শ্রাবণ মেঘের দিন পর্ব ২

#গল্পঃ শ্রাবণ মেঘের দিন(২য় পর্ব)
সেঁজুতি কাঁপাকাপা হাতে চিঠি টা খুললো।লজ্জা আর ভয়মিশ্রিত এক অনুভূতি কাজ করছে তার মনে।না জানি চিঠিতে কি লেখা আছে!কিন্তু চিঠিটা খুলে পড়া শেষ করার পর ও আবার আরেক আতঙ্কে পড়ে গেলো।কারন
সেখানে লেখা ছিলো,
“তুমি কি আমার বাদলা দিনে সদ্য ফোটা কদম হবে?
বৃষ্টির জলে ধুয়ে মুছে যার সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।
তুমি কি আমার বর্ষাকালে শ্রাবণ মেঘের দিন হবে?
যে বৃষ্টির জল হয়ে আমার অশ্রুটুকু ধুইয়ে দিবে।
তুমি কি আমার সে হবে?
যে হবে আমার বহমান নদী আর বিশাল নীল আকাশ।
যে আকাশে আমরা মেঘ হয়ে ঘুরে বেড়াবো সারাজীবন উড়িয়ে দিয়ে মনের সকল দুঃখ আর অভিলাষ।
তুমি কি আমার তেমনি একজন মানুষ হবে?
যে সুখে দুঃখে চলার পথে সারাজীবনের সঙ্গী হবে?”
লেখা টুকু পড়ে সাথে সাথে সেঁজুতি চোখ বন্ধ করে ফেললো।ওর বুকের হৃৎস্পন্দন ধীরে ধীরে বেড়ে যেতে লাগলো।সেঁজুতি জানে না এর উত্তর কি হবে।
এ যেনো সেঁজুতি বিশ্বাসই করতে পারছেনা।
উৎপল যে সেঁজুতিকে পছন্দ করতো এটা সেঁজুতি আগে থেকেই একটু আধটু টের পেয়েছিলো। কিন্তু এর বহিঃপ্রকাশ যে উৎপল এভাবে করবে তা সেঁজুতি ভাবতেই পারেনি। ধীরেধীরে রাত বাড়তে লাগলো,চারিদিকে পিনপতন নীরবতা।বাহিরে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে হঠাৎ জানালা দিয়ে কিছু দমকা হাওয়া এসে সেঁজুতির চুল গুলো উড়িয়ে দিয়ে গেলো। প্রিয় মানুষকে মনে মনে ভালবেসে তার স্মৃতিচারণ করার উপযুক্ত সময় আর কখন হতে পারে?
কাল সারারাত ঘুম হয়নি সেঁজুতির,ভোরবেলা একটু ঘুমিয়েছে এরমধ্যে হঠাৎ তিতলী এসে সেঁজুতির ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলো।
ঘুম থেকে উঠে সেঁজুতি ঘরের বাইরে পা রাখতেই উৎপলকে দেখতে পেলো।উৎপল উঠানে দাঁড়িয়ে সিরাজের সাথে কথা বলছে।
পুকুরপাড় থেকে ফরিদা বেগম সেঁজুতিকে কি কারণে যেন ডাকছে কিন্তু সেঁজুতি উঠান মাড়িয়ে সেখানে যেতে পারছেনা। কারণ কাল রাতে উৎপল চিঠিতে যা লিখেছে তা পড়ার পর থেকে উৎপলের কথা মনে পড়লেই সেঁজুতি লজ্জা পায়।
তারপরও এক প্রকার বাধ্য হয়েই সেঁজুতি উৎপলের সামনে দিয়ে পুকুরপাড়ে গেলো।উৎপল সেঁজুতিকে আজ আর কিছু বললো না কিন্তু আঁড়চোখে ঠিকই তাকিয়েছে সেঁজুতির দিকে।
এদিকে যুথির স্বামী দুলাল মানে সেঁজুতির দুলাভাই সেঁজুতির বিয়ের জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। ছেলে হাইস্কুলের মাস্টার।এর থেকে নাকি ভালো প্রস্তাব আর পাওয়া যাবেনা সেঁজুতির জন্য।
কথাগুলো এইমাত্র যুথি আপার কাছ থেকে শুনেছে সেঁজুতি। কথাগুলো শোনার পর মনের অজান্তেই সেঁজুতির বুকটা কেঁপে উঠলো, তাহলে কি সেঁজুতি ও মনে মনে উৎপলের নয়তো ওর মুচকি হাসির প্রেমে পড়েছে?
