#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৩১
#নিশাত_জাহান_নিশি
বাবা কথা বাড়াতে চাইছিলেন না বোধ হয়। তাই মুহূর্তের মধ্যে মুখমন্ডলে রুক্ষ ভাব ফুটিয়ে পরশের মুখের উপর ঠাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন! সঙ্গে সঙ্গেই আমার আঁখিদ্বয় বুজে এলো! লুটিয়ে পড়লাম আমি বাবার বুকে। পরশ জেনে শুনে আমাকে এভাবে ঠকাবে বুঝতে পারি নি আমি! পরশ নিশ্চয়ই জানতেন, বাবা কখন ও নিজের দাম্ভিকতা ভুলে পরশকে সাদরে আমন্ত্রন করবেন না! সব জেনে শুনে ও পরশ আমায় ঠকালেন?
,
,
মোটামুটি এক সপ্তাহ পাড় করে দিলাম! পরশ এবং আমার শ্বশুড় বাড়ির লোকজনদের সাথে কোনো রূপ যোগাযোগ ব্যতীত। পরিবারের প্রতিটা সদস্য আমায় এতটাই আদর, যত্নে, ভালোবাসায় মাতিয়ে রেখেছেন যে, সংসার জীবনের কথা অতোটা ও সাংঘাতিক ভাবে মনে পড়ছে না আমার! তবে পরশের নেওয়া অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রতিনিয়ত আমায় ভীষণ ভাবে পোঁড়াচ্ছে! বাবার হাব-ভাব, কলা-কৌশল, গতিবিধি বা চিন্তা-ভাবনা দেখে মনে তো হচ্ছে না মাত্র এক মাসের মাথায় বাবা স্বয়ং পরশকে আমন্ত্রণ করবেন এই বাড়িতে বা সাথে করে আমায় শ্বশুড় বাড়িতে নিয়ে যেতে বলবেন! মনে মনে বোধ হয় ছক কষে রেখেছেন সারাজীবনের জন্য আমাকে এই বাড়িতেই বন্ধিনী হিসেবে রেখে দিবেন!
বাবা ভীষন খুশি আমায় পেয়ে। মনে হচ্ছে যেন সেই ছোটবেলার টয়া টিকে বাবা পুনরায় কাছে পেয়েছেন! সেই ছোট বেলার মতোন মুখে লোকমা তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন, সর্বক্ষণ আমায় আশে পাশে রাখছেন, আমার কথা মতো দেয়ালে রং করাচ্ছেন, প্রতিদিন ভোরে বাবা নিজ হাতে শিউলি ফুল কুঁড়িয়ে আমায় মালা গেঁথে দিচ্ছেন! বিকেল হতেই আমায় নিয়ে হাঁটতে বের হচ্ছেন। দোকান থেকে গাধা গাধা চকলেট, চিপস, আইসক্রীম, আঁচার কিনে দিচ্ছেন, দোলনায় আমায় নিয়ে দোল খাচ্ছেন, রাতে ঘুমানোর সময় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো! বাবা অতি ক্ষুদ্র কারনে ও আজকাল দাঁত কেলিয়ে হাসছেন। বরাবর মুগ্ধ হচ্ছি বাবার হুটহাট হাসিতে। চোখে আনন্দ অশ্রু বয়ে আনার জন্য বাবার এই অতি ক্ষুদ্র হাসিটাই যথেষ্ট। বাবার প্রতি দিন দিন খুব দুর্বল হয়ে পড়ছি। পিতার প্রতি গাঢ় টান অনুভব করছি। বাবার এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় কোনো ভনিতা বা ছলনার অবকাশ দেখছি না আমি। সম্পূর্ণ মন থেকেই বাবা আমায় ভালোবাসছেন। যতটা ছোট বেলায় বাসতেন।
আজ সকালেই বেঁধে গেছে এক হুলুস্থুল কান্ড! পিয়াস ভাই আমাদের পাড়ার এক ছেলেকে কেলিয়ে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে এসেছেন! এই বিষয়টা নিয়ে সমাজের লোকজন এসেছেন বাবার কাছে নালিশ জানাতে। মূল বিষয়টা ঘটেছিল মূলত মিলি আপুকে কেন্দ্র করে! আহত ছেলেটা মিলি আপুকে প্রায় অনেকদিন যাবত টিস করছিলেন। মাঝে মাঝে মিলি আপুকে অনুসরন করে বাড়ি অবধি চলে আসতেন! ঘটনাটা কোনো ভাবে একদিন পিয়াস ভাইয়ার নজরে পড়েছিল। আর সেই জের ধরেই আজ সময়, সুযোগ পেয়ে পিয়াস ভাই ঐ ছেলেকে রাম পিটুনি দিয়ে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে এসেছেন। বিষয়টা জানার পর থেকেই মিলি আপু লুচির মতো ফুলছেন। পিয়াস ভাইকে সামনে পেলেই হয়তো আস্ত গিলে খাবেন! এই মহিলার হাব-ভাব বুঝি না আমি। পিয়াস ভাই তো তোর জন্যই গাঁ ভরাল, ঐ ছেলের সাথে লড়তে গেল, তোর সাথে বেয়াদবির শাস্তি দিল! কোথায় এসে তুই ভাইয়াকে একটু সাপোর্ট করবি তা না! তুই উল্টে ভাইয়ার উপর ফুলছিস? হাউ স্ট্রেন্ঞ্জ!
বিকেলের দিকে পিয়াস ভাইকে ডেকে এনে বাবা দু, এক কথা শুনিয়ে দিলেন। সাবধান করে দিলেন পরবর্তীতে যেন এই ভুলটা পুনরায় না ঘটে। পিয়াস ভাই নিশ্চুপ থেকে মাথা নুঁইয়ে শুধু সম্মতি জানিয়েছিলেন। মিলি আপুর রাগ যেন এতে ও দমছিল না। লুচির মতো কেবল ফুলছিলেন আর ফুলছিলেন! বাবার অনুরোধে পিয়াস ভাই আজ রাতটা আমাদের বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। মিলি আপু সুযোগ খুঁজছিলেন কখন পিয়াস ভাইকে একান্ত ভাবে পাবেন আর সঙ্গে সঙ্গেই টুটি চেঁপে ধরবেন! এই মহিলার হিংস্রাত্নক হাব-ভাব দেখে ঠিক বুঝতে পারছি আমি!
