#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ১৯
(৬১)
ইশরাতের মেডিক্যাল এডমিশন টেষ্টের রেজাল্ট এসেছে। সে মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। আজকে ইশরাত এবং সাদমানের পরিবারের খুশির অন্ত নেই। ইশরাত নিজে খুশি হয়েছে, তার পরিবার খুশি হয়েছে সেটা সবই বুঝলো৷ কিন্তু সাদমানের পরিবারের এতো খুশির কারণ সে তৎক্ষনাৎ ঠাউর করতে পারেনি। বিশেষ করে আশ্চর্য হয়েছিলো সে সাদমানের ব্যবহারে। রেজাল্ট পাবলিশ হয়েছে সেটা শোনার পর যেন ইশরাতের থেকে সাদমানের চিন্তা বেশি ছিলো। সবাই একসাথে বসেছিলো গোল হয়ে। আর সাদমান নিজেই ইশরাতের এডমিট কার্ড এনে নাম্বার এন্ট্রি করে রেজাল্ট চেক করছিলো। রেজাল্ট চেক করার পরপরই এক লাফে সোফা থেকে দাঁড়িয়ে গেল সাদমান। এরপর সবার সামনে জোরে এক চুমু খেল ইশরাতের গালে। এদিকে লজ্জায় দিশেহারা হয়ে লুকানোর জায়গা খুঁজতে লাগলো ইশরাত।
কিন্তু একসাথে গোল হয়ে বসে থাকার দরুন বেচারি ইশরাত সেখান থেকে কেটে পড়ার জায়গাটুকুও পাচ্ছিলো না। তবে সাদমান শুধু এতোটুকু পর্যন্তই ক্ষান্ত হয়নি। ইশরাতকে কোলে তুলে খুশিতে ঘুরছিলো। এদিকে আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে ইশরাত যেন কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতেও ভুলে গিয়েছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো তার আব্বু আম্মু এবং সাদমানের আব্বু আম্মু মুখ চেপে হেসে চলেছে অথচ কেউ কিছু বলছে না। যেন এমনটা হলে কোনো সমস্যাই নেই। মিশরাত বেশ সময় নিয়ে চাপা হেসেছে। তবে সময় বাড়ার সাথে সাথে নিজের হাসির উপর আর নিয়ন্ত্রণ রইলো না তার। পেট চেপে হো হো করে হেসে উঠলো। এদিকে সাদমানের থামার কোনো লক্ষণ না দেখে মৃদুস্বরে ইশরাত বললো
—-কী হচ্ছে টা কী এসব? নামান আমাকে কোল থেকে। সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।
—-থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ সোনা। কতোটা দিন! কতোটা দিন আমি অপেক্ষা করেছি এই দিনটার জন্য। অবশেষে আমার স্বপ্ন পূরণ হলো। আমি যে কতোটা খুশি হয়েছি তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।
এতোক্ষণ যাবত কেবল সাদমানের কার্যকলাপেই অবাক হচ্ছিলো ইশরাত। তবে এখন তার সাথে যোগ হয়েছে সাদমানের কথা বলার নমুনাও। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাকে এটা কী বলে সম্বোধন করলো সাদমান?
—-এসব কী বলছেন আপনি? এটা আপনার স্বপ্ন কবে থেকে হলো?
—-সে অনেক কথা। সব বলবো পরে। তবে এখন খুশি সেলিব্রেট করার সময়।
—-আরে ইয়ার, এবার তো আমার বোনটাকে নিচে নামাও? সেই কখন থেকে কোলে নিয়ে আছো!
