সুপ্ত ভালোবাসা পর্ব ৩৩+৩৪

#সুপ্ত_ভালোবাসা
#পর্ব_৩৩
#Tahmina_Akther

-ছোট আব্বু, তুমিই বলো আজ ছ’মাস ধরে সে আমেরিকায় পরে আছে।বলেছে ফুপি সুস্থ হলে চলে আসবে। এখন তো ফুপি সুস্থ তাহলে সে আসে না কেন? আজ দশটা দিন ধরে সে না আমার কাছে কল করেছে না আমি কল দিলে রিসিভ করেছে।
কান্না করছে আর নাক টেনে টেনে কথাগুলো বলছে হিয়া।

-কিন্তু, আমাদের সাথে তো দু’দিন আগেও কথা হলো। কিন্তু, তোর সাথে এতদিন ধরে যোগাযোগ করছে না এই ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে রে মা। অভিক তো এমন নয়!

-তোমাদের অভিক বদলে গিয়েছে। হয়তো তার মনেও নেই হিয়া নামক একটা মানুষ তার জীবনে আছে।তুমি জানো তোমার ছেলে সেখানে যাবার পর কি কান্ড ঘটিয়েছে?

এবার অভিকের মা মুখ খুললেন,

-ও আবার কি করেছে? কিছু করলে তো নোভা বা নিঝুম আমাদের জানাতো।

-কি করে নি সেটা দেখো।

বলেই হিয়া ওর মোবাইল থেকে গ্যালারিতে যেয়ে ছবি বের করে ওর শ্বাশুড়ি দিকে এগিয়ে দিলো।
অভিকের মা মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলেন অভিকের গালে একটি মেয়ে চুমু দিচ্ছে।

তিনি এই ছবি দেখে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলেন। মানে অভিক ওই দেশে যেয়ে এরকম করে বেড়াচ্ছে!

অভিকের মা’কে চুপ থাকতে দেখে হিয়ার মা এগিয়ে এসে উনার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে ছবিটি দেখলেন। এরপর, মোবাইল দিলেন উনার স্বামীর হাতে। সর্বশেষ, ছবিটি দেখলেন অভিকের বাবা। রাগে উনার শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো।রাগ সামলে হিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,

-তোকে এই ছবি কে পাঠিয়েছে?

-নোভা কাল রাতে আমার মেসেঞ্জারে দিয়েছে। যদি অন্য কেউ দিতো তাও বিশ্বাস করতাম না কিন্তু নোভা যখন এই ছবি দিয়েছে তারমানে ব্যাপারটা বড় ধরনের ছোট আব্বু। এখন তুমি বলো আমি কি করবো? অভিক কি ভাবে পারলো আমার সাথে বেঈমানী করতে!

হু হু করে কেঁদে উঠলো হিয়া। পরিবারের প্রত্যকেটি সদস্য যেন বাকহারা হয়ে আছে। কি বলে স্বান্তনা দিবে হিয়াকে?

অভিকের বাবা উঠে দাঁড়ালেন এরপর হিয়া সহ সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-বাড়ির সবাই অভিকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো।যদি ওর সাথে কারো যোগাযোগ হয় তবে আমাকে জানাবে। আমি ওর মুখ থেকে শুনতে চাই ও কেন এমনটা করলো হিয়ার সাথে?

দ্রুতগতিতে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন অভিকের বাবা। উনার পিছু পিছু অভিকের মা এবং অরিন চলে গেলো।বাকি রইলো হিয়ার বাবা-মা। মেয়ের চোখের পানি যেন তাদের হৃদয়কে রক্তাক্ত করে ফেলছে।

হিয়ার বাবা মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই চোখ তুলে তাকালো হিয়া। বাবাকে দেখে যেন কান্না আরো বেড়ে গেলো। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

-মা রে আমরা হয়তো তোর চোখের পানি দেখে কষ্ট পাচ্ছি কিন্তু তোর মনে যে আঘাত লেগেছে তা আমরা কখনোই অনুভব করতে পারবো না। তবুও বলবো মা’রে অভিক এমন ছেলে নয়। সে তোকে পাবার জন্য কি করেছে আমরা সকলেই জানি। তাই বলছি কি ওর সাথে যোগাযোগ করে না হয় ব্যাপারটা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করি। তুই কাঁদিস না মা তোর শরীরটা এমনিতেই ভালো যাচ্ছে না এখন যদি এভাবে কাঁদিস তাহলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বি।
আর কাঁদিস না চল আব্বুর সাথে কিছু খেয়ে নে। তোর আম্মু আজকে সব তোর পছন্দের খাবার তৈরি করেছে।