রাত ঠিক ১১ টা বাজতেই আমি ঘুমুতে চলে এলাম নিজ কক্ষে। বাড়ির বাকিরা ও রাতের খাবার শেষ করে চলে গেলেন নিজেদের কক্ষে। বাবার সাথে কিছুক্ষন আড্ডা দিয়েই আমার এইমাত্র কক্ষে ফেরা। দরজায় খিল আটকে আমি ওয়াশরুমে গেলাম ফ্রেশ হতে। কিয়ৎক্ষনের মধ্যে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মনে হলো দরজায় কেউ মন্থর গতিতে করাঘাত করছে। ভেজাক্ত মুখমন্ডল নিয়ে আমি তড়িঘড়ি করে রুমের দরজাটা আস্তে করে খুলে দিতেই তাজ্জব বনে গেলাম। ক্ষনিকের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল সবটাই আমার মাথার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলো। ব্ল্যাক হুডি পরিহিত অবস্থায় পরশ হালকা হাতে আমায় দরজার সম্মুখ থেকে সরিয়ে হুড়মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। ঝড়ের বেগে দরজার খিলটা আটকেই উনি পিছু ঘুড়ে আমায় ঝাপটে ধরলেন! নির্বাক, বিস্মিত, স্তব্ধিত আমি! শরীরের সমস্ত শক্তি আমার পরশের গাঁয়ের উপর সীমাবদ্ধ। উপরন্তু পনেরো মিনিট আমায় ঠিক এভাবেই ঝাপটে ধরে লোকটা হঠাৎ আদুরে গলায় বললেন,,
“খুব মিস করেছি খুব! বিয়ের পর বউ ছাড়া থাকা যায় নাকি?”
এখন ও নির্জীব আমি। বিশ্বাস ই হচ্ছে না মানুষটা এসেছে! আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। আদুরে স্বরে আমার গলায় মুখ ডুবিয়ে কথা বলছে। তার গায়ের মাতাল করা গন্ধে আমার রন্ধ্রন শক্তিকে মাতিয়ে তুলছে। আমার অনুভূতিদ্বয়কে সন্তপর্ণে নেশাক্ত করে তুলছে! পিনপতন মৌনতা উপলব্ধি করা মাত্রই মানুষটা আমার গলায় আলতো চুমু খেয়ে বললেন,,
“কি হলো? আমি এসেছি, বিশ্বাস হচ্ছে না তাই তো?”
মৌনতা ভেঙ্গে আমি নির্লিপ্ত গলায় বললাম,,
“হবে কি করে? আপনি তো বলেছিলেন এক মাসের পূর্বে আপনি আসবেন না। যদি না বাবা নিজ থেকে আপনাকে আমন্ত্রণ জানান!”
“আমার বউটা হয়েছে চরম লেবেলের গাধী! ওটা তো আমি তোমার বাবাকে থ্রেড দিয়ে বলেছিলাম। দজ্জাল শ্বাশুড়ী হয় শুনেছি। তবে দজ্জাল শ্বশুড় ও যে হয় নিজের ব্যক্তিগত জীবনে না পেলে হয়তো জানতেই পারতাম না!”
“আমার বাবা আপনার কাছে দজ্জাল হলে ও আমার কাছে ভালো বাবা!”
“এক সপ্তাহে বাবার প্রতি খুব ভালোবাসা জন্মে গেছে না? দিব্যি আমার ভালোবাসা ভুলে গেছ?”
“আপনিই তো বাধ্য করেছেন! রেখে গেলেন কেন আমায় এই বাড়িতে? সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন না কেন আমায়? কথা তো ছিল দুজনেই মিলে বাবাকে মানাব। হাতে, পায়ে ধরে হলে ও বাবাকে মানাব। মাঝখান থেকে আপনি কি করলেন? সিদ্ধান্ত পাল্টে আমাকে একাই রেখে চলে গেলেন? আপনি জানেন? আপনি আমায় ঠকিয়েছেন!”
“ওটাকে ঠকানো বলে না রে গাধী। ওটাকে গেইম বলে। তুমি জাস্ট মিলিয়ে নাও, ঠিক এক মাস পর আমিই হব এই গেইমের উইনার! আর তোমার বাবা হবেন লুজার!”
“আচ্ছা! আপনার মাথায় কি ঘুড়ছে একটু বলবেন?”
লোকটা ক্রুর হেসে আমার ওষ্ঠদ্বয়ের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,,
“বলব৷ আগে একটু আদর করে নেই!”
মুহূর্তের মধ্যে লোকটা আমায় পাজা কোলে তুলে নিলেন। রুমের লাইট অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। বিছানায় আমায় লম্ব করে শুইয়ে লোকটা হুডিটা গাঁ থেকে খুলে আমার গাঁয়ের উপর শায়িত হলেন। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে লোকটা আমার শাড়ির আঁচলটা হালকা সরিয়ে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলেন। পরম আবেশে আঁখিদ্বয় বুজে আমি লোকটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলাম। ভালোবাসা গাঢ় হতে লাগল আমাদের। দুজনই যেন স্বর্গীয় সুখে পদার্পন করলাম!
মধ্যরাত প্রায় ২ টোর কাছাকাছি। দরজায় হঠাৎ কড়াঘাত পড়ল। দু, এক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে কেউ পর পর দরজায় টোকা মারছেন। সঙ্গে সঙ্গেই পরশ আমার ওষ্ঠদ্বয় ছেড়ে দরজার দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। উনার সাথে সাথে আমি ও হকচকিয়ে উঠলাম। কিঞ্চিৎ মুহূর্তের মধ্যেই পরশ আমায় ছেড়ে হুডিটা গাঁয়ে জড়িয়ে নিলেন। তাড়াহুড়ো করে আমি শাড়িটা গাঁয়ে জড়াতেই মিলি আপুর গলার স্বর ভেসে এলো। মন্থর গলায় আপু আমায় ডেকে বলছেন,,
“এই টয়া, দরজাটা খোল!”