মিশরাতের কথায় যেন সাদমানের হুঁশ ফিরলো। নিজে খানিকটা লজ্জা পেলো বটে। তবে সেটা প্রকাশ্যে আনলো না। চুপচাপ ইশরাতকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। তবে মেডিক্যাল এডমিশনের রেজাল্ট শোনা থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত একটা প্রশান্তির হাসি ছেয়ে আছে সাদমানের চোখেমুখে।
ইশরাত আশেপাশে একবার তাকালো। ব্যাপক আশ্চর্য সে। তার আব্বু আম্মু এখনো চুপ করে আছে! ঘটনার কারণ আগামাথা কিছুই না বুঝে চুপচাপ সেখান থেকে চলে গেল ইশরাত। সবার থেকে একবার অনুমতি নিয়ে ইশরাতের পিছুপিছু গেলো সাদমান। রুমে ঢুকে ইশরাত দরজা বন্ধ করতে নেবে তবে তার আগেই দেখে হাসিমুখে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সাদমান। সাদমানকে দেখেও ইশরাত বিশেষ একটা পাত্তা দেয়নি। দরজা বন্ধ করতে উদ্যত হলো। ঠিক তখনই দরজা হাত দিয়ে আটকিয়ে দিলো সাদমান। রুমের ভেতরে ঢুকে নিজেই দরজা লাগিয়ে দিলো। ইশরাত ব্যাপক বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে সাদমানের দিকে।
—-কী সমস্যা আপনার? সেই কখন থেকে এরকম করছেন কেন?
ইশরাতের হাত ধরে বিছানায় নিয়ে বসাতে লাগলো সাদমান। তবে তার আগেই হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে নিলো ইশরাত।
—-আশ্চর্য! দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলতে পারেন না? এমন হুটহাট গায়ে হাত দেওয়া কোন ধরনের স্বভাব?
—–যার তার গায়ে হাত দিচ্ছি কী? সাদমান হাসান যার তার সাথে কথাও বলে না। আর গায়ে হাত দেওয়া কোন ছাড়! তাও মেয়ে মানুষ হলে তো নাউজুবিল্লাহ!
—–কেন? আমার কী আপনাকে দেখতে ছেলেমানুষ মনে হয়?
—–একবারও সেটা বলেছি? মেয়ে মানুষের গায়েও আমি হাত দিতে পারি, তবে তার সাথে আমার সম্পর্কটা কী সেটার উপর ভিত্তি করে।
—–তো আমার সাথে আপনার কী সম্পর্ক? প্রেমের? নাকী আপনি আমার হাসবেন্ড? কোনোটাই না।
—-হতে কতোক্ষণ?
—-মানে? আপনাকে কে বিয়ে করবে? আমি?
—-হ্যাঁ।
—-করবো না। আমি বাধ্য নই।
—–তুমি বাধ্য। কারণ আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাই তোমাকে বাধ্য করবে।
—-আন্দাজে কথা বানাবেন না। ওইসব আমার ঠুনকো আবেগ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।
—-বেশ বুঝদার হয়ে গেছো দেখছি? দু’দিনেই আবেগ আর ভালোবাসার পার্থক্য গড়ে ফেললে?
—-বোকা ছিলাম তাই আপনার পিছুপিছু ঘুরছিলাম। আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করেছেন সেটাও আমি ভুলিনি! যদি সত্যিই আমাকে আপনার পছন্দ না হতো, তবে কেন সেবার আমার পরীক্ষার সময় সায় দিয়েছিলেন? এরপর কেন এতোটা দূরদূর করে তাড়িয়ে দিতেন যখনই আপনার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতাম? বলুন? এখন তাহলে কেন এসেছেন? দূরেই থাকুন আমার থেকে। বুঝতে পেরেছেন?
মুচকি হেসে ইশরাতকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে নিজের থুতনি ঠেকালো সাদমান। প্রায় সাথে সাথেই লাফিয়ে ইশরাত দূরে সরে যেতে চাইলো। কিন্তু নিজেকে সাদমানের বাহুবন্ধনী থেকে মুক্ত করতে পারলো না। চাপা স্বরে বললো
—-আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন। আমি কিন্তু চিৎকার করবো এবার! আমার রুমে এসে দরজা বন্ধ করে এসব কী ঘেষাঘেষি করছেন হ্যাঁ? এই মুহুর্তে সবাইকে বলে দিবো বললাম!
