দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-৬৭
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
খোলা রাস্তার কিনারা ধরে হাঁঠছে বন্ধন।
বিষন্ন চিত্তে একা।মাথার ওপর রোদটা বড় বেশী প্রখর।
না বাতাস,না বৃষ্টি।
“কি আশ্চর্য ডিসেম্বর মাসে চৈত্রের খরা এলো কি করে?বাংলাদেশের আবহাওয়ার যে কি হচ্ছে?’
ফের চিন্তায় মগ্ন বন্ধন।আজ সকালে তার ছোট মেয়ে টুই মনে করিয়ে দিয়েছে কিছু কথা।
“শোন আব্বু মামনীর আজ জন্মদিন।মামনীকে তুমি আমি, আর ভাইয়া মিলে সারপ্রাইজ দিবো।মামনীর অনেক মন খারাপ মনটা ভালো করিয়ে দিতে হবে বুঝেছো?’
“পাকা সেয়ানা মেয়ে একটা,মায়ের মতো আবেগপরায়ণ হয়নি,এমন ভাব যেন মা তার মেয়ে আর সেই যেন তার মা।’
হঠাৎ থমকে যায় বন্ধন।
সামনে থেকে কেউ একজন তার হাতটা শক্ত করে ধরলো।
“কেমন আছিস বন্ধন বাবু?’
“ভালো।’
“মিথ্যে কেন বলছিস বন্ধন আমি জানি তুই ভালো নেই।’
“জানেন যখন জিজ্ঞেস করছেন কেন?আর ছাড়ুন তো হাতটা আমার অনেক কাজ।’
বন্ধন লক্ষ্য করলো তার চারপাশটায় ছায়া দিয়ে ঘেরা আর সামনে দাঁড়ানো পীর বাবা,বন্ধনের হাত ধরে আছে।
“আজব তো এত ছায়া কি করে এলো এখন আর এই পীর বাবা কোথা থেকে এলো?
“যত্তসব ভন্ডামী,আজকাল তো ফেইসবুক থেকেই সব পড়ে জানা যায় এই লোকও তাই করেছে আর আমার সাথে ছদ্মবেশ ধরে নাটক করছে, যাতে আমি ভড়কে গিয়ে মাল পানি দেই।’
হাতটা ঘুরিয়ে সময় দেখে বন্ধন।
“ভদ্রভাবে বলেছি আপনাকে আমার হাত ছাড়ুন।সময় কম না হলে আমার সাথে ভাওতাবাজি করার মানে বুঝিয়ে দিতাম।’
“কি কি বল্লি তুই বাবু?আমি ভাওতাবাজি করি?এত বড় স্পর্ধা?তোর মনে নেই কেয়ার সাথে বিয়ে হবার পর তোকে আমি কি বলেছিলাম,,,সেগুলি ফলে নি?আর এখন মিতুকে বিয়ে করেছিস।এও তোকে বলিনি,মিতুকেও তোর হারাতে হবে?’ বাজখাঁই গলায় হুংকার দিয়ে ওঠে পীর বাবা বন্ধনের কথা শুনে।
বন্ধনের বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচরে ভেংগে খান খান হয়ে যায়।
“মিতুকে হারাতে হবে,,,,কিন্তু কেন কোন অপরাধে?’
