শ্রাবণ মেঘের দিন পর্ব ৩

#গল্পঃ শ্রাবণ মেঘের দিন(৩য় পর্ব)
সেঁজুতি ভেবেই নিয়েছে আর কখনো উৎপলের সামনে পড়বে না,মরে গেলেও না।
তুলি কাগজটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে সেঁজুতিকে বললো,
“কিরে এটা তোকে কে দিলো”?
“এটা আমাকে কেউ দেইনি, এটা উৎপল তোকে দিয়েছে”।
তুলি সেঁজুতির কথা শুনে আর কিছু বললো না।চিঠিটা ভাজ করে বিছানার নিচে রাখলো।
একটুপরে তুলি আবার বলে উঠলো,
” পরশু রাসেলের বিয়ে। আমাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছে।আমি কি যাবো নাকি রে!”
কথাগুলো বলছিলো আর কাঁদছিলো তুলি।
তুলির প্রতিত্তোরে সেঁজুতি বলেছিলো “না”।সেঁজুতি তুলিকে আরো বলেছিলো,
একজনকে ভুলতে হলে তার মতো আরেকজনকে দরকার। আরেকজন তো তুই পেয়েই গেছিস।অতীত ভুলে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাব,তাহলেই ভালো থাকবি।
আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এলো তুলি।
পথে রমিজার সাথে দেখা হয়েছিলো সেঁজুতির।রমিজা মেয়েটা আগের চেয়ে অনেক শুকিয়ে গেছে। কারন জিজ্ঞেস করতেই রমিজা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“আমার স্বামী ঢাকাতে একটা মহিলারে বিয়া করছে।কোনো খরচাপাতি পাঠায় না গ্রামে। আচ্ছা সেঁজুতি,
“একজনকে কষ্ট দিয়ে আরেকজনকে নিয়ে কি সত্যিই
খুব সুখে থাকা যায়?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে সেঁজুতি বাড়ি পৌঁছে গেলো। অবশেষে সেঁজুতি বুঝতে পারলো সুখ জিনিসটা একেক জনের কাছে এক এক রকম।
সেদিনের পর থেকে প্রায় ১৭ দিন কেটে গেলো।তুলির সাথে আর সেঁজুতির দেখা হয়নি।সেঁজুতি কেন যেন ইচ্ছে করেই আর ওদের বাড়িতে যায়নি,তুলিও আর আসেনি।
সেঁজুতি মনে মনে ভাবে ওদের দিনগুলো মনে হয় ভালোই কাটছে।
আজকাল সেঁজুতি সবসময় ঘরে মধ্যে থাকে এবং মায়ের সব কাজে সাহায্য করে।
ফরিদা বেগম সহ ঘরের লোকজন সবাই চমকে গেলো সেঁজুতির এই হঠাৎ পরিবর্তনের জন্য। যে মেয়ে এতদিন একদণ্ড ঘরে থাকতো না,এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতো, দুপুর হলেই নদীতে সাঁতার কাটতে যেতো, সে মেয়ের এখন একাকী জীবনের মোড়টা কারো চোখ এড়ালো না।
সেঁজুতির দুলাভাই সেদিন বলে গিয়েছিলো,
“শুক্রবার সেঁজুতিকে দেখতে আসবে কিন্তু ছেলে পক্ষের কি যেনো কাজ ছিলো তাই তারা সেদিন আসতে পারেনি।”
আজ শুক্রবার, সেঁজুতিকে আজ আবারো দেখতে আসার কথা।কিন্তু
আজ ভোর থেকেই শুরু হয়েছে একটানা বৃষ্টি।মাঝে মাঝে বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সাথে বাতাস তো আছেই।
বৃষ্টির পানিতে পুকুর,নদীনালা ভরে গেছে। শিউলিদের বাড়ির পাশের রাস্তায় ও পানি জমে গেছে।শিউলির কথা মনে পড়তেই সেঁজুতির মনে প্রশ্ন জাগলো,
আচ্ছা, শিউলি রাসেলকে নিয়ে ভালো আছে তো!
সেঁজুতি ঘরের পাটাতনে বসে বৃষ্টি দেখছে আর ভাবছে,
“আজ লোকগুলো কিভাবে আসবে সেঁজুতি কে দেখতে?রাস্তায় তো হাঁটুর উপরে পানি জমে গেছে।
তাহলে কি বাবা তাদের আনতে নৌকা পাঠাবে”?
