অনুভূতির অন্বেষণ পর্ব -১৬

#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ১৬

(৫০)

সন্ধ্যে এখন সাড়ে সাতটা। মিশরাতের বাসায় সাদমানের আব্বু আম্মু এসেছে। আতিক হাসান, পারভীন সুলতানা এটা সেটা নিয়ে আলাপ আলোচনা করে যাচ্ছেন মিশরাতের আব্বু আম্মুর সাথে। তাদের সাথে সাদমান, ইশরাত এবং মিশরাতও বসা।

—-এতোদিন পর এসেছেন ভাইজান। পরশুদিন আবার চলে যাবেন এটা কোনো কথা হলো?

আতিক হাসানের করা প্রশ্নে মাথা নাড়িয়ে শোয়েব রহমান বললেন

—-এসেছিলাম এক সপ্তাহের সময় নিয়ে ভাইজান। কিন্তু হুট করেই একটা প্রয়োজনে যেতে হচ্ছে আবার। আমার যেতে হবে এখন। তবে কিছুদিন বাদে আবার আসবো। যেহেতু সময়ের আগেই চলে যাচ্ছি।

—-আসলেই ভালো। আপনার তো দেখা পাওয়াই মুশকিল। আপনার সাথে তো সময় কাটানোর সুযোগও পাওয়া দুষ্কর। অবশ্য আপনার পরিবার যেটা পায় না, সেটা তো আমার আশা করা বোকামি!

—-এভাবে বলবেন না ভাইজান। আপনারাও আমাদের পরিবারের মতোই। আপনার ভাইজান এখানে থাকে না ঠিক আছে। কিন্তু আপনাদের এখানে আমি সবসময় আমার পাশে পাই। সাদমান আপনার ভাইজানের অবর্তমানে কতো দায়িত্ব যে পালন করে সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। আপনাদের উপর, সাদমানের উপর ভরসা করেই তো আমি আমার মেয়ে দু’টোকে নিয়ে একা থাকার সাহস পাই।

রেণু আক্তারের কথায় স্মিত হাসলেন পারভীন সুলতানা আর আতিক হাসান। তার সাথে সুর মেলালেন শোয়েব রহমানও।

—-হ্যাঁ, আমাকে রেণু বলেছে এই ব্যাপারে। ইশুকে কয়েকদিন আগে নাকী পাওনা যাচ্ছিলো না, ফোন বন্ধ ছিলো। রাত হয়ে গিয়েছিলো বেশ। তখন নাকী সাদমানই তাকে কোন বান্ধবীর বাসা থেকে খুঁজে নিয়ে এসেছে।

শোয়েব রহমানের কথায় সাদমান, মিশরাত আর ইশরাত একে অপরের দিকে তাকালো। কারণ প্রকৃতপক্ষে সেদিন সাদমান নয়, বরং আরিয়ান খুঁজে বের করেছিলো ইশরাতকে। সাদমান তো চলে গিয়েছিলো কামরুলের বাসায়। তবে সেদিন রাতে বাসায় ফিরে আরিয়ানের কথা রেণু আক্তারকে জানায়নি কেউ। যা হয়েছে সব নিজেদের মধ্যে রেখেছে এই তিনজন।

একথা ওকথার মধ্যে হুট করে পারভীন সুলতানা একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলেন

—-আচ্ছা ভাইজান, আপা এবং মেয়ে দু’টোকে নিয়ে চলুন না একসাথে কোথাও ঘুরতে যাই না হয় আমরা? এমনিতে তো আর একসাথে কোথাও যাওয়ার ফুরসত পাই না। চলুন ছেলে মেয়েদের নিয়ে বের হওয়া যাক আজ বিকেলে।

সকলে এই প্রস্তাবে বেশ খুশি হলেও কেন জানি খুশি দেখাচ্ছিলো না ইশরাতকে। তবে তখন সে বললো না এর কারণ। বেশ অনেকটা সময় পর নানান কথার মধ্যে দিয়ে শেষ হলো তাদের আলাপ-আলোচনা।

(৫১)

দুপুরে খেয়েদেয়ে ছাদে এসেছেন শোয়েব রহমান। দাঁড়িয়ে আছেন বোধহয় কারোর অপেক্ষায়।

—-আংকেল?

মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে হাসি দিলেন শোয়েব রহমান। ছেলেটা তার বরাবরই খুব প্রিয়।

—-আসো আব্বু। তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। বলো কী প্রয়োজনীয় কথা বলবে?

—-আংকেল, আমার মনে হয় কথাটা সবাইকে জানানোর সময় এসে গিয়েছে। সবাই বলতে আম্মু, আব্বু আর আন্টির কথা বলছিলাম।

—-হঠাৎ তোমার এরকম মনে হওয়ার কারণ?

—-আম্মু বেশ কয়েকদিন যাবত সরাসরি কিংবা ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে বিয়ের প্রসঙ্গ তুলছে আমার। যদিও আমি বরাবরই বলে আসছি এখনো সময় হয়নি। কিন্তু আম্মুর কথা হলো ঊনত্রিশ বছর চলছে। এখন মেয়ে দেখা উচিত। আম্মু হয়তো মেয়ে খোঁজা শুরুও করে দিয়েছে।

—-কিন্তু এই সময় তো বিয়েটা ঠিক হবে না আমার মেয়ের জন্য বাবা।

—-আমি এখনের কথাই বলছি না আংকেল। এতোদিন পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে আছি আমি। আর কয়েকটা দিন ধৈর্য্য ধরতে আমার কোনো সমস্যা নেই। বিয়ের কথা এখনই তুলছি না আমি। ইনফ্যাক্ট, আমি চাই না নিজের জন্য একটা ফিউচার সিকিউর না করে আপনার মেয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসুক। কিন্তু আম্মুকে এই বিষয়টা জানিয়ে রাখলে এই মেয়ে দেখাদেখির তাগদা অন্ততপক্ষে বন্ধ করবে আশা করি।

—-তুমি ঠিক কতোটুকু পড়াশোনা শেষ করার কথা বলছো? এডমিশন টেষ্ট পর্যন্ত? নাকী মেডিক্যাল বা ভার্সিটির পড়াশোনা চুকানো পর্যন্ত? যদি একেবারে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করা পর্যন্ত বলো তাহলে তো তোমার বয়স অনেকটা বেশিই হয়ে যাবে।

—–না আংকেল, গ্র্যাজুয়েশনের কথা বলছিও না। এডমিশন টেষ্টের কথাই বলছি।

—-কিন্তু, মিশু?

—-সেটা আমিও ভাবছি। আসলে আপনার মেয়ের সাথে আমার বয়সের ব্যবধানটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে যার দরুন মিশরাতকে নিয়ে চিন্তা করতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে।

—-তোমার পরিচিত কেউ আছে যে আমাদের মিশুর উপযুক্ত হবে?

—-সেরকম ভাবে তো আসলে ভেবে দেখেনি। তবে আপনি যেহেতু বললেন তাই কথাটা মাথায় রাখবো।

—-একটু দেখো আব্বু। জানোই তো আমার মেয়েটার অতীত। সেই অতীতের তিক্ততার কারণে সে আর কখনো কোনো ছেলেকে তার আশেপাশে ঘেঁষতে দেয়নি। সেটা আমিও জানি। তবুও তাকে বলেছিলাম নিজস্ব পছন্দ থাকলে বলতে। মাঝেমধ্যে কেন জানি মনে হয় মেয়েটা এখনো অতীতেই আঁটকে আছে। আরিয়ানেই বোধহয় আঁটকে আছে। উপর থেকে নিজেকে শক্ত দেখালেও সে এখনো ভেতরে ভেতরে দূর্বল। নয়তো এতোগুলো বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরেও কেন সে আর কোনো ছেলের কথা ভাবেনি বলতে পারো? কেন জানি মনে হয় এখনো সেই জায়গায় আরিয়ানই আছে।

