দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-৭৩
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
মিতালীর শরীরটা আগের চাইতে একটু ভালোর দিকে।
তিনমাসের কিছু বেশী সময় ধরে ডাক্তারের পরামর্শক্রমে ওষুধ খাচ্ছে।
বড় বোন সেতারা তার মালয়েশিয়া ফিরে যাওয়ার সময় বাড়িয়ে নিয়েছে।ছেলে নওশাতকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
সিমলা রয়ে গেছে তার সাথে।
মিতুর এ অবস্থা আর মুহিনকে এভাবে ফেলে চলে গেলে কোনভাবে শান্তি পেত না সেতারা।
মুহিন এবং মিতালীকেও মালয়েশিয়ায়, সাথে নিয়ে যাবে কিনা এসব নিয়েও ভাবে বড়বোন সেতারা নিরুপায় হয়ে।
“বন্ধনও আর আসে না,যোগাযোগও নেই কোন।
মিতুটা তো কেমন হয়ে গিয়েছে,শুধু পড়ে পড়ে ঘুমায় আর কি যেন ভাবে,,এখনও পেটে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলে।
বন্ধন পুরুষ মানুষ,পুরুষ লোক এমন মানসিক রোগী নিয়ে আর কতদিন সংসার করতে চাইবে?
তার ওপর হীমেল আর বড় মামী আজকাল মিতুর খোঁজ খবর বেশী নিচ্ছে।
হীমেল তো পুরো গোল্লায় গেছে,নিজের বউ, বাচ্চার কোন খোঁজ নিচ্ছে না,,
মামী আর হীমেলের এসব আদিখ্যেতা আচরন মোটেও ভালো লাগছে না।
মিতুকে সোজা সরল পেয়ে হীমেল আবারও কোনও টোপ ফেলতে পারে,মায়ের নামে যে সম্পত্তি আছে তা বাগে পাওয়ার উত্তম সুযোগ নিতে পারে সে অস্বাভাবিক কিছু নয়,,,কবে যে আমিই পাগল হয়ে যাব এসব ভেবে।’
প্রচণ্ড দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে সেতারা।
মিতু আবারও স্কুলে জয়েন করেছে প্রায় এক মাস হলো।সেই আগের স্কুলটায়,তবে বাবাইকে আর দেখে না মিতু।
ওর ক্লাসে কয়েকবার খোঁজ নেয়।ওর সহপাঠী বন্ধুরা জানায় বাবাই নাকি দেশের বাইরে চলে গেছে ওর চাচ্চু আবীরের কাছে।
মিতুর বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে, বন্ধন তাহলে কোথায়?যদিও বন্ধন অনেকবার মিতুকে ফোন করেছিল,মিতু তো অভিমানে কথাই বলা বন্ধ করে দিয়েছিল ওর জন্মদিন থেকেই।এমনকি যেদিন বাবু মিতুকে দেখতে ওর বাসায় আসলো ঐদিন,মিতু তো রাগ করে কথাই বলেনি বরং বন্ধনকে দেখে দূরে সরে গেছে ঘৃনায়।প্রচণ্ড অভিমানে মিতু তার মোবাইল সেটটাও বন্ধ করে রেখেছে,সিমটা পর্যন্ত খুলে ফেলেছে।সিম আর মোবাইলটা যে কোথায় রেখেছে তাও ভুলে গেছে।
গত তিনমাস বা তারও বেশী সময় ধরে সে টানা ঘুমের ওষুধ আর সাইকোলজিক্যাল কিছু মেডিসিন যেগুলো এংজাইটি দূর করে খেয়ে যাচ্ছে। এসব ওষুধ রোগ প্রতিরোধ করার পাশাপাশি যথেষ্ট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াশীলও বটে।আর ঘুমের ওষুধ খেলে তো এমনি স্মৃতিশক্তি কমে যায়।
এখন যে নতুন বছর চলছে,মিতুর যে বাবা মারা গেছে,বাচ্চাটা পড়ে গেছে তাও ভুলে যায় মিতু মাঝে মাঝে।
পারুলের বিয়ে প্রায় ঠিকঠাক।
