#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-২৬)
#হালিমা রহমান
অর্জুন গাছের পাশেই একটা করমচা গাছ।গাছে করমচা নেই,খুব বেশি পাতাও নেই,সবল ডাল-পালাও নেই।মৃতপ্রায় গাছের ডালে একটা কাক অনেক্ষণ যাবৎ নিজ স্বরে ডাকছে।চারদিকের নিস্তব্ধতাকে গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে যেন কাকটা।মামুন একবার ক্লান্ত চোখে চেয়ে দেখে কাকটাকে।অন্য সময় হলে হয়তো তাড়িয়ে দিতো অবুঝ পাখিটাকে।কিন্তু এখন দিলো না।কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে আবারো আগের মতো চোখ বুঝে শুয়ে রইলো এবড়োখেবড়ো মাটির উপর।
ঠিক কত সময় ধরে সোনালীর কবরের উপর শুয়ে আছে তা জানা নেই মামুনের।একটু আগেও হৃৎপিন্ডের গতি তীব্র ছিল,হাত-পা কাঁপছিল।কিন্তু এখন আর এসব কিছুই হচ্ছে না।মামুন অনুভব করতে পারছে তার হৃৎপিন্ডের মন্থর গতি।হাত-পা কাঁপছে না ঠিকই তবে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই একফোঁটা। মাটির মাঝে শুয়ে থাকা মেয়েটা যেন সব শুষে নিয়েছে।চোখের জল শুকিয়ে চোখদুটো জ্বলছে খুব।দুটো চোখের মাঝে এতো এতো জল ছিল! মামুন অবাক হয়ে যায়।গলা শুকিয়ে কাঠ।গলা বেয়ে দুটো কালো পিঁপড়া নেমে গেল মাত্র।মামুন কিছুই করলো না।আগের মতোই হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রইলো কবরের উপর।
মামুন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে।চোখে পানি নেই তবে গলা দিয়ে অদ্ভূত শব্দ হচ্ছে।একবার নাক টেনে নেয় মামুন।জোরে শ্বাস নেয়।অক্সিজেনের সাথে কাঁচা মাটির গন্ধ হড়বড় করে প্রবেশ করে মামুনের ভিতর।আবারো তার চোখ বেয়ে একফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। কচ্ছপের মতো মাথা তুলে আলতোভাবে ঠোঁট ছোঁয়ায় মাটির উপর।ফলস্বরুপ কিছু শুকনো মাটি লেগে যায় মামুনের ঠোঁটে।সে সযত্নে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়।মাথায় নড়েচড়ে উঠে স্মৃতির পোকা। প্রথম দেখা থেকে শুরু করে কাল রাত পর্যন্ত সব কথা একে একে মনে পড়ে। থরে থরে সাজানো সব স্মৃতি। মনে পড়ে যায় সেই সন্ধ্যার কথা,প্রথম দেখার কথা। তারপর এক বাড়িতে থাকার সুবাদে কতবার দেখা হলো। সকাল,বিকাল, রাতে দেখতে দেখতেই ভালো লেগে গেল মেয়েটাকে।মেয়ের চলন-বলন সবকিছুতে মুগ্ধ হতো মামুন।সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো যখন হাম্মামখানা থেকে বেড়িয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুল মুছতো সোনালী।মামুনের চোখে এ ছিল এক অদ্ভূত সুন্দর দৃশ্য।কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে সোনালীকে দেখেছে সে! তারপর নদীর পাড়ের সেই মারকুটে সোনালীকেও মনে পড়ে যায়।শুভ্রার সাথে ঝগড়া হওয়ায় কীভাবে গলা টিপে ধরলো মেয়েটা! সেই দৃশ্য দেখেই মামুনের টনক নড়লো।বুঝতে পারলো অদ্ভূত কথা বলে খিলখিলিয়ে হাসা সোনালী আর মারকুটে সোনালীর মাঝে অনেক তফাৎ।মেয়েটা যেমন দেখায় সে আসলে তেমন নয়।তারপরেই ব্যক্তিগতভাবে অনুসন্ধান করলো মামুন।যত খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করলো, ততো অবাক হতে শুরু করলো।সোনালী আসল পরিচয় সামনে আসতেই ভয় শুরু হলো মামুনের। প্রেমের উল্টো পিঠেই ভয়ের বসবাস। ইউসুফ জানতে পারলে সোনালীর বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।তাই আগ বাড়িয়ে হাম্মামখানার দেওয়ালে সতর্ক বার্তা লিখে দিয়েছিল।কিন্তু মেয়েটা তাও বুঝলো না।ঠিকই রাতের বেলা চুপিচুপি অভিযানে বেরোত। সবশেষে মামুন নিজেই নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করলো।সোনালীকে সে বাঁচাবে।যেভাবেই হোক বাঁচাবে।কিন্তু পারলো কি? উঁহু, সুযোগই পেল না। তার আগেই সব শেষ।মামুন আবারো শব্দ করে কাঁদে।মামুনের মাঝের প্রেমিক সত্তাটা বারবার ধিক্কার জানাচ্ছে তাকে।গলা বাড়িয়ে বলছেঃ” তুই সত্যিই ব্যর্থ মামুন।প্রেমিক হিসেবেও, মানুষ হিসেবেও।”
মামুন মেনে নেয়।চোখ বুজে চুপচাপ পড়ে থাকে।জীবনে অনেক পাপ করেছে।কখনো যন্ত্রণা হয়নি, ভয় হয়নি,অনুতাপ হয়নি,অনুশোচনা হয়নি।কিন্তু আজ হচ্ছে।যন্ত্রণা, অনুশোচনা,অনুতাপ,বিষাদ– সব বাজে অনুভূতিরা ভর করেছে মামুনের উপর।এসব অনুভূতির স্বাদ এমন কেন? ভাগ্যে যতটুকু দুঃখ বরাদ্দ ছিল, তার সবটুকুই কি আজ ভোগ করতে হবে? মামুন হাঁসফাঁস করে। এতো গাছ-গাছালির মাঝেও অক্সিজেনের অভাব পড়লো? আশ্চর্য! মামুন কি মরে যাচ্ছে?
মামুনের মনে পড়ে যায় কাল সকালের কথা।কালকে এই সময়েও বেঁচে ছিল সোনালী।জ্বিভ নেড়ে,হাত নেড়ে কথা বলেছিল মামুনের সাথে।ইউসুফকে খুঁজতে গিয়েছিল দোতলায়। তখনই সোনালীর সাথে দেখা।গোসল সেড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুলে তোয়ালে চালাচ্ছিল। আগেই বলেছি এই দৃশ্য খুব পছন্দ মামুনের। ইউসুফের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সোনালীর সামনে যেয়ে দাঁড়ায় মামুন।মুখে ঝকঝকে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলেঃ ” সুপ্রভাত,ছোট্ট মেয়ে।”
সোনালী নরম চুলে তোয়ালে চালাতে চালাতে বলেঃ” সুপ্রভাত। কিন্তু আমাকে আপনি ছোট্ট মেয়ে বলেন কেন?”
_” ছোট মেয়েদেরকে ছোট না বললে কি বলব?”
