অনুভূতির অন্বেষণ পর্ব -১৭+১৮

#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ১৭

(৫৪)

সেদিন আরিয়ানের সাথে এভাবে কথা বলার পর নিজের মনেও কেমন খচখচ করে মিশরাতের। কাউকে না জানিয়ে সেদিন সে আরিয়ানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। ইশরাত এমনকী সাদমানও না। তার এখন সেই ঘটনার জের ধরে তার মনে যা কিছুই চলুক না কেন সে কাউকে কিছু বলতেও পারছে না।

আজকে অফিস থেকে এসে গোসল করে খেয়েদেয়ে মনমরা হয়ে বিছানায় পড়ে আছে মিশরাত। তার কিছুই ভালো লাগছে না। দরজায় নক করার শব্দ কানে গেল তার। সেই সাথে শোয়েব রহমানের কন্ঠ

—-আম্মু, ঘুমিয়ে গিয়েছিস? আমি কী এখন আসবো?

তাড়াতাড়ি উঠে বসে শোয়েব রহমানকে ভেতরে আসতে বললো মিশরাত। শোয়েব রহমান এসে বসলেন মেয়ের পাশে

—-ক্লান্ত লাগছে বেশি আম্মু?

—-না আব্বু, ওই একটু শুয়েছিলাম আর কী।

—-তোর জন্য ইদানীং ভীষণ চিন্তা হচ্ছে আমার আম্মু। তোর বিয়ের জন্য ছেলে দেখা নিয়েই ভাবছি এখন। পত্রিকায় “পাত্র চাই” নামে বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছি। সেখান থেকে অনেকগুলো ফোন এসেছে। তবে একটা আমার ভীষণ মনঃপুত হয়েছে। ছেলের পরিবার স্বচ্ছল, শিক্ষিত। ছেলে খুব ভালো একটা চাকরী করে। দেখতে শুনতেও ভালো লাগলো আমার। ছেলের ছবি আমার কাছে আছে। পাত্রপক্ষ পাঠিয়েছে। দেখবি আম্মু?

—-না আব্বু। আমি তো আগেই বলেছি আমার কোনো পছন্দ নেই। তোমাদের যেই ছেলেকে আমার জন্য সঠিক মনে হয়, আমি তাকেই বিয়ে করবো। ছেলে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সবকিছু ঠিকঠাক করা হয়ে গেলে আমাকে জানিয়ে দিও।

—-ছেলের নামটাও তো জিজ্ঞেস করলি না আম্মু?

—-নাম দিয়ে আর কী আসে যায় আব্বু? যা ইচ্ছে হোক, যেমন ইচ্ছে হোক দেখতে। যেহেতু আমার কোনো পছন্দ নেই, তাই তোমরা যে ছেলেকে আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলবে বিয়ে করতে, আমি তাকেই করবো।

—-বেশ, তবে তাই হোক। যাই হোক, একটা মজার কথা বলি তোকে। তোর আম্মুর সাথে আজকে কথা বলে বুঝলাম, তোর আম্মু সাদমানকে তোর জন্য পছন্দ করে বসেছিলো।

—-কীহ্! লাইক সিরিয়ালি? বাইরের মানুষ যা ইচ্ছে ভাবুক। তাই বলে আম্মুও?

—-হ্যাঁ রে মিশু। আমিও তো বেশ অবাকই হয়েছি।

—-আম্মু হঠাৎ এই কথা বললো যে? আমার জন্য ছেলে দেখছো তাই?

—-উঁহু। ইশুর কথা বলেছিলাম তাই। তুই তো জানিস না, তবে আমার মনে হয় তোকে জানানো প্রয়োজন। আসলে সাদমানের জন্য ইশুকে….

—-মানে? তুমি জানতে সাদমান ইশুকে পছন্দ করে যে?

—-শুধু আমি জানতাম না। বল যে আমি ছাড়া আর কেউ-ই জানতো না। এমনকী সাদমানের আব্বু আম্মুও না।

—-মানে তোমরা হবু শ্বশুর জামাই মিলে আগে থেকেই সব ঠিকঠাক করে রেখেছো? আর এখন এসে এই কথা বলছো আমাকে?

—-আজ থেকে প্রায় বছর তিনেক আগে সাদমান একান্তে একদিন আমাকে ডেকেছিলো তার সাথে কথা বলার জন্য। আমি যখন গেলাম, তখন প্রথমেই আমাকে বললো

“আংকেল, অভয় দিলে একটা কথা বলার ছিলো”। আমি বললাম বলো কী বলবে? বললো
” আপনার অবর্তমানে আপনার পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমি নিতে পেরে নিজেকে সার্থক মনে করছি। কথা দিচ্ছি, যতোক্ষণ পর্যন্ত এখানে আছি, আমার দায়িত্বের অবহেলা করবো না। তবে একটা জিনিস আপনার কাছে চাওয়ার ছিলো। আপনার বড় মেয়ের বিয়ের আগ পর্যন্ত আপনার অবর্তমানে তার সকল দায়িত্ব আমি পালন করবো। কিন্তু আপনার ছোট মেয়ের দায়িত্ব আমি আজীবনের জন্য নিতে চাইছি। আমি জানি না আপনি আমাকে সেই দায়িত্ব নেওয়ার উপযুক্ত মনে করবেন কীনা। কিন্তু আমি নিতে চাই আংকেল।”

শোয়েব রহমানের কথায় মিশরাত হা হয়ে আছে। তাহলে এতোদিন যে সাদমান ইশরাতের সাথে এরকম ব্যবহার করে আসছে তার কারণ কী?

—-আব্বু, তুমি এসব কী বলছো? সাদমান তো তাহলে অনেক আগে থেকেই আমাদের ইশুকে পছন্দ করে তোমার কথামতে। কিন্তু তুমি কী জানো যে সে ইশুকে সবসময় তার থেকে দূরে দূরে রাখতো? আরে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে তোমার ছোট মেয়েই তো তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। কিন্তু এখন সে সাদমানের পক্ষ থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে চুপ হয়ে গিয়েছে। এমনকী সাদমানের সাথে সে কোথাও বাইরে ঘুরতে অবধি যেতে চায় না।

—-ইশু আম্মু যে সাদমানকে পছন্দ করে সেটাও আমি জানি মিশু।

—-মানে? সব জেনেশুনে তুমি চুপ করে আছো?

—-হ্যাঁ, তার কারণও আছে। সাদমানই আমাকে এতোদিন চুপ থাকতে বলেছিলো।

—-কিন্তু কেন?

—-ইশুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ইশুর মঙ্গলের কথা ভেবে। আমাদের ইশু এখনো আবেগে চলে তুই জানিস। বয়সটাই এমন। বছর তিনেক আগে তো আরও আবেগী ছিলো। সে যে সাদমানকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে সেটা সাদমান বুঝতো। অনেকবার নানান ভাবে তার অনুভূতির জানান সাদমানকে দেওয়ার পর সাদমান নিজেও ভেবেছিলো ইশুর ডাকে সাড়া দিবে। তখন ইশুর এসএসসি পরীক্ষা চলে। ইশু যে সাদমানদের বাসায় খুব ঘনঘন যেতো সেটা তো তুই আমার থেকে ভালো জানিস। তো পরীক্ষা চলাকালীন একদিন সে সাদমানের বাসায় গেল। নিজে থেকেই চলে গেল সাদমানের কাছে। আবারও ইনিয়ে বিনিয়ে সে একই কথা বলতে যায় যে সে সাদমানকে খুব পছন্দ করে। সেদিন সাদমান নিজেও প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে ইশুর ডাকে সাড়া দিয়েছিলো। ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলো সে নিজেও ইশুকে পছন্দ করে। আর তার পরিণাম বল তো কী হয়েছে?

