কান্তা মনি পর্ব -১৫+১৬

#কান্তা_মনি
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

একা মেয়ে তাও এমন ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজের সন্দেহের কারনটিকে তদন্ত করা জন্য বেরিয়েছে। মনে যেন বিন্দুমাত্র ভাবনারা এসে টোকা দিচ্ছে না যে কোনো বিপদ হবে নাতো?

নওশাদের পিছু নিতে নিতে সরদার বাড়ির নিকটে এসে থামল কান্তা মনি। মাথায় এবার যেন প্রশ্নের পাহাড় জমেছে।
পাহারাদারকে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু একটা বলল নওশাদ। সঙ্গে সঙ্গে পাহারাদার বাড়ির ভেতর গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ফিরে এসে নওশাদকে মুখ নাড়িয়ে কি একটা যেন বলল তা কান্তা মনির কর্ণগোচর হলো না।
কিছুক্ষণ বাদেই মারজান সরদার সিংহদ্বার পেড়িয়ে বাইরে এলেন। দুজনের মধ্যের কথোপথন কান্তা মনির কান পর্যন্ত না এলেও কিছু একটা যে ঘাপলা আছে তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। কান্তা মনি এবার ভেবেই নিয়েছে, কি হতে চলেছে তাকে তা বের করতেই হবে। যত ঝড়-ঝাপটা আসুক সে হার মানবেনা। তাকে বের করতে হবে তার আব্বাজানের মৃত্যুর রহস্য। তাকে যে বের করতে হবে আসলে কি চলছে এখানে। একটা শ্বাস ফেলে পুনরায় তাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ভ্রু কুচকে আসে কান্তা মনির। তার বেশ সামনেই দু’জনের জায়গায় তিনজনকে দেখতে পাচ্ছে সে। একজন মারজান সরদার, একজন নওশাদ। তাহলে আর একজন কে? গঠন দেখেতো মহিলা মনে হচ্ছে। তবে কে এই মহিলা? মাথা যেন এত ভাবনায় ভাবনায় ঝিম ধরে যাচ্ছে কান্তা মনির।

হঠাত সময়ের কথা মনে হতেই জোর পায়ে স্থান ত্যাগ করে জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় কান্তা মনি। চারদিকে বিরাজমান অন্ধকারে যেন কিছুটা ভয় ভয় লাগছে। তার যে মনেই ছিল না যে অন্ধকারকে সে ঠিক কতটা ভয় পায়। নিজের প্রতি এতটাই তার আত্মবিশ্বাস যে এমন আকাশ বেয়ে নামা ঘোর অন্ধকারও তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি! আসলেই আত্মবিশ্বাস একটা মানুষকে ঠিক কতটা শক্তিশালী করে তুলতে পারে সবকিছুর উর্ধ্বে। অবাক হচ্ছে কান্তা মনি। হাতের তালু দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘামকে মুছে নিয়ে সামনে এগোয় কান্তা মনি।

কক্ষে এসে ধপ করে পালঙ্কের ওপর বসে পড়ে কান্তা মনি। হঠাত চোখ আচমকা তার পেটের দিকে যায়। সে কি ভুলেই গিয়েছিল যে তার মাঝে আরও একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে? এই অন্ধকারে যদি কোথাও হোচট খেয়ে পড়ে যেত! তাহলে কি হতো ভেবেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে কান্তা মনির। পেটে হাত বুলিয়ে বড় একটা নিশ্বাস নেয় কান্তা মনি। পানি তৃষ্ণা পেয়েছে অনুভব করায় চৌপায়ার ওপর তাকাতে নিতেই হঠাত থমকে যায় কান্তা মনি। জমিদার নিয়াজ মির্জা পানপাত্র ধরে আছে তার মুখের সামনে। নিয়াজ যে এতক্ষণ কক্ষেই ছিল তা সে একটা বার ও লক্ষ্য করে দেখেনি?

