।
যেদিন সঠিক সময় চলে আসবে সেদিন আমার পাহাড়সম ভালোবাসা নিয়ে তোমার আঙিনায় যাবো। ততদিন নাহয় একটু কষ্টই পেলে।তোমায় আমি অনেক ভালোবাসি হিয়া পাখি।
বলেই হাতে থাকা হিয়ার ছবিতে চুমু খেলো।
কে এই আগন্তুক যে কি না হিয়াকে ভালোবাসে?
——–
খুব ভোরে আজ ঘুম ভেঙে গেলো ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নামায পরলাম। নিচে এসে রান্নাঘরে গিয়ে আব্বুর জন্য সবজির স্যুপ রান্না করলাম। কারণ, আব্বু এখন কোনোপ্রকার ভারি খাবার খেতে পারবে না। আর আম্মুর জন্য করলা ভাজি, চিকেন কারি রান্না করে টিফিনবক্সে ভরে রাখলাম। রুমে এসে তৈরি হয়ে বেড়িয়ে পরলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্য।
রিকশা এসে থামলো হাসপাতালের সামনে ভাড়া মিটিয়ে চলে এলাম আব্বুর কেবিনে।দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম আব্বু ঘুমিয়ে আছে আর আম্মু চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমি টিফিনবক্সটি রেকে আম্মুকে আস্তে করে ডাক দিলাম। আম্মু ঘুম থেকে জেগেই আমাকে দেখে আস্তে করে বললো,
-হিয়া তুই এত সকালে কেন হাসপিটালে চলে এলি? আর তুই নিশ্চয়ই রান্না করে নিয়ে এসেছিস (টিফিন বক্স দেখিয়ে)।
-আম্মু তোমাদের ছাড়া ভালো লাগছিলো না।
তাই চলে এলাম। আর বাইরের খাবার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। তাই একটু রান্না করে নিয়ে আসলাম।
এখন যাও মুখহাত ধুয়ে এসো আব্বু ঘুম থেকে উঠলেই আমরা আজ একসাথে খাবার খাবো
কতদিন আমরা একসাথে খাই না তাই না আম্মু?
আম্মু দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আস্তে করে হু বললো।
কে যেন হঠাৎ করে দরজা খুলে হুড়মুড় করে ভিতরে দৌড়ে এলো। আম্মু আর আমি কি রিয়েকশন দিবো বুঝতে পারছি না তবে যে এসেছে সে বোধহয় কুকুরের ধাওয়া খেয়ে দৌড়ে এসেছে এখানে!
#সুপ্ত_ভালোবাসা
#সূচনা_পর্ব
#Tahmina_Akther