_” আমি মোটেও ছোট না।ঠিক সময়ে বিয়ে করলে ছোট একটা মেয়ে আমার থাকতো।”
মামুন হাসে।প্রসন্ন গলায় বলেঃ” আজকালকার মেয়েগুলো বয়সের আগেই পেঁকে যায় একদম। খালি ঘর -সংসারের কথা চিন্তা করে। আপনার ঠান্ডা লাগলো কি করে? গলা ভেঙে গেছে দেখছি।”
_” কি জানি কি করে লাগলো।গলা ব্যাথা করছে কাল রাত থেকে।সকালে উঠে দেখি গলার এই অবস্থা।”
মামুন কপাল কুঁচকায়।বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করেঃ” তাহলে গোসল করলেন কেন এতো সকালে? এতো অসচেতন হলে চলবে?”
_” খুব গরম লাগছিলো তাই করে ফেললাম।কিন্তু ঠিক হয়নি।এখন আবার ঠান্ডা লাগছে।কি একটা মসিবত বলুন তো।”
_” আমার জ্যাকেট দিচ্ছি আপনাকে।ওটা গায়ে দিন।”
_ ” কখন দিবেন? অনেক দেরি হবে?আমি এখনই ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি।”
_” না,না খুব দেরি হবে না।আমি এখনই এনে দিচ্ছি।”
মামুন পা বাড়ানোর আগেই পিছু ডাকে সোনালী।ভেজা চুলগুলো পিঠে ফেলে দিয়ে প্রশ্ন করে ঃ” কয়টা বাজে, মামুন সাহেব? আমার কাছে ফোন নেই।”
পকেট থেকে ফোন বের করার সময় চাবির গোছাটা পড়ে যায় পকেট থেকে।মামুন অভ্যস্ত ভঙ্গিতে চাবিটা মানিব্যাগে রেখে ফোন দেখে বলেঃ ” সাড়ে নয়টা বাজে।আমি পাঁচ মিনিটের মাঝেই আসছি।”
_” ধোয়া জ্যাকেট দেবেন কিন্তু।ময়লা- টয়লা হলে আমি গায়ে দেব না।”
মামুন চোখ পাকিয়ে তাকাতেই খিলখিল করে হেসে ওঠে সোনালী।মামুন আঙুল তুলে বলেঃ” আপনি একটা ফাজিল, ছোট্ট মেয়ে।”
মামুনের আঙুল দু-আঙুলে চেপে ধরে সোনালী।আহ্লাদী স্বরে বলেঃ” হ্যাঁ, ঠিক।আপনার সাথে তো আগে দেখা হয়নি।তবে আপনার মতো এতো ফাজিল হলাম কি করে, বলুন তো? আমি ঠিক।আপনার মতো হয়েছি।একটুও এদিক-ওদিক না।পুরো আপনার মতো।”
আবারো চোখ পাকিয়ে তাকালে অকারণেই খিলখিল করে হাসে সোনালী।
মেয়েটা অকারণেই হাসতো।হাসি সুন্দর বলেই হয়তো বেশি বেশি হাসতো। মামুনের দু-কান জুড়ে কেবল সোনালীর হাসির শব্দ বাজে। হাসিতে বেশ মানাতো মেয়েটাকে।নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আগ্রহ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মামুনের সাথে ঠিক সেটাই হয়েছে।বিপদ জেনেও ঠিক সোনালীর প্রেমেই পড়লো মামুন।সব কিছু জানার পরেও সোনালীতেই আঁটকে রইলো ছেলেটা।এমন পাগলও আছে দুনিয়ায়? অপরাধী হয়ে পুলিশের প্রেমে পড়লো।কি অদ্ভূত কথা!
মামুন মাথা তুললো। শুধু মাথা নয়।একটু একটু করে পুরো শরীরটা তুললো।শোয়া থেকে উঠে হাঁটু গেড়ে বসলো কবরের পাশে। দু-হাতে রগড়ে চোখ মুছে নেয়।মামুন কাপুরুষ নয়।অনেক কেঁদে ফেলেছে,আর নয়। প্রিয়তমার কবরের পাশে মুখ লুকিয়ে কাঁদলে চলবে? অনেক কাজ বাকি।ভেঙে পড়লে চলবে না।মামুনকে শক্ত হতে হবে।লৌহমানবের মতো কঠিন হতে হবে।মামুন মাথা নিচু করে বসে থাকে কিছুক্ষণ।মনে মনে পরিকল্পনা সাজায়।চিন্তাগুলো জুড়ে দেয় একটা আরেকটার সাথে।জোরে শ্বাস নেয় মামুন।জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ।এই ত্রিশ বছর বয়সে কখনোই খুব বেশি চিন্তা করতে হয়নি মামুনকে।নিজের সম্পর্কে ভাবতে হয়নি।সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে।মামুনের কোনো পরিবার নেই।বাবা-মায়ের মুখ এই জীবনে কোনোদিন দেখেনি সে।জন্মের পর থেকে ইউসুফের পরিবারেই ছিল।ইউসুফের বাবা নাকি তাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল করাচীতে।বংশ পরিচয়হীন মামুনকে বড় করেছে, পড়াশোনা শিখিয়েছে।তাই এই পরিবারের প্রতি মামুনের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ইউসুফের বাবা মারা যাওয়ার পর ইউসুফ এই দেশে ছিল অনেকগুলো বছর।গ্রামের বাড়ি ঠিক করেছে, বাড়ি দেখাশোনার জন্য মামুনকে এখানে রেখেছে।নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছে মামুনের।তবুও কিছুই বলেনি। যারা আশ্রয় দিয়েছে,তাদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো কথা বলেনি মামুন।কেন বলবে? ইউসুফের পরিবার আশ্রয় না দিলে কি অবস্থা হতো তার? বেঁচে থাকতো কি না সেটাই সন্দেহ।
তবে আজকে বোধহয় কৃতজ্ঞতার মহাসমুদ্রে ভাটা পড়লো। এতোদিনের অনুগ্রহ ভুলে গেল মুহূর্তেই।শেষ যৌবনের রক্ত টগবগ করতে শুরু করলো প্রতিশোধের নেশায়।মামুন বড় এক দম নেয়।অসার পা দুটোকে টেনেটুনে সোজা করে।বহু কষ্টে দাঁড়ায় মামুন।শরীর থেকে মাটি ঝেড়ে ফেলে দেয়।কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে সোনালীর শেষ ঠিকানার দিকে।মুহুর্তেই একফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।মামুন আলতো হাতে চোখ মুছে নেয়।পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে।মাতালের মতো হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় গোডাউনের দরজার কাছে।তালা খুলে দরজা খোলে মামুন।ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালে।এদিক-ওদিক ফোন ঘুরিয়ে নজর বুলায়। ওই তো কতগুলো ছুঁড়ি দেখা যাচ্ছে।ফ্লোরের একপাশে পড়ে আছে রক্তমাখা ছুঁড়িগুলো।চারটি রক্ত মাখা ছুঁড়ি।আঠালো রক্তগুলো শুকিয়ে আছে।এই ছুঁড়িগুলোই সেদিন দেখেছিল মামুন।ইউসুফ বলেছিল এগুলো দিয়ে বিশেষ কাজ করবে।এই ছিল বিশেষ কাজ? মামুন ধীরে ধীরে পা ফেলে। ফ্লোরে বসে আলতো হাতে ছুঁড়িগুলো ছুঁয়ে দেয়।চারটি রক্ত মাখা ছুঁড়ি! একটা মানুষকে মারতে চারটে ছুঁড়ির দরকার পড়লো? মামুনের মাথা চক্কর দেয়।বুঝতে পারে তার প্রিয়তমা খুব আরামে প্রাণত্যাগ করেনি।নৃশংসভাবে তাকে খুন করা হয়েছে।মামুন সযত্নে তুলে নেয় ছুঁড়িগুলো।চোখ মেলে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ।সোনালীর বিরহে যতটা কষ্ট সে পাচ্ছে,ততোটা কষ্ট ইউসুফও পাবে।মরার আগেই বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সইতে হবে ইউসুফকে। প্রিয়তমার মৃত্যু ইউসুফকেও দেখতে হবে।
