দ্বিতীয় বাসর পর্ব ৯১+৯২+৯৩

“দ্বিতীয় বাসর ‘(গল্প) পর্ব-৯১
হাসিনা সাঈদ মুক্তা

সেতারা বোনকে আস্তে করে ডেকে তুলছে।
বেলা দশটার কাছাকাছি বেজে গিয়েছে।
আজ শুক্রবার, স্কুল নেই তাই আর একটু ঘুমিয়ে নিতে চায় মিতালী মিতু।
তাছাড়া রাতে তো ডিপ্রেশন এর ওষুধের সাথে ঘুমের ওষুধ নিতে হয়।
তিন মাসের ওপরে ওষুধ চলছে।এখন মিতালী আগের চাইতে অনেকটাই স্বাভাবিক তথাপি সাইকোসোমাটিক রুগীদের ছয়মাসের একটা কোর্স থাকে এসব ওষুধ নিতে।
ছয়মাসের আগে ওষুধ ছাড়া যাবে না এমন পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসক।
সি এম এইচের ডাক্তারদের কাছে ইচ্ছে করেই যায় না সেখানে গেলেই ডকটর বন্ধন বাবুর কথা জিজ্ঞেস করে।
মিতু কিছুই বলতে পারে না বরং অারো অস্বত্তি লাগে তার। তাই সেতারা ওকে স্কয়ার হসপিটালে সাইকোথেরাপির জন্য মানসিক ডাক্তার বা সাইকোলজিস্ট এর কাছে নিয়ে যায়।
সাইকোলজিস্ট ডাক্তার আলম এর আন্ডারে তিনমাস ধরে চিকিৎসাধীন মিতু।বেশ খুশী ডাক্তার আলম মিতুর দ্রুত ইম্প্রুভম্যান্ট দেখে।
কারন হঠাৎ করে মানসিক অসুস্থতা অথবা ডিপ্রেশন দেখা দিলে,রোগীদের সেড়ে উঠতে বেশ সময়ও লেগে যায়।কারো ছয় মাস কারো একবছর বা তারও বেশী সময়ও লাগতে পারে কোন কেইসে।
তবে মিতালীর আর ওতো দিন লাগবে না ডাক্তার বল্লেন।
তবে লাস্ট যখন ডাক্তারের কাছে গেল ডাক্তার আলম তাকে এডভাইস করলো কিছু জিনিস।
শরীর আগের চাইতে ভালো হলেও মৃদু ডোজ ওষুধ চলবে এবং রেগুলার চেকাপে থাকার পরামর্শ দিলেন ডাক্তার মিতুকে।