—-থাকা তো উচিত না আংকেল। ওইরকম থার্ডক্লাস ছেলের জন্য…

—-থার্ডক্লাস বলো না আব্বু। আরিয়ানকে তুমি দেখোনি। আমি দেখেছি। তুমি আমার যতোটা প্রিয়, একটা সময় আরিয়ান আমার ঠিক ততোটাই প্রিয় ছিলো। ঠিক তোমার মতো করেই আমার পরিবারকে সে আগলে রাখতো। আমি তাদের অফিসে একজন সাধারণ কর্মচারী ছিলাম কেবল। কিন্তু আরিয়ান আমাকে তার আব্বুর সমান সম্মান করতো। অথচ এতোটা সম্মান আমার আসলেই প্রাপ্য ছিলো কীনা নিজেও জানি না। এমনকি পুরো এলাকায় হক পরিবারের সাথে সবচেয়ে বেশি সখ্যতা ছিলো আমার পরিবারেরই। এটা সেই এলাকায় অনেকের ঈর্ষার কারণ ছিলো। কিন্তু সেসব নিয়ে হক পরিবারের কেউ মাথা ঘামাতো না। আরিয়ানের আব্বু রাজনীতি করতো। এখন করে কীনা জানি না। তবে তাদের ক্ষমতা ছিলো অনেক। বাবার ব্যবসা এবং ক্ষমতা তো আরিয়ান এমনিতেই পেয়ে গিয়েছিলো। তার উপর নিজের প্রচেষ্টায় তার উন্নতি ক্রমশ হয়েই যাচ্ছিলো সকল ক্ষেত্রে। তার অমায়িক ব্যবহার, তার চতুরতা, তার দূরদর্শিতা, তার বাহ্যিক সৌন্দর্য সবকিছু মিলিয়ে আরিয়ানকে দেখলেই মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে আসতো “মাশা-আল্লাহ”। আর মিশুর কথা কীই বা বলবো। মিশুকে ছাড়া তো মনে হতো আরিয়ানের পরিবারের কোনো অনুষ্ঠানই পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। এতোটা প্রিয় ছিলো সে হক পরিবারের মানুষদের। কিন্তু হঠাৎই যে কী থেকে কী হয়ে গেলো!

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নিচু করলেন শোয়েব রহমান।

—-কিন্তু আরিয়ান তো আপনাকে সকলের সামনে অপমান করেছিল পরে?

—-অপমান করেছিলো৷ কিন্তু সকলের সামনে না। সকলের সামনে সে মিশুকে অপমান করেছিলো। জঘন্যভাবে। আমার মেয়েটার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলো। কিন্তু কেন করলো, কী থেকে এরকম প্রশ্ন তার মনে এসেছিলো আমি জানি না। একটা কথা কী জানো সাদমান? আমি শুধু নিজের অপমানের জন্য হলে হয়তো আরিয়ানাকে কখনো ক্ষমা করে দিতে পারতাম। কিন্তু নিজের মেয়ের অপমান বাবা হয়ে আমি কোনোদিনও ভুলতে পারবো না। আমার মেয়েটা সেদিন আমায় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলো। সে কান্না সহ্য করতে না পেরেই আমি বিচার চাইতে গিয়েছিলাম আরিয়ানের কাছে। আর তখনই আমাকেও অপমানিত হয়ে ফিরতে হয়েছিলো।

চশমা খুলে বাম হাতের মধ্যমা এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চোখ মুছলেন শোয়েব রহমান। সাদমান এখনো তাকিয়ে আছে শোয়েব রহমানের দিকে।

—-জানো তো সাদমান, যাকে বা যাদের আমরা খুব বেশি বিশ্বাস করি, তার বা তাদের থেকে যদি সামান্য একটু কটু কথা কিংবা সম্মানহানি হয় এমন কোনো মন্তব্য শুনি, তাহলে সেটা মনে খুব বেশি দাগ কাটে। মানুষ যে হুট করেই কীভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়, চেনা মানুষও অচেনা হয়ে যায়, তা আরিয়ানকে দেখে বুঝেছি আমি। ছেলেটাকে মন থেকেই অনেক পছন্দ করতাম, দোয়া করতাম। জানো? কিন্তু নিজের মেয়ের অপমান যখনই চোখের সামনে ভেসে উঠে, তখনই সবকিছু উলোটপালোট হয়ে যায়।