—-কী?

—-তোর মনে আছে ইশুর কোন সাবজেক্টে এ মাইনাস এসেছিলো?

—-হ্যাঁ, বায়োলজি। খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম আমি নিজেও। ইশু তো সবসময় বায়োলজিতে হাইয়েস্ট নাম্বার পেতো। কিন্তু বোর্ড পরীক্ষায় খারাপ করেছিলো কেন বুঝলাম না।

—-সাদমানের জন্য।

—-মানে?

—-বায়োলজি পরীক্ষার সময়ই সেদিন সাদমানের বাসায় ইশু গিয়েছিলো। তখনই একটা সময় পরে সাদমান ইশুর কথায় পরোক্ষভাবে সম্মতি জানিয়েছিলো। সে তখন বুঝতে পারেনি সেই প্রভাব ইশুর পরীক্ষার উপর এসে পড়বে। ইশুর বয়সটা তখন কেমন ছিলো জানিসই তো। ওই সাদমানের কথা চিন্তা করতে করতে আর পড়া হয়ে উঠেনি। তার পরিণাম তো রেজাল্ট দেখেই বুঝলি। এরপর থেকে সাদমান পুরোপুরি ইশুকে এড়িয়ে চলতো। সে বুঝতে পেরেছিলো তখন যদি ইশুর জন্য তার মনে থাকা অনুভূতি প্রকাশ করে, তাহলে ইশুর খারাপ ছাড়া ভালো হবে না। সাদমান কখনোই চায়নি ইশুর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটুক। ইশুর প্রতিদিনের খবর সে রাখতো। কখন কোথায় কার সাথে যায়। সব খবর সে আমাকে দিতো। তার সাথে সবসময় ছায়ার মতো থেকেছে অথচ তাকে একটাবারের জন্যও বুঝতে দেয়নি। এখনও এমনটাই করছে। কারণ ইশুর পরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি। বোর্ড পরীক্ষা শুরু হবে তারপর এডমিশন। আরও কয়েক মাসের ব্যাপার। এরপরই ভাবছি তাদের চার হাত এক করে দেবো।

তবে তার আগে তোর একটা ব্যবস্থা আমার করতে হবে যে আম্মু। সত্যি বলতে তোর বিয়ে নিয়ে একটু তাড়াহুড়ো করার আরেকটা কারণ হচ্ছে সাদমান। কারণ সাদমানের আম্মু তার জন্য মেয়ে খুঁজছে। ছেলেটার বিয়ে করাতে চাইছে। সাদমানের পাত্রী আমাদের ইশু। কিন্তু তোর বিয়ে না দিয়ে ইশুর বিয়ে তো দিতে পারছি না।

—-কেন পারবে না আব্বু? এটা তো কোনো নিয়ম নয় তাই না যে বড় মেয়ে দেখে আমাকেই আগে বিয়ে করতে হবে?

—-কিন্তু, সমাজ কী বলবে…

—-রাখো এসব আব্বু। কয়েকদিন কথা বলে চুপ হয়ে যাবে সবাই। তাই বলে ইশুর বিয়ে বসিয়ে রেখো না।

—-আমিও তাড়াহুড়ো করে তোর জন্য ছেলে খুঁজতে চাইছি না রে। ইশুর জন্য যেমনি করে সাদমানকে পেয়েছি, তোর জন্যও যদি এমন কাউকে মিলিয়ে দিতো আল্লাহ, তাহলেই সব ইচ্ছে পূর্ণ হয়ে যেতো আমার।

—-আমার নিয়তিতে যে আছে আর যখন আছে, সে ঠিক তখনই আসবে আব্বু। কিন্তু আমার জন্য ইশু আর সাদমানের বিয়ে আঁটকে রেখো না।

—-তাহলে বলছিস আগে ছোট বোনের বিয়ে দেখবি?

—-অবশ্যই। তুমি ছেলে দেখতে থাকো আমার জন্য সমস্যা নেই, কিন্তু বোনের বিয়ে আগে দেখেই যাই আমি। আমার বোন আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে বলে কথা!
কিন্তু আমি ভাবছি সাদমানের কথা, বুঝলে? মানে ব্যাপারটা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে গেল না? আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এতো আগের থেকে আমার ছোট বোনকে পছন্দ করে, অথচ সেটা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। অথচ তোমার সাথে সব ঠিকঠাক করে বসে আছে। তাকে ধরতে হবে আগামীকাল!

(৫৫)

লাঞ্চ টাইমের ব্রেক পড়তে না পড়তেই মিশরাত তার খাবারের বক্স নিয়ে সোজা চলে গেল সাদমানের ডেস্কে। সাদমান সবেমাত্র তার ব্যাগ খুলছিলো খাবার বের করার জন্য। এরমধ্যেই মিশরাত বললো

—-তুমি তো দেখছি সেয়ানা পাবলিক! মানে তলে তলে এতোদিন ধরে টেম্পো চালালে অথচ আমি ধরতেই পারলাম না! সবকিছুতে বেস্ট ফ্রেন্ড আগে, আর যখন নিজের বিয়ের কথা আসলো, বউয়ের কথা আসলো, তখন বেস্ট ফ্রেন্ড লাপাত্তা? হবু শ্বশুরের সাথে সন্ধি? বাহ্! চমৎকার!

মিশরাতের কথা শুনে সাদমানের মুখভঙ্গিতে তেমন একটা পরিবর্তন আসেনি। শুধু মুচকি হেসেছে। যেন এমন কিছু শুনতে হবে সেটা সে আগে থেকেই জানতো।

—-কী হলো? এখন বোলতি বান্ধ?

—-হিন্দিও বলো দেখছি!

—-কথা কাটাবে না একদম হ্যাঁ? আমাকে জানাওনি কেন এসব?

