#প্রেমনগর
পর্বঃ৮
লেখাঃনীলাদ্রিকা নীলা
.
মেঘ ঘুমিয়ে যাবার পর পরই নীলা দড়ি দিয়ে মেঘের হাত পা বেডের সাথে বেঁধে ফেললো। তারপর রুমের ভিতর একা একাই হাসতে হাসতে শোফায় গিয়ে বসলো। নীলার মা রুমে ঢোকার সাথেই আঁতকে উঠলেন, একি ওকে এভাবে বেধেছিস কেন?
নীলাঃ ও হচ্ছে আসামি! তাই বেধেছি। তুমি এখন এখান থেকে যাওতো মামনি।
নীলার মাঃ আসামি তোর ঘরে রাখছিস কেন! অন্য ঘরে রেখে আয়! কাল সকালে পুলিশে দিলেই হবে।
নীলাঃ তুমি যাও তো মামনি!
.
নীলার মা রুম থেকে চলে গেলে নীলা আবারও হাসতে শুরু করে। বিছানায় চিৎ হয়ে শোয়া ঘুমন্ত মেঘের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি দিতে দিতে বলেছে , তুমি এবার ধরা খেয়ে গেছো মেঘ, আটকা পরে গেছো। সকাল বেলা চোখ খুলে যখন তাকাবে তখন এই নীলা ছাড়া আর কিছুই বুঝবে না তুমি। কারণ এই পানিপড়ার পাওয়ার আগেরটার চেয়েও বেশি। চোখ খোলার সাথে তুমি অন্য এক দুনিয়া দেখবে! সেখানে শুধু নীলা আর নীলা! হিহিহি…..
.
পুরোনো জিপের ইঞ্জিনের শব্দে ড্রাইভাররের মাথা ঘুরছে। রৌদ্র কানে ইয়ার ফোন গুজে দিয়ে আছে। জিপটা ঝাকুনি দিয়ে চলায় সেই ইয়ার ফোনটাও বার বার কান থেকে পরে যাচ্ছে। জিপের ব্রেকটাও ঠিকমতো হচ্ছে না। একবার এদিক তো আরেকবার ওদিক। এভাবে একেঁবেঁকে সাপের মতো চলছে। রিরক্তিতে আকাশও মুখটা এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে। অতিরিক্ত ঝাকুনিতে অহনা একদম গভীর নিদ্রায় চলে গেছে।
আকাশ একবার অহনার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো, এর মধ্যেও মানুষ ঘুমায় ক্যামনে!
.
হঠাৎ জিপটা অতিরিক্ত পরিমাণে শব্দ করতে করতে বিকট শব্দ হয়ে থেমে গেলো।
রৌদ্রঃ ভাইয়া এটাতে করে বোধহয় আর যাওয়া যাবে না।
আকাশঃ নে আরও ওট! আমি গাড়ি নিয়ে আসতে বলেছি। গাড়ি আসছে। নমো সবাই।
.
অহনাকে জিপ থেকে নামার জন্য কয়েকবার ডাকা হলেও অহনা শুনলো না। অহনা মরার মতো ঘুমাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আকাশ অহনাকে কোলে তুলে নিয়ে হাটা শুরু করলো।
রৌদ্র পিছনে ফিরে এই দৃশ্য দেখে বলে উঠলো, হোয়াট এ রোমান্টিক সিন!
আকাশ চোখ গরম করে দাঁত কড়মড় করে রৌদ্রের দিকে তাকাতেই রৌদ্র আবারও হাটতে শুরু করলো। কিছুটা সামনে এগোতেই গাড়ি চলে এলো। অহনা এখনো ঘুমাচ্ছে। গাড়িতে বসে আকাশ অহনার মাথাটা আলতো করে নিজের কাধে রাখলো। মেয়েটা একদম ছোট বাচ্চাদের মতো করে ঘুমাচ্ছে। আকাশ অহনার কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে দেয়।
.
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নীলা আয়নায় নিজেকে দেখছে আর একা একাই আয়নার ভিতরে থাকা নিজের প্রতিচ্ছটাকে বলছে, কি! কি দেখছো! এখন মেঘ তোমার তাইনা! তুমি জিতে গেছো। আর কিছুক্ষণ পরেই তো মেঘ তোমাকে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে পাগল করে দেবে।
নীলা এবার লাজুক ভঙ্গিতে মুচকি হাসতে হাসতে দুই হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেললো কিন্তু তারপরেক্ষনেই আবার হাতটা সরিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো, কি! লজ্জা পাচ্ছো কেন!
.