মেয়ের চোখের পানি মুছিয়ে কথাগুলো বললেন ইসমাঈল জামান৷ হিয়ার মা মেয়েকে কি বলে স্বান্তনা দিবেন বুঝতে পারছেন না। মেয়ের কান্না দেখে উনার বুক ফেঁটে কান্না আসছে। কিন্তু, মেয়ের সামনে উনি কাঁদবেন না নয়তো মেয়ে যে আরো ভেঙে পড়বে।

——————

হিয়া তার মায়ের হাতে অল্প ভাত খেলো। এই অল্প ভাত খেতে গিয়ে যেন বারবার গলায় আঁটকে আসছিলো।পানি দিয়ে কোনোভাবে খাবার গিলে নিজের রুমে চলে এলো।

রুমে আসতে আবারও চোখের নোনা পানি বেরিয়ে গাল ভিজে যাচ্ছিলো।এই তো কিছুদিন আগেও অভিকের সাথে কথা বলার একফাঁকে হিয়া বলেছিলো,

-ফুপি তো এখন সুস্থ হচ্ছে। তুমি কিন্তু আর দেরি করো না দেশে ফিরতে। চলে এসো জানো তো তোমায় ছাড়া একটা দিনও ভালো লাগে না। একটা দিন পুরো সময় মিলিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা। আগে এই সময় চোখের পলকে চলে যেতো।আর তুমি যাবার পর এই চব্বিশ ঘণ্টা চব্বিশ দিন মনে হয়।

-আরে বোকা আমারও তোমাকে ছাড়া ভালো লাগছে না। এই তো আর কিছুটা দিন এরপর কখনো তোমায় ছেড়ে আর কোথাও যাবো না।

-অভিক?

-হুম, বলো বৌ’টা

-দোয়া করি তুমি যেন জলদি দেশে ফিরে আসতে পারো আর তোমার জন্য একটি সারপ্রাইজ আছে।

-কি সারপ্রাইজ?

-যদি বলে দেই তাহলে সারপ্রাইজ হলো কি ভাবে! আগে এসো তুমি।

পুরনো স্মৃতিচারণে শেষে হিয়া চোখের পানি মুছে বলছে,

-কেন এমনটা করলে অভিক? আমি তো বেশ ছিলাম আমার একাকীত্বের বেদনায়।কেন তুমি আমার জীবনে এসে আমার বদ অভ্যেস হলে?যদি আমারই না ছিলে তবে কেন এত প্রেম,ভালোবাসা আমায় দেখালে।আমার সাথে কেন এমনটা হয় বলতে পারবে কেউ? আহান চলে গেলো আমায় ছেড়ে। যখন সব ভুলে তোমার হাত আঁকড়ে ধরলাম তখন তুমি মাঝপথে এসে আমার হাত ছেড়ে দিলে।কি এমন অপরাধে আজ আমি একাকীত্বের অনূভুতিতে জর্জরিত!

বারবার কথাগুলো বলছিলো আর কান্না করছে এরইমাঝে কখন যে হিয়া ঘুমিয়ে পড়লো!

———————

রাত তখন অনেক গভীর। হিয়া বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। কে যেন আস্তে করে রুমের দরজা খুলে প্রবেশ করলো।শব্দহীন পায়ে হেটে হিয়ার শিয়রে এসে দাঁড়ালো। এরপর,ঝুঁকে গেলো হিয়ার মুখের সামনে।

রুমে কারো উপস্থিতি পেয়ে আমার ঘুম ভেঙে যায় চোখ মেলে তাকাতেই আমার সারা শরীরে হীম শীতল স্রোত বয়ে গেলো।
কে এতরাতে আমার ঘরে আসব?চোর নয়তো নাকি ডাকাত? এরইমাঝে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো সেই আগুন্তক।হায় আল্লাহ, আমার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করবে না তো!
আমার মুখের উপর ঝুঁকতেই আমি মনে মনে সাহস জুগিয়ে চোখ বন্ধ করে দিলাম এক চিৎকার।
আরেকটা চিৎকার দিবো তার আগেই আমার মুখ চেপে ধরলো সেই আগুন্তক।আমি উুঁ উুৃ করতে লাগলাম ছাড়া পেতে কারণ আমার দম আঁটকে আসছিলো।