—-মেয়েদের পেটে কথা থাকে না তাই। তোমার কথা শুনে বুঝতে পারছি আংকেল তোমাকে সবই বলে দিয়েছেন। বলেছিলাম না তোমাকে কয়েকদিন আগে যে আমার কিছু কারণ আছে ইশরাতকে পছন্দ করি কিন্তু সেটা প্রকাশ না করার? সেই কারণটা আংকেল বলে দিয়েছে আমি বুঝতে পেরেছি। তোমাকে কিছু বললে সেটা আগে পরে তোমার আম্মু কিংবা বোনের কানে চলেই যেতো। তুমি কথা চেপে রাখতে পারতে না। আর এরপর হতো টা কী? যেই কারণে আমি এতোদিন পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছি, সেই কারণটাই এলোমেলো হয়ে যেতো। তোমার বোনের পড়াশোনা চাঙ্গে উঠতো যেটা আমি একদমই চাইনি। বলেছিলাম তোমাকে সেদিন যে আমার কারণটা তোমার কাছে কতোটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাবে আমি জানি না, তবে আমার যেটা তোমার বোনের জন্য ভালো মনে হয়েছে আমি সেটাই করেছি।

—-এদিকে আমার বোন যে বেঁকে বসে আছে সেটা তুমি জানো? তোমরা হবু শ্বশুর জামাই মিলে ইশুর এডমিশন টেষ্টের পরেই বিয়ে ঠিকঠাক করে রেখেছো মনে মনে। অথচ পাত্রীকে একটাবার বিয়ের কথাটা শুনিয়ে দেখো? পুরো গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলবে! ইশুকে তোমার থেকে দূরে রেখেছো তার ভালোর জন্য সেটা মানছি। কিন্তু ভালো করতে গিয়ে যে তার মন থেকে উঠে যাচ্ছো ধীরেধীরে সে কথা কী জানো? এমনটা না হয় যে যার জন্য এতোগুলা বছর ধৈর্য্য ধরে বসে ছিলে, সে আবার তোমাকে বিয়ে করতে মানা করে দেয়!

—-করবে না। আমি করতে দেবো না। সেসব নিয়ে চিন্তা করো না। তোমার বোনকে আমি কিছুটা হলেও চিনি। সাময়িক দূরত্বের কারণে তার মনে একটা অবহেলার আস্তরণ পড়েছে। তবে সময়মতো আমি ঠিকই সেখানে প্রণয়ের রঙে রাঙিয়ে দিবো।

—-বাব্বাহ্! এতো কনফিডেন্স? সে ভালো। তবে আমি আবারও বলবো, তুমি আমাকে একটাবার জানাতে পারতে ব্যাপারটা। হুট করে আমি এসব শুনে কতোবড় শক খেয়েছি তুমি জানো? ইদানীং আমার থেকে কথা গোপন করছো তুমি। অথচ আমাকে বেস্ট ফ্রেন্ড বলে দাবি করো নিজের।

—-কথা তো তুমিও আমার থেকে গোপন করছো মিশরাত। সেদিন তুমি ববিতা আন্টির বাসায় যাওনি। কোথায় ছিলে?

সাদমানের দিকে চমকে তাকালো মিশরাত।

—-মানে?

—-ববিতা আন্টির মেয়ের কাছে যাবে বলেছিলে। অথচ আমি রাস্তায় দেখেছি ববিতা আন্টি মেয়েকে নিয়ে কোথায় যেন বের হয়েছেন। তুমি মিথ্যে কোনো কারণ ছাড়া বলবে না আমি জানি। আরিয়ানের কাছে গিয়েছিলে?

চুপ করে গেল মিশরাত।

—-সত্যি করে বলো তো মিশরাত, তুমি আরিয়ানকে এখনো ভালোবাসো তাই না?

—-এমনটা কিছুই না। সেদিন আরিয়ান আমাকে একপ্রকার জোর করেছিলো তাই যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। তবে তাকে একটা শর্ত দিয়ে এসেছি। যার কারণে এখন আর সে না তো দেখা করার আবদার করে, আর না আমাকে ফোন করে।

—-কী শর্ত?

(৫৬)

শোয়েব রহমান চলে গিয়েছেন আজকে। তবে যাওয়ার আগে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে সাদমানের আব্বু আম্মুর সাথে ইশরাত আর সাদমানের বিয়ের ব্যাপারে কথাও বলে গিয়েছেন। স্বয়ং পাত্রী বাদে এখন বিয়ের ব্যাপারে সবাই অবগত। ইশরাতের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে।

মিশরাত এখন নিজের রুমে বসে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা “বিকেল মৃত্যু” পড়ছে। অফিস থেকে ফেরার পর আর তেমন কোনো কাজ থাকে না তার। এরমধ্যে ফোন বেজে উঠলো তার। অফিসের এক কলিগের কল। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখতে নিয়ে মিশরাত দেখতে পেলো কললিস্টে আরিয়ানের নাম্বার এখনো আছে। শেষ কথা হয়েছিলো সেদিনই, প্রায় ছয়দিন আগে। সময়টা আরেকবার দেখে নিলো মিশরাত, দুপুর তিনটে বেজে বারো মিনিট। আচ্ছা, এখন কী তাহলে আরিয়ান এই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছে আবার? মিশরাত ভাবতে পারেনি আরিয়ান তাকে এতো সহজে বিরক্ত করা বন্ধ করবে। মিশরাতের নিজের নামে কসম কাটার কী এতো জোর? আরিয়ানকে বলেছিলো তার ভালোবাসার জোর কতোটুকু সেটা সে দেখতে চায়। তবে কী সত্যিই আরিয়ান তাকে এখনো…

না, আবারও মনে পড়ে যাচ্ছে সেই অতীত। যতোবারই আরিয়ানকে নিয়ে মিশরাত পজিটিভ কিছু ভাবতে যায়, ততোবারই অতীত অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

***

—-রেণু, আমার মনে হচ্ছে সর্ষের ভেতর ভূত লুকিয়ে আছে।

—-মানে?

—-বলেছিলাম না তোমাকে যে আরিয়ানদের কোম্পানি থেকে কীভাবে যেন টাকা সরে যাচ্ছে? তার জন্যই তো আমি এখন রাতে তাদের অফিসেই থাকি। কিন্তু আমি থাকাকালীন সময়েও টাকাগুলো কীভাবে যেন উধাও হয়ে যায়। মানে আমার চোখের সামনে থেকে কেউ টাকা নিয়ে যাবে এমনটা তো না। কিন্তু টাকা যাচ্ছে কোথায়? আমার মনে হচ্ছে হক পরিবারের সাথে সম্পর্কিত কেউ এই কাজের সাথে যুক্ত। কিন্তু, মানুষটা কে যে হতে পারে!

—-তুমি আরিয়ানের সাথে কথা বলেছো এই ব্যাপারে?

—-না, বলবো আগামীকাল।

এতোক্ষণ যাবত শোয়েব রহমান আর রেণু আক্তারের কথোপকথন শুনছিলো মিশরাত। তাদের রুম ক্রস করতে নিয়েছিলো। আরিয়ানের নাম শোনামাত্র জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল সে। কতোটা অবহেলা পেয়েও চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে সে আরিয়ানের দিকে। তার নাম শোনামাত্রই থমকে যায় সে। আচ্ছা, খুব বেশি কী ক্ষতি হয়ে যেতো যদি আরিয়ান তাকে একটু বুঝতো?

রুমে চলে গেল মিশরাত। রেণু আক্তারের ফোন বাজছে হঠাৎ। আরিয়ানের কল এসেছে। মিশরাত রিসিভ করতে গিয়েও করলো না। কারণ সে আরিয়ানের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। তবে একাধারে ফোন বেজে চলেছে এবং রেণু আক্তার এখনো রুমে আসেনি বিধায় মিশরাত ফোন রিসিভ করলো কিন্তু কোনো কথা বললো না। অপর পাশ থেকেও নীরবতা বিরাজমান। প্রায় মিনিট দুয়েক পরে মিশরাত শুনতে পেলো আরিয়ানের কন্ঠ।

—-মিশু?