“মিতু এই মিতু ওঠ তো…।’
আস্তে করে ডেকেছিল সেতারা যাতে ধরফড়িয়ে না ওঠে মিতু।
“হ্যা আপু কি হয়েছে?আজ তো স্কুল নেই আর একটু ঘুমাবো।’
মোবাইলের ঘড়ীর দিকে তাকায় ঘুম কাতুরে মিতু।
“তাড়াতাড়ি ড্রইংরুমটায় যা তো তোর জরুরী ফোন এসেছে।’
ফোন এসেছে কথাটা শুনেই এবার প্রায় লাফ দিয়ে ওঠে মিতু।
“গতরাতে যে কল দিলো সে নয় তো?’ভাবতে ভাবতে দৌড়ে যায় বৈঠকখানার ল্যান্ড ফোনটা রিসিভ করে।
“হ্যালো কে?’
“মিতু ভাবী আমি রানু বলতেসি।কেমন আসেন ভাবী?’
” এই তো আছি। তুমি কেমন আছো?কোত্থেকে ফোন করেছো?’
“ভাবী আমি তো দিনাজপুরে আপনার আসল শ্বশুরবাড়িতে।’
মিতুর বুকটা কেমন করে উঠলো যেন শ্বশুরবাড়ির কথা শুনে।
“তাই? নানু কেমন আছেন রানু?’
“হের ল্যাইগাই আপনেরে ফোন দিসি ভাবী,নানুর শরীর ভালা নাই,হেই যে আপনের অসুখ আর বন্ধন ভাইজান,বাবাই বাবা সব একলগে যাওনের পর বুড়ীটা পাগলের মতো হয়া আসে,খালি কান্দে।কখন যে কি হয়?’
মিতু ভীষন অস্থির হয়ে যায় কথাটা শুনে।
“কি বলছো রানু! নানুকে দেখার একটা লোকও নাই?আর তার বাবু সোনা কোথায় মরেছে?নানুকে নিজের কাছে এনে রাখবে না?’
রেগেও যায় মিতালী এবার।
“বন্ধন ভাই তো আইসিল…।’
“কবে?’
“পরশুদিন বিকালে আসছিল নানুরে দেইখ্যা চইলা গেসে।’
“তারমানে বন্ধন ঐদিন রাতে আমার কাছে এসে সাথে সাথেই নানুর কাছে চলে গিয়েছে….।’মনে মনে ভাবে মিতু তিনদিন আগের কথা ভেবে।
“কোথায় গেছে বন্ধন?আর আসে নি নানুর কাছে?’
“না ভাবি।বন্ধন ভাই এর যে কি হইসে? নানুরে ধইরা কি কান্দোনের কান্দন তারপর নানুর কাসে মাফ চাইলো তারপর…।’
“তারপর?’ গলা শুকিয়ে আসে মিতুর।
“ভাবী আপনে যেমনে পারেন দিনাজপুরে চইল্যা আসেন।নানু, ভাইজান হেরা কেউই ভালা নাই সবগুলা একলগে পাগলের মতো হয়া আসে…ওখন আপনেই পারবেন সব ঠিক করতে..।’
“হুম বাট কিভাবে আসবো কোথায় কার সাথে সেটাই বুঝতে পারছিনা।’
“বুঝোন লাগবো না কাউরে সাথে কইরা আসেন।’
“ঠিক আছে।আচ্ছা রানু তোমার বন্ধন ভাই যাবার আগে কিছু বলে যায় নি?’
“হো কইসে আমার নানুটারে তোমার কাসে দিয়া গেলাম তারে দেইখ্যাশুইন্যা রাখবা তুমি ছাড়া তার এখন কেউ নাই আর।’
“তাই বলেছে ?তুমি কি বল্লা শুনে?’
“আমি মূর্খ সূর্খ মানুষ আমি কি কমু ভাবী?তয় ভাবী একটা কথা কই আমার কেন জানি মনে হয় বন্ধন ভাইরে কেউ তাবিজ কবজ করসে নাইলে জ্বীনের আসর করসে,নাইলে এইভাবে সংসারটা শেষ হয়া যাইতো না কন….?’
মিতু কি বলবে ভেবে পায় না।
তার কপালে ফের চিন্তারেখা সেই সাথে অস্থিরতা বাড়ছে আবার সেই আগের মতো।
তবু দমে যায় না মিতু,নিজেকে স্বাভাবিক করে ঠান্ডা মাথায় দৃঢ়চিত্তে বলে,
“কিছুই শেষ হয়নি….আমি আসছি।’

রানুর সাথে কথা শেষ হতে না হতেই এবার তার মোবাইলটা বেজে ওঠে।
স্ক্রীনে দেখে সেই গতরাতের নাম্বার।
“হ্যালো?’
ভারাক্রান্ত কন্ঠে কেউ বলে ওঠে,
“মিতু আপু আমি আঁখি।’
“হ্যা আঁখি বলো কেমন আছো?’
“এই তো আপু,আপনি কেমন আছেন?শরীরটা ভালো আছে আপনার?’
“এই তো আছি ভালো আলহামদুলিল্লাহ্‌।তোমার তো সুসংবাদ পেলাম আঁখি কংগ্রেচুলেশন!’
আঁখি চুপ করে থাকে শুনে ফের বলে,
“মুহিন কেমন আছে মিতু আপু?’
এবার মিতু চুপ কি বলবে ভেবে পায় না সে..। (চলবে)”দ্বিতীয় বাসর’ (গল্প),পর্ব-৯২
হাসিনা সাঈদ মুক্তা

