#স্মৃতিতে_তোমার_বন্দনা
#পর্ব_৮
#Saji_Afroz
.
.
বেশকয়েকদিন কেটে গেলো ।
রাফসানের বদলির দিন চলে আসলো । সে ছোঁয়াদের সাথে দেখা করতে এসেছে ।
আফিয়া জান্নাতের চোখে পানি দেখে রাফসান বললো-
বাড়িতে মা আর এখানে আপনি! এমন করলে আমি কিভাবে যাবো? তাছাড়া আমি বাইরে কোথাও যাচ্ছিনা । এখানেই আছি ।
-তা জানি । কিন্তু….
-আমার মা বাবা আপনাদের খেয়াল রাখবেন । আমার ছোট বোনকে বলেছি । ও মাঝেমধ্যে দেখতে আসবে । আমিও আসবো ছুটি পেলেই । চিন্তার কোনো কারণ নেই ।
-বদলে যাবেনা তো তুমি?
-বদলি হচ্ছে বলে বদলে যাবো কেনো? কি যে বলেন না!
.
আফিয়া জান্নাতকে জড়িয়ে ধরলেন রাফসান ।
তাকে বিদায় জানিয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখলো, নয়নতারাও কাঁদছে । ছোঁয়া তার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ।
রাফসান বললো-
নয়নতারা তুমিও!
.
চোখ মুছতে মুছতে সে বললো-
ইচ্ছে করে কাঁদছি নাকি?
-আমি আশা করেছিলাম, ছোঁয়া কাঁদবে আমার জন্য ।
.
ছোঁয়া মুখটা বাকালেও ফিক করে হেসে ফেললো নয়নতারা ।
রাফসান বললো-
এভাবে হাসবে সবসময় । আর তোমার কাধে তো সবার দায়িত্ব । ওদের খেয়াল রাখবে। যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে জানাবে ।
-হুম ।
-আমি কি ছোঁয়ার সাথে একটু একা কথা বলতে পারি?
.
নয়নতারা ভেতরে চলে গেলে রাফসান বললো-
তুমি জানো ছোঁয়া? তুমি ভীষণ দুষ্টু একটা মেয়ে?
.
মুখটা গোমড়া করে থাকলো ছোঁয়া । রাফসান বললো-
কোনো দুষ্টুমি করবেনা ।
আর কোনো ছেলেকে প্রশ্রয় দিবেনা ।
-আমি দুষ্টু নয়! আমি কি বাচ্চা? তাছাড়া কাউকে প্রশ্রয় দিইনা আমি ।
-দুষ্টুমি করতে বাচ্চা হবার প্রয়োজন নেই! যেকোনো বয়সেই করা যায় ।
নিজের খেয়াল রেখো । আসি ।
.
রাফসান চলে যাচ্ছে । দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তার পথের দিকে তাকিয়ে আছে নয়নতারা । মনেহচ্ছে, অনেক দূরে চলে যাচ্ছে রাফসান….
.
.
এদিকে ছোঁয়ার কোনো খবর পেলোনা পরশ । সারাক্ষণ মাথায় যেনো ছোঁয়ার নামই ঘুরতে থাকে । কতোবার মনকে বুঝিয়েছে, ছোঁয়াকে ভুলে যাওয়া উচিত । তবুও সে পারছেনা ।
আর ভাবতে পারছেনা
সে ।
সময় কাটানোর জন্য মায়ের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো । গল্প করে যদি কিছু সময় কাটানো যায়!
মায়ের রুমে এসে দেখলো, তার চোখে পানি! পরশ অবাক হয়ে বললো-
তোমার চোখে পানি কেনো?
-ফারুকের কথা মনে পড়ছে । অনেকদিন ফোন দেয়না । এভাবে ভুলে গেলো আমাদের!
.
মায়ের পাশে বসে পরশ বললো-
ভুলেনি । ভাইয়া ব্যস্ত হয়তো ।
-তোরা শুধু তোদের গুলোই বুঝিস ।
-আমি কি করলাম?