-আ আপনি কখন এলেন? (কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল কান্তা মনি)
-আগে পানিটুকু খেয়ে নাও। (পানপাত্রটি কান্তা মনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার পাশে বসে পড়ে জমিদার নিয়াজ মির্জা)

ঢকঢক করে পানিটুকু খেয়ে নেয় কান্তা মনি। শাড়ির আচল টেনে মুখটা মুছে নিয়ে কাঁপা কাঁপা চোখে জমিদার নিয়াজ মির্জার দিকে তাকায় কান্তা মনি।
-কোথায় গিয়েছিলে তুমি? (কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে জমিদার নিয়াজ মির্জা)

শুকনো ঢোক গিলে কান্তা মনি বলে ওঠে,
-আসলে একটু ফুফুমনির কক্ষে গিয়েছিলাম। কিন্তু ফুফুমনি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। তাই একটু বাইরে বেরিয়েছিলাম। বেশিদূর না। বাড়ির পাশটায় ছিলাম। (কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠে কান্তা মনি)
ক্ষেপে যায় জমিদার নিয়াজ মির্জা।
-আমি তোমাকে বলেছিলাম না! এই নিয়াজ মির্জার কোমলতা দেখেছো তুমি কিন্তু কঠোরতা দেখোনি। কোন সাহসে তুমি সিড়ি বেয়ে নিচে নেমেছো? আর এই সন্ধ্যা রাতে বাইরেই বা কার কাছে শুনে বেরিয়েছো? আমি তোমাকে বলেছি আমার কাছ থেকে না শুনে কখনো সিড়ি বেয়ে নিচে নামবেনা। এত দুঃসাহস দেখালে কিভাবে তুমি? (রাগে চোখ লাল হয়ে গেছে জমিদার নিয়াজ মির্জার)

ভয়ে কুকড়ে ওঠে কান্তা মনি। শাড়ির আচল খামচে ধরে ঠোট চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করে কান্তা মনি। আসলেই সে কিছুই চিন্তা না করে বেরিয়ে গেলো কিভাবে? আর নিয়াজও এত দ্রুত কিভাবে এলো। তার তো আসতে অনেক রাত হবে বলেছিল। তাহলে?

-কি হলো? কি বলছি কানে যাচ্ছেনা? (কান্তা মনির দিকে দুই কদম এগিয়ে গিয়ে বলে উঠল জমিদার নিয়াজ মির্জা)
ভয়ে পিছাতে পিছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় কান্তা মনির।

-আ আসলে সারাদিন কক্ষে থাকতে থাকতে এক ঘেয়েমি লাগছিল। তাই আরকি একটু বেরিয়েছিলাম। দোহায় লাগে রাগ করবেন না। (কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠল কান্তা মনি)

চোখ বন্ধ করে একটা বড়সড় স্বাস ফেলে জমিদার নিয়াজ মির্জা। হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে নিয়ে কান্তা মনির দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। কান্তা মনির হাত টেনে তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসে জমিদার নিয়াজ মির্জা বলে উঠল,
-কান্তা মনি তুমি বোঝো না? আমার তো ভয় হয় প্রতিনিয়ত তোমাকে নিয়ে। নিজের বিষয়ে একটু সাবধানতা অবলম্বন করো। আমিতো সব সময় থাকব না। তোমাকে চোখে চোখে কে রাখবে? তুমি কি জানো তোমার আমার এমন কি জমিদার বাড়ির সকলের প্রাণের ঝুঁকি রয়েছে? আমার কোনো কথার অমান্য করোনা কখনো। আমি যে তোমাকে আসক্ত। তোমার ভালোবাসায় আসক্ত। আমার প্রাণপ্রিয় বেগম অফুরন্ত ভালোবাসার সাগরে সর্বদা ভাসিয়ে রাখতে চাই তোমাকে। (জমিদার নিয়াজ মির্জা)

চোখ খিচে বন্ধ করে জমিদার নিয়াজ মির্জার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্তা মনি।
-এতো ভালোবাসেন? আমিতো এতো ভালোবাসার যোগ্য না। টিকবে তো আমার কপালে এই ভালোবাসা? এই অভাগীর কপালে যে সুখ বেশি দিন দীর্ঘস্থায়ী হয়না। আমি তো আপনার ভালোবাসায় পাগল হয়ে যাব। আল্লাহর আছে কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া আপনার মতো একজন স্বামী আমাকে দিয়েছেন। (কান্তা মনি)

