মরিচাধরা মনের খাঁচা পর্ব -০৭

#মরিচাধরা_মনের_খাঁচা
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৭

নয়না অয়নের একহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, তুমি আমার উপর রাগ করো না প্লিজ।

না না রাগ করিনি। চলো উঠা যাক অনেক রাত হয়ে গেছে।

হুম চলো।

নয়নাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে অয়নও নিজের বাসায় চলে গেলো। গাড়ি পার্ক করে ভেতরে গিয়ে কলিংবেল বাজালে খুশি দরজা খোলে দিলো। ড্রয়িংরুমে অহনা চিন্তিত মুখে বসে আছে। এতো রাত হলো এখনো নিঝুম বাড়ি ফেরেনি আর ফোনও অফ বলছে। অয়ন অহনাকে দেখে রুমে না গিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলো।

কী হয়েছে মা, তোমাকে চিন্তিত লাগছে ?

অহনা চিন্তিত গলায় বললো, নিঝুম এখনো বাড়ি ফেরেনি।

অয়ন হাত ঘড়িতে দেখলো রাত সাড়ে দশটা বাজে, নিঝুম তো এতোরাত পর্যন্ত বাইরে থাকার মেয়ে না।

ফোন করেছিলে ?

অনেকবার ট্রাই করেছি অফ বলছে বারবার।

অয়নও যেনো চিন্তায় পড়ে গেলো এবার। কিছুক্ষণ ভেবে বললো, আন্টিদের বাসায় যেতে পারে সেখানে একবার জিজ্ঞেস করে দেখতে।

এটা আমিও ভেবেছিলাম কিন্তু পরে চিন্তা করলাম সেখানে না গিয়ে থাকলে ওরাও চিন্তায় পড়ে যাবে। আর নিঝুম ওখানে গেলে তো আমাকে বলেই যেতো।

আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখছি।

অয়ন বের হওয়ার জন্য দরজা খুলতেই নিঝুমকে দেখতে পেলো, সে কেবলই কলিংবেল বাজাতে যাচ্ছিলো।

অয়ন রাগি গলায় বললো, এতো রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে ?

নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বললো, তা দিয়ে আপনার কী প্রয়োজন বলুন তো ?

মা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছিলো।

সেটা আমি মায়ের সাথে বুঝে নিবো। এখন আপনি রাস্তা ছাড়ুন ভেতরে যাবো।

আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো পাইনি আমি।

নিঝুম অয়নের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো, আমাকে প্রশ্ন করার আপনি কে ?

তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো আমি তোমার হাসবেন্ড।

নিঝুম তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, সেটা শুধুমাত্র কাগজে কলমে তাও আর মাত্র দুই মাস পনেরো দিনের জন্য।

অয়ন রেগে বললো, তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছো এবার।

বাড়াবাড়িটা আপনি করছেন, আমি নই। আপনি কী চাইছেন বলুন তো ? দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে ইচ্ছে করছে। বাইরে গার্লফেন্ডকে সময় দিচ্ছেন আবার বাড়িতে আমার উপরও স্বামীর অধিকার ফলাতে আসছেন। আপনার মনে হয় না আজকাল আমার বিষয়ে একটু বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন আপনি। আমি যেখানেই যাই আর যার সাথেই যাই আপনার কিছু আসে যাওয়ার কথা তো নয়।

অহনা এগিয়ে এসে বললো, এতো লেট হবে একবার ফোন করে জানাবি তো। তোর চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো।

নিঝুম অয়নের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। ব্যাগটা সোফায় রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে বললো, সরি মা আসলে এতো ঝামেলায় তোমাকে জানানোর কথা মনেই ছিলো না আর যখন মনে হলো তখন দেখি ফোন অফ হয়ে গেছে চার্জ শেষ হয়ে।

অয়ন এতক্ষণ দরজার সামনেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। এবার বড় কদমে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।

অহনা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিঝুমকে বললো, এতো লেট হলো কেনো ?

