প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব -০৫

#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(০৫)
লাবিবা ওয়াহিদ

নীল আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন। প্রকৃতি যেন আজ বড়ই ক্ষুব্ধ। দমকা হাওয়ায় পথঘাটের ধুলো উড়ে চারপাশ অস্পষ্ট করে তুলেছে। কিছুক্ষণ বাদেই হয়তো আকাশটা কান্নায় ভেঙ্গে পরবে। মেঘ ডাকছে মিনিটখানেক পরপর। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে অনবরত চোখ কচলাচ্ছে আফনা। কাঁধে তার ব্যাগ, বোঝাই যাচ্ছে বাসায় ফিরছে। চোখের মধ্যে ধুমধাম গতিতে বালি ঢুকেছে। বাসট্যান্ডে এসে দাঁড়াতেই যে এমন ঝড় উঠবে কে জানতো? এদিকে কোনো বাস বা গাড়ির দেখা নেই। যেই পরিমাণে ধুলো উড়ছে, দিনের বেলাও চারপাশ অন্ধকার লাগছে। আফনাকে যেন অন্ধকারের ভূতনী লাগছে। জনমানবহীন হয়ে গেছে জায়গাটা। ভরদুপুরে কেই বা বাহিরে বেড়ায়? সেখানে তো ঝড়ের মাত্রা বেগতিক। আফনা ব্যাগ থেকে বোতলটি নিয়ে কাছের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলো। তুফানের শোঁ শোঁ শব্দ কানে বাজছে। আফনা বোতল থেকে পানি চোখে ছিঁটালো। কিছুক্ষণ ছিটিয়ে ওড়না দ্বারা মুখমন্ডল মুছতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। চোখ মুখে ঘোমটার নিচেই চুপচাপ বসে রইলো। ব্যাগ থেকে ফোন নিয়ে একটা ক্যাব বুক করলো।
কিছুক্ষণ বাদেই ঝুমঝুম বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। আফনা বিরাট ছাউনির নিচে আছে বিধায় তাকে বৃষ্টি স্পর্শ করতে পারছে না।

রায়াফ ড্রাইভিং করে বাসার দিকে যাচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎ মুষলধারায় বৃষ্টি নামলো। রায়াফ গাড়ি একপাশে থামিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং এ জোরে বারি দিলো “শিট” বলে। সেখানে বসে পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে তার চোখ দূরে আটকে গেলো। সে যখনই সামনের ছাউনির দিকে তাকালো তখনই একটি মেয়ে মুখ থেকে ঘোমটা উঠিয়ে দৌড়ে ছাউনি থেকে বেরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো, দুই হাত প্রসারিত করে। মেয়েটির বাচ্চামোতে রায়াফ আবারও ভাবনায় হারিয়ে গেলো, তার মন এবং মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ করে দিলো। তার কানের কাছে একটা লাইনই বারংবার বেজে চলেছে,

~”আমায় রেখো তোমার এই সোনালী বর্ষণে!”

মেয়েটির চেহারা দেখতে পেতেই রায়াফের ধ্যান কেটে গেলো। রায়াফ ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকালো, বিরক্তিতে! বারংবার এই মেয়ে কেন তার সামনে আসে সে বুঝে না। রায়াফ মেয়েটির থেকে চোখ সরিয়ে তার মিউজিক প্লেয়ারে অতি সুন্দর একটি গান চালালো।

“কিছু কথার পিঠে কথা..
তুমি ছুঁয়ে দিলে, মুখোরতা!
হাসি বিনিময়ে চোখে, চোখে,
মনে মনে রয়.. বেকুলতা!

আমায় ডেকো একা বিকেলে
কখনো কোনো ব্যথা পেলে।
আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে,
যখনই মন কেমন করে?”

গানটি রায়াফের ভিষণ পছন্দের একটি গান। সে জানে না গানটিতে আকর্ষণটা ঠিক কেন? তবে এই গানটি বারংবার তাকে টানে। গানটি শুনার সময় এক অন্য দুনিয়ায় বিস্তার করে, রায়াফ! আজ এই বর্ষণে সে এই গানটিকেই বন্ধু করে নিলো। রায়াফ না চাইতেও বারংবার আফনার দিকে তাকাচ্ছে। কোণা চোখে আফনাকে দেখা, প্রেমময়ী গান সাথে এই বৃষ্টি! ঠিক যেন “প্রেমময়ী বর্ষণে তুই” লাইনটিকে উদ্দেশ্য করে।

আফনা আরও কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিঁজে জোরে হাঁচি দিয়ে উঠলো। আফনার হাঁচি দেয়া দেখে রায়াফ আনমনেই হেসে উঠলো। আফনাকে যখন দেখলো ক্যাবে উঠে চলে যাচ্ছে তখনই রায়াফের ধ্যান ভাঙ্গে। সে গানটা বন্ধ করে ভাবলো,

-“এই মেয়েটির ফুল ডিটেইলস লাগবে আমার!”