হুট করেই যেন মিশরাতের কর্ণকুহরে এক মধুর ধ্বনি প্রবেশ করলো। মনটা খুশিতে নেচে উঠলো। আরিয়ান কী তবে তাকেই ফোন করেছে? তাকে মিশু বলে ডাকছে? কই, এতোদিন তো ডাকেনি? তবে কী আল্লাহ তার মনের ইচ্ছে পূরণ করেছে? অবশেষে কী তার আরিয়ান তার কাছে ফিরেই আসলো?

—-কথা বলবে না আমার সাথে মিশু? খুব বেশি রাগ করেছো বুঝি আমার উপর?

—-তুমি…তুমি আমাকে ফোন করেছো? সত্যি?

—-হ্যাঁ, তুমি ছাড়া মিশু নামে আমি আর কাকে ডাকবো?

হৃদযন্ত্র ধুকধুক করছে মিশরাতের। অতিরিক্ত উত্তেজনায় শরীর গরম হওয়ার কথা। তবে মিশরাতের হাত পা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে।

—-তুমি খুব করে চাইতে না মিশু আমি তোমার হয়ে যাই? আমি হতে চাই মিশু। সকলের সামনে তোমার জন্য আমার মনে থাকা অনুভূতি প্রকাশ করতে চাই। দিবে আমাকে সেই সুযোগ মিশু?

মিশরাতের এখনো সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। ফোন কানে রেখেই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো মিশরাত। আয়নার কাঁচে হাত রাখলো। কাঁচ তো ছুঁতে পারলো৷ তবে সে সত্যিই বাস্তবে আছে?

—-বলো না মিশু? অভিমানকে দূরে সরিয়ে দিবে না একটু ভালোবাসার সুযোগ?

খুশির আতিশয্যে কেঁদে দিয়েছে মিশরাত। আয়নায় নিজের অবয়ব সে নিজেই দেখতে পাচ্ছে। চোখ থেকে খুশির অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মিশরাত খুব করে চাইছে কান্না বন্ধ করতে। কিন্তু মনের সুখের বহিঃপ্রকাশ যে অশ্রুর মাধ্যমে হচ্ছে! খুশি তো আটকাতে পারছে না সে। তবে কান্না কী করে আটকাবে? কোনোমতে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো

—-আমি কী ভুল শুনছি?

—-একদমই না মিশু। তুমি একেবারে ঠিক শুনছো। আগামীকাল বড় গাছতলার নিচে এসে দাঁড়িয়ে থেকো। আমি সেখানে সবার সামনে তোমাকে আমার মনের অনুভূতি জানাবো। তোমাকে নিয়ে আমার মনে থাকা সত্যিকার অনুভূতি।

—-কিন্তু তোমার ওই মোনার কী হলো?

—-তাকে তো আমি কবেই ছেড়ে দিয়েছি। তুমি একদম ঠিক বলেছিলে। সে একটুও ভালো নয় আমার জন্য।

খুশিটা যেন আরেকটু নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো। আরিয়ান তাহলে তার কথায় এতো গুরুত্ব দেয়? সে আরিয়ানের জীবনে এতোটাই গুরুত্ব রাখে যে মোনাকে অবধি ছেড়ে দিলো তার জন্য? নিজেকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে মিশরাতের।

—-আগামীকাল আসবে কিন্তু মিশু। কেমন? আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।

ফোন আরিয়ান নিজেই কেটে দিলো। পুরো রুমে বেশ কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করলো মিশরাত একা একা। ভাগ্যিস ইশরাত টিভি দেখছিলো। নয়তো এভাবে তার পাগলামি দেখে যে কেউ হেসে দিতো। এতোদিনের অপেক্ষার পর সে নিজের মনের মানুষকে পেতে চলেছে। এর থেকে খুশির আর কিছু হতে পারে কী?

আলমারি খুলে রেণু আক্তারের শাড়িগুলো একে একে দেখতে লাগলো মিশরাত। সে সাজবে, অনেক সাজবে। শুধুমাত্র তার আরিয়ানের জন্য।

(৫৭)

আশেপাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে। তাদের কী আরিয়ানই ডেকে এনেছে কীনা তা জানে না মিশরাত। তবে সে মন ভরে সেজেগুজে এসেছে। এখন মুখে একরাশ লজ্জা এনে তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। সমানে হাত কচলে যাচ্ছে। খুব নার্ভাসও লাগছে এখন তার। আরিয়ান তার সামনে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে আরিয়ান বলে উঠলো

—-আপনাদের সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়েটি, যে প্রতিনিয়ত আমাকে বিরক্ত করে যাচ্ছে।

চোখ কিছুটা কুঁচকে গেল মিশরাতের “বিরক্ত” শব্দটা শুনে।

—-বেহায়া দেখেছেন কখনো? মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখুন। এই যে আমার পিছুপিছু ঘোরার পরেও আমি বারেবারে তাকে না করে দেই, তবুও দেখুন? আজ আবার চলে এসেছে সং সেজে।

চোখে কেন জানি সব ঝাপসা দেখছে মিশরাত। চোখ তুলে আরিয়ানের দিকে তাকালো। কিন্তু আরিয়ানকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। তবে কী চোখে পানি আসার কারণে?

—-এই যে দেখুন, কিছু বলতে না বলতেই চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিয়েছে। ন্যাকামো সব, বুঝলেন?
আচ্ছা,এই আমি আরিয়ান হকের সাথে কী এই মেয়ে যায় কীনা আপনারাই বলুন তো?

চারপাশে গুনগুন শব্দ শোনা যাচ্ছে। খুব আস্তে আস্তে কথাবার্তা বলছে এখানে আসা লোকজন নিজেদের মধ্যে।

—-আমি আমার যোগ্যতা অনুযায়ী আমার জীবনসঙ্গিনী নির্ধারণ করেছি। অথচ এই মেয়ে সেটাতেও হস্তক্ষেপ করতে আসে। অনধিকার চর্চা ঠিক কীভাবে করতে হয় তা মেয়েটার থেকে শিখে নিতে পারেন আপনারা।

আশেপাশে তাকাচ্ছে মিশরাত। সে থাকতে চায় না এখানে। আজকে তো তার আব্বুও এসেছে। আর দাঁড়িয়ে থাকবে না সে এখানে। তার আব্বুর কাছে চলে যাবে। আরিয়ানের দিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে উল্টোদিকে হাঁটা দিলো মিশরাত।

—-এই যে, হাতেনাতে ধরা পড়ে এখন কীভাবে মুখ লুকিয়ে কেটে পড়ছে দেখুন?

চোখ মুছতে মুছতে চলে যাচ্ছে মিশরাত। আরিয়ানের কোনো কথাই আর শোনার ইচ্ছে তার নেই। মিশরাত আর থামবে না বুঝে আরিয়ান দ্রুত পা চালিয়ে তাকে ধরতে চলে গেল। মিশরাতের হাত ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে জোরে থাপ্পড় দিলো তার গালে। মুখ হা করে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে মিশরাত। শেষ পর্যন্ত গায়ে হাত তুলতেও আরিয়ানের একটুও বাঁধলো না বিবেকে? এই ছিলো তার অনুভূতি প্রকাশ করার নমুনা? এতো সুন্দর নাটক সে কীভাবে করতে পারলো তার সাথে!

