#প্রেমনগর
পর্বঃ৭
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
আজ এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার দিন। তুলি এবার পরীক্ষা দিয়েছিলো। তুলির রেজাল্ট পাওয়া যায়। গাধী তুলি তিন সাবজেক্টে ফেল করেছে। ইংরেজি, ভূগোল এবং পৌরনীতিতে। তুলির মা মুখ দেখাতে পারছেন না। আত্মীয় সজনের সামনে মান সম্মান সব গেল। তুলির বাবাও লজ্জায় ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। তিনি ফোন করে তুলিকে গ্রামে নিয়ে যেতে বলেছেন। তুলির মা তুলিকে অনেক বকাবকি করতে করতে এক পর্যায়ে ঝাড়ু নিয়ে এসে পেটানো শুরু করলেন তখন অহনার মাসহ বাড়ির লোকজন এসে তুলির মাকে আটকায়। চিল্লাচিল্লিতে বাড়ি একদম মাথায় উঠে গেছে৷ নতুন জামায়ের সামনে এসব ঘটনায় অহনার বাবা মাও একরকম লজ্জায় পরে গেলেন। কাঁদতে কাঁদতে তুলি দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো।
.
অনেকক্ষণ থেকে তার কোনো সাড়া শব্দ নেই। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকা হলেও সে কোনো সাড়া দেয় নি।
শরিফাঃ খালাম্মা আফায় তো দরজা খুলে না। আফা খাইবো না?
তুলির মা রেগে বললেন,তোর এতো দরদ কিসের যা এখান থেকে। ওকে খাবার দেবার দরকার নেই।
.
মেঘ নীলাদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলো। দেখলো সেখানে ড্রইংরুমের ভিতর অনেক মানুষের জটলা বেধে আছে। মেঘকে দেখে শ্রাবনী এগিয়ে এলো,
শ্রাবনীঃ তোমার জন্যই এমনটা হয়েছে, কাল পানিটা খেলে কি এমন হতো!
শ্রাবনীর কথা শুনে মেঘের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
মেঘঃ নীলা ঠিক আছে তো?
তখনই নীলার মা এগিয়ে এসে বললেন, ডাক্তার এসেছিলো। ওর পেট থেকে ঔষধ গুলো ওয়াশ করে বের করা হয়েছে আর কোনো ভয় নেই কিন্তু ওর জ্ঞান এখনো ফেরেনি!
শ্রাবনীঃ তুমি পানিটা কেন খেলে না মেঘ!
নীলার মা তখনই ভ্রু কুচকে জিগাসা করলেন, কিসের পানি?
শ্রাবনী এবার মুখ ফসকে বলে ফেললো, নীলা একটা পানি এনেছিল সেই পানি।
তার পরেক্ষনেই সাথে সাথে জিব্বায় কামড় দিয়ে বলে উঠলো, কিছুনা আন্টি কিছু না!
নীলার মা কিছুই বুঝলো না,তিনি বললেন, কাল সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার সময় ওর হাতে একটা ছোট পানির বোতল দেখেছিলাম।
শ্রাবনী চোখ বড় বড় করে বললো, তার মানে নীলা কালও শ্যামপুর গিয়েছিলো?
নীলার মা ভ্রু কুচকে আবার বললেন, মানে?
শ্রাবনীও আস্তে করে আবার বলে উঠলো, না আন্টি কিছু না।
তারপর মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো, সব কিছু হয়েছে তোমার জন্য!
নীলার মা এবার মেঘের দিকে তাকালেন আর সন্দেহবসত বললেন, তুমি কিছু করোনি তো?
.
নীলার মা ভ্রু কুচকে মেঘের দিকে তাকিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে তাকিয়ে মেঘকে দেখছেন। মেঘ একটু জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললো, না না আন্টি,আমি আবার কি করবো!
নীলার মা তখনই নীলার বাবাকে ডাকলেন, ওগো এদিকে এসো,এই ছেলেটাই কিছু একটা করেছে।
নীলার বাবা এখানে এসে দাঁড়ালেন৷ ভয়ে মেঘের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
মেঘঃ আংকেল আমি কিছু করি নি!
নীলার বাবা রাগী গলায় বললো, তোমায় আমি পুলিশে দেব!