আঁখির কথা শুনে নিশ্চুপ মিতু।কি বলবে বুঝতে পারেনা।তাছাড়া রানুর সাথে কথা বলার পর ওর মনটা পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো ছটফট করছে।
গলাটা তারও ভারী হয়ে আসতে চায়।তবু সহজ কন্ঠে বলে,
“আছে…ও ভালো আছে।কেন ওর সাথে কথা হয় না তোমার? ‘
“না আপু।’
“কেন?কি হয়েছে..?’
“মা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে শুনে,মুহিন ভীষন মন খারাপ করে ফেলে তারপর থেকে আমার সাথে কথা বলে না, আমার ফোনও ধরে না…আপনি বলেন আপু এখানে আমার কি দোষ?’
“তাও তো ঠিক?আচ্ছা আঁখি কেন তোমার বন্ধু মন খারাপ করেছে জেনেছো?’
কিছুক্ষণ চুপ করে আঁখি বলে,
“আপু, মুহিন আসলে আমাকে অনেক পছন্দ করে…।’
“আর তুমি?’
“আমিও করি তবে…’
“তবে?’
“আপু মুহিন আমার খুব ভালো বন্ধু,ওর মনমরা আমার সাথে কথা না বলা আমাকে ভীষন কষ্ট দিচ্ছে…।’
“হুম বাট আঁখি সত্যি একটা কথা বলবে?’
“জ্বী বলেন?’
“তোমরা কি শুধুই ভালো বন্ধু?নাকি সম্পর্ক হয়েছিল তোমাদের?মুহিনের সাথে যোগাযোগ না করতে পেরে তুমি কষ্ট পাচ্ছ আর মুহিনও কেমন চুপচাপ হয়ে আছে।কি ব্যাপার বলো তো?’
“বিশ্বাস করেন আপু আমরা খুব ভালো বন্ধু বাট এখন মনে হচ্ছে….’
“কি?’
“আমিও মুহিনকে অনেক পছন্দ করে ফেলেছি….আপু আপনি কি কিছু করতে পারেন?’
গলাটা খানিকটা কেঁপে ওঠে আঁখির যেন কথাটা বলে।
আবারও কিছুক্ষণ চুপ করে মিতালী বলে ওঠে,
“দেখো আঁখি আজ কিছু কথা বলি একটু মন দিয়ে শোন।’
“বলেন আপু।’ব্যাকুলতা আঁখির।
“আন্টি যেখানে তোমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন, সেখানে আমার কিছু করার নেই,সে অধিকারও আমার নেই।কারন,প্রথমত তিনি তোমার মা,আর মা সবসময় তার মেয়ের মঙ্গল চাইবে।যদিও তোমার বিয়ের উপযুক্ত বয়স এটা নয়,তবু ডাক্তার পাত্র আন্টি কখনোই হাতছাড়া করবেন না।আর আমার ভাইটাতো এখনো ছোটমানুষ সবে মাত্র ইন্টার পাশ করে ভার্সিটিতে এডমিট হয়েছে,এখনো একটা সেমিষ্টারও শেষ হয়নি।আর তুমি তো তাও বিয়ের পরও পড়তে পারবে চাইলে ক্যারিয়ারও গড়তে পারবে যদি হ্যাসবেন্ডের সাপোর্ট পেয়ে যাও।কিন্তু মুহিনের সাথে এখনই তোমার কিছুই ঘটানো সম্ভব নয় আঁখি?যদিও আমিও তোমাকে অনেক পছন্দ করি।তাছাড়া আমি ওর বড় বোন হয়ে তোমাদের এভাবে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে পারিনা।আর এটাও ডেফিনেটলি করে বলতে পারিনা তুমি মুহিনের জন্যে অপেক্ষা করো।কারন মুহিন একটা ছেলে ওর পুরো ফিউচার পড়ে আছে, অনেক স্ট্রাগল করতে হবে ওকে উঠে দাঁড়াতে।আনটি নিশ্চুই ততোদিন অপেক্ষা করবেন না?’
আঁখি পুরোপুরি চুপ হয়ে যায়,ওপাশ থেকে ওর দীর্ঘশ্বাস এর আওয়াজ পায় মিতু।
আঁখি আর কিছু বলে না।
“ঠিক আছে আপু ভালো থাকেন আমার জন্যে দোয়া করেন। ‘বলে ফোনটা রেখে দেয়।
মিতালী মনে মনে ভাবে,
“আমি কি আঁখিকে বেশী বলে ফেল্লাম,মেয়েটা আশা নিয়েই ফোন দিয়েছিল মনে হয়….কিন্তু মিছে আশা ওকে দেই কি করে?পরে কষ্ট পাওয়ার চাইতে এখন যা পাওয়ার পাক…তবু ভালো থাক।’

