#বিকেলে_ভোরের_ফুল
#পর্ব_১৯
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
কয়েকদিন যাবত ধরে ফুল ওর রুমেই আটকে আছে।এতে ফুলের কোন ভাবান্তর নেই। কারণ এর আগেও তো এই রুমেই থাকত বের হতোই না। আজমল চৌধুরীর উপর মামলা দায়ের করা হয়েছে। আপাতত সেটা নিয়েই তিনি দৌড়াদৌড়ি করতেছে। নিজের টাকা পয়সা সব ঢেলে দিচ্ছেন সেখানেই। কিন্তু তিনি তার যে সম্মান হারিয়েছে তা হয়তো আর ফিরে পাবে না। কিন্তু জেলের ঘানি টানা থেকে তাকে মুক্তি পেতে হবে তাই তিনি দৌড়ের উপর আছেন।তাই আপাতত তিনি ফুলের দিকে নজর দিচ্ছেন না।
ফুলের দাদি সবসময় ফুলের রুমের দিকে কড়া নজর রাখে। কাউকে তিনি ওর রুমে যেতে দেয়না।জাইফ সাইফকে তো নয়ই এমনকি রিনা বেগমকেও নয়। শুধু তিনবেলা খাওয়ার সময় ফুলের রুমের দরজা খোলা হয় এছাড়া নয়।
ফুল বিছানায় বসে বসে স্পর্শের ফোন আর ওয়ালেট দেখতেছে। বারান্দায় ও যেতে পারছে না কারণ সেটাও তালাবন্ধ করা।স্পর্শের ফোনে তোলা ছবি গুলো দেখতেছে।
সেদিন স্পর্শ ফুলের ঘুমের সুযোগ নিয়ে যে সেলফি তুলেছিল সেগুলোই দেখতেছে আর হাসতেছে। কিন্তু তখনই ফুলের চোখ গেল নেটওয়ার্ক পয়েন্টের দিকে।ফোনে সিম কার্ড আছে। ফুল তো অবাক,এর আগে কেন চোখে পড়েনি ওর। ফুল তাড়াতাড়ি ব্যালেন্স চেক করল।ব্যালেন্স আছে কিন্তু মেয়াদ নেই। ব্যালেন্সের কথা পরে ভাবা যাবে আগে কন্ট্রাক লিস্ট চেক করা যাক। ফুল কন্ট্রাক লিস্ট চেক করল কিন্তু কারো নাম্বার পাচ্ছে না। অনেক খুঁজে স্পর্শর বাবার ফোন নাম্বার খুঁজে পেল।বাবা লিখে সেভ করা নাম্বারটা।
মুহূর্তেই ফুলের মুখে হাসি ফুটে উঠল কিন্তু সাথে সাথেই মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেল। কারণ ফোনে মাত্র তিন পার্সেন্ট চার্জ আছে।একটু পরেই তো ফোন অফ হয়ে যাবে।
ফুল মুখটা গোমড়া করে বসে আছে। মাথায় কিছু আসতেছে না।একটা চার্জার আনার জন্য হলেও এই রুম থেকে বের হতে হবে। হঠাৎ করেই ফুলের মনে পড়ল অনেক দিন আগে দাদি ওর রুমে এসেছিল ফোন চার্জ দিতে ওনার রুমের সুইচ বোর্ড খারাপ হয়ে গিয়েছিল বলে। তারপর চার্জার তো নেয়নি।বুড়ি হয়েও স্মার্ট ফোন চালায়।বুড়ি কোথাকার,,,দাদিকে মনে মনে বকলো ফুল। তারপর সারারুমে চার্জার খুঁজতে লাগল।প্রথমে ওয়্যারড্রপ খুঁজলো কিন্তু পেল না। শেষে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার এর মধ্যে চার্জার খুঁজে পেল।দেখেই মনে হচ্ছে চার্জারটা অনেক পুরোনো হয়ে গেছে।ভালো আছে কি না কে জানে?? ফুল বিসমিল্লাহ বসে চার্জার চার্জ বোর্ডে লাগিয়ে অন করল। সাথে সাথে চার্জারের আলো জ্বলে উঠলো। ফুল খুশিতে লাফিয়ে উঠে।ফোন চার্জে দিয়ে ফুল চুপচাপ বসে রইল।
দুপুরের দিকে ফুলের রুমে ওর দাদি আর একজন সার্ভেন্ট আসলো খাবার দিতে।দরজা খোলার শব্দ শুনে ফুল তাড়াতাড়ি ফোন আর চার্জার লুকিয়ে ফেলে।সার্ভেন্ট খাবার টি টেবিলে রাখল। ফুল ওর দাদিকে বলল,
–“সাইফ জাইফ কোথায় দাদি??”
–“ক্যান ওগো দিয়া তুই কি করবি??”
