ডাহুক নদীর তীরে পর্ব -২৮+২৯

#ডাহুক_নদীর_তীরে ( পর্ব-২৮)
#হালিমা রহমান

তথা সবে গেটের বাইরে পা দিয়েছে।এমন সময় কোথা থেকে একদল ছেলে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো তার সামনে।সাত-আটটা ছেলে। প্রত্যেকের বয়স বোধহয় সতেরো-আঠারোর ঘরে।তথার কপাল কুঁচকে যায়। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করেঃ” কি চাই?”

_” আসসালামু আলাইকুম, ভাবি।কোথায় যাচ্ছেন?”— সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা তথার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করে।সে মনে হয় দলের নেতা।তার দৃষ্টি নিচের দিকে।

সকাল সকাল মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল তথার।তবে বাচ্চা ছেলেগুলোর উপর রাগ দেখায় না।বড় এক দম নিয়ে বিরক্তি মেশানো রাগটুকু গিলে নেয়।তথার পিছনেই মাহাদী বেরিয়েছিল।তথা কপাল পর্যন্ত ওড়না টেনে দিয়ে ভাইকেই আদেশ দেয়।

_” মাহাদী,তুই এখন তিন রাস্তার মাথায় যাবি।ওখানে তোর ভাইয়া থাকবে।তাকে আমার সাথে দেখা করতে বলবি।আমি রামিম ভাইয়ের কোচিং থেকে বের হব সাড়ে দশটায়।কোচিং সেন্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলিস।”

মাহাদী বিরক্ত হয়। কপাল কুঁচকে বলেঃ” আমি একটু ব্যাডমিন্টন খেলতে যাব আপু।তুমি ফোন দেও ভাইয়ারে।”

_” তোর ভাইয়ার নম্বর নাই আমার কাছে।তুই একটু বলে দিস।ওদিক দিয়েই তো যাবি।”

_” ধুর ভাল্লাগে না।”— মাহাদী তথার বিপরীতে পা বাড়ায়। দিন-দুনিয়া অন্ধকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার।আগে আগে না গেলে বড়রা খেলায় নেবে না।আর এই তথা আপু সবসময় একটা না একটা ভেজাল করবেই।মাহাদী মুখ ভার করে রাস্তা দিয়ে হাঁটে।নিজেকে কবুতর মনে হচ্ছে তার।মুখের ভিতর খবর ঠেসে দিলো, ইরফানের কাছে এগুলো উগড়ে দিতে হবে। দু-দিন পর বিয়ে অথচ নম্বর নেই ফোনে। যত্তসব ঢং।

_” ভাবি রিকশায় উঠেন।এই রোদে হেঁটে যেতে হবে না।”

তথা ভেবেছিল কিছুই বলবে না তবে খুব বেশিক্ষণ না বলে থাকতে পারলো না।গলায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললঃ” ছোট ভাইয়ের দল,তোমরা বিরক্ত কেন করছো আমাকে? আমি নিজের মতো যাচ্ছি ভালো লাগছে না?”

দলনেতা ছেলেটা একটু থতমত খেয়ে গেল।চোখ নিচের দিকে নামিয়ে বললঃ” ভাই বলেছিল আপনি রাস্তায় বেরোলেই আপনাকে রিকশায় তুলে দিতে। ”

হাহ! সেই আগের কাহিনী। তথার চোখ পঁচে গেল এসব দেখে।ইরফানের এসব বাড়াবাড়ি একদম অপছন্দ তথার। মনে হয় যেন আল্লাহর দুনিয়ায় সে একাই প্রেমিক।বাকি সবাই বসে বসে ঘাস কাটে।বিরক্তিতে ভিতর‍টা তেতো হয়ে আসে তথার।

_ ” আমি সামনেই যাব রিকশার দরকার নেই।তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, তোমাদের ভাইকে আমি বুঝিয়ে বলব।”

দাঁড়ায় না তথা। ইরফানের সবকিছু ভালো লাগলেও এসব একদম বিরক্ত লাগে ।তথা কি রাস্তা চিনে না? বাড়াবাড়ি করতে কতবার নিষেধ করলো তথা,কিন্তু ইরফান শোনেই না। তথার কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়।একে নিয়ে আর পারা গেল না।
তথা আস্তে-ধীরে হাঁটে। গ্রাফিক্স ডিজাইনিংয়ের উপর একটা কোর্স করছে। এই বুদ্ধিটা অবশ্য ইরফানের।কয়েকদিন আগেও মরিয়া হয়ে একটা চাকরি খুঁজেছে তথা। এতোগুলো মানুষ মাথার উপরে। শুধু টিউশনিতে হচ্ছে না।কিন্তু অনার্স শেষ হয়নি বলে ভালো কোনো চাকরিই পেল না।ঘর ভাড়া,রুবাইদা-মাহাদীর স্কুলের বেতন,বাজার খরচ,কাকির ঔষধ খরচ — এতোগুলো খরচ মেটানোর একমাত্র উৎস কিছু জমানো টাকা।দিনদিন খরচ বাড়ছে অথচ টাকা কমছে।দু-একটা টিউশনি ছাড়া তথার হাতেও কোনো কাজ নেই।মাথার উপর এক হাত পানিতে অন্ধকার দেখছিল তথা। দিন-রাতে নিঃশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে আল্লাহর নাম জপেছে । জমানো টাকাগুলো শেষ হলেই সর্বনাশের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকবে না। এমন বিপদের সময়েই তথাকে বুদ্ধি দিল ইরফান। গতানুগতিক চাকরির চাইতে ফ্রিল্যান্সিংয়ের দিকে নজর দেওয়া ভালো।তাছাড়া অনার্স শেষ হলেই তো আর চাকরি পাচ্ছে না তথা।গ্রাফিক্স ডিজাইনিংয়ের বাজার ভালো এখন।কোর্স কমপ্লিট করলে তথারই লাভ। চাকরি না পেলেও সমস্যা হবে না।ঘরে বসেই মুশকিল আহসানের সুযোগ আছে।
বুদ্ধিটা মনে ধরলো তথার। ক্ষ্যাপাটে লোকটা মন্দ বুদ্ধি দেয়নি। সবসময় যে সনাতন পথেই চলতে হবে তার তো আর বাধা-ধরা নেই। তাছাড়া, ফেসবুক খুললেই তো দেখা যাচ্ছে কত-কত মানুষ ঘরে বসেই আয় করছে।তবে তথা কেন রাত-দিন নাকের আগায় দম নিয়ে চাকরি খুঁজবে? একবার ইরফানের কথা শুনে দেখাই যাক কিছু হয় কি না।ব্যস আগ-পিছ আর ভাবলো না তথা।কোর্স করতে রাজি হয়ে গেল।এরপর তাকে আর কিছুই করতে হয়নি। ভালো কোচিং সেন্টার খুঁজে তথাকে ভর্তি করে দিলো ইরফান।
তথা এদিক-ওদিক নজর বুলিয়ে হাঁটে। দু-পাশের বাড়ির মাঝে একটুখানি সরু গলি। একসাথে অনেক মানুষ হাঁটা যায় না।পৌষ মাস চলছে।তবে খুব বেশি ঠান্ডা নেই ঢাকায়। তথা কাঁধের উপর ভালোভাবে চাদর জড়িয়ে নেয়।সাদা রঙের পাতলা চাদর। মাথাটা ব্যাথা করছে তার। কত রাত যে শান্তিতে ঘুমাতে পারে না তার হিসাব নেই। ঘুমের উদ্দেশ্যে চোখ বন্ধ করলেই ওই মুখটা ভেসে উঠে। কানে তার কন্ঠ ভাসে। চোখের উপর ভেসে উঠে সেই সবুজ মনি দুটো। ইশ! কি খারাপ একটা অবস্থা। এরপর আর ঘুমাতেই পারে না তথা।অর্ধেক রাত তন্দ্রায় আর অর্ধেক রাত চিৎকার করেই কেটে যায়। কখনো কখনো রুবির কাঁথার নিচে শরীর গুজে রুবিকে বুকে জড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে তথা। আবার কখনো কখনো কাকির বুকে মাথা গুজে ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই ঘুম হয় না।মাঝ রাতে রুটিন করে ঘুম ভাঙবেই। গভীর ঘুমে থাকলেও মাঝ রাতের দিকে ঘুম ভেঙে যায়।অভিমান জড়ানো গলায় প্রতিরাতে কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে। কাঁদো কাঁদো গলায় অভিযোগ করেঃ” কেন প্রতারণা করলেন কামিনী ফুল?”
অবশ্য শুধু রাতে না দিনের বেলাও ইউসুফকে দেখতে পায় তথা।স্পষ্ট তার কন্ঠ শুনতে পায়। মনে হয় যেন একদম পাশে দাঁড়িয়েই কথা বলছে। শুধু তথাই দেখে ইউসুফকে আর কেউ দেখে না। আশ্চর্য হয়ে যায় তথা। এ কি তবে হ্যালুসিনেশন?