আচমকা নিয়াজের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে টুকুস করে নিয়াজের গালে চুমু খায় কান্তা মনি। নিয়াজ গালে হাত দিয়ে মুচকে হেসে দেয়। কান্তা মনির কোমরা আকড়ে ধরে বলে ওঠে,
-তা দোষ যখন করলেই শাস্তি তো পেতেই হবে বেগম। (নিয়াজ মির্জা)
-ক কি শাস্তি? সত্যিই বলছি আর এমন ভুল করব না। (কান্তা মনি)
-শাস্তি পেতেই হবে। এক্ষেত্রে কাউকেই আমি ছাড় দেইনা বেগম। এখন আমি খাবার আনতে পাঠাচ্ছি। সব খেতে হবে। প্রতিদিনের মতো বাহানা দিলে চলবেনা বেগম। (নিয়াজ মির্জা)

বেগম নূর জাহান চোখ বন্ধ করে বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। কান্তা মনি মৃদু পায়ে বেগম নূর জাহানের কক্ষে প্রবেশ করে।

-আম্মা মাথা ব্যথা করছে? (কান্তা মনি)
বেগম নূর জাহান চোখ খুলে পাশ ফিরে তাকিয়ে সামনে কান্তা মনিকে দেখে নড়েচড়ে বসে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে ওঠেন,
-ওই একটু ধরেছে আরকি। (বেগম নূর জাহান)
-ঘুমান না রাতে ঠিক মতো? চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। কি এমন চিন্তা করেন যে রাতে ঘুমান না ঠিক মতো? শরীরটা ঠিক আছে তো আম্মা? মাথায় তেল দিয়ে দেই? একটু ঘুম আসবে। (কান্তা মনি)

-আহা। এই মেয়ে এই খারাপ মানুষের জন্য এতো দুশ্চিন্তা করার লাগবেনা তোমার। আমি ঠিক আছি। (বেগম নূর জাহান)
-আম্মা এভাবে কেন বলছেন? আমি তেল মালিশ করে দিচ্ছি। ভালো লাগবে। (কান্তা মনি)
হন্তদন্ত পায়ে তেলের শিশি নিয়ে এসে বেগম নূর জাহানের মাথায় তেল মালিশ করে দিতে লাগল কান্তা মনি।

হঠাত বেগম নূর জাহান কান্তা মনির হাত টেনে নিয়ে তার পাশে এনে বসান। বেগম নূর জাহান কান্তা মনির দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখের পানি বিসর্জন নিয়ে বলে ওঠেন,
-মারে আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছি মা। আমি সব সময় গরিব আর ধনীর মাঝে তফাৎ করার চেষ্টা করেছি। কখনো বোঝার চেষ্টা করিনি, সবার মাঝেই মন থাকে। আমার কৃতকর্মের অনুতপ্ততা আমাকে রাতে ঘুমোতে দেয়না মা। তোর এই মাকে ক্ষমা করে দে। আমি তোকে অনেক অত্যাচার করেছি। না জানি আমার চোখ না খুললে আরও কত কি করতাম। আমাকে ক্ষমা করে দে মা। আমি মানুষ চিনতে অক্ষম ছিলামরে।
-বেগম নূর জাহানের দুহাতে চুমু খেয়ে তার বুকে মাথা রেখে কান্তা মনি বলে ওঠে,
-আম্মা এভাবে বলবেন না। আমার কোনো ভুল থাকলে তা ক্ষমা করে দিয়ে আমাকে মেনে নিন আম্মা।
-তুই তো হেতিজার মতো আমার আরেকটা মেয়েরে। এখন থেকে তুই এই মায়ের বুকের মাঝে সংরক্ষিত থাকবি। (বেগম নূর জাহান)
-তোকে একটা কথা বলতে চাই মা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ। হয়ত না বললে অনেক বড় ভুল হয়ে যাবে।(বেগম নূর জাহান)