ভেবেই রায়াফ বাইরের দিকে তাকিয়ে সানগ্লাস চোখে পড়ে নিলো। অতঃপর সে গাড়ি স্টার্ট দিলো। বৃষ্টি প্রায় কমে এসেছে।

এদিকে আফনা হাঁচি দিতে দিতে শেষ। আদনান পুরো টিস্যুর বক্স নিয়ে আফনার কাছে হাজির। আম্মু হাতে কয়েকটা মেডিসিন নিয়ে আসতে আসতে বললো,

-“এই তোরে বলেছি না অবেলায় বৃষ্টিতে ভিঁজবি না? এতো অবাধ্য কেন তুই বল তো? বৃষ্টিতে ভেঁজার তো নিয়ম আছে নাকি?”

আফনা নাক টেনে শীতল কন্ঠে বললো,

-“এভাবে ঠান্ডা লাগবে কে জানতো? হা..হাচ্চুউ! বৃষ্টি দেখে নিজের প্রতি কান্ট্রোলও ছিলো না আম্মু! হাচ্চুউউ!!”

আম্মু আর কোনো কথা বললো না। আফনাকে গরম স্যুপ খাইয়ে মেডিসিন দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এদিকে আফনা বসা থেকে শুয়ে পরলো। ঠান্ডা লাগলে আফনার সারাদিন ঘুম পায়। তাই ঘুম নষ্ট না করে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।

-“স্যার মেয়েটির নাম বা ছবি ছাড়া কীভাবে ডিটেইলস বের করবো?”
রায়াফ চুপ করে থাকে। অতঃপর লোকটি আবার বললো,

-“ক্যাবের নম্বর এবং সময়টা মনে আছে স্যার? থাকলে বলুন দেখি কিছু করতে পারি কি না!?”

ফাহানের পিএ’র কথায় রায়াফ যেন আশার আলো দেখতে পেলো। সে তৎক্ষনাৎ ক্যাবের নম্বর এবং সময়টা জানিয়ে দিলো। পিএ এগুলো সংগ্রহ করে চলে গেলেন। রায়াফের যাবতীয় কাজ ফাহানের পিএ কে দিয়েই সে করায়। ফাহানের পিএ অতি বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমতি। এধরণের লোককে রায়াফ পছন্দ করে। রায়াফ তার সিগারেটে ধরতে গিয়েও পারলো না। কী একটা অস্বস্তিবোধ কাজ করছে তার মধ্যে। বারংবার মেয়েটার কথাই মনে আসছে তার। রায়াফ সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বললো,

-“রায়াফের জীবনে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নিষেধ। রায়াফ পুরোটাই মেয়েদের জন্য নিষিদ্ধ কারণ, তার জীবনটা কালো মেঘের আঙ্গিনা!!”

রায়াফ তার সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে নিলো।
সন্ধ্যার পরে আফনার ফুপাতো ভাই ইসহাক বাসায় আসলো। মাঝেমধ্যেই এসে বেড়ায় সে। সন্ধ্যার পর আফনার কিছুটা ভালো লাগতেই সে এক বোতল কোকাকোলা এবং এক বাটি নুডুলস নিয়ে লিভিংরুমে বসেছে। ইসহাক পা টিপে টিপে আফনার পিছে দাঁড়িয়ে জোরে “ভাউ” করে উঠলো। এতে আফনার মধ্যে কোনোরকম রিয়েকশন দেখা দিলো না। সে একমনে নুডুলস গিলতে গিলতে বললো,

-“পোলাপানের টেকনিকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই, আমি ভয় পাই না। আদনাইন্নার ভুং ভাং শুনতে শুনতে অভ্যাস হয়ে গেছে।”

ইসহাক আফনার মাথায় গাট্টি মেরে সোফায় গিয়ে বসলো এবং হেলান দিয়ে বসলো। আফনা তখন মাথায় হাত বুলাতে ব্যস্ত। ইসহাক আফনার দিকে ভ্রু কুচকে বললো,

-“এক লিটারের কোকাকোলার সাথে এতো খাবার? বলি তোর মতো চিকনি এতো খাবার কেমতে খাস? ফুঁ দিলেই তো উড়ে যাস, তা এতো খাবার যায় কই হ্যাঁ? স্বাধে কী তোকে রাক্ষস বলি?”