সকাল নয়টা বাজে কেবল। চারপাশে আবছা কুয়াশা।সরু গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় পা দিতেই সামনে এক রিকশা থামে।কম বয়সী রিকশাওয়ালা ছেলেটা বিনীত ভঙ্গিতে বললঃ” ভাবি রিকশায় উঠেন।রামিম স্যারের কাছে আমি নিয়া যাইতাছি।”

তথা আশ্চর্য না হয়ে পারে না।ঘটনা কি? এতো তোয়াজ করছে কেন এই ছেলে? আশেপাশে নজর বুলাতেই ঘটনা বুঝতে পারে তথা।ওই তো পাতলা কুয়াশা ভেদ করে ইরফানের কালো রঙের বাহনটা দেখা যাচ্ছে। এদিকেই আসছে সে।তথা কপাল কুঁচকে ফেলে। এই লোকটা এমন কেন?

_” সুপ্রভাত, তথা।দাঁড়িয়ে আছো কেন? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”

_” আমি হেঁটেই যেতে পারব।রিকশা লাগবে না।আর মাহাদীর সাথে আপনার দেখা হয়েছে? ”

_” হুম।”

_” সাড়ে দশটায় মনে করে যাবেন কিন্তু।আমি অপেক্ষা করব।”

_” জরুরি কথা থাকলে এখানেই বলো।”

_” না।এলাকার মাঝে আপনার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না।সবাই কিভাবে যেন তাকায়।”

ইরফান তথার কথা গায়ে মাখে না।অবহেলার ভঙ্গিতে বলেঃ” তাকালে তোমার কি? তুমি তোমার হবু স্বামীর সাথে কথা বলবা,এতে কার বাবার কি? মানুষের দিকে এতো নজর দিয়ে লাভ আছে?”

_” আপনার মতো সমাজ ছাড়া নির্লজ্জ হতে পারিনি এখনো। হতে পারলে মানুষের দিকে নজর দেওয়া লাগতো না।”

ইরফান গাল ফুলায়। অন্যদিকে চেয়ে বলেঃ” সবসময় খালি নির্লজ্জ বলো আমাকে। আমি তো আর অন্য মেয়েদের সাথে নির্লজ্জের মতো আচরণ করিনি,পিছু পিছুও ঘুরিনি।আমার সবকিছু তো হবু বউয়ের জন্য। আমার বউয়ের সাথে আমি নির্লজ্জের মতো আচরণ না করলে কে করবে? অন্য ছেলেরা? হুহ।”

তথা মনে মনে হাসে।ইরফানের মুখ থেকে বউ কথাটা শুনতে ভালোই লাগে।অন্যরকম একটা শিহরণ জাগে মনে।আর ছেলেটাও কম যায় না।তথার সামনে এলেই শুধু বউ, বউ করে।

_” ভাই, ভাবি কি যাইব না?”

_ ” হুম যাবে।তুই একটু দাঁড়া।”

রিকশাওয়ালা ছেলেটাকে আদেশ দিয়ে হাতঘড়ির দিকে তাকায় ইরফান। নয়টা বিশ বাজে।তথার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলেঃ” তাড়াতাড়ি ওঠো।নয়টা বিশ বেজে গেছে। আমি সাড়ে দশটায় পৌঁছে যাব ওখানে।”

_” আমি হেঁটে যেতে পারব।সবসময় বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছিলাম আপনাকে।”

_” তুমিও বাড়াবাড়ি করছো এখন।দু-সেকেন্ডের মাঝে রিকশায় না উঠলে আমিও তোমার সাথে হেঁটে হেঁটে রামিম স্যারের কাছে যাব।বাজারের মাঝ দিয়ে একসাথে হেঁটে গেলে মানুষ হা করে চেয়ে থাকবে।ভালো লাগবে তখন?”

তথা প্রচন্ড বিরক্ত হয়।গাল ফুলিয়ে রিকশায় উঠে।

_” তোর ভাবিকে কোচিং সেন্টারের সামনেই নামিয়ে দিস।সাবধানে যাবি।”

রিকশা চলতে শুরু করলে মাথা নিচু করে একবার পিছনে তাকায় তথা। হ্যাঁ, যা ভেবেছিল ঠিক তাই।ইরফান পিছু পিছু আসছে। মুহূর্তেই মনটা ভালো হয়ে যায় তথার। এই মানুষটা এমন করে কেন? তথা কি তার সাধনার ফল।কে জানে! তথার মনে মনে গানের সুর বাজে।গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করে। আজকে সকালটা খুব সুন্দর। অবশ্য ইরফান সাথে থাকলে সব বেলাই ভালো লাগে। ইদানিং রাস্তায় বেরোলে তথা বারবার পিছনে তাকায়। মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে ইরফানকে কামনা করে। কি যে হয়েছে তথার!