—-এখন কোথায় যাচ্ছিস চরিত্রহীন কোথাকার? খুব সেজেগুজে এসেছিস তাই না? আমি একটু ভালোভাবে কথা বলেছি আর ওমনি ভেবেছিস তোকে মেনে নিয়েছি? মোনার জায়গা আমি তোকে দিবো সেটা ভাবলি কী করে তুই? কোন যোগ্যতায় আরিয়ান হকের স্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখিস? শুধুমাত্র শোয়েব আংকেলের মেয়ে হওয়ার কারণে আমি চুপ ছিলাম। কারণ এতোদিন ব্যাপারটা শুধু আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু এখন…

এরমধ্যেই কোত্থেকে মোনা চলে আসলো। এসে দাঁড়ালো আরিয়ানের পাশে। মুখে তার বাঁকা হাসি। এসেই আরিয়ানের হাত ধরে দাঁড়ালো সে। মোনার দিকে একবার তাকালো আরিয়ান। এরপরই মিশরাতের দিকে ফিরে বললো

—-খুব সেজেগুজে এসেছিস। ঠিক এভাবে সেজেগুজেই ছেলেদের নিজের ফাঁদে ফেলিস তাই না? যাকে দেখিস তাকে দেখলেই বুঝি তোর মন গলে যায়? এতো নোংরামি কীভাবে করিস বল তো? আসলেই তুই শোয়েব আংকেলের মেয়ে তো? আমার তো সন্দেহ হয় ভীষণ। কারণ উনার মেয়ের চরিত্র এরকম হতে পারে সেটা তো আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। যাকে দেখিস তার গলায় ঝুলে পড়িস তাই না? আমার কাছ থেকে পাত্তা না পেয়ে অন্য কারোর গলায় ঝোলার চেষ্টা করছিস। কী ভেবেছিস? জানবো না আমি কিছু? তোর আসলে চাই কী বল তো? শুধুই টাকা? নাকী ছেলে দেখলেই লোভে পড়ে যাস? একটু ইশারা পেলেই যার তার সাথে বুঝি

মিশরাত পুরো কথা শোনেনি। প্রাণপণে দৌড়ে কোনোমতে পালিয়ে চলে এসেছিলো সেখান থেকে। চারপাশের লোকজন তার দিকে ভীষণ বাজেভাবে তাকিয়ে ছিলো। ছিঃ ছিঃ করছিলো প্রত্যেকে। এক দৌড়ে হক পরিবারের বাড়ির সীমানা পাড় করলো মিশরাত। বাইরে বের হয়েই বসে পড়লো মাটিতে। তার গা গোলাচ্ছিলো। কেমন যেন মাথাটা ভনভন করছিলো। এরমধ্যে একজোড়া পা সেখানে দৌড়ে আসলো।

—-আম্মু, আমার আম্মুটার কী হয়েছে? মিশু, তোর এই অবস্থা কেন আম্মু?

শোয়েব রহমানকে দেখে যেন হুহু করে ভেতর থেকে কান্নাটা চলে আসলো মিশরাতের। নিজের আব্বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে মিশরাত। সে কান্না কোনোমতেই সহ্য হচ্ছে না শোয়েব রহমানের।

—-এই আম্মু, বল না কী হয়েছে? তুই এতো সেজে এসেছিস কেন? আর এতো কাঁদছিস কেন? গাছতলায় দেখলাম কতো মানুষ জড়ো হয়েছে। কিছুই তো বুঝলাম না।

—-আব্বু, আমাকে…

কান্নার কারণে কথা বলতে পারছিলো না মিশরাত।

—–তোকে কী আম্মু?

—–আমি নোংরা না আব্বু, বিশ্বাস করো? আমি চরিত্রহীন না।

এতোটুকু কথা শুনেই যেন রক্ত গরম হয়ে গেল শোয়েব রহমানের। মেয়ে কারোর কাছ থেকে অপমানিত হয়েছে সেটা শুনেই রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ক্রোধান্বিত স্বরে বললেন

—-কী বলছিস তুই এসব? কোন জানোয়ারের বাচ্চা তোকে এই কথা বলেছে একবার শুধু বল আমায়? সে যেই হোক, এক্ষুনি বিচার করবো আমি তার। আরিয়ানকে এক্ষুনি ফোন করছি আমি দাঁড়া।

ফোপাঁতে ফোপাঁতে মিশরাত বললো

—-কার বিচার করবে আব্বু? যার কাছে বিচার চাইতে যাচ্ছো তার?

তব্দা খেয়ে গেল শোয়েব রহমান মিশরাতের কথা শুনে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। আরিয়ান?

#পর্বঃ১৮

(৫৮)

অনেকক্ষণ যাবত আরিয়ানের নাম শুনে থ বনে ছিলেন শোয়েব রহমান। খুব কষ্ট হয়েছে উনার মিশরাতের কথা বিশ্বাস করতে। কিন্তু এভাবে কাঁদতে কাঁদতে নিশ্চয়ই মেয়েটা মিথ্যে কথা বলবে না? তাই তো সকল বিস্ময় দূরে সরিয়ে রেখে একরাশ চাপা ক্ষোভ মনে পুঞ্জীভূত করে শোয়েব রহমান চললেন আরিয়ানের উদ্দেশ্যে।
সেদিকে তাকিয়ে রইলো মিশরাত। শোয়েব রহমান চোখের আড়াল হতেই নিজের কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ পেলো মিশরাত। পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো মোনা তার দিকে এক ক্রুর হাসি মুখে এনে তাকিয়ে আছে।

—-কেমন লাগছে মিশরাত বিনতে শোয়েব? খুব অহংকার না তোমার নিজেকে নিয়ে? আমাকে সেদিন কীভাবে অপমান করেছিলে মনে আছে? সেদিন এই আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলে আর আজ? আজ সকলের সামনে তোমার নিজের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলো। শুধু প্রশ্ন বললে ভুল হবে। সরাসরি চরিত্রহীন বলা হয়েছে। আর সেটা বলেছে কে? যার কাছ থেকে তুমি পাহাড় সমান ভালোবাসা আর সম্মান আশা করে বসেছিলে। ভীষণ মজা পাচ্ছি জানো? ভীষণ আনন্দ হচ্ছে।

জানো কাউকে নিজের আয়ত্তে আনার সবচেয়ে সহজ উপায় কী? তাকে ম্যানিপুলেট করা। আর সেটা খুব ভালো করে করতে পারি আমি। অন্য সবার ক্ষেত্রে না পারলেও আরিয়ানকে আমার থেকে ভালো ম্যানিপুলেট কেউ করতে পারে না, ট্রাস্ট মি? আমার মনে হয় তার মা বাবাও ততোটা পারবে না। আর হ্যাঁ, কাউকে ম্যানিপুলেট করার আগে তার বিশ্বাস অর্জন করা খুব বেশি জরুরী। যেটা আমি কোনো না কোনোভাবে আরিয়ানের কাছ থেকে অর্জন করেছি। তো এর ফল দেখতেই পেলে! তো এখন তোমার অনুভূতি কী একটু বলো? জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে আমার। এই মুখ নিয়ে এই শহরে আর থাকতে পারবে? মাঠভর্তি মানুষের সামনে তো অপমান হয়ে এলে। এখন যার সামনে দিয়ে যাবে সে-ই তোমাকে বাঁকা চোখে দেখবে। চরিত্রহীন উপাধি পেয়েছো কীনা! বেশ জটিল একটা উপাধি কিন্তু!

