ডাহুক নদীর তীরে পর্ব -৩০ ও শেষ পর্ব

#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-৩০)
#শেষপর্ব
#হালিমা রহমান

কাউন্সিলর সাজ্জাদ সাহেবের বাড়িতে মেহমানের অভাব নেই।এদিকে মানুষ,ওদিকে মানুষ।পাড়া-প্রতিবেশীও আছে অনেক।এদের খাতির-যত্ন করতে করতে খালেদা বানুর প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে।রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেছে।বউ এনেছেন সেই মাগরিবের পরে।এরপর মেয়েটা কাছে মাত্র একবার যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। কাজের চাপে ইরফানের ঘরে যাওয়ার সুযোগই মিললো না। খালেদা বানু রান্নাঘরে যেয়ে খাবার নেন। মেয়েটার নিশ্চয়ই ক্ষুধা পেয়েছে। বিয়ের দিন খাওয়া যায় নাকি?
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে পা রাখতেই ইরফানকে চোখে পড়ে।সোফার উপর পা মেলে সোজা হয়ে শুয়ে আছে।চোখ দুটো বন্ধ,পুরো চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। খালেদা বানু আস্তে-ধীরে ছেলের পাশে যেয়ে দাঁড়ান।খাবারের প্লেট টেবিলের উপর রেখে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।

_” ইরফান,ইরফান।”

ইরফানের হয়তো চোখ লেগে এসেছিলো। দু’বার ডাকতেই চোখ খোলে সে।চোখ দুটো লাল হয়ে আছে পুরো।সে একদিকে কাত হয়ে শুয়ে মাকে বসার সুযোগ করে দেয়।খালেদা বানু ছেলের পাশে বসে ছেলের মাথায় বিলি কেটে দেন।আদুরে ভঙ্গিতে বলেনঃ” ঘুম আইছে অনেক?”

_” হ্যাঁ, মা।কাল রাতে ঘুম হয়নি।”

_” খাইছো কিছু?”

_” হুম।মিষ্টি আর জুস খেয়েছি একটু আগে।”

_” ভাত খায়া ফালাও। তোমার ঘর খালি কইরা শোয়ার ব্যবস্থা করতাছি।”

ইরফান মায়ের কোলে মাথা তুলে দেয়।চোখ বন্ধ করে বলেঃ” আমার ঘরে অনেক মানুষ।সবাই বউ দেখছে।এতো তাড়াতাড়ি ঘর খালি করার দরকার নেই।আজকেই তো তোমার ঘরের বউ দেখবে সবাই।দেখুক।আমি এখানেই কিছুক্ষণ শুয়ে থাকি।”

_” তথার ভাইটা আইছিলো না তোমগো লগে,ওয় কই?”

_” রাফায়েতের সাথে ছাদে।”

_” খাইছেনি কিছু?”

_” নাস্তা খেয়েছে একটু আগে। ওকে একটু খাইয়ে শুইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে,মা।ছোট মানুষ,পরে কষ্ট হবে।”

খালেদা বানু ছেলের মাথায় পরম আদরে হাত বুলিয়ে দেয়।নরম গলায় বলেঃ” বউরে কিন্তু আজকে কিছু একটা দিতে হইব, আব্বা।তুমি কিছু কিনছো নাকি?”

_” নাকের একটা নথ দেব, মা।তোমাকে সেদিন যেই নথটা দেখালাম, ওটা আজকে দেব ভেবেছি।নথটা সুন্দর না? ”

খালেদা বানুর পছন্দ হয় না ছেলের কথা।মুখ বাকা করে বলেনঃ” সুন্দর কিন্তু খালি একটা নথ দিবা! ওই ছোট্ট নথটা! মানুষ চেন বা আঙটি দেয়।”

_” তোমার ছেলের হাত খালি এখন।স্বর্ণের দাম জানো? চেন বা আঙটি পরে দেব। তাছাড়া তোমরা তো দিয়েছ বিয়েতে।আমি এখন না দিলেও চলবে।”

খালেদা বানু এবারেও খুশি হন না।ছেলেকে তাচ্ছিল্য করে বলেনঃ” এতো কিপ্টা কবে থেকা হইলা বাপ? তোমার বাবার থেকা টাকা নিয়া বড় একটা কিছু কিনলেই পারতা।”