মামুন বেরিয়ে আসে।দূর্বল হাতে তালা দেয় দরজায়।ইউসুফের সামনে যাওয়ার আগে গোসল করতে হবে আগে।অর্জুন গাছের পাশ দিয়ে হেঁটে আসার সময় আবারও নজর পড়ে কবরের দিকে। পা থেমে যায় মামুনের।আবারও সোনালীর কবরের পাশে বসে পড়ে।নিচু হয়ে হাত বুলিয়ে দেয় মাটির উপর।
_” আমি ফিরে আসব প্রিয়তমা।আপনার কাছে একেবারে ফিরে আসব। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আল্লাহর কসম এবার আর ব্যর্থ হয়ে ফিরব না।আপনার মৃত্যুর বদলা না নিয়ে একফোঁটা পানিও মুখে দেব না। আপনি শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকুন প্রিয়তমা। আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুক।”
এলোমেলো পা ফেলে বাড়ির পথ ধরে মামুন।যেভাবেই হোক আজ বিকালের মাঝে কাজ শেষ করতেই হবে।
***
দুপুরের ভাত খেয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়েছে ইউসুফ।কাল রাতে ঘুম হয়নি ভালোভাবে।ভেবেছিল আজ সকালে ঘুমাবে।কিন্তু তথার জন্য তাও পারেনি।ঘুমে চোখ বুজে আসছে ইউসুফের।মাথাটাও ব্যাথা করছে খুব।এখন একটু না ঘুমালে প্রাণটাই বেরিয়ে যাবে ইউসুফের।তাছাড় সকাল থেকে মেজাজটাও খারাপ হয়ে আছে তার।দুজন বডিগার্ড আসার কথা ছিল কিন্তু এলো না।ঢাকার রাস্তায় নাকি খুব জ্যাম।আসতে দেরি হবে।মামুনটারও দেখা নেই সেই কোন বেলা থেকে।ইউসুফ চোখ বন্ধ করে।সবকিছু কেমন এলোমেলো।ইউসুফের ভালো লাগছে না।দেশ ছাড়তে হবে শীঘ্রই। নাহয় কোথাকার জল কোথায় গড়াবে তার ঠিক নেই।
ইউসুফ সবে চোখ বন্ধ করেছে।এমন সময় দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়।বাহির থেকে শোনা যায় মামুনের গলার আওয়াজ।
_” স্যার,স্যার।”
চরম বিরক্ত হয় ইউসুফ।আজকাল মামুনের বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে।যখন ইচ্ছে হয় তখনই চলে আসে।এটা কারো আসার সময়?
একগাদা বিরক্তি নিয়ে দরজা খোলে ইউসুফ। গলায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলেঃ” দিনদিন তোমার বুদ্ধি কমে যাচ্ছে, মামুন।তখন এতো দৌড়াদৌড়ি করে কোথায় গিয়েছিলে?”
ইউসুফের প্রশ্নের উত্তর দেয় না মামুন।মাথা নিচু করে বলেঃ” সরি স্যার।কিন্তু এখন না এসেও উপায় ছিল না। আমাদের খুব দ্রুত পঞ্চগড় ছাড়তে হবে স্যার।”
মামুনের কন্ঠে ভয়। ইউসুফ অবাক হয়ে। বিস্মিত কন্ঠে বলেঃ” কি বলছো এসব! মাথা ঠিক আছে?”
_” জ্বি, স্যার।গোয়েন্দা বিভাগ থেকে অনেকগুলো অফিসার এসেছে।হাত ধুয়ে পড়েছে সবাই।কালকে সোনালীকে মেরেছেন না আপনি,সেও গোয়েন্দা অফিসার ছিল।”
_” আমি অনেক আগে থেকেই জানি।তোমাকে বলা হয়নি।সোনালী এস.বি অফিসার ছিল।”
মামুন ভীত স্বরে বলেঃ” আপনি তো ওকে মেরে ফেলেছেন।এতোক্ষণে নিশ্চয়ই অন্যান্য অফিসাররা সোনালীর খোঁজ নিতে শুরু করেছে।একবার যদি ওরা সোনালীর মৃত্যুর খবর জেনে যায়, তবে পালানো কঠিন হবে।আপনার সাথে গার্ডও নেই স্যার।বিষয়টা ভেবে দেখুন।”
মামুনের কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো নয়।ইউসুফের মনে ধরে বেশ।দু-বছর আগে প্রমাণের অভাবে বেঁচে গিয়েছিল।কিন্তু এইবার? সোনালীর লাশের খোঁজ যদি অন্যরা পেয়ে যায় তবে আর প্রমাণের দরকার হবে? মৃত সোনালী নিজেই ইউসুফের বিরুদ্ধে বড় প্রমাণ।ইউসুফের রাগ উঠে।একহাতে কপাল চেপে দাঁড়িয়ে থাকে।মেয়েটা মরেও শান্তি দিলো না।তাছাড়া, ইউসুফ অফিসারগুলোর নাম জানে না। কতজন এসেছে তাও জানে না।নাম জানলেই হতো।নাম-ঠিকানা ছাড়া চৌদ্দটা মেয়ে ও দশটা ছেলের মাঝ থেকে গোয়েন্দা খোঁজা আর খড়ের গাদায় সুচ খোঁজা একই কথা। ইউসুফ ঠোঁট কামড়ে ধরে।আজ-কালের মাঝেই যেভাবেই হোক পঞ্চগড় ছাড়তেই হবে।
_” স্যার ”
_” হুম।”
_” আপনি পারলে আজকেই দেশ ছাড়ুন।”
ইউসুফ চিন্তিত স্বরে বলেঃ” আমি একা থাকলে চিন্তা করতাম না, কিন্তু আমার সাথে তথাও আছে।আজকের মাঝেই ওকে নিয়ে দেশ ছাড়া অসম্ভব একদম।”
মামুন মুখটাকে কঠিন করে ফেলে।কঠিন স্বরে বলেঃ” তথা ম্যাম আপনার বিষয়ে সব জানে স্যার।ওনার কথা এখন আর ভাবতে হবে না।”
মামুনের কথা ঠিক বুঝলো না ইউসুফ।তাই এক ভ্রু তুলে প্রশ্ন করেঃ” মানে?”
_” মানে ম্যাম আপনার নাড়ী-নক্ষত্র সব জানে।আপনার কাজ, স্বভাব,চরিত্র সব। তিনি মোটেও আপনার প্রেমে পড়েননি।তিন শুধুমাত্র অভিনয় করছেন।”
ইউসুফ মোটেও বিশ্বাস করে না মামুনের কথা। কঠিন গলায় বলেঃ” এসব বাজে কথা তুমি কোথায় শুনেছো, মামুন? এসব কথা আমাকে বলতে এসো না।আমি এসবে বিরক্ত হই।”
_” আমি সত্যি বলছি স্যার।আমি নিজের কানে শুনেছি।তথা ম্যাম কার সাথে যেন বলছিল, আপনার সাথে আর অভিনয় করতে তার ভাল লাগে না।আপনার সাথে ভালো ব্যবহার করার চাইতে মৃত্যু শ্রেয়।”
ইউসুফের রাগ উঠে যায়।ডান হাতের আঙুল তুলে মামুনকে শাসায়।
_” অনেক্ষণ যাবৎ বাজে কথা শুনছি। এবার চুপ করো।তোমার জায়গায় অন্যকেউ হলে এতোক্ষণে গলা টিপে ধরতাম।শেষবারের মতো বলছি চুপ করো মামুন।তথার সম্পর্কে বাজে কথা বলার সাহস কোথায় পেলে?”