আফনা তার হাতের কাছে থাকা কোকাকোলাটা ইসহাকের দিকে ছুঁড়ে মারলো। ইসহাক সেটা ক্যাচ ধরে বলে উঠলো,

-“থ্যাংকস! গলাটা শুকিয়ে গেছে!”

বলেই বোতলের মুখটা খুলে ঢকঢক করে হাফ লিটার শেষ করে ফেললো। আফনার হা করে ইসহাকের দিকে তাকিয়ে আছে। অতঃপর দিলো এক চিৎকার! আম্মু এবং আদনান দৌড়ে আসলো আফনার কাছে। আফনা চোখের পানি, নাকের পানি এক করে বললো,

-“এই হারামীরে বাসা থেকে বেরকরো! কতো কষ্ট করে আমি এক লিটারের কোকাকোলা আনিয়েছি কিন্তু এই গর্ধব সব খেয়ে নিলো। আম্মু বিচার করো নয়তো আমি সত্যি সত্যি বাসা থেকে বের হয়ে যাবো!!”

ইসহাক আফনার বিচার দেয়া দেখে কিটকিটিয়ে হেসে দিলো। আম্মু ইসহাকের উদ্দেশ্যে বললো,

-“বোনকে কাঁদিয়েছিস এখন জলদি আরেক লিটার আনা নয়তো এই মেয়েকে আমি সামলাতে পারবো না!”

তখনই কেউ কলিংবেল চাপলো। আদনান দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো ডেলিভারি ম্যান। সে একটা পার্সেল দিয়ে চলে গেলো। বক্সটা বেশি বড় না আবার ছোটও না! ইসহাক এগিয়ে এসে আদনানের থেকে বক্সটা নিয়ে বললো,

-“পার্সেলটা আমার আদু। তুই গিয়ে পড়তে বস!”

আদনান মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। ইসহাক পার্সেলটা নিয়ে গিয়ে আফনার সামনে রাখলো। ব্লেজার খুলতে খুলতে বললো,

-“ন্যাকামি না দেখ কী এনেছি তোর জন্যে, আমি গেলাম ফ্রেশ হতে।”

বলেই ইসহাক ভেতরে চলে গেলো। আফনা পার্সেলটা দেখে কৌতুহল দমাতে না পেরে খুলে দেখলো সব স্নেকস! চিপস, চকলেট, কোল্ডড্রিংকস সাথে একটা ছোট বক্সে ৪ ডজন চুড়ি। এগুলো দেখে আফনার কান্না অটোমেটিক থেমে গেলো এবং ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।

-“তা হঠাৎ আমাদের কথা মনে পরলো তোর?” আম্মু ইসহাকের উদ্দেশ্যে বললো।

-“তোমার ননদ পাঠিয়েছে মামী। বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজতে বলেছে তোমায়। সেই বার্তা দিতেই হুট করে আসা।”

-“বাহ এ তো সুখবর। ঠিক আছে আমি আগামীকাল থেকেই ঘটক লাগাবো?”

-“ঘটকটা আমি হই?” দুজনের মাঝে বলে উঠলো আফনা। ইসহাক ভেংচি কেটে বললো,

-“মোটেই না। কোন পাগল, পেত্নিরে ধরে এসে বলবি সে আমার উড বি! তোরে আমার বিশ্বাস নাই!”

আফনা দাঁত কেলাচ্ছে আর চকলেট খাচ্ছে৷ আফনার ফেসকাটিং দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এমন কিছু জানে যা ইসহাকের ধারণার বাইরে।

-“তুমি কী ভাবো চান্দু, আমার আম্মা বলদ হলে আমিল বলদ? আমি জানি তুমি কিছুদিন পর ঠিকই ওই মেয়ের ছবি দেখাইয়া বলবা আমার এই মেয়ে পছন্দ হয়েছে। আমি কিন্তু তোমারই বোন ইসহাক ভাই? আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, তুমি আমার পা ধরে হেল্প চাইবা, হেহেহে!”

~চলবে।

!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here