অসহায় আর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জবাব খুঁজতে চায় বন্ধন।(চলবে)দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-৬৮
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
প্রায় পনেরো বছর আগে বন্ধনের বিয়ে হয়েছিল তার সহপাঠী কেয়ার সাথে।বিমানসেনার চাকরীটাও নতুন, ক্যান্টনমেন্ট এ তখনও ওঠেনি বন্ধন।
তাই ধানমন্ডির এই প্রিয় বাসাটিতে বন্ধন থাকতো তার আরও দুটো ছোটভাই ও নানুকে নিয়ে।বিয়ের মাত্র ছয়মাস আগে মা চলে যান না ফেরার দেশে তাদের ছেড়ে।
কেয়াকে আশীর্বাদ করে যান তিনি।
এ সময় আবীরেরও অস্ট্রেলিয়ায় ভিসা হয়ে যায় স্কলারশিপ নিয়ে সে চলে যায়।ওখানের একটা মেয়েকে বিয়ে করে,নাগরিকত্ব লাভ করে।
নীবিড় তখনও ছোট।মেঝো ভাই আবীর বন্ধনের প্রথম বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারেনি,গুরুত্বপূর্ন কাজে আটকে গিয়েছিল।
পাঁপিয়ার মরিয়া হয়ে যাওয়া, বন্ধনকে প্রবলভাবে কাছে পাবার চেষ্টা তখন থেকেই।বন্ধনের উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তাদের আরেক সহপাঠী ভালমানুষ জামিলকে হুট করে বিয়ে করে ফেলে।
সে ঘরে মেয়ে তন্নীও হয় তার।
বন্ধনের বিয়ে ঠিক হবার আগের রাতে বেসামাল অবসস্থায় রাতের অন্ধকারে পাঁপিয়া আসে তার কাছে এই ধানমন্ডির বাসায়।
বন্ধনের কাছে করোজোরে ভিক্ষে চায় তাকে।
কিন্তু বন্ধনের সাফ জবাব,কেয়াকে সে ধোকা দিতে পারবেনা।
কথাটা কোনভাবেই গ্রাহ্য করতে পারেনি পাঁপিয়া,তীব্র ঘৃনা আর আক্রোশে বন্ধনকে যা খুশি বলে গালাগাল দেয়।
শেষ পর্যন্ত অভিশাপ দেয় বন্ধনকে।
“তুই কোনদিনও সুখী হতে পারবি না বাবু,কেয়াকে ধোকা দিতে পারবিনা?এত ভালোবাসা এত মায়া ওর জন্যে?আর আমাকে যে ধোকা দিয়েছিস তার কি হবে?
তোর জীবনে কিছুই থাকবে না দেখে নিস তুই,,,,’
সদ্য মেয়েকে হারিয়ে নানুর মনটা আরও বেশী আতংকগ্রস্থ হয়ে গেলো পাঁপিয়ার দেয়া অভিশাপে।
তাই কেয়ার সাথে বন্ধনের বিয়ের প্রায় সাথে সাথে নানু বন্ধনকে নিয়ে পীর বাবার কাছে যান দিনাজপুরে।বন্ধনের গ্রামের বাড়ী।
কেয়া তখন আড়াইনারি বা বিয়ের পর প্রথম বাপের বাড়ি নাইওর গিয়েছিল।
পীর দরবেশ বাবাকে মোটামুটি সব খুলে বল্লেন নানু।
নানুকে সরে যেতে বলে গম্ভীর গলায় পীর বন্ধনকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।
“বন্ধন সাহেব যা যা ঘটেছে সব খুলে বলুন তবে ঘটনা সত্য হওয়া চাই’
বন্ধনের শরীর জ্বলে গেল রাগে
“এক আল্লাহ ছাড়া আমি কাউকে মানি না,আর এই পীর আবার কি করবে?এদের ক্ষমতা কতদূর যে সব খুলে বলতে হবে?নানুর পাগলামীর জন্যে এখানে এসেছি,,, ‘
বন্ধনের ভাবমূর্তি দেখে পীর বাবা আঁচ করে ফেল্লেন, যে বন্ধন তাকে মোটেই পছন্দ করছে না, তাই বিরক্ত।
ফের পীর বলে ওঠেন,
“দেখুন আপনার যদি আমাকে ভালো না লাগে বা আমাকে যদি না বলতে চান তবে ফিরে যান,অযথা এখানে সময় নষ্ট করবেন না।’
পীরের এই কথায় প্রভাবিত হয় বন্ধন,
“শত হলেও তিনি পীরের উপাধিতে ভূষিত,গ্রামের একজন সম্মানিত ও স্থানীয় সবার প্রিয় মানুষ তার উপর বিরক্ত হওয়া ঠিক নয় তাছাড়া তিনি মুরব্বী তার সাথে ভালো ব্যবহার করা উচিত,, ‘বন্ধনের মনে হতে থাকে।
“জ্বী বলুন বাবা কি জানতে চান?’