দরজা জোরে জোরে বারি মারছে আর আর আমাকে ডাকছে আব্বু, চাচ্চু সহ সবাই। এরইমাঝে আগুন্তক আমার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলছে,

– দিলে তো আমার সব প্লান নষ্ট করে। এই যে ছেড়ে দিচ্ছি আর একটাও চিৎকার দিবে না। বাবারে তোমার চিৎকারে পুরো কানের বারোটা বেজে গেছে আমার। একটুও নড়বে বসে থাকো আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।

আমাকে বসিয়ে দিয়ে সে চলে গেলো দরজা খুলতে আর আমি থম মেরে বসে আছি। সে চিরচেনা কন্ঠের মালিক তবে এলো আমার কাছে। চোখের পানিগুলো যেন শত্রু আমার যখন তখন বের হয়ে আসছে।

দরজা খোলার পর হিয়ার রুমে সবাই ঢুকার জন্য পা বাড়াতেই একজনকে দেখে সকলে হতবিহ্বল হয়ে একবার হিয়ার দিকে আরেকবার অভিকের দিকে তাকাচ্ছে।

অভিকের বাবা এগিয়ে এসে সপাটে থাপ্পড় মেরে দিলো অভিকের গালে।
উপস্থিত সকলে আরো একবার হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। কারণ, অভিকের বাবা কখনোই অভিকের গায়ে হাত তুলে নি।

অভিক আচমকা ওর বাবার এরকম আচরণে বেশ অবাক হলো।লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেলো ওর কারণ সেখানে হিয়ার বাবা-মাও উপস্থিত।

-তুমি আমেরিকায় গিয়েছিলে কেন? তোমার ফুপি অসুস্থ তোমার ভাই সব সামলাতে পারছে না তাকে তুমি হেল্প করতে সেখানে গিয়েছো।কিন্তু, ওখানে যাবার পর কি তুমি ভুলে গেছো যে, বাংলাদেশে তোমার স্ত্রী আছে যাকে তুমি সমাজের নিয়মের বাইরে গিয়ে বিয়ে করছো?কি ভাবে পারলে হিয়াকে ভুলে অন্য নারীকে? ছিহহ আমার বলতেও লজ্জা লাগছে।
কে এই মেয়ে যার জন্য তুমি হিয়ার সাথে বেঈমানি করেছো?
বেশ চিল্লিয়ে কথাগুলো বললেন অভিকের বাবা।

অভিক তার বাবার একটি কথাও বুঝতে পারছে না। কি বলছে ওর বাবা? আবার এখানে কোন নারীর কথা বলছে?না তাকে জানতে হবে কোন নারী কথা শুনে তার বাবা এভাবে ক্ষেপেছে?

-তুমি কার কথা বলছো বাবা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

-এত কান্ড করে এখন বলছো বুঝতে পারছো না তাই না! এই যে এই মেয়ে কে যার সাথে তুমি এত ঘনিষ্ঠ হয়ে ছবি তুলেছো?

ছবিটি দেখে অভিক বোকা বনে গেলো। এই কাজটা করলো কে? কে পাঠালো এই ছবি তার পরিবারের কাছে?

-বাবা, এই ছবিটি কে পাঠিয়েছে?

-নোভা গতকাল রাতে আমার মেসেঞ্জারের দিয়েছে। নিশ্চয়ই নোভা আমাদের মিথ্যে কিছু দেখায় নি?
পিছন থেকে হিয়া অভিককে উদ্দশ্যে করে বললো।

-নোভা তোমাকে এবং সবাইকে মিথ্যে কিছু দেখিয়েছে।আমি প্রমান করতে পারবো এই নারীর সাথে আমার কোনো খারাপ সম্পর্ক নেই।

-তাহলে করো প্রমান আমরাও দেখি তুমি কতটা নির্দোষ?