মামুন মাথা নিচু করে।তবে তার কন্ঠ নরম হয় না।আগের মতোই গলায় তেজ নিয়ে বলেঃ” আল্লাহর কসম,আমি সত্যি বলছি স্যার।আপনি নিজেও জানেন আমি কখনোই মিথ্যা বলি না।আজ সকালে আমি নিজের কানে এসব কথা শুনেছি।তবে কার সাথে এসব কথা বলছিলো তাকে দেখিনি।তথা ম্যামের আসল প্রেমিকের নাম খুব সম্ভবত ইরফান।সে পঞ্চগড় এসেছে ম্যামের খোঁজে।আমি নিজের কানে এসব না শুনলে কখনোই আপনাকে বলতাম না।আমার দায়িত্ব ছিল এসব খবর আপনার কাছে পৌঁছে দেওয়া।আমি দিয়েছি।এখন বাকিটা আপনার ইচ্ছা।তবে আমি এখনই পঞ্চগড় ছাড়ব স্যার।কিছুতেই ধরা দেব না।এবার ধরতে পারলে প্রশাসন কি করবে তা বুঝতেই পারছেন।তাদের একজন মরেছে আমাদের হাতে।আসছি স্যার,আল্লাহ হাফেজ।আপনিও প্লিজ তাড়াতাড়ি চলে আসুন।আমি সবকিছু রেডি করে রেখেছি।”
মামুন বেরিয়ে যায় খোলা দরজা দিয়ে।তার ঠোঁটের কোনে তৃপ্তির হাসি।ইউসুফকে খুব ভালো করে চেনে মামুন।তথার ব্যাপারে সে সবচেয়ে দূর্বল,সবচেয়ে স্বচ্ছ।তাই প্রতারনার শাস্তি সে দেবেই এটা তার জানা ।তথা মরবে।মরলে মরুক। ইউসুফের প্রেয়সী মরলে ইউসুফ নিজেই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে। যতটা কষ্ট মামুন পাচ্ছে ঠিক ততোটা কষ্টই ইউসুফ পাবে।আর রইলো ইউসুফের কথা।ও যেন মরে সেই ব্যবস্থাই নিজ হাতে করবে মামুন।বিভিন্ন সময়ের এগ্রিমেন্ট পেপারের কপিগুলো মামুনের কাছেই।ওগুলো শাফিন অবধি পৌঁছে দিলেই হবে।এরপর আর দেখতে হবে না।কুকুরের মতো টেনে নিয়ে যাবে ইউসুফকে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় মামুন।কাজ শেষ হয়নি এখনো।সব কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে,পাড়ি জমাতে হবে প্রিয়তমার কাছে।
বজ্রাহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে ইউসুফ। মামুনের খাপছাড়া কথাগুলো বিশ্বাস করেনি ইউসুফ।একটুও করেনি।কিন্তু মামুন খুব বিশ্বাসী। সে কখনোই মিথ্যা বলেনি।আবার তথাও অভিনয় করছে না।তথা সত্যি খুব পছন্দ করে ইউসুফকে।মামুনের কথা মোটেও বিশ্বাস করা যাবে না।দুঃশ্চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চায় ইউসুফ।তবুও কোথাও একটা কিন্তু থেকেই যায়। মামুন নিজের কানে না শুনলে কি এসব কথা বলেছে? আন্দাজে কথা বলার মানুষ মামুন না।তাছাড়া শেষে কি যেন একটা নাম বললো।ইরফান না? হ্যাঁ, ইরফানই তো।এই নামটা তথার মুখেও শুনেছে ইউসুফ।ওই যে সেদিন রাতের বেলা নদীর পাড়ে এই ছেলেটার কথাই বলেছিল তথা।ইরফানের নাম মামুন কিভাবে জানলো? নিশ্চয়ই সে তথার মুখে শুনেছে। তারমানে তথা সত্যিই অভিনয় করছে?
ইউসুফের পা কাঁপে। দুর্বল পায়ে খাটে বসে পড়ে সে।দু হাতের আঙুলে কপালের এ মাথা- ও মাথা চেপে ধরে।মাথা ব্যাথায় কপালের রগগুলো মনে হচ্ছে ছিঁড়েই যাবে।একে একে সব কথা মনে করার চেষ্টা করে ইউসুফ।প্রথম দেখা,প্রথম সকালের কথা কাটাকাটি,প্রেম নিবেদনের কথা শুনে তথার প্রতিক্রিয়া, তারপর হুট করেই তথার পরিবর্তন।রাতদুপুরে ইউসুফকে নিয়ে বাড়ির বাইরে ঘুরতে যাওয়া,হুটহাট ইউসুফের ঘরে চলে আসা— এসব যেন মিলাতে পারে না ইউসুফ।শুরুর দিকে তথা মোটেও এমন ছিল না।সে ইউসুফের সামনে এলেই কপাল কুঁচকে ফেলতো,বিরক্ত হয়ে কথা বলতো।এমনকি অসুস্থতার সময় পাশে বসেছিল বলে কি চোটপাটই না করেছিল তথা! এরপর প্রেম নিবেদনের সময় ভরভর করে বমি করে দিল।দু-দিন পরেই আবার এই তথাই প্রেমে পড়লো।সাহস করে রাতেরবেলা ইউসুফের ঘরে এলো সময় কাটাতে।এই মুহূর্তে তথার এই আচরণগুলো খুবই বেখাপ্পা লাগে ইউসুফের কাছে।তথা মিশতো ঠিকই। কিন্তু কোথায় যেন একটা সীমারেখা কাজ করতো তাদের মাঝে।হেসে কথা বলতো ঠিকই, ইউসুফের চুমুতেই প্রেমে পড়েছে– এ কথা বলত ঠিকই,কিন্তু সবসময় বৈধতার দোহাই দিয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখতো।এমনকি আজ সকালেও যখন অতি আগ্রহে ইউসুফ তার স্বপ্নের কথা বলছিল,তখনও তথাকে খুব বেশি আগ্রহী দেখা যায়নি।কেমন একটা গা ছাড়া ভাব ছিল তার মাঝে।ইউসুফ মেলাতে পারে না।এতোদিন একটা কঠিন কালো পর্দা ছিল চোখের সামনে। আজ মামুনের কথায় তা যেন উবে যেত শুরু করলো। তবে কি তথা সত্যিই অভিনয় করছে? চোয়াল শক্ত হয়ে আসে ইউসুফের। প্রতারণা একদম অপছন্দ তার।পা শক্ত করে দাঁড়ায় ইউসুফ।আলমারি খুলে রিভলবারটা পকেটে পুরে বেরিয়ে পড়ে ইউসুফ।
***
তথার ঘরে একটা সুন্দর তৈলচিত্র আছে।সেখানে স্থান পেয়েছে অসামান্য সুন্দরী এক নারী।তৈলচিত্রের সামনেই দাঁড়িয়েছিল তথা।এটা তার খুব পছন্দ।তথা গুনগুন করে গান গাইছে।একটু আগে শাফিনের সাথে কথা হয়েছে।শাফিন বলেছে, খুব বেশিদিন এখানে থাকতে হবে না।কথাটা শুনে অত্যন্ত খুশি হয়েছে তথা।কতদিন ভাই-বোনগুলোকে দেখা হয় না, খবর নেওয়া হয় না।রুবির শরীর কেমন তাও জানা হয়নি।কাকা-কাকির সাথেও কথা হয় না।তথা বাড়ি যেতে চায়।সবাইকে দেখতে চায়।তাছাড়া ঢাকা গেলে ইরফানের সাথেও দেখা হবে।অবশ্য ইরফান এখন এখানেই আছে।এই বাড়ি থেকে বেরোলেই দেখা হবে। ইশ! লোকটা একেবারে পাগল। এ অবধি চলে এসেছে।সে এতো পছন্দ করে কেন তথাকে? তথা লাজুক হেসে কানের পাশে চুল গুঁজে দেয়।লজ্জা লাগছে খুব।
_” কামিনী ফুল ”
ইউসুফের কন্ঠ শুনে মুখটাকে চিমসে ফেলে তথা।শয়তানটার আসার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।মন চাইলেই চলে আসে।বিরক্তিকর। মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে পিছু ফিরে তথা।
_ ” কি ব্যাপার সাহেব? আজ এই সময়ে মনে পড়লো আমাকে! ঘুম আসছে না নাকি?”