—-যার সাথে ছেলেটা অপরাধ করেছিলো, যদি সে স্বয়ং ছেলেটাকে ক্ষমা করে দেয়, তাহলে কী আপনি ছেলেটাকে মেনে নিবেন?

চকিতে ফিরে তাকালেন শোয়েব রহমান।

—-মিশুর কথা বলছো?

—-হুম, যদি কখনো আরিয়ানকে মেনে নেয়?

—-আমার মনে হয় না সে কখনো এমনটা করবে। হয়তো সে আরিয়ানকে এখনো পুরোপুরি ভুলতে পারেনি। কিন্তু তার মানে এটাও নয় যে সে আরিয়ানকে ভালোবাসে। মানুষ নিজের প্রথম প্রেম কখনোই ভুলতে পারে না। আমার মেয়েটাও সেটা পারেনি। আর কিছু না।

—-কিন্তু আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর তো এখনো দিলেন না।

নিচের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শোয়েব রহমান।

—-জানি না সাদমান। এমনটা ভেবে দেখিনি। তবে সেরকম পরিস্থিতিতে আশা করি আমার পড়তে হবে না। সেরকম পরিস্থিতি আমার জীবনে না আসুক।

(৫২)

—-আপু, আমি যাবো না মানে যাবোই না।

—-আব্বুর সাথে কতোদিন ধরে আমাদের কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না। এই একটা সুযোগ আসলো, আর তুই বলছিস যাবি না? ঘন্টা দু’য়েকের ব্যাপার তো ইশু। চলে আসবো তো আমরা খুব তাড়াতাড়ি।

—-আব্বুর সাথে যেতে আমার কোনো সমস্যা নেই আপু। আমি তো একপায়ে খাঁড়া। কিন্তু সেখানে তো শুধু আব্বু একা যাচ্ছে না।

—-আংকেল আন্টি তোকে এতো ভালোবাসে। তোর তাদের সাথে ঘুরতে যেতেও সমস্যা?

—-আমি কী বলেছি সেটা? আংকেল আন্টির সাথেও কোনো সমস্যা নেই।

—-তাহলে যাবি না কেন?

—-এতোক্ষণ যাদের কথা বললি, তারা ছাড়া আর কে বাদ আছে একটু চিন্তা কর, তাহলেই বুঝে যাবি।

—-সাদমান? সাদমানের জন্য তুই যাবি না?

—-হ্যাঁ।

—-সাদমান সাদমানের মতো থাকবে, তুই তোর মতো থাকবি। তাছাড়া আমরা সবাই সেখানে থাকছি। এমনভাবে বলছিস যেন সাদমান আর তোকে আমরা ডেটিং এ যেতে বলছি?

—-আপু!

—-কীসের আপু? তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বের হবো।

—-তোর ওই বন্ধু আমাকে যাচ্ছে তাই বলে, যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে অপমান করে জানিস তুই?

—-সাদমানের কাছ থেকে তোর নামে অভিযোগ শুনি, আর তোর থেকে সাদমানের নামে। শোন, তোরা টম এন্ড জেরির মতো লেগে আছিস, লেগে থাক। কিন্তু তাই বলে ফ্যামিলি হ্যাং আউট করবি না? এটা কোনো কথা? আর বললামই তো আমরা সবাই সেখানে থাকবো। সবার সামনে নিশ্চয়ই সাদমান তোকে কিছু বলবে না? আশা করি তুইও বলবি না। ব্যস! সমস্যা সমাধান। এবার তাড়াতাড়ি বই বন্ধ করে টেবিল থেকে উঠে গিয়ে ড্রেস পরে রেডি হ। আমি গেলাম।