—-তাই? কী বলবে?
—-এই যে জোর করে ধরে রেখেছেন আমায় পেছন থেকে সেটা।
—-ঠিক আছে। বলো। চিৎকার করে বলো।
—-আমি কিন্তু সিরিয়াস!
—-আমিও। করো যা করার। মানসম্মান তোমারই যাবে। আমার কী? আমি তো আমার অধিকারের বলেই ধরেছি। এখন কী নিজের বউকেও ধরতে পারবো না?
—-কে বউ? কীসের বউ?
—-সেটা তোমার আব্বু আম্মু বা আপুকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। আজকেই জিজ্ঞেস করে নিও। কেমন? এমনিতেও সময় বেশি দিন নেই। মানসিক প্রস্তুতি বলতেও তো একটা কথা আছে।
—-কীসের জন্য সময় নেই? কীসের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছেন?
ইশরাতের কাঁধে ছোট্ট একটা চুমু এঁকে তাকে ছেড়ে দিলো সাদমান।
—-আমার মিষ্টি কিনতে যেতে হবে। এতো কথা বলার সময় কই? আমি ছাড়াও অনেকেই আছে। এখুনি গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারো। সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, রাতে ফোন করবো। রিসিভ করতে যেন বিলম্ব না হয়।
সাদমান চলে যাওয়ার পর এখনো ইশরাত নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে মুখ হা করে তাকিয়ে আছে দরজা বরাবর। অজান্তেই নিজের বাম হাতে কাঁধে চলে গেল। ঠিক একটু আগে যে জায়গায় সাদমানের স্পর্শ পেয়েছিলো সে। অজানা শিহরণে পুরো শরীর কেঁপে উঠলো ইশরাতের।
(৬২)
—-মানে? আমার বিয়ে আর আমিই জানি না? এটা কেমন কথা আব্বু? আর আপু, শেষ পর্যন্ত যে তুইও সবার সাথে তাল মেলাবি সেটা আমি ভাবতে পারিনি। তোর থেকে এটা একদমই আশা করিনি আমি।
রীতিমতো গলা উঁচিয়ে চেঁচানো শুরু করেছে ইশরাত। তার কারণ একটাই, এই মাত্র সে জানতে পেরেছে তার বিয়ের পাত্র আগের থেকে ঠিক করা এমনকী বিয়ের সম্ভাব্য তারিখও। তবে স্বয়ং পাত্রী হওয়া সত্ত্বেও সে নিজেই অবগত নয় এই ব্যাপারে।
—-ইশু আম্মু, তোর আব্বুর উপর বিশ্বাস নেই তোর? তোর খারাপের কথা আমি তো কখনো ভাববো না, তাই না?
—-আমি সেটা একটাবারের জন্যও বলিনি আব্বু। কিন্তু এভাবে হুট করে কেন? আর পাত্র আমার পছন্দ না অপছন্দ তা তোমরা একবারও জানতে চেয়েছো?
—-সাদমানকে তোর অপছন্দ? সত্যি?
—-আমি জানি আপু হয়তো তোমাকে সবই বলেছে। কিন্তু…
—-না ইশু, মিশু আমাকে কিছুই বলেনি। আমি নিজেই সবকিছু আগের থেকে জানতাম। তোর সাথে সাদমানের বিয়ে আমি আজকে নয়, বরং তিন বছর আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। শুধু পার্থক্য হলো মাস সাতেক আগে সাদমানের আব্বু আম্মু আর তোর আম্মু জানতে পেরেছে।
—-কিন্তু তোমরা আমার ব্যাপারটা বুঝতে পারছো না। কী করে বলি তোমাদের? এই যে আপু, তুই তো সব জানিস। তোর বন্ধু আমার সাথে কেমন ব্যবহার করতো। এরপরেও তুই চুপ আছিস? তার সাথে হাসতে হাসতে বিয়ে করতে বলছিস?