***

সাদা রঙের একতলা বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ইরফান। ভিতরে রামিম স্যার গ্রাফিক্স ডিজাইনিংয়ের কোর্স করাচ্ছেন।ঘড়িতে দশটা বিশ বাজে। তথা এখনো বেরোয়নি।ইরফান বাইকে হেলান দিয়ে পাকা রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে। হুট করেই জীবনের রঙ এতোটা বদলে যাবে, তা মোটেও ভাবেনি ইরফান। আর মাত্র দশ দিন পরে তথার সাথে তার বিয়ে হবে। একসপ্তাহ আগে ইরফানের বাবা-মা তথার বাড়ি গিয়েছিল আঙটি পরাতে। সেদিনই দিন-তারিখ ঠিক হয়েছে। আঙুল গুনে ইরফান।দশ দিন অনেক বেশি সময়।আঙটি পরানোর পর এতো দেরি করে বিয়ের তারিখ ফেলতে হয়? দু-একদিনের মাঝে বিয়েটা হয়ে গেলেই ভালো হতো। আর কতোদিন প্রেয়সীর পিছু পিছু ঘুরবে ইরফান? বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিলেই হয়। তখন আর পিছু পিছু ঘুরতে হবে না।তথাকে বাইকের পিছুনে বসিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে যাবে। নিজের বাবার উপর রাগ হয় ইরফানের। বাবা অনেক নিষ্ঠুর। এতো দেরি করে বিয়ের তারিখ না ফেললেই পারতো।
ইরফান একমনে চেয়ে থাকে নিচের দিকে।মাঝে মাঝেই দুই মাস আগের সেই অপয়া দিনটার কথা মনে পড়ে যায়। ডাহুক নদীর তীরের সেই জমিদার বাড়িতে কাটানো কয়েকটা ঘন্টার কথা মনে পড়তেই গলা শুকিয়ে আসে ইরফানের। তথার ঘর থেকে গুলির শব্দ কানে আসতেই প্রাণপন ছুটেছে ইরফান।ছুটে গিয়েছিল প্রেয়সীর ঘরের দরজায়।আল্লাহ বাঁচিয়েছে সেদিন। বুলেট ইউসুফের বন্দুক থেকে নয়, বেরিয়েছিল অফিসার আরিফ হোসেনের বন্দুক থেকে। সোনালীকে খুঁজতে বাড়ির পিছনে যাওয়ার কথা ছিল তার। সেই উদ্দেশ্যেই উপরে এসেছিল আরিফ। শাফিনের কাছে শুনেছিল,দোতলার হাম্মামখানার ভাঙা জানলা দিয়ে বাইরে যাওয়া যায়। আরিফের ইচ্ছে ছিল সেখান দিয়েই যাবে।মূলত একারণেই শেষ দুপুরে দোতলায় এসেছিল সে। দোতলায় পা দিতেই তথার কন্ঠ কানে আসে। কাঁদতে কাঁদতে মৃত্যু কামনা করছে সে।পা টিপে টিপে তথার ঘরের দরজায় উঁকি দিতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় আরিফের। ইউসুফের রিভলবারের নল তথার কপালে ঠেকানো,তথা চোখ বন্ধ করে কাঁদছে।ব্যাস আর কিছু ভাবেনি আরিফ। তথাকে বাঁচানো তার দায়িত্ব। তাই পকেট থেকে রিভলবার বের সোজা গুলি চালিয়েছে ইউসুফের পিঠে। ভয়ংকর অপরাধী আহমেদ ইউসুফ মরেছে মাত্র দুটো বুলেটে। ইউসুফ লুটিয়ে পড়তেই চোখ খোলে তথা। হতভম্ব চোখে চেয়েছিল ইউসুফের দিকে,সবুজ রঙের অদ্ভূত মনি দুটোর দিকে।শাফিনের নিষেধ সত্ত্বেও ইরফান ছুটে গিয়েছিল তথার দিকে। চোখের পানি ও ঘামে মাখামাখি পুরো চেহারা,গলার দু-পাশে আঙুনের ছাপ,ডান হাতে আঙুলের ছাপ।ইরফান দিশেহারা হয়ে পড়ে। প্রবল আবেগে তথাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। আস্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলেঃ” কিছু হয়নি তথা। ভয় পেয়ো না।”

তবে তথা ভয় পেয়েছিল।তীব্র ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল ইরফানের বুকেই। শাফিনের তত্ত্বাবধানে তথাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ইরফান। আশ্রয় নিয়েছিল বাজারের সরকারী হাসপাতালে। শাফিনের মুখ থেকেই তথা-ইউসুফের মিথ্যা সম্পর্কের কথা জানতে পেরেছিল। শাফিনের কথায় অভিনয় করতো তথা। তথার ডায়রিয়ার সময় ইউসুফের যত্ন-আত্তি চোখে পড়েছিল শাফিনের।তখনই বুদ্ধিটা মাথায় আসে।তথাকে দিয়ে যদি ইউসুফকে ব্যস্ত রাখা যায়, তবে তাদের কাজ সহজ হবে।এরপর এক বিকালে তথাকে সব খুলে বলল শাফিন।ইউসুফের অপরাধের কথা,পরিকল্পনার কথা,অতীত -বর্তমান সবকিছু। সে নিজেও যে গোয়েন্দা পুলিশ সেটাও বলেছিল।অবশ্য বাকিদের কথা বলেনি।তথার মাধ্যমে যদি ইনফরমেশন লিক হয় তবে সাড়ে সর্বনাশ।আমও যাবে, ছালাও যাবে।তারপর সন্ধ্যার দিকে জ্ঞান ফিরলো তথার। সে আরো ভয়ংকর অবস্থা।তথা কাউকে কিছু বলছে না শুধু চিৎকার করে কাঁদছে,হাতের অবস্থা ভালো না।এর মাঝে শাফিনের কোনো খোঁজ নেই।জমিদার বাড়িতে কি চলছে তাও জানা নেই। ইরফান যেন দিশেহারা হয়ে পড়লো। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে রাফায়েতকে কল করলো। নিজের অবস্থা বুঝিয়ে বলল।রাফায়েত আর অপেক্ষা করেনি।সে রাতেই মাইক্রো নিয়ে ছুটে এসেছে পঞ্চগড়। তথা কে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে সারা রাত ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। সে রাতে একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছিল ইরফানের উপর। শাফিনও পাশে ছিল না। সোনালীর মৃতদেহ উদ্ধারের পর বেশ ভেঙে পড়েছিল ছেলেটা। বোনের লাশ দেখে তো কয়েক ঘন্টা অজ্ঞানই ছিল।
পরদিন অসুস্থ তথাকে নিয়ে ঢাকা এলো ইরফান ও রাফায়েত।এলাকায় পা দিতেই কানে এলো আরেক দুঃসংবাদ।তথার চাচাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।এদিকে রুবাইদা হাসপাতালে ভর্তি,তার অপারেশন চলছে।যত প্রকার বিপদ ছিল সব একদিনেই হানা দিলো যেন।ইরফান আর কি করবে? উপায় না পেয়ে তথাকে নিয়ে নিজের বাড়িতেই ছুটলো। সাজ্জাদ সাহেবকে সব বুঝিয়ে বলল। পঞ্চগড় যাওয়ার কথা,তথার কতাহ,ইউসুফের কথা, শাফিনের কথা,সোনালীর মৃত্যুর কথা —-সব।সাজ্জাদ সাহেব অমানবিক নয়।অসুস্থ,দূর্বল তথাকে আশ্রয় দিলেন নিজের বাড়িতে।অবশ্য ইরফানকে দুটো চড় মেরেছিলেন তখন।বেয়াদব ছেলে না জানিয়ে এতো দূরে গেল কোন সাহসে?
সেই দুঃসময়ের কথা মনে পড়লে গায়ে কাটা দেয় ইরফানের। তথা ও তথার পরিবারকে একসাথে সামলাতে হয়েছে। রুবাইদা অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি।স্বামীর অধপতনের কথা শুনে আকলিমা খাতুন নিজেও শয্যাশায়ী। মাহাদী ছোট মানুষ। মা-বোনের অবস্থা দেখে সেও কাহিল।পুরো পরিবারকে সামলাতে হয়েছে ইরফানকে।ঘরে তথা,হাসপাতালে তথার পরিবার।দিন-রাত ছুটোছুটি করতে করতে ইরফান ক্লান্ত। অবশ্য খালেদা বানু খুব যত্ন নিয়েছেন তথার।মায়ের মতো স্নেহ করেছেন মেয়েটাকে।হয়তো তিনি ছেলের দূর্বলতা জানতেন।তাই নিজের সবটুকু দিয়ে বিপদের সময় আগলে রেখেছেন মেয়েটাকে।নাহয় সপ্তাহ দুয়েকের মাঝে শারিরীক ও মানসিকভাবে কিছুতেই সুস্থ হতে পারতো না তথা।

_” আপনি কখন এসেছেন?”

তথার কন্ঠ পেয়ে চিন্তা রাজ্যে ভাঙন ধরে ইরফানের।আলগোছে একবার নজর বুলায় তথার দিকে।মেয়েটা শুকিয়ে গেছে।চোখের নিচেও কালি পড়েছে।রাতে ঘুমায় না নাকি।

_” কি জিজ্ঞেস করলাম?”

_” একটু আগে এসেছি। চল কোথাও ঘুরতে যাই।রমনায় যাবে?”

তথা চোখ ছোট ছোট করে তাকায়।

_” আপনার ব্যবসা- বানিজ্য নেই?”