কদিন বাদে শবে বারাতের রাত।মিতু মনে মনে ঠিক করেছে,ঐদিন দিনে রোজা রাখবে,সারারাত ইবাদত বন্দেগীতে কাঁটিয়ে দিবে।আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করবে তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে দিনাজপুরে রওনা দিবে।মুহিনকে বলে রেখেছে ওকে দিয়ে আসতে।রানুর কাছে আবার ফোন করে জায়গা,ঠিকানা সব বুঝে নেয় সে।রানুর ফোন নাম্বারটাও সেভ করে রাখে।তার আগে স্কুলের হেডমিষ্ট্রেস ম্যাডামকে জানিয়ে দেয় ছুটি চায় শ্বশুরবাড়ী দিনাজপুর যাবে বলে।ম্যাডাম নোভেরা হক ভালো মনের মানুুষ মিতুকে অনেক পছন্দ করেন।
“যাও ঘুরে আসো মিতু, ইউ নিড টু চেইঞ্জ এন্ড বেস্ট অফ লাক। ‘বলে সমর্থন দেন নোভেরা হক, মিতালীকে।
মোবাইল এর ম্যাসেজটোন বেজে ওঠে তার।ম্যাসেজ আসলেই মিতু চমকে যায় তার বন্ধন বাবু কোনো ম্যাসেজ তাকে পাঠালো কিনা।
সেটটা হাতে নিয়ে দেখে পারুলের ম্যাসেজ।
খুলে পড়ে মিতু,
“মিতু আপু তুমি কি ব্যস্ত?ফোন করেছিলাম ধরছিলেনা যে?শরীর কেমন তোমার?কাল একটু সময় দিতে পারবা?জামান বলছিল ওদের বিয়ের শাড়ীটা কেনা হয়নি,আমাকে নিয়ে যেতে চায়,তুমি কি যাবা?আর হলুদের তো এখনো অনেক কিছু বাকি আছে কেনা, কবে যাবা জানিও….।’
ম্যাসেইজটা পড়ে কেমন যেন বিরক্ত মিতালী। সবকিছুতেই পারুল ওকে টানছে।
“কিন্তু এখনো কেন?জামানের সাথে তো গিট দিয়েই দিয়েছি তারপরও কিছু হলে আমাকে টানবে?’
ভাবে মিতু।
রিপ্লাই পাঠায় মিতালী।
“আমি ভালো আছি পারুল।বিয়ের শাড়ী তোরা কিনবি তোরাই পছন্দ করনা আমাকে কাবাব মে হাড্ডি হতে বলছিস কেন?আর হ্যা আমি বেশ কিছুদিন ব্যস্ত থাকবো,তোকে সময় দিতে পারবো না।আর হলুদ নিয়ে এতো টেনশান কিসের?সবই তো ঈদের পরে….আমি না থাকলেও সেতারা আপু যাবে। তাছাড়া তোর শ্বশুড়বাড়ির মানুষ আছে,ওরা যেভাবে যেটা চাইবে সেভাবে কেনাকাটা কর পারুল।আমাদের চেয়ে এখন তোকে ওদেরকে সাথে নিয়ে কেনাকাটা করা উচিত।’