—-তোর সাদমানের সাথে কথা বলা প্রয়োজন ইশু। আমার মনে হয় সবকিছু শুনলে তুই এতোটা রিয়েক্ট করতি না।
—-আমি কিচ্ছু জানতেও চাই না, শুনতেও চাই না। আমি শুধু এতোটুকুই বলতে চাই যে….
কথা শেষ করার আগেই ফোন বেজে উঠলো ইশরাতের। সাদমান ফোন করছে। প্রথমবার ফোন না ধরে আবারও কথা বলতে উদ্যত হলে ঠিক সেই মুহুর্তে মেসেজ আসে ইশরাতের ফোনে সাদমানের নাম্বার থেকে।
“ফোনটা রিসিভ করো, কুইক। আগামীকাল অফিসে যেতে হবে। তাই এখুনি কথা বলা জরুরী। সময় নেই বেশি। ঘুমিয়ে পড়বো একটু পর।”
ইশরাত আর কিছু না বলে নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় বসলো। এরমধ্যে ফোন আসলো সাদমানের নাম্বার থেকে। ফোন কানে লাগিয়েই কিছু একটা বলতে যাবে তার আগে সাদমানের কন্ঠ সে শুনতে পেলো
—-উত্তেজিত হয়ো না, চিৎকার চেঁচামেচি করো না। ঠান্ডা মাথায়, আবেগ ছেড়ে বিবেক দিয়ে বিচার করবে। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছো। এখন আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন তোমার। আমার পক্ষ থেকে যা বলার সেগুলো আমি সবার আগে পরিষ্কার করবো। তুমি শুধু শুনবে আর মন বাদে মস্তিষ্ক দিয়ে বিচার করবে। আমি কী করেছি আর কেন করেছি সেগুলোর ভবিষ্যত চিন্তা করবে এরপর যা বলার বলবে। প্রথম থেকে বলছি। শোনো।
(৬৩)
—-ব্যাগ গুছিয়ে ফেল। আর হচ্ছে না।
ফোন হাতে নিয়ে নিজের আর মিশরাতের হাসোজ্জল ছবি দেখছিলো আরিয়ান। ছবিটা প্রায় সাত-আট বছর আগের তোলা। তখনও মিশরাত আরিয়ানের কাছে নিজের মনের অনুভূতি ব্যক্ত করেনি। তাই শোয়েব রহমানের মেয়ে হওয়ার দরুন মিশরাতের সাথে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক ছিলো আরিয়ানের। ছবিটা মিশরাতের জন্মদিনের। জন্মদিনের কেক আরিয়ান নিজে কিনে এনেছিলো এবং ছবিতে মিশরাত আরিয়ানকে কেক খাইয়ে দিতে নিচ্ছিলো এরই মধ্যে আরিয়ান মিশরাতের গালে কেকের ক্রিম লাগিয়ে দিচ্ছিলো। দু’জনের মুখেই অনাবিল হাসি। তখনও একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিলো আরিয়ান আর মিশরাতের মাঝে। মিশরাত আরিয়ানকে তখন থেকে পছন্দ করলেও সেটা প্রকাশ করেনি বিধায় আরিয়ানের সাথে তার দূরত্বও সৃষ্টি হয়নি। মূলত, মিশরাতের অনুভূতি প্রকাশের পর থেকেই আরিয়ান ক্রমশ তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখতো। তবে এই ছবিতে দু’জনের মুখে অকৃত্রিম হাসি লেপ্টে আছে। ছবিটায় মিশরাতের অংশটুকু জুম করে দেখছিলো আরিয়ান। স্বচক্ষে দেখার তৃষ্ণা এখন ফোনে ছবিতে তাকিয়েই মিটাতে হচ্ছে তার। তবে সেটাও করতে দিলো না আরাভ। হুট করে বলে বসলো ব্যাগ গোছাতে।
—-আরে ওই আরিয়ান, বলছি তো কিছু আমি?