ইচ্ছাকৃত ভাবেই আমি ঘুম জড়ানো গলায় বললাম,,
“কেন আপু? কি হয়েছে?”
“আগে দরজাটা খোল। পরে বলছি কি হয়েছে!”
“আমি তো এখন ঘুমুচ্ছি আপু। কাল সকালে না হয় বলো!”
“ঘুমুলে কথা বলছিস কিভাবে? দরজাটা খুলতে বলছি, খোল!”
“তোমার ডাকাডাকিতেই তো আমার কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। তুমি প্লিজ এখন যাও আপু। কাল সকালে আমরা কথা বলছি।”
“তুই দরজাটা খুলবি কিনা বল? নতুবা আমি জেঠুকে ডাকতে বাধ্য হব!”
ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো আমার। শাড়িটা কোনো রকমে গাঁয়ে পেঁচিয়ে আমি পরশের মুখোমুখি দাঁড়াতেই পরশ হিংস্র রূপ ধারন করে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের দরজাটা খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই মিলি আপু জেঠু বলে চিৎকার করে উঠতেই পরশ ঠাস করে আপুর গালে এক চড় বসিয়ে দিলেন! আপু গালে হাত দিয়ে টলমল দৃষ্টিতে পরশের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি নিজেই তাজ্জব দৃষ্টিতে পরশের দিকে চেয়ে আছি। দাঁতে দাঁত চেঁপে পরশ আপুর উদ্দেশ্যে বললেন,,
“তোমার মতো নির্লজ্জ এবং বেহায়া প্রকৃতির মেয়ে মানুষ পৃথিবীতে আমি দুটো দেখি নি। এত বেহায়া ধাঁচের কেন তুমি? বিয়ের আগে ও যেমন আমার পিছনে লেগেছিলে, এখন ও ঠিক আগের মতোই লেগে আছ! কিন্তু কেন একটু বলবে? আমার তো এখন বিয়ে হয়ে গেছে তাই না? তোমার আপন চাচাতো বোন এখন আমার ওয়াইফ! আমরা দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি, আগের চেয়ে ও আমাদের মধ্যকার ভালোবাসা দ্বিগুন বাড়ছে। ভবিষ্যতে এর মাত্রা আর ও অধিক হারে বাড়বে৷ তুমি কি ভেবেছ, তুমি এবং তোমার জেঠু মিলে আমাদের আলাদা করতে পারবে? কখনো না! পৃথিবীতে কারো সাধ্য নেই আমাদের আলাদা করার। তোমার কখন ও মন চায় না না? পিয়াসের নিঃস্বার্থ ভালোবাসাটাকে একটু বুঝতে? ছেলেটা তুমি তুমি করে জাস্ট মরে যাচ্ছে। যত বার তুমি তার ভালোবাসা প্রত্যাখান করছ তত বার সে দ্বিগুন ভাবে তোমায় ভালোবেসে যাচ্ছে! আচ্ছা? তোমার কখন ও ইচ্ছে জাগে না? এসব কুটিলতা বাদ দিয়ে সুন্দর একটা ভালোবাসায় মোড়ানো বিবাহিত জীবন কাটাতে? কারো ভালোবাসায় গাঁ ভাসিয়ে দিতে? নিজের একটা সাজানো সংসার তৈরী করতে? কেমন মেয়ে মানুষ তুমি? যে মেয়ে মানুষের জীবনে কোনো ভালোবাসা নেই, কোনো ইচ্ছে নেই, কোনো চাহিদা নেই, ভালোবেসে কাউকে আপন করে নেওয়ার মন মানসিকতা নেই! পিয়াস কি তোমায় ভালোবেসে এতটাই অন্যায় করেছে যে তুমি তাকে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত মরণ যন্ত্রনা দিবে? তোমাকে ভালোবাসা কি এতটাই পাপ?”
মিলি আপু ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠতেই পাশের রুম থেকে পিয়াস ভাই বেরিয়ে এলেন। মিলি আপুর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মাথা নুঁইয়ে পরশকে বললেন,,
“মিলিকে আর কিছু বলো না পরশ! শুনতে খারাপ লাগে আমার। তোমাদের চোখে মিলি হাজার খারাপ হলে ও, আমার চোখে সে আমৃত্যু পৃথিবীর সব’চে ভালো মেয়ে মানুষ হয়েই থাকবে। আমি আজীবন ওর পিছনে ঘুড়তে রাজি। যতবার সে আমায় ফিরিয়ে দিবে, আমি ঠিক ততবারই তার কাছে ফিরে যাব! ভালোবাসায় বেহায়া হতে হয়। এতটুকুই আমি বুঝতে পেরেছি তাকে ভালোবেসে!”
মিলি আপু হেচকি তুলে কেঁদে হঠাৎ পিয়াস ভাইয়ার বুকের পাজরে মাথা ঠেঁকিয়ে দিলেন! পিয়াস ভাইয়ার শার্ট দ্বারা নাক মুছে ছলছল দৃষ্টিতে পিয়াস ভাইয়ার বিস্মিত দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,
“আজীবন বেহায়া থাকতে হবে আপনাকে। নয়তো আপনার গলা কেটে নিব।”
ছুটে পালালেন আপু! উপস্থিত সবাই তাজ্জব দৃষ্টিতে মিলি আপুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছি। কিয়ৎক্ষনের মধ্যে পরশ বাঁকা হেসে পিয়াস ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে বললেন,,
“ডোজ কাজে দিয়েছে তবে!”
পিয়াস ভাইয়া লজ্জা মিশ্রিত হাসিতে মাথা নুঁইয়ে নিলেন। পিছনের চুল গুলো কিঞ্চিৎ টেনে বললেন,,
“সবই তোমার অবদান! তোমার কয়েকটা খড়তড় কথার কারনেই প্রেয়সীর মন গলল!”
আমরা সবাই উচ্চ শব্দে হেসে উঠলাম। মিলি আপুর আকস্মিক পরিবর্তনে আমরা সবাই আনন্দে আপ্লুত প্রায়!