শবে বারাতের দিনটা রোজা রাখলো মিতু।সেতারাও রেখেছে, যদিও বারন করে সেতারা মিতুকে এখনই রোজা না রাখার জন্যে।কারন সকালেও ওষুধ আছে তার।ভোর রাতে দুবোন কিছু খেয়ে নেয়।বুটের আর গাজরের হালুয়াটা আগের দিনই বানিয়ে রাখে সেতারা,মিতুকে কিছু করতে দেয় না এবার।মিতু কয়টা চালের রুটি বেলে দেয় ওগুলো খায় দুবোন হালুয়া দিয়ে আর নীচতলায় রহিমা খালা, রশিদচাচাকে কিছু পাঠায়। ফজরের আযানের আগে মিতু ওষুধগুলো খেয়ে নেয়।

সকাল থেকেই হঠাৎ করে মাথাটা চক্কর দিচ্ছে মিতুর।তাছাড়া বমিও আসছে মনে হচ্ছে তার।
সেগুলো আমলে নেয় না মিতু।অনেকদিন পর রোজা রাখায় হয়তো পেটে গ্যাস হয়েছে, তাছাড়া নানুর খবর পাওয়ার পর দুশ্চিন্তা হচ্ছে এসব কারনে বমীটা হয়েছে তার এমনটা ভাবে।
আজ স্কুলও নেই।রহিমা খালা এসে চালের রুটি বেলে দেয়, আর চুলোয় খিচুড়ী আর গরুর গোশত বসিয়ে দেয় সেতারা।আগামীকাল মিতু আর মুহিন দিনাজপুর এর উদ্দেশ্যে রওনা দিবে।ভাইবোন দুটোকে খাবার দিয়ে দিতে হবে তাছাড়া প্রথম বারের মতো মিতু দিনাজপুরে যাচ্ছে তাও স্বামী ছাড়া নিজের শ্বশুরবাড়ির আসল ভিটায়। মিতালীর শরীরের এই অবস্থা তার ওপর স্বামী ছাড়া এতটা দূরের পথ যাবে।মুহিনকে সেতারা বারবার বলে দেয় মিতুর দিকে খেয়াল রাখতে আর সাবধানে থাকতে।
“ওতো নিজেই কত ছোট ও কি পারবে?’
সেতারার নিজে যাওয়া উচিত কিন্তু বাসাটা এভাবে খালি রেখে যাওয়া যাবে না। উপর নীচতলা ভাড়া বাসা সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়,ভাড়া তুলতে হয়।
আবার মিতুকে নাও করা যাচ্ছে না।নানুর এ বিপদে ওকে না করবে কেমন করে।ভীষন দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় মা রূপী মুহিন, মিতুর বড় বোন সেতারা।

প্রায় সারাটা রাত ধরে মিতু ইবাদত বন্দেগী করে,নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ, তসবিহ পাঠ ও কোরআন তেলাওয়াত করে।
এর ভেতর সন্ধ্যার পর, রাত আটটার দিকে ওয়াশরুমে বমী করে ফেলে। তবে চুপচাপ ঘরের কাউকে জানায় না।
সেতারা জানলে তো ওর দিনাজপুর যাওয়া হবে না।
“ওটা তেমন কিছুনা ঠিক হয়ে যাবে, তাছাড়া আমাকে এখন এত দূর্বল হলে চলবে না।নানুর কাছে যাওয়া আমার জরুরী।’
ভাবে মিতু।রহিমা খালাকে বলে বেশী করে লেবু দিয়ে ঠান্ডা শরবত করে দিতে।