_” আমি এখন কামাই করি।বাবার টাকা আর আমার টাকায় এক জিনিস না। ধার করে বউকে গিফট দিতে হবে কেন? টাকা হলে আমি নিজেই ভালো কিছু কিনে দেব।আর নথটাও কিন্তু সুন্দর মা।তুমি শুধু শুধু রাগ করছো।”

খালেদা বানু কোল থেকে ছেলের মাথা নামিয়ে দেন।এই ছেলে কথা শোনার ছেলে নয়।একটা কথার বিপরীতে চৌদ্দটা কথা তৈরি করে রাখে।ছেলে-মেয়েরা বড় না হলেই ভালো হতো।ইরফান যদি ছোট হতো,তবে বেশ হতো।তৃপ্তি নিয়ে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারতেন তিনি।মায়ের কথার বাইরে কথা বলে।কত বড় সাহস!

খালেদা বানু থমথমে মুখে উঠে দাঁড়ান। হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে ইরফানকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ” সায়েমরে একটা বড় আঙটি পাঠাইতে বলছিলাম তথার জন্য। ওয় পাঠাইছে।ঘরে যাওয়ার আগে ওইটা নিয়া যাইবা। কিপ্টামি বাদ দাও,ইরফান। বউ মানুষ, কালকে ঘুম থেকা উইঠা সবাইরে এইডা দেখাইব।তহন কি কইব সবাই? ইমারে শফিকে বড় একজোড়া কানের দুল দিছে।মাইষেরে দেইখাও তো একটু কিছু শিখতে পারো।কিছু তো বুঝোই না, আবার মুখে মুখে তর্ক করো।ফাজিল।”

খাবারের প্লেট নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে চলে যান খালেদা বানু। মানুষটা যে রেগে আছে,তা বেশ বুঝতে পারে ইরফান।মায়ের গমনপথে চেয়ে মুচকি হাসে ইরফান। সে সত্যি ভাগ্যবান। আর যাই হোক অন্যান্য ঘরের মতো বউ-শ্বাশুড়ির যুদ্ধের সম্ভাবনা তার ঘরে নেই। বাঁচা গেল,ইরফান চোখ বন্ধ করে।সত্যি চোখদুটো খুব জ্বলছে তার,মাথাটাও ব্যাথা করছে। ঘরে যাওয়ার আগে এখানে কিছুক্ষণ না ঘুমালে মাথা ব্যাথায় হয়তো মরেই যাবে ইরফান।

***

_” বড় আপা,ভাবিরে ফোনটা দেও।আমি একটু সরাসরি তার সাথে কথা বলি।”

সায়েমের কথায় মাথা নাড়ে ইমা। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলেঃ” এখন না।তুই তো দু-দিন পরেই আসবি।তখন কথা বলিস।”

সায়েমের রাগ হয়।বিরক্ত ভঙ্গিতে বলেঃ” এগুলো কোনো কথা! ”

_” আরে ভাইয়ার ঘরে অনেক মানুষ।মেয়েটা এমনিতেই নার্ভাস।এখন যদি তোর সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে হয়,তবে আরো নার্ভাস হয়ে পড়বে।তুই ভাইয়ার ফোনে কল দিয়ে পরে কথা বলিস। আর বিয়ের ভিডিওগুলো দিয়েছিলাম তোকে।দেখেছিস?”

_” কিছুই দেখি নাই।ফোন রাখো তুমি।আমি দেশের বাইরে থাকি বলে সবকিছুতে ঠকে যাই। আর ফোনই দেব না তোমাদেরকে।দেশেও আসব না।”

খট করে লাইন কেটে দেয় সায়েম।ছেলেটা ভীষণ অভিমানী।মেয়েদের মতো কথায় কথায় গাল ফুলায়,দিনে হাজারবার রাগ করে।তাই ইমা খুব বেশি একটা পাত্তা দিলো না।রাত পেরোনোর আগেই সায়েম নিশ্চিত আবার ফোন দেবে। গলায় আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করবেঃ” এই বড় আপা,ভাবির জন্যও একটা কম্বল আনব? দেশে কি শীত পড়ছ অনেক?”