–“না মানে ওদের সাথে তো অনেকদিন দেখা হয়না তাই বলছিলাম।”
–“হোন তুই যা করছোস তাতে তোর লগে কেউ দেখা করতে চায়না। আমিও চাইনা, খালি খাওন দিতেই আহি।নয়লে তোর মতো মাইয়ার ঘরে আমিও আইতাম না।”
বলেই তিনি বাইরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে চলে যায়। ফুল ভেংচি কেটে বলল,
–“ইশশ বুড়ির তেজ দেখো, এখন আমি কি করি। আমার যে জাইফ সাইফ কে খুব দরকার। একমাত্র ওরাই পারে আমাকে সাহায্য করতে।”
হঠাৎ কারো ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ পেল। ফুল দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল।বলল,
–“কে??”
–“আপু আমি সাইফ।”
পাশে থেকে জাইফ বলে উঠলো,
–“আর আমি জাইফ।”
–“তোরা এখানে??”
–“তোমাকে দেখতে এসেছিলাম।দাদি যখন তোমাকে খাবার দিতে এসেছিল তখন আমি আর জাইফ সব শুনেছি।”
জাইফ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
–“ওই বুড়িটা আমাদের তোমার কাছে আসতে দেয় না। কতবার বলেছি যে আপুর কাছে যাব।মাও বলেছে কিন্তু বুড়িটা আসতেই দিলো না।”
ফুল বলল,
–“আচ্ছা ঠিক আছে। তোরা আমার একটা কাজ করে দিতে পারবি??”
–“কি কাজ বলো আমরা করেদেব।”
–“আমি একটা ফোন নাম্বার লিখে দেব তোরা টাকা রিচার্জ করে দিতে পারবি।”
জাইফ সাইফ উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
–“আপু তুমি ফোন চালাও??”
–“চুপ চুপ আস্তে বল।পারবি??”
–“পারব।”
–“গুড।”
ফুল একটা কাগজে নাম্বার লিখে দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে কাগজটা বের করে দিল।জাইফ সাইফ আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না।কেউ দেখতে পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।এক দৌড়ে ওরা চলে গেল। আইসক্রিম খাওয়ার নাম করে দুজনে বেরিয়ে ফোনে টাকা রিচার্জ করে দিয়ে দুজনে খুশিতে লাফাতে লাফাতে বাড়িতে ফেরে।
🍁🍁🍁
স্পর্শ ওর রুমে চুপ করে বসে আছে। সেদিনের পর থেকে বাইরে বের হয়নি ও।কারো সাথে কোন কথাও বলছে না। বাবার প্রতি একটু রেগে আছে স্পর্শ। কারণ টা হলো ফুলকে নিয়ে।ফুলকে সেদিন ওদের সাথে না আনার কারণেই স্পর্শ সবার ওপর রেগে আছে। তখনই স্পন্দন রুমে এসে স্পর্শের পাশে বসে।স্পর্শ তখনও নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।স্পর্শের কাঁধে হাত রেখে স্পন্দন বলল,
–“কি রে তোর রাগ এখনও কমেনি??”
স্পর্শ কোন কথা বলল না।
–“দেখ এভাবে আর কতদিন চলবে??”
–“যতদিন না আমি মরছি।”
–“একটা থাপ্পর দিব।কি বলছিস এসব আজেবাজে কথা।”
–“ঠিকই বলছি ভাইয়া। আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। এভাবে জ্যান্ত মরা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।”
–“তোর ফুলকে চাই তাই তো??”
–“হ্যা চাই। ভাইয়া প্লিজ আমাকে যেতে দাও। আমি প্রমিস করছি আমি কোন ঝামেলায় জড়াব না। ফুলকে নিয়েই চলে আসব।”
–“এই কদিনে এই কথাটা না হয় তুই হাজার বার বলেছিস। কিন্তু বাবা কি রাজি হয়েছে?? দেখা আমরা কেউই চাই না তুই ফুলের কাছে যাস। ফুলের কাছে গেলে আজমল চৌধুরী তোকে মেরে ফেলবে। জানিসই তো ওনার কত পাওয়ার। আমরা তোকে হারাতে চাই না।সবাই একসাথে সুখে থাকতে চাই। তুই সবকিছু ভুলে নতুন করে বাঁচতে শেখ।”
–“সম্ভব নয়।”
–“কিন্তু আমার মেয়টার সাথে তো একটু সময় কাটানো সম্ভব।”
স্পর্শ আর স্পন্দন দরজার দিকে তাকালো।দিয়া ওর চার বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলল। দিয়া কাছে এসে বলল,
–“যেদিন থেকে এসেছো সেদিন থেকে রুমেই বসে আছো। আর দিশামনি যে সবসময় চাচ্চু চাচ্চু করে সেটা শুনেছো??”
স্পর্শ উঠে দাঁড়িয়ে দিশাকে কোলে তুলে নিলো।দিয়া বলল,
–“ও এখন আইসক্রিম খেতে চাচ্ছে।সেই কবে তুমি ওকে আইসক্রিম খাইয়েছিলে মনে আছে??”