মেঘঃ আংকেল এখন তো নীলার বিপদ কেটে গেছে আর কোনো ভয় নেই।
নীলার বাবাঃ তাহলে আমার মেয়ে চোখ খুলছে না কেন!
মেঘঃ আমি খোলাবো….নীলার রুমটা কোনদিকে?
শ্রাবনী হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিয়ে বললো,ওই যে ওইদিকে…
মেঘ দৌড়ে সেদিকে চলে যায়
নীলার মাঃ এই ছেলে এই… তুমি ওইদিকে কোথায় যাচ্ছো!
বাকিরাও সবাই মেঘের পিছু পিছু এসে নীলার রুমে উপস্থিত হয়।
.
তুলি দরজা খুলছে না। ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দও নেই। তুলির মা এবার ভয় পেয়ে গেলেন। ভিতরে কোনো অঘটন ঘটে নি তো! বাড়িতে কান্নার রোল উঠে গেল। দরজায় অনেক বার ঢাক্কা ঢাক্কি করার পরও কোনো কাজ হলো না। দরজা ভিতর থেকে লক৷ মিস্ত্রি এনে দরজা ভাঙা হলো।
এইসব কান্ড দেখে রৌদ্র সবার চোখের আড়ালে মুচকি মুচকি হাসছে।
.
দরজা ভাঙার সাথে সাথেই সবাই হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পরে। তুলির মা চিৎকার করে বলছেন, মা রে তুলি!
তুলি অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পরে আছে। তাকে ধরে বিছানায় তোলা হয়। আকাশ এসে তুলির চেক আপ করছে।
আকাশঃ ভয়ের কিছু নেই, আপনারা শান্ত হন। জ্ঞান এখনই ফিরবে। ওর কিছুই হয় নি। ভয়ই মেয়েটা জ্ঞান হারিয়েছে।
পানি ছেটানোর পর তুলি চোখ খুললো।
.
মেঘ নীলার রুমে এসেই নীলাকে অনবরত ডেকে যাচ্ছে।
মেঘঃ এই নীলা ওঠ। ওঠ না? তোর বাবা তোমাকে পুলিশ দেবে বলছে। ওঠ না। আমি তোর পানি খাব। কোথায় রেখেছিস পানি বল৷ আমি এক্ষুনি খেয়ে নিচ্ছি।
মেঘ নীলার রুমে এখানে ওখানে পানির বোতল খুঁজতে থাকে,
মেঘঃ এই নীলা বল না কোথায় রেখেছিস বোতলটা আমি তো খুঁজে পাচ্ছি না৷
নীলার মাঃ এই ছেলে এই তুমি রুমের জিনিস পত্র এভাবে এলো মেলো করছো কেন!
মেঘঃ আমি বোতলটা খুঁজে পাচ্ছি না। নীলা বল না কোথায় রেখেছিস!
নীলার মাঃ আরে কিসের পানি!! কিসের বোতল!
.
কিছুক্ষণ পর নীলা চোখ খুললো। আর বালিশের নিচ থেকে সে বোতলটা বের করলো। মেঘ সেটা দেখার সাথেই কিছু না বলে নীলার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে বোতলের সব পানি টুকু খেয়ে নেয়। সবাই চোখ বড় বড় করে সেদিকে চেয়ে আছে।
মেঘঃ আংকেল দেখুন আপনার মেয়ে এখন চোখ খুলেছে।
নীলাঃ তোমরা সবাই এখন যাও এখান থেকে।
.
সবাই একে একে চলে গেল। মেঘ বিছানা থেকে উঠতেই নীলা মেঘের হাত টেনে ধরে,তুই কোথায় যাচ্ছিস। তুই বস।
মেঘঃ কেন এরকম করেছিলি। তোর যদি কিছু হয়ে যেত।
নীলাঃ হলে তো তুই সব থেকে বেশি খুশি হতি।
মেঘঃ চুপ! এরকম কথা আর কখনো বলবি না৷
.
হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীলা এগিয়ে এসে মেঘের ঠোঁটে চুমু দিয়ে ফেললো আর মেঘকে জড়িয়ে ধরে রইলো।
.