ইমা শাড়ির আঁচল দিয়ে কাঁধ ঢেকে পা চালায় ইরফানের ঘরে।ঘরে পাঁচ-ছয়জন মহিলা বসা।সবাই বউয়ের আশেপাশে বসে কথা বলছে,হাসাহাসি করছে।খাটের মাঝে তথা বসে আছে,তার একপাশে মা। তথার মুখটা ছোট্ট হয়ে আছে।ঘাড় নামিয়ে একদৃষ্টিতে চাদরের দিকে চেয়ে আছে। ইমা তথার কষ্ট বোঝে। বিয়ে নিশ্চয়ই আনন্দের অনুষ্ঠান। তবে আনন্দ শুধু অন্যদের জন্য।বিয়ের দিনের আনন্দ বউয়ের জন্য নয়। গায়ে এতো ভারী শাড়ি-গয়না জড়িয়ে পুতুল সেজে বসে থাকার কষ্ট কেবল ভুক্তভোগীরা জানে। ইমা যেয়ে তথার আরেকপাশে বসে পড়ে।কানের কাছে ফিসফিস করে প্রশ্ন করেঃ” ভাবি,কোনো সমস্যা?”

তথা এদিক-ওদিক মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।

_” ওয়াসরুমে যেতে হবে?”

_” জ্বি না,আপু।”

_” আচ্ছা,কোনো সমস্যা হলে বলবে কিন্তু।”

তথা এবার একটু মুখ খোলে। নিচু স্বরে বলেঃ” আপু, আমার ভাইটা এসেছিল।ওর সাথে একটু কথা বলতে পারলে ভাল হতো।বাড়িতে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমার ফোনটা ওর কাছে।”

ইমা মাহাদীকে চেনে না।তাই তথার আরেক পাশে বসে থাকা খালেদা বানুকে ডাক দেয়।

_” মা, ভাবির ভাইটা কই?”

_” ওয় বলে রাফায়তের লগে ছাদে গেছে। তুই একটু দেখতো মা। পোলাডারে ডাক দে।কিছু খায়া ঘুমায়া থাকুক।”

_” আচ্ছা।”

ইমা আবারো উঠে যায়।খালেদা বানু খাবারের প্লেট হাতে নেন।তথাকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ” ভাত খায়া নেও বউ।খাইতে পারবা নিজের হাতে?”

তথা উপর-নিচে মাথা দোলায়।মিনমিন করে বলেঃ” আরেকটু পরে খাই? ”

_” না আর পরে খাওয়া লাগব না। এই শাড়ি-টাড়ি পাল্টাও। লাগলে গোসল করো।একটা সুতির শাড়ি পরো, আরাম পাইবা।অস্থির লাগতাছে না তোমার?”

সত্যিই অস্থির লাগছে তথার। শাড়ি,গয়না,সাজ–সবকিছু মিলিয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা।এই পৌষের রাতেও ঘেমে-নেয়ে একাকার। খালেদা বানু ঘরের মেহমানদের কৌশলে বের করে দিলেন।ইরফানের বেডসাইড টেবিলে খাবারের প্লেট ঢেকে রেখে বললেনঃ” তুমি গোসল করবা?”

_” জ্বি,অস্থির লাগছে খুব।”

_” তাইলে নামো খাট থেকা।এই ভারী শাড়ি পাল্টাও।তোমারে দেইখা আমার নিজেরই গরম লাগতাছে।”

বহুক্ষণ পরে খাট থেকে নামে তথা।ঘরে খালেদা বানু ও সে।খালেদা বানু দরজা আটকে দেন।তথার কাছে এসে বলেনঃ” দেখি বসো,মাথার কাছে বড় একটা সেফটিপিন আছে।আমি খুইলা দেই।”