পাত্র তারই পছন্দের ক্যাপ্টেন জামান।
যদিও পারুলের মা মিতুর ছোট মামী প্রথমে রাজী ছিলেন না তবে সেতারা ছোটমামাকে বোঝায় মিতুর হয়ে।
“জামান আর্মি অফিসার।মামী তো চেয়েছিল তার মেয়ে মিতুর মতোই সম্মান পাক,যেটা বন্ধনের গুনে পেয়েছে মিতু।জামানের সাথে বিয়ে হলে সম্মান ও সুবিধা সবই পাবে পারুল।মামীর এখানে আপত্তি কেন?তাছাড়া পারুল ও জামানকে বেশ পছন্দ করে,,মামীর আপত্তি হলে এই ছেলের ফেমিলি তো বসে থাকবে না,পারুলের জন্যে?ভালো মেয়ে পেলেই জামানের বিয়ে দিবে।’
মিতুর বাবার বাসায় আদাবরে কলিং বেল বাজছে।
সেতারা খুলে দেয় একটি মেয়ে এসেছে।
ফর্সা ছিপছাপ গড়ন মেয়েটি নাম বল্ল রানু,মিতুকে চাইছে।
“তুমি সেই রানু?এসো ভেতরে এসো।’
“ভাবীজান কই আপামনি?’
“তোমার ভাবী তো স্কুলে গেছে,ছুটি হয়ে যাবে কিছুক্ষন পড় তুমি বস ও চলে আসবে।’
“আপনি কি ভাবীর বোইন লাগেন?ভাবীর শরীরের কি অবস্থা এখন?’
“হ্যা আমি মিতুর বড় বোন,আছে ও কোনরকম বেঁচে আছে আর কি।কিন্তু কি ব্যাপার বলো তো তোমাদের কোন খোঁজ নেই।আমি আর মুহিন কত খোঁজ করলাম।বাসায় পর্যন্ত গেলাম।ধানমন্ডির বাসাটায় বিরাট তালা ঝুলছে।দারোয়ানও নেই।তারপর পাশের বাসায় খোঁজ করলাম কেউ কিছু বলতে পারে না।বন্ধন,নানু, বাবাই ওরা কোথায়,কেউ কিছুই জানে না,,,,বন্ধন কোথায় বলো তো রানু?’
“বন্ধন ভাই তো নাই?’
আঁতকে ওঠে সেতারা প্রচণ্ড জোরে,,,,
“নেই মানে কোথায় গেছে বন্ধন?'(চলবে)দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-৭৪
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
রানুকে দেখে ভীষন খুশি মিতু।সাথে সাথেই ওকে জড়িয়ে ধরল।
কিন্তু মিতুকে দেখে মোটেই চিনতে পারলো না রানু।
শুকিয়ে কেমন যেন হয়ে গেছে মিতু,গায়ের হাড়গোড় গুলো বের হয়ে তা জানান দিচ্ছে।
মুখটা ফ্যাকাশে,চোখগুলো কোটরে যদিও মিতালী ঘুমের ওষুধ খাচ্ছে এখনও তার ডিপ্রেশন এর ওষুধসহ।
কিন্তু গোলগাল সেই চেহারাটা কেমন শুকনো আর মলিন।
কাঁচা হলুদের রঙ মিতালীর সে রঙটাও এখন কত ময়লা হয়ে গিয়েছে।
রানুর ভীষন মায়া লাগলো মিতালীকে দেখে,অজান্তে চোখের কোণে পানি চলে এলো মিতুর জন্যে।
মিতুর কথাগুলোও কেমন জড়িয়ে যাচ্ছিল,বারবার আঁটকে যাচ্ছিল।
তবে ওর স্কুলের প্রিন্সিপাল মিসেস নোভেরা হক বড় ভালো মানুষ, মিতুর এ সমস্যাটা গুরুতরভাবে নেয় নি ছোট ক্লাস গুলো দিয়েছে মিতুকে যাতে তেমন অসুবিধা না হয় পড়াতে মিতুর।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটি সেনাবাহিনীদের আওতাভুক্ত,
যেটিতে বাবাই ও পড়তো।যার সুত্র ধরে মিতালী রহমান মিতুর বিয়ে হয়েছিল বন্ধন আহমেদ বাবুর সাথে।
চোখের সামনে রানু, যে মিতালীকে দেখেছে,সে মিতু মিতালী এখন আর সেই আগেরটি নেই।
“কি খবর বলোতো রারানু?এতদিন পরে মনে হলো বুঝি আআমার কথা?’
কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল মিতুর।এসব ওষুধের রিয়াকশন।
“ভাবীজান আপনের কথা আমার সবসময় মনে পড়ে বিশ্বাস করেন?’
মিতু এবার অন্যদিকে মুখ করে জিজ্ঞেস করে,
“আরর কারো মনে পড়ে না,,,?’
“পরে সবার মনে পড়ে,,,সবাই আপনেরে অনেক ভালোবাসে ভাবী।’
সেতারা এবার রেগে যায় শুনে,অনুযোগের সুরে বলে,
“থাক বাপু কেমন মনে পড়ে তাতো দেখলাম,একটা অসুস্থ এতীম মেয়ে মিতু,বাচ্চাটাও যার জন্যে হারিয়েছে সেই যে এল কবে আর কোন খোঁজও নিলো না আমার বোনের?ওর তো ভাগ্য ভালো যে ওর বড় বোন বেঁচে আছে না হলে আমার এতীম বোনটা ধুকে ধুকে মরত,,,।’
প্রচণ্ড অভিমানে সেতারার চোখ বেয়েও জল গড়িয়ে পড়ে।
রানু মাথা নীচু করে চুপ করে থাকে,কি বলবে সেও যেন অসহায়, জবাব নেই যেন তার কাছে?
“কোথায় মরেছে বন্ধন আহমেদ?নাকি যা ছিল এতোদিন আমার বোনের সাথে পাতানো সংসারের খেলা? এতদিনে একটা খোঁজও নিল না মিতালীর? কিভাবে পারলো ঐ বেঈমানটা?’ক্ষিপ্ত সেতারা।
রানু বলে ওঠে এবার,
“বন্ধন ভাই বেহদিস সেতারা আপা।’
“বেহদিস মানে?’
সেতারার জিজ্ঞাসা,মিতুও বোকার মতো তাকিয়ে থাকে রানুর দিকে কি বলছে বুঝতে পারে না।
“দুইমাস আগে বন্ধন ভাই এর মেঝো ভাই আসছিল দেশে,বন্ধন ভাই বাবাইরে হের লগে বাইরে পাঠায় দেয়।’
“তারপর?’
“তারপর কাউরে কিসু না জানায় বন্ধন ভাইজান যে কই গেল,যেদিন বাসা থ্যাইকা চইলা যায় তার আগের দিন আমারে বইলা যায় নানুর দিকে খেয়াল রাখতে,,,’
“নানু জিজ্ঞেস করেনি, বন্ধন কোথায় যাচ্ছে?’
সেতারার জিজ্ঞাসা ফের।
“নানু ঘুৃমায়া আসিলো, তয় বন্ধন ভাইজান চইলা যাওনের পর নানু পাগল হয়া হেই যে কান্দন,আবীর ভাইজান,নীবিড় ভাইজান কারো কাসে কোনো খোঁজ নাই,নানুর শরীর ভালা নাই,কানতে কানতে বুড়ী আন্ধা হয়া গেসে পাগল হয়া আসে, ভাবীজানের লেইগাও কানদে বুড়ী।’
“কি বলছো রানু এসব?বন্ধন এতদিন ধরে নিখোঁজ?দুমাসের বেশী হয়ে গেছে ওর কোনো খোঁজ নেই,,,!ওর আর কোন বাড়ীর লোক নেই,আত্মীয় স্বজন,বন্ধুরা কেউই কি জানে না বন্ধন কোথায়?’