_” বিয়ের ছুটি চলছে।”

_” এখনো দশ দিন বাকি বিয়ের! ”

_” হোক। আমি জীবনে একবারই বিয়ে করব।এতুটুকু ছুটি কাটালে পাপ হবে না।তাছাড়া নিজের বিয়েতে অনেক কাজ, বুঝলে। তোমার বিয়ের শাড়িগুলোই এখনো কিনতে পারলাম না।তিন দিন তিন মার্কেট থেকে ঘুরে এসেছি।যা দেখি তাই ভালো লাগে।ইচ্ছে করে সব দোকানের শাড়িগুলো নিয়ে আসি।কি একটা অবস্থা বলো তো! ”

তথা কপাল চেপে ধরে।এই লোক আসলেও এক পাগল।এর সাথে কথা বলতে গেলে তথা নিজেই পাগল হয়ে যাবে।

_” তুমি কি যেন বলবে বলেছিলে।”

তথা এক পলক তাকায় ইরফানের দিকে। কয়েক সেকেণ্ড অপলক চেয়েই থাকে। হালকা গলায় বলেঃ” আহমেদ ইউসুফ আমার কপালে তিনবার চুমু দিয়েছিল।ঠিক তিনবার।”

ইরফান অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। গম্ভীর গলায় বলেঃ” তুমি অনেকবার এই কথা বলেছে আমাকে। এটা শুনতে ভালো লাগে না আমার।রাগ লাগে অনেক।আমার বউয়ের কপালে চুমু দিয়েছে আরেক শয়তানের ছাও! আমি নিশ্চয়ই আনন্দে ধেইধেই করে নাচব না। ”

_” না,তবুও এই কথাটা আপনাকে শোনাতে খুব ভালো লাগে আমার।”

_” বিয়ের পর আমি দিনে একশটা চুমু দেব কপালের মাঝে।তখন ভাল লাগলেই চলবে।”—ফিচেল হেসে উত্তর দেয় ইরফান।

_” আপনি একটা নির্লজ্জ।”

_” হ্যাঁ, জানি। পাঁচ বছর ধরে এক তোমার পিছনে ঘুরছি। আর কতো ভালো লাগে বলো।আমারও একটা ধৈর্যের সীমা আছে। এখন আর প্রেমিকা নয়,বউ ভাবতে ইচ্ছে করে তোমাকে।আমার ছেলেকে আমি খুব দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেব।ছেলে যেই মেয়ে পছন্দ করবে ঠিক সেই মেয়ের সাথেই বিয়ে দেব।দরকার পরলে বিয়ের পর ছেলে আর ছেলের বউকে একসাথে পড়াশোনা করাবো।তাও আমি যতটা ভুগেছি ততোটা ভুগতে দেব না আমার ছেলেকে।”

তথা কপাল চাপড়ায়। মিনমিন করে বলেঃ” কই আছে কি,পান্তা ভাতে ঘি।”

ইরফান শুনতে পেলো না তথার কথা।সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেঃ”আর কি বলবে? ”

তথা মাটির দিকে চেয়ে চুপ করে থাকে। মনে হয় যেন সে কথা সাজিয়ে নিচ্ছে মনে মনে।কয়েক সেকেন্ড নীরবতা পালন করে বলেঃ” আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি,ইরফান।আমি ইউসুফকে দেখতে পাই,ওর কথা শুনতে পাই,ওর উপস্থিতি টের পাই। রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারি না।মনে হয় যেন ও খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে।কখনো কখনো মনে হয় ও ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।ভেবেছিলাম দিন গড়ালেই সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু হচ্ছে না।দিনদিন অসুখ বেড়েই চলছে।আমার ভালো লাগে না ইরফান।একটুও ভালো লাগে না। ইউসুফকে যখন দেখি তখন মরে যেতে ইচ্ছে করে।কি করব আমি?”

তথার চোখে পানি টলমল করে।ইরফান এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে প্রেয়সীর দিকে। মেয়েটার চোখের নিচের কালি বলে দিচ্ছে, কতরাত সে ঘুমাতে পারে না।আফসোস হয় ইরফানের।দুজনের মাঝে বৈধতা থাকলে ভালো হতো।ইরফান আষ্টেপৃষ্টে তথাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। নির্ভরতার সুরে বলতোঃ” তুমি চিন্তা করো না, তথা।সব ঠিক হয়ে যাবে।তোমার সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। আমি আছি তো।”
#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-২৯)
#হালিমা রহমান

_ ” তোমার হবু স্ত্রীর নাম যেন কি? “— চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ইরফানের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন সাইকিয়াট্রিস্ট শারমিন আঞ্জুম।

_” সায়রা খানম তথা।”

_” ওর সাথে সরাসরি কথা বলতে পারলে ভালো হতো। ওকে নিয়ে আসলেই পারতে।”

ইরফান খালি চায়ের কাপ টেবিলে রাখে। সোফায় হেলান দিয়ে বলেঃ” বিয়ের মাত্র তিনদিন বাকি। এই সময়ে আমি গলা কেটে বললেও আমার সাথে কোথাও যাবে না।দেখাই করতে চাইছে না। ওর নাকি লজ্জা করে।”

শারমিন হাসে।বাম হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে চশমাটা নাকের উপরে ঠেলে দিয়ে বলেঃ” খুব লজ্জাবতী নাকি?”

_” খুব।মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষ নয় লজ্জাবতী লতা বিয়ে করছি।”

_” তোমার থেকে যতটুকু শুনলাম তা থেকে আমি অনায়াসে বলতে পারি,ওর সমস্যাটা হ্যালুসিনেশন। এর মাঝে কোনো ভূত-টূতের ব্যাপার নেই।”

_” আমিও এটাই ভেবেছিলাম।কি করব এখন? রাতে ঘুমাতেই পারছে না মেয়েটা। স্বাস্থ্য-টাস্থ্য ভেঙে একাকার। চোখের নিচে এক আঙুল কালি পরেছে।ওকে দেখলে আমার নিজেরই কান্না পায়।”

শারমিন একবার ইরফানের দিকে নজর বুলায়।আত্মীয় হওয়ার সুবাদে ইরফানের সব তার জানা।সেদিনও ছেলের বিয়ের দাওয়াত দিতে এসে সাজ্জাদ সাহেব কিছুক্ষণ আফসোস করেছেন।ছেলের কাজ-কর্মের কোনো দিকপাল নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে তুলে হবু বউয়ের পিছনে ঘুরছে। এলাকার বয়স্কদের কথার চোটে ঘর থেকে বের হওয়াই দায়। সাজ্জাদ সাহেব রাস্তায় বেরোলেই চাচার বয়সী লোকেরা এদিক-ওদিক মাথা নাড়ায়।আফসোসের সুরে বলেঃ” তোমার পোলাডা মানুষ হইলো না,সাজ্জাদ। তুমি কি আছিলা,আর তোমার ঘর থেকা এডা কি হইলো! সারাদিন এদিক-ওদিক ঘুরে।ওরে কিছু কও না?”

এদিক-ওদিক বলতে যে তথাকে বুঝানো হয়েছে তা বেশ বুঝতে পারেন সাজ্জাদ সাহেব।কিন্তু কি আর বলবেন তিনি? এই ছেলে কথা শোনার ছেলে নয়। সাজ্জাদ সাহেব হাত তুলে ফেলেছেন অনেক আগে। ইরফান বাবার মুখের উপর কথা বলে না ঠিক,তবে সুকৌশলে বাবার কথার অবাধ্য হয়। একে ঠিক কুলাঙ্গার বলা যায় না আবার সুসন্তানও বলা যায় না। ইরফানটা যে কার মতো হলো।সমাজ ছাড়া, গোত্র ছাড়া, দল ছাড়া এক বেহায়া ছেলে।

_” শারমিন আপা, কোনো মেডিসিনের দরকার আছে? মানসিক সমস্যা তো,তাই বলছিলাম আর কি।”

_” এক্ষেত্রে ওকে কিছু এন্টি সাইকোটিক মেডিসিন দেওয়া যেতে পারে। তবে আমার মনে হয় না এখনই মেডিসিন দরকার।”

_” তাহলে?”