তথা আড়ষ্টভাবে খাটের কোনে বসে।খালেদা বানু সেফটিপিন খুলতে খুলতে বলেনঃ” শোনো বউ,কিছু কথা কই।এহনকার বেশিরভাগ ঘরে বউ-শ্বাশুড়ি খোঁচাখুঁচি করে। আমার কিন্তু এডি অনেক খারাপ লাগে।বউ এককালে আমিও আছিলাম,আজকে শ্বাশুড়ি।তেমনি তুমিও এহন বউ,কালকেই শ্বাশুড়ি হইবা।তুমি সংসার শিখবা কার থেকা? আমার থেকা নিশ্চয়ই।আমি তোমারে হাতে-কলমে শিখামু।কাজ শিখামু,রান্না-বাড়া সব শিখামু।না পারলে বকা দিমু,রাগ করমু,কথা কমু না।এহন দেখা যায় এসব তোমার সবসময় ভাল্লাগবো না।মাঝে মাঝে তুমিও রাগ করবা,ইরফানের কাছে আমার নামে বিচার দিবা।ইরফান আবার আমারে কইব তারপরেই লাগব ভেজাল।এমনেই কিন্তু সব ঘরে ভেজাল লাগে। আমি চাইতাছি আমগো ঘরে এমন না হোক।আমার কথা-বার্তা যদি তোমার ভালো না লাগে তাইলে তুমি চুপ কইরা থাইকো।আমার লগে তর্ক কইরো না। আমিও অনেক সময় ভুল করমু,তুমি তহন ধীরে-সুস্থে আমার ভুল ধরায়া দিয়ো। আমি যেই কাজ করতে যামু,ওই কাজেই তোমারে সাথে রাখমু। সামনে দাঁড়ায়া তোমারে শিখামু।তুমি কিন্তু রাগ করতে পারবা না।পড়ালেখাও মন দিয়া করতে হইব,সংসারও মন দিয়া করতে হইব।বুঝছো মা?”

_” জ্বি।”

_” বুঝলেই ভালো। একটা কথা মনে রাইখো তথা, সাজানো -গোছানো সংসারে পা দেওয়ার চাইতে এলোমেলো সংসার গোছায়া নেওয়া সহজ। আমি যহন তোমার শ্বশুড়ের ঘর করছি, তহন এতো বিলাসিতা কিন্তু আছিলো না।তিলে তিলে সব সাজাইছি আমি। তোমার শ্বশুড় বাইরে করছে,আমি ঘরে করছি।কষ্ট হইলেও আমি সহজেই নিজের মতো সংসার সাজাইতে পারছি। আজকে থেকা তুমিও এই ঘরের মাইয়া। যতটা কষ্ট আমার হইছে তারচেয়ে বেশি কষ্ট এহন তোমার হইব।সাজানো-গোছানো সংসারে আসছো তুমি।এইখানে এখনো তোমার মনমতো কিছুই নাই। যা আছে সব আমার মনমতো সাজানো। এই সংসারেই নিজেরে খাপ-খাওয়াইতে হইব। কখনো কখনো কষ্ট হইব,রাগ হইব,আবার কখনো অনেক ভালো লাগব।সব অবস্থাতেই নিজের সাথে জড়ায়া নিতে হইব সবকিছু।বুঝছো?”

এবারেও মাথা নাড়ে তথা।খালেদা বানু মুচকি হেসে তথার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।গলায় একরাশ স্নেহ ঢেলে বলেনঃ” আমি আল্লাহর কাছে সবসময় ঘর ভরা ছেলে চাইতাম,মেয়ে চাইতাম না।ক্যান জানো?”

_” কেন?”

_” মাইয়া বড় হইলে তো পরের ঘরে দিতে হইব।আমার ইমা যেদিন শ্বশুড়বাড়ি গেছে,সেদিন মনে হইছে আমার কলিজাটা কেউ ছুঁড়ি দিয়া কাইটা নিয়া গেছে। কত রাইত ইমার ঘরের বালিশ বুকে জড়ায়া কানছি! যেদিন মা হইবা,সেদিন বুঝবা মাইয়া বিয়া দিলে মাগো কেমন যন্ত্রণা হয়।আর পোলা হইলে তো এই যন্ত্রণা নাই।একটা পোলা বিয়া দিলে একটা বউ ঘরে আইব,আমার একটা মাইয়া আইব। এই যে দেখ,তুমি এহন আমার মাইয়া।তুমি আমারে আম্মা ডাকবা,তোমার শ্বশুড়রে আব্বা ডাকবা। ইমার মতো তুমিও আমার মাইয়া। এর লেগাই আমি সবসময় পোলা চাইতাম।যাতে আমার মাইয়ারা আমার ঘরেই থাকে। আমার শেষ বয়স পর্যন্ত তারা আমার পাশেই থাকে।”