শরীর দুলিয়ে হাসছে মোনা। সেই হাসিতে মোনার খুশি প্রকাশ পেলেও মিশরাতের কাছে সেই হাসি গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো। কিছুক্ষণ হেসে হাসি থামালো মোনা। এরপর আশেপাশে তাকিয়ে বললো

—-তোমার আব্বু বুঝি আবার বিচার চাইতে গিয়েছে তোমার হয়ে? আহারে! কেন যেতে দিতে বলো তো উনাকে? নিজে তো অপমানিত হলে হলে এখন নিজের বাবাকেও অপমানিত হতে দিচ্ছো?

শোয়েব রহমানের কথা শুনে চমকে চোখ তুলে তাকালো মিশরাত। সেটা থেকে বাঁকা হেসে মোনা বললো

—-তুমি ছাড়াও তোমার বাবার ব্যবস্থাও আমি করে রেখেছি। বলতে পারো কোনো দিকে কমতি রাখিনি আমি। তো তোমার বাবার জন্য কী ব্যবস্থা করেছি সেটা জানতে চাও? শুধু একটু অপেক্ষা করো তোমার বাবা ফিরে আসার। এরপরেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। যাই হোক, চলি আমি। তোমার সাথে কথা বলার রুচি বা ইচ্ছে কোনোটাই ছিলো না আমার। কিন্তু কী বলো তো? আমি এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারছি যে তুমি আর এখানে এই শহরে লজ্জায় থাকতে পারবে না। আজ কালের মধ্যে চলে যাবেই। তো বলতে পারো আগেভাগে তোমাকে বিদায় দিতে এলাম। যাই হোক, একটা শিক্ষা অন্তত নিয়ে যাও। যার তার সাথে লাগতে এসো না ঠিক আছে? সারাজীবন যাতে আমাকে না ভুলতে পারো তার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলাম।

মিশরাতের দিকে মুখ রেখেই একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছে মোনা। ডান হাত তুলে কয়েকটা আঙুল নাড়াতে নাড়াতে বললো

—-টা টা বাই বাই আর যেন কখনো দেখা না পাই!

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে মিশরাত। অন্য কিছু নিয়ে আর চিন্তা করছে না সে। শুধু ভাবছে শোয়েব রহমানের কথা কী বলে গেল এগুলো মোনা?

অপরদিকে আরিয়ানের কাছে চলে গেল শোয়েব রহমান। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের এসিস্ট্যান্টের সাথে কথা বলছিলো আরিয়ান। দূর থেকে শোয়েব রহমানকে দেখতে পেলো সে। শোয়েব রহমান তার একেবারে কাছে এসে দাঁড়ালেন। কন্ঠে যথেষ্ট কাঠিন্য এনে বললেন

—-আমার মেয়ের সাথে এভাবে ব্যবহার করার দুঃসাহস তুমি কোথায় পাও আরিয়ান হক?

নিজের এসিস্ট্যান্টের দিকে একবার তাকিয়ে শোয়েব রহমানের উদ্দেশ্যে আরিয়ান বললো

—-ভেতরে চলুন।

—-কেন? ভেতরে কেন? এখানে এখন এই মুহুর্তে বলবে তুমি। আমার মেয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করো তুমি? কে তুমি হ্যাঁ? সেই অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?

—-যথেষ্ট সম্মান করি আপনাকে। তাই এখানে কিছুই বলতে চাচ্ছি না। ভেতরে চলুন।

আর কিছু না বলে বাড়ির ভেতর চলে গেল আরিয়ান। তার পেছন পেছন গেলেন শোয়েব রহমান। নিজের রুমে গিয়ে থামলো আরিয়ান। শোয়েব রহমানও চলে এলেন সেখানে।

—-নিজের মেয়েকে খুব বেশিই আদর দিয়ে ফেলেছেন। অতিরিক্ত আহ্লাদ দিয়ে বিগড়ে দিয়েছেন।

—-এখন তুমি আমাকে শেখাবে কী করে মেয়েকে সঠিকভাবে বড় করে তুলতে হয়?

—-না, সেটা শেখানোর মতো যথেষ্ট জ্ঞান হয়তো আমার নেই। আপনার আছে, তবে মেয়েকে অতিরিক্ত মাথায় তুলে ফেলেছেন যার কারণে আজ আপনার মেয়ের এই অবস্থা। সে কোথায় কী করে না করে সেগুলো আপনি জানেন না, জানার প্রয়োজনও মনে করেননি। আপনি জানেন আপনাদের মেয়ে আমার পেছনে কতোদিন ঘুরঘুর করেছে? কখনো বলিনি সে বিষয়ে আমি। চাইনি আপনাকে লজ্জায় ফেলতে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আপনার মেয়ে আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। দিনকে দিন তার উচ্ছৃঙ্খলতা বেড়েই চলেছে। আপনার সেদিকে নজর রাখা দরকার ছিলো। আপনি রাখেননি। এখন এসেছেন বিচার চাইতে? একটু জিজ্ঞেস করে দেখবেন আমার কথা বিশ্বাস না হলে যে আসলেই আপনার মেয়ে আমার পেছনে ঘুরঘুর করেছে কীনা বেহায়ার মতো। আশা করি আপনার কাছে সে মিথ্যে বলবে না। আর একটা বললেই বাকীগুলো আপনা-আপনি বের হয়ে যাবে মুখ দিয়ে। আপনার মেয়ের শাসন দরকার। আমার কাছে কৈফিয়ত চেয়ে সময় নষ্ট না করে সেই সময়টা নিজের মেয়েকে শাসন করতে ব্যয় করুন, তার বেহায়াপনা আশা করি কিছুটা হলেও কমবে।

আরিয়ান রুম থেকে বের হয়ে গেল। এখনো ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছেন শোয়েব রহমান। এতোটা লজ্জা কোথায় রাখবেন বুঝতে পারছেন না তিনি। তার মেয়ে ছেলেদের পিছুপিছু ঘোরে? আরিয়ানের চোখে স্পষ্টতা দেখেছেন তিনি। আরিয়ান শতভাগ নিশ্চিত হয়ে এতোগুলো কথা বললো কীভাবে?

ক্লান্ত পায়ে রুম থেকে বের হতে নিবেন শোয়েব রহমান। এরমধ্যেই তিনি দেখলেন দরজার সামনে আরিয়ানের বাবা আহনাফ হক দাঁড়িয়ে। উনার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ রেগে আছেন তিনি।

—-আপনারা বাপ মেয়ে মিলে তো দেখি ভালোই খেল দেখালেন মিস্টার রহমান?