পুরো কথা বলার আগেই পেছন থেকে কারও কন্ঠ শুনে থেমে যান বেগম নূর জাহান।
#কান্তা_মনি
#পর্ব_১৬
#লেখনীতে_আফিয়া_অন্ত্রীশা

-তোকে একটা কথা বলতে চাই মা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ। হয়ত না বললে অনেক বড় ভুল হয়ে যাবে।(বেগম নূর জাহান)
পুরো কথা বলার আগেই পেছন থেকে কারও কন্ঠ শুনে থেমে যান বেগম নূর জাহান।

-কি গুরুত্বপূর্ণ কথা ভাবিজান? (মেহেরুন্নেছা)
আচমকা মেহেরুন্নেছার কন্ঠ পেয়ে কান্তা মনি ঘাড় ঘুরিয়ে মেহেরুন্নেছার দিকে তাকায়।

-তেমন কিছুইনা মেহেরুন। (নূর জাহান)
-বললে গুরুত্বপূর্ণ আবার বল তেমন কিছুনা ! নাকি আমাকে বলা যাবে না ভাবিজান? (মেহেরুন্নেছা)
-আরে আমি ওকে ওর এই সময়ের সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাচ্ছিলাম। যেগুলো না বললে ভুল হবে। এই আরকি। (বেগম নূর জাহান)
-ওহ আচ্ছা। তা বউ-শাশুড়ির মধ্যে এত সখ্যতা কিভাবে হলো হঠাত? (হেসে দিয়ে বলে উঠলেন মেহেরুন্নেছা)
-ওই কোনো এক ভাবে। মানুষের চোখ কখন খুলে যায় কেউ বলতে পারে? কাছের মানুষেরা ঠকিয়ে আমাকে মানুষ চেনা শিখিয়ে দিয়েছে। (বেগম নূর জাহান)
-মানে? কে ঠকিয়েছে তোমাকে ভাবিজান? (মেহেরুন্নেছা)
-আরে এমনিই একটু ঠাট্টা করলাম। তোর হাতের বেগুনি খেতে ইচ্ছে করছে মেহেরুন। বানাবি? (বেগম নূর জাহান)
-আরে কেন বানাবোনা। এখনই যাচ্ছি আমি। (মুচকি হেসে বলে ওঠেন মেহেরুন্নেছা)

মেহেরুন্নেছা কক্ষ হতে বের হয়ে যেতেই বেগম নূর জাহান কান্তা মনির দিকে তাকান।
-কান্তা মনি! (বেগম নূর জাহান)
-জ্বি আম্মা। (কান্তা মনি)
-আমার ছেলেটার প্রাণের ঝুঁকির রয়েছে রে মা। তুই আমার ছেলেটার খেয়াল রাখবি মা। আমারও কখনো কিছু হয়ে যেতে পারে। আপনজনেরাই বারংবার আঘাত করবে। কিন্তু টিকে থাকতে শিখতে হবে। আজ আমার চোখ না খুললে হয়ত আমার সব থেকে প্রিয় জিনিসটা আমার দোষেই হারিয়ে যেত। মেহরিনকে নিয়াজের ধারে কাছেও ঘেষতে দিবিনা। (বেগম নূর জাহান)
-বিশাল ষড়যন্ত্র হচ্ছে আম্মা। আমি আগেই আচ করতে পেরেছি। কিন্তু আমার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ না এলে কিভাবে আমি ওনাকে সব খুলে বলব? কখন কি ঘটে যায় আমার খুব ভয় হয় আম্মা। কিন্তু হাতেনাতে না ধরে কিছুই করে উঠতে পারছিনা। ওনাকে যতদ্রুত সম্ভব সব জানাতে হবে। আম্মা আপনি আমার পাশে থাকবেন তো? (কান্তা মনি)
-তা আর বলতে? (বেগম নূর জাহান)

-ভাবিজান কি করো? (হেতিজা)
-এইতো আমার হেতিজা বুবুর বানানো আচার খাচ্ছি। (কান্তা মনি)
কান্তা মনির পাশে হেতিজা ধপ করে বসে পড়ে। কান্তা মনির পেটে কাছে কান এনে হেতিজা বলে ওঠে,
-এই যে একটু তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসুন তো। আপনার ফুফুমনির যে তর সয় না। আপনার ছোট ছোট হাত-পা গুলো নাড়িয়ে নাড়িয়ে খেলা করা দেখব। ফুফুমনি আপনাকে অনেক ভালোবাসবে। খাইয়ে দেবে। গোসল করিয়ে দেবে। ঘুম পাড়িয়ে দেবে। ঘুরতে নিয়ে যাবে। আম্মাজানকে একদম কষ্ট দেবে না বুঝেছেন?