নাহ্ সেঁজুতির এখন এগুলো ভাবতে মোটেও ভালো লাগছে না।সেঁজুতি এক দৃষ্টিতে দূরে তাকিয়ে আছে।
সেদিনের পর থেকে উৎপল ও আর আসেনি সেঁজুতিদের বাড়িতে।
সিরাজ’দার সাথে মাঝেমধ্যে উৎপল আড্ডা দিতে আসতো কিন্তু এখন আর আসে না।সেঁজুতির ইচ্ছে করে সিরাজ’দার কাছে থেকে উৎপলের খোঁজ খবর নিতে।কিন্তু সেঁজুতি সাহস পায়না পাছে যদি ভাই ওকে বকে দেয়।
পাশের বাড়ির সুখন ভাই আর ভাবি বৃষ্টিতে ভিজছে।তাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় ২০ বছর কিন্তু এখনো তাদের মাঝে যে ভালবাসার বন্ধন খুঁজে পাওয়া যায় তা তাদের কিশোর বয়সের সেই দুরন্ত প্রেমকেও হার মানায়।
সুখন ভাই একসময় কত কষ্ট করেছে,ঘরে বাজার পর্যন্ত করতে পারেনি কিন্তু কখনো তাদের ঘর থেকে কোনো ঝগড়ার আওয়াজ শোনা যায়নি।সেই অভাবের দিনগুলোতেও তিথি ভাবি ভাইয়ের পাশে ছিলো।
তখন সবাই বলতো,
শুধু শুধু কষ্ট করছো কেন?তোমার বাবার অবস্থা তো খুব ভালো।তার কাছে চলে যাও।সে নতুন করে তোমার আবার কোনো না কোনো ব্যবস্থা করে দিবে।
ভাবির উত্তর ছিলো,
“দুঃখ কষ্টের সময় যদি প্রিয়জনের পাশে না থাকতে পারি,তার কষ্টটা যদি আমার হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি নাই করতে পারি,তাহলে আমি তাকে কেমন ভালবাসলাম ?
আজ আমি যদি তাকে ছেড়ে চলে যাই তাহলে এটা আমার ভালবাসা হবে না হবে স্বার্থপরতা।আমি আমার প্রিয়জনকে ছেড়ে কোথাও যাবো না বরং আমাদের ভালবাসার কাছে সবকিছুকে হার মানিয়ে দিবো।
যদিও আজ তাদের কোনো কষ্ট নেই।সংসার,সন্তান নিয়ে খুব ভালো আছে তারা।
একেই বুঝি বলে সত্যিকারের ভালবাসা!
সেঁজুতি ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো মনেই নেই।ঘুম থেকে উঠেই একটা কথা ভাবতেই ওর বুকটা ধক করে উঠলো। কারণ সেঁজুতি একটু আগে স্বপ্নে দেখেছিলো।
উৎপল আর সেঁজুতি একসাথে হাতে হাত রেখে বৃষ্টির পানিতে ভিজতে ভিজতে দূরে কোথাও হেঁটে যাচ্ছে!
ফরিদা বেগম মেয়েকে ডাকতে লাগলেন,
“বেলা ১২ টা বেজে গেছে। এখনো কি করিস তুই?নিচে নেমে আয়,সকালের খাবারও তো এখন পর্যন্ত খাসনি”।
সেঁজুতি উৎপলের কথা ভাবতে ভাবতে নিচে নেমে এলো।
এখনো বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে।
সেঁজুতি কাউকে কিছু না বলেই এক লাফে উঠোনে নেমে গেলো বৃষ্টিতে ভিজতে।কতদিন ধরে সেঁজুতি বৃষ্টিতে ভিজে না!পাশের ঘর থেকে দুই চাচাতো বোনকে পটিয়ে নিয়ে গেলো নদীর পাড়ে।
আজ সেঁজুতি বৃষ্টিতে ভিজবে আর সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠবে।
নদীর পাড় দিয়ে পানিতে নামতেই পিছন থেকে কে যেনো বলে উঠলো,
“বৃষ্টিতে ভিজলে মেয়েদের দেখতে একদম বাজে লাগে তোকে বলেছিনা আর কখনো বৃষ্টিতে ভিজবি না”?
কন্ঠটা খুব পরিচিত মনে হলো সেঁজুতির।
পিছনে ফিরে তাকাতেই ১৭দিন পর উৎপলের দেখা মিললো।
উৎপলকে দেখে লজ্জায় আর নদী থেকে উঠতে পারেনা সেঁজুতি।কি করবে না করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা সেঁজুতি।
কথা তো বলতেই পারছেনা বরং হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে গেলো।
ওদিকে উৎপল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেঁজুতির দিকে আর ভাবছে,
নিষ্পাপ মেয়েটা দেখতে সত্যিই অনেক সুন্দর। বিশেষ করে যখন ও লজ্জা পায় তখন ওকে দেখতে আরো সুন্দর লাগে।এগুলো ভাবতে ভাবতে উৎপল মুচকি হাসতে লাগলো।
এরমধ্যে হঠাৎ সেঁজুতি এক লাফ দিয়ে নদী থেকে উঠেই বাড়ির দিকে দৌড় শুরু করলো।কে আর পায় ওকে।পিছন থেকে সেঁজুতির ২ চাচাতো বোন চেচামেচি করে বলতে লাগলো,
আপা,তোর ওড়না নিয়ে যায়!