“জানলে কি আর এই কথা কই?আর বন্ধন ভাইজানেগো আত্মীয় স্বজন বলতে তেমন কেউ নাই।নানুর শরীরটাও অনেক খারাপ কখন কি হয়া যায় তার ঠিক নাই,ভাবীর লেইগা,বাবাই এর লেইগা বুড়ী কত যে কানসে,,, এই শেষ বয়সে বুড়ীর শান্তি হইলো না।’
“কোথায় আছে নানু?আর তুমিই বা এতদিন পর আসলে কেন রানু আরও আগে কেন আসোনি?’
“আমার বিয়া হয়া গেসে আপা।’
সেতারা, মিতু অবাক হয়ে যায় শুনে।
“বিয়ে? কবে কার সাথে হলো তোমার?’জিজ্ঞেস করে সেতারা।
“আমার ফুপাজান ঠিক করসে আমার বিয়া,সে ঝিনাইদহেই থাকে,কাপড়ের ব্যবসা করে উনি।’
“আর নানু কই থাকেন কেমন আছেন?’
“নানু হের গেরামের বাড়ী দিনাজপুরেই থাকে,বন্ধন ভাইজানগো মার আর বাপের বাড়ী তো এক জায়গাতে, হেগো আত্মীয়োগো মধ্যে বিয়া হইসিল।নানু দুই বাড়ী মিলায়া থাকে।আমিও ছিলাম কিসুদিন কি বিরাট বাড়ী,বন্ধন ভাইজানেগো দাদী বাড়ী আর নানী বাড়ী।মিতু ভাবী যদি যাইতে পারতো,তাইলে দেখতো,গাসগাসালি,ধানক্ষেত,ফসল,হাসমুরগী খামার,পুকুর ঘাট সবই আসে,,,,,’
“আর কবে যাওয়া হবে,,,?’মিতু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কথাটা শুনে।
রানু চলে যাবার আগে মিতু জানতে চায় একটা কথা,
“নানু না তোমাকে নীবিড়েরর জন্যে পছন্দ করেছিল,আর তুমিও তো নীবিড়কে পছন্দ করতে?তাহলে বিয়ে কররে ফেল্লে যে,,,?’
রানু হেসে ওঠে কথাটা শুনে,
“গরীবের আবার পসন্দ? ‘
আর তেমন কিছু বলে না রানু,ওর কাঁধে ঝোলার মতো একটা ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে,মিতুর দিকে এগিয়ে দেয়,
“কি এটা রানু?’
“খুইলা দেখেন ভাবীজান।’
পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেটটা খুলতেই একটা শাড়ী বের হয়ে এলো।
চমৎকার রঙ, বেগুনী মিষ্টি জাম কালার আর মোটা সোনালী পাড়, সুন্দর সেডের টাঙাইলের সুতি শাড়ী।
রানু এটা এনেছে তার স্বামীর দোকান থেকে।
নিজে পছন্দ করেছে মিতুর জন্যে।
মিতুর চোখদুটো আনন্দে ঝিলিক দিয়ে ওঠে,
“এটা আমার জন্যে এনেছো রানু?কিন্তু কেকেন?আমি তো তোমাকে কিছুই দেই নি,হসপিটালে তুমি ররক্ত দিলে আববার বিয়ে হলো তোমার, আমাররই তো দেয়া উচিত?’
“কি যে কন ভাবী,আমি যখন আপনেগো কাসে সিলাম আপনে আমারে আপনার আলমারী থ্যাইকা শাড়ী,সালোয়ারকামিজ দেন নাই,আমারে রান্না কইরা খাওয়ান নাই?’
“কিন্তু ররানু আমি তো তোমমার গায়ে হাতও তুললেছিলাম আর তুমি আমাকে রক্ত দিয়য়ে জীবন বাঁচিয়েছো।’
“ভাবীজান জীবন বাচানোর মালিক ঐ উপরওয়ালা,আপনের শরীলে আমার রক্ত গেসে ওখন আমি আপনের রক্তের বোইন আর ঐগুলি কি কন,আমি ছোড বোইন ভুল করসি আপনে বড় বোইন হয়া আমারে শাসন করসেন,,,, ‘
রানু এসব কথা বলতে বলতে ওর গলাটা কেমন ভারী হয়ে আসে।
খুব অবাক মিতু, যে মানুষটাকে সে ভুল বুঝেছিল সে মানুষটা আসলে খারাপ নয় আর যে মানুষটাকে সে অন্ধের মতো ভালোবেসেছিল,বিশ্বাস করেছিল আজ তার কোনো খোঁজই জানে না মিতালী,,,!