পরদিন খুব সকালে মুহিন সি এন জি বা রিক্সা আনতে বের হয় তারপর সেখান থেকে ষ্টেশনে যাবে ওরা।
রশিদ চাচাও সাথে যাচ্ছে ওদের।সেতারা রশিদচাচাকে অনুরোধ করে ঠিকমতো দুভাইবোনকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে।সেতারা বোনের সারা শরীরে সুরা পড়ে ফুঁ দিয়ে দেয়। খাবার দিয়ে দেয় সাথে আর খুব সাবধানে যেতে বলে।মিতুর ব্যাগে ওষুধগুলোও দিয়ে দেয়।
কলিং চাপতেই দরজা খোলে মিতু।মুহিন গাড়ী নিয়ে এসেছে কিনা ভাবে।
কিন্তু দরজা খুলতেই বোরখা পড়া মোটামুটি মাঝারি উচ্চতার একজন ভেতরে ঢোকে।
এরপর,
“মিতু আপু….. ‘বলেই মিতালীকে জড়িয়ে ধরে মেয়েটি প্রবল কান্নায়। (চলবে)”দ্বিতীয় বাসর’ (গল্প),পর্ব-৯৩
হাসিনা সাঈদ মুক্তা

নেকাব খুলে ফেলার পর মিতু দেখলো আঁখি ভীষন কাঁদছে।
ওকে ঘরে ঢুকিয়ে সোফায় বসালো মিতু।
চিবুকে হাত দিয়ে সুধালো,
“আহা আঁখি এভাবে কেঁদো না বোন…সব ঠিক হয়ে যাবে।’
“কিচ্ছু ঠিক হবে না আপু,পরশু আমার আকদ হয়ে যাবে,আমি মুহিনকে হারিয়ে ফেলবো…।’
বলেই মিতুর কাঁধে নুয়ে পড়ে।
দীর্ঘশ্বাস নেয় মিতালী ফের।
এবার আঁখির মুখটা তুলে মিতু একহাত দিয়ে ওর চোখগুলো মোছে।
ফের ঠান্ডা গলায় বলে মিতু,
“শোনো আঁখি এমন করলে এবার সত্যি মুহিনকে হারিয়ে ফেলবে তুমি।’
আঁখি কিছুটা হতচকিত হয় কথাটা শুনে মিতুর দিকে ফিরে চায় এবার।
ফের কিছুটা কঠিন গলায় বলে,
“তুমি কি চাও সেটা?’
“না আপু তা কেন চাইবো?আমি সবসময় মুহিনের পাশে থাকতে চাই,ওর কাছাকাছি থাকতে চাই।’
“তাহলে লক্ষী মেয়ের মতো মায়ের ঠিক করা পাত্রকে বিয়ে করে ফেলো আঁখি।’
“সেটা হলে আমি মুহিনের কাছে কি করে থাকবো…?’
“পারবে…মুহিনের কাছে থাকতে গেলেই যে ওর বউ হয়ে থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই,তুমি ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু তাই এখন এমন কিছু করা যাবে না যে শেষপর্যন্ত বন্ধুত্বটাও নষ্ট হয়ে যায়।’
“আপু….আপনি কি কিছু করতে পারেননা,আমাদের হয়ে?’
“না পারি না।দেখো আঁখি আমি সব জানি,তোমার বাবা মারা যাবার পর আনটি হসপিটালে রিসেপ্টসনিস্ট এর চাকরী করছেন।তোমাদের ভাইবোনদেরকে অনেক কষ্ট করে বড় করে তুলেছেন এতদিন।তাছাড়া ঐ ছেলেটি বোধহয় তোমাদের দুসর্ম্পকের আত্মীয়।আনটির সাহায্য নিয়ে উনার হসপিটালে ম্যাডিকেল এ এডমিশন পেয়েছে।তুমি তার বড় মেয়ে।তোমার জন্য পছন্দ করা ডাক্তার পাত্র সেটা তার জন্যে অনেক বড় স্বপ্ন। আমি বা মুহিন পারিনা সেই স্বপ্ন ভেঙে দিতে।’