কান্তা মনি ফিক করে হেসে ফেলে।
-এই যে হেতিজা বুবু! ইনি আসতে এখনো অনেক দেরি আছে। এত দ্রুত ধৈর্য্য হারালে চলবে? (কান্তা মনি)
হেতিজা ঠিক হয়ে বসে কান্তা মনির গাল টেনে দিয়ে বলে ওঠে,
-আমার ভাবিজান এত সুন্দর। না জানি আমার ভাতিজা/ভাতিজিটা কত সুন্দর হবে। ইশ আমার তো এখনই মন চাইছে যদি এখনই ইনি বের হয়ে এসে আমার কোলে ঝাপিয়ে পড়ত।

কান্তা মনি হেতিজার কথা শুনে হেসে কুটি কুটি হয়ে যায়।
-হাসো হাসো। বেশি করে হাসো। (ভেংচি কেটে বলে ওঠে হেতিজা)

-এত হাসাহাসি কিসের তোমাদের? (যোহরা)
-আরে যোহরা বুবু ভেতরে আসো। (কান্তা মনি)
-আসছে ঝামেলার বস্তা। (বিরবির করে বলে ওঠে হেতিজা)

-দেখি কি খাচ্ছো তুমি! ওমা আচার? কে বানিয়েছে এটা? জানো আচার আমার অনেক প্রিয়। আমি নিয়ে নেই এটা? (যোহরা)
-হুম অবশ্যই। নাও। (মুখে স্বভাব সুলভ হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে কান্তা মনি)
-দাড়া যোহরা। এই আচার আমি ভাবিজানের জন্য বানিয়েছি। ভাবিজানের জন্য কেন বানিয়েছি তা তো তোর অজানা নয়। এটা এদিকে দে। নিজে বানিয়ে খা পারলে। (হেতিজা যোহরার হাত থেকে আচারের জারটি ছো মেরে নিয়ে নেয়)
-হেতিজা! তুই! (যোহরা)
-আমি কি? (ভ্রু কুচকে বলে ওঠে হেতিজা)
-তোকে দেখে নেবো আমি। (বলেই হনহন করে কক্ষ হতে বেরিয়ে যায় যোহরা)
-এটা কি করলে তুমি? (কান্তা মনি)
-তুমি থামো। এতো মায়া দেখানো লাগবেনা তোমার বুঝেছো? (হেতিজা)

জানালার পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কান্তা মনি। শীতের সকালে সূর্যের মিষ্টি রোদ শরীরে এবং মনে অদ্ভুত এক অনুভূতির সৃষ্টি করে। গাছের ডালে বসে থাকা একজোড়া দোয়েলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কান্তা মনি। হঠাত বাইরে নিচের দিকে চোখ যায় কান্তা মনির। আহসান মির্জা আর শাহ সুলতান মির্জা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কি যেন বলাবলি করছে। হঠাত শাহ সুলতান মির্জার হাতে কাপড়ে পেচানো কিছু একটা তুলে দেয় আহসান মির্জা। ভ্রু কুচকে আসে কান্তা মনির।