শারমিন আরেকবার চশমাটা ঠেলে দেয় নাকের উপর। ইরফানের দিকে চেয়ে বলেঃ” দেখ ইরফান,মেয়েটা একদম সামনা-সামনি মৃত্যু দেখেছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা মানুষের কাছাকাছি থাকতে হয়েছে, বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে।স্বাভাবিকভাবেই ঘটনাগুলো তার মনে দাগ কাটবে। শাফিনের কাছে শুনেছি আহমেদ ইউসুফ খুব কেয়ারিং ছিল তথার ব্যাপারে। ইউসুফের মতো একটা জটিল চরিত্রকে খুব কাছ থেকে দেখেছে তথা। তাই মৃত্যুর পরেও ওকে ভুলতে পারছে না মেয়েটা। নিজের আশেপাশে সবসময় ওর অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। যেটা কল্পনায় আছে, বাস্তবে নেই। তবে একটা জিনিস ভালো লেগেছে আমার।তথা ভেঙে পড়েনি।অনেক সময় হ্যালুসিনেশনে মানুষ সুইসাইড করতেও দ্বিধা করে না।”

তথার প্রশংসা করায় বেশ খুশি হয় ইরফান।এলোমেলো চুলগুলোকে পিছনে ঠেলে দিয়ে বলেঃ” হ্যাঁ, খুব সাহসী মেয়ে তথা। ওর চাচা যেই কাজটা করলো ওর সাথে, আমি ভেবেছিলাম তথা মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।কিন্তু তা হয়নি। দুই সপ্তাহ পর থেকেই কথা-টথা বলেছে সবার সাথে। নিজে ঠিক থেকে পরিবারকে আগলে রেখেছে। ওদের পরিবারে ওই তো এখন অভিভাবক। আমার চাচি শ্বাশুড়ি একদম নরম হয়ে গেছে।বেশিরভাগ সময় অসুস্থই থাকে।”

_” চাচি শ্বাশুড়ি! তোমার বিয়ে হয়েছে এখনো?”

ইরফান মুচকি হাসে।মুখে হাসির রেখা ধরে রেখে বলেঃ” হবে তো,শারমিন আপা।আর মাত্র তিনদিন বাকি।কালকে আমার মেহেদী, পরশু হলুদ,তার পরদিন বিয়ে।”

_” ছেলে পক্ষ মেহেদী করে?”

_ ” আমি করব।আমার বিয়েতে সব হবে। মেহেদী থেকে শুরু করে সব।জীবনে একবারই বিয়ে করব। সাধ মিটিয়ে না করলে কি হয়?”

শারমিন মুচকি হাসে। ছেলেটা লজ্জা-শরম আসলেই কম। নাহয় নিজের বিয়ের কথা মানুষ এভাবে বলে? এই ছেলে নিশ্চিত বউ পাগল হবে।

_” শোনো ইরফান,আমি তথাকে কোনো মেডিসিন দেব না এখন। আর তিনদিনই তো।কাজ-কর্মে হয়তো ব্যস্ত থাকবে।তবে বিয়ের পর খুব দ্রুত আমার সাথে দেখা করবে।আমি একটু সরাসরি তথার সাথে কথা বলতে চাই।আর তোমারও দায়িত্ব আছে। তথাকে সঙ্গ দেবে। ওকে খুব বেশি মানসিক চাপের মাঝে রাখবে না। ওর যেন পর্যাপ্ত ঘুম হয় সেদিকে খেয়াল রাখবে।”

_” কিন্তু ওর তো ঘুমই হয় না।”

_ ” তথা রাতের বেলা একা থাকে।সারাদিন হয়তো কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকে বলে ইউসুফের কথা মনে পড়ে না। অথবা হয়তো মনে পড়লেও ওতো পাত্তা দেয় না। নিস্তব্ধ রাতে অতীত বেশি মনে পড়ে ওর।হ্যালুসিনেশন হয়,পুরো রাত ঘুমাতে পারে না।এক্ষেত্রে তোমার কাজ হলো ওকে রাতের বেলা সঙ্গ দেবে বেশি। শান্ত রাখবে ওকে। একটা নির্ভরতার জায়গা তৈরি করতে হবে তোমাকে।তথা যাই বলুক,ও কিন্তু এখনও তোমাকে বিশ্বাস করে না। হয়তো পছন্দ করে,ভালোবাসে তবে বিশ্বাস করে না। ”

ইরফান চমকে যায়।সোজা হয়ে বলেঃ” কি বলছো,শারমিন আপা! বিশ্বাস ছাড়া আবার ভালোবাসা হয়?”

শারমিন হতাশ হয়ে তাকায় ইরফানের দিকে।সে ভুলেই গিয়েছিল তার সামনে এক প্রেমিক পুরুষ বসে আছে। এদের যুক্তি-তর্ক সবসময় ভিন্ন হবে।

_” ভাই ইরফান,তোমার প্রেম-ঘটিত কথা-বার্তা আমি বুঝব না।তাই বিশ্বাস ছাড়া ভালোবাসা হয় কি না তার উত্তর এখন দিতে পারছি না।তবে আমি আমার কথার ব্যাখ্যা দিতে পারি। তথার সবচেয়ে নির্ভরতার জায়গা ছিল ওর পরিবার। বাবার জায়গাটা চাচাকে দিয়েছে। ওর চাচাই কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করতে চেয়েছে।আর একটা মানুষের কাছে নিজের পরিবারটাই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসী। সেখান থেকেই ধাক্কাটা খেয়েছে তথা।বুঝতেই পারছো নির্ভরতা বা বিশ্বাস শব্দটাকেই এখন আর বিশ্বাস করতে পারবে না মেয়েটা। তাই আমি বলতেই পারি, তথা তোমাকে বড়জোর পছন্দ করে অথবা ভালোবাসে।তবে বিশ্বাস করে না।আমি নিজেও যদি তথার জায়গায় থাকতাম হয়তো আমিও এই কাজটাই করতাম।আরেকটা কথা মনে রেখো,তথা স্বভাবগতভাবে খুব অন্তর্মুখী। সবকিছু নিজের মাঝে চেপে রাখার প্রবনতা বেশি। হ্যালুসিনেশন তো আর আজ-কালের মধ্যেই হয়নি।ও যখন নিজের কথাগুলো আর চেপে রাখতে পারেনি,তখনই তোমাকে বলেছে। এ ধরনের মানুষদের সাথে একসাথে থাকা কিন্তু একটু কঠিন। ওর সমস্যাগুলো তোমাকে বুঝে নিতে হবে। হয়তো সবকিছু বুঝতে পারবে না,তবে চেষ্টা করবে। সবসময় মনে রাখবে, তথার মানসিক স্বাস্থ্য ও আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য এক নয়।মেয়েটা এমনিতেই একটা ধাক্কা খেয়েছে।এরকম বাজে ঘটনা যেন ওর সাথে আর না ঘটে।”

ইরফান অবুঝ নয়।মুহূর্তেই বুঝতে পারে সবকিছু।তথার মানসিক অবস্থা সত্যি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো না।অথচ মেয়েটা সারাদিন কি রকম ভাব নিয়ে থাকে! মনে হয় যেন সে খুব হাসি-খুশি,খুব স্ট্রং একজন মানুষ। যে কোনো বিপদের মুখোমুখি হলেও সে ভেঙে পড়বে না। অথচ মেয়েটা একদমই ভিন্নরকম। সে নিজেই খুব অসহায়। ইরফানের খারাপ লাগে খুব। কেন তথার সাথেই এমন হলো?

_” ইমার কি খবর, ইরফান? ”

_” ভালো, আপা।তুমিও ইমা আপার সাথে চলে যেতে পারতে। ”

_” না, আমি এতো আগে যেয়ে কি করব? হলুদের দিন পৌঁছে যাব।তাছাড়া, শাফিনটাও তো বাড়িতে।আমি চলে গেলে ওর কি হবে?”