নীলা ঠোঁটে লিপস্টিক আর চোখে আইলারনার দিয়ে সাজতে শুরু করে। সাজতে সাজতেই আয়নার দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপ মারলো আর লিপস্টিক দেওয়া ঠোঁটটা কিস দেওয়ার স্টাইলের মতো করে রয়েছে।
তখনই মেঘ চোখ খুললো। হাত পা নড়াতেই টান টান অনুভব করতেই দেখলো তাকে দড়ি দিয়ে বেধে রাখা হয়েছে। মেঘের মাথা ঘুরছে। মাথাটা কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে। মাতালের মতো লাগছে । পাশে তাকাতেই নীলাকে দেখে বলে উঠলো, নীলা!
মেঘের কথায় নীলা চমকে উঠে এদিকে ফিরলো তারপর এগিয়ে আসতে আসতে বললো, ও মাই জান তুমি উঠে গেছো!
মেঘ রুমের চারিদিক তাকাতে তাকাতে বলে ওঠে, আমি কোথায়? আমার কি হয়েছে, আমার হাত পা বাঁধা কেন?
.
নীলা মেঘের মাথার কাছে এসে বসলো। মেঘের চুলে আলতো ভাবে হাত রাখতে রাখতে বললো, তুমি তো আমার ঘরেই আছো জান।
মেঘ শুয়ে থেকেই চোখ উপরে তুলে নীলার দিকে তাকায়। মেঘের তাকিয়ে থাকা দেখে নীলার বুকের ভিতরটা দুরুদুরু করছে।
মেঘঃ কিন্তু আমাকে এভাবে বেধে রেখেছিস কেন?
নীলাঃ আমি এখনি বাধন খুলে দেব তার আগে তো কিছু বল! আমি যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না! আমার এখনি জানতে হবে।
মেঘ এবার একটু রেগে যায়, মানে? কি নাটক শুরু করেছিস! খুলে দে এগুলো!!
নীলাঃ তুই আমায় ধমক দিয়ে কথা বলছিস!
মেঘঃ তো?
নীলাঃ এমন তো হবার কথা ছিল না।
মেঘঃ তাহলে কেমন হবার কথা ছিল। তাড়াতাড়ি এগুলো খুলে দে বলছি!
নীলা এবার মেঘের মুখের কাছে নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে আসে৷ তারপর ভ্রু কুচকে মেঘের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, তুই আমায় ভালোবাসিস না??
মেঘও ভ্রু কুচকে রেগে নীলার দিকে তাকিয়ে আছে।
মেঘঃ না বাসি না!
নীলা এবার চট করে দাঁড়িয়ে গেলো, ভালো বাসিস না মানে!
মেঘঃ ভালোবাসি না মানে বাসি না। না বাসলে জোর করে বাসাবি নাকি। এখন খুলে দে এগুলো! আমার অসহ্য লাগছে।
.
নীলা মাথায় এবার বাজ পরতে শুরু করে। পানি পড়া খাওয়ার পরেও কেন মেঘ এরকম কথা বলছে। এতোক্ষণে তো মেঘের নীলার প্রেমে পরে হাবুডুবু খাওয়ার কথা। কবিরাজ তো এমনটাই বলেছিলো। পানি পড়া খাওয়ার কয়েক ঘন্টা পরেই নাকি এটি কাজ করতে শুরু করবে৷ নীলা আবার মেঘের দিকে তাকালো। এগিয়ে এসে মেঘের পাশে বসতে বসতে মেঘের গায়ে হাত দিতে দিতে বললো, তুই আমার সাথে মজা করছিস তাই না। এখন সত্যিটা বল, নীলা আই লাভ উ!
মেঘ রেগে বললো, নাটক তো তুই করছিস! তাও আমার এই রাতের বেলা। খুলে দে এগুলো আমি বাড়ি যাব।
নীলা আবারও ভ্রু কুচকে মেঘের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, মেঘ তুই আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস না?
মেঘঃ হাবুডুবু তো দূরের কথা আমার রীতিমত অসহ্য লাগছে। খুলে দে এগুলো।
.
রাগে নীলা আবারও দাঁড়িয়ে গিয়ে টেবিলে থাকা কাচের গ্লাসটা হাতে নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে দিলো। তাহলে কি কবিরাজের দেওয়া পানি পড়া কোনো কাজই করে নি? মেঘ তো পুরো পানি টুকুই খেয়ে নিয়েছিলো। তারপরও কেন মেঘের কোনো পরিবর্তন হলো না? কপাল ভাজ করে নীলা ভাবতে ভাবতে শোফায় বসে পরলো।
.
গ্লাস ভাঙার শব্দ শুনেই নীলাদের বাসার একজন একজন সিকুরিটি গার্ড দৌড়ে এই রুমের ভিতর চলে এসেছে। তাকে দেখার সাথেই যেন মেঘ কলিজায় পানি পেলো, ভাই আমার বাধন গুলো খুলে দেন। আমাকে বাঁচান!