–“সরি ভাবি।আসলে আমি,,,,”
–“আর কিছু বলতে হবে না এখন যাও তো ঘুরে আসো।”
স্পর্শ দিশার সাথে কথা বলতে বলতে বাইরে এসে দিশাকে বাইকের সামনে বসিয়ে আইসক্রিম খেতে নিয়ে যায়।দিশা স্পর্শের সাথে বাইকে ঘুরতে খুব ভালোবাসে।
দরজায় দাঁড়িয়ে স্পন্দন স্পর্শের চলে যাওয়া দেখতেছে।দিয়া ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
–“দেখ আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
–“তাই যেন হয়।”
ফুল এতক্ষণ ফোন হাতে নিয়ে বসেছিল। ফোনে টাকা রিচার্জ হওয়ার সাথে সাথেই আর এক মুহূর্তও দেরি করল না স্পর্শের বাবাকে ফোন করল। কয়েকবার বাজার পর ফোন রিসিভ হলো।
–“হ্যালো কে বলছেন??”
–“আঙ্কেল আমি ফুল বলছি। ভালো আছেন??”
–“হ্যা ভালো আছি। কিন্তু তুমি, আর আমার ফোন নাম্বর কোথায় পেলে??”
–“সেসব কথা পরে বলব।আঙ্কেল আমি,,,,”
–“স্পর্শের সাথে কথা বলতে চাও তাইতো??”
ফুল নিচু স্বরে বলল,
–“হ্যা”
–“দেখ ফুল তোমার একটা কথা জানার দরকার। তোমার বাবা চায় না তুমি স্পর্শ কিংবা আমার পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ রাখো।যদি তুমি আর স্পর্শ একে অপরের সাথে যোগাযোগ করো তাহলে তোমার বাবা স্পর্শের ক্ষতি করে দেবে। আমি চাই না আমার সন্তান কিংবা আমার পরিবারের কারো ক্ষতি হোক।তাই বলছি আজকে ফোন করেছো ভালো কথা, কিন্তু এরপর কোনদিন আমাকে ফোন করবে না। এমনকি স্পর্শের সাথে কোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। তাহলে তোমার ও ভালো স্পর্শরও ভালো। আমরা স্পর্শকে সামলে নেব। তুমিও নিজেকে সামলে নাও। ভালো থেকো।”
বলেই তিনি ফোন রেখে দিলেন। ফুল স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বেয়ে পড়ছে। সবসময় এরকম হয় কেন ওর সাথে???কাছের মানুষ গুলো সবসময় ওকে ফেলে কেন চলে যায়??বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো ফুল।
স্পন্দন এতক্ষণ বাবার সব কথা শুনল।ও এগিয়ে এসে বলল,
–“বাবা ফুল ফোন করেছে??কি বলল ও??”
–“আগে বল স্পর্শ কোথায়??”
–“বাইরে গেছে।”
–“কি?? বাইরে গেছে কেন??”
–“চিন্তা করো না।স্পর্শ আমাকে কথা দিয়েছে আমাকে না জানিয়ে ও কিছু করবে না। ফুল কি বললো??”
–“আমি ওকে কিছু বলতে দেইনি। আর একটা কথা ফুল ফোন করেছিল একথা যেন স্পর্শ না জানতে পারে।”
–“ও যদি জানতে পারে তাহলে তো কুরুক্ষেত্র শুরু করবে।”
–“সেজন্যই তো আমাদের সবটা লুকিয়ে রাখতে হবে। ফুল যেন কিছুতেই স্পর্শর জীবনে আসতে না পারে।”
স্পন্দন মাথা দুলিয়ে চলে যায়।
তিনমাস পার হয়ে গেছে। ফুল আর স্পর্শর বাবাকে ফোন করেনি।যদিও ফোন করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু করেনি। অনেকবার ফোন হাতে নিয়েছিল তবুও কল করতে পারেনি।স্পর্শের বাবার বলা কথাগুলো ওকে আটকে দেয়।
বিকেলে ওর দাদি ওর রুমে আসল। ফুল কিছুটা অবাক হয়। কারণ রিজন ছাড়া ওর রুমে দাদি আসে না। আর এখন তো খাবার দেওয়ার সময়ও নয় তাহলে। দাদি এসে ফুলের পাশে বসে ওর হাতে একটা শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–“তাড়াতাড়ি এই কাপড়টা পর। তারপর আমার লগে চল।”
–“কোথায়??”
–“কোথায় আবার, পাত্রপক্ষ তোরে দেখতে আইছে। আগের পোলাডা তো ভালোই আছিল। তুই চইলা যাওয়ার পর হেয় অন্য জায়গায় বিয়া করছে।এহন তো তোরে বিয়া দিতে হইবো। ঝামেলা তো রাখা ভালো না।”
–“আমাকে তোমাদের ঝামেলা মনে হলে বাড়ি থেকে চলে যেতে দাও আমাকে। আমি বিয়ে করব না।”
–“আর একটা কথাও কইবি না। তাড়াতাড়ি কাপড় পর ছেমড়ি। না হইলে তোর বাবা কিন্তু রাগ করবো।”
ফুল অনেক চেষ্টা করেও ওর দাদিকে কিছু বোঝাতে পারল না। শেষমেশ বাধ্য হয়েই পাত্রপক্ষের সামনে যেতে হলো।
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,