,
,
পরশের চ্যালেন্জ্ঞ নেওয়ার ১ মাসের মধ্যে ঠিক বিশ দিনের মাথায় আমার হঠাৎ পিরিয়ড সাইকেল বন্ধ হয়ে গেল! কিছুদিন যাবত আমি শরীরে ঠিকঠাক তাল খুঁজে পাচ্ছি না। খাওয়া, দাওয়া, চলাফেরায় সবকিছুতেই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে মাথা ঘুড়ানো আর বমি ভাবটা ভয়ঙ্কর পর্যায়ে আছে। এই তো আজ সকালেই শ্বাশুড়ী মায়ের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই হঠাৎ মাথা ঘুড়ে এলো আমার। ভাগ্যিস বিছানাতেই মাথা ঘুড়িয়ে পড়েছিলাম, নয়তো ফ্লোরে ছিটকে পড়লে সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটে যেত। আমার মা বিষয়টা জানার পর থেকেই ভীষন টেনশানে আছেন। ভাবছেন আমার হয়তো কোনো অসুখ করেছে। কিন্তু যখন বললাম আমার পিরিয়ড সাইকেল ও বন্ধ হয়ে আছে তখনই মা ফার্মেসী থেকে প্রেগনেন্সি কিট এনে বললেন পরীক্ষা করে দেখতে। পরদিন সকালে পরীক্ষা করতেই ফলাফল পজেটিভ এলো! বাকরুদ্ধ হয়ে আমি দীর্ঘ ১৫ মিনিট বিছানার উপর বসে ছিলাম। নেত্রযুগল থেকে অজান্তেই খুশির অশ্রু বাহিত হচ্ছিল। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করব! খবরটা কি প্রথমেই বাবা-মাকে জানাব? নাকি পরশকে একবার কল করব? দোটানায় ভুগে একই জায়গায় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতেই হঠাৎ মিলি আপু দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করলেন। ব্লু কালার একটা ড্রেস হাতে নিয়ে আপু মৃদ্যু হেসে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,
“ড্রেসটা কেমন টয়া? সুন্দর না?”
নিবার্ক চিত্তে আমি সামনে পিছনে মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালাম। আপু ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ড্রেসটা ট্রায়াল দিচ্ছেন আর বলছেন,,
“পিয়াস গিফট করেছে! একটু পরেই ওর সাথে ঘুড়তে বের হব!”
আমার মৌনতা দেখে আপু পিছু ঘুড়ে তাকালেন। অতঃপর কপালে কয়েক জোড়া উদ্বিগ্নতার ভাঁজ ফুটিয়ে বললেন,,
“কি করে? কি হয়েছে তোর? এই ভাবে চুপচাপ বসে আছিস কেন?”
হাতে থাকা কিটটা আমি আপুর সম্মুখে ধরে বললাম,,
“পজেটিভ!”
সঙ্গে সঙ্গেই আপু উচ্চ আওয়াজে হেসে আমায় ঝাপটে ধরে বললেন,,
“কংগ্রাচুলেশন বনু! উফফফস দাঁড়া। খবরটা আমি বাড়ির সবাইকে দিয়ে আসছি!”
আপু প্রানপনে ছুটে গেলেন নিচ তলার দিকে। আমি বালিশের তলা থেকে ফোনটা বের করে পরশের নাম্বারে ডায়াল করলাম। সঙ্গে সঙ্গেই লোকটা কলটা রিসিভ করে ব্যতিব্যস্ত গলায় বললেন,,
“অফিসে আছি টয়া। খুব ব্যস্ত এখন। একটু পর কল ব্যাক করছি। আর হ্যাঁ প্লিজ রাগ কর না। জাস্ট ফাইভ মিনিটস ওকে? ফাইভ মিনিটসের মধ্যেই কল ব্যাক করছি!”
নির্বিকার নির্লিপ্ত গলায় আমি প্রত্যত্তুরে লোকটাকে বললাম,,
“উপপপস বাবা হতে চলেছেন আপনি! এত ব্যস্ততা দেখালে চলবে?”
#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৩২
#নিশাত_জাহান_নিশি
“উপপপস বাবা হতে চলেছেন আপনি! এত ব্যস্ততা দেখালে চলবে?”
টেলিফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি সম্পূর্ণ নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ, নির্বাক! অনুভূতি শূণ্য এক স্তব্ধিত মূর্তিপ্রায়। শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচলের ক্ষুদ্রতম আওয়াজ ও কর্নপাত হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন আমি একাই শূন্যতার সাথে কথা বলছি! মানুষটা কি খুশিতে মরেই গেল? পাল্লা দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হচ্ছে আমার। কিয়ৎক্ষনের মধ্যে ভয়ঙ্কর ভয় চেঁপে বসল বুকে। লোকটা এত নির্বিকার নির্লিপ্ত কেন? হয়েছেটা কি লোকটার? কখনো সখনো তো এমন হয়, অতি খুশিতে মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে যায় নতুবা ছোট খাটো হার্ট এ্যাটাক করে বসে! হায় আল্লাহ্! লোকটার আবার এমন কিছু হয়ে গেল না তো? এসব অবাঞ্ছিত বিষয় জল্পনা কল্পনার মধ্যেই টুং টাং শব্দে কখন যে ফোনটা কেটে গেল ঠিক ঠাওড় করতে পারলাম না আমি। ফোনটা কেটে যাওয়ার প্রায় পঞ্চদশ মুহূর্ত পরে ও সেই একই ভাবে ফোনটা কানে ধরে রেখেছি আমি। লোকটার প্রতিক্রিয়া আদৌ বুঝতে পারছি না আমি। আমার কি উচিত পুনরায় লোকটাকে ফোন করা? হ্যাঁ ফোন করাই উচিত! ফোনটা করেই দেখি না! কি হয়! কান থেকে ফোনটা দৃষ্টির সম্মুখে ধরে আমি পুনরায় লোকটার নাম্বারে ডায়াল করতেই শ্বাশুড়ী মায়ের নাম্বার থেকে পাল্টা কল এলো। ঠোঁটের কোণে মলিন হাসি ফুটিয়ে আমি কলটা তুলতেই মা ঐ প্রান্ত থেকে আনন্দে আপ্লুত গলায় বললেন,,
“আলহামদুলিল্লাহ্ আলহামদুলিল্লাহ্ আলহামদুলিল্লাহ্। আল্লাহ্ র দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া মা। অবশেষে আমি দাদি হতে চলেছি। তুমি জানো না টয়া, আমি যে কি ভীষন খুশি হয়েছি! মায়ের উপর রাগ করে থেকো না টয়া। সব ভুলে তুমি বাড়ি ফিরে এসো। তোমার বাবাকে বুঝাও। প্রয়োজনে আমি এবং তোমার শ্বশুড় বাবা আসব তোমার বাবাকে বুঝাতে। তোমাকে ফিরিয়ে আনতে।”
“মা আপনি তো জানেন। আপনার ছেলে বাবাকে কিসব চ্যালেন্জ্ঞ ছুড়ে দিয়েছেন। ১ মাস পূর্ণ হওয়ার পূর্বে আপনার ছেলে হার মানবেন না। আমি বলেছিলাম আপনার ছেলেকে, আপনাদের নিয়ে এই বাড়িতে আসতে। কিন্তু উনি মুখের উপর মানা করে দিয়েছিলেন!”