অহনার কে বিদায় দেয়া হয়েছে। বিদায়ের সময় অহনা প্রচন্ড রকমের হাসি হাসছিলো । তুলিরও ওই বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু তুলি পরীক্ষায় ফেল করায় তুলির মা রাগ করে তুলিকে নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। আকাশ, অহনা এবং রৌদ্র বেড়িয়ে পরলো প্রেম নগরের উদ্দেশ্য। গাড়িতে বসে অহনা এখনো হেসেই যাচ্ছে।
আকাশঃ কি আশ্চর্য! এভাবে পাগলের মতো হাসছো কেন?
অহনারঃ কি করবো,আমার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে।
অহনা এবার মুখ চেপে আবারও হাসতে শুরু করলো।
আকাশঃ তোমাকে না বলেছি এভাবে পাগলের মতো যখন তখন হাসবে না! আর অবশ্যই ওই বাড়িতে গিয়ে এরকম করবে না তুমি।
.
হঠাৎ করে বিকট শব্দে গাড়ির টায়ার ফেটে গেল। আর চলন্ত গাড়িটা ব্রেক করে থেমে গেল। সবাই ঝাকুনি খেয়ে উঠলো।
আকাশঃ ওই দেখ তো কি হলো!
ড্রাইভার আর রৌদ্র নেমে দেখলো টায়ার ফেটে গেছে।
রৌদ্রঃ ভাইয়া টায়ার ফেটে গেছে। এটা চেইঞ্জ করতে হবে।
আকাশঃ ওট শিট! রাস্তা তো আরো বহুদুর। আর মেঘ কোথায় রে। সকাল থেকে ওর কোনো পাত্তাই পাচ্ছি না।
রৌদ্রঃ জানিনা ভাইয়া কোথায় গেছে। আমাকে বলে যায়নি।
ড্রাইভারঃ স্যার আমি সামনে এগিয়ে দেখছি কোনো গ্যারেজ আছে কিনা।
রৌদ্রঃ আমিও যাব।
আকাশঃ ঠিকাছে সাবধানে যাস।
.
রৌদ্র আর ড্রাইভার হাটতে হাটতে সামনে চলে গেল। রাত হয়ে এসেছে।
আকাশঃ এমন একটা জায়গায় গাড়িটা নষ্ট হলো কোনো জন মানবও নেই। আরেকদিকে আবার ঘন অন্ধকার।
অহনা এখনো হেসেই যাচ্ছে।
আকাশঃ সমস্যা কি তোমার। এমন একটা পরিস্থিতিতেও তুমি হাসছো?
অহনাঃ তো হাসবো না?
আকাশঃ কেন তোমার ভয় করছে না?
অহনাঃ ভয়? কিসের ভয়। না তো!
.
কিছুক্ষণ পর রৌদ্র আর ড্রাইভার একটা খোলা পুরোনো জিপ নিয়ে ফিরলো।
ড্রাইভারঃ স্যার সামনে কোনো গ্যারেজ নেই। এটা করেই যেতে হবে।
খোলা জিপটা দেখে আকাশ ভ্র কুচকে বলে উঠলো, এটা আবার কোথা থেকে পেলে?
ড্রাইভারঃ একটা বাংলো বাড়ির ভদ্রলোক দিলো।
জিপের ভিতরে সামনের সিটে বসা রৌদ্র বলে ওঠে, ভাইয়া ভাবিকে নিয়ে উঠে পর। আমাদের এটা করেই যেতে হবে তারপর সামনে গিয়ে একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
আকাশঃ আরে নাহ! আমি ফোন করে গাড়ি নিয়ে আসতে বলছি।
রৌদ্রঃ ভাইয়া প্লিজ! ওই গাড়ি আসতে আসতে আমরা অনেক দূর অবদি চলে যাব।
রৌদ্রের জোরাজুরিতে আকাশ আর অহনা গাড়িতে গিয়ে উঠলো। পুরোনো জিপ প্রচন্ড শব্দ করে করে আর ঝাকুনি দিয়ে দিয়ে চলছে। ঝাকুনিতে মাথার নাট বল্টু সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।
.
এদিকে মেঘ নীলার রুমে ঘুমিয়ে পরেছে। সন্ধ্যার নাস্তার পর পানি খাবার সময় মেঘের পানিতে নীলা কিছুটা এলকোহল মিশিয়ে দিয়েছিলো। আর তারপর নীলার রুমে এসে গল্প করতে করতে মেঘের চোখ দুটো আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে আসে।
.
চলবে….