মরিচাধরা মনের খাঁচা পর্ব -০৮

#মরিচাধরা_মনের_খাঁচা
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৮

আজানের মিষ্টি ধ্বনি কানে যেতেই ঘুম ভেঙে গেলো নিঝুমের। কিছুটা সময় সেভাবেই শুয়ে রইলো বেডে। আজান শেষে চারদিকে আবার নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগলো। নিঝুম উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো, ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নামাজ পড়ে নিলো। মোনাজাতে সবার ভালো চাইলেও নিজের জীবন উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিলো। উপরওয়ালার যেটা ভালো মনে হয় তাই যেনো হয় তার সাথে। মোনাজাত শেষ করে মুখে হাত রাখতেই বুঝতে পারলো চোখে নোনাজলের অস্তিত্ব। জায়নামাজ ভাজ করে রেখে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ছাদে চলে গেলো, সকালের স্নিগ্ধ বাতাসে মন জুড়িয়ে যাচ্ছে তার। খানিকটা শীতল বাতাস বইছে চারপাশে, এ যেনো শীতের পূর্বাভাস।

এতো সকালে এখানে কী করছো ?

নিঝুম ঘুরে তাকিয়ে অয়নকে দেখতে পেলো। সকালের শুভ্র আলোয় অসম্ভব সুন্দর লাগছে উজ্জ্বল শ্যামবর্নের এই পুরুষ টাকে।

নিঝুম মনে মনে বললো, খুব কী বড় অন্যায় হয়ে যেতো যদি আপনি আমাকে ভালোবাসতেন ? আমরা সুন্দর একটা সংসার সাজাতাম, একটা এতিম বাচ্চা এডপ্ট করে নিতাম। যেখানে আপনিই ভালোবাসেন না সেখানে এতবড় অপূর্নতা নিয়ে কীভাবে আপনার জীবনে থাকি ?

কী হলো কোথায় হারিয়ে গেলে ?

নাহ্ কোথাও না।

নিঝুম আবার ঘুরে রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকালো। পূর্ব আকাশে রক্তিম সূর্য উঁকি দিচ্ছে। পৃথিবীর অন্ধকার কাটিয়ে আলো আধিপত্য বিস্তার করছে।

আজ আপনার জন্য একটা সুখবর আছে।

অয়ন ভ্রু কুঁচকে বললো, কী সেটা ?

আমি খুব তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি এই বাড়ি থেকে আর আপনার জীবন থেকেও। আপনি জিতে গেছেন আর আমি হেরে গেছি খুব বাজেভাবে। জিত টা অনেক আগেই হয়েছে আপনার তবে এবার জিত উপভোগ করার পালা।

অয়নের কানে বারবার যেনো প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো খুব তাড়াতাড়ি চলে যাবো আপনার জীবন থেকে।

নিঝুম অয়নের পাশকাটিয়ে যাওয়ার সময় ধীর আওয়াজে বললো, আর একটা সারপ্রাইজ মায়ের সামনে দিবো আপনাকে।

নিঝুম চলে গেলো আর অয়ন কিছুটা সময় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। ছাদ থেকে নেমে এক্সারসাইজের রুমে গিয়ে ট্রেডমিলে দৌড়াতে লাগলো। আজ তো তার খুশি হওয়ার কথা তবে কেনো কষ্ট হচ্ছে ?

সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট করছে। অহনা আর অয়ন বারবার নিঝুমের দিকে তাকাচ্ছে কারণ আজ তার ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি।

খাওয়াটা শেষে অয়ন উঠে যেতে চাইলে নিঝুম বললো, আমার কিছু কথা আছে, একটু ওয়েট করলে খুশি হতাম।

অয়ন আবার নিজের জায়গায় বসে পড়লো আর অহনা বললো, কী কথা নিঝুম ?

নয়না আপুর বাসা থেকে তার বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, সে তিন মাস আঁটকে রাখতে পারবে না তাদের। ডিভোর্স পেপার হাতে পাওয়ার এখনো অনেক দেরি। তাই আমি বলছি আগে উনার আর নয়না আপুর বিয়েটা হয়ে যাক। আমি বিয়ের দিন চলে যাবো আর ডিভোর্স পেপার হাতে পেলে সাইন করে পাঠিয়ে দিবো।

কথাগুলো নির্বিকার বললেও বুক ফেটে যাচ্ছিলো নিঝুমের। অয়ন আর অহনা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে।

অহনা বললো, তুই এসব কী বলছিস নিঝুম ?

আমি ঠিকই বলছি মা। আমার জন্য একবার উনি নয়না আপুকে হারাতে হারাতেও পেয়েছেন। আবার আমার জন্য চিরতরে হারিয়ে ফেলুক সেটা আমি চাই না। আর প্রথম স্ত্রী অনুমতি দিলে তো দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাঁধা নেই।

অহনা রেগে বললো, তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে নিঝুম। তোর মতো হাজারো মেয়ে আছে যারা,,,

নিঝুম অহনাকে দ্রুত থামিয়ে দিয়ে বললো, মা।

অহনা মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, তারা কিন্তু নিজের সংসার অন্যের হাতে তুলে দেয় না।

অয়ন ভ্রু কুঁচকে বললো, নিঝুমের মতো হাজার মেয়ে আছে মানে ?