“যে মেয়েটি আপনাকে অভিশাপ দিয়েছে তার সম্পর্কে বলুন।আমার মনে হয় তার সাথে আপনার সম্পর্ক অনেক বেশী গভীর ছিল,অর্থাৎ শারীরিক সম্পর্ক অবশ্যই ছিল তা না হলে এতটা মরিয়া হয়ে যেতো না, অভিশাপ দিতে পারতো না আপনাকে।’
বন্ধন এবার বিস্মিত হলো,পীরের বয়স খুব বেশী নয়,বন্ধনের চাইতে দশ কিংবা বারো বছর বড় হবে। তার ওপর সে শুদ্ধ ও সুন্দর ভাষায় কথা বলছে,অবাক হবার মতোই ব্যাপার।
“পাঁপিয়ার সাথে পরিচয় প্রায় পাঁচ বছর পূর্বে।আমরা একসাথে ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম।ইংরেজী বিভাগের ছাত্র আমরা দুজন।পাঁপিয়া যতটা সুন্দরী তার চাইতে ওর আলাদা কিছু গুন ছিল।বাবা দেশের একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি। বড়লোক মিনিস্টার এর মেয়ে পাঁপিয়া তখন থেকেই দামী গাড়ী হাঁকিয়ে ভার্সিটি আসতো।
জিনস,টিশার্ট, দামী ব্রান্ডের সুগন্ধী মেখে, কখনো কড়া মেকআপ সাজে, সে নিজেও গাড়ী চালিয়ে আসতো ভার্সিটিতে।প্রবল স্মার্ট, উচ্চাভিলাষী, আর ইংরেজি বিষয়ে তুখোড় যে কোন মানুষ বিশেষ করে ছেলেদের কাছে প্রধান আকর্ষন বা মাথা নষ্ট করার মতোই ব্যাপার ছিল তার ভেতর।’
“আর আপনার ভেতর?আপনার মাথা কি করে নষ্ট হয়েছিল সেটা বলুন।’বেশ আস্থার সাথে জিজ্ঞেস করলো পীর বাবা।
মাথাটা খানিকটা বাকিয়ে মৃদু হেসে ফের বলতে থাকে বন্ধন….(চলবে)দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-৬৯
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
“তা সে নষ্ট করতে পেরেছে আমার মাথাটাও এটা তার একটা ক্রেডিট বৈকি। কারন তখন সে যদি ঐ ব্যাচে প্রধান আকর্ষন হতে পারে আমিও কিছু কম ছিলাম না।আপনি সত্যিটা জানতে চেয়েছেন তবে শুনুন বয়োপ্রাপ্ত হবার পর থেকেই আমার পেছনেও বহু সুন্দরী রমনী বা তরুনীরা ঘুরঘুর করতো।তবে আমার প্রেম ছিল অন্যকিছু।ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল আকাশে উড়বো,প্লেন চালাবো,বাবা ছিলেন একজন আর্মি অফিসার তার থেকেই অনুপ্রেরণা পেতাম।মেয়েদের প্রতি তাই দূর্নিবার আকাক্ষা সেভাবে জাগতো না।’
“পাঁপিয়ার প্রতি কি করে জেগেছে তাহলে?যেভাবে ওর বর্ননা দিলেন আপনার প্রতি ওর আকর্ষন হওয়াতো তো একটা ব্যাপার ছিল।’
“তা তো ছিলো।আমিও সে ব্যাচে সুদর্শন ও ব্যাক্তিত্ববান বলে সমাদৃত হতে লাগলাম, ডিবেটিং ও খেলাধুলায় পারদর্শীতা তাতে যোগ হলো,মাথা নষ্ট হওয়ার জন্যে আর কি লাগে?’
“শুধু কি মাথা নষ্ট বা মোহ ছিল বন্ধন?ভালোবাসা ছিল না,তা বলতে চান?’