মুহিন হঠাৎ ঘরে ঢুকে যায়।আঁখিকে ওভাবে দেখে সেও নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।বাইরে সিন এন জির চাকার শব্দ পায় মিতু।মিতু বলে,
“মুহিন তুই লাগেজ আর খাবার নিয়ে গাড়ীতে ওঠ চাচাকেও বল উঠতে আমি আসছি।’
এবার আঁখি কেঁদে ওঠে ফের,বলে
“তাহলে আপু আমার স্বপ্ন?এতদিন ধরে আমি মুহিনের কাছাকাছি রয়েছিলাম ওর বিপদে আপদে পাশে ছিলাম সেগুলোর কোনো মুল্য নেই?’
“অবশ্যই আছে আঁখি।আর আছে বলেই বলছি।তোমাদের দুজনাই সমবয়সী এমন যদি হতো মুহিন খানিকটা বড় তোমার চেয়ে ওর পড়াশোনা শেষ জব করছে বা করবে এমনও তো নয়?আনটিকে তাও মানানো যেতো কিন্তু এখন কোনোভাবেই সেটা সম্ভব নয়।বরং যদি তোমরা দুজন এখন কিছু করে বসো,আনটির অভিশাপ লেগে যাবে,আর এত কম বয়সে বিয়ে করলে তোমাদের কারো কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে না।দুদিন ভালো লাগবে তারপর ফ্রাসট্রেটেড। ‘
“আপু আমি যদি অপেক্ষা করি?’
“সেটাও এখন সম্ভব না,পরশু তোমাদের আকদের দিন ঠিক হয়ে আছে। আমি কিভাবে বলবো আকদ ভেঙে দিয়ে মুহিনের জন্যে অপেক্ষা করার কথা বলতে?বোঝার চেষ্টা করো আঁখি তুমি এখন একটা ঘোরের মধ্যে আছো।মায়ের প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাও।এভাবে সারাজীবন মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে কাঁদার চেয়ে তোমরা দূর থেকে বন্ধু হয়ে থাকো।এখন কষ্ট হবে তোমাদের বাট পরে ভালো থাকবে। ‘
সেতারা আসে এবার বৈঠকখানায়। ও এতক্ষণ ওর স্বামী আরিফের সাথে ফোনে কথা বলছিল।
আঁখিকে এ অবস্থায় দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারেনা।
মিতু সেতারাকে আগে এ বিষয়ে জানিয়েছিল।
সেতারা পাশের ঘর থেকে মোটামুটি শুনছিল মিতু আঁখিকে যা বোঝাচ্ছিল।
সেও একইভাবে আঁখিকে বোঝায়।
সেতারা আর মুহিনের উদ্দেশ্যে তাড়াতাড়ি রওনা দিতে বলে।
“আমি আঁখিকে ওর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবো এবার তোরা যা আল্লাহর নাম নিয়ে।’
আঁখি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে মিতু আর মুহিনের দিকে চেয়ে থাকে।
মুখে ওরা দুজন কিছুই বলে না, তবু কথা হয় দৃষ্টিতে আর হতাশা ঝরে দীর্ঘশ্বাসে।