বস্তিতে গিয়ে দেখি সাথীর মা মারা গেছে।

কী বলিস, কীভাবে ?

ক্যান্সার ধরা পরেছে বেশ কয়মাস আগে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারেনি। আজ ভোর রাতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে।

অয়ন নিঝুমের কথা শুনে সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো আর চুপচাপ শুনতে লাগলো।

সাথী এখন কেমন আছে ?

মাথার উপর এতদিন তাও মায়ের ছায়া ছিলো কিন্তু এখন একদম একা হয়ে গেছে। বস্তির বখাটে ছেলেদের বাজে নজর ছিলো সাথীর উপর। ওখানে একা থাকা ওর জন্য নিরাপদ না। তাই কী করা যায় সেটা ঠিক করতেই এতো সময় লাগলো।

সাথী এখন কোথায় আছে ?

আমাদের বাড়িতে রেখে এসেছি।

অহনা অবাক হয়ে বললো, তোদের বাড়ি ?

হ্যাঁ, মা অনেকদিন ধরে বলছিলো একটা কাজের মেয়ে দরকার। সাথী এখন থেকে আমাদের বাসায় থাকবে আর মায়ের কাজে হেল্প করবে। আর তাছাড়াও মা সবসময় বাসায় একা থাকে তার একজন সঙ্গীও হলো।

তুই বরং এখানেই নিয়ে আসতি।

নিঝুম মুচকি হেসে বললো, এখানে আমি কতদিন আছি তারই ঠিক নেই আবার ওকে আনবো।

উত্তরে অহনা আর কিছু বলতে পারলো না। অয়ন ঘুরে তাকালো নিঝুমের দিকে, মেয়েটার চোখে পানি টলমল করছে।

নিঝুম আবার বললো, বস্তির অনেকে ঝামেলা করছিলো। বলছিলো চল্লিশ দিনের আগে সাথী ঐ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে না। আসলে ঐ বখাটে গুলো উসকানিমূলক কথা বলছিলো আশপাশের মানুষকে। তাই বেশ ঝামেলা হয়েছে সাথীকে আনতে তাই এতো লেট।

আচ্ছা তুই তো ক্লান্ত একটু ফ্রেশ হয়ে আয় আমি খাবার দিচ্ছি।

আমি খেয়ে এসেছি, এখন রেস্ট নিবো।

ঠিক আছে তাহলে রুমে যা।

নিঝুম অহনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে রুমে চলে গেলো। অয়ন সেদিকে এবার তাকিয়ে নিজেও রুমে চলে গেলো। নিঝুম রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেলকনিতে গিয়ে বসলো। আশপাশটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে, সামনের রাস্তায় দু’একটা গাড়ি শা করে চলে যাচ্ছে খুব দ্রুত। নিঝুম চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা নিশ্বাস নিলো। জীবনে যা চেয়েছে খুব সহজে পেয়ে গেছে সবসময়। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান নিঝুম, তাই তার কোনো চাওয়া কখনো অপূর্ণ রাখেনি তারা। নিঝুমের বাবা বড় পর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তা। জীবনটা সবসময় খুব সহজ ছিলো নিঝুমের জন্য। অয়নকে চেয়েছিলো নিঝুম, তাকেও সহজে পেয়েছে। সত্যি পেয়েছে কী ? অয়ন তার জীবনে আসার পর বুঝতে পেরেছে না পাওয়ার যন্ত্রণা কাকে বলে। পেয়েও না পাওয়ার কষ্টটা কেমন। আজ তিথিকে কোলে নিয়ে নিজের অক্ষমতার কষ্টটা কেমন সেটাও উপলব্ধি করতে পেরেছে। হ্যাঁ নিঝুম কখনো মা হতে পারবে না। আর এটাই কারণ অয়নকে তার ভালোবাসার মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার। সময়ের সাথে হয়তো অয়ন একদিন ঠিক মেনে নিতো নিঝুমকে। কিন্তু যখন জানতে পারতো নিঝুম কখনো মা হতে পারবে না তখন নিঝুম সারাজীবন তার চোখে অপরাধী হয়ে থাকতো। তাকে বাবা ডাক থেকে বঞ্চিত করার অধিকার নেই নিঝুমের।

