#কান্তা_মনি
#পর্ব_১৪
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা
রান্নাবান্না কতদূর হয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য সেদিকে যেতেই একটা কক্ষের সামনে এসে চলার গতি থেমে যায় নূর জাহানের। দ্বারের পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকে নূর জাহান। বিস্ফোরিত নয়ন স্থির হয়ে আছে । কক্ষের ভেতর থেকে আসা কথোপকথনের ধ্বনি কানে এসে বাজতেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নূর জাহানের।
আদরের পুত্রকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে তাও আবার নিজের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ! এই ব্যাপারটা যে কিছুতেই বেগম নূর জাহান (নিয়াজের আম্মা) মেনে নিতে পারছেন না। পাথরের মতো স্থির হয়ে দ্বারের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন বেগম নূর জাহান। এখান থেকে সরে যাওয়া যে উচিত তা তার মাথায়ই নেই। নির্বাক হয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে ব্যস্ত তিনি।
কক্ষ হতে বের হতেই সামনে বেগম নূর জাহানকে দেখে থমকে যায় মেহরিন। মেহরিনকে দেখেই কান্না থামিয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকান বেগম নূর জাহান।
-খালাজান আপনি! আপনি এখানি কি করছেন? (কাঁপা কাপা কন্ঠে স্বভাবসুলভ হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে মেহরিন)
রাগে থরথর করে কাপতে শুরু করলেন বেগম নূর জাহান।
-কি হয়েছে খালাম্মা? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? (মেহরিন)
কিছু না বলেই গটগট পায়ে স্থান ত্যাগ করেন বেগম নূর জাহান।
এতবড় খুশির দিনে শহর থেকে মহাশিন (শাহ সুলতান মির্জার মেঝো পুত্র) এবং মুর্শিদা (মহাশিনের বেগম) চলে এসেছে ।
হেতিজা ও শাহতাজের বাগদান করা শেষে সকলে ভোজনশালায় উপস্থিত হন। খানাপিনা শেষে সকলে গল্পে মশগুল হয়ে ওঠে।
নতুন জমিদারকে (নিয়াজ মির্জা) সসম্মানে গ্রহণ করে নেয় প্রজা সাধারণেরা।
আকাশ বেয়ে আধার যত নেমে আসছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে যে বেগম নূর জাহানের অনুতপ্ততার পাল্লাও ধীরে ধীরে ভারী হচ্ছে। আসলে মানুষ ধাক্কা না খেলে কোনো কিছুরই মর্ম বোঝেনা। সে যে জেনে-বুঝে কান্তা মনিকে বহুত অত্যাচার করেছে, প্রিয় পুত্রের বেগম হিসেবে কখনো মেনে নিতে পারেনি। শুধুমাত্র সে গরীব ঘরের মেয়ে হওয়ায়। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে বেগম নূর জাহান। নিজেকে মুহূর্তে মুহূর্তে ধিক্কার জানাচ্ছেন তিনি।
কক্ষের এ মাথা হতে ও মাথা পায়চারী করছে কান্তা মনি। শাড়ির আচল আঙুলে পেচিয়ে যাচ্ছে সে। সেদিন পর থেকে সে এই বাড়ির প্রতিটা মানুষকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। সেদিন হতে এখন পর্যন্ত শাহ সুলতান মির্জাকে (নিয়াজের চাচা) সে বেশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছে। সন্দেহের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আসলে চলছেটা কি এই বাড়ির মধ্যে এই গ্রামে? নওশাদকে (নিয়াজ মির্জার ফুফু মেহেরুন্নেছার পুত্র) তো সে প্রথম থেকে সুবিধাজনক মনে হয় না কান্তা মনির। আসলে এনাদের উদ্দেশ্যটা কি? সরদার বাড়িতেই বা কেন এত আনাগোনা এনাদের? দ্বারে ঠক ঠক আওয়াজ হতেই নিজেকে সামলে নেয় কান্তা মনি। রক্ষী দ্বার খুলে দিতেই বেগম নূর জাহান থালা ভর্তি নানা রকম ফল কেটে নিয়ে হাজির হন কান্তা মনির কক্ষে।