মিশরাতের চলে যাওয়ার দিকে মুখ বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছে ইশরাত। এই প্রথমবারের মতো তার বোনের উপর খুব রাগ হচ্ছে। ঠাস করে বই বন্ধ করে চলে গেল রেডি হতে। অন্যদিকে মিশরাত কেবল রেণু আক্তারের রুমে যেতে নিচ্ছিলো, তখনই তার ফোন থেকে মেসেজের টোন শোনা যায়। হাতে থাকা মোবাইলের লক খুলে মিশরাত দেখে তাতে লেখা আছে

“শুনলাম শোয়েব আংকেল নাকী এসেছে? ভালোই হলো। এখন তাহলে শ্বশুর শ্বাশুড়ি সবাই একসাথে আছে। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আজকে, ইনফ্যাক্ট এখুনি চলে আসছি, কী বলো?”

আরিয়ানের ম্যাসেজ দেখে রাগ হলো মিশরাতের। তবে সেদিকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেল রেণু আক্তারের রুমে। সেখান থেকে পারফিউম নিয়ে এসে কেবল নিজের রুমে ঢুকতে যাবে, এর মধ্যে আসলো আরেকটি ম্যাসেজ।

“আমি মজা করছি না মিশু। সিরিয়াসলি বলছি। আমি কিছু বলছি না বা করছি না বলে এই নয় যে কিছু করবোও না। তুমি আমাকে তোমার পেছনে ঘোরাচ্ছো আর আমিও বেহায়ার মতো ঘুরছি। সেসব আমি মেনেও নিয়েছি। বউয়ের জন্য বেহায়া হবো না তো আর কার জন্য হবো? কিন্তু সহ্যেরও একটা সীমা থাকে মিশু, তাই না? এবার যদি তুমি সত্যিই আমার ফোন না ধরো, তবে আমি সরাসরি তোমার বাসায় চলে আসবো। বলে রাখা ভালো, তোমার বাসা আমি চিনে গিয়েছি। ইনফ্যাক্ট, তুমি বাসা এবং অফিস ছাড়াও কখন কোথায় যাও, সেটাও আমার জানা। তাই বুঝতেই পারছো, তুমি যেখানেই থাকো না কেন, আমার তোমার কাছে পৌঁছাতে বেগ পেতে হবে না। আমার তোমার সাথে কথা আছে মিশু, ফোনটা ধরো প্লিজ।”

সাথে সাথেই ফোন আসলো আরিয়ানের নাম্বার থেকে। মুখে বিরক্তি ছাপিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে কল রিসিভ মিশরাত। ফোন কানে লাগিয়ে কিছুই বললো না।

—-অবশেষে তুমি ফোন ধরলে মিশু। যাক!

—-

—-মিশু, শুনতে পাচ্ছো আমার কথা?

—-আমি বয়রা না। যা বলার দ্রুত বলে শেষ করুন। আমার তাড়া আছে। বের হতে হবে এক জায়গায়।

—-আগে আমার সাথে দেখা করো, তারপর যেখানে যাওয়ার যেও।

—-সেটা কখনোই হচ্ছে না। আমি আপনার কথায় বিশ্বাস করে গিয়েছিলাম তো একদিন। যথেষ্ট হয়েছে। আপনি ফোন ধরতে বলেছিলেন, ধরেছি। আশা করি আর কিছু বলার নেই। আর আপনি বললেও আমি শুনছি না।

—-কিছুই তো বলতে দিলে না। আজকে বিকেলে দেখা করো না প্লিজ!

—-আপনি এই শহরে আসার ঠিক দু’দিন পরেই সাদমান আমাকে বলেছিলো আপনার নামে থানায় কেস করতে। আমার তখনই করা দরকার ছিলো। সমস্যা নেই, তখন করিনি তো কী হয়েছে, আজই করবো।

—-তাই? বেশ, বেশ। করো তবে। কিন্তু যার বিরুদ্ধে কেস করতে যাবে, তার নাম শোনার পর পুলিশের চেহারার নকশা কী হয় সেটা অবশ্যই বলবে কিন্তু!