অভিক অবাক হয়ে তার ফুলের দিকে তাকালো। তার ফুল তাকে এতটা অবিশ্বাস করে!দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিঝুমকে কল করলো।

দু’বার রিং হতেই কল রিসিভ করলো নিঝুম। অভিক বললো,

-হ্যালো নিঝুম ভাইয়া। বাসায় আছো?

-হ্যা বাসায় আছি। তুই কি পৌঁছে গেছিস?

-হ্যা, পৌঁছালাম মাত্র।নোভা কোথায় ওকে একটু দাও তো কথা আছে?

নিঝুম কয়েকবার ডাক দিতেই নোভা এসে মোবাইলটা কানে ধরলো।

-হ্যালো, হ্যা অভিক। কখন গেলি?

-এই তো একটু আগে। তুই গতকাল কার ছবি দিয়েছিস ফুলের কাছে?

-তাহলে ধামাকা হয়ে গেছে।

-কিসের ধামাকা বলছিস তুই? যার সাথে আমার ছবি সে কিভাবে আমার সাথে ছবি তুলেছে তোর থেকে ভালো কে জানে? আর তুই কি না এরকমটা করতে পারলি আমার সাথে?

-তুই ঠিক কি কি করেছিস আমার সাথে ছোটবেলায় মনে আছে? আমার সব প্লানিং তুই নষ্ট করতি? তাই এবার আমি তোর সাথে এমনটা করলাম। ব্যস হিসাব সমান সমান।
আমি ভিডিও কল দিচ্ছি হিয়াকে বল তোর সাথে থাকতে।

এতক্ষণ, সবাই নোভা আর অভিকের কথা শুনেছে। আর এতক্ষণে ক্লিয়ার হলো অভিকের সাথে ওই নারীর খারাপ কোনো সম্পর্ক নেই।

নোভা ভিডিও কল দিতেই হিয়া কল রিসিভ করলো।কল রিসিভ করতেই মোবাইল স্ক্রীনে এক নারীকে দেখা যাচ্ছে যে। আরেহ এ তো ছবিতে অভিকের সাথে থাকা নারী। হিয়া তৎক্ষনাৎ নোভাকে বললো,

-কে উনি? তোদের বাড়িতে কি করছে?

-আরে উনি তো ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড। যার সাথে একবার ব্রেকআপ হয়েছিলো।উনাদের আবারও পেচ আপ হয়েছে।আম্মু সুস্থ হলে উনাদের বিয়ে হবে।

-কিন্তু তুই না আমায় ছবি দিয়ে বললি, অভিকের সাথে উনার গভীর সম্পর্ক আছে?আর ছবিতে এত ঘনিষ্ঠ কেন ওরা?

-আরে বোকা, জেনিফার ভাবি অভিকের সাথে মজা করছিলো আর এমন টাইমে আমি ছবিটা ক্লিক করেছিলাম।যখন শুনলাম অভিক দেশে যাবে কিন্তু তোদের বলবে না মানে সারপ্রাইজ দিবে আর তোর থেকেও শুনলাম অভিকের সাথে কয়েকদিন যোগাযোগ হচ্ছে না ঠিকমতো। তখন এই ছবিটা তোকে দিয়েছি যেন অভিকের সারপ্রাইজ প্ল্যান ফ্লপ হয় আর সবার কাছে বকা খায় বুঝলি।
আর তুই তো জানিস না তোর জামাইটা আমাকে ছোট থাকতে আমেরিকায় এসে বহু জ্বালান জ্বালাইছে।তাই এবার প্রতিশোধ নিলাম।

ফট করে হিয়ার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিলো অভিকের বাবা। এরপর নোভাকে বললেন,

-তোমার ষ্টুপিডিটির জন্য আজ কি হয়েছে এখানে তোমার ধারণাও নেই। তোমার এই কাজে আমি বেশ কষ্ট পেয়েছি। তোমার মা সবসময়ই তোমাদের ভুল শিক্ষা দিয়েছে। নয়তো এরকম একটা সেনসেটিভ বিষয়ে কেউ এরকম মজা করতে পারে না।

নোভাও বেশ লজ্জা পেলো ওর ছোট মামার মুখ থেকে কথাগুলো শুনে। আসলে সে বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা এমব ঘোলাটে হয়ে যাবে।

বাড়ির সবাই অনুতপ্ত অভিককে ভুল বুঝার জন্য বিশেষ করে অভিকের বাবা আর হিয়া।

ছেলের কাছে গিয়ে রোকন জামান বললেন,

-আব্বু, বুঝতে পারিনি আসলে ছবিতে?