নিঝুম আনমনে বলে উঠলো,

আমার মনের খাঁচায় মরিচা ধরেছে,
সে হারিয়েছে নিজের সৌন্দর্য।
ভেতরে বন্দী রাখা পাখিটা,
কেমন ছটফট করছে,
ছাড়া পাওয়ার আশায়।
এতো সুন্দর পাখিটা,
মরিচাধরা খাঁচায় যে মানায় না।
পাখিটার ছটফটানি আর সহ্য হয় না।
কোনো এক তপ্ত দুপুরে তাকে মুক্ত করে দিলাম।
সে উড়ে চলে গেলো চোখের পলকে,
নিজ পছন্দের স্বর্ন খাঁচা ঠিক খোঁজে নিলো।
আমি নোনাজল ভেজা চোখে তাকিয়ে দেখলাম,
পছন্দের খাঁচা পেয়ে তার প্রাণঢালা খুশি।
আমি পরে রইলাম একা নিঃসঙ্গ,
শূন্য পরে রইলো আমার মরিচাধরা মনের খাঁচা।
হয়তো পাখিটা একদিন খুঁজবে,
সেই মরিচাধরা খাঁচাটা।
ততদিনে সে হয়তো বিলীন হয়ে যাবে প্রকৃতির মাঝে।

১৫.
নিঝুম চোখ বন্ধ করে ভাবলো সেই অভিশপ্ত দিনটার কথা। যে দিন তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অনুভূতিগুলো কেড়ে নিয়েছে। সেই অনুভূতিগুলো তার জীবনের জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।

বাবার বাড়ি এসেছে নিঝুম, এবার অনেকদিন থাকবে সে মায়ের কাছে। পরিক্ষার জন্যই আসা হয়েছিলো কিন্তু শেষ হয়ে গেলেও যেতে ইচ্ছে করছে না। অহনার কাছে বলে আরো কিছুদিন সময় নিয়েছে এখানে থাকার। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য মেয়েকে ডাকতে গিয়ে দেখে মেয়ে ফ্লোরে পরে পেট চেপে ধরে কান্না করছে। শুক্রবার তাই নিঝুমের বাবা নিয়াজ চৌধুরী আজ বাসায়। স্ত্রীর চিৎকার শুনে মেয়ের রুমে এসে সেও ভয় পেয়ে গেলেন। মেয়ের পাশে বসে মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলেন সে। সেলিনা তখন হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

নিয়াজ চৌধুরী মেয়ের মাথা হাত বুলিয়ে বললো, কোথায় কষ্ট হচ্ছে মা ?

ব্যাথায় দাঁত কামড়ে নিঝুম বললো, বাবা আমার খুব ব্যাথা হচ্ছে পেটে।

নিয়াজ ব্যস্ত গলায় বললো, সেলিনা ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে বলো তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করতে।

হুশ ফিরলো সেলিনার, দৌড়ে রুমে গিয়ে ফোন করলেন ড্রাইভারকে। শুক্রবার সেও তাই বাসায় চলে গেছে আজ, তাড়াতাড়ি আসছে জানালো। নিয়াজ চৌধুরী বেশ কঠিন মানুষ তবে এই মেয়েটাই তার সবচেয়ে দূর্বল জায়গা। মেয়ের কষ্ট দেখে চোখ থেকে টপটপ পানি পড়ছে তার। ড্রাইভার আসলেই মেয়েকে কোলে তুলে বের হয়ে গেলেন নিয়াজ আর পেছনে সেলিনা। হসপিটালে গিয়ে ফোন করে জানালো অহনাকে। অয়ন ব্যবসার কাজে কক্সবাজার গিয়েছে সকালেই, আসবে আরো পনেরো দিন পর। অহনা একাই চলে গেলো হসপিটালে। ইমারজেন্সি সব পরিক্ষা করা হলো নিঝুমের। ডক্টরের চেম্বারে চিন্তিত মুখে বসে আছে নিয়াজ আর সেলিনা।