তথার প্রাণ জুড়িয়ে যায়।শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি-শ্বশুড়বাড়ি এসব নিয়ে খুব ভয়ে ছিল তথা।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অকারণেই ভয় পেয়েছে।এই মানুষটা ঠিক মায়ের মতো। মায়েদের মতোই স্নেহময় তার কথা-বার্তা,আচার-আচরণ। কয়েক সেকেন্ডের মতো আপন মনে ভাবে তথা।এই বাড়ির মানুষগুলো এতো ভালো কেন?

***

রাত সাড়ে দশটা বাজে।গোসল সাড়তে প্রায় পৌনে একঘন্টা সময় লেগেছে।এতোক্ষণে শান্তি লাগছে তথার কাছে।কানে ধরেছে সে।আর জীবনেও পার্লারে সাজতে যাবে না। মুখের উপর কয়েকটা স্তর তৈরি হয়ে যায় পার্লারে সাজলে।তথা এতোবার মেকাপ কম করতে বললো,কিন্তু মেয়েটা শুনলোই না।পেঁচিয়ে-পুঁচিয়ে চুলগুলোকে অদ্ভূতভাবে খোঁপা করে দিয়েছে।এই খোঁপা খুলতে যেয়ে একগাদা চুল ছিঁড়েছে। এমনিতেই দিনদিন চুল সব পড়ে যাচ্ছে।নিজে ঘরে সাজলেই ভালো হতো।তথা তোয়ালেতে চুল মুছতে মুছতে সারা ঘরে পায়চারী করে।নিজেকে নতুন বউ মনেই হচ্ছে না। সবাই যেমন আচরণ করছে,মনে হচ্ছে তথা অনেক আগে থেকেই এ বাড়ির সদস্য। তথা ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একবার খাটের দিকে তাকায়।খুব সাধারণভাবে রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে সাজানো খাটটা। ইরফানের নাকি লাল গোলাপ পছন্দ নয়।একারণেই পুরো খাটে ফুল ছড়ানো নেই।শুধ চারপাশে কয়েকটা রজনীগন্ধা।অবশ্য খারাপ লাগছে না দেখতে। তাছাড়া তথাও খুব বেশি একটা ফুল পছন্দ করে না।তথা আয়নায় নিজের দিকে একবার নজর বুলায়। লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে মন্দ লাগছে না।বেশ ভালোই দেখাচ্ছে। ঘরে আর কেউ নেই। তথা অবাক না হয়ে পারে না।অনেক বাড়িতেই বিয়ের প্রথমদিনে অনেক নিয়ম-কানুন পালন করতে দেখেছে ও।কিন্তু ওর বেলায় এসব কিছুই নেই।বিষয়টা অবশ্য স্বস্তি দেয় ওকে।অনাড়ম্বরতা ভীষণ পছন্দ মেয়েটার।
তথা এনার্জি লাইট বন্ধ করে ডিম লাইট জ্বালায়।গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় জানলার কাছে।বারান্দা দিয়ে বাতাস আসে বলে বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল ইমা।তথা আর দরজা খুললো না।জানলা দিয়ে রাস্তার আলো আসে। তথা জানলার গ্রিলে মাথা ঠেকায়। শীতের রাতে ঘন কুয়াশা পড়েছে চারদিকে।ল্যাম্পপোস্টের নিচে ঘন কুয়াশা।তথা এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে বাইরের দিকে।কোথা থেকে যেন মৃদু হাসনাহেনার ঘ্রাণ আসছে নাকে।তথা চোখ বুজে রাতের নিস্তব্ধতা অনুভব করে। সারাদিনের ঝামেলা শেষে দম ফেলার সুযোগ পেয়ে বেশ আনন্দ অনুভব হয় তথার।” ইরফান আরেকটু পরে আসুক”– মনে মনে এই কামনা করে তথা।