-আসসালামু আলাইকুম আম্মা। (অবাক চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। (বেগম নূর জাহান)
ফলের থালাটি চৌপায়ার ওপর রেখে কান্তা মনির বাহু টেনে নিয়ে পালঙ্কের ওপর বসেন বেগম নূর জাহান। কান্তা মনির কপালের ওপর ঝুকে থাকা অতিরিক্ত চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দেন বেগম নূর জাহান।
-এই সময়ে খাওয়ার রুচি থাকবেনা। বমি হবে। শরীর দূর্বল লাগবে। খারাপ লাগলে কখনো নিজের মধ্যে দমিয়ে রাখবেনা। আমাকে অবশ্যই জানাবে। এই সময়ে কিন্তু খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। দরকার ছাড়া সিড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতে হবেনা। ওপরেই হাটাচলা করবে বুঝেছো? (নূর জাহান)
কান্তা মনি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বেগম নূর জাহানের দিকে।
-কি হলো যা বলেছি বুঝেছো তো? (নূর জাহান)
চোখে-মুখে বিস্ময় সূচক ভাব ফুটিয়ে রেখে মাথা কাত করে ‘হ্যা’ সূচক ইঙ্গিত দেয় কান্তা মনি।
-এগুলো সব খেয়ে নিও। আমি আসছি। (গম্ভির মুখে কক্ষ ত্যাগ করলেন বেগম নূর জাহান)
নূর জাহানের এহেন কান্ডে কিংকর্তব্যবিমূঢ় কান্তা মনি।
-আমার ছোট কান্তা মনির এই ছোট পেটটায় একটা ছোট প্রাণ বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে। (কান্তা মনির পেটের ওপর হাত রেখে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
লজ্জায় গুটিশুটি মেরে যায় কান্তা মনি।
-আজকে আমি জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো শ্রেষ্ঠ খুশিটা উপভোগ করলাম কান্তা মনি। তুমি আমাকে কতবড় একটা খুশি উপহার দিয়েছো আমি বলে বোঝাতে পারব আমার বেগম। মহান আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।
-ছেলে চাই নাকি মেয়ে চাই আপনার? (কান্তা মনি)
-মহান আল্লাহ যাকেই পাঠাক আমি তাতেই খুশি আমার বেগম। তা আপনার কি চাওয়া শুনিতো? (নিয়াজ মির্জা)
-আমিও আল্লাহ যাকেই পাঠাবেন আমি তাতেই খুশি। কিন্তু সে যেন আপনার মতো হয় এমন হয়। এই একটাই চাওয়া। (কান্তা মনি)
নিয়াজ মির্জা মুচকি হেসে কান্তা মনিকে বাহুডোরে আগলে নেয়।
-তা বেগম সাহেবা এখন থেকে কিন্তু একটু বেশি বেশি মানে মাত্রাতিরিক্ত যত্ন নেব আপনার। আপনি টু শব্দটি করতে পারবেন না। কিন্তু আমার যে এখন থেকে সময়ের টানাপোড়নে থাকতে হবে। জমিদারের দায়িত্ব যে বিশাল। তবুও যতটুকু সময় পাব আমার প্রাণপ্রিয় বেগম কে যত্নের নাম করে আচ্ছা মতো জ্বালাবো। (হেসে হেসে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
মুখে হাত চেপে হাসতে শুরু করে কান্তা মনি।
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে জনাব। (কানা মনি)
দ্বারে ঠকঠক আওয়াজ হতেই নড়েচড়ে বসে দুজনে।
-উফফ এমন সময়ে আবার কার আগমন! (বিরক্তের সুরে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
হেতিজা কাচের জার ভরে আচার নিয়ে কক্ষে করে।
-কি জমিদার সাহেব বেগমের যত্ন কি নেওয়া হচ্ছে ঠিক মতো? (চোখ টিপ্পনি কেটে বলে ওঠে হেতিজা)
-তুই এই সময়ে কি করিস হুম? (নিয়াজ মির্জা)