নিঝুম কথা এড়িয়ে বললো, এই সংসারটা কখনোই আমার ছিলো না মা। আমি জোর করে আমার করার চেষ্টা করেছিলাম শুধুমাত্র। আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে দিয়েছি। তুমি আজই নয়না আপুর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলতে যাবে। তারা আমার কথা কিছুই জানে না আর জানানোর প্রয়োজনও নেই।

নিঝুম উঠে চলে যেতে নিলে অয়ন বললো, এক মিনিট, নয়নার বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে সেটা তুমি কী করে জানলে ?

নিঝুম মুচকি হেসে বললো, সেটা আপনার না জানলেও চলবে মিস্টার অ্যাটিটিউট।

নিঝুম চলে গেলে অহনা বললো, ও যখন নিজের অধিকার ছেড়ে দিচ্ছে তাহলে আমি আর কেনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো ? বিকেলে নয়নার বাড়ি নিয়ে যেও আমাকে। আমিও নাহয় আমার ভুল শুধরে নেই।

অয়ন একা বসে রইলো ব্রেকফাস্ট টেবিলে। জীবনটা তার কাছে এলেমেলো মনে হচ্ছে। যত নয়নার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তত মনে হচ্ছে সে ভুল করছে। আবেগ আর ভালোবাসা চিনতে ভুল করছে মারাত্মকভাবে। আবেগের পেছনে ছুটতে দিয়ে ভালোবাসা হারিয়ে ফেলছে। অয়ন উঠে বের হয়ে গেলো বাসা থেকে।

১৬.
বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বাড়িতে কোনো আয়োজন হচ্ছে না হলুদ থেকে রিসিপশন সবই কমিউনিটি সেন্টারে হচ্ছে। তবু ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে অয়নদের বাড়িটা। নিঝুম ঘুরে ঘুরে চেনা বাড়িটা অচেনা হয়ে যেতে দেখছে।

অহনাকে দেখে নিঝুম বললো, মা আমাকে একটু আমার বাসায় যেতে হবে।

অহনা মলিন হেসে বললো, আমার অনুমতি নেওয়ার কী আর কোনো প্রয়োজন আছে ?

নিঝুম অহনাকে জড়িয়ে ধরে বললো, এই বাড়ির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তুমি সারাজীবন আমার মা থাকবে। আর এখনো পুরোপুরি চলে যাওয়ার সময় আসেনি তাই ফিরে আসবো তাড়াতাড়ি।

নিঝুম বের হয়ে গেলো বাসা থেকে। তিথির জন্য কিছু কেনাকাটা করা লাগবে। পনেরো দিন হলো সাথী নিঝুমদের বাড়িতে আছে। তিথির বেশিরভাগ পোশাক পুরোনো হয়ে গেছে তাই মা কয়েকদিন ধরে বলছিলো কিনে দিতে। আজ বাড়িতে দমবন্ধ হয়ে আসছিলো তাই আজই বাইরে আসার সিদ্ধান্ত নিলো।

বাসায় গিয়ে কলিংবেল বাজালে সেলিনা দরজা খোলে দিলো। নিঝুম মুচকি হেসে বললো, আসসালামু আলাইকুম মা।

সেলিনা গম্ভীর গলায় বললো, ওয়ালাইকুম আসসালাম।

কেমন আছো মা ?

সেলিনা মেয়ের দিকে তাকিয়ে অসহায় মুখে বললো, তুই কী কাঠের পুতুল হয়ে গেছিস ঝুম ? তোর কী কষ্ট হচ্ছে না একটুও ?

কষ্ট কেনো হবে বলো তো ?

সেলিনা রেগে ভেতরে চলে গেলো। সে জানে মেয়েটা ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিঝুম ভেতরে যেতেই দেখলো সেলিনা সোফায় বসে খেলছে তিথির সাথে আর সাথী কিচেনে।

নিঝুম গম্ভীর গলায় বললো, বাবার বদলি হয়েছে ?

দুদিন হলো জয়েন করেছে গিয়ে, তুই যখন চাইবি তখনই চলে যাবো আমরা। তোর বাবা আর এখানে আসবে না। আমাদের একাই চলে যেতে বলেছে।

আগামীকাল যাবো আমরা। তার আগে সাথী আর তিথির জন্য আজ কিছু কেনাকাটা করে আসি, ওখানে সেসব ওদের প্রয়োজন হবে।

সাথী রেডি হয়েই আছে, তিথিকেও সাথে নিয়ে যা।

কিন্তু তিথি ঘুমিয়ে পড়েছে দেখো।

সেলিনা নিজের কোলে তাকিয়ে দেখলো সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছে তিথি।

তাহলে ওকে রেখেই যা, আমি তো আছি।

ঠিক আছে।

এই সাথী বাকিটা আমি করে নিবো তুই বরং তোর আপু সাথে যা।

সাথী কিচেন থেকে বের হয়ে বললো, ঠিক আছে মা। আপা তিথিরে নিবেন না ?