প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে আজো সেঁজুতিকে দেখতে আসা হলো না ছেলে পক্ষের। বিকেলে আকাশটা একটু হালকা হলো।বৃষ্টি এখন নেই বললেই চলে কিন্তু বর্ষাকালের দিন কখন না কখন হুট করে বৃষ্টি চলে আসে বলা যায়না।
বিকেলে সেঁজুতি বাড়ির পিছনে বিশাল বড় এক তেঁতুল গাছের নিচে বসে আছে।উৎপল একটুপরে কতগুলো টকটকে তাজা লাল গোলাপ নিয়ে হাজির হলো সেঁজুতির সামনে।
সেঁজুতি মনে মনে ভাবতে লাগলো উৎপল আসলেই কোনো মানুষ নাকি জ্বীন? যদি ও মানুষ হয়ে থাকে তাহলে যখন তখন হুটহাট করে কিভাবে খুঁজে পায় আমাকে?ও জানে কিভাবে আমি কখন কোথায় থাকি?
সেঁজুতি উৎপলকে দেখে উঠে দাঁড়ালো এবং ওর পিছন বরাবর খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।উৎপল সেঁজুতির এ আচরণ দেখে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো এই তেঁতুল গাছ থেকে সেঁজুতিকে কোনো পেত্নীতে ধরে নিতো আবার!
উৎপল সেঁজুতিকে প্রশ্ন করলো,
” কি ব্যাপার,তুই এমন করছিস কেন?
সেঁজুতি উৎপলের ছায়া দেখে নিশ্চিত হয়, নাহ্ ও অন্যকিছু না,ও আসলেই উৎপল।
একটুপর হঠাৎ সেঁজুতি খেয়াল করলো উৎপলের হাতে অনেকগুলো লাল গোলাপ।এই গ্রামে তো এ ফুলগুলো খুঁজেই পাওয়া যায়না একমাত্র শহর ছাড়া।তাহলে উৎপল এই ফুলগুলো উৎপল কোথায় পেলো!
দু’জনেই ৫ মিনিট নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।একটুপরে উৎপল সেঁজুতির হাতে ফুলগুলো দিয়েই বললো,
“এগুলো আমার গাছের ফুল।তোর জন্য নিয়ে এসেছি”।
উৎপলের কথা শুনে সেঁজুতি প্রচন্ডভাবে রেগে গেলো এবং বললো,
“আপনারা পুরুষ মানুষ অনন্ত পক্ষে আপনাদের দৃষ্টি আগে ঠিক করুন।যাকে তাকে না, শুধুমাত্র একজনকে ভালবাসুন। একটাই হৃদয়। এটা একজনকেই দেয়া যায়, ১০ জনকে না।একটা হৃদয় ১০জনকে দিতে গেলেই তখন ভালবাসা নামক জিনিসটা ঠুনকো হয়ে যায়”।
আর কিছু না বলেই সেঁজুতি সেখান থেকে চলে এলো।
আজ উৎপলকে সবচেয়ে খারাপ মানুষ হিসেব মনে হচ্ছে সেঁজুতির।খারাপ মানুষের প্রতি কখনো ভালবাসা জাগতে পারেনা ওর মনে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত।রাতের খাবারদাবার শেষে সবাই সবার রুমে ঘুমাতে গেলো।সেঁজুতির আজ একটুও ঘুম আসছে না।বিকেলের কথাটা বারবার মনে পড়ছে।
সারাদিন শেষে রাতটা খুবই কষ্টদায়ক।
জীবনে ফেলে আসা অতীতের কথা মনে করিয়ে কেবল কষ্ট দেয়।
একটুপরে টিনের ঘরের বাহিরে সেঁজুতি যেনো কার ফিসফিস কন্ঠে কথা বলার আওয়াজ শুনতে পেলো।কে যেনো ফিসফিস কন্ঠে ওকে ডাকছে।
সেঁজুতি বুকে একরাশ সাহস সঞ্চার করে আস্তে করে জানালাটা খুলতে লাগলো আর মনে মনে ভেবে নিলো ভূত-পেত্নী অথবা চোর ডাকাত হলে ও জোরে চিৎকার করে সবাইকে ডেকেই ওখান থেকে দৌড়ে পালাবে। কিন্তু দেখা গেলো উল্টোটা।
জানালার ঐপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো তুলি।এতরাতে তুলিকে এখানে দেখে চমকে গেলো ও।সেঁজুতি আরো চমকে গেলো যখন পিছনে উৎপলকে দেখতে পেলো।
সেঁজুতি মনে মনে বলতে লাগলো উৎপলকে,
এতরাতে নষ্টামি করতে এসেছিস তাও আবার আমাকে দেখিয়ে। দেখ আজ তোর কি অবস্থা করি।
তুলিকে দাঁড়াতে বলে খাট থেকে নিচে নেমে দরজার দিকে পা বাড়ালো সেঁজুতি……
#বাকি পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন।
লেখাঃ হামিদা ইমরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here