রানুর কথা শুনে সেতারাও বিড়বিড় করে রহিমা খালার কাছে।
“কোথায় গেল বন্ধন,পাঁপিয়াও তো জেলে নেই?ও নাকি পালিয়েছে ওর বাবা বিদেশে নাকি পাঠিয়েছে মেয়েকে গোপনে,তবে কি বাবু,,,,,?’
কথাটা মিতুর কানে আসে ওর বুকের ভেতরটায় দমকা হাওয়া বইতে থাকে পাঁপিয়া পালিয়েছে শুনে।(চলবে)দ্বিতীয় বাসর (গল্প), পর্ব-৭৫
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
পাঁপিয়া পালিয়েছে।ঢাকা কেন্দ্রীয় কারগারে নেই সে।গা ঢাকা দিয়েছে দেশের বাইরে।তার প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী বাবার ক্ষমতা ও কিছু নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাকে গোপনে দেশের বাইরে পাঠানো হয়েছে।খবরটি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের কর্ণধার এবং বন্ধনের বন্ধু সাংবাদিক কাজল জানায় বন্ধনকে।
খবরটা শোনার পর থেকে মস্তিষ্কে আগুন ধরে যায় বন্ধনের।হতভম্ব হয়ে যায় সে।
“দেশে এসব হচ্ছেটা কি?এরকম একটা খুনী কিভাবে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালালো?কাস্টমস অফিসাররা কি ভাং খায়,যে পাঁপিয়া তাদের নাকের ডগায় পালিয়ে গেল?’
কাজলের কাছে জবাব চায় অসহায় ভাবে বন্ধন।
মিতু আর বন্ধনের ভালোবাসার প্রথম চিহ্ন তাদের সন্তান, পাঁপিয়ার কারনে মিতুর শরীর থেকে ঝরে গেছে।
আর মিতুর শরীরে যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাকেও বের করে দিতে হয়েছিল,কতটা কষ্টের ছিল সে মুহূর্ত গুলো!
বন্ধনের ধানমন্ডির বাসায় বৈঠকখানার কার্পেটটায় সেই অবুঝ নিষ্পাপ সন্তানের রক্ত আজও লেগে আছে।
সেগুলো আবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে বন্ধনের।
তার ঘরের দেয়ালে হাত মুঠো করে সজোরে আঘাত করে বন্ধন।
প্রচণ্ড হতাশা আর তীব্র ঘৃনায় নুয়ে পড়ে বারবার কি করবে এখন সে।
যে পাঁপিয়া রূপী ডাইনীর কারনে বন্ধনের জীবনে একের পর এক অভিশপ্ত ঘটনা ঘটেই চলেছে,মিতালী পর্যন্ত এখন তাকে ঘৃনা করে।
“আর করবেই বা না কেন আমি ভুল করেছি,আমার মিতুকে আরো আগেই সব খুলে বলা উচিত ছিল।ও আমার কাছে জানতেও চেয়েছিল আমি বলতে গিয়েও পারিনি বলতে,,ও কষ্ট পাবে বলে এখন অজান্তেই কত কষ্ট পেয়ে গেছে।ওর কতো বিপদ যাচ্ছে, নিজের বাবার অন্তীম দিনেও ভাগ্য হয়নি, বাবার মুখটা শেষবারের জন্যে দেখার।আমার এখন সবসময় ওর পাশে থাকা উচিত,কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আমাকে সে ঠিকমতো চিনতে চাইছে না,যদিবা চিনছে,বাবু কই তার মেয়ে কই আমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছি এসব বলে আমায় দোষারোপ করছে।