সেলিনা চোখ রাঙিয়ে বললো, তোকে না বলেছি ভালো করে কথা বলবি। আপা কী হ্যাঁ ? সুন্দর করে আপু বলবি। আমি সমাজের কাছে তোকে নিজের ছোট মেয়ে বলে পরিচয় দিয়েছি, তাই নিজেকে সেভাবে তৈরি কর।

সাথী কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, আমার মতন কপালপোড়ার ভাগ্যে এতো ভালোবাসা আছিলো বুঝি নাই কহনো।

সেলিনা আবার রেগে বললো, না এভাবে হবে না। এই মেয়ের জন্য একটা টিউটর রাখতে হবে। ঝুম এবার যা তো নাহলে লেট হয়ে যাবে আসতে।

নিঝুম মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো সাথী আর মায়ের খুনসুটি। সেলিনা এতো তাড়াতাড়ি সাথীকে এতোটা আপন করে নেবে ভাবতে পারেনি নিঝুম। নিজের বাবা-মায়ের উপর গর্ব হয় নিঝুমের। তিথিকে রেখে সাথীকে নিয়ে শপিংয়ে গেলো নিঝুম। নিজের কষ্টগুলো থেকে একটু পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা মাত্র আর হাতেও সময় নেই। আগামীকাল অয়ন বর সেজে বের হয়ে যাওয়ার পরই নিঝুমও চলে যাবে অয়নের থেকে অনেক অনেক দূরে। যেখান থেকে অয়ন চাইলেও আর নিঝুমকে খোঁজে বের করতে পারবে না। নিঝুমও পাগল অয়ন তাকে খুঁজতে যাবেই বা কেনো ? সাথীর জন্য পোশাক কিনতে গিয়ে থমকে গেলো নিঝুম। যে কষ্টগুলো থেকে সে পালিয়ে বেড়াতে চাইছে সেগুলোই তার পিছু পিছু চলে আসে। নয়নার তো এখন পার্লারে যাওয়ার কথা ছিলো হলুদের সাজের জন্য। সে অয়নের সাথে শপিংমলে কী করছে ? নিঝুম সাথীকে পছন্দ করতে বলে একটু এগিয়ে গিয়ে আড়ালে দাঁড়ালো যাতে অয়ন বা নয়না তাকে দেখতে না পায়।

অয়ন তুমি একটা পছন্দ করে দাও না প্লিজ।

অয়ন বিরক্ত হয়ে বললো, পছন্দ করে হলুদের জন্য লেহেঙ্গা পাঠানো হয়েছিলো তোমাকে। তাহলে এখন এখানে আসার মানে কী ?

নয়না মলিন মুখে বললো, আমি জানি লেহেঙ্গাটা নিঝুমের পছন্দের, তাই সেটা পরে আমি আমার হলুদের অনুষ্ঠান করতে চাই না।

নিঝুমের চোখ টলমল করে উঠলো নয়নার কথায়। নয়না কী তাকে তাদের জন্য অশুভ করে করছে ? নয়না কী জানে বুকে কতটা কষ্ট চাপা দিয়ে নয়নার জন্য প্রত্যেকটা বিয়ের কেনাকাটা করেছে সে। সে তো করতে চাইনি অয়ন জোর করেছিলো তাকে৷ হয়তো কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে। এতদিন নিঝুম তাকে তেতো কথা বলেছে তার প্রতিশোধ নিতে। অয়নের গায়ের হলুদের পাঞ্জাবিটাও নিঝুমের পছন্দ করা। নিঝুম চোখ মুছে সেখান থেকে চলে যেতে নিলে অয়নের কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলো।

অয়ন গম্ভীর গলায় বললো, নিঝুমের পছন্দের বর বিয়ে করতে পারছো আর নিঝুমের পছন্দের লেহেঙ্গা পড়তে পারবে না।

নয়না অবাক হয়ে বললো, অয়ন কী হয়েছে তোমার, তুমি এভাবে কথা বলছো কেনো ?

অয়ন অন্যমনস্ক হয়ে বললো, জানি না কী হয়েছে আমার ? তবে এটুকু বলতে পারি আমি ভালো নেই। ভালো থাকতে পারছি না আমি, কিছুতেই না।

অয়ন বের হয়ে গেলো সেখান থেকে। নিঝুম আর নয়না দুজনেই অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পানে। একটু পর নয়নাও ছুটলো তার পিছনে, নিঝুম দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেলো সাথীর দিকে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here