-থাক বাবা, আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি মনে কষ্ট নিও না। আমি ঠিক আছি। তোমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ো অনেক রাত হয়েছে। সকালে কথা হবে।

একে একে সকলে রুম থেকে চলে গেলো। অভিক দরজা লক করে বেডসাইড টেবিলে রাখা এক গ্লাস
পানি খেয়ে নিলো।

এরপর, হিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে শুয়ে পড়লো সোফায়।হিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-হিয়া, লাইট অফ করে দাও। আমি ভীষণ ক্লান্ত উনিশ ঘন্টার ফ্লাইট জার্নিতে।

হিয়া আর কোনা কথা না বলে লাইট অফ করে দিলো।
অভিকের মুখ থেকে এই প্রথম হিয়া ডাক শুনে ভীষণ কষ্টে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো হিয়ার।

কখনোই অভিক তাকে হিয়া নামে ডাকে নি ফুল বলে ডেকেছে। তবে আজ কি অভিক অনেক কষ্ট পেয়েছে তাকে ভুল বোঝার জন্য !
#সুপ্ত_ভালোবাসা
#পর্ব_৩৪
#Tahmina_Akther

হঠাৎ করেই শরীর কেমন যেন ভার হয়ে এলো।মনে হলো কেউ আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হুট করে চোখে খুলে তাকালাম না, কেউ তাকিয়ে নেই আমার দিকে।
সোফায় নজর গেলো, অভিক শুয়ে আছে উপুড় হয়ে।

তাহলে মহাশয় আমার দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো যেই না আমি চোখ খুললাম ওমনি তিনি সুবোধ বালকের ন্যায় ঘুমানোর ভান ধরে পড়ে রইলেন।

মুচকি হেঁসে এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে ধীরে খাট থেকে নেমে এলাম। জানালা কাছে গিয়ে পর্দা টেনে দিতেই দিনের প্রথম প্রহরের এক ফালি রোদ্দুর ছেঁয়ে গেলো পুরো রুম জুড়ে। বিছানা গুছিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।

হিয়া ওয়াশরুমে ঢুকতেই অভিক উঠে বসলো।উফফ, আরেকটু হলে ধরা পড়ে যেতাম।
নোভার বাচ্চা শুধুমাত্র তোর জন্য আজ আমার এই অবস্থা। ছয় মাস আমার বৌ’টাকে দেখি না এখন দেশে এসে তোর ষড়যন্ত্রের রোষানলে পড়ে আমার মিষ্টি বৌয়ের সঙ্গে রাগ করে বসে আছি।কিন্তু, রাগ করে কি লাভ হলো আমার বৌ’টা তো একবারও আমার রাগ ভাঙাতে এলো না।

মনে মনে কথাগুলো বলছে আর আফসোস করছে অভিক।

এরইমাঝে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো হিয়া। সোফায় বসে থাকা অভিকের দিকে এক পলক তাকিয়ে রুমে থেকে বেরিয়ে গেলো।

অভিক হিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো কারন ওর গোসলের প্রয়োজন।

———————-

রান্নাঘরে আজ হরেক পদের খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে। কারণ বাড়ির ছেলে আজ কতদিন পর ফিরে এলো।রান্নাঘরের দরজা সামনে দাঁড়িয়ে হিয়া তার মা আর শ্বাশুড়ি দিকে তাকিয়ে আছে। কি যে তাড়াহুড়ো করে সব কিছু করছে তারা!

-ছোট আম্মু?

হিয়ার ডাক শুনে অভিকের মা ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,

-কি রে মা কিছু লাগবে? আর অভিক ঘুম থেকে উঠেছে?

-না আমার কিছু লাগবে না। আর মহাশয় ঘুম থেকে জেগেছে আমার আগে। কিন্তু কেন যেন ঘুমের ভান ধরে পড়ে আছে?

হিয়ার শেষের কথাগুলো শুনে হিয়ার মা এবং শাশুড়ী হেঁসে ফেললেন।

-আমি কি এমন কথা বললাম যে এভাবে হাঁসছো তোমরা? হাসি থামিয়ে বলো, কি কাজ করবো?