আজ মনটা ভালো নেই সেঁজুতির।তুলির কাছে কাল থেকে আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব ঘটনা গুলো বলেই ওর মনটা হালকা হবে।
কালরাতে ফরিদা বেগম মেহমানদের জন্য পিঠা বানিয়েছিলেন তার থেকে কিছু পিঠা একটা বাটিতে ভরে সেঁজুতির হাতে দিলো ফরিদা বেগম।দিয়ে বললো এগুলো আবুলের বউ জোহরার কাছে দিয়ে আসতে।
সেঁজুতি বাটিটা হাতে নিয়ে রওনা দিলো।কালকের রাতে উৎপলের কথা ভাবতে ভাবতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলো সেঁজুতি। হঠাৎ কাঁদার মধ্যে পা পিছলে পড়ে গেলো ও।লাফ দিয়ে সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আশেপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে নিলো কেউ দেখেছে কিনা।
নাহ্ ভাগ্য ভালো কেউ দেখেনি।এরপর আবার একমনে চুপিচুপি গান গাইতে গাইতে হাঁটতে লাগলো সেঁজুতি। একটুপরে কোথা থেকে যেনো উৎপল এসে সেঁজুতির পিছু নিয়ে বললো,
–“হাঁটতে গেলো এখনো বাচ্চাদের মতো পরে পরে আছাড় খাস কেন?
কাঁদা মাটির রাস্তায় সাবধানে পা ফেলে হাঁটতে হয়।”
সিরাজ বললো,
–“তোর দুলাভাই নাকি তোর জন্য প্রস্তাব নিয়ে এসেছে বিয়ের?
হুম,তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নে।বিয়ের কয়েকবছর পর দেখবি তোরও কয়েকটা বাচ্চা হবে।তোকে আর তখন দেখতে এমন বাচ্চা বাচ্চা লাগবে না।তখন তুই দেখতে একেবারে বুড়ির মতো হয়ে যাবি।”
“আচ্ছা এই প্রসঙ্গ বাদ দিলাম।
কাল রাতে যে আমি তোকে একটা চিঠি দিয়েছি তার উত্তর কই?
“হ্যাঁ” বা “না” বলে দে।”
সেঁজুতি কি বলবে ভেবে পায় না,ওর হাত পা সমানে কাঁপতে লাগলো।সেঁজুতি মনে মনে ঠিক করলো এক দৌঁড়ে উৎপলকে পিছনে ফেলে জোহরা চাচিদের ঘরে গিয়ে উঠবে।কিন্তু এ সাহস ও পেলো না পাছে যদি আবার আছাড় খেয়ে পরে যায়!
সেঁজুতির নীরবতা দেখে উৎপল চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
–“আরে তুই কিভাবে আমার প্রশ্নের উত্তর দিবি?
আমি তো তোকে বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম।
কাল আমি তোর হাতে যে চিঠিটা দিয়েছিলাম ওটা মূলত আমি তোকে দেইনি,মা চলে আসছে বিধায় কথাটা তোকে বলতে পারিনি।
শোন তুই এই চিঠিটা গিয়ে এখনি তুলির কাছে পৌঁছে দিবি।তুলিকে আমি অনেকদিন যাবৎ পছন্দ করি কিন্তু কখনো বলতে পারিনি।
হঠাৎ মনে হলো তুই ওর বান্ধবী, তোর কাছে বললে বোধহয় সমস্যাটার সমাধান হবে তাই তোকে ধরা।
তুই চিঠিটা ওকে দিবি এবং ওর উত্তরটা রাতের মধ্যে আমাকে জানাবি।মনে থাকবে তো?”
এই বলে উৎপল সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো।
এই কথা শোনার পর সেঁজুতির বুকটা ধক করে উঠলো।
তাহলে কি তার সব এলোমেলো ভাবনাগুলো ভুল ছিলো?