***

ঘরের দরজা খুলেই এতো সুন্দর একটা দৃশ্য চোখে পড়বে তা মোটেও কল্পনা করেনি ইরফান। সে ভেবেছিল তথা হয়তো মাথায় আধ-হাত ঘোমটা টেনে লজ্জাবতী লতার মতো মাথা নুইয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে।কিন্তু না,এখানের চিত্র পুরোই ভিন্ন।তার প্রাণপ্রিয় রমনীটি জানলার গ্রিলে হেলান দিয়ে রাতের প্রকৃতি অনুভব করছে।ডিম লাইটের আলোতে সাদা শাড়ি গায়ে জড়ানো তথার অস্তিত্ব যেন অপার্থিব কোনো দৃশ্যের অবতারণা। মনে হচ্ছে প্রাচীন যুগের কোনো এক রাজকন্যা চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছে। ইরফানের খুব ভাল লাগে।সে আস্তে করে ঘরে ঢুকে নিঃশব্দে দরজা আটকে দেয়। শব্দহীন পায়ে তথার পিছনে দাঁড়ায়। বলিষ্ঠ হাতদুটো দিয়ে তথার কাঁধ আকড়ে ধরে।ফিসফিসিয়ে বলেঃ” আসসালামু আলাইকুম, তথাবউ।”

তথার ধ্যান ভাঙে।পিছন ফিরে ইরফানের দিকে তাকায়। নরম গলায় বলেঃ” ওয়া আলাইকুম আসসালাম। কিন্তু সালামটা আমার দেওয়ার কথা ছিল।”

_” আমিই নাহয় আগে দিলাম। ক্ষতি কী?”

তথার ছোট চুলগুলো কপাল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ইরফান আস্তে আস্তে তা গুছিয়ে দেয়।

_” গোসল করেছো?”

_” হুম।অস্থির লাগছিলো।”

_” ঠান্ডা লাগবে না? ”

_” না,গরম পানি দিয়ে করেছি। মাহাদী ঘুমিয়েছে?”

_” হুম।রাফায়েতের সাথে শুইয়ে দিয়ে এসেছি।রুবিকেও নিয়ে আসলে পারতে।”

_ ” না, মা একা হয়ে যায় তাহলে।কান্নাকাটি করছে এখনো।রুবি সঙ্গ দিচ্ছে।”

_” ওহ।”

_” আচ্ছা, আমার একটু লজ্জা পাওয়া উচিত তাই না ইরফান?”

ইরফান হাসে। ঠোঁট উল্টে বলেঃ” কি জানি! ”

_” না,সত্যিই উচিত। কিন্তু আমার একটুও লজ্জা করছে না। এতোদিন আপনাকে দেখলেই কেমন যেন লজ্জা লাগতো,পুরো গা গুটিয়ে আসতো।কিন্তু এখন এসব কিছুই হচ্ছে না।আমি কি লজ্জা পাওয়ার অভিনয় করব?”

_” করো। অভিনেত্রী বউ বিয়ে করেছি, একটু-আধটু অভিনয় তো সইতেই হবে।”

ইরফানের বুকে মৃদু চাপড় দেয় তথা। নাক-মুখ কুঁচকে বলেঃ” আমি মোটেও অভিনেত্রী নই।”

_” আর কখনো অভিনয় করবে না?”

_” উঁহু, সাধ মিটে গেছে একদম।তাছাড়া অভিনয়ের সাথে আরো অনেক কিছু জড়িয়ে থাকে। ফিট থাকতে হয়,ফ্যাশন সচেতন হতে হয়,ভালো অভিনয় করতে হলে অভিনয় শিখতে হয়।এসব আমার দ্বারা হবে না। নায়িকাদের মতো ওই কাট-কাট ভাব-ভঙ্গি আমার আসে না।পঞ্চগড় যাওয়ার আগে এসব তলিয়ে দেখিনি।দেখলেই বুঝতাম,অভিনয়কে বড়জোর আমি শখ হিসেবে দেখতে পারি ;পেশা হিসেবে নয়।”

ইরফান যেন বেঁচে গেল। প্রফুল্ল মনে একবার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে।