আমার ভুলের কারনে কেয়া শাস্তি পেয়েছে, আমারি ভুলের কারনে আবারও মিতু সেই একই শাস্তি পাচ্ছে বাচ্চাটাকে হারিয়ে,,,,অথচ কেউ তারা দোষী নয়?দোষী তাদের ভাগ্য আমার সাথে জড়িয়ে,,,এইবার বন্ধন আহমেদ তুমি আর কত ভালো সাজবে?পাঁপিয়াকে খুন করে তবে তোমার মুক্তি,,, ‘
আপন মনে ভেবেই যাচ্ছে বন্ধন নিজের মনে।
ফের কাজলকে ফোন করে বন্ধন কিভাবে কি করবে,ব্যাকুলতায় দিশেহারা সে।
“আমি বলিকি বাবু,তুই বরং জামিলকে ফোন কর।’
বুদ্ধি দেয় কাজল বন্ধনকে।
“কি বলিস,আবার জামিলকে ফোন করবো,ওর কথা শুনতে গিয়েই তো আজ আবারও সেই একই অঘটন ঘটল,তাছাড়া ও কি আমাকে বুঝবে? পাঁপিয়াকে জড়িয়ে আমাকে গালাগাল দেবে জামিল।’
“দোস্ত গালাগাল খেতে হলে খাবি,পাঁপিয়া পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে তোকে,এখন জামিলের সাথে যোগাযোগ ছাড়া তোর আর কোনো পথ নেই।তাছাড়া জামিলকে আমি যতটুকু দেখেছি সাদাসাপটা নরম মনের মানুষ।পাঁপিয়া ওর সাথে যা করেছে তারপরও ও সব ভুলে ও কিন্তু আবারও চেয়েছিল সংসারটা করতে।মেয়ে তন্নীকে সে জীবনের চাইতেও ভালোবাসে,মেয়ের কথা ভেবে সে আর একটা বিয়ে পর্যন্ত করেনি।ভেবে দেখ বাবু,,,।’
বন্ধনও সায় দেয় কাজলের কথায়।
“ঠিকই বলেছিস,কেয়া মারা যাবার পর উদ্ভ্রান্ত হয়ে আমি রাস্তায় ঘুরছিলাম হঠাৎ সজোরে আসা পিকআপ থেকে এই জামিলই আমাকে বাঁচিয়েছিল।ভয় হয়,ও কি আমাকে বুঝবে এখন,নাকি মিতুর মতোও আমাকে ঘৃনা করতে চাইবে?’
“দেখ বাবু,এসব নিয়ে পড়ে ভাবা যাবে,তাছাড়া তুইও ঋৃন শোধ করতে চেয়েছিলি,পাঁপিয়া তোকে তার শরীরি বলে ট্রেপে ফেলতে চেয়েছে,আর পরিস্থিতি পুরোভাবে পাঁপিয়ার পক্ষে ছিল।পাঁপিয়া তোর জন্যে কতটা ক্রেজি সেটা আমরা বন্ধু মহলে সবাই মোটামুটি জানতাম, আর চোখেও দেখেছি,কিভাবে যখন তখন তোকে ফোনে বা বাসায় এসে বিরক্ত করতো,সেটা তো জামিলেরও অজানা ছিল না এখানে দোষ থাকলে তোর একার কেন হবে?জামিলই বা সব জেনে শুনে পাঁপিয়ার কাছে তোকে কেন পাঁঠালো,তুই ও তো প্রথমে রাজি হোস নি ওর অসভ্য বউ এর কাছে যেতে,ওর হয়ে কথা বলতে,,?’
“আচ্ছা এবার নাম্বারটা দে জামিলের কথা বলে দেখি।’
“আই সাজেস্ট তুই বরং জামিলের গুলশানের বাসাটায় যা আমি এডরেস দিয়ে দিচ্ছি।আর একটা কথা তন্নী কিন্তু সুইসাইড এটেম নিয়েছিল শুনেছিস কিনা?’
“কি বলছিস কবে?এখন কেমন আছে?’