শাফিনের কথা শুনতেই ইরফানের মুখটা মলিন হয়ে যায়।শাফিনকে দেখলে এখন ওর খারাপই লাগে। ছেলেটা কি থেকে কি হয়ে গেল! আগের দেই চঞ্চলতা, দুরন্তপনা কিছু নেই এখন।শখের চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছে।সারাদিন এখন ঘরেই থাকে। সোনালীর মৃত্যুতে শাফিন এতোটা বদলে যাবে তা কেউ ভাবেনি।

ইরফান একবার হাতঘড়ির দিকে নজর বুলায়।সাড়ে দশটা বাজে কেবল।ঘুম থেকে উঠেই শ্যামলী ছুটে এসেছে। কিন্তু কাজের চাপে তথার সমস্যার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলে।আজ ভোরে মনে পড়তেই ছোট বোন ইমার শ্বশুর বাড়িতে চলে এসেছে।শাফিনের বড় বোন নিজেই একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। তাই অন্য কোথাও যায়নি ইরফান।শারমিন পঞ্চগড়ের অনেক কথাই জানে।তথার কথাও শুনেছে শাফিনের মুখে।তাই তথাকে না দেখেও মোটামুটি একটা ধারণা দিতে পেরেছে ইরফানকে। অন্যকেউ তথার সাথে কথা না বলে ইরফানকে এভাবে বুঝিয়ে দিতো কি না সন্দেহ। ইরফান উঠে দাঁড়ায়।শারমিনকে উদ্দেশ্য করে বলেঃ” শাফিন ঘরে আছে নাকি, আপা?”

_” হ্যাঁ, ঘরেই।ঘুমাচ্ছে বোধহয়। দেখা করতে যাবে নাকি? ছেলেটা সারাদিন একা একা থাকে।”

_” হ্যাঁ, এসেছি যখন একবার দেখা করেই যাই।দো-তলার প্রথম ঘরটাই না?”

_” হুম। ”

_” আচ্ছা।”

ইরফান পা বাড়ায় শাফিনের ঘরে।ছেলেটার কাছে তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। শাফিন না থাকলে পঞ্চগড়ে একটুও সুবিধা করতে পারতো না ইরফান।তথাকে পঞ্চগড়ে হাসপাতাল অবধি নিয়ে যাওয়ার পিছনেও শাফিনের অবদান। বিয়ের শুরু থেকে শেষ অবধি যদি শাফিন সাথে থাকতো,তবে বেশ হতো।

***

শাফিন ঘুম থেকে উঠেছে ভোর সকালে।সে এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে দৈনিক।কুরআন শরীফ পড়া শিখেছিল সেই ছোটবেলায়।এরপর বহু বছর আর পড়া হয়নি। এখন একটু একটু করে পড়ার চেষ্টা করে। নামাজের পর ইমাম সাহেবের পাশে বসে বাচ্চাদের মতো থেমে থেমে পড়ে। একটু ভুল হয়,একটু শুদ্ধ হয়।কখনো কখনো ভুল হলে বৃদ্ধ ইমাম সাহেব শাস্তিস্বরূপ কান টেনে দেন।তখন একটু লজ্জা পায় শাফিন। তবে দমে যায় না।আবার চেষ্টা করে। এই দুনিয়াটাই তো সব নয়।ওপাড়ে যেয়ে দাঁড়াতে হবে। এই জীবনে বহু ভূল করেছে শাফিন,চলতে-ফিরতে অন্যায় করেছে।সেগুলো এখন শুধরে নিতে চায়। ফজর নামাজের পরে প্রত্যেকদিন কবর যিয়ারত করে শাফিন।সোনালীর মৃতদেহ ঢাকায় আনে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। প্রত্যেকদিন বোনের শেষ ঠিকানা দেখতে যায় শাফিন। কবরের উপর পড়ে থাকা শুকনো পাতা পরিষ্কার করে।কতগুলো গাছও লাগিয়েছে সেখানে। সোনালীর কবরের দিকে তাকালেই চোখ ভিজে যায় শাফিনের। মেয়েটা যদি আর কয়েক বছর বেঁচে থাকতো!

শাফিন জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার জানলা দিয়ে সোনালীর কবর দেখা যায়। বাড়ির পাশে একটুখানি জায়গা ছিল।শাফিনের দাদা-দাদির মৃত্যুর পর সেই জায়গাটুকুই পারিবারিক কবরস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। শাফিনের বাবা খুব যত্ন করে দেয়াল তুলে দিয়েছেন কবরস্থানের চারপাশে।এ বাড়ির মৃত মানুষেরা এ বাড়িতেই থাকে। পারিবারিক কবরস্থান থাকায় বাইরের কবরস্থানে দাফন-কাফনের প্রয়োজন পড়ে না।

_” শাফিন, আসব?”

ইরফানের কন্ঠ পেয়ে পিছু ফিরে তাকায় শাফিন। মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বলেঃ ” এসো,ইরফান।কী খবর তোমার?”

ইরফান ঘরে ঢুকে খাটের এককোনে বসে পড়ে। প্রসন্ন গলায় বলেঃ” এই তো আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কি খবর?”

_” আমিও আছি ভালো।তথা কেমন আছে?”

_” সেও ভালো।আমাদের বাড়ি গেলে না যে? আঙ্কেল-আন্টি-শফিক ভাই সবাই গেল। তাদের সাথে তো তোমারও যাওয়ার কথা ছিল।”

ইরফানের পাশেই বসে পড়ে শাফিন।বিরস গলায় বলেঃ” এখন আর এসব ভালো লাগে না ইরফান।এতো হৈ-হল্লা বিশৃঙ্খলা মনে হয়।আমি বাড়ি বসেই দোয়া করব তোমাদের জন্য। আল্লাহ তোমাদেরকে সুখী করুক।”

ইরফানের মন খারাপ হয়। সে বিষন্ন গলায় বলেঃ” খুব বেশি হৈচৈ হবে না।বাবাকে তো চেনোই।তিনি এসব পছন্দ করেন না।তুমি আমাদের বাড়িতে গেলেই পারতে।”

শাফিন মুচকি হাসে। ইরফানের দিকে চেয়ে বলেঃ”বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে ভাল লাগে না এখন।দেখলে না চাকরিটাও ছেড়ে দিলাম। গতমাসে শেষবারের মতো ব্রেকআপ হয়েছে।আমি এখন পুরো কুয়োর ব্যাঙ হয়ে গেছি।”

_” চাকরিটা না ছাড়লেও পারতে শাফিন।”

_” চাকরিটা না ছাড়লে আফসোসে মরে যেতাম।খূনী থেকে শুরু করে মাফিয়া,কত অপরাধী ধরেছি এই দুই বছরে।অথচ আমার বোনের হত্যাকারীকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে পারলাম না। আমার মতো হতভাগা কোথায় আছে?”

_” ইউসুফ তো মরেছে।”

শাফিনের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে যায়।শক্ত কন্ঠে বলেঃ” ওর সাত কপালের ভাগ্য ও মরেছে। এতো সহজ মৃত্যু ওর কাম্য ছিল না। আরিফ ভুল করেছে।পিঠে গুলি না করে হাতে করতে পারতো। হাতে গুলি করলে তো আর মরতো না। তুমি সোনালীর লাশ দেখেছিলে?”