_” শ্বশুড় আব্বু বিয়েতে রাজি হলো কি করে? আমি যতদূর জানতাম তিনি আমাকে পছন্দ করেন না।”

_” কে বলেছে পছন্দ করে না? বাবা তোমাকে আগে থেকেই পছন্দ করতো।পঞ্চগড় না গেলে হয়তো বছরের মাঝামাঝিতেই বিয়ে হতো আমাদের।পরে তোমার পেশাটার জন্য একটু দ্বিমত করেছিল।কিন্তু পরে আমি সব খুলে বলেছি।এরপর আর কোনো আপত্তি ছিল না।”

_” ওহ।”

ইরফান মোহাবিষ্টের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে অর্ধাঙ্গিনীর মুখের দিকে।এই মুখটা তার ভীষণ প্রিয়।তথার চোখ-নাক-গাল সব যেন মেপে মেপে দেখে ইরফান।তথাও কিছু বলে না।ইরফানের হাতের মাঝে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

_” তথা ”

_” হুম।”

_” তোমার কেমন স্বামী পছন্দ?”

_” কেমন বলতে?”

_” মানে ধরো,কি কি গুণ থাকা উচিত। ”

তথা কিছুক্ষণ ভাবে।বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর বলেঃ” আমি যখন ইন্টারে পড়তাম, তখন এসব বিষয়ে খুব ইন্টারেস্টেড ছিলাম। সেই সময় একবার ভেবেছিলাম,যে ছেলে শোয়ার সময় মশারি টাঙিয়ে দেবে,ভাত খাওয়ার পর আমার প্লেট ধুয়ে দেবে আর গোসলের পর আমার ধোয়া জামা-কাপড় ছাদে নিয়ে শুকাতে দেবে,তাকেই বিয়ে করব।এই তিনটা কাজ করতে আমার খুব বিরক্ত লাগে।”

_” আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।আপনার স্বামীর এই একটা গুণও নেই।আমার ঘরে মশারি নেই,ভাত খাওয়ার পর প্লেট মা ধুয়ে দেয় আর জামা-কাপড় বুয়া ধুয়ে ছাদে শুকাতে দেয়। এসব বিষয়ে নজর দেওয়ার মতো সময় কোথায় আমার?”

_” ইশ,কি অপদার্থ! লজ্জা করে না? ”

_” লজ্জা! সেটা আবার কি জিনিস?”

তথা হাসে।ইরফানের দিকে অপলক চেয়ে বলেঃ” এখন আর ওতো গুণে গুণান্বিত স্বামী চাই না।এখন শুধু একটা জিনিসই চাই।”

_” কি?”

_” এখন একটা ইরফান চাই শুধু।”

ইরফান খুব খুশি হয়।টুপ করে তথার কপালের মাঝে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।

_” ইরফান ”

_” হুম।”

_” শেরওয়ানি পাল্টে ফেলুন।”

_” পরে। মুহূর্তটা উপভোগ করতে দাও।”

_” আপনি আসার আগে অনেকক্ষণ আমি জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম।অবশ্য আমি একা ছিলাম না।আমার সাথে আরেকজন মানুষ ছিল।”

ইরফানের কপাল কুঁচকে যায়। আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” আর কে ছিল? কারো তো থাকার কথা নয়।”

তথা দু’ পা সামনে আসে।ইরফানের একদম কাছাকাছি এসে নেতিয়ে যায় ইরফানের বুকে। ভীত গলায় বলেঃ” আহমেদ ইউসুফ ছিল।আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন,ঠিক এখানেই ছিল।একদম আমার পিছনে। আমি একদম অসারের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম।হাত-পা নাড়তে পারিনি।নাহয় দৌড়ে বাইরে চলে যেতাম।আমি ওকে সত্যিই দেখতে পাই ইরফান,ওর কথা শুনতে পাই।”

ইরফান দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তথাকে।মেয়েটার হাতগুলো পুরো ঠান্ডা হয়ে আছে।তথাও বাধ্য মেয়ের মতো স্বামীর বুকে মাথা গুঁজে দেয়।ইরফান আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলেঃ” ইউসুফ মরে গেছে।ও বাস্তবে নেই। যা হচ্ছে পুরোটাই তোমার হ্যালুসিনেশ ,এছাড়া আর কিছুই না।”

_” না,এটা হ্যালুসিনেশন না।আমি বলছি ওকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই,ও আমার সাথে কথা বলে।একটু আগে কি বললো, জানেন?”