আশ্চর্য হয়ে আহনাফ হকের দিকে তাকালেন শোয়েব রহমান। কখনো আহনাফ হক উনাকে “ভাইজান” ছাড়া অন্যকিছু বলে সম্বোধন করেননি। আর আজ মিস্টার রহমান?

—-আপনি কী বলছেন এগুলো ভাইজান?

—-একদম না! খবরদার, একদম না! কোনো বেঈমানের মুখ থেকে আমি ভাইজান ডাকটা শুনতেও চাই না।

—-বেঈমান! কে? কাকে বেঈমান বলছেন আপনি?

—-বেঈমান নিজে জিজ্ঞেস করে কাকে বেঈমান বলছি! বাহ্! আরে মানুষ এভাবে ভালোমানুষির মুখোশ পরে থাকে? আমাদের পরিবারের সান্নিধ্যে থেকে লাভ ছাড়া কোনো ক্ষতি আপনাদের হয়েছে এটা বলতে পারবেন? অথচ আপনারা কী করলেন? লজ্জা করলো না এমনটা করতে?

—-কী করেছি আমি সেটা তো বলবেন?

—-আরে হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েও নাটক করছেন আপনি? নাটক? অবশ্য এতোদিন তো সেটাই করে এসেছেন। আপনার নাটকের ব্যাপারে তো আরিয়ানকে এখনো কিছু বলিনি আমি। আপনার বড় মেয়েকে নিজের পরিবারের সদস্য মনে করেছিলাম আমরা। একেবারে নিজের রুপ দেখিয়ে দিলো। ছেলেটা আমার সেই বিষয় নিয়ে এখনো পড়ে আছে। তার উপর আপনার বেঈমানীর কথা এখন তাকে বলি কী করে বলুন? একেবারে ভাব দেখালেন যে আপনি আমাদের কোম্পানিতে রাতে গিয়েও থাকবেন নিজের পরিবার ছেড়ে। আমরাও সহজ সরল মনে এটার বাহবা দিতে লাগলাম। আর এর পরিণাম? নিজেই টাকা সরাতেন কোম্পানি থেকে। আর ভাব দেখাতেন যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানেন না?

—-ভাইজান!

—-ভাইজান ডাকবেন না আমাকে খবরদার! ভাইজান শব্দটার মানে জানেন আপনি? আরে আপনারা তো গিরগিটির থেকেও অধম! এখন আর কথা ঘোরাতে পারবেন না। সব প্রমাণ আছে আমাদের কাছে।

কতোগুলো মিথ্যে বানোয়াট প্রমাণ দেখানো হয়েছিলো শোয়েব রহমানকে। বেশ কিছু কাগজ যাতে প্রমাণ করতে পারে শোয়েব রহমান নিজে কোম্পানির টাকা আত্মসাৎ করতো। কয়েকবার শোয়েব রহমান বোঝাতে চেয়েছিলেন যে এসব কিছুই মিথ্যে। তবে সেদিকে কেউ কান দেয়নি। কেউ শোনেনি উনার কথা। একটা সময় হাল ছেড়ে দিলেন শোয়েব রহমান। চুপ করে গেলেন। এরকম ভয়ানক বাস্তবতার সম্মুখীন কখনো হতে হবে উনি ভাবতে পারেননি। আহনাফ হক উনাকে আজীবনের জন্য হক কোম্পানি থেকে বহিষ্কার করে দিলেন শাস্তিস্বরূপ।

ঠিক এভাবেই পুরোপুরিভাবে দুই পরিবারের মধ্যে থাকা সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। শোয়েব রহমান পুরো পরিবারকে নিয়ে চলে আসেন সেই শহর ছেড়ে। অতীত ভোলেনি কেউ-ই। এখনো সেই অতীতকে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। সময় এগিয়ে গেছে। এই শহরে এসে চাকরী জুটেনি শোয়েব রহমানের। পেয়েছেন খুবই দূরে। তাই তো পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয় উনাকে। মিশরাত সেই ঘটনার পর থেকে আর কখনো পিছু ফিরে তাকায়নি। নিজের সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছে পড়াশোনা এবং পরিবারের প্রতি। দ্বিতীয়বারের মতো আর কোনো ছেলের চিন্তা সে মাথায়ও আনেনি। সেদিন শোয়েব রহমান জিজ্ঞেস করায় মিশরাত সব সত্যি কথা বলে দিয়েছিলো। সে আরিয়ানকে পছন্দ করতো সেই কথা। তবে শুধু ততোটুক ছাড়া যে বাকী সব অপবাদ মিথ্যে এবং আরিয়ান নিজে কৌশলে ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে জনসম্মুখে অপমান করেছে, সেটাও শোয়েব রহমান শুনেছেন। পড়াশোনা শেষ করে ভালো রেজাল্ট থাকার কারণে মিশরাতের চাকরী মিলে যায়। সৌভাগ্যক্রমে সাদমান যেই অফিসে চাকরী করে সেই অফিসেই মিশরাতের চাকরী হয়। সাদমানের সাথে মিশরাতের পরিচয় এখানে আসার পর থেকেই। তবে তখনো ততোটা গভীর বন্ধুত্ব তাদের মধ্যে গড়ে উঠেনি। যখন থেকে তাদের বাসার ঠিকানার সাথে সাথে চাকরীর ঠিকানাও মিলে গেল, তখন থেকে তাদের বন্ধুত্ব আরও মজবুত হতে লাগলো। বয়সে মিশরাত সাদমানের থেকে চার বছরের ছোট। তবে বয়সকে বন্ধুত্বের মাঝে আসতে দেয়নি সাদমান। মিশরাতের জীবনে আরিয়ানের অবস্থান নিয়ে ভালোই অবগত সাদমান। আর তাইতো শক্ত হাতে মিশরাতকে সামলানোর দায়িত্ব নিয়েছিলো সে। সামলে গেছেও। সেই থেকে দু’জনের মধ্যে এক চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

***

অতীতের চিন্তা থেকে মিশরাতকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করলো ইশরাত। ধপাস করে এসে বিছানায় শুয়ে গিয়েছে তার পাশে। সেদিকে তাকিয়ে মিশরাত প্রশ্ন করলো

—-কী রে? আজকে এতো তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে এলি যে? পড়াশোনা শেষ?

—-না রে আপু, মাথাটা ভার হয়ে আছে মনে হচ্ছে। আপাতত আর লোড নিতে পারছি না। একটু ঘুম প্রয়োজন। ফজরের নামাজ পড়েই আবার পড়তে বসে যাবো। এখন ঘুমোবো। ঘুম পাড়িয়ে দে।

বোনকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজলো ইশরাত। এরমধ্যেই হুট করে বলে উঠলো

—-আব্বুকে বলেছিলাম এই ফ্ল্যাট ছাড়ার কথা। আব্বু পাত্তাই দিলো না আমার কথাটা মনে হলো।

—-কেন? হঠাৎ ফ্ল্যাট ছাড়ার কী হলো?

—-এই ফ্ল্যাটে একজন এলিয়েন থাকে জানিস না? যার আমাকে দেখলেই অহেতুক খোঁচা মারা লাগে? অসহ্যকর!