ইরফান এদিক-ওদিক মাথা নাড়ায়।তথাকে নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিল তখন। লাশ দেখার সময় পায়নি।

_” আমার বোনকে যখন মাটির ভিতর থেকে তুললাম,আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। পুরো শরীরে কাদা মাখা,পেটে আঘাত,দুটো হাতে আঘাত,লাশ থেকে পঁচা গন্ধ বেরিয়ে গিয়েছিল। তুমি চিন্তা করতে পারো ইরফান? আমার বোনকে ওই কুকুরটা কত কষ্ট দিয়ে মেরেছে? মরার সাথে সাথে শেষ গোসলটাও পায়নি ও। আর কাফনের কাপড়ের কথা আমি বাদই দিলাম। আমারই ভুল ছিল।সেই রাতে সোনালীর পিছু পিছু যাওয়া উচিত ছিল। অথবা তথাকে যদি আগে থেকেই সোনালীর কথা জানিয়ে রাখতাম। তথা ইউসুফকে নিজের সাথে রাখলেই হয়তো মেয়েটার পরিনতি ভিন্ন হতো।”

শাফিনের কন্ঠ ভেঙে আসে।ইরফান কাঁধে হাত দেয়। সহানুভূতির সুরে বলেঃ” অতীতের কথা চিন্তা করে আর কি লাভ বলো? তারচেয়ে সোনালীর জন্য দোয়া করো। আল্লাহ মেয়েটাকে ভালো রাখুক।”

_” হ্যাঁ, সেটাই করছি।তবে মাঝে মাঝে সেই দিনের কথা খুব মনে পড়ে জানো। তুমি তো তথাকে নিয়ে বেড়িয়ে গেলে,ইউসুফ মরলো,ডিরেক্টর গ্রেফতার হলো।মেয়েগুলো ভয়ে কিভাবে যে চিৎকার করে কেঁদেছে,তুমি শুনলে বুঝতে। গ্রামের মানুষ সব জড়ো হয়ে গিয়েছিল ওদের কান্নাকাটিতে।”

_” ইউসুফের সাথে কোনো মানুষ ছিল না?”

_” একটা চ্যালা ছিল।মামুন নাম।মামুনও মরেছে।ওর জন্য মাঝে মাঝে আমার কষ্ট হয়। আত্মহত্যা করেছে ছেলেটা। আমরা বাড়ির পিছনে যেয়েই ওর লাশ দেখেছি।”

_” ফাঁসি দিয়েছিল?”

_” উঁহু। গলায় ছুঁড়ি চালিয়েছে।হাত-পা ছড়িয়ে সোনালীর কবরের উপর পড়েছিল।ছেলেটা খুব ভালোবাসতো সোনালীকে। আমার মনে হয়, সোনালীর মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি বলেই আত্মহত্যা করেছে। আমার কাছে কিছু ডকুমেন্ট এসেছিল ওই দুপুরেই। ওগুলোও মনেহয় ওই দিয়েছিল।”

_” পরে ওর লাশও নিয়ে এসেছিলে?”

_” হুম।ইউসুফের লাশ,মামুনের লাশ–দুটোই ঢাকা নিয়ে এসেছিলাম। দেখেছো, কত দূর্ভাগ্য আমার? যে আমার বোনকে মারলো, তার লাশ দায়িত্ব নিয়ে ঢাকা অবধি নিয়ে আসতে হয়েছে। লাশ থেকে গন্ধ বের হওয়ার পর আমার বোন শেষ গোসল পায়।অথচ একদিনের মাঝেই ইউসুফের তরতাজা লাশের দাফন হয়েছে। আমি সাথে থাকার পরেও আমার বোনের এই পরিনতি।আমার মতো কুলাঙ্গার ভাই আর কোথাও দেখেছো ইরফান? ”

ইরফান চেয়ে থাকে শাফিনের ব্যাথাতুর মুখের দিকে।ছেলেটার দু-চোখ দিয়ে আষাঢ়ের বৃষ্টি নেমেছে। ফর্সা গাল দুটো, নাকের পাটা লাল হয়ে গেছে একদম।দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেয় শাফিন। জীবনের একটা ব্যর্থতা খুঁচিয়ে মারে শাফিনকে। যদি একবার,আরেকবার অতীতে ফিরে যাওয়া যেতো,তবে ভালো হতো।প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে বোনকে বাঁচাতো শাফিন।

***

_” ও মা,আরেকটু টেনে দাও না চুলগুলো।এই যে এদিক দিয়ে টেনে দাও।”

আকলিমা খাতুনের ডানহাত টেনে নিজের মাথায় রাখে তথা।মাথাটাকে আরো গুজে দেও মাতৃসম কাকির কোলে। কাকিকে মা ডাকে তথা।মানুষটা তো মায়ের মতোই। তবে মা ডাকতে দোষ কোথায়।আকলিমা খাতুন দূর্বল হাতে তথার চুল টেনে দেয়।আজকাল শরীরটা ভালো যায় না তার।এটা-ওটা লেগেই থাকে।বড় মেয়েটার বিয়ে দু-দিন পরেই।অথচ সাধ মিটিয়ে কিছুই করতে পারছেন না। স্বামীর কথা এখন আর মনে করতে চান না আকলিমা খাতুন। অনেকে জামিনের জন্য আবেদন করতে বলেছিল। কিন্তু আকলিমা খাতুন করেননি।তথা তো তার মেয়েই। ইকবাল মিয়া মেয়ের গলায় ছুঁড়ি দিতে দ্বিধা করেনি। আজ লোভে পড়ে তথার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে,কাল দেখা যাবে রুবির গলায় ছুঁড়ি ধরবে। তারচেয়ে পাপের শাস্তি ভোগ করুক। শাস্তি শেষ হলে নাহয় নিজেই ফিরে আসবে।

_” তথা তোর কষ্ট হয় না?”

তথার চোখ লেগে এসেছিল। আকলিমা খাতুনের কথা শুনে চোখ খোলে। দুই হাতে মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে বলেঃ” হ্যা,তোমাদের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।আমি না থাকলে কিভাবে কি করবে তোমরা?”

_” বোকার মতো কথা কইছ না।আল্লাহ কারো লেগা কাউরে বসায়া রাখে না। আমি অন্য কারণে কইছি কথাডা। এই যে তোর বিয়াতে কোনো আয়োজন করতে পারতাছি না,ঘরোয়াভাবে বিয়া দিয়া দিতাছি, নাকের-কানের কোনো গয়না দিতে পারতাছি না–এইসব কারণে তোর খারাপ লাগে না?”

তথা কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকে আকলিমা খাতুনের দিকে।বিরক্ত গলায় প্রশ্ন করেঃ” আমাকে স্বার্থপর মনে হয় তোমার?”

_” তবুও প্রত্যেকটা মেয়েরই একেকটা স্বপ্ন থাকে।তোরও থাকতেই পারে।”

_” এসব ফালতু স্বপ্ন তোমার মেয়ের নেই।আমার সামর্থ্য কতটুকু তা আমি জানি।”

_” তোর ফুফুগোরে যে দাওয়াত দিলাম না,হেরা মন খারাপ করব না?”

_” আমাকে চেনে নাকি তারা? এই জীবনে একবার তাদের মুখ দেখেছি।শুধু শুধু দাওয়াত করে কি লাভ? রাগ করলে করুক।”

_” তবুও।”

_” তোমার টাকা আর শখ বেশি থাকলে করো তুমি।তাদের প্রতি ওতো ভালোবাসা আমার নেই। যারা আমার খোঁজ নেয়নি, তাদের প্রতি ভালোবাসার কোনো মানেই হয় না।”

রুবি ও মাহাদী পাশের ঘর থেকে দৌঁড়ে এলো।রুবির গায়ে হলুদ রঙের বাহারি জামা,মাহাদীর গায়ে সাদা পাঞ্জাবী।রুবির মুখ জ্বলজ্বল করছে।সে খাটের কাছে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে বলেঃ” তথা আপু,ভালো লাগছে না জামাটায়?”