“আছে ভালোই আছে। জামিলের সাথে আছে।জামিলের ঐ বাসাটায় তার মা,বাবা আর বিধবা বোন আছে।
পাঁপিয়াকে নিয়ে যখন নানা স্কেন্ডাল ছড়ালো,মিডিয়ায় ওর আসল রূপ বের হলো তারপর কারগারে যাওয়ার পর তন্নীর ক্লাসে যাওয়া অসহনীয় হয়ে পড়লো।মেয়েটা জামিলের স্বভাবই পেয়েছে অনেক নরম মনের।এ ব্যাপার গুলি স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে নি তারপর আর যা হয় আর কি, একদিন তার মিউজিক ক্লাস শেষ করে বের হচ্ছিল ওর মাকে নিয়ে অপদস্থ হতে হয়েছে দেন ঘুমের মেডিসিন অনেকগুলি খেয়ে ফেলে ওর নানা বাড়ীতে।জামিল শুনেই আর দেরী করেনি।মেয়েকে বাঁচানোর জন্যে নিজেই দৌড়াদুড়ি করে।বাবাকে দেখে তন্নী আর নানাবাড়ীতে ফিরে যায় নি।বাবার কাছে চলে আসে।আর পাঁপিয়া সবে দেশের বাইরে অন্যদেশের মাটিতে।মেয়ের এই খবর শুনে সাথে সাথে ফোন করে জামিলকে সেদিন তো এপোলো হসপিটালে আমিও ছিলাম।জামিলই আমাকে জানালো সেদিন, পাঁপিয়া নেই এদেশে ইংল্যান্ডে পালিয়েছে।
সব শুনে মাথা ঠান্ডা করে ভাবে বন্ধন।কাজলের কথামতো আবারও দারস্থ হয় সে জামিলের কাছে।
এ শহর, এদেশের মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পাঁপিয়া পালিয়েছে ঠিকই,পাঁপিয়া পালিয়েছে তার সাবেক মন্ত্রী বাবার সেকেন্ড হোম ইংল্যান্ডে অবস্থিত লন্ডন নগরীতে।যেখানে অন্যদেশের নামী দামী সুপারষ্টার,খেলোয়াড় বা নেতারা পয়সা আর পাওয়ারের জোরে জমি বা বাড়ী কিনে নিজের নামে সেকেন্ড হোম গড়তে সক্ষম।
কাজলের পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত নেয় বন্ধন ঠানন্ডা মাথায়।জামিলের কাছ থেকে ভালোভাবে জেনে পাঁপিয়া
কোথায় আছে।
জামিল এবারও তেমন কিছুই বলে নি।সে তার মেয়েকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবে বলে জানায়।
বন্ধনও জানায় তার বন্ধু জামিলকে,
“বন্ধু তখন তুমি আমাকে পাঠিয়েছিলে আজ আমি নিজে যাবো ঐ পাপী পাঁপিয়ার কাছে শেষ বোঝাপড়া করতে,,’
ফের মনে মনে বলে বন্ধন,
“এ শহর, আইন কানুন থেকে পালিয়ে বেঁচেছে পাঁপিয়া তবে এইবার আমার হাত থেকে ওকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।’
পারুলের বিয়ের কেনাকাটা চলছে বেশ সমারোহে।
সেতারা চায় তার বোন মিতু তাদের আরেক আদরের মামাতো ছোট বোনটার বিয়ে উৎসব,কেনাকাটা এসব নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখুক।
তাছাড়া মিতালীর এসব ভীষন পছন্দের।আর হবেই বা না কেন বিয়ের ঘটকালী বলতে গেলে মিতালীই করেছে বেশ আগ্রহ নিয়ে।
যদিও শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষন অসুস্থ মিতালী,তবু যতটা সম্ভব এ বিয়ে ঠিকঠাক হবার জন্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে সে।