_” উঁহু, একটুও না।একটা সুখবর দিতে এলাম আপনাকে “— তথার দিকে দু’ পা এগিয়ে আসে ইউসুফ।
তথা অবাক হয়।গলায় আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” কি সুখবর?”
_” কাজি এসেছে নিচে।আজ আমাদের বিয়ে।বিয়ে করেই পঞ্চগড় ছাড়ব আমরা।”
একটুও বিশ্বাস করতে চায় না তথা।অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলেঃ” হুহ,আপনি বললেই হলো? এখন বিয়ে! অসম্ভব।”
ইউসুফ তথার হাত ধরে।হাত টেনে নিচে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বলেঃ” বিশ্বাস না হলে নিচে চলুন।নিজের চোখেই দেখবেন।”
ইউসুফের কথা শুনে ভয় হয় তথার।লোকটার কথা শুনে মনে হচ্ছে সে সত্যি বলছে। ইউসুফের হাতের মুঠো থেকে জোর করে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে তিক্ত কন্ঠে বলেঃ” আপনাকে আমি বলেছিলাম, ঢাকা যেয়ে বিয়ে করব।আপনি এখন এসব পাগলামি কেন করছেন? আমি এখন কিছুতেই বিয়ে-টিয়ে করতে পারব না।হাত ছাড়ুন।”
তথার জোর-জবরদস্তি ও কন্ঠের তিক্ততা খট করে চোখে লাগে ইউসুফের। তথা যদি ভালোবাসে তবে এমন করবে কেন? মুহূর্তেই বুঝতে পারে মামুন ঠিক ছিল।ইউসুফের মাথা ব্যাথা দ্বিগুন হয়।চোখের সবুজ মনির আশপাশ রক্তবর্ণ ধারণ করে। তার ভিতর- বাহিরে একটাই করুণ স্বর বাজে।
— ” তথা ভালোবাসেনি,একটুও ভালোবাসেনি।”
_” কি হলো হাত ছাড়ুন।”— তথার কন্ঠে তীব্র ঘৃণা।
ইউসুফ মৃদু হাসে।হাতের মুঠো আরো শক্ত করে।তথাকে কাছে টেনে টুপ করে চুমু দেয় কপালের মাঝে। আরেক হাত তথার গলায় নেয়। দু- আঙুল দিয়ে গলার দু- দিকে চেপে ধরে।
তথা কিছুই বুঝতে পারছে না।তবে তার কষ্ট হচ্ছে খুব।এক হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে ইউসুফ,আরেক হাত গলায়।ইউসুফের আঙুলগুলো ঠিক লোহার মতো শক্ত।তথার দম নিতে কষ্ট হয়।
বাম হাতে নিজের গলা থেকে ইউসুফের হাত সরানোর চেষ্টা করে তথা।খুব কষ্ট করে বলেঃ” কি করছেন, ইউসুফ? আমার কষ্ট হচ্ছে।”
ইউসুফ হাসে।মুখটাকে তথার কানের কাছে নিয়ে বলেঃ” এতো ছলনা কেন করলেন,কামিনী ফুল? প্রতারণা করার সময় একটুও ভয় হলো না? একটুও বুক কাঁপলো না?”
ইউসুফের প্রশ্নের উত্তর নেই তথার কাছে।তার মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত নামে।বুঝতে পারছে ইউসুফের আঙুলগুলো আরো শক্তভাবে চেপে বসেছে গলার দু প্রান্তে।চোখে- মুখে অন্ধকার দেখে তথা।মাথা ঘুরাচ্ছে খুব।গলায় ব্যাথা পাচ্ছে প্রচন্ড।হাতটাও মনে হচ্ছে ভেঙে যাবে।মৃত্যু যন্ত্রণা কি একেই বলে?
#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-২৭)
#হালিমা রহমান
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো ইরফান।হাঁটুতে ব্যাথা,কনুইয়ে ব্যাথা,কাঁধে এক বিশাল ট্রাভেল ব্যাগ।ক্লান্ত দুপুরের নিস্তব্ধ রাস্তায় একাকি হাঁটছে সে।অখ্যাত এক অজপাড়া গাঁয়ের কাঁচা রাস্তায় হাঁটতে ভালো লাগছে না ইরফানের।শরীরের সাথে সাথে মনের অসুখ চেপে ধরেছে একদম। ইরফানের উদ্দেশ্য বাস স্টেশন। স্টেশনে যাবে তারপর ঢাকার বাস ধরবে। এখানে আসার আগে বেশ উত্তেজনা ছিল ছেলেটা মাঝে।ভেবেছিল তথার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, তার মানে নিশ্চিত তথা বিপদে আছে।ইরফান ঢাকা থেকে বীরপুরুষের মতো আসবে,বুক ফুলিয়ে ডাহুক নদীর তীরের জমিদার বাড়িতে যাবে,রূপকথার রাজাদের মতো তার রানীকে উদ্ধার করবে। তারপর পরম নির্ভরতায় হৃদয় রানীর হাত আগলে বলবেঃ” আর কোনো ভয় নেই , প্রিয়তমা।আমি আছি তো ।” আহ! রূপকথার গল্পের মতো সুন্দর সমাপ্তি।
কিন্তু বাস্তবে কি হলো?এখানে আসার পর এক্সিডেন্ট, তারপর শাফিনের মুখে শুনতে হলো তথার প্রনয় গাঁথা। সাংঘাতিক অপরাধী আহমেদ ইউসুফের সবচেয়ে পছন্দের মানুষটির নাম তথা এবং তথার বীরপুরুষটির নাম আহমেদ ইউসুফ।তাদের সুন্দর প্রেম কাহিনীতে ইরফান সাদিক নিতান্তই অনাহূত একজন। সহজ বাংলায় বলতে গেলে সে ইউসুফ ও তথার মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি। ‘ তৃতীয় ব্যক্তি ‘ শব্দটা মাথায় আসতেই হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে ইরফানের। কি ভেবেছিল আর কি হলো। জীবনটা যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে ইরফান।এখানে আসার আগে রাফায়েত বারবার নিষেধ করেছিল। কিন্তু ইরফান শুনলোই না। সে প্রেমিক পুরুষ।হাজার নিষেধাজ্ঞা পায়ে ঠেলার ক্ষমতা ও সাহস তার আছে। সুতরাং আরেক ছেলের কথা শুনে কি হবে? ইরফান সেটাই করবে যেটা তার মনে ধরবে।তবে এখানে আসার পর এসব তত্ত্ব কথা ফুরিয়ে গেছে।এবার ঢাকা যেয়ে রাফায়েতের পা ধোয়া পানি খাবে। রাফায়েত সবসময় ভালো বুদ্ধি দেয়।ওর কথা মতো এখানে না এলেই ভালো হতো। আর যাই হোক, তথার প্রেম কাহিনো তো আর নিজের কানে শুনতে হতো না।
রাস্তার পাশে এক বিরাট বটগাছ।গাছের সাথে হেলান দিয়ে ছায়ায় দাঁড়ায় ইরফান। কেন যেন খুব অস্থির লাগছে। ওই যে কোনো খারাপ খবর শুনলে মানুষের যেমন অস্থির লাগে, ঠিক তেমন।অসুস্থতার কারণে এমন হচ্ছে বোধহয়। ইরফান কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে পাশে রাখে।পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে আধ-বোতল পানি খেয়ে নেয় ইরফান।চোখে-মুখেও খানিক পানি ছিটিয়ে দেয়। পকেট থেকে ফোন বের করে নজর বুলায় একবার।এখনো শাফিনের কোনো খোঁজ-খবর নেই। কাল রাত থেকে শাফিনের একটা কলের জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করেছে ইরফান। কিন্তু শাফিনের কোনো খবরই পেলো না।এই ছেলের উপরও রাগ জমে ইরফানের। এটাই পালের গোদা। ও যদি ইউসুফের সব জারিজুরি তথার কাছে ফাঁস করে দিতো,তবে তথা কি এতো খারাপ একটা লোকের প্রেমে পড়তো?