এই মুহূর্তে সেঁজুতির মনের মধ্যে এক ভয়ংকর ঝড় বয়ে যেতে লাগলো।কোন কারণ ছাড়াই সেঁজুতির চোখ থেকে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।
যুথি আপু আজ চলে গেছে এবং বলে গেছে শুক্রবার সেঁজুতিকে দেখতে আসবে।সেঁজুতি মনে মনে ভালবেসে ফেলেছিলো উৎপলকে নয়তো ওর খুন শুঁটিকে।
উৎপল যেমন ওর প্রিয় মানুষ তেমনি তুলিও ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ।প্রিয় মানুষগুলোর মিল হয়ে গেলে চমৎকার হবে।
কিন্তু তারপরও এক প্রকার অভিমান নিয়েই সেঁজুতি মনে মনে রাজি হয়ে গেলো বিয়ে করতে।সেঁজুতি মনে মনে বলতে লাগলো,
“ভাগ্যিস উৎপলকে আগেভাগেই কিছু বলে দেইনি।আমার ভালবাসা আমার কাছেই গোপন থাকুক।সব ভালবাসা এবং পছন্দ প্রকাশ করতে নেই।”
অন্য সব মেহমানরা ও চলে গেছে। পুরো ঘর জুড়ে আজ একপ্রকার শূন্যতা বিরাজ করছে যেমনটা শূন্যতা আজ সেঁজুতির মনে।
ঘরে কেউ নেই।মা গেছে হয়তো কারো ঘরে, বাবা ক্ষেতে আর দুই ভাই কোথায় গেছে কে জানে।
সেঁজুতি পাটাতনে উঠে সেই চিঠিটা হাতে নিলো এমনকি আরো একবার পড়লো।তারপর রওনা দিলো তুলিদের বাড়িতে।
উৎপলদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আবারো ছেলেটার দেখা মিললো।সেঁজুতি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো,
যেখানে উৎপল পিছু নিবে তুলির তা না নিয়ে আমার পিঁছু।আমি তো ঠেকেছি ওদের সম্পর্ক নিয়ে এই বলে সেঁজুতি মুখ ভেংচি কাটলো।
উৎপল সেঁজুতিকে দেখে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে বললো,
–“কিরে আমার উত্তর কই?”
সেঁজুতির নীরবতা দেখে উৎপল বললো,
–“বোবা দের মতো থাকিস কেন সবসময়?একটু কথা বললে কি হয়?”
সেঁজুতি প্রতিত্তোরে কিছু না বলে এবার উৎপলের সামনাসামনি মুখ ভেংচি কেটে তুলিদের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
পাছে উৎপল অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।
সেঁজুতি মনে মনে ভাবে এই ছেলের সামনে আর পরা যাবে না।গ্রামের মানুষজন দেখলে বদনাম উঠিয়ে দেবে।
জোহরাকে বাটিটা দিয়ে সেঁজুতি চলে গেলো মোল্লা বাড়িতে।ইউসুফ চাচার ছেলে রহিম বিয়ে করেছে কয়েকদিন আগে?
সবাই বউ দেখতে আসলেও সেঁজুতির আসা হয়নি তাই আজ সেঁজুতি এসেছে বউ দেখতে।
রহিমের বউটা দেখতে একেবারে মন্দ না।কি সুন্দর একটা লাল শাড়ি পরে বড় করে একটা ঘোমটা দিয়ে রেখেছে।
লোকজনের সাথে অনেক আস্তে আস্তে কথা বলছে।
তুলি বলেছিলো,
নতুন বউদের নাকি একটু বেশী লজ্জা থাকে।
একটুপরে এই বউয়ের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে সেঁজুতি। নাহ্ বেশিক্ষণ কল্পনা করতে পারে না সেঁজুতি, লজ্জায় ওর চোখ বুঁজে আসে।
একটুপরে নতুন বউ এসে সেঁজুতির কাছে বসলো।এবং সবার অগোচরে সেঁজুতির কানে কানে বলতে লাগলো,
–“আমার স্বামী রহিমের লগে তোমার কোনো প্রেম,ভালোবাসা আছিলো নি?”