-কি করিসনি? বিয়েটা করলে বউমার সাথে সময় কাটালে, অন্য কিছু মাথায় ঘুরতো আমার?
-সময় হলে করবো ।
-কখন হবে সময়?
-জানাবো আমি ।
-আমি সময় কাটাতে পারি, এমন কাউকে এনে দে ।
-বাবাতো আছেই ।
-তিনি শুধু তার এক্স গফদের গল্প করে আমার সাথে ।
.
কথাটি শুনে হো হো শব্দে হেসে উঠলো পরশ ।
সাফিনা আহম্মেদ বললেন-
মিথ্যে বলিনি ।
-আচ্ছা আমি তোমার জন্য একটা বান্ধবী জোগাড় করতে পারি কিনা দেখি ।
.
সাফিনা আহম্মেদ দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললেন ।
পরশ জানে, তার মায়ের মনে কি চলছে । কিন্তু সে যে ছোঁয়ার জন্য অপেক্ষা করবে । এই অপেক্ষা অনন্তকালও করতে পারে সে!
.
.
দেখতে দেখতে প্রায় এক মাস কেটে গেলো ।
আজ পরশ তার পরিবারের সাথে রেস্টুরেন্টে এসেছে । অবশ্য সাফিনা আহম্মেদের ইচ্ছেতেই সে এখানে এসেছে ।
মা বাবার পাশে বসে আছে পরশ । হালকা কেশে বললো-
অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছি । কফি ছাড়া কিছু অর্ডার করলেনা । কফি ছাড়া যদি কিছু নাই খাও, তবে এখানে এলে কেনো?
.
শফিউল আহম্মেদ বললেন-
কেনো রে? রেস্টুরেন্টে শুধু কফি খাওয়া যায়না?
-বাসায়ও খেতে পারতে ।
-বাসায় কি এমন নেই যা এখানে আছে?
-তোমার সাথে কথায় আমি কোনোদিন পেরেছি?
-বেশ ভালো । নিজেই হার মেনে নিয়েছিস ।
.
সাফিনা আহম্মেদ বললেন-
উফফ, তোমরা থামবে! একটা পাবলিক প্লেসে এসেও এসব…
.
পরশ বললো-
আরে আমি খারাপ কি বললাম? খেতে বলছি সেটাও দোষ?
-নিশ্চয় খাবো । কিছু গেস্ট আসবে আমার । এখন খেলে তাদের সাথে খাবো কিভাবে?
-রেস্টুরেন্টে তোমার গেস্ট?
.
বলতে বলতেই কয়েকজন এগিয়ে আসছে তাদের দিকে ।
সাফিনা আহম্মেদ ও শফিউল আহম্মেদ দাঁড়িয়ে স্বাগত জানালেন তাদের । একজন মধ্যবয়সী মহিলা, একজন পুরুষ ও একজন রূপবতী মেয়ে এসেছে । তারা সকলে বসে পড়লে পরশ মায়ের উদ্দেশ্যে ধীরগলায় বললো-
তোমরা বসো । আমি আসছি ।
-তোকে ছাড়া হবেনা ।
-কি হবেনা?
-এনারা তোর মামার বন্ধুর পরিবার ।
-তো?
-তোর জন্য মেয়েটিকে দেখতে এসেছি আমরা ।
.
কথাটি শুনেই পরশের মুখটা চুপসে গেলো । এই বিষয়ে তাকে কিছু জানানোই হয়নি!
সাফিনা আহম্মেদ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে ফেললেন ।
তিনি জানতেন, পরশকে বললে সে কখনোই আসতে রাজি হতোনা । তার ভাই এর কাছে শুনেছে মেয়েটি অতি সুন্দরী । তাই কৌশলে পরশকে নিয়ে এসেছে । যদি দেখে ভালো লেগে যায় মেয়েটিকে!
.
.