সিকুরিটি গার্ডটা মেঘের বাধন খুলে দেওয়ার জন্য এগিয়ে যেতেই ভাঙা কাঁচের টুকরোতে পা দিলো। অতিরিক্ত কৌতুহলবসত মেঘকে দেখতে ব্যস্ত থাকার কারণে সে নিচের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করে নি৷ আর নীলার রুমে আসতে গেলে তাদের সবার জুতা খুলে খালি পায়ে আসতে হয়। কাঁচের টুকরোয় পা দেওয়ায় সাথে সাথে পা কেটে রক্ত বেড়িয়ে গেল।
তখনই নীলা বলে ওঠে, খবরদার ওকে কেউ খুলে দেবে না! এখন যাও এখান থেকে।
সিকুরিটি গার্ডটা পা কেটে আহত হয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেটে নীলার রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
.
ওর বেড়িয়ে যাওয়া দেখে মেঘ হতাশ হয়ে যায়। নীলা রাগ চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে৷ মেঘ রুমে থাকা দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো। সময় রাত ১ টা বেজে ৫ মিনিট। মেঘের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
মেঘঃ আমায় একটু পানি দিবি?
নীলা রেগে চেচিয়ে বললো, তোকে এক ফোঁটাও পানি দেব না আমি!
মেঘঃ তাহলে আমাকে খুলে দে। আমি বাড়ি যাব।
রাগে নীলা এগিয়ে এসে মেঘের শার্টের বোতাম খুলে দিচ্ছে। জোরে টানাটানি করতে করতে শার্ট কিছুটা ছিড়েও গেল।
মেঘঃ আরে আরে এ্যাই কি করছিস কি! ছাড়!
নীলাঃ আমার যা ইচ্ছে তাই করবো! খুলে দিতে বলেছিস, নে খুলে দিয়েছি।
.
নীলা আবার শোফায় গিয়ে বসলো আর তারপর মেঘকে দেখিয়ে দেখিয়ে গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেলো। তবুও মেঘকে এক ফোঁটা পানিও দিলো না৷ ঘুমে মেঘের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। মেঘ চোখ বুঝলো।
.
আকাশ,অহনা ও রৌদ্র মাঝরাতে প্রেমনগরের চৌধুরী মহলে ফিরেছে। ওদের ফেরার চিন্তায় বাড়ির কেউই এখনো ঘুমাতে পারে নি। সবাই ড্রইংরুমে বসে গল্প করতে করতে অপেক্ষা করছিলো। আকাশ অহনাকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকে। অহনা এখনো ঘুমাচ্ছে। অহনাকে আকাশের কোলে দেখে সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। রৌদ্র তার ঘরে চলে যায়।
মনিরা বেগমঃ তোরা এতো দেড়ি করলি কেন? আর বৌমার কি হয়েছে!
আকাশ কিছু না বলে অহনাকে নিয়ে ঘরে চলে গেল। সবাই ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকিয়ে থেকে মনে কৌতুহল নিয়েই যে যার ঘরে চলে যায়৷
.
অহনাকে বিছানায় শোয়ানোর সাথেই অহনা
আকাশকে জড়িয়ে ধরলো। ঝাকুনিতে আকাশের শরীরও ক্লান্ত হয়ে গেছে। আকাশ অহনার গায়ের ওপর পরে থাকা অবস্থাতেই চোখ বন্ধ করলো।
.
সময় রাত সাড়ে তিনটা। ঘুমে নীলার চোখও বন্ধ হয়ে এসেছিলো। হঠাৎ বাথরুম পেয়ে গেল। রুমের লাইটটা জ্বালানোই রয়েছে। নীলা শোফা থেকে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। তখন মেঘকে দেখিয়ে দেখিয়ে বেশি পানি খাওয়ার কারণেই বাথরুমটা বেশি পরিমাণে পেয়ে গেছে। বাথরুম সেড়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে টাওয়েলটা হাতে নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। আর বিছানার দিকে তাকাতেই চেচিয়ে ওঠে, মেঘ!!
.
বিছানার ওপর দড়ি গুলো পরে রয়েছে। ঘরের জানালা খোলা। জানালার পাল্লা দুটো বাতাসে একটার সাথে আরেকটা বারি খাচ্ছে। মেঘ পালিয়েছে।
রাগে নীলা ওয়াশরুম থেকে বালতি ভর্তি পানি নিয়ে এসে রুমের ভিতর পানি ঢালতে থাকে।
নীলাঃ নে নে। নে পানি!
বাহিরেরও এই সময় বৃষ্টির পানিতে গাছপালা, রাস্তাঘাট ভিজে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কোথাও জোরে জোরে বজ্রপাতও হচ্ছে।
.
চলবে….