নতুন বউয়ের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় সেঁজুতি। তাহলে তুলি আর গ্রামের মানুষের কথাই ঠিক হলো।গ্রামের সবাই বলাবলি করছিলো নতুন বউ নিয়ে।
নতুন বউ নাকি একটু পাগল টাইপের।
মেয়েদের দেখলেই চুপিচুপি নাকি জিজ্ঞেস করে,
“করিমের লগে তোমার কোনো প্রেম, ভালবাসা আছিলোনি?”
আর ভাবতে পারেনা সেঁজুতি। নতুন বউয়ের কথা শুনে জোরে হেঁসে উঠলো সেঁজুতি। বউয়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়েই ও হাঁসতে হাঁসতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
পিছনে নতুন বউ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।
একটুপরে সেঁজুতি তুলিদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। পথে ওর বড় ভাই সিরাজের সাথে দেখা।ওরা ৩জন করিমের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। সিরাজ সেঁজুতিকে দেখে ধমক দিলো বললো,
–“সারাদিন বাহিরে বাহিরে এখানে সেখানে ঘুরিস কেন?”
উৎপল সিরাজের সামনেই সেঁজুতিকে প্রশ্ন করলো,
–“কিরে বউ দেখতে এসেছিস?”
সেঁজুতি জবাব দিলো,
–“হুম।”
উৎপল আর কিছু না বলে সামনের দিকে পা বাড়ালো।একটু দূরে যাওয়ার পর উৎপল আবার পিছনে এলো ওদের সামনে রেখে।
সেঁজুতির সামনে এসে উৎপল বললো,
“তোকে বউ সাজলে অনেক সুন্দর লাগবে। বিয়ের দিন তোর খোঁপায় গুজে দেয়ার জন্য কয়েকটা তাজা গোলাপফুল এনে দিতে হবে।তোকে সেদিন এত সুন্দর লাগবে যে,
তোর বর সেদিন সারারাত না ঘুমিয়ে তোর দিকে তাকিয়ে থাকবে।”
উৎপল হাসতে লাগলো আর সেঁজুতি কথাগুলো শুনে কপাল কুঁচকে সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো।
পিছন থেকে উৎপলের কথা শোনা গেল।সে চিৎকার দিয়ে বলছে,
–“রাতের মধ্যে আমার উত্তর চাই।”
তুলিদের বাড়িতে গিয়ে তুলির কোনো সাড়াশব্দ মিললো না।একটুপরে দেখা গেল ও পাটাতনে শুয়ে আছে।চোখগুলো ফোলা আর লাল হয়ে আছে।
সেঁজুতিকে দেখে তুলি ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো, যেনো এক আকাশ মেঘ নিয়ে তুলি বসে ছিলো সেঁজুতির আশায়। ও আসলেই চোখের জলগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরবে।
কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তুলি বললো,
আজ ৩ দিন হলো রাসেলের সাথে ওর কোনো যোগাযোগ নেই। রাসেলকে ও প্রচন্ড ভালোবাসে।এই রাসেলের সাথে নাকি ওর বাবা মা শিউলির বিয়ে ঠিক করেছে।এই ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা তুলি।তুলির মুখে এই কথাশুনে থমকে গেলো সেঁজুতি। কিভাবে সম্ভব এটা?
এই রাসেল আর তুলির জন্য কত করেছে সেঁজুতি।
ওদের কথা বলতে দিয়ে অনেক ঝুঁকি নিয়ে পাহারা দিয়েছে সেঁজুতি, আরো কত কি!
এই ছেলে এতো গভীর ভালোবাসা ভুলে অন্য মেয়েকে কিভাবে তার জীবনের সাথে জড়াবে?
তুলি বারবার সেঁজুতিকে বলতে লাগলো,
“আমি ভুলে থাকতে চাই রাসেলকে।কিন্তু কিছুতেই পারছিনা।”
সেঁজুতি কোনো উত্তর না দিয়ে ওরদিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলো।
তুলি কাগজটা পড়ে অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।তুুলির চোখে ছিলো অবাক হওয়ার দৃষ্টি আর সেঁজুতির মনে ছিলো অভিমান।সেঁজুতি ভেবেই নিয়েছে আর কখনো উৎপলের সামনে পড়বে না,মরে গেলেও না।
তুলি কাগজটা হাতে নিয়ে সেঁজুতিকে বললো…………….
#বাকি পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন।
লেখাঃ হামিদা ইমরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here