ইরফান মোবাইল পকেটে পুরে নেয়। ঢাকা তো চলেই যাবে কিন্তু তার আগে একবার জমিদার বাড়িতে গেলে ভালো হতো না? তথার জন্যই তো এতোদূর ছুটে আসা।একবার চোখের দেখা না দেখলে একটুও শান্তি পাবে না ইরফান।একবার নাহয় যাওয়াই যাক।দূর থেকে দেখেই চলে আসবে।ইরফান কাঁধে ব্যাগ তুলে নেয়।দু’পা এগিয়েই আবার থমকে দাঁড়ায়।একটু বেশিই নির্লজ্জতা হয়ে যাচ্ছে না? তথা ভালো আছে,জমিয়ে প্রেম করছে। তাহলে ইরফান কেন চিন্তা করছে? যা করছে তা করুক। ইরফান আবার দাঁড়িয়ে থাকে। সে এখান থেকে বাস স্টেশনেই যাবে।তথা- টথা বাদ। ইরফান বড় এক দম নেয়।তথার কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে।” তথা কেউ না,তথার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই”– মনে মনে নিজেকে বুঝায় ইরফান। তবে ইরফান তো একটু বেশিই নির্লজ্জ, তাই মনের এককোনে একটু খচখচানি ভাব রয়েই যায়। একটু ভাবে ইরফান। একবার দেখে গেলে কি এমন ক্ষতি হবে? আর যাই হোক তথা তো আর ভালো মানুষের সাথে প্রেম করছে না।প্রেমে পড়েছে এক হতচ্ছাড়া শয়তানের। কখন কি ঘটে যায়।দূর থেকেই এক নজর দেখে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয় ইরফান।তথার ব্যাপারেই সে সবচেয়ে বেশি নির্লজ্জ, সবচেয়ে বেশি আত্মসম্মানহীন।আরেকটু নির্লজ্জ হলে ক্ষতি কী?
***
ইউসুফের হাত দুটো মনে হচ্ছে তথার প্রাণ কেড়েই নেবে। একহাত গলায় চেপে আছে, আরেক হাত তথার ডানহাতে।তথার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।প্রচন্ড যন্ত্রণায় দম বন্ধ হয়ে আসে।চোখ উল্টে যায়।তথা কি যেন বলতে চাইছে কিন্তু স্বর ফুটে না গলায়।কেবল গড়গড় শব্দ হয়।বাম হাতে ইউসুফের বুকে মৃদু ধাক্কা দিতেই গলা থেকে হাত সরিয়ে নেয় ইউসুফ। তথার হাত ছেড়ে দিয়ে দু-হাতে কপাল চেপে ধরে।
তথা বসে পড়ে।ঘন ঘন শ্বাস নেয়।ডানহাতটা মনে হয় অসার হয়ে গেছে। বামহাতে একবার নিজের গলা ছুঁয়ে দেয় তথা।একটানা কয়েক মিনিট কাশি দেয়। গলা শুকিয়ে কাঠ। জ্বিভের আশেপাশে পুরো খরা চলছে।একটু পানি না পেলে বোধহয় মরেই যাবে তথা।তথার চোখ জ্বলে,টুপটুপ করে দু-ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ে।
_” পানি খান, কামিনী ফুল।”
ইউসুফও হাঁটু ভেঙে বসে পড়েছে তথার সামনে।তার হাতে একগ্লাস পানি।এদিক-ওদিক তাকায় না তথা। ইউসুফের হাত থেকে থাবা দিয়ে পানির গ্লাস নিয়ে একঢোকে পানি খেয়ে নেয়। আল্লাহ বাঁচিয়েছে।মনে হচ্ছে মৃত্যুর দুয়ার থেকে জানটা ফিরে এসেছে। চোখ বন্ধ করে রাখে তথা।ইউসুফের দিকে তাকানোর সাহস তার নেই।
_” কামিনী ফুল,চোখ খুলুন।চোখ খুলুন বলছি।”
ইউসুফের কথা শোনে না তথা।আগের মতোই চোখ বন্ধ করে রাখে। তবে তথার এই অবাধ্যতা হয়তো পছন্দ হলো না ইউসুফের।সে আবারো দু-আঙুলে তথার দু-গাল চেপে ধরে।নিজের হাতের সমস্ত জোর ঢেলে দেয় তথার গাল দুটোতে। যন্ত্রণায় বাধ্য হয়ে চোখ খোলে তথা। কথা বলার সামর্থ্য নেই তার।দু-চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে কেবল। ঘোলাটে চোখে ইউসুফের দিকে তাকায় তথা।আশ্চর্য! ইউসুফের সবুজ মনির চোখ দুটোও ছলছল করছে। পানিতে টইটম্বুর চোখ দুটো।লোকটা সত্যি কাঁদছে নাকি সবটাই তথার চোখের ভুল?
_” এখন কাঁদছেন কেন,কামিনী ফুল? আমার সম্পর্কে সবকিছু জানার পরেও কেন এতো বড় ভুলটা করলেন? একবারও মনে হয়নি,আমি জানতে পারলে কপালে দুঃখে আছে?”
উত্তর দিতে পারে না তথা।মুখের ভিতরের নরম চামড়াগুলো মনে হচ্ছে দু-পাটি দাঁতের সাথে কেটে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় অস্ফুট শব্দ বেরোয় মেয়েটার মুখ থেকে।ইউসুফের হয়তো কষ্ট হয়। তথার দু-গাল একটু জোরে টিপে দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়।
_” আপনাকে খুব সহজ মৃত্যু দেব, কামিনী ফুল।এখানে আসার আগে ভেবেছিলাম খুব সময় নিয়ে, খুব কষ্ট দিয়ে মারব আপনাকে। কিন্তু এখন দেখছি এ সাধ্য আমার নেই।আপনার চাইতে আমার বেশি কষ্ট হয়। ”
এতোক্ষণে স্বর ফুটে তথার গলায়।ক্ষীণ স্বরে বলেঃ” আপনি ভুল ভাবছেন ইউসুফ।আমি, আমি..”