“না তা কেন হবে?ভালোবাসাটা অবশ্যই ছিল তবে একতরফা আমার দিক থেকে।আমি তাকে বিয়ে করবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম কিন্তু সে তখন তা প্রত্যাখান করলো,তার ক্যারিয়ারের দোহাই দিয়ে।’
“তারপর?’
“তার আগে কিছু কথা বলে নেই,বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার স্থায়িত্ব বেশীদিন ছিল না কারন তার কয়েক মাসের ভেতর আমি এম আই এস টি তে আমার স্বপ্নের সুযোগ পেয়ে যাই অ্যারোনেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হই।
এর মাঝে প্রিয় বাবা মারা যান,পাঁপিয়া জানতো বাবার সাথে আমার ঘনিষ্ট কতখানি, সে সময়টা পাঁপিয়ার কথা, সংস্পর্শ আমার কাছে নেশার মতো মনে হতে লাগলো।তারপর যা ভুল তা হলোই।’
“কি ভুল?’
“ঐ বয়সে দুজনেই তরুন,নিঃসঙ্গতায় কাছাকাছি আসা তারপর পাঁপিয়ার সাথে অন্তরঙ্গতা,,,,তারপর ভুল,, যে ভুলের কথা আপনি অনুমান করেছেন সেটাই পীর বাবা।’
কন্ঠস্বর খানিকটা কেঁপে উঠল বন্ধনের।
“কিন্তু আপনি ভুল বলছেন কেন আপনি তো তাকে ভালোবেসেছিলেন? ‘
” ভালোবেসেছিলাম বলেই বিয়ে করতে চেয়েছিলাম,সে রাজি হয় নি।বল্ল প্রস্তুত না।আমি তাকে সময় দিলাম তবুও তার নানারকম বাহানা,বিয়ের পর তার বাবার ফ্ল্যাট এ উঠতে হবে,সাথে সাথে বাচ্চা নিতে পারবে না কত শত শর্ত তার।
“কিছু শর্ত মানা যেত বিয়ের কিছুদিন পর বাচ্চা নেয়ার কথা বলতে পারতেন,ক্যারিয়ার গড়বে এটা খারাপ কি?আর তার বাবার ফ্ল্যাট আপনারা ভাড়া দিতে পারতেন এভাবে বলে কি আপোষ করা যেত না?’
“তা যেত তবে সে তো আমাকে রীতিমতো ডোমিনেটিং করতে লাগলো একসময় বল্ল আমার মা,নানু ও ভাইদের আলাদা থাকতে হবে,,,, আমার মা তখন অসুস্থ আপনিই বলুন পীর বাবা এটা কি করে সম্ভব?’
“হুম আপনার কথা শুনেই বুঝেছি বন্ধন পাঁপিয়া শুধু আপনাকে নিজের করে পেতে চেয়েছিল চরম স্বার্থপরতা ওকে অন্ধ করে তুলেছিল।’
“তারপর চলে যায় বেশ ক’বছর। আমাদের সম্পর্কটা যত দ্রুত আর গভীর হয়ে গিয়েছিল ওর এই ঔদ্ধত্বপূর্ন আচরন আমাকে বাধ্য করেছিল ওকে ছাড়তে।’
“তারপর পাঁপিয়া আর ফিরে আসার চেষ্টা করেনি?’
“করেছে,আমার উপর শোধ নিতে গিয়ে আমার আগে বিয়ে করে ফেল্ল,জামিল নামে আমাদেরই সহপাঠী সে, জামিল অবশ্য আগেই পছন্দ করতো তাকে।তাদের মেয়েও হয়েছে।কিন্তু কোন কিছুর তোয়াক্কা নেই তার।সব ছেড়ে দিবে আমার জন্যে আমার পরিবার নিয়ে এখন আর কোন বাঁধা নেই তার এবার নতুন শর্ত দিল কেয়াকে ছাড়তে হবে।কিন্তু কেয়ার সাথে আমার বাগদান হয়ে গেছে,তাছাড়া আমি এখন কেয়াকে ভালোবাসি এটা সে মেনে নিতে পারছে না, আমাকে এও বলে অভিশাপ দিয়ে গেছে, আমার কোন বংশধর থাকবে না।'(চলবে)