-না থাক তোর কিছু করা লাগবে না। তুই এইগুলো
খেয়ে শেষ কর তাহলে আমাদের কাজ হয়ে যাবে।

হিয়ার দিকে আঙুরের প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললো হিয়ার মা। হিয়া প্রথমে না করলেও পরে
উনাদের জোড়াজুড়িতে খেতে বাধ্য হলো।কিছু আঙুর খাওয়া হলে হিয়া প্লেট নিয়ে ড্রইংরুমে চলে আসে। এসে দেখে আগে থেকেই সেখানে অভিক আর সাদাফ বসে কি যেন ফুসুরফাসুর করছে। হিয়া আর ওখানে না বসে রুমে চলে গেলো।

এইদিকে,

অভিক সাদাফের সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে হিয়ার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলো।হিয়া এই ছয়মাসে বেশ পরিবর্তন হয়েছে গাল দুটো আগের থেকে বেশ ফোলা ফোলা, চোখ দুটো আগের থেকে আরো নজরকারা হয়েছে,আগের থেকে স্বাস্থ্য একটু উন্নত হয়েছে,চুলগুলো কোমড় ছাড়িয়ে গেছে।

হিয়া চলে যেতেই অভিক সাদাফকে বললো,

-এই তুই না বলেছিস তোর বোন আমার বিরহে কেঁদে সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকতো!এখন তো দেখছি সে দিব্যি ভালো আছে। আগের থেকে তোর বোন আরো সুন্দরী হয়ে গেছে।

-ভাইয়া শোনো আমার আপু আগে থেকেই সুন্দর বুঝলে।তোমার তো কপাল ভালো আমার বোনের মতো আলাভোলা বৌ পেয়েছো নয়তো অন্য কেউ হলে তোমার আর জেনিফারের কিসিং মোমেন্ট না ডেথ মোমেন্ট বানিয়ে ফেলতো।

-ভাই তোদের বললে তো বিশ্বাস করবি না। ওই নিঝুমের ফিয়ন্সে ওর মতোই হ্যাংলা টাইপ। কথা বলার ফাঁকে শরীরের উপর ঢলে পড়ে। একদিন আমি বসে ছিলাম গার্ডেনে আর ওমনি কোত্থেকে এসে আমার হামলে পড়ে গালে ইয়ে দিয়ে বসলো।আর নোভার বাচ্চা সেটার পিক তুলে ফুলের কাছে পাঠিয়ে দিলো।সব ওই নোভার বাচ্চার ষড়যন্ত্র তোর বোনের সাথে আমার ঝগড়া বাঁধানোর।এখন দেখ এতদিন পর এলাম তোর বোন একটি বার আমায় জিজ্ঞেসও করলো না আমি কেমন আছি?

-তুই জিজ্ঞেস করেছিস ও কেমন আছে?যে কর্ম করেছিস ও এখন তোর সাথে যে ব্যবহার করছে তা স্বাভাবিক।

রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে কথাগুলো বললেন অভিকের মা।

-মা, বাইরের কান্ট্রির লোকেরা এইসব ব্যাপারকে খোলামেলা ভাবে দেখে। তারপরও, সেদিন জেনিফারের ওরকম বিহেবিয়ারের পর ওর সাথে আমার বেশ বড় ধরনের ঝগড়া হয়েছে।পরে নিঝুম ভাইয়া এই ব্যাপারটাকে সামলেছে।

-সবই বুঝলাম। কিন্তু, তোর ফুলকে মানাবি কিভাবে? ও কিন্তু অনেক কষ্ট পেয়েছে গত পরশু রাত থেকে ওর কান্না শুরু হয়েছে আর থেমেছে তুই আসার পরে ।

-ও তো বেশি বুঝে। ও কি জানে না ওর অভিক ওকে ছাড়া আর দ্বিতীয় কাউকে চায় না। আর সে আমাকে ছাড়া ভাল আছে। একা একাই খেয়ে নিচ্ছে আমি নামক একটা মানুষ যে এতদিন পর এলাম কি করছি? কি খাচ্ছি?কোনো খবর রাখছে সে?
অভিমানী কন্ঠে কথাগুলো বলছে অভিক।

ছেলের অভিযোগ শুনে মিটিমিটি হাসছেন অভিকের মা।

-অভিক একটা কথা শুনবি?