—-এখন বিরক্ত করিস না তো! যাহ্, আমি আমার মিশুকে দেখছি।
—-হ্যাঁ, ফোনে দেখছিস। আর আজীবন ফোনেই দেখে যাবি। স্বপ্ন দেখতে থাক সজাগ থেকে। ওই মেয়ের ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিস তো? এইতো কয়েকদিনের মধ্যে তোকে ফোন দিলো বলে।
আরাভের কথাগুলো এতোক্ষণ যাবত খুব বিরক্তিকর লাগলেও শেষের কথাটায় যেন মন নেচে উঠলো আরিয়ানের। খুশিতে চোখ দু’টো চিকচিক করে উঠলো৷ ফোন হাত থেকে রেখে দ্রুত আরাভের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। উত্তেজনা যেন বেড়েই চলেছে তার।
—-সত্যি বলছিস আরাভ? মিশু ফোন করবে আমাকে? তুই জানলি কীভাবে? তোকে ফোন করেছিলো নাকী? না, তা তো হওয়ার কথা না। আচ্ছা, এমনটা নয় তো যে আমাকে ফোন করেছিলো কিন্তু আমি ধরতে পারিনি? শিট! কী করলাম বল তো এটা? দাঁড়া, কললিস্ট চেক করি একবার।
আরিয়ানের ব্যবহারে আরাভ আহাম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে বললো কী আর ছেলেটা বুঝলো কী!
কললিস্ট ঘেঁটে একাকার করে ফেলছে আরিয়ান।
—-আমার কথা শুনবি তো পুরোটা? তোকে কী আমি বলেছি ওই মেয়ে তোকে ফোন দিয়েছিলো? বলেছি যে ফোন দিবে। শত হলেও তোদের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিলো এক সময়! তুই যেভাবে পিছু নিয়েছিলি, তো তোকে নিজের বিয়ের দাওয়াত দেবে না তা কী হয়?
স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আরিয়ান আরাভের দিকে। আরাভের কথাটা মনে হলো আরিয়ানের বোধগম্য হলো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
—-কী বললি তুই?
—-ওই মেয়ের জন্য ছেলে মোটামুটি ঠিকঠাক। বিয়ে ধরতেও হয়তো খুব বেশি দেরী করবে না। সেদিন এমনি মুখের কথা বলেছিলাম। তবে এখন মনে হচ্ছে আমার সেদিনের বলা কথাটাই ফলতে চলেছে।
—-মিশু এমনটা করতে পারে না আরাভ। আমি এতোদিন ধরে তার জন্য ছটফট করলাম। এর কী কোনো মূল্য নেই? এমনটা হতে পারে না আরাভ। তুই ভুল খবর পেয়েছিস হয়তো। যার থেকে খবর পেয়েছিস তাকে আবারও ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে বল।
—-ঘটনা পুরোপুরি সত্য। মেয়ে দেখা হয়ে গিয়েছে। ছেলে সমেত এসেছিলো মেয়ে দেখতে। ছেলের সাথে মিশরাতের ছবি দেখবি?