মধুর স্বর পাল্টে মা কিঞ্চিৎ খড়তড় গলায় বললেন,,
“আমার ছেলেটা ও হয়েছে এক রোঁখা। আর তোমার বাবা ও কিন্তু কম যায় না টয়া! তোমার পাঁচ আঙ্গুলে কপাল বুঝেছ? আমার ছেলেকে স্বামী রূপে পেয়ছ! তুমি যে পরিমান অলস, নির্বোধ, কাজে অপরিপক্ক, হিতাহিত জ্ঞান শূন্য। আমি অন্তত মনে করি না পৃথিবীর কোনো সংসারে এত অনায়াসে তুমি টিকতে পারতে! আমার ছেলে তোমাকে ছাড় দেয় বলেই তুমি আমার সংসার জীবনে টিকে আছো! এই বিষয়টা তোমার বাবাকে বুঝতে হবে। এত অহংকারী, দাম্ভিক, নির্বোধ প্রকৃতির মানুষ আমার পছন্দ নয়। তোমার বাবা এই পর্যায়ে এসে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে!”
প্রসঙ্গ পাল্টাতে আমি বিষন্ন গলায় মাকে শুধিয়ে বললাম,,
“আপনার ছেলে কল করেছিলেন মা? নয়তো আপনি খবর টা জানলেন কিভাবে?”
“পরশ ম্যাসেজ করেছিল। ফোনে কথা হয় নি।”
“আমি তো ফোনে কথা বলছিলাম মা। কোনো কথা বার্তা ছাড়াই হঠাৎ করে উনি কলটা কেটে দিলেন! তাই টেনশান হচ্ছে!”
“টেনশান করার কিছু নেই। হয়তো কাজে ব্যস্ত আছে। কি পোঁড়া কপাল আমার। দাদি হচ্ছি জেনে ও বউমাকে কাছে পাচ্ছি না। সব হয়েছে তোমার বাবার হটকারী সিদ্ধান্তের জন্য!”
“থাক না মা। দয়া করে বাবাকে আর কিছু বলবেন না। মেয়ে হওয়ার বদৌলতে মন খারাপ আমার ও হয়!”
প্রত্যত্তুরে মা তটস্থ গলায় বললেন,,
“রাখছি এখন। ভালো থেকো, নিজের যত্ন নিও। আর হ্যাঁ, অতি শীঘ্রই নাতি, নাতনী সমেত আমার বাড়িতে ফিরে এসো।”
ফট করেই কলটা কেটে দিলেন মা। ঐ দিকে নিচ তলা থেকে খুশির আমেজ ভেসে আসছে আমার রুম অবধি! ফোন হাতে রেখেই আমি খুশির রেশ ধরে দরজার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই দেখলাম মা দ্রুত পায়ে হেঁটে এলেন আমার নিকটে। আনন্দে মা আমায় ঝাপটে ধরে বললেন,,
“আমি খুব খুশি রে মা। খুব খুব খুব খুশি। ফারিহার পূর্বেই তুই মা হতে পেরেছিস! তোর সন্তান দিয়েই আমাদের পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম বাড়বে!”
আমি নির্লিপ্ত গলায় মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,
“বাবা? বাবার প্রতিক্রিয়া কি মা?”
মা অট্ট হাসিতে ব্যস্ত হয়ে বললেন,,
“মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে! পরশের প্ল্যান এই মাত্র উনার ঘিলুতে ঢুকেছে!”
ফিক করে হেসে দিলাম আমি। ইতোমধ্যেই মিলি আপু সহ কাজিনরা এসে আমায় নিয়ে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠল। বড় আপু কিছুক্ষন পর পর ভিডিও কলে আমাদের দেখছেন। আমাদের খুশিতে খিলখিল করে হাসছেন। মাঝে মাঝে নেত্র কোটরে জল ও জমে আসছে আপুর! আপু এবং জিজু অনেক চেষ্টা করে ও কোনো সু-সংবাদ দিতে পারছেন না আমাদের। এর জন্যই আপু সামান্য হতাশ। ঐদিকে বাবা সুখবরটা শোনার পর থেকে রুম বন্ধী হয়ে আছেন। কিছুতেই যেন রুম থেকে বের হতে চাইছেন না। হয়তো নিজেকে ব্যর্থ ভাবছেন! পরশের কাছে হেরে যাওয়ার কারনে নিজেকে ছোট ভাবছেন! অথবা হেরে যাওয়ার পর পরশের সাথে নিজ থেকে কথা বলতে খুব দ্বিধা-দ্বন্ধে ভুগছেন!