—-ক্ষমতার গরম দেখাচ্ছেন? ক্ষমতা আছে বলে যাচ্ছে তাই করবেন?

—-মিথ্যে অপবাদ দিও না মিশু। আমি ক্ষমতা প্রয়োগ করে কিছুই করিনি তোমার সাথে। আর করতেও চাই না। আমি যা চাই সেটা হলো তোমার সাথে একটু কথা বলতে। সেটার সুযোগ দিলেই চলবে আমাকে। প্লিজ, একটাবার দেখা করো?

—-কথা কানে যায় না আপনার? না করেছি না আমি?

—-বেশ! তুমি আমার সাথে দেখা করতে আসবে না তো কী হয়েছে? আমি তোমার সাথে দেখা করতে যেতেই পারি! আসছি আমি, কেমন? পরে কিন্তু দোষারোপ করতে পারবে না আমাকে যে কিছু না বলে চলে এসেছি।

ভীষণ বিপদে পড়েছে মিশরাত। এখন যদি আরিয়ান তার বাসায় চলে আসে তাহলে ব্যাপারটা আরও ঘেঁটে যাবে। সে চায় না তার আব্বু আম্মু আরিয়ানকে আর কখনো দেখুক। তাই বাধ্য হয়ে এখন তাকে রাজি হতেই হবে। তবে মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে।

(৫৩)

দমকা হাওয়া বইছে চারিপাশে। মিশরাতের খোলা চুলগুলো উড়ছে প্রবলভাবে। আরিয়ানের বরাবর না দাঁড়িয়ে মুখ উল্টোদিকে রেখে দাঁড়িয়ে আছে মিশরাত। মিশরাতের চোখে রাগ ছাড়া কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না। অপরদিকে আরিয়ানের চোখে অসহায়ত্ব। একটু আগে মিশরাতের জন্য সযত্নে আনা ফুলগুলো মিশরাতের হাতে দেওয়ার সাথে সাথে সেগুলো হাতে নিয়ে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে দিয়েছে মিশরাত।

—-অপর পাশে ফিরে তাকিয়ে থাকলে আমি কথা কী করে বলবো মিশরাত? ফুলগুলো পিষে ফেলেছো ভালো কথা, তাই বলে আমার দিকে তাকাতেও সমস্যা?

—-ন্যাকামো কম করে মূল কথা বলুন। আপনার সাথে দেখা করার জন্য আমাকে সকলের সাথে মিথ্যে বলে আসতে হয়েছে। আপনি দেখা করতে বলেছেন, আমি করেছি। এবার শুধু কথাবার্তাই চলবে। আপনার ন্যাকামো দেখলে আমার গায়ে অসহ্য জ্বালা ধরে। তাই সেসব না করলেই আমি খুশি হবো।

—-তুমি কী জানো কথা বলার সময় অপর পক্ষের মানুষের চোখের দিকে তাকালে তুমি তার ভেতর থাকা সত্যিকার আবেগটা অনেকটা বুঝতে পারবে? আমার চোখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো মিশু? আমার দিকে ফিরে আমার কথাগুলো একটু শোনো?

—-আমি কোনো অহংকারীর চোখের দিকে তাকাই না। আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা কোনো ব্যক্তির চোখের দিকে তাকাতে আমার রুচিতে বাঁধে। শুনেছেন? বুঝতে পেরেছেন? আর শুনুন, আমি এখানে অফুরন্ত সময় নিয়ে আসিনি। এটা সেটা বলে কাটিয়ে এসেছি কিছুক্ষণের জন্য। তাই যা বলার দ্রুত বলুন। আমার হাতে সময় নেই। আমার পরিবার অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