তথার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দেয় ইউসুফ। নরম গলায় বলেঃ” মিথ্যে বলছেন কেন,কামিনী ফুল? মরার আগেও কেউ মিথ্যা বলে? আপনার আর আমার মাঝে লুকোচুরির কিছু নেই।আমার সব আপনি জানেন,আপনার সব আমি জানি।”
_” আমার কথাটা শুনুন একটু।আপনি ভুল ভাবছেন ইউসুফ।”— জীবন বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বলে তথা।ফাঁকা ঢোক গিলে সে। ইউসুফের কথায় মনে হচ্ছে প্রাণটাই বেরিয়ে যাবে।
_” আপনি আর কি বলবেন কামিনী ফুল? নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন নিশ্চয়ই। কোনো লাভ নেই।আপনার অভিনয়গুলো আমার চোখে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল। ইরফান কি আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে?”
বোকার মতো চেয়ে থাকে তথা।ইরফানের কথাও জানে ইউসুফ! তথার হৃৎপিণ্ডের গতি তীব্র হয়।মনে মনে আরো কয়েক বছরের আয়ু প্রার্থনা করে পরম দয়ালু সৃষ্টিকর্তার কাছে।
তথার দৃষ্টি দেখে উদভ্রান্তের মতো হাসে ইউসুফ। ঠেস দিয়ে বলেঃ” বয়ফ্রেন্ডের নাম কানে যেতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল? সেদিন রাতে নদীর পাড়েও খুব সুনাম করেছিলেন এই ছেলের।তখনই বুঝা উচিত ছিল আমার,ইরফান কোনো সাধারণ ছেলের নাম নয়।”
একটুও শব্দ করে না তথা।ইউসুফের কথা তার সব জোর শুষে নিয়েছে।কয়েক সেকেন্ড প্রেয়সীর মুখের দিকে চুপচাপ চেয়ে থাকে ইউসুফ। উদাস গলায় বলেঃ” আপনি প্রতারণা না করলেই পারতেন কামিনী ফুল।প্রতারণায় খুব এলার্জি আমার।আমার বাবাও এরকম চিট করেছিল মায়ের সাথে।আমার দেখা সবচেয়ে খারাপ মানুষ। বহু নারীতে আসক্ত ছিলেন তিনি। আমার বয়স যখন আঠারো, তখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলাম। রিভলবার তাক করে গুনে গুনে তিনটে বুলেট পুরেছি বাবার বুকে।একদম স্পট ডেড। নিজের বাবাকে মারতে একফোঁটা কষ্ট হয়নি।কিন্তু আপনাকে মারার সময় হাত কাঁপছে আমার। হাত-পা ভেঙে আসছে।আপনি নিশ্চিত জাদুকরী, কামিনী ফুল।”
_” আমাকে ছেড়ে দিন ,প্লিজ। আমি ঢাকা চলে যাব,কাউকে কিছু বলব না।কসম, আপনার সম্পর্কে একটা কথাও আমার মুখ দিয়ে বেরোবে না।”
তথার কথায় আবারো হাসে ইউসুফ।কপালের দু-পাশে লেপ্টে আছে তথার চুল।ইউসুফ আলতো হাতে তথার চুল গুছিয়ে দেয়।
_” বাঁচার আশা এখনো আছে? কি আশ্চর্য! আমি নিজেই আর বাঁঁচব কি না সন্দেহ। আমার বাড়িতে অনেকগুলো গোয়েন্দা পুলিশ এসেছে।তাদের একজনকে মেরে ফেলেছি কাল রাতে। কাজটা একটুও ঠিক হয়নি।মনে হয় না এই কাজের পরেও গোয়েন্দারা আমাকে ছেড়ে দেবে।আমি নিশ্চিত ওরা আমাকে এবার মেরেই দম নেবে ।”
তথার গলা কাঁপে। কাকে মেরেছে ইউসুফ? কাল রাত থেকে শুধু সোনালীকেই দেখা যাচ্ছে না।তবে কি সোনালী? না,না সোনালী নয়।ও তো একটুখানি মেয়ে।ও কি করে গোয়েন্দা পুলিশ হবে?
তথা কাঁপা গলায় বলেঃ” আপনি কাকে মেরেছেন কাল?”
_” সোনালী আহমেদকে।মেয়েটা ভীষণ সাহসী ছিল।কাল রাতে একচোট লড়াই করেছে আমার সাথে।আমার হাঁটুতে দুটো লাথি দিয়েছে,বুকেও একবার লাথি দিয়েছে। এরপর পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে আমার দিকে তাক করলো।ভাবতে পারেন কত সাহস! ”
তথা দু-চোখে অন্ধকার দেখে। ইউসুফ কি নাম বললো? সোনালী? তার মানে সোনালী ঢাকায় যায়নি।তাকে ইউসুফ মেরে ফেলেছে! দু-চোখ বন্ধ করে ফেলে তথা। মানসপটে ভেসে উঠে সোনালীর মিষ্টি হাসিমাখা একটা মুখ।আহ,সোনালী! মেয়েটা খুব ভালো ছিল।
_” এরপর আমি কি করলাম জানেন কামিনী ফুল? গোডাউনে ছুঁড়ি ছিল। সোনালী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর হাত লক্ষ্য করে একটা ছুঁড়ি ছুড়ে মারলাম।তারপর আরেকটা। আমি খুব সুন্দর ছুঁড়ি চালাতে জানি। সোনালীর রক্তাক্ত হাত থেকে রিভলবার পড়ে গেলে। আরো দুটো ছুঁড়ি নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। ওর চুলের খোঁপা মুঠোতে পুরে হাঁটুতে লাথি দিলাম।সোনালী হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মাটিতে।আর আমি এক ছুঁড়ি ওর গলায় চালিয়ে দিলাম,আরেকটা পেটে। দু-বার লাথি দিলাম ওর পেটে।ব্যাস,সোনালী শেষ।”
তথা দু-হাতে কান চেপে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলেঃ” চুপ করুন,আল্লাহর দোহাই লাগে চুপ করুন।”
ইউসুফ মৃদু হেসে তথার হাত নামিয়ে দেয়।
_” শেষটুকু শুনেই নিন, কামিনী ফুল।এরপর মাটি চাপা দিলাম সোনালীকে। তবে আমি তো আর কবর করতে জানি না।তাই কোনোরকম করে একটুখানি মাটি খুঁড়েই সোনালীকে শুইয়ে রেখেছি। দূর থেকে বোঝাই যায় না, ওখানে কেউ শুয়ে আছে।মনে হয় যেন এমনিই মাটি উঁচু করে রেখেছে কেউ। তারপর আমার ঘরে গেলাম।সোনালীর হয়ে একটা চিঠি লিখলাম। চিঠিটা নিয়ে আপনার ঘরে গেলাম।দরজা খোলাই ছিল।টেবিলের উপর চিঠি রেখে, আলমারি থেকে সোনালীর জামা-কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম।তারপর সোনালীর মৃতদেহের মতো তার ব্যাগটাও লুকিয়ে রাখলাম। সব কাজ শেষ করতে করতেই ভোর হয়ে গেল।”
তথা নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকে।কতটা নির্লজ্জ হলে মানুষ নিজের পাপের গল্প শোনাতে পারে! এই লোকের শরীরে কি মানুষের রক্ত বইছে?