-হুম বলো, মা।

——————-

ইদানিং সকালের প্রথম মিষ্টি রোদ গায়ে লাগলে বেশ আরাম অনুভূত হয় হিয়ার। বারান্দায় পাতানো চেয়ারে বসে বসে আঙুর খাচ্ছে আর অভিকের কথা ভাবছে।

-কি ভাবে পারলো সে তার গালে পেতে দিতে ওই জেনিফারের সামনে!এখন আবার রাগ দেখানো হচ্ছে আমার সাথে সে থাকুক তার রাগ নিয়ে।

হিয়া যখন ভাবনার সাগরে ডুবে ডুবে অভিযোগ করছিলো অভিকের ঠিক তখনি ওর পাশের চেয়ারটায় কে যেন ধপ করে বসে পড়লো।হিয়া ভয়ে পেয়ে লাফিয়ে উঠলো।

-কি হয়েছে? ভয় পেয়েছো?

-ভয় পাবো না তো কি করবো। এভাবে কেউ হুট করে চলে আসে!

-আসবো না তো কি করবো।তুমি কি ভাবে পারলে আমার থেকে এত বড় কথা লুকিয়ে রাখতে,ফুল?

বলেই হিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো অভিক। এরপর, ওর পেটে চুমু দিলো অনেক সময় নিয়ে। কিছু মনে পড়তেই হিয়া হেসে ফেললো অভিকের কান্ড দেখে। অভিক উঠে দাঁড়ানোর আগে মুখটাকে আবারও গম্ভীর করে ফেললো।

অভিক উঠে দাঁড়িয়ে হিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো পলকহীন চোখে।হিয়া এক কি দু’বার অভিকের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। কারন,ওই চোখে যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না!চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

কপালে ভেজা কিছু টের পেতেই হিয়া চোখ তুলে তাকালো। অভিক ওর কপালে চুমু দিয়ে জরিয়ে ধরলো বেশ শক্ত করে।
এই জড়িয়ে ধরাতে কি যেন আছে! এতদিনের সব জমানো রাগ, অভিমানের বরফ গলে শীতল পানিতে পরিণত হয়ে গেছে।

-পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের অনুভূতি কি জানো?কেউ একজন আমাদের শরীরের একাংশ হয়ে এই পৃথিবীতে আসবে তার আগমণ বার্তা জানা। তার আগমনে যে আমাদের নতুন করে জন্ম হবে কারণ আমরা মা-বাবা হবো যে।
তুমি কেন জানাও নি আমায় ফুল আমি বাবা হবো?মায়ের কাছ থেকে এই মাত্র আমি জানলাম। এই দেখো খুশিতে আমার সারা শরীর কিভাবে কাঁপছে?

হিয়া দেখলো আসলেই অভিকের সারা শরীর কাঁপছে।

-আমি চেয়েছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে। কিন্তু গতকালের ইন্সিডেন্টে সব নষ্ট হয়ে গেলো।

মন খারাপের সুরে বললো হিয়া।

-এত বড় সারপ্রাইজ আমি নিতে পারছি না।আমি বাবা হবো ও মাই গড। ইট’স আনবিলিভএভেল!
কবে আসবে আমার পাখিটা আমার তো আর সহ্য হচ্ছে না?
হিয়াকে ঘুরিয়ে ওর পিঠ অভিকের বুকে লাগিয়ে নিলো। এরপর, ওর পেটে হাত রেখে, কাঁধে মুখ গুজে বললো অভিক।

-সে আসবে আরো তিন মাস পর।

-তারমানে তুমি সিক্স মান্থ প্রেগনেন্ট রাইট!
অভিক অবাক সুরে বলে উঠলো।

হিয়া মাথা নাড়িয়ে হু বললো।

-এইজন্যই তো আমি বলছিলাম, তোমাকে আগের থেকে এত মোটা মোটা লাগছে কেন?এদিকে যে আমার পাখিটা এখানে ঘাপটি মেরে আছে কে জানতো!
ফুল আজ এত খুশি খুশি লাগছে কেন আমার বলতে পারো?

#চলবে
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here