কমলাপুর রেলস্টেশনের নির্ধারিত রেলগাড়ির একটি কামরায় চেপে বসে মিতালী,রশিদ চাচা আর মুহিন।
ওদের ট্রেন সকাল দশটার দিকে ছাড়বে দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে।সেখান থেকে মিতু যাবে পার্বতীপুর নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
সি এন জিতে খেয়াল করেছে মিতু তার ভাই মুহিনের মনটা ভীষন রকম খারাপ।আকাশ থেকে এক পশলা বৃষ্টি নামে, আকাশও বেশ গর্জে উঠেছিল।মুহিন সারারাস্তায় একটা কথাও বলে না।অথচ বৃষ্টি হতে দেখলেই মুহিন মজার মজার গল্প,আর হাসি ঠাট্টায় ভরিয়ে দিতে চাইতো।
অথচ আজ তার দুচোখ ছলছল, বুকটা বোধহয় আকাশের গর্জনের মতো ফেঁটে যাচ্ছে মুহিনের।
মিতুর নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়,
” কোনো ভুল করলাম না তো?আঁখি মুহিনের জন্যে অপেক্ষা করতে চাইছিলো কিন্তু কি করে বলতাম ওকে অপেক্ষা করতে?ওর মা তো পরশুই বিয়ে করিয়ে দিচ্ছে ওদের বিয়ে এভাবে ভাঙতে বলাটা চরম স্বার্থপরতা আর অশুভ হয়ে যেতো। সেটা আঁখি আজ না বুঝলেও কাল বুঝবে….।’
মিতুর ইচ্ছে হচ্ছিলো ভাই এর হাতটার উপর হাত রেখে স্বান্তনা দিতে।সেটাও আর করেনা।ভাইকে একা নিজের মতো থাকতে দেয় মিতু।

ঢাকা থেকে দিনাজপুরগামী একতা এক্সপ্রেসের ফার্স্ট ক্লাস কামরায় ওঠে ওরা।এরপর ট্রেনের নির্দিষ্ট জায়গায় ওদের ব্যাগ ও খাবারটা রাখে ওরা।
রশিদ চাচার আবার যাত্রাপথে পান আর চা না খেলে হয়না।উনি এর মধ্যে নেমে পড়েছেন গাড়ী ছাড়ার আগে সেগুলো খেতে।মিতু মুহিনকে বলে এবার,
“যা না মুহিন তুইও চা টা খেয়ে আয়?’
“না খাবো না ভালো লাগছে না….।’
মিতু বাইরে তাকিয়ে দেখে রকমারী আমসত্ত্বের ঢালা নিয়ে বসেছে আমসত্ত্বওয়ালা।
ভীষন পছন্দের মিতুর মিষ্টি আমসত্ত্ব।
মুহিনকে বলে তৎক্ষণাত নিয়ে আসতে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও যায় মুহিন বোনের জন্যে আমসত্ত্ব কিনতে।
মিতুর ধারনা ঠিক ছিল মুহিন গাড়ী থেকে নেমেই একহাতের কনুই কপালে,দুচোখে চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
মিতুর জন্যে শব্দ করে কাঁদতে পারছিল না এতক্ষন।
তবে আমসত্ত্ব কেনার চ্ছলে ট্রেন থেকে নেমেই হু হু ক্রন্দনে কেঁদে ওঠে মুহিন।

প্রথমবারের মতো ভালোবাসা হারালে সেটা যে কত তীব্র আর যন্ত্রণাময় মিতালী তা ভালো করেই জানে।
দূর থেকে ভাই এর উদ্দেশ্যে বলে মিতু,
“কাঁদ ভাই কাঁদ অন্তত জ্বালাটা তো কিছু কমবে …..? ‘
হঠাৎ উইসেলের শব্দ বেজে ওঠে এখনই ট্রেন ছাড়বে।কিন্তু হঠাৎ কেমন যেন খারাপ লাগে মিতালীর। মনে হচ্ছিল ঠিক এইরকম খারাপ তার আগেও লেগেছিল সেটা কবে মনে করার চেষ্টা করে।
আজকাল স্মৃতিভ্রম হচ্ছে তার…..
গাটা গুলিয়ে আসছে মিতুর।ভীষন বমী আসছে ওর।এতক্ষন কষ্ট করে চেপে ছিল।চোখমুখ লাল হয়ে আসছে… …শেষপর্যন্ত পারে না আর,অতঃপর জানালা বেয়ে মাথা বাড়িয়ে গলগল করে বমী করে দেয় মিতু।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here