দুপুর হতেই আমি নিচে নেমে এলাম। বাবাকে ড্রইং রুমের কোথাও দেখতে না পেয়ে সোজা বাবার রুমে চলে এলাম। রুমের দরজাটা হালকা ভেজানো৷ তাই সহজেই আমি দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করতে পারলাম। ব্যালকনীতে পাতা ইজি চেয়ারটায় বাবা আঁখিদ্বয় বুজে শায়িত অবস্থায়। মন্থর গতিতে হেঁটে আমি বাবার সন্নিকটে এলাম। বাবার মুখোমুখি দাঁড়াতেই মুখমন্ডলে অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা, বিষন্নতার ছাপ দেখতে পেলাম! হাঁটু গেড়ে বসে আমি বাবার হাত দুটো আঁকড়ে ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গেই বাবা হকচকিয়ে উঠলেন এবং বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। পলকহীন দৃষ্টিতে আমি বাবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,
“কি হয়েছে বাবা? তুমি এতো স্যাড কেন?”
অনতিবিলম্বে বাবা মাথা নুঁইয়ে নিলেন। অল্প সময় মৌণতা বজায় রেখে অতঃপর বেদনাহত দৃষ্টিতে আমার দিকে দৃষ্টি স্থির করে বললেন,,
“সত্যিই কি বাবার ভালোবাসার তুলনায় স্বামীর ভালোবাসা বেশি বড়?”
“আমি কখন ও এই দুটো সম্পর্ককে তুলনা করে দেখি নি বাবা। দুটো সম্পর্ককেই দুটো সম্পর্কের জায়গায় সবসময় রেখেছি, মনে প্রাণে ধারন করেছি! কোনোটাই আমার কাছে কম, বেশি নয়! দুটোই সমান।”
“আমার কি মনে হয় জানিস? তোর কাছে তোর বাবার ভালোবাসার চেয়ে তোর স্বামীর ভালোবাসা অধিক প্রিয়! তাই তো তুই বাবাকে ছেড়ে, বাবাকে কষ্ট দিয়ে, বাবার মান-সম্মান নষ্ট করে, সমাজের কাছে বাবাকে ছোট করে ঐ ছেলেটার হাত ধরে নির্দ্বিধায় পালিয়েছিলি! ভুলে গিয়েছিলি বিগত ২২ বছর ধরে আমি তোকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে লালন পালন করেছি। লাইফে অনেক বড় বড় সেক্রিফাইজ করেছি। কত যত্নে, কত আদরে, কত ভালোবাসায় তোকে মানুষ করেছি! কয়েকদিনের ভালোবাসার কাছে সেই ২২ বছরের ভালোবাসা এতটা তুচ্ছ হয়ে গেল?”
মাথা নুঁইয়ে আমি অশ্রুবিলাসে মশগুল হয়ে পড়লাম। এই মুহূর্তে প্রত্যত্তুরে বাবাকে কি বলা উচিত সঠিক বুঝে উঠতে পারছি না আমি। এর মধ্যেই রুমে তৃতীয় কারো উপস্থিতি টের পেলাম। মা রুখে এলেন বাবার দিকে। তটস্থ গলায় বাবাকে বললেন,,
“ভুলে যেও না আফজাল। তুমি ও একজন স্বামী! বাবার পাশাপাশি তুমি ও কিন্তু একজন স্বামী। আমি ও কিন্তু একটা সময় আমার বাবা-মাকে ছেড়ে তোমার হাত ধরে তোমার এই বাড়িতে উঠেছিলাম। আমাদের বিয়েটা ও কিন্তু এরেন্জ্ঞ ছিল না! লাভ ম্যারেজ ছিল। আমার বাবা ও প্রথমে রাজি ছিলেন না তোমার মতো একজন বেকার যুবকের কাছে আমার বিয়ে দিতে! অনেক কথা কাটি, অনেক ঝগড়া- বিবাদ, অনেক মনোমালিন্যের দীর্ঘ একটা সময় পর পরিশেষে বাবা রাজি হয়েছিলেন। তখন কিন্তু আমি বাবার তুলনায় তোমার ভালোবাসাকেই অধিক প্রাধান্য দিয়েছিলাম! শুধু আমার ক্ষেত্রে নয় পৃথিবীর সবক’টা মেয়ে একটা নির্দিষ্ট সময় পর যখন তার জীবনে মা-বাবার পর বিশেষ কোনো ভালো লাগা বা ভালোবাসার মানুষ আসে তখন সে তাকেই প্রাধান্য দিবে এটাই নিতান্ত স্বাভাবিক এবং বাস্তবিক ব্যাপার। আর বিয়ের পর তো স্বামীই হবে তার ভবিষ্যত, তার বাঁচা-মরা! দীর্ঘস্থায়ী এক পবিত্র বন্ধনে তারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এটাই জাগতিক নিয়ম। জগৎ সংসার তৈরী হওয়ার পর থেকেই এই নিয়ম যথারীতি প্রয়োগ হয়ে আসছে। তাহলে তুমি নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে কেন এই স্বাভাবিক নিয়মটাকে মেনে নিতে পারছ না? যেভাবেই হোক, বিয়েটা তো হয়েই গেছে! এখন সে নতুন একটা সংসারে জড়িত। স্বামী এখন ও জীবিত তার। এখন তো আমাদের মেয়ে সন্তান সম্ভাবা ও। তুমি কে বলো? তাদের তিন তিনটে প্রাণকে আলাদা করার? তুমি কি বুঝতে পারছ না? তুমি পিতার ভালোবাসায় এতটাই অন্ধ হয়ে গেছ যে, নিজের মেয়ের ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষতি করছ? তার সাংসারিক জীবন নষ্ট করছ? একটা কথা বলি শোন? তোমার মেয়ের পাঁচ আঙ্গুলের কপাল বুঝেছ? পরশের পরিবারের মতো এত ভালো একটা সংসার পেয়েছে। পরশের মায়ের মতো একজন জ্ঞানী এবং মিষ্টি শ্বাশুড়ী মা পেয়েছে! কি গুন আছে তোমার মেয়ের? না জানা আছে ভালো কাজ না জানা আছে সহবোধ! আক্কেল, জ্ঞান আছে নাকি তোমার মেয়ের? সামান্য ভাতটা পর্যন্ত রান্না করতে পারে না সে! আর তুমি যে লাফাচ্ছিলে, পিয়াসের কাছে তোমার মেয়েকে বিয়ে দিতে। তুমি জানো না? বড় আপার স্বভাব, চরিত্র? আপা কতটা বদরাগী, অহংকারী এবং জালিম স্বভাবের? পরশের পরিবার তো তোমার মেয়েকে সহ্য করে আসছে আর ভবিষ্যতে ও করবে। কিন্তু আমার আপা? সংসারে যাওয়ার ঠিক ৪/৫ দিনের মধ্যেই তোমার মেয়েকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদায় করে দিতেন! তখন পারতে বাবা হয়ে বিষয়টা সামলে নিতে?