হঠাত পেছন থেকে বলিষ্ঠ একজোড়া হাত কান্তা মনির কোমর আকড়ে ধরতেই কেপে উঠে পেছনে ফিরে তাকায় সে।
-ওহ আপনি? (চোখ বন্ধ করে একটা দম নেয় কান্তা মনি)
-আমি ছাড়া আর কে হবে হুম? (কান্তা মনির কাধের ওপর থুতনি ঠেকিয়ে বলে ওঠে নিয়াজ মির্জা)
-না হঠাত এভাবে ধরায় একটু ভয় পেয়েছিলাম। (কান্তা মনি)
-তোমার চোখ-মুখ এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন? কিছু খাওনি? কি নিয়ে দুশ্চিন্তা করছো তুমি? আমাকে সত্যি সত্যি বল। (কান্তা মনিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে হন্তদন্ত কন্ঠে বলে ওঠে জমিদার নিয়াজ মির্জা)
-আরে বাবা কিছুই হয়নি আমার। আব্বার জন্য মন কেমন করছিল। আব্বার কবরটা অনেক দিন দেখিনা। কালকে একটু যেতে মন চাইছে। যাব? (কান্তা মনি)

জমিদার নিয়াজ মির্জা পালঙ্কের ওপর এসে বসে পড়ে।
-আমি তো কাল অনেক ব্যস্ত থাকব। জমিদারি দায়িত্ব যে। আমি হেতিজাকে বলব তোমাকে নিয়ে যাবে। ঠিক আছে। (নিয়াজ মির্জা)

জমিদার নিয়াজ মির্জার কথার উত্তরে মাথা কাত করে ‘হ্যা’ সূচক ইঙ্গিত দেয়। নিয়াজের মুখপানে তাকিয়ে মুখটা মলিন হয়ে যায় কান্তা মনি। মানুষটা কি কষ্ট করছে দিন-রাত। কান্তির ছাপ যে ভিষণ ভাবে জেঁকে বসেছে জমিদার নিয়াজ মির্জার চোখে-মুখে। কান্তা মনি চৌপায়ার ওপর থেকে পানপাত্রে পানি ঢেলে নিয়াজ মির্জার সামনে ধরে।
কান্তা মনিকে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে ঢক ঢক করে পানিটুকু খেয়ে নেয় নিয়াজ মির্জা।

-শুনলাম আম্মাজানের মনও নাকি চুরি করে নিয়েছো হুম? (জমিদার নিয়াজ মির্জা)
মুচকি হাসে কান্তা মনি।
-হুম। আম্মা আমাকে মেনে নিয়েছেন। (খুশির ঝলক ফুটে ওঠে কান্তা মনির চোখে-মুখে)
নিয়াজ কান্তা মনিকে টেনে বুকের মাঝে মিশিয়ে নেয়।

রমিজ হাওলাদারের কবর থেকে কিছুটা দূরে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কান্তা মনি। হাত উঠিয়ে আল্লাহর দরবারে তার প্রিয় আব্বার জন্য প্রাণভরে দোয়া করে কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে তার আম্মার কবরের দিকে যায়। আম্মার জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করে হেতিজাকে নিয়ে হাওলাদার বাড়িরে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় কান্তা মনি। রাহেলাকে তার ভাইজান নিয়ে গেছেন বেশ কয়েক মাস হয়েছে।

সরদার বাড়ির সামনে থেকে অতিক্রম হওয়ার সময়ই দাঁড়িয়ে পড়ে কান্তা মনি আর হেতিজা। কান্তা মনি ঘোড়ার গাড়ি বিদায় দিয়েছে সেই হাওলাদার বাড়ির সামনে এসে নেমেই। মেহরিন আর মারজান সরদারকে সরদার বাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা ঝোপের পেছনে হেতিজাকে নিয়ে লুকিয়ে পড়ে কান্তা মনি।

-আব্বা ওই কান্তার আব্বা তো বড় একটা প্রমাণ ছিল আমাদের বিরুদ্ধে। না জানি সরিয়ে না দিলে কি হতো। কেউ বুঝতেও পারল না রমিজ হাওলাদারের হত্যা এই সরদার বাড়িতেই হয়েছে। হাহাহা। (হাসতে হাসতে বলে ওঠে মেহরিন)
-আস্তে কথা বল মেহরিন। কথা কিছু হাওয়ায় ভাসে। তাই সাবধান। এখন পরিকল্পনা মোতাবেক এগোতে হবে। লক্ষ্য পূরণ হলেই কেল্লাফতে। (মারজান সরদার)

কান্তা মনির চোখ ইতোমধ্যে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠে হাত মুঠো পাকিয়ে নেয় কান্তা মনি। হেতিজা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here