মিশরাত বুঝতে পারলো ইশরাত কার কথা বলছে। মুখ টিপে হাসছে সে। শুধু চিন্তায় আছে একটা বিষয় নিয়েই, হুট করে বিয়ের কথা শুনে ইশরাতের মুখভঙ্গি কেমন হবে তা নিয়ে।

(৫৯)

দেখতে দেখতে কেটে গেছে প্রায় সাত মাস। ইশরাতের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রেজাল্টও এসেছে, সকলের মনঃপুত হয়েছে। সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। এখন ভর্তি পরীক্ষার জন্য চেষ্টা করছে। বেশিরভাগ পরীক্ষাগুলোই সামনের মাসে। সর্বমোট দুই মাসের মধ্যে সব পরীক্ষা শেষ হবে তার।

ইশরাত আর সাদমানের বিয়ের বন্দোবস্ত করে রাখা হবে এরপরেই। এরমধ্যে শোয়েব রহমান থেমে নেই মিশরাতের ছেলে দেখার ক্ষেত্রেও। কমপক্ষে হলেও প্রায় বারো পনেরো জন ছেলের পক্ষ থেকে মিশরাতের বিয়ের জন্য প্রস্তাব পেয়েছেন তিনি। বেছে বেছে অবশেষে একজন তার মনঃপুত হলো। ছেলের নাম নিশান হোসেন। আগামীকাল মিশরাতকে দেখতে আসার কথা ছেলের। তার জন্য শোয়েব রহমান ছুটি নিয়ে এসেছেন। যদি পারেন তাহলে ইশরাতের বিয়ের কিছুদিন পরেই মিশরাতের বিয়ে দিয়ে দেবেন বলে মনঃস্থির করেছেন তিনি। ছেলের কথা মিশরাতকে জানানোর পর মিশরাত কেবল স্মিত হেসে মাথা নাড়িয়েছে। আর কিছুই বলেনি সে।

(৬০)

হালকা শীত শীত পড়ছে চারিদিকে। অথচ আরিয়ান এখন নিজের রুমে এসি অন করে ফ্যান চালিয়ে শুয়ে আছে। হাতে তার জ্বলন্ত সিগারেট। বাম হাত মাথার উপর রেখে উপরে ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ডান হাতের দুই আঙুল দিয়ে সিগারেট ফুঁকছে সে। চোখ দু’টো লালচে হয়ে আছে।

রুমের দরজা আবজা দেওয়া ছিলো। দরজা টেনে ভেতরে ঢুকলো আরাভ। সিগারেটের ছাই এখনো ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কয়েকটা মদের বোতল বিছানায় রাখা। আর কয়েকটা খালি বোতল ফ্লোরে রাখা।

—-খাবার বেড়েছি। খেতে চল।

—-খাবো না। তুই খেয়ে নে।

—-এক কাজ কর, বিষ খেয়ে মরে যা। মরবি? বল, মরবি? প্রমিজ করছি, বিষ আমি নিজে নিয়ে আসবো তোর জন্য। শুধু একটাবার বলে দেখ আমায়। কারণ তোর হাবভাব দেখে ভালোই বুঝতে পারছি যে তুই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরবি না। আর এই ছাইপাঁশ খেয়ে নেশায় বুদ হয়ে পড়ে থেকে তিলে তিলে মরে যাওয়ার চেয়ে বিষ খেয়ে মরে যা। এতে আমাদের সবার উপকার হবে।

ঠোঁট কাঁপছে আরাভের। রাগে, কষ্টে। আরিয়ানের এই অবস্থা আর দেখতে পারছে না সে। বিগত সাতটা মাস ধরে ছেলেটার এই অবস্থা। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে ঈষৎ গোলাপি ঠোঁটদু’টো কালো হয়ে গিয়েছে তার৷ আরাভের কথা শুনে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না আরিয়ানের মধ্যে।

—-ফোনটা অন্তত এবার চার্জে দে? যতোক্ষণ পর্যন্ত সজাগ থাকিস ফোন নিয়ে পড়ে থাকিস। কয়েক ঘন্টার জন্যে চোখ বন্ধ করলেও মোবাইল হাতে নিয়ে ঘুমাস। এর কোনো মানে হয়?

—-মিশু যদি আমাকে তার সাথে দেখা করতে বলে তাহলে তো ফোন করেই বলবে তাই না? ফোন পাশে না রাখলে আমি জানবো কী করে?

—-সাত মাস ধরে সেই মেয়ে তো তোকে ফোন দিয়ে আসছে তাই না? শালা গবেট কোথাকার! বেহায়া হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছিস। না, শুধু চূড়ান্ত পর্যায় কেন বলছি? মনে তো হচ্ছে সকল সীমা পরিসীমা অতিক্রম করতে বসেছিস।

—-একদিন যাকে বিরক্তিকর, অসহ্যকর বলে দূরদূর করতাম, আজ তার কাছেই আমি বিরক্তির কারণ।
একদিন যাকে সবার সামনে বেহায়া বলেছিলাম, আজ তার জন্য বেহায়া নিজে হলাম।
একদিন যাকে সকলের সামনে অপমান করেছিলাম, আজ ঠিক তারই জন্য সকলের সামনে নিজে অপমানিত হচ্ছি।
একদিন যাকে চড় মারার মতো জঘন্য অপরাধ করেছিলাম, আজ তার হাতের চড় লাথি খেয়েও তারই আশায় বেঁচে আছি।
একদিন যাকে পায়ে ঠেলে দিয়েছিলাম, আজ তার কাছ থেকে কুকুরের মতো ব্যবহার পেয়ে যাচ্ছি।

প্রকৃতি তার প্রতিশোধ ঠিকই নিয়ে নেয়, তাই না রে?

—-বুঝতেই যখন পারছিস তখন কী আশায় বসে আছিস আরিয়ান? ফিরে চল আমার সাথে? তুই তো তোর চেষ্টার কোনো কমতি রাখিসনি, তাই না? এখন কেউ যদি তোর ভাগ্যে না থাকে তাহলে তুই কী করবি বল? ভুল করেছিলি, তার শাস্তিও তো পেয়েছিস, পেয়ে যাচ্ছিস। এখন সব ভুলে চলে আয় আমার সাথে।

—-আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে রে আরাভ। গত ছাব্বিশ ঘণ্টা যাবত ঘুমাইনি। যদি মিশু ফোন করে তাহলে আমাকে ডেকে দিস একটু, কেমন?

রাগে গা জ্বলছে আরাভের। সে বারেবারে কেন যে এই পাগলটাকে বোঝাতে যায় সেটা নিজেই বুঝে না। দাঁত কিড়মিড় করে বললো

—-হ্যাঁ, আসবে তো ফোন। অবশ্যই আসবে। যখন নিজের বিয়ের দাওয়াত দিবে, তখন ফোন করবে তোকে। গিয়ে ওই মেয়ের বিয়ের দাওয়াত খেয়ে আসিস। ঠিক আছে? শালা মর তুই!

ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল আরাভ। অথচ কেউ দেখলো না, দু’চোখ বেয়ে অবিরাম অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়তে লাগলো এক অসহায় প্রাণীর!

চলবে…
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here