কিয়ৎক্ষনের মধ্যে বাবা গর্জে উঠলেন। হুংকার দিয়ে বললেন,,
“রুম থেকে বের হও তোমরা। আমাকে একটু একা থাকতে দাও প্লিজ। আজ সারাদিনের জন্য এই রুমে তোমাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। আমি একটু একা থাকতে চাই!”
আমি ফ্যাস ফ্যাস করে কেঁদে উঠতেই মা দাঁতে দাঁত চেঁপে আমায় বললেন,,
“এই তোর ন্যাকা কান্না বন্ধ কর। রুম থেকে বের হ। নানা হওয়ার কোনো খুশিই দেখছি না এই লোকের মধ্যে! আছে শুধু নিজের দাম্ভিকতা নিয়ে। পঁচে মরুক এই লোক এই একাকিত্ব রুমে। আসব না আমি বলছি তো। আজ সারাদিনের জন্য আমি এই রুমে আসব না!”
আম্মু রাগে গজগজ করে আমায় নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এলেন। দুপুরের খাবার খেয়ে আমি রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। এক কদম ও রুমের বাইরে বাড়ালাম না। পরশটা ও সকাল থেকে কল তুলছেন না। টেনশানে আমার হাত পা থরথরিয়ে কাঁপছে। অস্থিরতা এবং অস্বস্তিতে ভুগছি ক্রমাগত। এই উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়েই রাত ১০ টা বাজতে চলল ঘড়িতে। রাতের খাবার খেয়ে রুমে প্রবেশ করতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল। পরশ বিছানার উপর হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে লম্বভাবে শুয়ে আছেন। তাড়াহুড়ো করে আমি রুমের দরজাটা আটকে বিছানায় বসেই ব্যতিব্যস্ত গলায় বললাম,,
“আপনি? কখন এলেন? নিচেই তো ছিলাম আমি। বাড়িতে প্রবেশ করতে তো দেখি নি!”
পরশ চোখ বুজা অবস্থাতেই নির্লিপ্ত গলায় বললেন,,
“শালীদের প্রয়োজন তো এই দিনেই। জিজুদের হেল্প করার জন্য। শালীরাই কায়দা করে আমায় তোমার রুম অবধি পৌঁছে দিয়ে গেছে!”
“সারাদিন কোথায় ছিলেন আপনি? কলটা ও তো তুলছিলেন না। একবার ও কি মনে হয় নি আমাকে কল ব্যাক করার?”
হুড়মুড়িয়ে পরশ শোয়া থেকে উঠলেন। ঠোঁটের কোনে প্রাণোচ্ছ্বল হাসি ফুটিয়ে পরশ ডেস্কের উপর থেকে ফুলের বগিটা হাতে নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলেন আমার মুখোমুখি! ফুলের বগিটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে লোকটা মাধূর্য্যমন্ডিত গলায় বললেন,,
“কংগ্রাচুলেশান আমার মেয়ের মাম্মাম! জানি বড্ড লেইট করে ফেলেছি আমার দু দুটো ভালোবাসার মানুষকে উইশ করতে। কি করব বল? সু-খবরটা শোনার পর থেকে আমি সারাদিনের জন্য অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়েছিলাম। বুঝে উঠে পারছিলাম এই খুশিতে ঠিক কতটা রিয়েক্ট করা উচিত। অফিসের কাজ ছেড়ে দিশেহারা হয়ে আমি বাড়ি ফিরি। মায়ের কোলে মাথা ঠেঁকিয়ে সারাটা দিন পাড় করেছি। খুশির কান্না যেন কিছুতেই থামছিল না আমার! সন্ধ্যা হতেই ফুল, মিষ্টি, গিফটস নিয়ে এই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া। আর এখন, অনেকটা দেরিতেই তোমাদের মুখোমুখি হয়ে বসা। বুকে হাত দিয়ে দেখতে পার টয়া, আমার হৃদস্পন্দন কতটা তিপ তিপ শব্দে কাঁপছে। বাবা হওয়ার অনুভূতি এতটা প্রখর আর প্রগাঢ় হয় তা আজ মাত্র উপলব্ধি করলাম আমি। জানি না আগামী ৮/৯ মাস আমি কিভাবে কাটাব! আমার সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া অবধি আদৌ আমার শান্তি মিলবে কিনা!”
টলমল দৃষ্টিতে আমি ফুলের বগিটা হাত বাড়িয়ে নিতেই পরশ ঝড়ের বেগে প্যান্টের পকেট থেকে একটা লাল কাপড়ে মোড়ানো আংটির বক্স বের করলেন। বক্সটা খুলতেই ডায়মন্ডের রিং টা চকচক করে উঠল। বিস্মিত দৃষ্টিতে আমি রিংটার দিকে তাকাতেই পরশ মৃদ্যু হেসে রিংটা আমার বাঁ হাতের তর্জনী আঙ্গুলে অতি যত্নের সহিত পড়িয়ে দিয়ে বললেন,,
“মা হওয়ার প্রথম উপহার। আমি না ভেবে রেখেছি জানো? আগামী প্রতিটা মাসে আমি তোমার জন্য কিছু না কিছু একটা গিফটসের ব্যবস্থা রাখব। প্রতিটা মাস একই ভাবে স্মরনীয় করে রাখব। প্রথম বেবি আমাদের! দিন গুলো স্মরনীয় করে রাখতে হবে না?”