—-মিশু, বিশ্বাস করো, আমি সত্যি বলছি। শোয়েব আংকেল আমাদের সাথে কখনো বেঈমানী করতে পারে না সেটা আমরা সবাই জানতাম। আমি স্বপ্নেও কখনো ভাবতে পারিনি যে আব্বু এভাবে আংকেলকে ভুল বুঝবে। বিশ্বাস করো, আব্বু নিজের থেকে এসব কিছু বলেনি। আব্বুকে ভুলভাল বোঝানো হয়েছিলো মিশু। আমি জানিও না কখন আব্বু আংকেলকে বেঈমানী করার জন্য দোষারোপ করেছে। আমি বলতেও পারবো না কখন কী হয়েছে। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করো একটাবার আমার কথা? আব্বুর ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছিলো। তখন তৃতীয় পক্ষ এতো এতো জাল প্রমাণ দেখাচ্ছিলো যে আব্বু দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলো। আব্বু খুব লজ্জিত মিশু। আংকেলের সম্মুখীন হওয়ার মুখ পর্যন্ত তার নেই। আংকেলের কাছে আমি নিজে ক্ষমা চাইবো মিশু। কিন্তু তার আগে তোমার সাথে আমার অতীত পরিষ্কার করা খুব প্রয়োজন।

—-আমার আব্বু কতোটা বছর আপনাদের হয়ে কাজ করেছিলো। তার মূল্য আপনারা অন্য কারোর কথার উপর ভিত্তি করে দিলেন?

—-আপনারা বোলো না মিশু। আমি তখন ছিলাম না সেখানে। আব্বুকে হ্যানত্যান কী বলে কী বুঝিয়েছে সেটা আমি জানতামও না। আমি থাকলে সেটা কখনোই হতে দিতাম না।

—-মানলাম সেখানে আপনি না হয় ছিলেন না। কিন্তু আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলার সময়? সেটা তো আপনার আব্বু করেনি? সেই কথা তো আপনি স্বয়ং নিজের মুখে বলেছিলেন। একজন পিতা তার সন্তানকে এতো কষ্ট করে বড় করে তোলে কী সেই সন্তানের কারণে অপমানিত হওয়ার জন্য? তাহলে তো আমি বলবো সেই সন্তানের মরে যাওয়া উচিত। আমার যে আব্বু বরাবরই আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করতো, সেই আব্বুরই আপনার কাছ থেকে আমার চারিত্রিক সার্টিফিকেট পেতে হলো। আমি নাকী যার তার সাথে…

পুরো কথা শেষ করতে পারেনি মিশরাত। তার আগেই কথা গলায় আঁটকে গেল তার। বুকটা চিনচিন করে ব্যথা করছে। শরীর গরম হয়ে আসছে। চোখে দেখা দিয়েছে অশ্রুকণা।

কাঁদছে আরিয়ানও। ঠিক এই জায়গায় এসে তার কিছু বলার মুখ থাকে না। নিজের করা ব্যবহারের জন্য নিজেই মুখ লুকানোর জায়গা পায় না সে।

—-ভুল করেছিলাম তো মিশু। বড্ড ভুল করেছিলাম। তার জন্য যেকোনো শাস্তি পেতেও আমি রাজি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি এমনি এমনি এসব কথা বলিনি। শুধু তুমি আমাকে ভালোবাসো বলেছিলে তার জন্য এমনটা করিনি বিশ্বাস করো। আমাকে…

—-হ্যাঁ, এখন বলবেন আপনাকেও ভুল বোঝানো হয়েছে। মানে মগের মুল্লুক নাকী হ্যাঁ? আপনারা সবাই ছোট শিশু? আপনাদের যে কেউ এসে ভুল বুঝিয়ে যাবে আর আপনারাও সেটা বুঝে যাবেন? নিজেদের বিবেক নেই আপনাদের? নিজেদের চিন্তা শক্তি নেই? আপনারা না হক পরিবারের মানুষ? আপনি আর আপনার আব্বু না রাজনীতির লোক? এই মাথা নিয়ে রাজনীতি করেন আপনারা? আমাকে দেখে কী আপনার নির্বোধ মনে হয়? যা বোঝাবেন তাই বুঝবো? এসব এক্সকিউজ ছাড়া কিছুই না। এই আপনার অতীতের ভুল বোঝাবুঝি পরিষ্কার করার নমুনা? তাহলে বলবো থাক ভাই, আপনার কিংবা আপনাদের ভুল বোঝাবুঝি পরিষ্কার করার কোনো দরকার নেই। আমরা ভুল বুঝেই শান্তিতে আছি।