পারুল ফেইসবুকে অনলাইন শপিং,ব্রাইডাল লুক ইত্যাদি বিভিন্ন পেইজ থেকে কিছু বিয়ের সাজ সজ্জা ও শাড়ী,গহনার ছবি ডাওনলোড করে।
সেগুলো তার প্রিয় দুইবোন,সেতারা আর মিতুকে দেখায়।
মিতু পারুলের ল্যাপটপে খুব মনোযোগী হয়ে এসব দেখে। হঠাৎ একটা ছবিতে ওর চোখ আঁটকে যায়।
খুব সুন্দর চকলেট,ব্রাউন আর গোলাপী রঙে বিভিন্ন ফ্লাওয়ারস আর হার্ট শেডের নকশায় সুসজ্জিত বড়সড় কেক দেখতে পায়।
কেকের গায়ে লাল রঙা তাতে লেখা,
“ইটস এ প্রমিজ,উই উইল সি দ্যা নেক্সট সানসাইন
এন্ড ফোর এভার
হ্যাপি বার্থডে মিতু মাই লাভ💘’
চোখে চশমা মিতুর,চশমাটা খুলে মুছে আবার পড়ে লেখাগুলো,ল্যাপটোপের স্ক্রীনে হাত দিয়ে স্পর্শ করে সে।
মিতু পারুলকে বলে, জন্মদিনের এই কেকের ছবিটা ওর মোবাইলে দিয়ে দিতে।পারুল দিয়ে দেয় ছবি আরও কিছু ফুলের ছবিসহ যেগুলো বন্ধন মিতুর জন্মদিনে এনেছিল কতনা যত্ন করে?
সেতারা ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে আলমারীতে পায় মিতুর হারিয়ে যাওয়া মোবাইলটা। কিন্তু সিম খুলে রেখেছিল সেটি আর খুঁজে পায়নি মিতু।
এক বুক কষ্ট আর প্রচণ্ড অভিমানে মিতু কি না করেফেলেছে।নিজের ভালোবাসার মানুষকে সে দূরে ঠেলে দিয়েছে।অথচ বন্ধন হসপিটালে ওর ব্লাড সরবরাহের জন্য সারাদিন না খেয়ে দৌড়েছিল।সকালে তার আদরের ভাইকে সে একা গিয়ে ছাড়িয়ে এনেছিল কারাগার থেকে।তারপর মিতুর বাবা মারা গেলে বড় ছেলের মতো দাফনের কাজও দায়িত্বের সাথে পালন করেছে।মুহিনের প্রাইভেট ভার্সিটি ভর্তির পুরো টাকা সে দিতে চেয়েছিল,সেতারা বাঁধা দেয়ায় অর্ধেক টাকা সে দিয়েছে।সবরকম দায়িত্ব পালন করেছে তার বন্ধন বাবু।
আর সে কিনা অভিমানে জন্মদিনের কেকটাও ভালো করে দেখেনি।সেদিন এসেও তো ছিল তার বাবু তার জন্মদিনে তার কাছে অথচ সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
“সেদিন বোধহয় হীমেল ভাই এসেছিল ফুলও এনেছিল সাথে ?কিন্তু আমার বাবুর হাতেও অনেক ফুল ছিল,,,’
মনে করার চেষ্টা করে মিতু।
রাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে মিতু।মোবাইলটার স্ক্রীনে হাত দেয় কেকের সেই ছবিটায়, মিতুর জন্মদিনে তার বাবু একথা গুলি বলেছে তাকে পারুল জানায়।
কিছুতেই ঘুম আসে না মিতালীর,যদিও আজও তো খেয়েছে ঘুমের ওষুধ।
বুকটা হাহাকার করে মিতুর প্রচণ্ড আর্তনাদে,কি ভীষন মিস করছে তার স্বামী,তার বাবুকে,
প্রবল ব্যাথায় ফোঁপাতে থাকে মিতু,,,
আবারো সেই আগের ঢঙে বাবু বাবু বলে ডাকতে থাকে,
“বাবু আপনি কই?আমার ভুল হয়ে গেছে,আপনি ফিরে আসেন ,,,আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না,,,প্লিজ ফিরে আসেন তাড়াতাড়ি আমার বুকে,,,,মরে যাবে আপনার মিতু আপনাকে ছাড়া,,,,,,'(চলবে)