তথা শোয়া থেকে উঠে বসে।রুবিকে উপর-নিচ ভালোভাবে দেখে বলেঃ” হ্যাঁ, ভালোই লাগছে। হলুদে পড়লে বেশ মানাবে তোকে।আজ কয়টা দোকান ঘুরে এই জামাটা এনেছি,জানিস? তোর এই একটা জামার জন্য পাঁচটা দোকান ঘুরতে হয়েছে।মাহাদী,তোর কি খবর? পাঞ্জাবী ঠিক হয়েছে?”

মাহাদী মুখ কালো করে এদিক-ওদিক মাথা দোলায়।কাঁদো কাঁদো মুখে বলেঃ” আরেক সাইজ বড় লাগতো।পেটের কাছে অনেক টাইট।”

_” আরেক সাইজ বড়! ভাই তুই ডায়েট কন্ট্রোল করবি কাল থেকে। এই বয়সেই পেট ফুলে একাকার।”

_” পাঞ্জাবীটা বদলাতে পারবে না?এটা কিছুতেই হলুদে পরব না আমি।”

_” আবার নিউমার্কেট যেতে হবে! ভালো লাগে না এসব।”

আকলিমা খাতুন ধমক দেন মাহাদীকে। কপাল কুঁচকে বলেনঃ” আর বদলান লাগব না।যেইটা আইনা দিসে,ওইটাই পরবি।”

মাহাদী মুখটাকে আরো কালো করে ফেলে।গম্ভীর গলায় বলেঃ” আচ্ছা এটাই পড়ব।”

এমন সময় দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়।আকলিমা খাতুন মাহাদীকে আদেশ দিলেন।

_” মাহাদী,দেখ তো কে আইলো।”

মাহাদীর মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিল।মায়ের আদেশ পেয়ে আরো খারাপ হয়ে যায়।সবাই ওকেই খাটায় শুধু।মাহাদী ধপধপ করে হেঁটে দরজার কাছে যায়। বিরক্তমুখে দরজা খুলতেই সোনাইকে চোখে পড়ে।দু-হাতে দুটো পলিথিন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।একটা ছোট পলিথিন, একটা বড় পলিথিন।

_” ভাবীরে ডাক দেও মাহাদী,ইরফান ভাই এগুলা পাঠাইছে।”

_” ইরফান ভাই! ”

_” হুম।”

মাহাদী গলা বাড়িয়ে তথাকে ডাকে।কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই তথা দরজার কাছে আসতে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দেয় সোনাই।

_” ভাবি,ভাই পাঠাইছে এগুলা। এই ছোট পলিথিন আপনার, বড়টা বাকিদের।”

তথা একটি অবাক হয়। গলায় বিস্ময়ের রেশ নিয়ে বলেঃ” বিরিয়ানি পাঠিয়েছে কেন তোমার ভাই? এগুলো লাগবে না সোনাই।নিয়ে যাও।”

সোনাই নাছোড়বান্দা। কিছুতেই ফিরে যাবে না।তথাদের ঘরের দরজায় জিনিসগুলো রেখে সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বলেঃ” আপনার প্যাকেটটা আলাদা খুলতে বলছে, ইরফান ভাই।আসি ভাবি।আসসালামু আলাইকুম।”

সোনাই দাঁড়ায় না আর।তথার কৌতুহল বেড়ে যায়।জিনিসপত্র ঘরে এনে দরজা আঁটকে দেয়।মাহাদীর হাতে বড় প্যাকেটটা দিয়ে বলেঃ” মাকে দে এগুলো।আমি আসছি একটু পরে।”

বরাদ্দ পলিথিনটা নিয়ে সোফায় বসে পড়ে তথা।পলিথিনে একটা বিরিয়ানির প্যাকেট দেখা যাচ্ছে।তথা মনে মনে রাগ করে খুব।এগুলো পাঠানোর মানে কি?
তবে বিরিয়ানির বাক্স খুলে প্রচন্ড অবাক হয় তথা।মাঝারি সাইজের বাক্সে একটা চিঠি ও একটা রঙিন ছবি। এই দুটো জিনিসের নিচে পুরো বাক্স ভরা বকুল ফুল।ফুলগুলো পুরো সতেজ।তথা চিঠির আগে ছবিতে চোখ বুলায়।তার অনেক আগের একটা ছবি।সাদা স্কুল ড্রেস পরে স্কুলে যাচ্ছে।তখন কেউ একজন লুকিয়ে ছবি তুলেছে হয়তো।তথা চিঠির ভাঁজ খোলে।গুটি গুটি অক্ষরে লেখা কিছু বাক্য।এক নিঃশ্বাসে সবটা পড়ে ফেলে তথা।

প্রিয় তথাবউ,

আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি। কবে থেকে জানো? সে যখন স্কুলে পড়তো, তখন থেকে।আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে প্রতিদিন টুকটুক করে হেঁটে যেত সে। আমি তখন ভার্সিটিতে পড়ি। নতুন ফোন কিনেছি।ক্যামেরা ভালো কি না তা দেখার জন্য বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তা-ঘাটের ছবি তুলছিলাম।তখনই এক ভয়ংকরী হেঁটে গেল আমার সামনে দিয়ে।মেয়েটাকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনতাম। প্রতিদিন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই স্কুলে যাওয়া-আসা করে।প্রথমে খুব বেশি একটা নজর দিলাম না।রাস্তার ছবি তুলতে তুলতেই মেয়েটাও ক্যামেরায় উঠে এলো। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম ছবিটা। কিভাবে যেন ভালো লেগে গেল।আমি একটানা অনেকক্ষণ দেখলাম মেয়েটাকে।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। অসুখটা তখনই আক্রমণ করলো।এরপর থেকেই ভয়াবহ এক অসুখ পেয়ে বসলো আমায়। লুকিয়ে-চুরিয়ে ওই ভয়ংকরীকে আমার দেখতেই হবে।যেভাবেই হোক দেখতেই হবে।সময় বাড়লো,অসুখ কমলো না।দিনদিন তা আরো বাড়তেই লাগলো।আগে শুধু বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দেখতাম,কয়েকদিনের মাঝে পিছু নেওয়া শুরু করলাম।সে যেখানে যায় আমিও সেখানে যাই।সে কোচিংয়ে যায়,আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি।সে স্কুলে যায়,আমি পিছু পিছু স্কুল পর্যন্ত যাই।সে বিকালে হাঁটতে যায়,আমিও তার পিছু পিছু হাঁটি।কি ভয়াবহ অসুখ দেখেছো? আমার অসুখ সাড়লো না,আমিও নিরাময় চাইনি।আমি ওই ভয়ংকর অসুখে মরে যেতে চেয়েছি।চোখ বন্ধ করে ডুব দিতে চেয়েছি ভয়ংকরীর মোহে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মোনাজাতে তাকেই চেয়েছি। বারবার সৃষ্টিকর্তার কাছে সেই ভয়ংকরীকেই চেয়েছি।কেঁদে কেঁদে চেয়েছি।আল্লাহ আমায় ফিরিয়ে দেননি।যা চেয়েছি তার দ্বিগুণ দিয়েছেন।সেই ভয়ংকরী আমার বউ হবে,গোটা তথাটাই আমার বউ হবে।এই বিশাল পৃথিবীতে আমি এখন সবচেয়ে সুখী। আমার প্রতিটা হাসিতে তৃপ্তি থাকে,সুখ থাকে। আমি অপেক্ষা করছি তথাবউ। তাড়াতাড়ি চলে এসো আমার কাছে। তোমাকে খুব থেকে দেখার তৃষ্ণা আমার বহুদিনের। ভালোবাসি তথাবউ।একটু-আধটু নয়, অনেকখানি ভালোবাসি।

ইতি

তোমার একান্ত অনুগত পুরুষ।

তথা চুপ করে বসে থাকে। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। পুরো ঘরে বকুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে।তথা মুখ ঢেকে ফেলে দু-হাতে।খুব লজ্জা লাগছে তার। পৃথিবী এতো সুন্দর কেন?

চলবে….
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here