—-আমার কথা শেষ হয়নি তো মিশরাত। আব্বুর দিকটা আমি বলেছি। আমার কথাটা পরিষ্কার করিনি তো এখনো। আমি তো আমার বোনকে….

—-ওহ, এখন নুজহাত আপুকেও ছাড়লেন না? এটাই বাকী ছিলো আসলে। সেদিন আন্টির কথা বলে মিথ্যে কসম কেটে আমাকে দেখা করতে বললেন এবং আপনার প্রাক্তন কিংবা সম্ভবত বর্তমান প্রেমিকার সাথে আপনার রঙঢঙ দেখলাম। এরপর টেনে আনলেন আংকেল মানে আপনার আব্বুকে। আর এখন নুজহাত আপু? নিজের দোষ ঢাকতে আর কতোজনকে টানবেন মিস্টার হক? এবার তো মিথ্যাচারীতা বন্ধ করুন?

—-মিশু আমি…

—-ব্যস! ইনাফ ইজ ইনাফ! আপনি আমাকে খুব ভালোবাসেন তাই না?

মুখে হাসি ফুটিয়ে উপর নিচ মাথা নাড়লো আরিয়ান।

—-বেশ! তাহলে দেখি আপনার ভালোবাসার নমুনা। যদি আসলেই আপনি আমাকে ভালোবেসে থাকেন, তাহলে কোনোদিনও আপনার এই মুখটা আমাকে দেখাবেন না। আমার সামনে ততোক্ষণ পর্যন্ত আসবেন না যতক্ষণ না আমি নিজে আপনার সামনে যাই কিংবা আপনাকে আসতে বলি। কসম রইলো আমার!

থমকে গেল আরিয়ান। হুট করেই তার মনে হলো চারিদিকে শূণ্যতা বিরাজমান। দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো

—-মিশু!

—-হ্যাঁ, মিশু। আমি মিশরাত বিনতে শোয়েব আজ আপনাকে এই কথাটা বলে গেলাম। এবার দেখি, আসলেই আপনার ভালোবাসার জোর কতোটুকু?

আকাশের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। মিশরাত ফোন হাতে নিয়ে শোয়েব রহমানকে কল দিতে দিতে দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছে সামনে। বৃষ্টি নামবে এখুনি, তার যাওয়া উচিত এখন। সে চলেও যাচ্ছে। এতোক্ষণ আশেপাশে থাকা মোটামুটি সবাই চলে যাচ্ছে নিজ নিজ গন্তব্যে সম্ভাব্য বৃষ্টির কারণে। শুধু একজোড়া পা-ই সেখানে এখনো দাঁড়ানো। আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ার আগেই যার চোখ থেকে পড়ছে অশ্রুধারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। ক্লান্ত পথিকের মতো দাঁড়ানো থেকে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো আরিয়ান। মিশরাতের কথার অর্থ সে বুঝতে পেরে গিয়েছে। আরিয়ানকে শর্ত দিয়েছে যতোক্ষণ না পর্যন্ত মিশরাত নিজে তার সাথে দেখা করে বা করতে বলে ততোক্ষণ যাতে আরিয়ান নিজে দেখা না করে। আর আরিয়ান খুব ভালো করেই জানে যে মিশরাত নিজে থেকে এমনটা কখনোই করবে না। তবে কী এটাই মিশরাতের সাথে তার শেষ দেখা ছিলো? গগনবিদারী এক চিৎকার দিয়ে উঠলো আরিয়ান। অথচ আফসোস, সে চিৎকার শোনার মতোও আশেপাশে কেউ নেই। কোথাও নেই…

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here