ইউসুফ তথার দিকে একপলক চেয়ে পকেটে হাত ঢুকায়।কয়েকি সেকেন্ডের মাঝেই পকেট থেকে বের করে আনে চকচকে রিভলবার।বন্দুকের নল তথার কপালে ঠেকায়।একফোঁটা পানি ইউসুফের চোখ বেয়েও গড়িয়ে পড়ে।ভাঙা গলায় বলেঃ” ভেবেছিলাম এই কপালে শুধু ঠোঁট ছোঁয়াব।কিন্তু আমার ভাগ্যই খারাপ। এই নিয়ামতটুকুও কপালে জুটলো না।আমার কামিনী ফুল স্বচ্ছ নয়,নির্মল নয়।আমার ফুলের মাঝে পোকার বসবাস।”
_” আমাকে ছেড়ে দিন, প্লিজ।”
_” উঁহু, কোনো ছাড়াছাড়ি নেই।আপনাকে খুব সহজ মৃত্যু দেব কামিনী ফুল।প্রথম বুলেটে আপনি মরবেন,দ্বিতীয় বুলেটে আমি। আমার দিনও ফুরিয়ে এসেছে।এখান থেকে বেরোনোর রাস্তা নেই।ধরা এবার পড়তেই হবে।তবে আহমেদ ইউসুফ এতোটা সহজলভ্য নয়।প্রয়োজনে আমি আত্মহত্যা করব।যেন আমি মরার পরেও গোয়েন্দা বিভাগ আফসোস করে। হাতের কাছে পেয়েও মনমতো শাস্তি না দিতে পারার আফসোস তাদের রয়েই যাবে।”
একটু থামে ইউসুফ।একটু নাক টেনে নেয়।তথা আবারো সেই একই অনুরোধ করে।হাত জোড় করে বলেঃ” একটু দয়া করুন,ইউসুফ।আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।প্লিজ ইউসুফ।আপনার পায়ে পড়ি।”
_” যে পৃথিবী আমার নয়,সেখানে আপনি থেকে কি করবেন কামিনী ফুল? তারচেয়ে চলুন একসাথে জড়াজড়ি করে মরে যাই।তাছাড়া বেঁচে থেকেই কী করবেন? আপনার তো যাওয়ার জায়গা নেই।আপনার চাচাও আমার এজেন্ট। আপনাকে এখানে নিয়ে আসার পিছনে আপনার চাচার অবদান কম নয়।অবশ্য আমাকেও খরচা করতে হয়েছে। গুনে গুনে দশ লাখ খরচ হয়েছে আপনার পিছনে।”
তথা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে থাকে। কান দুটোতে মনে হচ্ছে গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে কেউ।বেঁচে থাকার ইচ্ছেই মরে গেছে। নিজেকে ঠিক পন্য ম্নে হচ্ছে।তথার বোধশক্তি লোপ পায়,হাত-পা ভেঙে আসে।ইউসুফের হাত দুটো ধরে ভাঙা গলায় বলেঃ” আমাকে মেরে ফেলুন ইউসুফ, দয়া করে মেরে ফেলুন।”
চোখ বন্ধ করে তথা।থেমে থেমে শ্বাস নেয়।চোখের উপর ভেসে উঠে রুবির হাসিমাখা মুখ,মাহাদীর মুখ,মাতৃসম কাকির মুখ ও ইরফানের বিষাদগ্রস্ত মুখ।
***
একের পর এক পাতা উল্টে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে যায় শাফিন।অনেকগুলো এগ্রিমেন্ট পেপারের কপি স্টেপলার করা। পুরো কাগজে নজর বুলিয়ে বুঝতে পারে এগুলো আহমেদ ইউসুফের ব্যবসায়িক চুক্তিপত্র। শাফিন এদিক-ওদিক নজর বুলায়।টেবিলের উপর কে রাখলো কাগজগুলো? কাগজগুলো মুড়িয়ে পকেটে রাখে শাফিন।আর সময় নষ্ট করার দরকার নেই।প্রয়োজনীয় প্রমাণ এসে গেছে হাতে।সবাইকে দেখাতে হবে।ইউসুফকে গ্রেফতার করে ঢাকা নিয়ে যেতে হবে।হতচ্ছাড়াটাকে বুঝাতে হবে বিখ্যাত ডিম থেরাপি কাকে বলে।দ্রুত হাতে দরজা খুলতেই আরেক দফা অবাক হয় শাফিন।বসার ঘরে ইরফানকে দেখা যাচ্ছে। এদিক-ওদিক নজর বুলিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে সে।শাফিন এক প্রকার উড়ে যায় ইরফানের কাছে।হতভম্ব গলায় বলেঃ” তুমি কি পাগল, ইরফান? এখানে এসেছ কেন? কেউ দেখেনি তো?”
_” না কাউকেই দেখলাম না।দরজা খোলা পেয়ে চলে এলাম।তথার সাথে একটু দেখা করিয়ে দেও না প্লিজ।এক নজর দেখেই চলে যাব।”
শাফিন কপাল চাঁপড়ায়।ইরফানের হাত টেনে দরজার কাছে যেতে যেতে বলেঃ” পাগলামি করো না।বাড়ি চলে যাও। আমরাও আজকের মাঝেই ঢাকা যাব।তখন দেখো।”
_” কিন্তু শাফিন…
তীব্র আওয়াজে ইরফানের কথা বন্ধ হয়ে যায়।উপর থেকে ভেসে এলো গুলির আওয়াজ।একবার নয় দুইবার।ইরফান ও শাফিন দুজনেই চমকে যায়।ইরফান হতভম্ব গলায় বলেঃ” শাফিন ওটা..
ইরফানের কথা থেমে যায় শাফিনের মুখ দেখেই।শাফিনের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।ইরফানেট হাত ছেড়ে ক্ষীণ স্বরে বলেঃ” ওহ নো,ওপাশে তো তথার ঘর।শব্দটা তো ও ঘর থেকেই এলো।”
একছুটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় শাফিন।ইরফান বজ্রাহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।শাফিনের কথা বুঝতে ঠিক দশ মিনিট সময় লাগে তার।তবে যেই মুহূর্তে শাফিনের কথা মাথায় ঢুকে তখনই কাঁধের ব্যাগ ফেলে দেয়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটার বদলে একছুট দেয়।কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই পৌঁছে যায় প্রেয়সীর ঘরের দরজায়।
***
গুলির শব্দ কানে আসতেই একটুখানি মাথা তুলে মামুন।কবরের উপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়েছিল সে।দোতলা থেকে গুলির শব্দ এলো মাত্র।তার মানে তথা মরেছে।শাফিনের কাছে এগ্রিমেন্ট পেপারগুলো পৌঁছে দেওয়া শেষ।এবার ইউসুফ মরবে। মামুন বাঁকা হাসে।দু-দুটো খুনের শাস্তি নিশ্চয়ই ইউসুফ পাবে।কবরের মাটিতে একটূ ঠোঁট ছোঁয়ায় মামুন।অস্ফুটস্বরে বলেঃ” আমি আসছি,প্রিয়তমা।”
পকেট থেকে একটা ছুঁড়ি বের করে মামুন।ছুঁড়িতে টকটকে লাল রক্ত শুকিয়ে আছে।মামুন চোখ বন্ধ করে।দু-ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে চোখ বেয়ে।মামুন চোখ মুছে কবরের উপরে আবার শুয়ে পড়ে।কাঁপা হাতে রক্তাক্ত ছুঁড়িটা চালিয়ে দেয় নিজের গলায়।
চলবে…
চলবে…