ইরফান তথার কথার পাশ কেটে যায়। তথাকে জড়িয়ে ধরে বলেঃ” চলো মুভি দেখি।দেখবে? আমি খুব মুভি পছন্দ করি।একসাথে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে যাব।খুব ভাল বুদ্ধি,তাই না?”

তথা খুব বিরক্ত হয়।ইরফানের হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।কপাল কুঁচকে বলেঃ” আপনি আমার কথা শুনতে চাইছেন না কেন,বলুন তো? আমার কথা কি বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনি কি হাসনাহেনার ঘ্রাণ পাচ্ছেন? আমি পাচ্ছি।যখন থেকে এখানে দাঁড়িয়েছি, তখন থেকে পাচ্ছি।ইউসুফ আমার কাছে আসলেই আমি বিভিন্ন ঘ্রাণ পাই।”

ইরফান হতাশ চোখে তাকায়। ভেবেছিল ওসব কথার সাথে তাল না মিলালে তথা হয়তো আর ইউসুফের কথা বলবে না।কিন্তু না,তা হলো না।তথা ওই এক জিনিসেই আঁটকে আছে।ইরফান তথার দিকে চেয়ে বলেঃ” ওসব তোমার মনের ভুল। হাসনাহেনা গাছ বারান্দায় আছে।প্রতি রাতেই ফুলের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।তুমি দেখবে? চলো বারান্দার গাছটা দেখে আসি। ”

_” না,ওদিকে যাব না।একটু আগে ইউসুফ বলল,আমি নাকি কখনো সুখী হব না,কখনো ভালো থাকব না।”

ইরফানের খারাপ লাগে। এতোক্ষণের তথা আর এই তথাকে মেলাতে পারে না।শীতের রাতেও ঘাম দেয় ইরফানের শরীরে।তথা এমনভাবে বলছে,মনে হচ্ছে ইউসুফ এখনো এখানে আছে।ইরফান লাইট জ্বালাতে যায়।নীলচে আলোয় হয়তো তথার সমস্যা বেশি হচ্ছে।তবে যেতে পারে না।পিছন থেকে ইরফানের হাত টেনে ধরে তথা।ভীত কন্ঠে বলেঃ” ওখানে কোথায় যাচ্ছেন? ইউসুফ আপনার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।”

ইরফানের শরীর শিরশির করে।আচমকা তথাকে নিজের কাছে টেনে আনে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তথার আধ-ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে আস্তে আস্তে বলেঃ” কিছু হবে না।কেউ নেই ওখানে। আমি আছি তো।আমরা ভালো আছি আর ভালো থাকব।চল ঘুমিয়ে পড়ি।”

তথা শান্ত ভঙ্গিতে লেপ্টে থাকে ইরফানের বুকে।তবে সে অনুভব করতে পারছে কেউ একজন তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে অভিমানী গলায় বলছেঃ” কেন প্রতারণা করলেন, কামিনী ফুল? আপনি কখনো ভালো থাকবেন না,আপনি কখনো ভালো থাকবেন না।”

তথা ভয়ে গুটিয়ে যায়। ভয়ে ইরফানের বুকে মাথা গুঁজে দেয়।বিরবির করে বলেঃ” আমি ভালো আছি,খুব ভালো আছি।ইরফানের সাথে খুব ভালো থাকব আমি।”

ইরফান পরম যত্নে বউয়ের মাথায় বিলি কেটে দেয়,আস্তে আস্তে চুল টেনে দেয়।বেশ আরাম পায় তথা।সারাদিনের ক্লান্তি শেষে চোখ বন্ধ হয়ে আসে।তবে চোখ বন্ধ করেও শান্তি পায় না মেয়েটা।চোখের উপর ভাসে একজোড়া সবুজ চোখ,পানিতে টইটম্বুর একজোড়া অদ্ভূত চোখ।

(সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here