ডক্টর গম্ভীর গলায় বললো, জরায়ুতে টিউমার হয়েছে অনেক আগে আর এখন সেটা ক্যান্সারের রুপ নিচ্ছে। লক্ষণগুলো হয়তো আমলে নেয়নি পেশেন্ট তাই গুরুত্ব দেয়নি। আরো আগে চিকিৎসা নিলে এই অবস্থায় পৌঁছাতে পারতো না। এখন দ্রুত অপারেশন না করলে ধীরে ধীরে বাড়বে আর মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়বে পেশেন্ট। আর অপারেশন করলে পেশেন্ট আর কখনো মা হতে পারবে না।

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে নিয়াজ চৌধুরী। সেলিনা মুখে আঁচল চেপে কান্না করছে। বাইরে অহনা বারবার অয়নকে কল দিয়ে যাচ্ছে।

মা মিটিংয়ে আছি বারবার কেনো কল দিচ্ছো ?

নিঝুম হসপিটালে।

অয়ন অবাক হয়ে বললো, হসপিটালে কেনো, কী হয়েছে ?

জানি না হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

অয়ন এবার বিরক্ত হয়ে বললো, অসুস্থ হয়েছে ডক্টর দেখলে ঠিক হয়ে যাবে। এতে ব্যস্ত হওয়ার কী আছে ? আমাকে আর বিরক্ত করো না।

অহনার কোনো কথা না শুনে কল কেটে দিলো অয়ন। নিয়াজের কাছে সবার আগে তার মেয়ে তাই ডক্টরকে বললো যেকোনো ভাবে তার মেয়েকে বাঁচাতে। অপারেশনের পর নিঝুমের সব বিপদ কেটে গেলেও, চিরদিনের মতো মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে কিন্তু প্রতিনিয়ত মনে হতে থাকে সে অয়নের জীবন নষ্ট করছে আর এসব কিছুই না জানা সত্ত্বেও অয়নের অবহেলাও দিন দিন বাড়তে থাকে। অয়ন যেদিন সব জানতে পারবে তখন তো নিঝুম তার কাছে অপরাধী হয়ে যাবে। তাই ঠিক করে নেয় সে চলে যাবে অয়নের জীবন থেকে। নিয়াজ, সেলিনা আর অহনা ছাড়া নিঝুমের ব্যাপারে আর কেউ কিছু জানে না। নিঝুম মেনে নিয়েছে নিজের নিয়তি। এটাও ঠিক করে ফেলেছে ডিভোর্সের পর বাবা-মার সাথে অনেক দূরে চলে যাবে। অয়নের সামনে যেনো কোনোদিন পরতে না হয় তাকে। অয়নের উপর তার কোনো অভিযোগ নেই, সে নিজের ইচ্ছেতে না গেলে অয়ন তাকে কখনো তাড়িয়ে দিতে পারতো না। তাই সে নিজেই চলে যাচ্ছে অয়নের জীবন থেকে। অয়নের বিয়ের খবর পেয়ে নয়না অয়নকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। নিঝুম নয়নাকে জানিয়েছে তার সাথে অয়নের কেবল কাগজ কলমের সম্পর্ক, সে অয়নকে তার কাছে ফিরিয়ে দেবে। তাই ফিরে এসেছে নয়না। আজ নয়না ফোন করেছিলো, বললো তার বাবা-মা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। অনেক ভেবেচিন্তে নিঝুম আরো একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামীকাল সকালেই সেটা সবাইকে জানাতে হবে।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here