-শুনলাম আমি নাকি ফুফুমনি হবো। তো আমারও তো একটা দায়িত্ববোধ আছে। নতুন সদস্য আসার পর যদি বলে , “ফুফুমনি তুমি আমার আর আম্মাজানের যত্ন করোনি তাই তোমার কোলে উঠব না আমি।“ তখন তো আমার আবার কপাল চাপড়ে আফসোস করতে হবে তাইনা? তাই বিকালের পরে সব যোগাড় করে আচার বানিয়ে এই নিয়ে এলাম আমার ভাবিজানের জন্য। (হাসতে হাসতে বলে ওঠে হেতিজা)
-বাবা আলসের শেহজাদির দেখি সুবুদ্ধি হয়েছে। (নিয়াজ মির্জা)
-ভাইজান! তুমি কিন্তু বেশি বলতেছো হুম। ভাবিজান এই নাও। তোমার স্বামীকে একটু আচ্ছামত জব্দ করে দিও তো আমার হয়ে। আমি এখন আসছি। (কথাগুলো বলেই কক্ষ ত্যাগ করে হেতিজা)
-পাগলি বোন আমার। (মুচকি হাসে নিয়াজ মির্জা)
-মাস খানেক পরেই হেতিজা বুবুর বিয়ে তাইনা? (কান্তা মনি)
-হুম। (নিয়াজ মির্জা)
-বুবু তার ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাচ্ছে। সে কত ভাগ্যবান। আপনার মতো একটা ভাইজান যেন সকল বোনেরা পায়। (কান্তা মনি)
কান্তা মনিকে দু হাত দিয়ে জাপটে ধরে নিয়াজ মির্জা।
-হুম। আচ্ছা বেগম আবার বিয়ে করি আমরা দুজন। কি বল? (দুষ্টু হেসে বলে ওঠে)
-যাহ। (লজ্জায় দুহাতের তালুতে মুখ ঢেকে নেয় কান্তা মনি)
-এ বাবা! লজ্জা পেয়েছো তুমি? (নিয়াজ মির্জা)
-আপনি থামবেন? এমনিই শরীরটা দূর্বল লাগছে তার ওপর আবার আপনি মজা করছেন? (কান্তা মনি)
এভাবেই তাদের খুনসুটি চলতে থাকে।
-নিয়াজ? (বেগম নূর জাহান)
প্রিয় আম্মাজানের কন্ঠ পেয়ে এক সিড়ি নেমেও পুনরায় ওপরে উঠে এসে নূর জাহানের সামনে দাড়া নিয়াজ মির্জা।
-জ্বি আম্মা বলুন কি বলবেন? (নিয়াজ মির্জা)
-তুমি আমার ওপর রেগে আছো তাইনা? এই নিষ্ঠুর আম্মার ওপর আর রাগ করে থেকোনা আমার পুত্র। (নূর জাহান)
-আম্মা আপনি এভাবে বলছেন? সন্তান কি কখনো তার মায়ের ওপর রাগ করে থাকতে পারে বলেন? (নিয়াক মির্জা)
মুচকি হাসেন নূর জাহান।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে মা ছেলের কথোপকথন শুনছে কান্তা মনি। একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে পুনরায় কক্ষে প্রবেশ করে কান্তা মনি।
আকাশ বেয়ে ঘন আধার নেমে এসেছে। সারাদিন কক্ষে ঘাপটি মেরে থাকতে থাকতে ধৈর্য্য হারা হয়ে যাচ্ছে কান্তা মনি। জমিদার নিয়াজ মির্জা এক বিশেষ বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার জন্য বেরিয়েছে সেই বিকেলে। ফিরতে মধ্যরাত। তাই কক্ষে পানি থাকা সত্বেও পানি খাওয়ার বাহানায় সিড়ি বেয়ে নিচে কান্তা মনি। এই সময়ে সবাই সবার কক্ষেই থাকে। হাড় কাপানো শীতে চলাফেরা করার সময় পা বরফের ন্যায় জমে যেতে শুরু করে দেয়। পানি পান করে পেছনে ঘুরতেই কান্তা মনির ভ্রু কুচকে আসে। নওশাদ (মেহেরুন্নেছার পুত্র) চুপিসাড়ে মোটা শাল দিয়ে আপদমস্তক ঢেকে বাইরের দিকে রওনা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ দরকার পড়লেও তো কখনো এমন চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে বাইরে যাওয়ার কথা না। সন্দেহ জেঁকে বসে কান্তা মনির মনে। পানপাত্রটি জায়গামতো রেখেই গায়ের শাল দিয়ে ভালোভাবে শরীর ঢেকে নিয়ে নওশাদের পেছনে পেছনে বের হয়ে যায় কান্তা মনি। একা মেয়ে তাও এমন ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজের সন্দেহের কারনটিকে তদন্ত করা জন্য বেরিয়েছে। মনে যেন বিন্দুমাত্র ভাবনারা এসে টোকা দিচ্ছে না যে কোনো বিপদ হবে নাতো?
চলবে…