ড্রয়িংরুমের সোফায় পা তুলে বসে আলুর খোসা ছাড়াতে ব্যস্ত ছোঁয়া ।
এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলে উঠতে চায়লো সে । নয়নতারা এসে বললো-
আমি দেখছি ।
.
স্কুলের ছাত্রীর মা এসেছে দেখে নয়নতারা তাকে সমাদরে ভেতরে এনে বসতে বললেন ।
তিনি বললেন-
আমার মেয়ে পড়াশোনায় কেমন ম্যাডাম?
-তানিয়া একটু অঙ্কে দূর্বল । বাকিগুলোতে মোটামুটি ভালোই ।
-আমি চাচ্ছিলাম ও আপনার কাছে আলাদাভাবে প্রাইভেট পরুক । অঙ্কটা করালেই হবে । যদি আপনার অসুবিধে নাহয়…
-আমার অসুবিধে নেই ।
– আলহামদুলিল্লাহ । কখন থেকে পাঠাবো?
-কাল থেকেই পারেন । বাসা যেহেতু কাছেই সন্ধ্যার সময়ে পাঠাতে পারেন ।
-ঠিক আছে । আর টাকার ব্যাপারটা?
-আপনার যা ইচ্ছে দিয়েন ।
.
কিছুক্ষণ পর তিনি চলে যেতেই ছোঁয়া বললো-
আরেকটা টিউশনী পেয়ে গেলে আপু! বাহ ভালো তো ।
-এই স্কুলটা না থাকলে আমাদের কি যে হতো!
.
.
সামনাসামনি বসে আছে পরশ ও নিশি । পরশ ও নিশিকে আলাদাভাবে কথা বলতে দেয়া হয়েছে ।
নিশি মেয়েটা লাজুক স্বভাবের মেয়ে । মাথা নিচু করে বসে আছে সে আসার পর থেকেই । পরশের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছে কিনা সন্দেহ!
পরশ এর আগে এমন পরিস্থিতিতে কখনো পড়েনি । বিয়ের জন্য পাত্রী সে কখনো দেখতে যায়নি । তাই এসব সম্পর্কে অভিজ্ঞতা তার নেই ।
নিশি দেখতে খারাপ নয় । বরং সুন্দরী । কিন্তু পরশ বিয়ে করতে পারেনা । কেননা ছোঁয়াতেই পড়ে আছে তার মন । ভালো না বাসলে বুঝতোই না, ভালোবাসার জন্য শহীদ হবার কাহিনীগুলো মিথ্যে নয়! ভালোবাসার জন্য মানুষ পাগলও হতে পারে ।
নীরবতা ভেঙে পরশ বললো-
আপনি কি জানেন আমরা কেনো দেখা করতে এসেছি?
-হ্যাঁ ।
-বফ আছে আপনার?
.
প্রশ্নটা শুনে খানিকটা অবাকই হলো নিশি । এই পর্যন্ত কয়েকটা পাত্রের সামনেই সে গিয়েছে । কেউ তাকে এমন প্রশ্ন করেনি ।
না সূচকভাবে মাথাটা নাড়লো নিশি ।
পরশ নিজেরমনে বললো-
থাকলে ভালোই হতো ।
এখন কিভাবে তোমার মতো মেয়েকে রিজেক্ট করি!
.
কিছুক্ষণ ভেবে পরশ বললো-
এতো সুন্দরী একটা মেয়ের বফ নেই!
-কেনো? আপনার গফ আছে?
-এই প্রশ্ন?
-আপনিও কম সুন্দর নয়!
-তার মানে আপনি আমাকে দেখেছেন?
-আমি অন্ধ নই ।
-তাহলে মাথাটা তুলতে পারেন । লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই । আমি আপনাকে বিয়ে করবোনা ।
.
পরশের কথাটি শোনামাত্র তার দিকে তাকালো নিশি ।
পরশ বললো-
আসলে দোষটা আপনার নয় । আমার! আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি ।
-তাহলে এখানে এসেছেন কেনো? আপনি মেয়ে নন যে জোর করে আপনাকে আনা হবে!