আরাভ আরিয়ানকে যে ছবিটা দেখালো তাতে একটা ছেলের সাথে মিশরাত দাঁড়িয়ে আছে মিশরাতের বাসার বাইরে। সেই ছবিতে অবশ্য মিশরাতের পরিবার এবং সাদমানের পরিবারের লোকজনও আছে। তার সাথে আরও দু’জন বয়স্ক পুরুষ মহিলা। সম্ভবত মিশরাতের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির মা-বাবা।
—-ছেলের নাম নিশান হোসেন। মিশরাতের হবু স্বামী। এবার অন্তত বাস্তবে ফিরে আয়? প্রায় নয় মাস যাবত পড়ে আছিস এই শহরে। নিজের কাজ, পরিবার সব ছেড়ে। ফলাফল কী? শূন্য। এবার আগামীকালের জন্য ব্যাগপত্র গোছা। এই শহর ছাড়ছি আমরা।
আরাভ কথাগুলো বলে রুম থেকে চলে গেল। নিজের রুমে গিয়ে টুকটাক নিজের কিছু ব্যক্তিগত কাজ সেরে নিয়ে ফিরলো আবার আরিয়ানের রুমে। তবে রুমে এসে চোখ কুঁচকে এলো তার। কারণ আরিয়ানকে সে রুমে দেখতে পায়নি। সামান্য হেঁটে রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় চলে গেল আরাভ। সেদিকে গিয়ে দেখতে পেল আরিয়ান বসে আছে। তবে তার দিকে মুখ করে নয়, আরিয়ানের পিঠ তার দিক বরাবর। মুখ অপরপাশে। আরিয়ানের পিঠে হাত রেখে আরাভ ডাক দিলো
—-আরিয়ান?
সাথে সাথেই আরাভের দিকে ফিরে তাকালো আরিয়ান। আরিয়ানকে দেখে ভয়ে খানিকটা কেঁপে উঠে একটু পিছিয়ে গেল আরাভ। চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে তার। আর হাতের উল্টো পিঠ থেকে রক্ত বের হয়ে আসছে। সেই পুরোনো অভ্যাস আরিয়ানের। রাগ উঠলে নিজের হাত নিজেই কামড়াতে থাকা। আরাভ তার সাথে থাকলে কোনোমতে শান্ত করে রাখে জোর করে। কিন্তু আরাভের অনুপস্থিতির এই হলো হাল।
—-কী করছিস তুই এগুলো হ্যাঁ? কামড়াতে কামড়াতে রক্ত বের করে ফেলেছিস। ঠোঁটেও রক্ত লেগে আছে তোর। কী পরিমাণ ভয়ংকর লাগছে দেখতে তোকে জানিস? আয়, আমার সাথে রুমে আয়।
আরিয়ান এক চুলও নড়লো না। হিসহিস করতে লাগলো। এরপর ক্ষীণস্বরে বললো
—-আজকাল আসলেই ভালোর দাম নেই আরাভ। আমার ভুল ছিলো আমি মিশরাতের সাথে জোর করিনি। সে আমার এই ভালোমানুষির দাম দিলো না। আর এখন? এখন চাইলেও আমি তাকে জোর করতে পারবো না। করবো টা কী করে? আমি তো তার সাথে দেখাই করতে পারবো না। নিজের কসম দিয়ে আমাকে আঁটকে রাখলো। আমি হেরে গেলাম আরাভ। নমনীয়তা দেখাতে গিয়ে আমি হেরে গেলাম।
প্রচন্ড রাগে কাঁপতে থাকা আরিয়ান মুহুর্তের মধ্যে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে একটাই কথা বলছে সে
—-মিশু এটা ঠিক করলো না আরাভ। সে এভাবে কৌশলে আমার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেবে আমি ভাবতেও পারিনি। আমি তাকে সেদিন মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডেকে অপমান করেছিলাম। তার বদলা সে এভাবে নিলো আরাভ? এভাবে? আমি কী করবো রে আরাভ? আমি যে থাকতে পারবো না তাকে ছাড়া।
আরাভ আরিয়ানের পাশে গিয়ে বসলো। বসা মাত্রই তাকে ধরে হুহু করে কাঁদতে লাগলো আরিয়ান। আজ তার কান্না থামছে না। এই কান্না থামবে না আরাভও জানে। আরিয়ানের কান্না দেখে নিজের চোখের পানি আঁটকে রাখতে পারলো না আরাভ। মিশরাতের উপর রাগ হচ্ছে তার। অসম্ভব রাগ।
চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)
[