প্রেমময়ী নির্বাক দৃষ্টি আমার লোকটার দিকে সীমাবদ্ধ। কতটা খুশি লোকটা! বাবা হওয়ার আনন্দে। আমাকে পেয়ে ও বোধ হয় লোকটা এতটা খুশি হন নি! যতটা খুশি হয়েছেন বাবা হওয়ার উচ্ছ্বাসে! আংটি টা পড়ানোর পর লোকটা আচমকা চোখের পানি ছেড়ে আমার বাঁ হাতটায় দীর্ঘ এক চুমো খেয়ে বললেন,,
“থ্যাংকস টয়া। পৃথিবীর সব’চে মধুরতম এবং শান্তিময় অনুভূতিটা আমাকে অনুভব করানোর জন্য। আই কান্ট এক্সপ্লেইট দেট ফিলিংস টয়া! আই কান্ট এক্সপ্লেইন!”
ইতোমধ্যেই হঠাৎ রুমের দরজায় করাঘাত পড়ল। রুম্পা আপুর গলার আওয়াজ কর্নপাত হলো। উফফস বলতেই ভুলে গেছি! রুম্পা আপু আজ বিকেলেই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। কিছুদিন থেকেই আবার চলে যাবেন। দরজায় পর পর কয়েক বার কড়াঘাত পড়ার পর আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের দরজাটা খুলে দিলাম। আপু চোখের চশমাটা ঠিক করে হাতে মিষ্টির প্লেইট সমেত অধৈর্য্য গলায় আমায় বললেন,,
“জিজু মিষ্টি এনেছেন। তোদের দিতে আসছিলাম। হঠাৎ দেখি জেঠু এই রুমের দিকে এগিয়ে আসছেন! যেভাবেই হোক, জিজুকে বল লুকিয়ে পড়তে। গেইমের শেষ পর্যায়ে এসে এভাবে হেরে গেলে চলবে না!”
অস্থির হয়ে উঠলাম আমি। পিছু ফিরে পরশের দিকে উৎকন্ঠিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলাম পরশ অলরেডি ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছেন! দরজা থেকে মুখ বের করে পরশ ক্রুর হেসে বললেন,,
“আমি ওয়াশরুমে আছি। দজ্জাল শ্বশুড় কে ভেতরে আসতে দাও! হেরে যাওয়ার পর দেখি আমার শ্বশুড় মশাইয়ের প্রতিক্রিয়া কি!”
ফট করে ওয়াশরুমের দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন পরশ। সঙ্গে সঙ্গেই বাবা আমার রুমের দরজায় এসে অবস্থান নিলেন। রুম্পা আপু শুকনো ঢোক গিলে মিষ্টির প্লেইটটা আমার দিকে এগিয়ে বললেন,,
“খেয়ে নিস মিষ্টি টা। নানু হওয়ার খুশিতে জেঠিমনি অর্ডার করেছিলেন!”
মিষ্টির প্লেইটটা হাতে নিয়ে আমি জোর পূর্বক হাসি টেনে বাবাকে রুমে সাদরে আমন্ত্রন জানিয়ে বললাম,,
“এসো বাবা। রুমে এসো!”
ম্লান হেসে বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে রুমে প্রবেশ করলেন। বিছানায় আমার পাশে বসে বাবা হঠাৎ মাথা নুঁইয়ে আমায় শুধিয়ে বললেন,,
“আমি খুব খারাপ বাবা! তাই না রে টয়া?”
আহত হলাম আমি। বাবার এহেন হৃদয়বিদারক কথায়। উদ্বিগ্ন গলায় আমি বাবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,
“এসব তুমি কি বলছ বাবা? আমি কখনো বলেছি? আমার বাবা খারাপ?”
“বলিস নি৷ তবে মনে মনে তো ধারনা করতেই পারিস!”
“তুমি ভুল বুঝছ বাবা। আমি কখনো তোমায় নিয়ে এমন ধারনা পোষণ করি নি।”
“আজ আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি! বিয়ের পর মেয়ের শ্বশুড় বাড়িই হলো মেয়ের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল৷ যেখানে সে নিজ পরিবারের মতোই একটা নতুন পরিবার পায়, নতুন মা-বাবা পায়, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষজন, নতুন সংসার, নতুন সব! আর তার স্বামীই হলো সেই সংসারের প্রাণ! সেই জায়গায় পরশ একদম ঠিক তোর জন্য! বিষয়টা প্র্যাক্টিক্যালি ভেবে দেখলাম, আমি অযথা চেষ্টা করছি তোর থেকে তোর স্বামী, সংসার আলাদা করতে। মন থেকে আমি কিছুতেই পরশকে মেনে নিতে পারছি না! কারন, পরশের সাথে আমার এখন ও, ঐ রকম ভালো কোনো সম্পর্কই তৈরী হয়ে উঠে নি। সেই সুযোগটাই এখন ও হয়ে উঠে নি। সবসময় দুজন দুজনকে দোষারোপ করেছি, গাল মন্দ করেছি, নিজেদের অহংকার বজায় রেখেছি! আমার না খুব খারাপ লাগছে! এইভাবে হেরে যাওয়ার পরে ও পরশের সাথে কথা বলতে। তাকে এই বাড়িতে ডেকে আনতে! খুব বিবেকে বাঁধছে আমার। কি করি বল তো? তুই একটু আমার হয়ে পরশকে বলবি এই বাড়িতে আসতে? তোকে সাথে করে নিয়ে যেতে? আর পারছি না নিজের কিঞ্চিৎ পরিমান দাম্ভিকতা ভুলে পরশকে আমন্ত্রণ করতে! সাথে এ ও পারছি না সন্তানসম্ভবা হওয়ার পরে ও তোকে জোর খাঁটিয়ে এই বাড়িতে আটকে রাখতে! কি করব আমি বল তো?”
ইতোমধ্যেই পরশ ওয়াশরুমের দরজা থেকে আমায় ইশারা করে বলছেন যেন বাবাই পরশকে কল করেন! আমি যেন কিছুতেই রাজি না হই পরশকে কল করে এই বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে!
#চলবে…?
#চলবে…?