-জোর করেনি । তবে বলেওনি ।
-বুঝলাম না ঠিক ।
-আসলে ক্যারিয়ার গোছানোর জন্য বিয়েটা এতোদিন করিনি আমি । মোটামুটি সব দিক যখন গুছিয়েছি লাইফের, মা জোরাজোরি করেন বিয়ের জন্য । আমিও বিষয়টা নিয়ে ভাববো চিন্তা করেছি । কিন্তু মাঝখানে এক রমনীর প্রেমে পড়ে যাই ।
-নিশ্চয় ছ্যাকা খেয়েছেন?
-নাহ! আর দেখায় হলোনা ।
-মানে?
.
সবটা শোনার পর নিশি বললো-
এমন অনেক মানুষের সাথে পথ চলতে দেখা হয় আমাদের । পরিচয়ও হয় । কিন্তু তাদের দেখা আমরা আর পাইনা । ভাগ্যক্রমে কয়েকজনের সাথে দেখা হলেও হতে পারে ।
-আমি ভাগ্যের উপরে বিশ্বাস করে বসে আছি ।
-প্রথম দেখাতে এতোটা গভীরভাবে ভালোবাসা! এটা প্রথম শুনছি ।
-তাই হয়তো এতোদিন কাউকে ভালোবাসিনি । ওর জন্যই জমা করে রেখেছিলাম ।
-হু । এখন কি করবেন? আমাকে পছন্দ হয়নি জানাবেন?
-উহু! আপনি বলবেন, আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি । আমি চাইনা, আমার মা বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত থাকুক ।
-মিথ্যে বলতে বলছেন?
-সরি?
-কিছুনা । বলবো আমি । শুভ কামনা আপনার জন্য । খুব তাড়াতাড়ি যেনো ছায়ার দেখা পান ।
-ছায়া নয়, ছোঁয়া!
.
মুচকি হাসলো নিশি । এই প্রথম কোনো ছেলেকে দেখে তার এতোটা ভালো লেগেছে । কেনো যে মাসখানেক আগেই তাদের দেখা হলোনা!
.
.
সকাল সকাল বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছিলো পরশ ।
সাফিনা আহম্মেদ এসে বললেন-
কাল এমন স্বাভাবিক আচরণ করবি তুই, ভাবতে পারিনি আমি!
-নিশির মতো একটা মেয়েকে দেখে উল্টাপাল্টা আচরণ করা যায় নাকি?
.
হাসতে লাগলো পরশ । সাফিনা আহম্মেদ খুশি হয়ে বললেন-
তার মানে নিশিকে তোর ভালো লেগেছে?
-ভালো না লাগার কথা নয় মা!
-সত্যি বলছিস তুই?
-নিশি সুন্দরী, শিক্ষিতা ভালো লাগার মতোই মেয়ে ।
.
আমি এখুনি তোর মামাকে জানাচ্ছি । নিশির মত কি জিজ্ঞাসা করতে বলছি ।
-অবশ্যই ।
.
সাফিনা আহম্মেদ খুশিতে গদগদ হয়ে চলে গেলেন ফোন করতে ।
পরশ ধীরস্বরে বললো-
সরি মা! তোমাকে দুঃখ দিতে চাইনা । তাই মিথ্যের আশ্রয় নিতে হলো । আমি বিয়েতে রাজি না বললে, হয়তো তুমি আমায় জোর করতে, কারণ জানতে চায়তে । তার চেয়ে বরং ওদিক থেকেই না বলুক!
.
কিন্তু পরশের মাথায় বাজ তখনি পড়লো যখন সে জানতে পারলো, নিশি এই প্রস্তাবে রাজি হয়েছে ।
নিশিকে সবটা বোঝানোর পরেও কেনো সে রাজি হলো!
.
চলবে